দেশভাগে উত্তরবঙ্গ এবং তারপর

 

দেশভাগে যে যুক্তিতে একটি ভারতীয় উপমহাদেশ কেটে দু টুকরা করা হয়েছিল, একই যুক্তিতে বাংলার বুক চিড়ে রক্তরেখা আঁকা হয়ে গেল এবং প্রান্তিক জনপদ উত্তরবঙ্গ এই ভাগ-বিয়োজনের খেলা হতে বিচ্ছিন্ন নয়, অভিন্ন; উত্তরবঙ্গ কর্তিত হয়ে এক দেশ ভেঙে দুটি রাষ্ট্র ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান গঠনে ভূমিকা রাখল।

দেশভাগে একটা দেশ-ই দুই খণ্ড হয়নি, ঘটে গেল এক বিস্তর অশ্রু-রক্ত-অপরাধ চিহ্নিত মানব-বিপর্যয়।

প্রতিহিংসার প্রেরণায় সীমানার দু'ধারে তখন হানাহানি, রক্তারক্তি, ভয়-ভীতি, বাস্তুচ্যুতি সব অঙ্গাঙ্গি জড়িত। অনাহারী সেই সব দিনরাতে ছক অনুযায়ী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল; রাজশাহীর সান্তাহার স্টেশনেও অসংখ্য হিন্দুকে ট্রেন থামিয়ে টেনে নামিয়ে হত্যা করা হয়েছিল; রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল মজিদের মতো ব্যক্তি পূর্ববঙ্গের মুখ্য সচিব আবদুল আজিজের সঙ্গে মিলে হিন্দু বিতাড়নের চক্রান্তকারী ছিল।

প্রমত্ত হিংসার প্রদর্শনীতে একটি পরিবার যখন বাস্তুত্যাগ করেঘটে যায় বাস্তুনাশ, ভয় তখন সর্বনাশ, এতকালে চেনা প্রতিবেশী হয়ে ওঠে আততায়ী; আবার দেখা যায় অনুতপ্ত প্রতিবেশীর কুণ্ঠা, যারা সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে ব্যর্থ হয়েছে; চেনা গণ্ডি, চেনা মানুষজন অচেনা হয়ে পড়ে; নীরবতা কখনো প্রতারণা হয়ে ওঠে।

কলকাতার দাঙ্গা ছেচল্লিশের আগস্টে ঘটে গেলে পরে অক্টোবরে সংঘটিত হয় নোয়াখালীর দাঙ্গাযেহেতু সেখানে ধর্মান্ধ মৌলবাদের ঘাঁটিতাই মৌলবাদীদের প্ররোচনায় হিন্দুদের আত্মনাশ, জাতিনাশ, ধর্মনাশ, বাস্তুনাশ, নারীত্ব নাশ এতটা তীব্রতায় প্রকাশ পেয়েছিল যে, দাঙ্গার তীক্ষ্ণতা, ধারালো অস্ত্রের মতো দেশভাগে ব্যবহৃত হয়েছিল।

দেশভাগে মানুষের দেশ বদল হয়নি শুধু, বদল হয়েছে পাড়াপড়শি, ভাগ হয়েছে পরিবার, ভাই ভাইয়ের থেকে, বোন বোনের থেকে পৃথক হয়েছে, পিতামাতা বিচ্ছিন্ন হয়েছেন সন্তানের কাছ হতে।

দেশভাগ বিভক্ত করেছিল তেভাগা আন্দোলনকেও; আন্দোলনের নেতা-কর্মী অনেকে চলে গিয়েছিলেন পশ্চিম বাংলায়। পূর্ববঙ্গের দিনাজপুরে ১৯৪৬-এর শেষে সাম্প্রদায়িক বিষদাঁতকে উপেক্ষা করে হিন্দু-মুসলমান সংগ্রামী কৃষকেরা মিলিতভাবে গড়ে তুলেছিল তেভাগা আন্দোলন তিনভাগ ফসলের দুভাগ দাবিতে। তবে এই আন্দোলন বর্গাচাষিদের বাড়তি ফসল আদায়ের দাবি নয়, তা ছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কৃষকদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে এবং রাজশক্তি কঠোরভাবে দমন করে মৃত্যুর মিছিলে শামিল করে কৃষকদের উপনিবেশিত স্বাধীনতার প্রাক্কালে।

নতুন রাষ্ট্রে স্তিমিত সেই তেভাগা আন্দোলন আবার গর্জে ওঠে। কৃষকদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তান কায়েম হলে তাদের দুঃখ-বঞ্চনা দূর হবে; কিন্তু সেই আশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে না; প্রতারিত কৃষক সমাজ লাঙল-কাস্তে হাতে তুলে নেয় আবার প্রতিবাদে-প্রতিরোধে। ইতিমধ্যে সুশীল সেনের মতো অনেক নেতা চলে গেছেন ভারতে; যাঁরা আছেন তাঁদের অনেকে জেলে রাজবন্দি। ১৯৫০ সাল নাগাদ এ আন্দোলন নির্মম নিষ্ঠুর শাসকদের আক্রোশে স্তিমিত হয়ে যায়।

