মৃত্যুঞ্জয়ী লম্ফ
দুজনের মধ্যে কে আগে মরবে, তা নিয়ে কথা উঠলে ফার্স্ট হওয়ার জন্য ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতা হয় দুজনের মধ্যে। বয়সের বিচারে স্বামীটি সাড়ে চার বছরের বড়। বয়সের বিচারে বার্ধক্যের কোঠায় ঢুকেছিল দুজনই। নিজেদের বুড়ো-বুড়ি পরিচয় দিত সগর্বে। যৌবনের রঙ্গ-রস যেটুকু অবশেষ ছিল, তা কেবল একান্তে নিজেদের জন্য। সংসারের সব দায়দায়িত্ব পালন আর ঝক্কি-ঝামেলা শেষ। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিলিব্যবস্থাও হয়ে গেছে। ওপারে যাওয়ার জন্য এপারের কিনারে পা বাড়িয়ে বসে ছিল দুজনই। স্ত্রীর লাফ দেওয়ার ইচ্ছেটা বেশি জোরালো। প্রায়ই গুডবাই বলার ভঙ্গিতে বলত, ‘একদিন ইনসুলিন নেওয়া বন্ধ করলেই কিডনি কি হার্ট ফেইল করবে আমার। হাসপাতালে নিয়ো না কিন্তু! নিজের সংসারে থেকেই শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলতে দিয়ো।’
শেষ নিঃশ্বাস হরণের ক্ষমতা যে ওপরওয়ালার হাতে, তার কাছেও স্ত্রীর প্রার্থনার হাত উঠত নিয়মিত। রোগব্যাধিতে শয্যাশায়ী থাকার বদলে হুট করে একদিন আজরাইলের রথে চড়ে পরলোকে যাত্রার প্রার্থনাও জানিয়েছে ঘন ঘন। স্বামীকেও সরবে প্রায় শোনাত সে কথা। অন্যদিকে অনন্ত পরকালবাসের শান্তি নিশ্চিত করার বদলে ইহকালীন সুখ-সুবিধা ভোগের ব্যাপারে স্বামীটির ঝোঁক বেশি। তবে ওপরওয়ালার কাছে নির্ভেজাল চাওয়া ছিল এবং নিজের ক্ষমতারও সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করেছে সে স্ত্রীকেই দীর্ঘায়ু করার জন্য। নিজের হৃদযন্ত্রে দুটি রিং পরানো ছাড়াও শরীর আরও একটি অপারেশনের ধকল সয়েছে। চারটি দাঁত পড়েছে। নকল দাঁতে একটার গর্ত ভরেনি আর। মাথায় শুধু নয়, সর্বাঙ্গেই সাদা নিশান উড়িয়ে দিয়েছে বার্ধক্য। স্ত্রীকে তাই সাহস জোগাত স্বামীটি, ‘ডায়াবেটিস নিয়েও তোমার বড় বোন এখনো হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। আমি মরার পর তুমি বোনের চেয়েও ভালো থাকবে অন্তত পনেরো-বিশ বছর। আমার পেনশনের একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে পুরোটাই আমৃত্যু ভোগ করবে তুমি। এ আমার একান্ত ইচ্ছে। তা না হলে কিন্তু এ সরকারের কাছে মরেও বঞ্চনার শিকার হবো আমি। বুঝলে?’
গৃহবধূ হিসেবে সারা জীবন স্বামী-সংসারের সেবা করে এযাবৎ মাসে নিয়মিত পাঁচ হাজার টাকাও হাতখরচা পায়নি বউটি। নানা রকম খেঁচাখেঁচি ও সংসার খরচ এদিক-সেদিক করে নিজের প্রয়োজন মেটাতে হয়েছে। ভোগবিলাসী লোকটা নিজে ভোগের বদলে তার পেনশনের পুরোটাই স্ত্রীর ভোগে উৎসর্গ করতে চায়, এমন বিশ্বাস না জাগাই ছিল স্বাভাবিক। স্বামীকে তাই উল্টো উপদেশ দিয়েছিল, ‘আমি মরার পর দেখেশুনে গরিব দেখে কম বয়সী একটি কাজের মেয়েকে বিয়ে করো। তাহলে তোমার পেনশনের পঁচিশ হাজার টাকা সেই মাগী আমার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি ভোগ করতে পারবে। তুমিও শেষ বয়সে রসকষ পাবে ভালোই।’
একদা দ্বিতীয় কিংবা স্ত্রীর বিকল্প নারীকে কাছে পাওয়ার কল্পনাও রোমাঞ্চ জাগাত। কিন্তু অন্য মেয়েমানুষের দিকে স্বামীর গোপন চাউনিতেও হবু-সতীনের ছায়া দেখলে হিংসায় জ্বলত স্ত্রীটি। দ্বিতীয় নারী, বিশেষ করে একটি কাজের মেয়ের সংসর্গ নিয়ে বয়সকালে দাম্পত্য বিবাদ এবং ভুল-বোঝাবুঝির স্মৃতিও ভাণ্ডারে কম জমেনি। কিন্তু মৃত্যুর কিছুদিন আগেও স্বামীর পেনশনভোগ সম্পর্কিত স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শটি, সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর স্বামীর স্মৃতিতে দৈববাণীর মতো ঘুরেফেরে উদয় হতে থাকে।
স্ত্রীকে বরাবর মাথামোটা মানুষ মনে হতো তার। নিজের ছাত্রীজীবনে যেমন, তেমনি দীর্ঘ সংসার ও দাম্পত্য জীবনেও ব্রেনওয়ার্ক তেমন করেনি সে। সেই মানুষ কিনা ব্রেনস্ট্রোকে, তা-ও ফার্স্ট স্ট্রোকেই স্বামীর আগে মরবে, কে ভেবেছিল? স্বজনেরা কেউই এমন আশা করেনি। মৃত্যু যে কখনো সুন্দর জিনিস নয়, নিজের মরণে স্ত্রীটি দেখিয়ে দিয়ে গেছে। মুখখানা বাঁকা হয়ে পেত্নীর চেহারা পেয়েছিল। পরনের বস্ত্র নষ্ট হয়েছিল আপন বর্জ্যে। যথারীতি দাফন-কাফনের সময় পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। কিন্তু বাঁকা মুখ সোজা হয়নি আর।
২
গোরস্তান থেকে ফিরে আসার পর পুত্রবধূ স্বামী-শ্বশুরসহ সকলকে শুনিয়ে কান্নাভেজা গলায় সান্ত্বনা দেয়, ‘এমন স্ট্রোকের পরও মা প্যারালাইজড অবস্থায় বিছানায় থেকে কাউকে কষ্ট দেয়নি। মা বিছানায় পড়ে থাকলে বাবাই বেশি কষ্ট পেত। শেষ বয়সে রোগ-দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাকে এভাবে তুলে নিয়েছে। এটাও আল্লাহর অশেষ রহমত!’
