ব্রাহ্মণ, নমঃশূদ্র ও মুসলমান সমাজের নকশা
স্মৃতিমাত্র মনের ব্যাপার-স্যাপার। শৈশবের ফেলে আসা জীবনের জাবর কাটতে কার না ভালো লাগে। জীবনের একটা বয়সে মানুষমাত্রই স্মৃতিকাতর। ‘স্মৃতি মানেই অতীত’—এটা সহজ ধারণা। কিন্তু স্মৃতির অপর আদল অতীতের সাথে বর্তমানকে মেলানো। মানে ইতিহাসের আরেক বিচারসভা। কেননা এতে থাকে সত্য-মিথ্যার দায়। থাকে ঘটনা আর দুর্ঘটনা। স্মৃতিকথা লিখে কেউ হয়তো ইতিহাসের দায় মেটায়, কেউবা ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যায়। তবে কোনো কিছু না লিখেও অনেকের অনেক কিছু ইতিহাস হয়েছে। সে তর্ক ভিন্ন। তবে কোনো লেখক আত্মজীবনী লেখেন না, লেখেন জগতের অপরাপর পদ ও পদার্থের সাথে আপন সম্পর্কের কথা। মানে, জীবনের অভিজ্ঞতার ভেতরের ঘটনা সম্পর্কিত রূপ। কেননা ব্যক্তির উত্থান-পতন একক ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে না। অপর পদ ও পদার্থ এতে ক্রিয়া করে। কি ভাব কি বস্তু, কি মানুষ কি জন্তু, কি অতি কি প্রকৃতি—সকল সম্পর্কমাত্রই দ্বান্দ্বিক। দ্বন্দ্বের এমন দোলাচলে মানুষের জীবনগাথা। তাই কি আনোয়ারা সৈয়দ হকের স্মৃতি কেতাবের নাম নরক ও ফুলের কাহিনী?
বহির নামায়নে লেখিকা দুই পদের কাহিনির কথা ইঙ্গিত করেছেন। দুই পদ—নরক আর ফুল। কেন স্মৃতি বহির নামে নরক আর ফুলকে টানলেন? আদতে নরক আজাবের প্রতীক আর ফুল নাজাতের প্রতীক। নরক এমন জগৎ, যার আপাত-কোনো বস্তুগত ভিত্তি নাই। আছে ভাবগত ভিত্তি। নরক কল্পনাশ্রিত ভয়াবহ রূপ। পরকালই তার কালপর্ব। আর ফুল নামক পদার্থ বর্তমান, তবে ভেতরের বীজ ভবিষ্যতের। ফলে আনোয়ারার বহিখানি স্মৃতিনির্ভর কল্পনার বর্তমান। আর এহেন বর্তমানই বাস্তব। শিল্পী পাবলো পিকাসোর একটি কথা প্রায় এমন—যা কিছু কল্পনা করা যায়, তাই বাস্তব। কেননা বাস্তব পোষাই মনুষ্য স্বভাব। আর তার অভাব মাত্রই সংস্কারমূলক জ্ঞান। তর্কালংকার শ্রী গোপীনাথ ভট্টাচার্য এমন মতের ধারক। তাঁর মত, ‘যে জ্ঞান মাত্র সংস্কার জনিত তাহাকে স্মৃতিশাস্ত্র কহে।’
কী আছে আনোয়ারা সৈয়দ হকের নরক ও ফুলের কাহিনী নামক স্মৃতিশাস্ত্রে? তিনি একে বলছেন ‘ছেলেবেলার কাহিনী’। কেন নয় মেয়েবেলা—লিঙ্গবাচকপত্নীরা এই প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু বাঙাল সমাজে ‘মেয়েশিশু’কে ‘মেয়েছেলে’ বলারও কথ্য রূপ আছে। কেননা লিঙ্গ তথাস্তু, আর ভাবগতভাবে এতে শুদ্ধ ‘কাল’ই বিদ্যমান। কোনো কোনো উগ্র লিঙ্গবাচকপত্নী এতে নাখোশ হতে পারেন। তার এই ‘ছেলেবেলা’ বলার ভেতরে পুরুষতন্ত্র নাই। কোন রাগ-ঢাক ছাড়াই নিজের খণ্ড জীবন লিখেছেন তিনি। বহিতে জায়মান তার জন্ম থেকে বালিকা কাল। তার বয়ানে—
[...] আমার জন্ম হয় যশোর শহরের কোতোয়ালি থানার অধীন চুড়িপট্টি নামের একটি মহল্লায়।
মহল্লাটির নাম কেন চুড়িপট্টি? এখানে ছিল চুড়ির কারখানা বা ভাটিখানা। শুধু চুড়ি নয়। মাথার চিরুনিও এখানে তৈরি হত। আমাদের পুর্বপুরুষের অনেকেই চুড়ির কারখানা বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই কারণে অনেকে তাদের চুড়িঅলা বলেও সম্বোধন করত। [...]
