কবিতা ও হৃদয়ের প্রশ্নে সিকদার আমিনুল হক!
কবিতার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। বৈধতা প্রমাণের জন্য যারা আমাকে আদা-জল খেয়ে মাঠে নামার পরামর্শ দেবেন, তারা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী কি-না, সে-বিষয়েও আমি নিশ্চিত নই। এই অনিশ্চয়তার বেনোজলে ভেসে যেতে যেতে আমি অনুভব করি, কবিতা ও আমার সম্পর্কের সেতুটা সম্ভবত অবৈধ প্রণয়ের মতোই—দোদুল্যমান কিন্তু দুর্নিবার। এবং সে-কারণেই বোধ করি আমার এই কবিতার কাছাকাছি থাকার আনন্দে কোনো অভ্যাসজাত কিংবা ব্যবহারজনিত জীর্ণতা নেই। তাই সকল বিবাদ ও বিতর্কের বাইরে দাঁড়িয়ে বলা যায়, ‘ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর’। সম্মোহনের এই তীব্রতাকে ‘টান টান উত্তেজনা’ হয়তো বলা যায়, কিন্তু তাতে প্রাণের আকুতি ও টানের তীব্রতা কতটা দৃশ্যমান হবে, সেটা নিরূপণের ভার পাঠকের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। এই কথাগুলোকে নিজের বলে চালিয়ে দিতে পারতাম যদি-না সিকদার আমিনুল হক এই লেখায় অনুপস্থিত থাকতেন।
বাংলা সাহিত্যে বিরলপ্রজ লেখক হিসেবে যাঁদের সুখ্যাতি আছে, সেই তালিকায় সিকদার আমিনুল হকের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর লেখালেখির জগৎ দীর্ঘ-বিস্তৃত-বহুবর্ণিল। এই বর্ণাঢ্যের ভাঁজ খুলে কেউ যদি সাহিত্যের বিচিত্র শাখা-প্রশাখার তত্ত্বতালাশ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি হতাশ হবেন। তাঁর বৈচিত্র্যের প্রায় পুরোটাই কবিতার কাঁধে ভর করে পাঠকের প্রাণের কাছে সমর্পিত হতে চেয়েছে। দূরের কার্নিশ [১৯৭৫], তিন পাপড়ির ফুল [১৯৭৯], পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা [১৯৮২], আমি সেই ইলেকট্রা [১৯৮৫], বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকার [১৯৮৭], পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল [১৯৭৮], এক রাত্রি এক ঋতু [১৯৮১], সতত ডানার মানুষ [১৯৯১], সুপ্রভাত হে বারান্দা [১৯৯৩], কাফকার জামা [১৯৯৪], সুলতা আমার এলসা [১৯৯৪], রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা [১৯৯৫], লোরকাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেলো [১৯৯৭], বিষণ্ণ তাতার [২০০০], ঈষিতার অন্ধকার শুয়ে আছে [২০০২] ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের বাইরে সিকদার আমিনুল হকের গ্রন্থ-বহির্ভূত কবিতার সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো। কাব্যগ্রন্থের নামকরণের মধ্যে কবির অন্তর্গত সত্তার অনেকটাই মুদ্রিত থাকে বলে কেউ কেউ মনে করেন। সিকদারের কাব্যগ্রন্থাবলির নামকরণের দিকে নজর দিলে এই মতে আস্থা রাখতে ইচ্ছে করে।
বিশ শতকের ষাটের দশকের কবিতায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিচিত্র উপাদান উপস্থিত থাকলেও তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতার আলোকে একাধিক গোষ্ঠী বা দলে বিভক্ত হওয়ার খবর আমরা জানি। এই দল বা গোষ্ঠীর সচেতন প্রয়াসকে কেউ কেউ আন্দোলন হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। স্যাড জেনারেশন বা হাংরি জেনারেশনের তৎপরতার কথা এ-প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে। চেতনাগত বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও ভেতরের শূন্যতা বা নিঃসঙ্গতাকে শিল্পরূপ দেওয়ার চেষ্টা এই দুই জেনারেশনের কবিতায়ই বিশেষভাবে মুদ্রিত হয়েছে এবং এই দুটি ধারাই গঙ্গা-যমুনার মতো সিকদার আনিমুল হকের কবিতার সমুদ্রে এসেছে মিলেছে। অনেক তত্ত্বাশ্রয়ী পাঠক তাঁর কবিতায় ফরাসি বৈদগ্ধ্যেরও নানা চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ‘আমাদের লোক’। তাঁর উচ্চারণ বাংলাদেশের হৃদয় হতে উৎসারিত।
দূরের কার্নিশ কাব্যগ্রন্থের ‘একা’ কবিতায় সিকদার আমিনুল হকের ঘোষণা: ‘আহত হৃদয় একা, করপুট ধরে থাকে একা/ শোকার্ত গৃহের কাছে নিরাশ্রয় জটিল লন্ঠন।’ এই একাকিত্ব অনেকটাই নিয়তির মতো, যাকে কিছুতেই এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। তাই অপমানজর্জর আহত হৃদয়ের অবিমৃষ্য বিভ্রান্তিতে প্রণত হয়ে কবি আমাদের পরামর্শ দেন, ‘বুক জলে একা হও, করপুট ধরে আছে ক্ষমা।’ এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে স্মৃতিমগ্ন মানুষের চিত্ত ও চিন্তার বিরাট পরিসর জুড়ে কেবল যন্ত্রণাদগ্ধ দীর্ঘশ্বাসই সংগীতের মতো বাজতে থাকে:
প্রতিশ্রুতি দিতে পারে কুটিল যন্ত্রণা
কালবিনাশী স্মৃতি,
মেঘের মতো সহজলভ্য তোমার প্রবঞ্চনা
স্নিগ্ধ আত্মাহুতি।
[স্মৃতি: দূরের কার্নিশ]
এই আত্মাহুতির অভিজ্ঞান থেকেই কবি এক রহস্যময় মতবাদে নিমজ্জিত হন, যার নাম ‘তাও’। এ এক আশ্চর্য ধূম্রগন্ধময় জীবনবোধ, যা উত্তরাধুনিকতা বিষয়ক অনেক ভাবনার সমান্তরালে প্রসারিত হয়েছে। এই মতবাদ মানুষকে মুক্তির পথ দেখায় না বরং নিমজ্জিত হতে বলে গভীর গহ্বরে, উষ্ণতার বিপরীত বিশ্বে। তাই দুঃসময়ের প্রবল প্রবাহ থেকে নির্গত হয় প্রগাঢ় চিৎকার। এই উপলব্ধি পরস্পরের নিকটবর্তী হওয়ার প্রতিশ্রুতি রচনা করে না, কেবলই দূরত্বের আবহ সঞ্চার করে।