স্ত্রীহারা হতে না হতেই ছেলের সংসারে ছেলেবউয়ের জিম্মায় নিজেকে অবাঞ্ছিত ও অসহায় মনে হয় স্বামীটির। স্ত্রী বেঁচে থাকতে এ রকম মনে হয়নি। পুত্রবধূ যেন আগে মরার জন্য শাশুড়িকে আল্লাহর রহমত প্রাইজ দিচ্ছে। আর বেঁচে থাকার জন্য শ্বশুরকে সে কী দেবে, তা ভাবার আগে দৈববাণীর মতো মনে পড়ে স্ত্রীর শেষ উপদেশটি, ‘আমি মরলে দেখেশুনে তুমি বরং বিয়ে করো আরেকটি।’ নাম্বার ওয়ান সেলফিশ পুত্রবধূর চরিত্র জানত বলেই হবু-সতীনকেও সে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু শেষ বয়সে নতুন বিয়ের ভাবনা আসার কষ্টেও সদ্য স্ত্রীহারা স্বামীর চোখ থেকে শোকের অশ্রু গড়ায়।
একা হওয়ার পর বড় ছেলের সংসারে আশ্রিত না হয়ে তার উপায়ও নেই। সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মেয়েটি, কিন্তু নিজস্ব সন্তান-স্বামী-সংসার নিয়ে সে প্রবাসী। ছোট ছেলের ছোট চাকরি। শ্বশুরবাড়ির তত্ত্বাবধানে থাকে ভাড়া বাসায়। অন্যদিকে নিজের গ্র্যাচুইটি-প্রভিডেন্ট ফান্ডের পুরো টাকাটা সে বড় ছেলের এই ফ্ল্যাট কিনতে দিয়েছিল শেষ বয়সে বুড়ো-বুড়ি এখানেই থাকবে বলে। বলা যায় বাপের কেনা ফ্ল্যাটেই বাস করছে ছেলে। এ ব্যাপারে তার পিতৃনির্ভরতা ছোটবেলার মতোই দ্বিধাহীন। কিন্তু পুত্রবধূ শাশুড়ি বেঁচে থাকতে সখেদে প্রায়ই বলত, ‘দুইজনই চাকরি করি আমরা, তারপরও শাশুড়ির সংসারে আশ্রিত হয়ে আছি! নিজের ফ্ল্যাট-সংসার কোনো দিনই হবে না আমার।’ শাশুড়ির আকস্মিক মৃত্যুতে শোকের অশ্রুর পেছনে তার নিজস্ব সংসার হওয়ার সুখটাও পষ্ট দেখতে পায় শ্বশুর। অনিচ্ছাতেও কখনওবা তার জামার ভিতরে ব্রাশিয়ারের অবয়ব দেখতে পায় যেমন।
ছেলে ও বউ—দুজনই অফিস করায় তাদের দুই সন্তান থাকত দাদু-দিদা ও কাজের মেয়েদের জিম্মায়। স্কুল-ক্লাস না থাকলে বাসায় দুই নাতি-নাতনির সঙ্গে প্রায় দিনেই যোগ দিত তাদের প্রতিবেশী ও সময়বয়সী কাজিন। নাতি-নাতনিদের খেলার দর্শক, সাথী, কখনো-বা রেফারির ভূমিকা পালন করতে হতো দাদুকেই। কিন্তু জ্বালাতনটা যে তাদের দিদার ওপর দিয়েই বেশি যেত, সেটা স্ত্রীর মৃত্যুর পর হাড়ে হাড়ে টের পেতে লাগল স্বামীটি।
দিদার মৃত্যুশোক কাটতে না কাটতেই, তার অনুপস্থিতির শূন্যতাও যেন খেলার মাঠ হয়ে যায় নাতিদের কাছে। দিদা বেঁচে থাকতে শোবার ঘরে কিংবা কিচেনে ছোটাছুটি ও লুকোচুরি খেলতে পারত না ওরা। কাজিনদের নিয়ে এখন অবাধে নিষিদ্ধ জায়গাতেও দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। দাদুর একাকিত্বের কষ্টকে লাথি মেরে নিজেদের খেলার আনন্দটাই বড় করে তোলে তারা। অবশ্য ঘরে একা চুপচাপ দেখে আট বছরের নাতনি সহানুভূতি দেখিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছে একদিন, ‘দিদাকে মিস করছ খুব? এক কাজ করো দাদু, ইউটিউবে ভিডিও-গেম দেখো। তাহলে মন ভালো হয়ে যাবে। দাও ফোনটা, আমি এখনই বের করে দিচ্ছি।’
ক্লাস ফাইভে পড়া বড় নাতিকে স্মার্টফোনের বদলে ডেস্ক কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে তার লেখাপড়ার সুবিধা হবে বলে। খেলার সাথীদের অভাবে একা থাকলে নাতি সেই কম্পিউটারের স্ক্রিনে ইন্টারনেটের অসীম জগতেও খেলার আনন্দ খুঁজে বেড়ায়। গুগল সার্চে যেকোনো প্রশ্নের জবাব খুঁজে জ্ঞানের গভীরতা দেখায় দাদুকে। ছোট বোনটি ভাইয়ের সঙ্গে পারে না বলে দাদুর ফোন নিয়ে টানাটানি করে বেশি। নাতি ও নাতনি—দুজনেই স্মার্টফোন ও ল্যাপটপ চালাতে দাদুর চেয়েও পাকা। বড়টি বাবা-মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও নিজে ভুয়া-ছবি-নাম ব্যবহার করে ফেসবুকেও অ্যাকাউন্ট খুলেছে। কৈশোর না পেরোতেই সে গার্লফ্রেন্ড খোঁজে। ইন্টারনেটের অসীম দুনিয়ায় নিজের নিভৃত আনন্দ-ভ্রমণ নির্বিঘ্ন রাখতে দাদুকেও সে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। দিদার মৃত্যুর পর দাদুকে সে সান্ত্বনা দেয়, ‘বেশি ইউটিউব দেখলে দিদা তো আগে আগে খ্যাঁচখ্যাঁচ করত। এখন সারা দিন ইউটিউব-ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার করো। নতুন নতুন গার্লফ্রেন্ডদের মেসেজ পাঠাও। কেউ তোমাকে আর বাধা দেবে না।’
‘তার মানে, দিদা মরে গিয়ে আমাদের সুবিধাই হয়েছে! কী বলিস?’