[...] কেউ এখন আর নিজেদের চুড়িপট্টির চুড়িঅলাদের বংশধর বলে স্বীকার করতে চায় না। এখন চুড়িপট্টিও আর চুড়িপট্টি নেই। আমার এক দূর সম্পর্কের দাদার কর্মময় জীবনের সাফল্যকে স্মরণ করতে এখন হয়েছে হাজি আবদুল করিম রোড। [...]
[...] আমি সেই চুড়িঅলা বংশেরই মেয়ে। এক হাতে ফুলের গন্ধ, আরেক হাতে নরকের দুর্গন্ধ মেখে আমার জন্ম। [...]
[নরক ও ফুলের কাহিনী, পৃষ্ঠা ১০]
আনোয়ারা সৈয়দ হক © ছবি: ঢাকা অপেরা
তাঁর পরিবারের অনেকে ‘চুড়িঅলা’ উপাধিতে হেয় বোধ করত। লেখক সেই জাত-পাতের ধার ধারেন নাই। হেয় তো পরের কথা, তাঁর বলার ভেতরে বাড়ম্বরিতাও নাই। তিনি বংশের বিসম্বাদ করেছেন ইতিহাসের তলানি থেকে। বাঙালি হিন্দু নমঃশূদ্র কিংবা বাঙালি মুসলমানের সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিত হতে। মধ্যবিত্তের ভদ্রলোকী সমাজে উপরচালাকির একটা ব্যাপার থাকে। বাস্তব ঘটনা গোপন করার রেওয়াজ। লেখক সেই রেওয়াজের বরখেলাপ করেছেন। কুলধর্ম-পেশা-জাতপাত যে তাঁর পরিবারে বারে বারে বিপর্যস্ত ঘটনার মুখোমুখি হয়নি তা নয়, বহিতে সেসব ঘটনার বিবরণ ও নিপুণ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
আনোয়ারা সৈয়দ হকের নরক ও ফুলের কাহিনী বহির ভাষা প্রমিত। তবে সরল ও সাহিত্যভাবাপন্ন। স্মৃতির নিশানায় মঞ্জুলিকা তাঁর জন্ম থেকে স্কুল-কলেজ নাগাদ সময়কে চিহ্নিত করেছেন। তার পরের কাহিনি না লিখলে এটি হবে তাঁর খণ্ডিত ইতিহাস। আর এই বহি না লিখলে হয়তো পাঠক জানতই না লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হকের অপর নাম ‘মঞ্জুলিকা’। মঞ্জু মানে সুন্দর আর মনোহর। মঞ্জুলিকা কোনো ইতিহাস নন, কিন্তু তিনি সমাজের সদর-অন্দরের যে মনোহর কাহিনি বর্ণনা করেছেন, সেটাই তো ইতিহাস। এটি বাঙাল হিন্দু ব্রাহ্মণ, নমঃশূদ্র আর মুসলমান সমাজের জীবন-সংস্কৃতির নকশা।
কিন্তু বহিতে জন্মের সন-ক্ষণ না থাকলেও একটা জিনিস স্পষ্ট লেখকের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে। আর্থিক দৈন্যভাব মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে তখন। ক্ষুধায় আর্ত এই শিশুর পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে পিতার জীবন সাবাড়। পিতাও ছল করতেন। আধসের দুধ কিনে আধসের পানি মিশাতেন। শিশুর পিতার এই খাসলত মা বুঝতেন। কিন্তু উপায় কী? যেখানে গরুর খাবার নেই সেখানে দুধ আসবে কোথা থেকে? শেষমেশ মা-ই এলাহি ভরসা।