কৃষক নেত্রী ইলা মিত্র নাচোলে সাঁওতাল চাষিদের জোট করে আন্দোলনে ফুঁসে উঠলে তাদের ওপর নেমে আসে শাসক গোষ্ঠীর নারকীয় অত্যাচার।

দেশভাগ যেমন ধর্মীয় উন্মাদনার ফসল, তেমনি ধর্মীয় ভাবাবেগ, জাতিহিংসামানুষকে অনেকখানি একে অপরের থেকে দূরে হটিয়ে দেয়; ধর্মীয় কিংবা গোষ্ঠীগত কারণে এবং শ্রেণিস্বার্থ চরিতার্থ করতে মানুষের সঙ্গে অমানুষ এসে পার্থক্য তৈরি করেছে

জেল থেকে বিপ্লব-এর লক্ষ্যে রাজবন্দি কমিউনিস্ট নেতারা সে সময় আমরণ অনশনে জীবনবাজি সংগ্রামে লিপ্ত হলে তাদের ওপর একপর্যায়ে ১৯৫০-এ রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি বর্ষণ করা হয়।

দমন-পীড়ন নিষ্ঠুরতায় নেতারা এই উপদ্রুত জনপদ ত্যাগ করলে সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ অসহায় বোধের শিকার হলো এবং আশা-ভরসার স্থান হারিয়ে নিম্নবর্গের হিন্দু চাষিরা অধিক বিপন্ন এবং অস্তিত্বের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিপতিত হলো। বোধ করি কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীরা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যর্থ হয়ে দেশ ত্যাগ করে আরেকটি বিপ্লব গড়ে তুলতে পশ্চিম বাংলা গমন করলেন।

দেশ ত্যাগের প্রধান কারণ হলো মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট। হিন্দু জনগোষ্ঠী, বিশেষত অবস্হাপন্ন হিন্দুরা বংশপরম্পরায় জমি ভোগ করেছেন, সামাজিক মর্যাদা পেয়েছেন; এখন তাঁরা অনুভব করলেন, দেশটার অধিকার আর তাঁদের হাতে রইল নানিজ বাসভূমে তাঁরা পরবাসী হয়ে গেলেন। কখনো স্পষ্ট ঘোষণা, কখনো প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে হুমকি দেশান্তরি করে ছাড়ে তাঁদের।

১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের স্বাধীনতা লাভ সূত্রে নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার আনন্দে নাগরিকেরা ছিলেন আনন্দিত-উদ্বেলিত। শুধু প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় নয়, রাজশাহীতেও স্বাধীনতা উদযাপনের মুহূর্ত ছিল উন্মাতাল করা। ১৯৪৬-এর পূর্বপরিকল্পিত দাঙ্গার ভয়াবহতার পর নোয়াখালীর দাঙ্গার আগে পর্যন্ত দেশভাগের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা ছিল কম, তবে পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রমকারী হিন্দু-মুসলমানদের সরাসরি রক্তাক্ত দাঙ্গার অভিজ্ঞতা দেশভাগের সীমানাকে রক্তাক্ত করেছিল। পূর্ব সীমান্তে ছিল অজানা আতঙ্ক, একধরনের Soft Violence

রাষ্ট্রলাভের আনন্দ-উল্লাস ক্রমে মূর্ছা লাভ করতে শুরু করল।

পূর্ববঙ্গ ক্রমে ব্যাপক উদ্বাস্তু অভিপ্রয়াণ ও উদ্বাস্তু আগমনের সংঘাতের স্থানে পরিণত হয়। অভিপ্রয়াণ করে আসা অবাঙালি মুসলিমরা সীমান্তবর্তী স্থানসমূহে অবস্থান গ্রহণ করতে থাকে। অভিবাসীদের সঙ্গে একাত্মতা তাদের গড়ে ওঠেনি।

মালদা ও মুর্শিদাবাদ হতে আগতদের মামু বলে সম্বোধন করা হয় রাজশাহীতে; মালদা হতে মা এবং মুর্শিদাবাদের মু চয়ন করে এই নামকরণ। এইভাবে চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বহিরাগতদের পরিচয় স্পষ্ট ও পৃথক করে তোলে; দেশভাগের সময় এই দুই জেলা হতে যারা রাজশাহীতে এসেছিল তারা হচ্ছে মামু