রুহু স্মার্টলি জবাব দেয়, ‘বুড়ো হয়ে গেলে মানুষ তো মরবেই। তুমিও তো মরবে। মা তো ঠিক কথাই বলে দাদু, বুড়ো মানুষের তাড়াতাড়ি মরে যাওয়াই ভালো। তাহলে কষ্ট কম হবে।’
এইটুকু ছেলের শোক-দুঃখের আবেগহীন এমন নির্মোহ স্বাভাবিকতা দেখে দাদুর নিজের শোক উথলে ওঠে। সাধে কি স্ত্রী বলত, মায়ের মতো স্বার্থপর হবে রুহুটা! বাসায় একদিন নাতিদের সঙ্গে খেলতে দেখে এক বন্ধু প্রশস্তি গেয়েছিল, ‘নাতি-নাতিন নিয়ে স্বর্গীয় বাগানে আছ মনে হচ্ছে! বেশ কাটছে সময়। তাই না?’
অস্বীকার করা যাবে না—স্ত্রী বেঁচে থাকতে স্বর্গীয় বাগানের ফেরেশতেরা আনন্দের বড় উৎস হয়ে উঠত প্রায়ই। কিন্তু শিশুরা যে ইবলিশ শয়তানের চেয়েও ভয়ঙ্কর ও দুর্বিষহ যন্ত্রণার উৎস হতে পারে, তা বুড়ো দাদু একা হয়ে হাড়েমজ্জায় টের পেতে লাগল প্রায়ই। নতুন করে বুঝল একদিন নিজের মোবাইল ফোনটা উধাও হয়ে যাওয়ার পর।
দাদুর মোবাইল নিয়ে নাতি-নাতনিরা খেলত বলে সন্দেহটা ওদের ওপর আসা স্বাভাবিক। কিন্তু দুজনেই স্রেফ অস্বীকার করে পাল্টা দাবি করে, আমরা কি চোর-ডাকাত? নানাভাবে অনুরোধ ও প্রলোভন দেখানোর পর আপসরফা হয়। দাদু নামাজ পড়তে মসজিদে কিংবা হাঁটতে বাইরে যাক, রুহু ইন্টারনেটের এন্টিহ্যাকার রোবটকে নামিয়ে হারানো ফোনটা খুঁজে বের করে দেবে। পারলে পুরস্কার দিতে হবে অবশ্যই।
দাদুকে বাইরে পাঠিয়ে পিচ্চিদের কোনো স্বার্থ হাসিলের মতলবের কাছে নতি স্বীকার করে দাদুটি বাইরে যায়। নির্জন ঘরের একাকিত্ব কিংবা নাতি-নাতনিদের উৎপাত থেকে মুক্তির সহজ পথ পাঁচবার মহল্লার মসজিদে যাওয়া। কিন্তু আল্লাহর পথে শ্বশুরের আগ্রহ কম দেখে, তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য নিজের মরহুম পিতার গল্প শোনায় পুত্রবধূ। অবসর নেওয়ার পর নাকি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ছাড়াও, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত দশ ঘণ্টা আল্লার ধ্যানেই কাটত তার। হাতে তসবি থাকত ঘুমের মধ্যেও। এমন ধার্মিক পিতার মেয়ে হয়ে নিজে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়েও শ্বশুরকে মসজিদে পাঠানোর উপদেশ খয়রাত করা ঠিক না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি তথা নিজেরটা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ধর্মেও নিষিদ্ধ। মরার পর আমার কবরে যা ঘটবে, তার ভাগ নিতে যাবে কেউ তোমরা?
বউমার সঙ্গে কথা বলারও রুচি হয় না বলে নিজের চিন্তাচেতনা চেপে রাখে সে। আর নাতি ও তাদের সঙ্গ গৃহবন্দি সময়টাকে দুর্বিষহ করে তুললে অপ্রয়োজনেও নগরীর রাস্তায় কিংবা পার্কে গিয়ে হাঁটাহাটি করতে ভালো লাগে। ফ্ল্যাটটা কেনার সময় সকাল-বিকেল হাঁটার জন্য কাছাকাছি চন্দ্রিমা উদ্যানের অবস্থানটি প্লাস পয়েন্ট মনে হয়েছিল। সেখানে নিয়মিত হাঁটার সঙ্গীও জুটেছে বেশ কয়েকজন। আর ভাগ্যগুণে সবচেয়ে বড় সঙ্গী হয়েছে নির্ভরযোগ্য পুরোনো বন্ধু তপংকর চক্রবর্তী ওরফে তপু।
৩
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিভেদ ঘুচিয়ে যেমন মুক্তিকামী বাঙালি একাত্ম ও মানবিকতার মহান বোধে উদ্দীপ্ত হয়েছিল, তপুর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব তারও আগে থেকে, বলা যায় মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় ও খেলার আনন্দে গড়ে উঠেছিল সেই কৈশোরেই। একাত্তরে দুজন একই সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল ইন্ডিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য। তারপর কলেজ-জীবন থেকে কর্মজীবনের শুরু এবং পরস্পরের বিবাহেও শরিক হওয়া পর্যন্ত বাল্যবন্ধুত্বের সম্পর্কটা নিবিড়ই ছিল। কিন্তু চাকরি ও সংসারজীবনের আত্মমগ্নতা দুজনের মধ্যে ক্রমে দূরত্ব এতটাই বাড়িয়ে তুলেছিল যে, টেলিফোনেও যোগাযোগও ছিল না দীর্ঘ কয়েক বছর। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তপু আমেরিকান-নাগরিক ছেলের বাড়িতে সস্ত্রীক আশ্রয় নিয়েছিল। বছর চারেক ছিল সেখানে। ছেলের সুবাদে আমেরিকায় বসবাসের গ্রিনকার্ড পেয়েছে, এত দিনে নাগরিকত্বও পেয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সনাতন ধর্মে আস্থাশীল তপংকর চক্রবর্তীর স্ত্রী শেষ পর্যন্ত আমেরিকার জীবনধারা মানিয়ে নিতে পারেনি। দেশের মাটিতেই পুড়ে ছাই হবার বাসনা নিয়ে দেশে ফিরেছে। ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে। সেই বড় ফ্ল্যাটে সপরিবার ছোট মেয়েকেও রেখেছে। আমেরিকান ছেলের সুবাদে দেশেও তপংকরের প্রতিষ্ঠা পোক্ত। ছেলে নিয়মিত ডলার পাঠায়। বুড়ো-বুড়ির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ঘাটতি নেই কোনো।