সিকদার আমিনুল হক কবি ও কবিতাবিষয়ক বিস্তর কবিতা লিখেছেন। প্রায় প্রত্যেক কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতায় এই বিষয়ের উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। কবিতাগুলো এ-কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, এ থেকে সিকদারের কবিস্বভাব ও কাব্যদৃষ্টির প্রতিনিধিত্বশীল প্রবণতা অনুধাবন করা যায়। তিন পাপড়ির ফুল কাব্যগ্রন্থের ‘কবিতার দিকে তাকিয়ে কবি’ কবিতাটির প্রথমাংশে মগ্নতা বা ধ্যানস্থ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে ঝরা পাতা, ঝোড়ো দিন, সমুদ্রের কর্কশ সাঁতার, সরীসৃপ, আকাশের গূঢ় অন্ধকার এবং পান্থশালার প্রসঙ্গ আছে। এসবের ভেতর থেকে মুক্তির একটা নির্ভরযোগ্য উপায় অন্বেষণ করেছেন কবি। মুক্তির জন্য খরস্রোতা নদীর কাছে গেছেন, শুশ্রূষার প্রতিশ্রুতি-মুদ্রিত ওষ্ঠের কাছে গেছেন, দিগন্তবিস্তৃত আনন্দধামে বিহার করেছেন। কিন্তু তৃষ্ণাই কেবল বেড়েছে, জলের পরিবর্তে দৃশ্যমান হয়েছে প্রতারক মরীচিকার প্রতিকারহীন দম্ভ।
তিন পাপড়ির ফুল কাব্যগ্রন্থেই সিকদার আমিনুল হকের কয়েকটি জনপ্রিয় কবিতা রয়েছে। ‘সুলতাকে নিয়ে একগুচ্ছ’ একটি সিরিজ কবিতা যার অনেকগুলো অংশ পাঠকের কণ্ঠে নানা প্রসঙ্গে ধ্বনিত হয়। নামকরণের মধ্যে যে প্রেমের সম্ভাবনা মুদ্রিত, কবিতার ভেতরে প্রবেশ করলে তার অনেকটাই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কবিতার শিরোনাম একটি কিন্তু অনেকগুলো উপশিরোনামে বিভাজিত এই কবিতা। ‘সুলতা জানে’ উপশিরোনামে কবি লিখেছেন:
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো,
আকাশে মেঘ- দিঘিতে কেন হাঁস,
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো,
কবিরা কেন নারীর ক্রীতদাস।
সুলতা জানে সুলতা জানে ভালো
প্রেমিক কেন থাকে না চিরকাল
সুলতা জানে সুলতা জানে ভালো
দহনে শ্রুতি নির্মম বহুকাল।
[সুলতাকে নিয়ে একগুচ্ছ : তিন পাপড়ির ফুল]
এই উচ্চারণ অনেকটা মন্ত্রের মতো। বলতে ভালো লাগে, শুনতে ভালো লাগে। এবং স্মৃতির ভেতরে মুদ্রিত রাখতেও আমরা আরাম বোধ করি। বাংলাদেশের সমুদয় নারীর মধ্যেই সুলতার ছায়াপাত লক্ষ করেছেন কবি। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা দিগন্তে তিনি এঁকেছেন সুলতার মুখ। বাস্তবের নারীই কেবল নয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নারীদের মধ্যে খুঁজেছেন সুলতার মুখচ্ছবি। নানা শ্রেণি-পেশার নারীর কথা কবিতাটিতে উল্লেখ করেছেন প্রকারান্তরে যারা সকলেই সুলতার প্রতিনিধি।
তিন পাপড়ির ফুল কাব্যগ্রন্থেই সিকদার আমিনুল হকের কয়েকটি জনপ্রিয় কবিতা রয়েছে। ‘সুলতাকে নিয়ে একগুচ্ছ’ একটি সিরিজ কবিতা যার অনেকগুলো অংশ পাঠকের কণ্ঠে নানা প্রসঙ্গে ধ্বনিত হয়। নামকরণের মধ্যে যে প্রেমের সম্ভাবনা মুদ্রিত, কবিতার ভেতরে প্রবেশ করলে তার অনেকটাই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
সিকদার আমিনুল হক © পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
কবিদের প্রকৃতি-প্রবণতা-গতি-গন্তব্য চিহ্নিত করতে গিয়ে দশকওয়ারি বিভাজনের একটি রীতি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে চালু আছে। কবিদের মধ্যেও এই রীতির সমর্থন করেন এমন অনেকেই আছেন। কিন্তু একটি কবিতায় কবিদের এই বিভাজনকে কটাক্ষ করেছেন সিকদার আমিনুল হক। কোনো রকম কাটা-ছেঁড়া না করে পুরো কবিতাটিই এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক:
পাঁচ বছরের অপেক্ষা
একটি এলিজি
আমি পারবো না।
বিশ বছর পরে আরোগ্যশালার বারান্দায়
একটি গাছ
দশ লাইনের মধ্যে হয়ে গেলো ক্ষোধিত পাথর।
রিল্কে পারতেন তার কোনো ব্যক্তিগত
ঘরানা ছিলো না।
আমাদের আছে
একসঙ্গে, দশক গোষ্ঠী, মহামূর্খ চতুর্দিকে।
[সাম্প্রতিক মুখোশ: তিন পাপড়ির ফুল]
এই কবিতা একটি এলিজিই বটে। কিন্তু তা কেবল সিকদার আমিনুল হকের নয়। বাংলাদেশের যেকোনো কবিরই তা হতে পারে। এই কাব্যেরই ‘নিজ মেরুতে দাঁড়িয়ে’ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘চেনা প্রতীক এক দশকের ঢলে/ কোথায় চলে যায়-।’ তাই এভাবে কালোত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব নয়, তাই কবি আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘খুঁজতে হবে-/কিন্তু এইভাবে তো নয়।’
সিকদার আমিনুল হক কাব্যগ্রন্থের নাম রাখেন পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা—যেখানে গ্রন্থের নামের শরীরেই একটি স্বাস্থ্যসম্মত কবিতার কাছে প্রত্যাশিত সমৃদ্ধি ও সম্মোহন মুদ্রিত হয়ে যায়। বইয়ের ‘এই মৃত্যু এই স্বাধীনতা’ কবিতায় পিতা-পুত্রের সম্পর্কের বিচিত্র দিক ধরা পড়েছে। বাংলা কবিতায় মায়ের মুখ যেভাবে মুদ্রিত হতে দেখি, সেই তুলনায় পিতা অনেকটাই অনুপস্থিত বলা যায়। কিন্তু সিকদারের কবিতায় পিতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও বিচ্ছিন্নতার নানা দিগন্তে দৃষ্টি দিয়েছেন। কবিতাটিতে সংসারধর্মে ব্যস্ত পিতার মৃত্যুকেই তাঁর মুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। সংসারের নানা কাজে নিমগ্ন পিতা কখনোই নিজের কথা ভাবেননি। তিনি এখন দূর বিশ্বের বাসিন্দা, যেখান থেকে আর ‘দেখবে না সন্তানের ধু-ধু খরা অকাল বৈশাখে।’ পিতার উপস্থিতি কবির তাঁর সমস্ত চিন্তা ও কর্মের ভেতরে গভীরভাবে অনুভব করেছেন।