একবার পাঁচড়া রোগে আক্রান্ত হন আনোয়ারা। হোমিওপ্যাথির চিকিৎসায় তার বালাই-মুসিবত দূর হয়। দাদি ফাতেমা চৌধুরী নাদুসনুদুস ফুটফুটে সেই শিশুর নাম রাখেন মঞ্জুলিকা। তাঁর পিতৃদত্ত নাম আনোয়ারা খাতুন চৌধুরী। মঞ্জুলিকার ভাবগত ইতিহাস পরের মাথায়। কিন্তু দুনিয়ায় আসার আগের ইতিহাস সাংঘাতিক! মঞ্জুলিকার মা তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। বড় বা সৎ মা দেশোয়ালি মুসলমান, আপন মা বাঙালি হিন্দু। শুদ্ধ হিন্দু নহে, খাঁটি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে প্রতিমা মুখোপাধ্যায়। সম্প্রদায়ের কুল-কুষ্টি খেয়ে প্রতিমাই একদিন আসিয়া খাতুন চৌধুরী নামে স্বামী গোলাম রফিউদ্দিন চৌধুরীর ঘরে আসেন। তখন সম্প্রদায়-সম্প্রদায় সম্পর্ক উথাল-পাতাল। তার বয়ান—
শুনেছি আমার মা-বাবার বিয়ে নিয়ে কোলকাতার হিন্দু মহাসভা ক্ষেপে আগুন হয়। এই সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানটি বরাবরই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের ভেতরে হিংসা-দ্বেষ এবং প্রতিহিংসা বজায় রাখার জন্য বিখ্যাত ছিল; খবরের কাগজে বিবরণ মুসলিম যুবক কর্তৃক হিন্দু যুবতী অপহরণ এবং বিয়ে ইত্যাদি।
[নরক ও ফুলের কাহিনী, পৃষ্ঠা ২৯]
সকলে মানবেন, জগৎ সংসারে কে কখন কার সাথে সম্বন্ধ পাতে বলা মুশকিল। কিন্তু এমন সময়ে প্রতিমা আর গোলাম সাহেবের বিয়েটাও একটা বিপ্লবাত্মক ব্যাপার। হিন্দু-মুসলমানের সংস্কারের ট্যাবু ভেঙে দিলেন তাঁরা। যৌবনের দুধারি বেপরোয়া তরবারির তেজ আর কাকে বলে! সেই সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মুখ দেখাদেখি তো সহনশীল ব্যাপার, কিন্তু মুখ কাটাকাটিও যে স্বাভাবিক সংস্কারে পরিণত হয়েছিল, তা বর্তমান লেখকের জবানিতে বেশ কবার দেখা মেলে। কুসংস্কারের ধর্ম আর সংস্কৃতির ট্যাবু মনুষ্যরূপী বান্দাকে মানুষ হয়ে ওঠার পথ বাতলে দেয় না। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের ট্যাবু নিয়ে সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদ যত না ধর্মগত, তার চেয়ে রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধির কৌশল এতে প্রয়োগ হয়েছে বেশি। ধর্ম মাত্র ধারণ করে। এটা সংস্কৃতির রূপ। এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়কে ধারণ করার ভিতর সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধির নিরসন সম্ভব। সেটাকে বলা যায় সম্প্রদায়গত মহামিলন। মঞ্জুলিকাও মনে মনে পুষতেন সম্প্রদায়-সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই মিলনের কথা।
বাল্যকাল থেকে মঞ্জুলিকা ডানপিটে স্বভাবের। সারা দিন বিড়বিড় করা ছিল অভ্যাস। টইটই করে গাঁ ঘুরে বেড়ানোর শখ। ফলে পরিবারের পরিজনেরা ভাবল, মঞ্জুলিকাকে ভূতে আছর করেছে। ওঝা ডাকা হলো। ওঝার ঝাড়ফুঁকের জন্য সব আয়োজনও হলো। গভীর রাতে ঘরে এসে বাদ সাধলেন তাঁর বাবা। এদিকে ওঝার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে নেমে পড়লেন গোলাম সাহেব। তার আগেই পয়সাকড়ি হাতিয়ে ওঝা সাহেব তো মৌরসিপট্টি। আর মঞ্জুলিকার ভূত তাঁর কাঁধে রহিয়া গেল! বাঙালি মুসলমান বা হিন্দু সমাজের অন্ধবিশ্বাস থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিল না তাদের পরিবার। শুদ্ধ তখন নয়, এমন সামাজিক চালচিত্র বাঙাল সমাজে এখনো বিদ্যমান।
লেখা-পড়ার প্রতি ঝোক তাঁর ছোটকাল থেকেই। বহি-পত্রপত্রিকার প্রতি তাঁর দরদ বিস্তর। খুঁজে খুঁজে গল্পের বহি পড়াই তাঁর স্বভাব। মা-দাদির মুখে মুখে শুনেছেন রূপকথার গল্প। গল্পের বহি সংগ্রহের বিবরণেই ছিল [...] হয়রানির কথা! পাঠক, সে কথা বইয়ে পড়ে নেওিয়াই শ্রেয়। বহিতে উঠে এসেছে অনুভূতি-প্রেম-হৃদয়ের আশা-হতাশার বয়ান। তাঁর মতো এমন সরল সাদামাটা স্বীকারোক্তি খুব কম স্মৃতিকথায় দেখা যায়। জীবনের সদর-অন্দর পরখ করার মতো এমন সাহস খুব কম বাঙালি লেখিকার আছে। বহিখানার কোনো কোনো ঘটনা পড়তে পড়তে বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ রচনার এক কাহিনি মনে পড়ছে। বেগম রোকেয়ার যাত্রাপথের কাহিনি। পথিমধ্যে একদল যাত্রী কানাকানি করছে। রোকেয়ার বয়ান—
[...] পথিকা স্ত্রীলোকেরা আমার দিকে চাহিয়া হাস্য পরিহাস করিতেছিল। আমি তাহাদের ভাষা না বুঝিলেও ইহা স্পষ্ট বুঝিতেছিলাম যে, তাহাদের উপহাসের লক্ষ্য বেচারি আমিই। সঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম—
‘উহারা কী বলিতেছে?’
উত্তর পাইলাম—‘উহারা বলে যে, আপনি অনেকটা পুরুষভাবাপন্ন।’
পুরুষভাবাপন্ন ইহার মানে কী?