দু’বন্ধুতে আবার যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসাটা দুজনের জন্যই শেষ বয়সের বড় আশীর্বাদ। নিজেরা তারা স্বীকার করে, আর দুই বন্ধুর তুই-তোকারি সম্পর্ক দেখে ও পরম্পরাতে তপুও বাঙ্গু সম্বোধন শুনে অন্যরাও সেটা বুঝতে পারে। বাসাতেও নানা উপলক্ষে সস্ত্রীক যাতায়াত ছিল উভয়ের। বন্ধু বিপত্নীক হওয়ার পর তপুর বন্ধুপ্রীতি ও দায়টাও যেন বেড়েছে। শরীর খারাপের জন্য যেদিন পার্কে বা রাস্তায় হাঁটার সঙ্গী হতে পারে না, ফোনে নিয়মিত খোঁজ নেয়। নাতিদের কাছে ফোন দিয়ে জব্দ হওয়ার খবর শুনে তপু নতুন লকসিস্টেম ফোন কিনে তা গোপনে ব্যবহারের কৌশলও শিখিয়ে দেয়।
পার্কে দুজনের মনখোলা একান্ত আলাপে তপুই একদিন বন্ধুকে জোরালো মত দেয়, ‘আমার মনে হয়, মৃত্যুর আগে ভাবি তোকে ঠিক পরামর্শটাই দিয়ে গেছে। তোর সমস্যা যতটুকু বুঝছি, দেখেশুনে আরেকটা বিয়ে করাটাই সমাধান। তাতে তোর বর্তমান চাহিদা মিটবে, পেনশনের ভবিষ্যৎ সদ্ব্যবহারও নিশ্চিত হবে।’
বন্ধু বলার আগেই সে দ্বিতীয় বিবাহটা কল্পনায় ঘটিয়ে তার সুবিধা ও অসুবিধাগুলো বিস্তারিত উপভোগ করেছে সে। অভিজ্ঞ মানুষের মতো জবাব দেয়, ‘প্রথম কথা হলো, এই বয়সে দ্বিতীয় বিবাহ করলে আমার তিন ছেলেমেয়ের কেউই সহজভাবে মানবে না। নিজের পেনশন ও সঞ্চয়পাতির জোরে ছোট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে নতুন বউকে নিয়ে আলাদা সংসার চালাতে পারব ঠিকই, কিন্তু বউয়ের বয়স কম হলে তার শারীরিক ও মানসিক চাহিদা মেটাতে পারব না।’
‘আরে বাঙ্গু, সত্তর বছর এই যুগে কোনো বয়স না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তিন নং বউটারে দেখিস নাই? খালি কি লোকদেখানোর জন্য ফার্স্ট লেডিরে সাথে নিয়া হাত ধরে হাঁটে? নিয়মিত এক বিছানায় থাকে অফ কোর্স। এই বয়সে আমি যদি নিজের বৃদ্ধাটির সঙ্গে মাসে অন্তত দু-একবার থাকতে পারি, তুইও নতুন বউয়ের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে একবার হেসে খেলে পারবি রে। আমি ড্যাম শিওর। উপযুক্ত অষুধ তো তোকে দিয়েছি।’
স্ত্রীর মৃত্যুর মাসখানেক আগেও সে অনিচ্ছুক স্ত্রীর ওপর যৌবনের তেজ ও দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছিল। তার মূলেও ছিল তপু চক্রবর্তীর দেওয়া দাওয়াই তথা ভায়াগ্রা জাতীয় অষুধ। কথা প্রসঙ্গে একদিন শয্যায় তার উত্থানরহিত যৌনসমস্যার কথা জানালে, সেদিনই দুশ টাকায় চারটা ট্যাবলেট কিনে বন্ধুকে দিয়েছিল। সেই ওষুধগুণেই হঠাৎ স্বামীর যৌবনের হারানো পরাক্রম দেখে স্ত্রী হয়তো দ্বিতীয় বিবাহের পরামর্শ দিয়ে গেছে। কিন্তু এসব ওষুধের গুণে সম্ভাব্য দ্বিতীয় স্ত্রীর চাহিদা আর কত দিন মেটাতে পারবে সে? তার চেয়েও বড় কথা, এই বয়সে দ্বিতীয় বিয়ের পাত্রী খুঁজছে জানলে পেশাদার ঘটকও ভীমরতির সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে তার গল্প রসিয়ে রসিয়ে অন্যদের শোনাবে নিশ্চয়।
তপুর দেওয়া সেক্স-হরমন বাড়ানো নীল ট্যাবলেট খেয়ে যদি সে স্ত্রী-সহবাস করে, তবে নবপরিণীতা তাকে বেশি বেশি ওই ওষুধ খাইয়েই মারবে হয়তো। আর ভায়াগ্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় না হোক, যেকোনো ছুতোয় আগামী পাঁচ-দশ বছরে মরতে হবে বলে সে মোটামুটি নিশ্চিত। দ্বিতীয় স্ত্রীকে ঘরে রেখে মরে গেলে প্রথম পক্ষের কোনো সন্তান এবং নাতি-নাতনিও শ্রদ্ধা কি শোক জানাতে আসবে না। মৃত্যুর পরও আত্মীয়স্বজন ও সমাজের ঘৃণাবোধ নিথর শরীরে পাহাড়ের মতো চাপ সৃষ্টি করবে। এ রকম নিঃসঙ্গ ও ট্র্যাজিক মরণ মেনে নেওয়ার সাহস বা যুক্তি—কোনোটাই খুঁজে পায় না সে।
তপুকে এসব যুক্তি শোনালে সে তার স্বভাবসুলভ ঔদার্য দেখাতে লেকচার দেয়, ‘বাঙালি কোনো দিন মানুষ হবে না রে বাঙ্গু। তাদের কাছে পিতা মানে দেবতা, স্ত্রী মানে সতী-সাবিত্রী, ভাই মানে রাম-লক্ষ্মণ। আর জীবনের প্রকৃত সুখশান্তি আসলে পরজন্মে কি অনন্ত পরকালে। এই সব ভুয়া গল্পকাহিনির আদর্শ-বিশ্বাস নিয়ে আমরা আছি এখনো! আসলে বয়স হলেও যে ব্যক্তির জীবনে কত চাহিদা থাকে—নিজের পরিবারের সন্তানেরাও বুঝতে চায় না। কিন্তু তোদের ধর্মে তো একাধিক বিয়ের পারমিশন দেওয়াই আছে। ’
‘যত যুক্তি দে, সন্তানরা মায়ের আসনে বিকল্প কাউকে দেখতে চায় না। যৌবনকাল যাওয়ার পরও বুড়ো বয়সে পিতার যৌনক্ষুধা তাদের কাছে বিকৃতি কিংবা চরিত্রহীনতা মনে হবে।’
‘আমার মেয়েটাও ওই রকম রে! আমি ঠিক করেছি বউটা মরে গেলে আমেরিকায় গিয়ে একা হবো। সিটিজেনশিপ হয়ে গেলে ওখানে ভাতা পাব। তা দিয়ে ডেটিং করার মতো বুড়ি পাই তো ভালো, না হলে কোনো ওলডহোমে থেকে কুকুর পালব।’
‘তুই তো আমেরিকান সিটিজেন প্রায় হয়েই আছিস। আমি কি তবে ধর্মকর্মে মন দেব তপু?’