সিকদার আমিনুল হক স্মৃতির ভেতর দিয়ে তাঁর প্রিয়জনদের সান্নিধ্য উপভোগ করেছেন। এই সান্নিধ্যও অনেক দূরত্ব বজায় রেখেই সম্পন্ন হয়েছে। ‘তোমার বারান্দা’ কবিতাটিতে প্রেমের প্রতি ঔদাসীন্যের চমৎকার দৃশপট ধরা পড়েছে। প্রিয়জনের বারান্দাকে দুরবিন কল্পনা করে সেই যন্ত্রে নিজের যন্ত্রণা দেখার চেষ্টা করেছেন কবি। এই বারান্দাই আবার দুজন মানুষকে আলাদা করে দিয়েছে ‘তুমি আজ ভিন্ন ঘরানার’ শীর্ষক কবিতায়। শুধু বারান্দাই বদলে যায়নি, প্রেমিকেরও বদল হয়েছে কবিতাটি— ‘কিন্তু আছে মননের ভিন্ন/ সত্ত্বাও। যখন স্বপ্নে তুমি থাকো নিভৃত নিঃশব্দে,/ ড্রাগন, হরিণ, জেব্রা, হাঙরের গভীর সমুদ্রে,/ কিংবা কোনো উপন্যাসে বাহুলগ্ন সৌম্য প্রেমিকের।’ বদলে যাওয়া প্রেমিকার জন্য হাহাকারই এই কবিতাটির মর্মকথা।
‘কয়েকটি মাদ্রিগাল’ কবিতায় সেই অর্থে কোনো গালাগাল নেই। বরং পুরাতন প্রেমকে নতুন করে অনুভবের ব্যাপার আছে, দীর্ঘ বিরতিতে পরস্পরকে না-চেনার বিস্ময় আছে, হঠাৎ দেখা কোনো বিদেশি বালিকার প্রতি মুগ্ধতা আছে, দৃশ্যমান বৈপরীত্যের কিছু খণ্ডচিত্র আছে। কয়েকটি উপশিরোনামে কবিতাটিকে বিভক্ত করা হলেও প্রতিটি খণ্ডই একটি স্বতন্ত্র কবিতা হিসেবে পাঠ করা যায়। বরং খণ্ডাংশগুলোর মধ্যে সংযোগসেতু খুঁজে পাওয়াই কঠিন। ‘একটি উত্তরণ’ অংশে কবি কোনো এক অপরাহ্ণে ‘পাথরঘাটার ক্যাথলিক গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে’ উত্তরণ প্রত্যাশা করছেন। কবিতাটিতে দুজনের ধর্মবিশ্বাসে ভিন্নতার ইঙ্গিত আছে। কিন্তু সেটি বড় কথা নয়, বিশ্বাস ও বাস্তবের বৈপরীত্য এই কবিতায় চমৎকার শিল্পসংহতি লাভ করেছে:
যদিও তোমার পুরুষ আপাদস্তক তোমার ধর্মের অনুগত
কিন্তু যিশু আমাকে বিধর্মী বলেননি। উপরন্তু
আমি বহুদূর থেকে এসেছি। আপাতত ক্লান্ত, আপাতত
রাত্রি অবসন্ন,
আপাতত আমার বয়স ছত্রিশ পূর্ণ হলো
—অর্থাৎ ধর্মান্ধ হওয়া ছাড়া আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
হয়তো যিশুর অনুগত হলে তুমি এনে দেবে প্রলম্বিত ঝাউগাছ
অর্থাৎ সঙ্গ-স্তন, অর্থাৎ কমলার রস, অর্থাৎ দেয়ালে
তিব্বতি থালা—
কিন্তু আমি তোমাকে আমার প্রয়োজন বুঝে
বেলেল্লা হতে বলি না।
[কয়েকটি মাদ্রিগাল: পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা]
এই কবিতায় আপাতত এবং অর্থাৎ শব্দের উপর্যুপরি ব্যবহার লক্ষ করার মতো। ধর্মীয় পরিমণ্ডল, বিশেষভাবে যিশুর উপস্থিতি পরস্পরের প্রত্যাশাকে অনেকাংশে শাসন করেছে বলে মনে হয়। তাই শরীরের অনুষঙ্গ সত্ত্বেও কবিতাটিতে বেলেল্লাপনা প্রশ্রয় পায়নি। ‘মধ্যযৌবনের জার্নাল’ কবিতায় আবার সেই সংযম নেই। অবশ্য নামকরণের মধ্যেই সেই অসংযমের ইঙ্গিত আছে। কবির চোখে নায়িকার দেহাবয়ব এখানে নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে— ‘তোমার প্রসন্ন গ্রীবা, স্তন, নাভি, ফিরোজা-নীলায়/ সহজ শাশ্বত দান ঈশ্বরের নিজ হাতে আঁকা।’
সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় প্রেমের চেয়ে মৃত্যুর প্রতাপ অধিক বলে মনে হয়। প্রেমের কথা বলতে গিয়েও তিনি মৃত্যুর ভয়াল দৃশ্যকে শব্দবন্দি করেন। ‘শেষ অভিবাদন’ কবিতায় রুগ্ণতার সুগন্ধি ছড়ানোর চেষ্টা আছে, আছে এলিয়ট-রবীন্দ্রনাথের কাছে হাত বাড়ানোর প্রয়াস— “ক্লেদজ কুসুম’ শেষ, মধ্যাহ্নের চেতনার রঙে/ পান্না হলো দারুণ সবুজ।” এরপর পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধি-সম্ভোগের কথা আছে, কিন্তু মৃত্যু-প্রসঙ্গেই অধিক জোর দিয়েছেন কবি। প্রেমের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার কথাও সিকদারের কবিতায় আছে, কিন্তু সেই প্রেমকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের ইচ্ছের অনলে দগ্ধ করেন কবি। তাই পাওয়ার প্রবল ইচ্ছেও শেষ পর্যন্ত কোনো পরিণত আনন্দের দৃশ্যপট রচনা করে না। ‘কৃতী নক্ষত্রের পাশে’ কবিতায় আমরা একজন অস্তিত্বসচেতন কবির দেখা পাই। কবি নিজেই বলছেন, ‘রাখিনি নিজের চিহ্ন কৃতী-দীপ্র নক্ষত্রের পাশে’, কিন্তু কালজয়ী শিল্পস্রষ্টাদের সঙ্গে তিনিও যে নৌকা ভাসিয়েছিলেন, এতেই তাঁর আনন্দ। তাঁর কালের সদুময় দুঃস্বপ্ন ও দুর্ভাবনার চিহ্ন লেপ্টে আছে তাঁর শরীরে। স্বৈরশাসকের বিধ্বংসী বিধিনিষেধের শিকার হয়েছেন তিনিও, জীবনানন্দের মতো তিনিও শুনেছেন পেঁচার নষ্ট ডাক। পুরো পৃথিবীর শোষিত-বঞ্চিত মানুষের হাহাকার তাঁকেও বিক্ষত করেছে। বস্তুর নির্জন যে রং ‘কামরুলের হাতে খোলে। রাহমান, আল মাহমুদ/ দিয়েছে বাঁচার মুক্তি বারোয়ারি বিরক্ত প্রহরে’, সবকিছুর সঙ্গেই সংযোগ ছিল তাঁর।
আমি সেই ইলেকট্রা কাব্যগ্রন্থের নামকরণের মধ্যে যে পৌরাণিক আবহ মুদ্রিত, সেই অর্থে কবিতায় তিনি ইতিহাস-ঐতিহ্যের সম্ভ্রান্ত অতীতে খুব বেশি কালক্ষেপণ করেননি। বরং যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গেই আবর্তিত হয়েছেন তিনি। এবং এই যাপনের ভেতর থেকেই অত্যন্ত সচেতনভাবে কবিতার জন্য রসদ কুড়িয়েছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় মাতার চেয়ে পিতার উপস্থিতি অধিক। এই বইয়ের ‘প্রিয় পিতাকে’ কবিতায় পিতাকেও তিনি একটি মহৎ গ্রন্থের মতো গভীর একাগ্রতায় পাঠ করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘বস্তুত আমার সত্তা আমার পিতা।’ পিতার অনুপস্থিতিতে কবির জীবনের সমুদয় আরাম-আনন্দ হারিয়ে গেছে। খাদ্য গ্রহণে রুচি নেই, প্রবল তৃষ্ণাতেও তাঁর জলের নিকটবর্তী হতে ইচ্ছে করে না। এভাবেই পিতার সঙ্গে কবির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের পুরাণ নির্মিত হয়েছে।