বিয়াল্লিশের বাংলা হতে দেখা যায় দিনাজপুর ও রংপুর জেলাতে খুব ধনী ও বড় মুসলমান জোতদার ছিল। বগুড়া জেলাতে বেশি হল শিক্ষিত মুসলমান মূলত উকিল, ডাক্তার প্রভৃতি। শহর-গঞ্জে উকিল, চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে পাবনা ও ঢাকার ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সাহা, কুণ্ডু বেশি।

দেশভাগের সময় হিন্দু সম্প্রদায় সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে অসহায়ত্ব বোধের তাড়না হতে দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাসহ উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। ধর্মীয় কারণে এবং জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা প্রস্থান করেছে। সেখানে তারা বহন করে নিয়ে গেছে যে মৌখিক ভাষা তাতে যেমন পার্থক্য আছে, এখানে আগতদের মৌখিক ভাষায়ও তফাত বিদ্যমান। অভিবাসিত জনগণের উচ্চারণ-প্রকৃতি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে এই অঞ্চলের মুখের ভাষাতে এবং একটি পার্থক্য গড়ে দেয়।

কলকাতার দাঙ্গা শেষ হতে না হতেই শুরু হওয়া নোয়াখালীর হিন্দু নিধনকারী দাঙ্গার পথ ধরে সংঘটিত বিহারের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের কলকাতা হয়ে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় পুনর্বাসন করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলায় আগত বাঙালি মুসলমানরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল রুচি-মূল্যবোধ-আধুনিকতা-মুক্তচিন্তা-আচার-রীতি-আচরণ, অপরপক্ষে শরণাগত অবাঙালি মুসলমানরা ছিল দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত, হতদরিদ্র, বোধবুদ্ধি শূন্য বিবেকহীন। তাদের চলন-বলন কোনো বিবেচনায় বাঙালিদের সাযুজ্যপূর্ণ না হলেও এখানে তাদের আশ্রয়ণ ঘটে। উর্দুভাষী হওয়ার সুবাদে তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় বদান্যতার অভাবও ঘটে না; অচিরেই তারা দখল করে নেয় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত হিন্দু পরিত্যক্ত সম্পত্তি এবং নিম্নপদস্থ নানা প্রকার চাকরিলাভও করে তারা।

সম্পদশালী ও শিক্ষিত অবাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধুতে চলে যায়; সেখানে বসবাস তাদের জন্য উপযুক্ত মনে করেছিল।

পূর্ব বাংলায় আগত অবাঙালি বিহারি মুসলমানদের পরিকল্পিতভাবে সরকার হতে জায়গা করে দেওয়া হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রামে যেমন, তেমনি উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়াসহ বিস্তৃত জনপদের বিভিন্ন স্থানে। তারা চাকরি পেয়েছিল এখানে রেলওয়েতে। তাদেরকে উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে পুনর্বাসনের পর দেখা যায়, অনেক স্থানে মূল বাসিন্দার তুলনায় তাদের সংখ্যাধিক্য হয়ে গেছে।

এই বিহারিরা উত্তরবঙ্গে পুনর্বাসনের জন্য রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া সমন্বয়ে স্বতন্ত্র ভূখণ্ড নিউ বিহারিস্তান-এর দাবি করেছিল। তাদের এ দাবি পূর্ণতা না পেলেও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে বাঙালি নিধনে অংশ নিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে সেই বিহারিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। বাঙালিরা ছাড়া ৪৭-এর পরবর্তী কেউ আশ্রয় দেয় নাই অথচ ১৯৭১-এ তাদেরই বিরুদ্ধে জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তারা।

দেশভাগ যেমন ধর্মীয় উন্মাদনার ফসল, তেমনি ধর্মীয় ভাবাবেগ, জাতিহিংসামানুষকে অনেকখানি একে অপরের থেকে দূরে হটিয়ে দেয়; ধর্মীয় কিংবা গোষ্ঠীগত কারণে এবং শ্রেণিস্বার্থ চরিতার্থ করতে মানুষের সঙ্গে অমানুষ এসে পার্থক্য তৈরি করেছে।

তথ্যসূত্র

১। বিয়াল্লিশের বাংলা, নির্মলকুমার বসু, সারস্বত লাইব্রেরী, কলকাতা ২০০৭ সংস্করণ

২। দেশভাগ দেশত্যাগ, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ, কলকাতা ২০০৭ সংস্করণ

৩। কোরক, প্রাক-শারদ ১৪১৮, তাপস ভৌমিক সম্পাদিত, কলকাতা [বিশেষত আবুল হাসান চৌধুরী ও জীবনকুমার ঘোষ]

৪। দেশভাগ সংখ্যা, এবং অন্যকথা, সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ ঘোষ প্রমুখ, উত্তর ২৪ পরগনা ২০১৯ [বিশেষত অনিন্দিতা ঘোষাল]