ইহার অর্থ এই যে, আপনাকে পুরুষের মতো ভীরু ও লজ্জা নম্র দেখায়।
পরিবারের অনেকে ‘চুড়িঅলা’ উপাধিতে হেয় বোধ করত। লেখক সেই জাত-পাতের ধার ধারেন নাই। হেয় তো পরের কথা, তাঁর বলার ভেতরে বাড়ম্বরিতাও নাই। তিনি বংশের বিসম্বাদ করেছেন ইতিহাসের তলানি থেকে। বাঙালি হিন্দু নমঃশূদ্র কিংবা বাঙালি মুসলমানের সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিত হতে। মধ্যবিত্তের ভদ্রলোকী সমাজে উপরচালাকির একটা ব্যাপার থাকে। বাস্তব ঘটনা গোপন করার রেওয়াজ। লেখক সেই রেওয়াজের বরখেলাপ করেছেন। কুলধর্ম-পেশা-জাতপাত যে তাঁর পরিবারে বারে বারে বিপর্যস্ত ঘটনার মুখোমুখি হয়নি তা নয়, বহিতে সেসব ঘটনার বিবরণ ও নিপুণ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
আনোয়ারা সৈয়দ হক © ছবি: ঢাকা অপেরা
শুদ্ধ ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার ইতিহাস লেখেন নাই তিনি, লিখেছেন ব্রিটিশরাজের নির্যাতনের কথা। হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান ভাগের কাহিনি। বয়ানকৃত কাহিনির ভেতর অনেক বাস্তব ঘটনা উঠে এসেছে। এসেছে সে সময়কার চুড়িপট্টির হাল হকিকত। মানুষের অসহায় মুখ। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দেশ ত্যাগের কাহিনি। আছে নিম্নবর্ণের জাতিগোষ্ঠীরা কীভাবে এই দেশে থেকেছেন। সকলে মানবেন, শূদ্র ওর্ফে নিম্নজাতিরা শাসিত হন উচ্চজাতির মানব দিয়ে। তাই নিম্নরাই বেশি শিকার হন নিষ্পেষণের। লেখিকা পরিবার সমাজ রাষ্ট্রকে এক করে দেখেননি। দেখেছেন আলাদা আলাদাভাবে। স্মৃতির সঙ্গে যুক্তি মিলিয়ে ইতিহাসের ব্যাখ্যা করেছেন। শুধু চুড়িপট্টি নয়, দেখিয়েছেন যশোরের একাংশের রাজনৈতিক-জীবন সংস্কৃতির ইতিহাস। বহিতে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বাঙাল নওজোয়ানদের জেগে ওঠার বয়ান—
[...] কাকিমা বলেন, বাঘা যতীনের মতো বিপ্লবী এদেশে আর হবে না বুঝলি?
কী রকম কাকিমা?
মানে এ রকম সাহসী বিপ্লবী আর হবে না। কাকিমা বলেন। তারপর বলেন, বিপ্লবীদের জীবন কী যে কষ্টের ছিল, তা কাউকে বলে বোঝানো মুশকিল। ইংরেজদের খপ্পর থেকে ভারতবর্ষকে বের আনার জন্য তাদের যে সংগ্রাম, ইতিহাসে তা সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। [...]
[...] কাকিমা বলেন, বাঘা যতীনের নাম বাঘা যতীন কী করে হলো বল তো?
উত্তরে মাথা নেড়ে বলি, তা তো জানিনে কাকিমা।
তাহলে শোন, কাকিমা বলেন, একবার জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে থাকতে গিয়ে তিনি বাঘের কবলে পড়ে যান। সেদিন তার হাতে কোন অস্ত্র নেই। শেষে কী করেন? যুবক মানুষ তিনি, বুকে অসীম সাহস, খালি হাতেই তিনি বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঘটাকে মেরে ফেলেন।[...]
[নরক ও ফুলের কাহিনী, পৃষ্ঠা ১৪৮]
[...] বস্তুত বাংলা বিভক্তির পেছনে মূলেই ছিল বাঙালি মুসলমানের প্রতি বাঙালি হিন্দুর ভয় ও অবিশ্বাস। এই ভয় ডাক্তার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ভেতরেও ছিল এবং তার মতো অনেক জ্ঞানী এবং সংস্কৃতমনা হিন্দুর ভেতরে ছিল। শুধু ভয় ছিল বললে ঠিক হবে না। ভয়ের সাথে ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা আর অবিশ্বাস।
বিশেষ করে ডাক্তার শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরীর [নাকি মুখার্জি] চোখে আমরা মুসলমানেরা ছিলাম, ‘a set of converts from low caste HIndus [Hindus] to Islam এবং তার এই দৃষ্টিভঙ্গি তখনকার দিনের অনেক হিন্দুরই দৃষ্টিভঙ্গি বলা যায়।[...]’