এই বইয়ের অনেকগুলো কবিতায় সিকদার আমিনুল হক কবিতা বিষয়ে তাঁর ধ্যানধারণার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কবিতার তাত্ত্বিক অভিব্যক্তি নয়, বরং তাঁর চিত্তলোক কীভাবে কবিতার সংস্রবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, সেই বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। সহজ করে সাবলীল ভঙ্গিতে কবিতার সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার কাব্যিক বয়ান হিসেবে কবিতাগুলো সুখপাঠ্য। এ প্রসঙ্গে ‘আমি ও আমার কবিতা’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘কবি’, ‘কবিতা সভার প্রতি’ প্রভৃতি কবিতার নাম করা যায়। কবিতার পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষেরা বাস্তবের সকল অভিঘাত সহ্য করেও নিজের জন্য একটি অন্য রকম পৃথিবী নির্মাণ করে নেন। সেখানে বাস্তবের ছায়াপাত হয়তো মিথ্যে নয়, কিন্তু চিত্তের স্বস্তি ও শুশ্রূষার জন্য অন্য এক আকাশ থেকে অবিরল বৃষ্টি ঝরতে থাকে। জীবনানন্দের বরাত দিয়ে বলা যায়, সেই আকাশের ওপারেও আকাশ।
একজন কবি অবজ্ঞা ও উপেক্ষাকে অলংকার ভেবেই নিজের কাজে একনিষ্ঠ থাকেন। তবে সেই অবজ্ঞা-উপেক্ষাও নানা উপমা-রূপকল্পে কবিতার শরীরেও জায়গা করে নেয়। সিকদার আমিনুল হক কোনো রকম আড়াল না করে কবিতার বইয়েরই নাম রাখেন বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকার। এই বইয়েও অনেক কিছু আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিসর দখল করে আছে কবিতা। তিনি কবিতার কথা বলেছেন, প্রকারান্তরে যা নিজেরই কথা। ফলে এই বইয়ের অনেক কবিতায় আত্মকথনের ভঙ্গিটি ধরা পড়েছে। তিন পাপড়ির ফুল কাব্যের ‘সাম্প্রতিক মুখোশ’ কবিতায় কবি যেমন কবিদের দশকওয়ারি বিভাজনে বিরক্ত বোধ করেছেন, বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকার কাব্যেও সেই বিরক্তির প্রকাশ স্পষ্ট। তবে এখানে তিনি কবিতা বিচারের ক্ষেত্রে কবির নিজস্ব মুদ্রা আর নিজস্ব বৃত্তের কথা বলেছেন। ‘তার কাছে যাও’ কবিতায় তিনি লিখেছেন: ‘আমাদের মুদ্রা আর নৃত্যের নিজস্ব বৃত্ত/ দশক হিসেবে তার বিচার হবে না—/ কার সামনে ছিলো ছায়াচ্ছন্ন পানের বরজ/ সাঁওতালি নাচ আর ফ্যাক্টরির ভাঙা চাঁদ/তার কোনো হিসাব হবে না।’ কবিতার আঙ্গিক বিষয়েও তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট। শিশু ও সত্যবানের প্রশ্নে সহমত হলেও আঙ্গিকের বৈপরীত্য মুছে যাবে না। কবি মানুষের কাছে ফিরে যেতে বলেছেন। অন্য কোনো কবিকে হয়তো নয়। নিজেকেই বলেছেন। দূরের কার্নিশ কাব্যগ্রন্থে তিনি যেমন বলেছেন, ‘আমাদের সামনে এখন মানুষ।’ এই মানুষ যে সব সময় সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-আনন্দের আদর্শে উজ্জীবিত উজ্জ্বল-প্রবল-প্রাণবন্ত মানুষ এমন নয়। বিষণ্ন-বিপন্ন-বিধ্বস্ত মানুষের কাছেও যেতে হবে। সামাজিক চোখে যারা ভ্রষ্ট হিসেবে স্বীকৃত, তাদের কাছেও কবিতার জন্য স্বাস্থ্যকর অনেক কিছু আছে। সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় এ-জাতীয় মানুষের সংখ্যাই অধিক। তাঁর কবিতার মানুষজনের একটা বিরাট অংশ মদ ও নারীর মধ্যে মুক্তি খুঁজে বেড়ায়। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে যদি আমরা মনোযোগ দিয়ে তাঁর ‘কবিতা প্রসঙ্গ’ পাঠ করি। সেখানে সম্রাজ্ঞীর স্বচ্ছ মসলিনের কথা আছে, শাদা হাঁস ও ঘন কুয়াশার কথা আছে, দেবদারু-প্রেতলোকের কথা আছে, কিন্তু সবচেয়ে জোর দিয়েছেন সেখানে, যেখানে মদ্যপের পদচারণা প্রবল—‘মদ্যপ কবিতা তুমি, কৃতী মাকড়সা।’ কবিতা-প্রসঙ্গে তিনি আরও অনেক কথা বলেছেন। কিছু কথা কবির ভাষায় পাঠ করলেই পাঠক অধিক আনন্দ পাবেন:
‘কবিতা গভীর নিদ্রা, এক ঝাঁক পাখি—
আধখণ্ড চাঁদ, আত্মগ্লানি, জটিল-কুটিলা’;
সারা রাস্তা নিষ্প্রদীপ, ফিরে দেখি দরজায় খিল
হুট করে ছেড়ে দিই ধনুকের ছিলা।
কবিতা সোনালি তাঁত নিদ্রাছুট অসুস্থ ঈগল,
ভিখিরি মেয়ের চুলে নিখিল উকুন
কবিতা নিশ্চুপ থাকে, অনাসক্ত, বস্তুত নীরব
কাঁপে ও ক্রন্দন করে সমুদ্রের নুন।
[কবিতা প্রসঙ্গ: বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকার]
এ থেকে সিকদারের কবিতার গতিবিধি অনেকটা আঁচ করা যায়। এই বৈরী বাস্তবতায় বিধ্বস্ত মানুষটিকেই আমরা খুঁজে পাই ‘সম্পর্কের ছুটি’ কবিতায়। এই কবিতায় পৌঢ়ের বিলাস নিদ্রা, জঙ্ঘা ও জানুর সম্মোহন থেকে মুক্তির কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘বরঞ্চ পিচ্ছিল করে দাও/ হতাশার পথ, ম্রিয়মাণ বেলা, হাঁটুর পতন।’ অতঃপর বুদ্ধদেব বসুর মতো শাপভ্রষ্ট দেবশিশু কল্পনা করেছেন নিজেকে—‘আমি নই ব্যতিক্রম, অমরত্বের অভিপ্রায় জানি;/ বাঁচাই অশ্লীল কাজ—শাপভ্রষ্ট পেতে চাই ছুটি।’ ছুটি চাইলেই তো আর কেউ এসে ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় না। কবিকে ছুটতে হয়।
কবিদের প্রকৃতি-প্রবণতা-গতি-গন্তব্য চিহ্নিত করতে গিয়ে দশকওয়ারি বিভাজনের একটি রীতি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে চালু আছে। কবিদের মধ্যেও এই রীতির সমর্থন করেন এমন অনেকেই আছেন। কিন্তু একটি কবিতায় কবিদের এই বিভাজনকে কটাক্ষ করেছেন সিকদার আমিনুল হক।
সিকদার আমিনুল হক © পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
