ইহুদিবিদ্বেষী এক বীর স্লোভাক ভাষাতাত্ত্বিক
গাস্তন ডোরেন
গাস্তন ডোরেন একজন ভাষাতাত্ত্বিক, সাংবাদিক এবং বহুভাষাবিদ। তিনি ওলন্দাজ, লিম্বার্গিশ, ইংরেজি, জর্মন, ফরাসি এবং হিস্পানি ভাষায় কথা বলতে পারেন, পড়তে পারেন আফ্রিকানস, ফ্রিসীয়, পর্তুগিজ, ইতালীয়, কাতালান, ডেনিশ, নরওয়েজীয়, সুইডিশ ও লুক্সেমবুর্গিশ। ওলন্দাজ ভাষায় তিনি দুটো গ্রন্থ রচনা করেছেন— অভিবাসীদের ভাষা নিয়ে রচিত Nieuwe tongen [New Tongues] এবং Taaltoerisme [Language Tourism]; যে বইয়ের ওপর ভিত্তি করে Lingo: A Language Spotter’s Guide to Europe ইংরেজিতে রচিত হয়েছে, এবং তৈরি হয়েছে Language Lover’s Guide to Europe নামের একটি অ্যাপ [বক্ষ্যমাণ রচনাটি Lingo বইটিরই একটি নাতিদীর্ঘ অধ্যায়ের অনুবাদ]। অবসরে গাস্তঁ দোরেন গান গাইতে পছন্দ করেন এবং অবশ্যই তা বহু ভাষায়। নেদারল্যান্ডসের আমার্সফুর্ট-এ তিনি সস্ত্রীক বাস করেন। অনুবাদ করেছেন জি এইচ হাবীব।
আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকেরা একাডেমিয়ার চৌহদ্দির বাইরে সাধারণত পা রাখেন না। আর যদি কখনো তাঁদেরকে উঁচু গলায় কিছু বলতে হয় তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা তাঁদের তত্ত্বের সমর্থনে, নয়তো তাঁদের গবেষণা বাজেটের কারণে। নিজেদের সময়ের বড় বড় সমস্যার ক্ষেত্রে তাঁরা তেমন একটা কথা বলেন না; যদি কেউ বলেন তো দেখা যায় লোকটি নোম চমস্কি।
অবশ্য ব্যতিক্রম আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বহু ভাষাতাত্ত্বিকেরই জাতীয়তাবাদী কর্মসূচি এবং আন্দোলনের প্রতি একটা আগ্রহ ছিল, বিশেষ করে ইউরোপের সেই অংশটুকুতে যা ফিনল্যান্ড থেকে একেবারে গ্রিস অব্দি বিস্তৃত। আর এসব ভাষাতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদীর মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন লুদোভিত শ্টুর [২৮ অক্টোবর, ১৮১৫—১২ জানুয়ারি, ১৮৫৬]।
নামটি কখনো শুনেছেন বলে মনে হচ্ছে না তো? না শোনারই কথা। পশ্চিম ইউরোপে তিনি একেবারে অবজ্ঞাত; ডায়াক্রিটিক্যাল চিহ্নভারাক্রান্ত তাঁর নামটি উচ্চারণ করা তেমন কঠিন নয় যদিও।
আর, ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চলে তাঁকে কেউ না চিনলেও, তাঁর স্বদেশ স্লোভাকিয়ায় তিনি ঘরে ঘরে সমাদৃত। তাঁর অনেক সহযোদ্ধাই তাঁর কবিতা মুখস্থ বলতে পারেন [পাবলিক ফিগাররা তখন কবিতা লিখতেন, এখন যেমন তাঁরা টেলিভিশনে মুখ দেখান]। যে বাড়িতে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন, সেটি এখন একটি জাদুঘর, ঠিক যেমন যে ঘরে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সেটিও [প্রথম জাদুঘরটির অবশ্য আরেক দাবিদার আছেন; মানে একই বাড়িতে আরেকজনের জন্ম হয়েছিল, তিনি প্রাগ বা প্রাহা বসন্তের প্রথম সারির রাজনীতিক আলেকজান্ডার দুবেক। উরোভেক নামের ছোট্ট সেই শহরটার সেই বাড়িতে শ্টুর জন্মেছিলেন ১৮১৫-তে, আর দুবেক ১৯২১-এ]। এবং সারা দেশেই তাঁর মূর্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গত শতকের শেষ দুই দশকে যখন স্লোভাকিয়ার নিজস্ব কারেন্সি ছিল, তখন ৫০০ কোরুনার নোটে তাঁর প্রতিকৃতি ছিল। আর, তাঁকে যে কেবল একটি অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট দেওয়া হয়েছিল তা-ই নয়, একটি অ্যাওয়ার্ড তাঁর নামেই দেওয়া হয়ে থাকে।
এত কিছুর পরেও, নিজের জীবনকে তিনি নিশ্চয়ই এক করুণ ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেননি। ঘটনাবহুল এবং আশায় পরিপূর্ণ ১৮৪৮ সালে মনে হয়েছিল তাঁর দুই বড় স্বপ্নসাধ—স্লোভাকদের জন্য স্বায়ত্তশাসন অর্জন এবং স্লোভাককে একটি রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করা—বুঝি পূরণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু শিগগিরই তা ভেস্তে গেল; স্লোভাকিয়া একটি হাঙ্গেরীয় ভাষার নির্ভরতা হিসেবেই রয়ে গেল; তার ভাষা স্বীকৃতি পেল না। সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী, এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধের একজন প্রবক্তা হিসেবে শ্টুরের অক্লান্ত পরিশ্রমের কোনো ফল ফলল না।
