টান টান উত্তেজনার জোয়ার
উনিশ শতকের মাঝামাঝি এডগার অ্যালান পোর গোয়েন্দাকাহিনিতে যেমন সে সময়কার ইউরোপের সমাজ বাস্তবতা উঠে এসেছে; তেমনি বাংলার ব্যোমকেশ বক্সী, কিরীটি রায়, ফেলুদা বা মাসুদ রানার গল্পেও সমসাময়িক ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা উঠে এসেছে। অন্য উপন্যাসের মতো গোয়েন্দাকাহিনিও আদতে সংশ্লিষ্ট দেশ-কাল ও ইতিহাসের সাক্ষী। এটি ছাড়া পাঠক ওই গল্পের ধারাবিবরণীতে নিজেকে খুঁজে পায় না। কার্যত এর মধ্য দিয়ে পাঠক গল্পের কাহিনি ও চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজের একটা সংযোগ স্থাপন করে। ফলে পাঠকের সামনে একটা অঞ্চল ও কালের ছবি মূর্ত হয়ে ওঠে।
সংশয়বাদ, নিয়তিবাদ এবং নৈতিক অস্পষ্টতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা উপন্যাসের এক ধারা—নোয়ার (Noir)। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত বেস্টসেলার এলভিস ও জো পাইক গোয়েন্দা সিরিজের প্রথম বই দ্য মাংকিজ রেইনকোট এ ধারার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উপন্যাসটি ১৯৮৮ সালে ‘সেরা পেপারব্যাক মৌলিক রচনা’ হিসেবে অ্যান্থনি পুরস্কার পায়। আরও অর্জন করে ম্যাকাভিটি পুরস্কার। সেরা উপন্যাস হিসেবে এডগার ও শামুস পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। গোয়েন্দা লেখক রবার্ট ক্রেইসের এলভিস ও জো পাইক সিরিজটি শুরু থেকেই দারুণ সাফল্য পেয়েছে। সিরিজের পরবর্তী বইগুলোও অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে এবং পুরস্কারও জয় করেছে। ‘এলভিস ও জো পাইক’ সিরিজের ১৯তম বইটি প্রকাশিত হয়েছে এ বছর—রেসিং দ্য লাইট।
রবার্ট ক্রেইসের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে ১৯৫৩ সালের ২০ জুন। হিল স্ট্রিট ব্লুজ, ক্যাগনি অ্যান্ড লেসি, কুইন্সি, মিয়ামি ভাইসের মতো বিখ্যাত টিভি সিরিজের চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। তবে সাহিত্যে বরেণ্য হয়েছেন থ্রিলার উপন্যাসের জন্য। গোয়েন্দাকাহিনির জন্য ২০০৬ সালে রস ম্যাকডোনাল্ড সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৪ সালে মিস্ট্রি রাইটার্স অব আমেরিকা তাঁকে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ বলে ঘোষণা করে।
রেমন্ড চ্যান্ডলার, ড্যাশেল হামেট, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, রবার্ট পার্কার এবং জন স্টেইনবেকের প্রভাব আছে রবার্ট ক্রেইসের লেখায়। তাঁর বই ৬২টি দেশে প্রকাশিত হয়েছে। এলভিস ও জো পাইক গোয়েন্দা সিরিজ ছাড়াও ক্রেইসের উল্লেখযোগ্য রহস্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে—হোস্টেজ, এল. এ. রেকুইম, ডিমোলিশন অ্যাঞ্জেল।
ক্রেইসের লেখনী সম্পর্কে প্রয়াত মার্কিন লেখক হারলান এলিসন বলেন, ‘আপনাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের দেয়ালের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় দুনিয়ায় শেষ মুহূর্তটি উপভোগ করতে চাইলে শেষ সিগারেটটা অন্য কাউকে দিয়ে এলভিস কোলের উপন্যাস আনতে বলুন।’ এডগার পুরস্কার জয়ী প্রয়াত মার্কিন লেখক টনি হিলারম্যান বলেন, ‘ক্রেইসের হাত ধরে প্রাইভেট ডিটেক্টিভদের দুনিয়ায় এক নতুন নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটেছে। দুর্দান্ত গতির উপন্যাস।’
দুই
দ্য মাংকি’জ রেইনকোট রোমাঞ্চোপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে সমাজে সংঘটিত নানান অপরাধ ঘিরে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র এলভিস কোল। জন্মের পর তার নাম ছিল ফিলিপ। মা রাজা ফিলিপকে দেখতে গিয়েছিলেন। আর রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ছেলের নাম পরিবর্তন করে এলভিস রাখেন। এলভিস কোল লস অ্যাঞ্জেলেসের পোড় খাওয়া প্রাইভেট ডিটেক্টিভ। ভিয়েতনাম যুদ্ধফেরত যোদ্ধা। এলভিস যোগব্যায়াম ও মার্শাল আর্ট জানেন। ডিজনির বিভিন্ন স্মারকচিহ্ন দিয়ে তার বাড়ি ভরা। এখানেই শেষ নয়—তার একটা হুলো বেড়াল আছে, যে তার সাথে বিয়ারও খায়।