কবিতার বইয়ের নাম পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল। এই তৃষ্ণাজাগানিয়া নামকরণের নানা অর্থ ও তাৎপর্য থাকতে পারে। কিন্তু কবিতার অন্দরমহলে প্রবেশ করলে আমরা লক্ষ করি, এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতায়ই কবি নিজের ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর কবিতায় অন্তর্গত উচ্চারণে যে মগ্নতা পাঠককে আচ্ছন্ন করে, এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতায়ই তা অনুপস্থিত। বইটির প্রকাশ-সালের দিকে খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কবির জন্মভূমির উত্তাল দিনগুলোই তাঁকে ঘরের বাইরে টেনে এনেছে। স্বৈরশাসনের ভয়াল থাবায় বিধ্বস্ত বাংলাদেশেরই অনেক রক্তচিহ্ন লেগে আছে বইটিতে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষায় বলতে গেলে, ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়।’ এ কারণেই ‘দিনগত পাপক্ষয়’ কবিতায় আমরা দেখি, চারদিকে কেবল মুখোশের মিছিল। ভোগ ও বিত্তের তাপে মানুষের সর্বস্ব লুট করেও নানা রকম সামাজিক অনুষ্ঠানে ভালো মানুষের ভান করে তারা, ‘মৃতের বাড়িতে গিয়ে নিমেষেই কালো পোশাকের মেনে নেয় শোকরীতি।’ এই কালখণ্ডের সবাই যেন আপাদমস্তক পচন-ধরা মানুষ, কবির ভাষায় ‘বিনষ্ট বিশ্বের নাগরিক’। ‘এই আমি মধ্যরাত’ কবিতায়ও কবি এক বিরূপ বিশ্বের বাসিন্দা। মধ্যরাতের পরিব্রাজক হিসেবে তিনি যা-কিছু দেখেছেন, তার কোনো কিছুই স্বাস্থ্যপ্রদ নয়। কবি নিজেকে এই মধ্যরাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ কল্পনা করেছেন।
‘বিষ্ণু দে, একটি লাল কমলের প্রতি’ কবিতায় বিষ্ণু দের সঙ্গে কবির সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা শিল্পরূপ পেয়েছে। দেখা হয়েছিল অনেক আগে। সেই দেখার দিনটিকেই আবার নতুন করে নিজের মনের মতো সাজিয়ে নিয়েছেন। কলকাতার গোলাম মোহাম্মদ রোডে তাঁদের দেখা হয়েছিল, ‘সন্ধ্যায় নিরিবিলি গৃহস্থের ছোটো ঘরে’, কিন্তু এই ঘরটিই কবির চেতনায় শিল্পিত সারা বিশ্বের প্রতিভূ হয়ে ওঠে। বিষ্ণু দের কাব্যাদর্শ ও শিল্পভাবনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, যার সঙ্গে সিকদার আমিনুল হকের কাব্যভাবনা ও শিল্প-দৃষ্টির সম্পর্ক মেরুদূর। কিন্তু সেদিন কবি বিষ্ণু দে-কে দেখে মার্কসের ব্যক্তিত্ব মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন। কবিতাটিতে বিষ্ণু দে হয়ে উঠেছেন মনুষ্যত্বের রাষ্ট্রীয় প্রতীক। কবির এই ভাবনার পশ্চাতে নিশ্চয়ই স্বৈরশাসন-কবলিত বাংলাদেশের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা সক্রিয় ছিল। বিশ শতকের ষাটের দশকের কবিরা পাকিস্তানি সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত সক্রিয়তা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই আমরা জানি। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যখন সেই স্বৈরতন্ত্রই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন তাদের কলমে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-বিপ্লবের শব্দ উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। সিকদার আমিনুল হক রাজনৈতিক চেতনাপুষ্ট উচ্চকণ্ঠ কবিতা খুব কমই লিখেছেন। কিন্তু দেশাত্মবোধের প্রশ্নে তিনিও সরব হয়েছেন কখনো কখনো। উদাহরণ হিসেবে পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল কাব্যের ‘আত্মজের প্রতি’ এবং ‘প্রতিটি সকালের স্বাধীনতা’ কবিতা দুটির কথা উল্লেখ করা যায়।
‘আত্মজের প্রতি’ কবিতায় সন্তানের জন্য কবির দুশ্চিন্তার কথা বলা হয়েছে। কারণ, এই নয় যে, সন্তান বখাটে হয়ে গেছে। পাড়ায় সে মাস্তানি করে না, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কোনো নেশাদ্রব্যও গ্রহণ করে না সে। কিন্তু কবির স্বকালে দেখা অধিকাংশ যুবকের মতো সে নয়, এটাই কবিকে ভাবিয়ে তুলছে। কবিপুত্র মিশার অস্তিত্বজুড়ে বিরাজ করে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। এই নামের মূল্য দিতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে মনসুর, নজরুল, তাজউদ্দীনকে। কবি মনে করেন, এই নামের প্রতি ভালোবাসা কেবলই প্রতিদান চায়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা—শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেছেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করলেই শাসকের রক্তচক্ষু হায়েনার মতো ধেয়ে আসত তাকে ধ্বংস করতে। কবি-পুত্রের মানসলোকে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব বিষয়ে কবি লিখছেন:
তোকে নিয়ে তোর মা আর আমি পিতা সর্বদা শঙ্কিত থাকি।
যে বয়সে দেয়ালে থাকে জ্যাকসন আর শ্রীদেবীদের
নয়ন ভোলানো ছবি
সে বয়সে তোর ঘরে সারা দেয়ালজুড়ে দেখি সাতই মার্চের জনসভা
আর বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত তর্জনী ওঠানো হাত, দেখি নীলিমায়
পায়রা ওড়ানো স্বপ্নদূত বঙ্গবন্ধুর
আরেকটি ছবি, এবং সেই যে দেবদূত ফিরলেন বন্দিদশা থেকে
মুক্ত বাংলায়, ঢাকার রাস্তার সেই জনস্রোত—
সস্ত্রীক রাসেলকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ানো; এসব ছবিকে
ছোটো বড়ো নানান ফ্রেমে
অত্যন্ত সযত্নে তুই বাঁচিয়ে রাখিস প্রহরে প্রহরে।
[আত্মজের প্রতি: পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল]
কয়েকটি ছবির বর্ণনায় বাংলাদেশের গৌরবদৃপ্ত ইতিহাসের একটা বিরাট অংশ পাঠ করে ফেলি। এ-রকম বৈরী বাস্তবতায় ইতিহাসের প্রকৃত পৃষ্ঠাগুলো এমন একনিষ্ঠভাবে পাঠ করা সহজ কথা নয়। অন্তত কবির নিজের তো সে সাহস নেই-ই। কবি বলেছেন, কেবল তাঁর পুত্র মিশাই নয়, মিশার মতো কয়েক লক্ষ ছেলে আছে বাংলাদেশে, যারা সুবিধাবাদী মানুষের বিবেচনায় খাপছাড়া। আখের-গোছানো চিত্ত ও চেতনায় অন্ধ, স্বভাবে কেরানি, আশায় লম্পট অধিকাংশ মানুষের বয়সই ত্রিশ থেকে আশি বছর। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও তারা স্বভাবে সমগোত্রীয়।