‘শেষ বয়সে ওসব ভণ্ডামি করে পার পাবি না। তোর পুরুষাঙ্গে বল যখন ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, সঙ্গিনীর ব্যবস্থাও হবে। তবে পেশাদার ঘটক দিয়ে কাজ হবে না। তোর জন্য উপযুক্ত একটা পাত্রী আমাদের নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে। তুইও ফেসবুকে খুঁজে দেখ, আমিও দেখছি ইন্টারনেটে আর কীভাবে খোঁজা যায়।’
বন্ধু তপুর পরামর্শে এবং ইঁচড়েপাকা নাতি রুহুর প্রভাবেও বটে, ফেসবুক-ইন্টারনেটে আসক্তি জন্মেছে বৃদ্ধ বয়সেও। ছেলের সংসারে নিজের একাকিত্বের সময়টায় ফোনের স্ক্রিনে নানা খবর ও ছবি দেখে। মাঝে মাঝে নিজেও সামাজিক সমস্যায় স্ট্যাটাস দিয়ে প্রগতিশীল মতামত দেয়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তার ছবিসহ ব্যক্তিগত শোকসংবাদটি ফেসবুকে জানালে মন্তব্যের ঘরে সহানুভূতি জানিয়েছে একচল্লিশ জন স্বজন-বন্ধু। যারা মন্তব্য করেনি, তারাও লাইক বাটনে চাপ দিয়ে আহা রে মার্কা সহানুভূতি জানিয়েছে। কিন্তু শতাধিক ফেবু বন্ধুর প্রতিক্রিয়া মন ভরিয়েছে তার কতটুকু? এত দিন দেখেশুনে যা বুঝেছে সে, তাতে ফেসবুকের হাজার চেনা-অচেনা বন্ধুদের ওপরেও বিন্দুমাত্র আস্থা নেই তার। থাকলে কি আর ঘুরেফিরে পুরোনো বন্ধু তপুর সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ কিংবা ফোনে কানে কানে কথা না হলে অস্থির হয়ে ওঠে? ফেসবুক কি ম্যাসেঞ্জারেও তপুর মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর খবর খোঁজে সে প্রথম।
দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছেটি চিন্তাচেতনায় শিকড় ছড়াবার আগেই, একদিন ফেসবুকে তপুর স্ট্যাটাসে নিজেকে অবিষ্কার করে চমকে ওঠে লোকটি। তপু লিখেছে, তার অতি পরিচিত একজন অবসরপ্রাপ্ত সজ্জন মানুষ স্ত্রীর মৃত্যুতে বড় একা হয়ে পড়েছে। সত্তর বছর বয়সী এই পাত্রের জন্য মাসিক বত্রিশ হাজার টাকার সরকারি পেনশন ছাড়াও অন্যান্য সম্পদের বৈধ উত্তরাধিকারী হওয়ার শর্তে আগ্রহী মধ্যবয়সী বিধবা বা ডিভোর্সি পাত্রী প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, পাত্র শারীরিকভাবে সচল ও সক্ষম, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। যোগ্য ও আগ্রহী পাত্রীর সন্ধান কারও জানা থাকলে ইনবক্স করুন।
ফেসবুকে নিজের সমস্যার বিজ্ঞাপন দেখে সে হঠাৎ বেআব্রু হয়ে যাওয়ার মতো লজ্জা-ভয়ে চারদিকে তাকায়। এগারো বছরের নাতি তার ফেসবুক পড়তে পারে। নাতির বাবা-মায়েরাও ফেসবুক করে, কাজেই সংসারের একান্ত স্বজনদের কাছে ধরা পড়ার ভয়টাই চলকে ওঠে প্রথম। তপুকে সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করে ধমক দেয়, ‘এটা কী করেছিস তুই হারামি? সর্বনাশ হবে আমার!’
তপু তার স্বভাবসিদ্ধ বরাভয় দেয়, ‘আরে দোস্ত, ফেসবুকে সব শালারা জন্মদিন, বিবাহ দিনসহ নিজেদের জীবনের তুচ্ছ ব্যাপার ছবিসহ প্রচার করে। আমি প্রবীণদের একটি মানবিক সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তোর নাম-পরিচয় তো দেইনি। কেউ টের পাবে না। নানাভাবে তোর যোগ্য সঙ্গী খুঁজছি আমি, সন্ধান পাব আশা করছি। দেখা যাক কপালে কী আছে তোর।’
মাত্র দুদিন পর তপু আবার ফোন করে ইউরেকা বলে খুশির উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। আসল খবরটা ফোনে বা ম্যাসেঞ্জারে নয়, পার্কে মুখোমুখি বসে জানাবে সে। কারণ, সাড়া যে দিয়েছে, সে তপুর ফেসবুক বন্ধুতালিকায় ছিল বটে, কিন্তু ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জারে নয়, সরাসরি ফোন করে বলেছে—আমি আপনার স্ট্যাটাস নিয়ে কথা বলতে চাই। তারপর সশরীরে বাসাতেও এসেছিল। তপু ও তার স্ত্রীর সামনেই কথাবার্তা হয়েছে।
৪
নাম তার কৃষ্ণা অধিকারী। বয়স পঞ্চান্ন, হালকা-পাতলা গড়ন বলে মনে হয় আরও কম। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলের সংসারে আছে। নাতিও আছে একটি। একসময় একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নার্সিংয়ের চাকরিতে ছিল। নিজস্ব আয় ছিল বলে ছেলের সংসারে কিছুটা সম্মান ও স্বাধীনতাও ছিল। ওই সময়ে তপংকর চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার আমেরিকান ছেলের প্রয়োজনে। আমেরিকান সন্তানদের জন্য বেবিসিটার হিসেবে দেশে থেকে একটি মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছিল তপুর ছেলে। তপুকে এই মেয়ের সন্ধান দিয়েছিল তার এক খ্রিস্টান বন্ধু। আগ্রহী প্রার্থী হিসেবে কৃষ্ণা তখন তপুর বাসায় এসেছিল কয়েকবার। তার বায়োডাটা ও ছবিও পাঠিয়েছিল ছেলের ই-মেইলে। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা যাওয়া হয়নি কৃষ্ণা অধিকারীর। বাস্তব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবার পর, ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে কবে যে মহিলা তার বন্ধু হয়েছে, তপু ঠিক জানেও না। স্ত্রীহারা নিঃসঙ্গ বন্ধুর পাত্রী হিসেবে তার ফোন পেয়ে তাই চমকে উঠেছিল। বর্তমানে সে বেকার। চাকরিটা যাওয়ার পর ছেলের সামান্য রোজগারের ভাগী হওয়ায় পুত্রবধূর খোঁটা খেয়ে ছেলের সংসারে আরও দুচার বছর বাঁচার চেয়ে এক্ষুনি বিষ খেয়ে মরে যাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে হয়। চাকরি খুঁজছে। একটা চাকরি পেলে অবশ্যই নিজের মতো করে একা ও আলাদা থাকবে। একটা খ্রিস্টান মিশনারি মহিলা মেস ঠিক করেও রেখেছে। সমস্যা হলো, নতুন একটা চাকরি ও ছেলের সংসার ছেড়ে আলাদা হওয়ার জন্য তার নগদে লাখ দুয়েক টাকা প্রয়োজন? এই টাকা জোগাড় করতে পারছে না বলে নতুন চাকরি হচ্ছে না, ছেলের সংসারে থাকার অশান্তিও কাটছে না। এই সংকটে তপুর ফেসবুক পোস্টটিকে অকূলে কূল পাওয়ার মতো মনে হয়েছিল তার। এখন তপুর অতি পরিচিত বন্ধুটি যদি দেখেশুনে তাকে যোগ্য মনে করে, তবে ধর্মান্তরিত হয়ে বৈধ স্ত্রী হতে আপত্তি নেই তার। এমনকি বৈধ স্ত্রীর মর্যাদা না পেলেও, একযোগে দুলাখ টাকা ধার বা অগ্রিম বেতন হিসেবে পেলেও উদ্ধারকর্তা মনিবকে বাঁধা নার্স-এর মতো আজীবন সেবা দিয়ে যেতেও আপত্তি করবে না।
একে ফেসবুকের মাধ্যমে পাত্রীর সন্ধান এসেছে, তার ওপর শুরুতে টাকার শর্ত। প্রথমে তপুর প্রস্তাবটাকে একদম আমল দিতে চায় না সে। মনে হয়, ঘরের নাতির মতো কেউ ফেসবুকের ভুয়া আইডি নিয়ে তার টাকা খসাবার ফন্দি করছে। কিন্তু বাল্যবন্ধু অপুকে চট করে অবিশ্বাস করতে পারে না। কারণ মনে পড়ে, বছর কয়েক আগে আমেরিকায় ছেলের স্পন্সরশিপে একটি কাজের মেয়েকে পাঠানোর বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেছিল সে। কৃষ্ণা অধিকারী সেই মেয়ে হওয়ায় তার সঙ্গে তপুর গোপন শরীরী সম্পর্ক নিয়েও আজ সন্দেহ জাগে। কারণ, স্ত্রী ছাড়াও দেশে-বিদেশে বেশ কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে শরীরী সম্পর্কের স্বীকারোক্তি বন্ধুকে অকপটে বলেছে তপু। বিয়ে ছাড়াও পারস্পরিক সম্মতিতে নারী-পুরুষের দৈহিক মিলন তার কাছে ব্যভিচার তো নয়ই, বরং শ্রেষ্ঠ আনন্দের বিষয়। অন্যদিকে এই সমাজে অর্থ-বিত্ত-প্রতিষ্ঠার লোভে বৈধ কি অবৈধ পথে এই আনন্দ বিতরণের জন্য তৈরি আছে কত যে মেয়ে! খ্রিস্টধর্মাবলম্বী কৃষ্ণা প্রয়োজনে ধর্মান্তরিত হয়ে তার আইনসিদ্ধ স্ত্রীর মর্যাদা পেতে সম্মত শুনে প্রতারিত হওয়ার ভয়ও জাগে। টাকার জন্য লোভী মানুষ এ যুগে কী না করতে পারে? তপুকে জানায় সে, ‘আমার কিন্তু ভদ্রমহিলাকে চিট মানে কলগার্ল জাতীয় মনে হচ্ছে রে।’
জোর প্রতিবাদ করে তপু জানায়, নিজে স্ত্রীহারা অবস্থায় এ রকম একটা মেয়ের সন্ধান পেলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করত সে। দুলাখ টাকার লোভ নয়, তার বর্তমান ক্রাইসিসটা বড় বাস্তব। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দার্শনিকের মতো যোগ করে সে, ‘দেখ দোস্ত, নানা রকম হিংসা-ঘৃণা-অবিশ্বাস আর জাতপাতের সংকীর্ণতার ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে আছি আমরা। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হয়েছে আমাদের। আমি চাই, আমরা চলে যাওয়ার পর পৃথিবীতে মানুষে মানুষে বিশ্বাস ও ভালোবাসার সম্পর্ক এবং মানবতার ধারাটা বজায় থাকুক। তুই তো জানিস, ধর্মীয় সংকীর্ণতা মানি নাই বলে একটি মুসলমান মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কত মেয়ের সাথে সঙ্গ করলাম, কিন্তু সেই মেয়েটাকে ভুলতে পারিনি এখনো। শেষ বয়সে কৃষ্ণা অধিকারীর সাক্ষাৎ পাওয়াটা তোর সৌভাগ্য বলে মনে হয়েছে আমার। মেয়েটাকে যদি তোর পছন্দ হয় এবং আইনগতভাবে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিস, মহিলাটির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অনেকটা নিরাপদ হবে, তুইও ভাবির অভাব অনেকটাই ভুলতে পারবি। আমি একজনের খোঁজ দিলাম, এখন দেখেশুনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব তোর।’