এলভিসের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন সঙ্গী জো পাইক, যিনি কখনো হাসেন না এবং ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। এলভিস ও জো বহু কঠিন চেহারার ভিলেনের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
রবার্ট ক্রেইসের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে ১৯৫৩ সালের ২০ জুন। হিল স্ট্রিট ব্লুজ, ক্যাগনি অ্যান্ড লেসি, কুইন্সি, মিয়ামি ভাইসের মতো বিখ্যাত টিভি সিরিজের চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। তবে সাহিত্যে বরেণ্য হয়েছেন থ্রিলার উপন্যাসের জন্য। গোয়েন্দাকাহিনির জন্য ২০০৬ সালে রস ম্যাকডোনাল্ড সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৪ সালে মিস্ট্রি রাইটার্স অব আমেরিকা তাঁকে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ বলে ঘোষণা করে
দ্য মাংকি’জ রেইনকোট উপন্যাসের কাহিনি এগিয়েছে অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যেখানে চলে আসে মাদক ও মাফিয়া। এলেন ল্যাং নামে এক নারী কোলকে নিয়োগ করেন তার স্বামী মর্ট ও নয় বছরের ছেলে পেরিকে খুঁজে বের করতে। মর্ট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একজন এজেন্ট ছিলেন এবং কিছু ছায়াময় চরিত্রের সঙ্গে তার সংযোগ ছিল।
এলভিস কিছুটা অনিচ্ছাকৃতভাবে কেসটি নেয়। কাজে নামতেই দেখা গেল অনেক গভীরে ছড়িয়েছে রহস্যের শিকড়। পুলিশের সহায়তাও পাচ্ছে না তারা, এখানে সহযোগিতার চেয়ে বেশি হস্তক্ষেপ। চারপাশে জিজ্ঞাসা করে এবং আবিষ্কার করে যে মর্টের একজন বান্ধবী রয়েছে। লাপাত্তা হয়ে গেছে মর্টের বান্ধবী কিম্বার্লি মার্শও। সন্দেহজনক কিছু লোক কড়া নজর রাখছে তার অ্যাপার্টমেন্টের দিকে। এদিকে কারা যেন লণ্ডভণ্ড করে রেখে গেছে এলেনের বাড়ি। কিছু একটা খুঁজছে কেউ। তার মানে, এলভিসের সন্দেহ, মামুলি অপহরণের ঘটনা এটা নয়। জোর করে মাদক ব্যবসায়ী সাবেক ম্যাটাডোর দোমিঙ্গো গার্সিয়া দুরানের র্যাঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো এলভিসকে। দুই কেজি হেরোইন চুরি গেছে তার। দোমিঙ্গোর ধারণা, কাজটা মর্টের। তার সাফ কথা, মাদক ফেরত না দিলে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে পেরিকে। ইতিমধ্যে মিলল মর্টের মৃত্যুর খবর। এলভিসের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এবার তুলে নেওয়া হলো এলেন ল্যাঙকেও। দ্রুত অবনতি ঘটছে অবস্থার। খুনখারাবি, মাদক ব্যবসা, প্রতারণা এবং ষড়যন্ত্রের জাল ছড়িয়ে আছে চারদিকে। যেভাবে হোক কোনো অঘটনের আগে এলেন ও তাঁর ছেলেকে উদ্ধার করতে হবে। নতুন একটা সূত্র উন্মোচিত হওয়ার সাথে সাথে উত্তেজনা বাড়তে থাকে, যা একটি ক্লাইমেটিক সমাপ্তির দিকে নিয়ে যায়, যেখানে সব রহস্য উন্মোচিত হয়।
উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র প্রাণবন্ত ও অনন্য, ঠিক যেমনটা বাস্তবে হওয়ার কথা। চরিত্রগুলোর বিকাশ ও ক্রিয়াশীলতার কারণে এ উপন্যাসের কাহিনি নিজস্ব ছন্দে এগিয়েছে।
তিন
সাহিত্যের ধারা হিসেবে অনুবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদিও, অনেকের অভিমত, অনুবাদের মাধ্যমে যেকোনো লেখার মৌলিকত্ব খর্ব হয়। সবচেয়ে সমৃদ্ধ অনুবাদও মূল বইয়ের লেখকের ধরন হুবহু তুলে ধরতে পারে না। এখানে যেমন দুজন পৃথক মানুষের পৃথক সৃজনশীল বাস্তবতা রয়েছে; তেমনি দুটি ভিন্ন ভাষার আবেদনেও পার্থক্য থাকে। তাই অনুবাদে মূল রচনার মৌলিকত্ব খর্ব হয়। আবার ভালো অনুবাদ এক ভিন্ন মৌলিকত্বও সৃষ্টি করে। আর এর মাধ্যমে ঋদ্ধ হয় সাহিত্য। কারণ, এক ভাষার সাহিত্য অন্য ভাষায় নিজের জায়গা করে নিতে পারে অনুবাদের মাধ্যমে। তা উভয় ভাষার সাহিত্যকে বিকাশের সুযোগ দেয়।
দ্য মাংকি’জ রেইনকোট উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন শওকত হোসেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রকাশনা সংস্থা কথাপ্রকাশ থেকে, ২০২২ সালে। অনুবাদ বেশ প্রাঞ্জল। গোয়েন্দা উপন্যাসের ভাষাশৈলীতে যে উত্তেজনা থাকার কথা, ভাষান্তরেও সেটি ভালোই বজায় রয়েছে। ফলে অনূদিত হলেও এটি বাংলা সাহিত্যে রোমাঞ্চোপন্যাসের ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।