একই ভাব ও অভিজ্ঞতাজাত কবিতা ‘প্রতিটি সকালের স্বাধীনতা’। স্বাধীনতার পর চৌদ্দ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই স্বপ্ন তখনো অধরা। কবি এই চৌদ্দ বছরের অপেক্ষাকে নানা উপমা-রূপকল্পে হাজির করেছেন। শাসনতন্ত্র, অধিকার ইত্যাদির জন্য চৌদ্দ বছর অনেক সময়। এই সময়ের মধ্যে বালিকারা অনেকবার মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করেছে, অনেক অঙ্কুর বৃক্ষের অবয়ব পেয়েছে, পদ্মা ও মেঘনার অনেক জল সমুদ্রে পৌঁছেছে, যুক্ত-তর্কে অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে, স্বাধীনতার শত্রুদের মাথার চুলও সাদা হয়ে গেছে, প্রেমিক-প্রেমিকার চুম্বন থেকে তাদের সন্তানেরা কিন্ডারগার্টেনে গেছে, তৈরি হয়েছে বড় বড় কারখানা, জলবিদ্যুৎ, কিন্তু সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত থেকেছে বাংলাদেশের মানুষ। কবি মনে করেন, ‘এতো স্তব্ধতার পরে আর কোনো স্তব্ধতা নেই।’ এসব হতাশার পরেও বিশ্বাস করতে হবে এমন বিষয়ের একটি দীর্ঘ তালিকা হাজির করেছেন কবি:
আমাকে বিশ্বাস করতে হবে
বাজারের রাস্তায় আনা পাখির খাঁচার পাখিগুলিও বন্দি
বিশ্বাস করতে হবে
বস্তির দরিদ্র কুপির সামনে হাড্ডিসার শিশুর মৃত্যুও মৃত্যু
বিশ্বাস করতে হবে
মুদ্রিত চোখ লম্পটের নিদ্রাও লালসাযুক্ত নিদ্রা
বিশ্বাস করতে হবে
বারবনিতার অনিচ্ছুক রাত্রি যাপনও শ্লীলতাহানি
[প্রতিটি সকালের স্বাধীনতা: পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল]
এই তালিকা আরও দীর্ঘ। সেই তালিকায় কবির স্বকালের বন্দুকের গুলিকে তুলনা করা হয়েছে একাত্তরে শত্রুপক্ষের বন্দুক থেকে ছোড়া গুলির সঙ্গে। সামরিক শাসনকালে উদ্ধত সবুজ জিপগুলোকে অশ্লীল উৎপাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বানভাসি মানুষের বেদনাকে তুলনা করা হয়েছে বিধবার করুণ আর্তনাদের সঙ্গে। গলির বেকার যুবকদের মধ্যে কবি দেখতে পেয়েছেন ক্রীতদাসের হতাশা। কবি বিশ্বাস করেন, ‘পাখি ও পাখির ডানার আকাশে প্রেরিত আমাদের কবিতা।’ বাংলাদেশের লাল গোলাপের মধ্যে কবি দেখতে পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত। বিশ্বাসের ক্রমাগত বর্ষণ শেষে কবি বলেছেন:
হে আমার স্বাধীনতা, তোমার মৃত সন্তানদের দিকে তাকিয়ে
এই বিশ্বাসের কসমগুলি আরেকবার
সকলের রক্তে স্মরণ করিয়ে দাও।
[প্রতিটি সকালের স্বাধীনতা: পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল]
সিকদার আমিনুল হকের কবিস্বভাবের অনুকূল নয় এই দুইটি কবিতা। তাঁর কবিতার তাৎপর্যপূর্ণ দিক গভীর মগ্নতা যা পাঠককে দৃশ্যাতীত কিন্তু অনুভবসম্ভব চৈতন্যের দরোজায় দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু এই দুটি কবিতা আমাদের অন্তর্লোকের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলে না, কেবল অতীতের দিনগুলোকে দৃশ্যের সন্নিবেশে আমাদের সামনে মেলে ধরে। সেই অর্থে এই দুটি কবিতার দুর্বলতাই সহজে চোখে পড়ে। কিন্তু একটি জাতির দুর্যোগ-দুঃসময়ের চালচিত্র হিসেবে, স্বৈরশাসনকবলিত বাংলাদেশের দিনলিপি হিসেবে, ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব চিত্রায়ণের প্রয়াস হিসেবে ‘আত্মজের প্রতি’ এবং ‘প্রতিটি সকালের স্বাধীনতা’ কবিতা দুটির গুরুত্ব স্বীকার করতেই হয়।
এতক্ষণ যে অসুখ-বিসুখের বিবরণ দিলাম, একই অসুখে আক্রান্ত হয়েছে বাংলাদেশের সেই সময়ের কবিতা। এ কারণেই সিকদার আমিনুল হকের কবিতার নাম ‘কবিতা তোমার দুর্ভোগ’। দীর্ঘ কবিতা, কিন্তু মূল বিষয় দুঃসময় কীভাবে কবিতার আত্মা ও অবয়বে অমোচনীয় চিহ্ন রেখে যায় তারই প্রতীকী-উদ্ভাসন। যদিও প্রতীকী বলছি, তবে বস্তুনিষ্ঠতার দিকেই কবির মনোযোগ ছিল বেশি। এই কবিতায় আমাদের যা-কিছু আছে, তার একটা লম্বা তালিকা হাজির করেছেন কবি। সস্তা হাততালি, নিজস্ব পত্রিকা, নির্ধারিত ভোট, পৃষ্ঠপোষকের হাত থেকে ওড়া রঙিন বেলুন, মিছিলের স্বাগত ব্যান্ড, ‘প্যান্ডেল সাজানো ফুল-পাতা’, ‘আছে উঁচু নীলিমা-ওঠার মজবুত সিঁড়ি, আছে মোটাসোটা খাটে বা ডিভানে ঝলমল করা অর্থকুমিরের শোচনীয় উপেক্ষিতা বেগমের ভক্ত টেলিফোন’। এত সব থাকার পরও কবিতার জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ কিছুই খুঁজে পাননি কবি।
এই দুর্যোগ-দুর্বিপাক-দুঃসময়ের চিত্র এক রাত্রি এক ঋতু কাব্যগ্রন্থেও লক্ষ করা যাবে। নামকরণের মধ্যেও এই বিপর্যয়ের ছাপ স্পষ্ট। সমস্ত ঋতুকে যখন একটি রাতের রূপকল্পে হাজির করা হয়, তখন বুঝতে পারি, অন্ধকারে অন্ধকার ঘষে আলো নয়, কেবল অন্ধকারেরই জন্ম হতে থাকে। তাই ‘সৌন্দর্যের সামনে’ কবিতায় কবির ‘ক্রমান্বয়ে, মৃত প্রেমিকার গাল, তার সর্প চুল;/ বিলাপ-বন্দিনী স্তন, জঘনের জয়গাথা, মত্ত/ আচরণ, লাল নখ, মর্গসুদ্ধ প্রতীক্ষার শব মনে পড়ে যায়।’ তাহলে কোন সৌন্দর্যের সামনে এসে দাঁড়ালেন কবি? নির্মাতা মাতিস তুলি নিয়ে যে সুঠাম নারীর ছবি আঁকেন, দৃশ্যমান করে তোলেন নারীর ত্বক-মাংসের লাবণ্য ‘গোলাপী আভার স্পর্ধা’য়, তা কেবল স্বপ্নের ভেতরে ঘুরপাক খায়। এই বিরূপ বাস্তবতায় জীবনের চেয়ে মৃত্যুর উপস্থিতিই অধিকতর সংগত মনে হয়:
চিন্তার প্লাবন কিংবা মৃত্যুচিন্তা, কোনো বিষয়েই
দূরদৃষ্টি ঠিক নয়, বিশেষত প্রেমিকের। ক্ষয়
চতুর্দিকে, তাড়া করে বাঘ, অভিজাত অশ্বপাল;
বনের আদলে জেগে ওঠে জন্তু, নারী বাঘিনিরা।
তৃপ্তি নয় ক্লান্তি, এ জীবন মধু আহরণ!