এরপর তপুকে আর সন্দেহ-অবিশ্বাস করে সে কোন যুক্তিতে? এমনকি বন্ধুকে বাদ দিয়ে, কৃষ্ণা অধিকারীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ও যোগাযোগের প্রস্তাবেও সম্মত হয় না। অতএব এক সপ্তাহের মধ্যে চন্দ্রিমা উদ্যানে কৃষ্ণা অধিকারীর সঙ্গে বন্ধুকে পরিচিত করিয়ে দিয়ে, দুজনকে একান্তে কথা বলার সুযোগ দিতে তপংকর চক্রবর্তী তার দায়িত্বে ইতি টানে।
৫
প্রথম দর্শনে প্রেম কী জিনিস, সেটা শেষ বয়সে এসে উপলব্ধি করে নিঃসঙ্গ লোকটি। কারণ, প্রথম সাক্ষাতেই কৃষ্ণাকে পছন্দ হয় তার। নবীন যৌবনের মতো রোমাঞ্চ ও নায়ক হওয়ার মতো উত্তেজনাও অনুভব করে কিছুটা। ভদ্রমহিলা যেন তার হবার জন্য তৈরি হয়েই এসেছে। নাম কৃষ্ণা হলেও রংটা ফর্সাই। তপু যেসব তথ্য দিয়েছিল, কৃষ্ণার আত্মকথনে কোনো হেরফের হয় না। পাত্রের চেয়ে ঘটকের প্রশংসায় আন্তরিক সে, ‘তপংকর বাবুর ফ্যামিলিকে আমি অনেক দিন ধরে জানি, উনি উদার ও ভালো মনের মানুষ।’ বন্ধুর প্রশংসায় বুঝি কিছুটা হিংসাও হয় লোকটার, জানতে চায়, ‘আর আমাকে কি অসৎ ও খারাপ মানুষ মনে হচ্ছে?’ লজ্জা পেয়ে মেয়েটি বলে, ‘তা না, আসলে আপনার সব কথা শুনে আমার মনে হয়েছে আমাকে হয়তো আপনি পছন্দ করবেন না। বিয়ের জন্য নিজেদের ধর্মে আমার চেয়েও সবদিক থেকে যোগ্য ও ভালো ফ্যামিলির মেয়ে আপনি পাবেন। তপংকরবাবু আমার বিপদের কথা শুনে হয়তো দয়া করে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।’
তপুর কাছে যে সে বাল্যকাল থেকে বাঙ্গু এবং বাঙ্গুর চাহিদাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে কৃষ্ণার মতো একটা উপযুক্ত মেয়েকে খুঁজে বের করেছে, সেটা কৃষ্ণাকে আর বুঝতে দেয় না লোকটি। মানুষের মন বড় জটিল জিনিস। প্রথম দর্শনেই পছন্দ এবং আগ্রহ-আসক্তি উছলে উঠতে চায় বলে প্রতিরোধের বাঁধ সৃষ্টি করতে বলে, ‘এই বয়সে ভুল করলে মারাত্মক সাফার করতে হবে দুজনকেই। তা ছাড়া এই ঘটকালির পেছনে তপুরও কোনো বদ মতলব আছে কি না ভাবতে হবে। তপুকে নির্ভর করে নয়, পরস্পরকে ভালোভাবে জেনে চিন্তাভাবনা করে এগোতে হবে আমাদের। এক দিনে তো হবে না, এ জন্য ফোনে কথা বলতে হবে, প্রয়োজনে আবার সাক্ষাৎ করব আমরা।’
সহমত হয়ে মেয়েটি বলে, ‘আপনি যা জানতে চাইবেন সব সত্য জবাব দেব। তবে ছেলের বাসায় আমার স্বাধীনতা নেই, ফোন করলে রাত বারোটার পরে করতে হবে। অথবা আমি সময় পেলে মিসড কল দেব। হোস্টেলে উঠতে পারলে প্রতিদিনই আপনার সঙ্গে স্বাধীনভাবে দেখাসাক্ষাৎ করতে সমস্যা হতো না। অবশ্য সে ক্ষেত্রে রিকশা ভাড়া ও বাদাম খাওয়ার টাকা আপনাকেই দিতে হতো।’
মেয়েটি হাসি দিয়ে অর্থনৈতিক দৈন্য ঢাকার চেষ্টা করে। তাতে লোকটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলার হাসিমুখে পেশাদার কলগার্লের ছায়া খোঁজে। তাকে পাওয়ার জন্য দুলাখ টাকার শর্তটাও মনে হয়। অতঃপর ফোন-নাম্বার বিনিময়, ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জারেও সংযুক্ত থাকার পথঘাট চিনে প্রথম যোগাযোগের সমাপ্তি ঘোষণা করে হাসিমুখে। বিদায়বেলা লোকটা জোর করেই কৃষ্ণাকে এক হাজার টাকা এগিয়ে দেয়, কৃষ্ণা নিতে না চাইলে জোর করে, ‘এ টাকাটা হয়তো আমার প্রয়োজনেই আপনাকে খরচ করতে হবে।’
প্রথম সাক্ষাতের পর বাসায় লোকটির একাকিত্ব শিস দিয়ে উড়িয়ে দিতে দিনে-রাতে একাধিকবার ফোন করে কৃষ্ণা। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য বাসার বাইরে গিয়েও নিরাপদ স্থান থেকে কল দেয়। রাতে ভালো ঘুম হয় না বলে বারোটার পরও ভিডিও কল দেয় লোকটি। ইনবক্সে কৃষ্ণা নিজের ও পরিবারের ছবিও পাঠায়। দুজনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কত রকম যে সওয়াল-জবাব চলে! প্রায় প্রতিদিনই কানে কানে কথাবার্তা ও ফোনে দেখাদেখির পরও সম্ভাব্য হবু স্ত্রীকে নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই লোকটার। দ্বিতীয় সাক্ষাতের আগেই যেন সিদ্ধান্ত পাকা ও পরিণয়-পরিণতি নির্ভুলভাবে বুঝতে চায়। মেয়েটার প্রতি সন্দেহ ক্রমে কমে আসছে। কারণ, দু’লাখ টাকার প্রতিশ্রুতি পেলেই সে ডাকামাত্র ছেলের সংসার থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এরপর লোকটা তাকে আইনসম্মতভাবে বিয়ে করে ঘরে তুলুক, কিংবা বিয়ের আগেই হানিমুনে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাক, আপত্তি নেই তার। তবে সপ্তাহখানেকের মধ্যে বাসায় ফিরে ছেলেকে দেড় লাখ টাকার ঋণ শোধ করতে হবে এবং নিজেকে আলাদা মেসে উঠতেও হবে। তারপর চাকরির চেষ্টায় ছোটাছুটি করতে হবে।