এরপর নিয়তির কোপ নজর পড়ল তাঁর পারিবারিক জীবনের ওপর। প্রথমে তাঁর ভাই ক্যারল সাতটি সন্তান রেখে মারা গেলেন; লুদোভিতকে তাদের দায়িত্ব নিতে হলো। এরপর, দুই বছরের মধ্যে তাঁর বাবা, মা, এবং তাঁর সবচেয়ে কাছের বান্ধবী—সবাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। শ্টুরের পালা এলো ঠিক আড়াই বছর পর, চল্লিশ বছর বয়সে। মৃত্যুটাও হলো একেবারে অ-বীরোচিতভাবে: শিকার করার সময় সামান্য একটা বাধা লাফ দিয়ে পার হতে গিয়ে নিজের বন্দুকের গুলি তাঁর নিজেরই গায়ে লাগে। পায়ে সেই বুলেটের আঘাতের কারণেই কয়েক হপ্তা পর তাঁর মৃত্যু ঘটে, ১৮৫৬ সালের ১২ জানুয়ারি।
কিন্তু তাহলে এসব মূর্তি, জাদুঘর, ব্যাংক নোট, সম্মান—এগুলো কিসের জন্য? মুখ্যত তাঁর একটি অক্ষয় কীর্তির জন্য: একটি সুসংহত স্লোভাক ভাষা সৃষ্টির জন্য। জার্মানি থেকে ভাষাতত্ত্ববিষয়ক পড়াশোনা করে আসার পর তিনি মুখ্যত কেন্দ্রীয় স্লোভাক উপভাষাগুলোর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন মান স্লোভাক ভাষা তৈরির কাজ শুরু করেন। এর আগে অব্দি স্লোভাকদের দুটো সাহিত্যিক ভাষা ছিল—একটি, পশ্চিমা উপভাষানির্ভর ক্যাথলিক, অন্যটি প্রটেস্ট্যান্ট—চেক ভাষার খানিকটা ‘স্লোভাকিয়ান’ রূপভেদ। প্রমিতকরণটি ছিল অন্যান্য ভাষাতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিকের অংশগ্রহণভিত্তিক একটি দলীয় প্রচেষ্টা। কিন্তু স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কোনো দলে যোগ দিলে তার নেতৃত্ব গ্রহণের একটি প্রবণতা ছিল শ্টুরের মধ্যে। কাজেই, গ্রন্থকার হিসেবে তাঁর নামেই স্লোভাক ভাষার একটি নির্দেশনামূলক [প্রেসক্রিপ্টিভ] ব্যাকরণ ও বানানের বই Nauka reci Slovenskej বের হয়, ১৮৪৬ সালে। এর মধ্যে তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা নতুন ভাষাটি জাতীয়তাবাদী কবিতা, পত্র-পত্রিকা, এবং নানা বইয়ে ব্যবহার করতে থাকেন। পরে বানান সংস্কার বা পরিবর্তন করা হয়, যদিও সব সময় তার ফল ভালো হয়নি, কিন্তু তারপরেও, আজকের লিখিত স্লোভাক প্রধানত Nauka অনুসারী। আর সে কারণেই এই জয়ধ্বনি: শ্টুরই স্লোভাক ভাষার স্রষ্টা, এবং স্লোভাকই স্লোভাকিয়া তৈরি করেছে, যদিও পরেরটি আসতে তখনো অনেক দিন বাকি ছিল।
পাদটীকা
১. ‘ডব্রো’ [dobro] নামের একধরনের গিটার স্লোভাক-আমেরিকান ডপিয়েরা ভ্রাতাদের তৈরি। ‘ডব্রো’ বলতে ডপিয়েরা ভ্রাতাদের বোঝালেও কথাটার আরেকটা মানে ‘ভালো’ এবং সেটা কাকতালীয় নয়।
২. প্রজনোভিত [proznovit] – কারও ফোনে মাত্র একবার রিং বাজানো, এই আশায় যে তারা কল ব্যাক করবে [সোজা বাংলায়, মিসড কল দেওয়া; বা কোনো সংকেত হিসেবে]। মজার ব্যাপার হলো, অনেক ভাষাতেই এই কাজ বোঝাতে নানান শব্দ ব্যবহার করা হয়, যেমন হিস্পানিতে বলে dar un toque, মানে, কাউকে নক করা।
৩. ব্যাপারটি দুর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের এই বীর স্লোভাক ভাষাতাত্ত্বিক একজন ইহুদিবিদ্বেষী ছিলেন এবং ছিলেন এই বিভেদ তত্ত্বের প্রবক্তা যে স্লোভাক ইহুদিরা স্লোভাক জাতির অংশ হতে পারবে না।
লেখা ভালো লেগেছে। তথ্যঋদ্ধ, পরিমিতিসম্পন্ন। শ্রদ্ধা জানাই লেখক ও লেখার অনুবাদককে। মনের কাঁটা হয়ে খচ খচ করছে শিরোনামটা। মন বলছে, এমন শিরোনাম অত্যন্ত রূঢ় ও অসম্মানজনক। এবং লেখার মূল অংশ সাপেক্ষে অপ্রাসঙ্গিক।
হামিম কামাল
অক্টোবর ১৩, ২০২২ ১২:৩৩
অজানা তথ্য জানলাম তবে শিরোনামে ইহুদীবিদ্বেষী এক বীর স্লোভাক- ব্যবহারের কারনটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি- বর্ণবাদী শিরোনাম । ধন্যবাদ
প্রতাপ দাস
সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২২ ১৬:৩৬