[...] আর বাংলা যেই ভাগ হল, এক ভাগ হল পূর্ব পাকিস্তান আরেক ভাগ হলো পশ্চিমবঙ্গ, [অ]মনি সুড়সুড় করে উচ্চবর্ণের হিন্দু বর্ডার পেরিয়ে হাজির হলেন কোলকাতায়, তাদের তীর্থস্থানে। আর পেছনে ফেলে গেলেন তাদের ডোম, মুচি, সাঁওতাল এবং নমশূদ্র ভাইদের, [...]
[ নরক ও ফুলের কাহিনী, পৃষ্ঠা ১৮৬]
তিনি বাঙালি মুসলমান বলে এ রকম উক্তি করেননি। হিন্দু সমাজের কূপমণ্ডূকতা নিয়ে যেমনি কথা বলেছেন, ঠিক তেমনি বলেছেন মুসলমান সমাজের কুসংস্কার নিয়ে। এটাকে নৈর্ব্যক্তিকই বলা চলে। কেননা তাঁর বর্ণনায় নমঃশূদ্রদের প্রতি পক্ষাবলম্বন নয়, সমাজের নির্যাতিত মানুষের মুখচ্ছবি। তবে বহিতে ঘটনার পরম্পরার খামতি আছে। ঘটনার পর ঘটনা বর্ণনায় নানা দৃশ্যের উদয় হয়। নানা পাটাতনে নানা ভাগ হয়ে ডালাপালা ছড়াতে থাকে। বিবরণ দু-এক স্থানে অগোছালো। এতে দেখা গেছে বয়ানের মন্তাজে কোথাও কোথাও ছেদ ঘটেছে। ভালো সম্পাদনার অভাবে এমনটি ঘটেছে। সম্পাদনার অভাব শুধু আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘নরক ও ফুলের কাহিনী’ বহির বেলায় নহে। আমাদের দেশে যারা স্মৃতিকথা বা আত্মকথা লিখে থাকেন, তাদের বহিতেও একই রকমের সংকটের মুখোমুখি পড়তে হয় পাঠক-সমালোচককে। বেশির ভাগ বহিতে যথাযথ ফুটনোট, তথ্যসূত্র আর নির্ঘণ্ট থাকে না। এ বড় মুশকিল বটে!
মোটা কথায়, আনোয়ারা সৈয়দ হকের নরক ও ফুলের কাহিনী বহির ভাষা প্রমিত। তবে সরল ও সাহিত্যভাবাপন্ন। স্মৃতির নিশানায় মঞ্জুলিকা তাঁর জন্ম থেকে স্কুল-কলেজ নাগাদ সময়কে চিহ্নিত করেছেন। তার পরের কাহিনি না লিখলে এটি হবে তাঁর খণ্ডিত ইতিহাস। আর এই বহি না লিখলে হয়তো পাঠক জানতই না লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হকের অপর নাম ‘মঞ্জুলিকা’। মঞ্জু মানে সুন্দর আর মনোহর। মঞ্জুলিকা কোনো ইতিহাস নন, কিন্তু তিনি সমাজের সদর-অন্দরের যে মনোহর কাহিনি বর্ণনা করেছেন, সেটাই তো ইতিহাস। এটি বাঙাল হিন্দু ব্রাহ্মণ, নমঃশূদ্র আর মুসলমান সমাজের জীবন-সংস্কৃতির নকশা। এই নকশা ইতিহাসের দায় না মেটালেও ইতিহাসের খোরাক জোগাবে। পাঠক, বহিখানা পড়লে স্মৃতি যে কত বড় উচ্ছৃখল সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। মনে মনে, চেতনে অচেতনে।