কখন উঠেছি গিয়ে স্বপ্ন ঘরে, এক ক্লিন্ন চাঁদ
চুমু খেলো এক রজস্বলা মেঘ-নারী। ঘুরে দেখি
আমার প্রেমিকার নয়, রমণ—জয়ন্তী ধূর্ত বেশ্যা।
[সৌন্দর্যের সামনে: এক রাত্রি এক ঋতু]
এক রাত্রি এক ঋতুর অনেকগুলো কবিতায় সিকদার আমিনুল হক কবি ও কবিতা নিয়ে কথা বলেছেন। কবিতার নামকরণের মধ্যেই কবির অভিপ্রায় অনেকখানি মুদ্রিত। ‘কবি ও বাঘ’, ‘একটি ব্যক্তিগত কবিতা’, ‘রেখো মা দাসেরে মনে’, ‘প্রেমিক নজরুল’, ‘যেভাবে ছিলেন রিল্কে’ ইত্যাদি কবিতায় সিকদারের কাব্যভাবনার বিচূর্ণ দীপ্তি ধরা পড়েছে। ‘প্রেমিক নজরুল’ কবিতায় সিকদারের স্বপ্নে এসে হাজির হয়েছেন নজরুল। সঙ্গে ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা। ‘জলোচ্ছ্বাস কিংবা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো’ তীব্র আবেগ নেই সিকদারের, যেমনটি ছিল নজরুলের। সিকদার স্বীকার করেছেন, ‘আমি মৃদু স্বভাবের এক খঞ্জ কবি’ যিনি দৃষ্টিহীনের মতো অবলীলায় খঞ্জরের সামনে মাথা পেতে দেন। দুজনের দূরত্ব ‘প্রায় স্বর্গ ও মর্তের’। দুজনের ব্যবধান ‘সৌভাগ্যের, দশকের, অহংকারের, জননন্দনের, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের।’ তবু নজরুলকেই স্বপ্নে দেখেছেন কবি। স্বপ্নেই নজরুল সিকদার আমিনুল হককে ভর্ৎসনা করেছেন। তাতে নিজেকে গর্বিতই মনে করেছেন সিকদার। নজরুলের গানের একনিষ্ঠ ভক্ত তিনি। তাই ভুল সুরে কেউ নজরুলের গান গাইলে সিকদার বিরক্ত হন। কবি লিখেছেন:
তোমার সেই ভর্ৎসনা আমি মনে রাখিনি;
কিন্তু মহফিলে, জন্মজয়ন্তিতে
ভুল সুরে অরূপসীরা তোমার গান গাইলে
ঢেউ-খেলানো চুলের রূপময় চেহারাটা ভেসে ওঠে
চোখের সামনে। অবিরল আমাকে যেভাবে
শাসিয়েছিলে—প্রায় সেরকমই—
কেননা রূপসীদের সঙ্গে জড়িয়ে, তোমার অন্য একটা
নাম ছিলো
‘প্রেমিক নজরুল’!
[প্রেমিক নজরুল: এক রাত্রি এক ঋতু]
‘যেভাবে ছিলেন রিল্কে’ কবিতায় সংসারের সকল কাজ শেষ করে, শরীরের দাবিদাওয়া সম্পন্ন করার পর কবি যখন নিজের মুখোমুখি বসেন, তখনই মাথার ওপর ভর করে মৃত্যুচিন্তা। বিশৃঙ্খল জীবনের পুরস্কার হিসেবে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। তবুও প্রবঞ্চকের মতো দেহ ও মনের অসুখ-বিসুখ আড়াল করে ভদ্রলোকের মতো বেঁচে থাকা। ‘এ দৃশ্যে কোথায় আমি’ কবিতায় এসেছে কবিতার প্রভাব ও পরিণতির কথা, লাস্যময় জীবনের অন্তঃসারশূন্যতার কথা, অন্ধকারে নিমগ্ন থেকে নিরানন্দ নদীতে গন্তব্যহীন ভেসে বেড়ানোর কথা। ‘যখন তোমাকে দেখলাম’ কবিতায় ‘খৈয়ামের সাকি-সুরা আর মৃত্যুভয়’ কবিকে জাগিয়ে রাখে, ‘রোগীর টেবিলে থাকা বহু উপেক্ষিত কমলা লেবুর’ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘যে ভোলে ভুলুক আজ অর্থহীন গানে, বিজ্ঞাপনে’ থেকে আমরা কল্পনা করে নেই সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। কিন্তু কবিতার শেষে কবি নির্মাণ করেন প্রগাঢ় এক স্মৃতিমগ্ন মুহূর্ত, যেখানে জীবনের সদর্থক উজ্জীবনের কোনো চিহ্নই আর অবশিষ্ট নেই:
চারিদিকে আজ ধূর্ত নখ
তোমার গলিত লাশে চেপে বসে, আর
ঠোঁট রাখে আগুন শরীরে। কার সাধ্য
সৌন্দর্য বাঁচিয়ে খুঁজে নেবে তার প্রিয় শ্যামলিমা?
নির্বাসিত বারান্দায়
বসে থাকি একা একা।
[যখন তোমাকে দেখলাম: এক রাত্রি এক ঋতু]
এই কবিতার ‘তুমি’র মধ্যে প্রেমিকার মুখ কল্পনা করা অসম্ভব নয়। কিন্তু বৈরী বাস্তবতার যে দৃশ্যপট কবিতাটির মর্মে মর্মে মুদ্রিত, তা থেকে জন্মভূমির মুখটিই বেশি মনে পড়ে। বিশেষ করে কবি যখন প্রিয় শ্যামলিমার প্রসঙ্গ আনেন, তখন প্রিয়তমার মুখটি ক্রমশ অদৃশ্য হতে হতে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে চায়।
সিকদারের কবিতায় মাটির দেখা মেলে, সেই মাটি যতই কলুষিত হোক; মানুষের দেখা মেলে, সেই মানুষ যতই বিপন্ন-বিধস্ত-বিকলাঙ্গ হোক। আর আকাশের ছড়াছড়ি অনেকটা জীবনানন্দের মতো, যে আকাশ অতিক্রম করলে আমরা আরেক আকাশের দেখা পাই।
সিকদার আমিনুল হক © পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
সিকদার আমিনুল হকের হাত ধরে অনেক দূর চলে এসেছি। তাঁর ডানায় ভর করে উড়েও এসেছি অনেক আকাশ। একটু বিশ্রামের দরকার। বিশ্রামের জন্য বৃক্ষের প্রয়োজন, যদি মাটির সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় হয়। আর যদি আসমানই হয় নির্ভরযোগ্য আশ্রয়, তাহলে ডানার খোঁজ করতে হবে, যার আড়ালে প্রশান্তির প্রতিশ্রুতি মুদ্রিত থাকে। সিকদারের কবিতায় মাটির দেখা মেলে, সেই মাটি যতই কলুষিত হোক; মানুষের দেখা মেলে, সেই মানুষ যতই বিপন্ন-বিধস্ত-বিকলাঙ্গ হোক। আর আকাশের ছড়াছড়ি অনেকটা জীবনানন্দের মতো, যে আকাশ অতিক্রম করলে আমরা আরেক আকাশের দেখা পাই। তাই বিশ্রামের জন্য ডানাই অধিকতর প্রাসঙ্গিক মনে নয়। আলোচনা থেকে অনেকেই হয়তো বুঝে গেছেন যে, আমরা সিকদারের সতত ডানার মানুষ নিয়েই কথা বলছি।
কবিতায় আমরা যে মগ্নতার কথা বলি, আত্মতার কথা বলি, নিজেকে নেড়েচেড়ে নতুন ভাব ও রূপে আবির্ভূত হওয়ার কথা বলি, তার সবকিছুই সতত ডানার মানুষে বিচিত্র অবয়বে মুদ্রিত। সিকদার আমিনুল হক খোলামেলা কথা বলতে পছন্দ করেন, শরীর ও সম্পর্ক বিষয়ে প্রচলিত বিধিনিষেধের দেয়াল ভাঙার ব্রত নিয়েই তিনি কবিতার পথে পা বাড়িয়েছেন। নারীর শরীর তাঁর কবিতায় কোনো অস্পৃশ্য বস্তু নয় যার স্পর্শে কবিতার সৌরভ ও সৌন্দর্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ পর্যন্ত আমরা সিকদারের কবিতার যে পরিচয় পেয়েছি, তা থেকেও এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। কিন্তু সতত ডানার মানুষে তিনি আরও স্পষ্ট হতে চাইলেন, ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামলেন, ‘আজ আমি প্রসঙ্গ নারীর কথাই বলবো।...আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে; এখন আমি মানুষের লালসা নিয়েও ঠাট্টা করতে পারি।’ কবিতায় কবির আত্মপ্রতিকৃতি নির্মাণের যে কথা সমালোচনা-সাহিত্যে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণের সংস্কৃতি চালু আছে, সেই বিবেচনায় পুরো গ্রন্থটিকে সিকদার আমিনুল হকের আত্মকথনের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে পাঠ করা যায়।
এই বইয়ের সবগুলো কবিতা মিলে মূলত একটিই কবিতা। মাঝে মাঝে কবিতার শিরোনাম চোখে পড়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংকেত বা তারকা-চিহ্নের মাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টির প্রয়াস আছে, কিন্তু কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা সেই শিরোনাম কিংবা বিভাজনের গুরুত্ব স্বীকার করে না। কবিতায় নারীর কথা বলবেন বলেই এই কাব্যের জন্ম— এমন একটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হয়েছে কবিতা। কিন্তু সব নারীকে তিনি কবিতায় ধারণ করতে প্রস্তুত নন। সেই নারীদের কথা তিনি বলতে চান, ‘যারা অপেক্ষা করে, শীতের সবুজ পতঙ্গের মতো।’ বসন্ত আর প্রেমের মতো ক্ষণস্থায়ী অনিশ্চিত যাদের টলমলে সুঠাম পা, তাদের জন্য নয় কবিতা। কারণ, হিসেবে কবি আমাদের জানান ‘বালিকা-বয়স থেকেই নিদ্রিত স্তন হয়ে ওঠে ওদের নৈরাশ্য এবং সম্পদের ভার।’
‘অতি প্রগল্ভ শতাব্দীর কবিতা’ শিরোনামে তিনি কবিতাকে ‘বিশাল নারীর প্রশস্ত নিতম্বের মতো দায়িত্ববোধে আবৃত’ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সিকদারের ভাষায় কবিতা সম্রাটের মতো। ক্ষতবিক্ষত সৈনিকের গল্পের বিষয় হবে কবিতা। কবিতা ‘সেই কিশোরীর অন্তর্বাস, বৃদ্ধেরা যার রং পর্যন্ত আঁচ করতে পারে না। বেতের চেয়ারে বসে যারা কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।’ অগ্নিশিখা আর ক্রোধের মতো, পশুর গর্জনের মতো, কবরের বিষণ্ন গোলাপের মতো কবিতার কথাই সিকদার বারবার বলেছেন। একটি উপমার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার কথাও এসেছে নানা জায়গায়। একটু উদাহরণ হাজির করি:
নতুন উপমা, একটি নতুন জন্ম। আমি উচ্চারণ করি পাপ আর অনুসরণ
করি সুঠাম নারীর নগ্ন কোমরের রক্তচক্ষু ভর্ৎসনা। চোখ দিয়ে আমি রাতের শরীর দেখবো, আমার আঙুল সেই সন্ধ্যার প্রহর থেকেই আর্দ্র।
[আমি প্রগল্ভ শতাব্দীর কবিতা.../সতত ডানার মানুষ]
এই কাব্যের একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ মৃত্যুচেতনা। কেবল এই কাব্যে কেন, বলা যায় সূচনালগ্ন থেকেই তিনি মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে কবিতার পথে হেঁটেছেন। এই মৃত্যুভয় কি জীবনকে গভীরভাবে অনুভব-আস্বাদন-উপভোগের অভিপ্রায় থেকে উৎসারিত? তাঁর কবিতার সঙ্গে দীর্ঘ পথপরিক্রমার অভিজ্ঞতা তো সেই কথাই বলে। তবে এ বিষয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। শেষ বাক্য উচ্চারণের মধ্যে একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা ধরা পড়ে। সিকদার আমিনুল হক অন্তত সে রকমই বিশ্বাস করেন বলে মনে হয়: ‘শেষ কথা স্বৈরশাসক আর দুর্ধর্ষ বর্বর বিজয়ী সম্রাটের মুখেই মানায়; যাঁদের দম্ভ আর শক্তির একটি করুণ ডানা মৃত পতঙ্গের মতো সমুদ্রের বালির ওপরে অতি নির্বাসনে পড়ে থাকে।’ একথা বোধ করি কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
সতত ডানার মানুষ কাব্যের সিকদার আমিনুল হকের মধ্যে একধরনের সমগ্রতার আবহ নির্মিত হয়েছে বলে আমার মনে হয়। সম্পূর্ণ কবির সন্ধান পেতে হলে কবির সঙ্গে হেঁটে যেতে হবে আরও বহু পথ, যেখানে মিলবে মুক্তার মতো জ্বলজ্বলে আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ, হীরকখণ্ডের মতো দ্যুতিময় বেশ কিছু শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা। কিন্তু সতত ডানার মানুষে যে সম্পন্নতার রূপকল্পে হাজির হয়েছেন সিকদার, তাঁকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেবল স্বভাবে নয়, প্রভাব বিবেচনায়ও সতত ডানার মানুষ এক অনবদ্য সৃষ্টি।
সিকদার আমিনুল হক এক রাত্রি এক ঋতু কাব্যে বলেছেন, ‘যার কোনো ক্ষত নেই, তার স্বপ্ন-মাছি উড়ে যায় ত্বক থেকে।’ কিন্তু স্বপ্ন-মাছি উড়ে গেলে তো কবির চলে না। তাই ক্ষতের ওপর আঙুল চালিয়ে ক্ষতস্থানকে জীবন্ত রাখতে হয় কবিকে। সতত ডানার মানুষ কাব্যেও কবি বলছেন, ‘কবিতার শেষ কথাগুলি বাস্তবিকই রক্তক্ষণের। কিন্তু আয়ু আর হৃদয় বলছে, বলবার পক্ষে এই হচ্ছে ফেনিল সময়।’ এই বইয়ের শেষ পঙ্ক্তিতেও এই অভিপ্রায়ের সমর্থন মেলে: ‘রক্তক্ষরণ, আত্মার ঐশ্বর্য আর প্রণয়ের উৎসর্গ—পৃথিবীর ক্ষতগুলি ঢাকবার জন্যে আপাতত এই তো যথেষ্ট!’ হয়তো তাই। কিংবা অন্য রকম। কিন্তু সিকদারের কবিতা যেকোনো সুস্থ-সুন্দর স্বাভাবিক মানুষের প্রতিশ্রুতি রচনা করে না, নিশ্চিত আরাম-আনন্দে দিনযাপনের উপযোগী পৃথিবীর রূপকল্প হাজির করে না—একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
এভাবেই চিহ্নিত হয়ে যান সিকদার আমিনুল হক। রেখে যেতে চান ব্যক্তিত্বখচিত কিছু স্পন্দন। তাঁর ভাষায়, ‘তথাপি আমরা চিহ্নিত থাকতে চাই। কবিতা ও হৃদয়ের প্রশ্নে। সততা ও অন্যের প্রয়োজনে। প্রিয় নারীর সংলাপ ও বন্ধুদের উষ্ণ প্রশ্রয়ে।’ সকল প্রতিবন্ধকতা দু’হাতে ঠেলেই তিনি কবিতার জন্য মেলে ধরতে চান একটি বাসযোগ্য, বিশ্বস্ত ও শিল্পসমৃদ্ধ পৃথিবী। পৃথিবীর ক্ষতস্থান যতই বিস্তৃত হোক, ভারাক্রান্ত করুক আমাদের, সিকদার আমিনুল হক এই পৃথিবীরই ‘শাপভ্রষ্ট দেবশিশু’ এবং শেষ পর্যন্ত তিনি মানুষের কাছেই দায়বদ্ধ।