লোকটা আশ্বাস দেয়, ‘আমার পেনশনের উত্তরাধিকারী হতে চাইলে বাইরে ছোটাছুটি করা যাবে না। নিজের সংসারে বন্দি থেকে দিনে-রাতে স্বামীসেবা করতে হবে।’ আশ্বস্ত মেয়েটি আগাম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
৬
বাসায় খুব সতর্ক থাকার পরও কবে, কখন এবং কীভাবে কৃষ্ণা অধিকারীর সঙ্গে অপার সম্ভাবনাময় গোপন সম্পর্কটার ভিত পরিবারের সবার কাছে উন্মোচিত হতে শুরু করেছিল, জানে না লোকটি। অবশ্য কৃষ্ণার সঙ্গে একদিন ফোনে কথা বলার সময় পুত্রবধূর চোখে প্রথমে সন্দেহ চলকে উঠতে দেখেছিল। অথবা হতে পারে নিজের মধ্যে অপরাধের ছায়া চলকে উঠেছিল বলে পুত্রবধূকে সন্দেহ করেছিল সে। কৃষ্ণার সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তার কক্সবাজারে অভিসারে যাওয়ার প্রোগ্রামটি পাকা হওয়ার পরদিনই, গোটা পরিবারের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে সে।
এগারো বছরের নাতি রুহু প্রথম বিজয়গর্বে ঘোষণা করে, ‘দাদু, আজ তোমার বিচার বসবে। আমি তোমার গার্লফ্রেন্ডের সব ডকুমেন্টস হ্যাক করে বাবা-মাকে দেখিয়েছি। তোমার ভিডিও কলও রেকর্ড করেছি। কী মনে করো তুমি আমাকে? কম্পিউটার প্রোগ্রামার শুধু নয়, বড় হয়ে সিআইডি ইন্সপেক্টর জেনারেল হব আমি।’
দাদুর নতুন ফোন নিয়ে নাতির বাড়াবাড়ি কৌতূহল দেখেই সন্দেহ জেগেছিল একদিন। মায়ের হয়ে রুহু যে দাদুর ওপর গোয়েন্দাগিরি করছিল, সেটা বুঝতে দেরি হয়েছে বোকা লোকটির। বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ছোট ছেলে সস্ত্রীক বড় ভাইয়ের বাসায় আসে একদিন। মেয়ে বিদেশ থেকে আসতে না পারলেও ভিডিও কলে পারিবারিক কনফারেন্সে যোগ দেয়। অনুপস্থিত মেয়েই কান্নার গলায় সকলের হয়ে পিতার উদ্দেশে অভিযোগ উত্থাপন করে প্রথম, ‘মা মরতে না মরতেই তুমি এসব কী শুরু করেছ বাবা? রুহু তোমার গার্লফ্রেন্ডের সব ডকুমেন্টস আমার কাছেও পাঠিয়েছে। কে এই কৃষ্ণা অধিকারী? পেনশনের নমিনি করা ছাড়াও তুমি তাকে আর কী দেয়ার লোভ দেখিয়েছ? ছি, আমি ভাবতেও পারি না, মা মরতে না মরতেই তোমার সম্পর্কে এসব কথা শুনতে হবে।’
‘আমি এ বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব।’
মেয়ের ফোন রেখে দিলেও, মেয়ের জিজ্ঞাসা তার দুভাই ও তাদের স্ত্রীদের মাধ্যমে আরও তীব্রভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। কে এই কৃষ্ণা, কী সম্পর্ক তার সঙ্গে আপনার?
মাত্র সপ্তাহ দুয়েকের ফোনালাপ ও ভিডিওতে দেখাদেখির পরও কৃষ্ণার সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ-সম্পর্ক এখনো নিজের কাছে স্পষ্ট ও চূড়ান্ত হয়নি। তবে স্বপ্ন-কল্পনায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত সম্পর্কের বিস্তার এতটাই ঘটেছে এবং কৃষ্ণা এত বেশি কল্পনা ও কামনার রঙে গড়া তার পরিচয়, এককথায় কী জবাব দেবে সে? তারপরও নির্বিকার কণ্ঠে সত্য কথাই বলে লোকটি, ‘কৃষ্ণা অধিকারী একজন অভাবগ্রস্ত খ্রিস্টান, বিধবা ভদ্রমহিলা।’
বড় ছেলের আক্রমণাত্মক জবাব, ‘তা অভাবগ্রস্ত বিধবা মহিলাকে ইতিমধ্যে দু লাখ টাকা এবং পেনশনের উত্তরাধিকারী করতে চাইছ, লুকাচ্ছ কেন? আমি তপু আংকেলের কাছে গিয়েছিলাম, সে সব জানে, বলেছে, তোমার বাবার সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে দাও।’
‘তোমরা কৃষ্ণার ব্যাপারে রুহুকে গোয়েন্দা নিয়োগ ছাড়াও, আমাকে না জানিয়ে তপুর সঙ্গেও যোগাযোগ করে ফেলেছ।’
ছোট ছেলে জবাব দেয়, ‘তপু কাকুই যত নষ্টের গোড়া। লোকটা নিজে ধর্মকর্ম মানে না। নাস্তিক। আমেরিকায় থেকে আরও ভোগবাদী হয়েছে। সে তোমাকে কুবুদ্ধি দিয়ে ডোবানোর তালে আছে বাবা।’
পুঁজিবাদ-ভোগবাদবিরোধী বন্ধুকে সে ছেলেদের তুলনায় বেশি জানে। ফোনে কৃষ্ণা বিষয়ে তার সাম্প্রতিক শেষ কথাটিও মনে পড়ে, ‘কৃষ্ণার কাছে তুই কী পাবি না পাবি, জানি না দোস্ত। তবে তোর মৃত্যুর পর তোর সরকারি পেনশনটা কৃষ্ণা ভোগ করার রাইট পাবে জানলে একটা মানবিক কাজ করতে পারলাম বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারব আমি।’
বড় ছেলের বউ বলে, ‘ওই ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করে যদি এ বাড়িতে আনেন, আমরা কি তবে এ ফ্ল্যাটে থাকতে পারব। মায়ের মতো সে কি আমাদের আপন করে নিতে পারবে?’
ছোট ছেলে আবার মারমুখী প্রতিবাদ করে, ‘এ বাসায় আনবে কেন? এ ফ্ল্যাট তো মায়ের নামেও, বাবা আমাকে কিছু না দিলেও মায়ের ফ্ল্যাটে আমারও অধিকার আছে।’
ছোট ছেলের বউ বলে, ‘অস্ট্রেলিয়ার আপার কথা তো আপনি শুনলেনই না। তার মতটা নিন।’
বড় ছেলে মুরব্বির মতো বিষণ্ন কণ্ঠে বলে, ‘মা চলে গেল, কবছরই আর বাঁচবে তুমি? মৃত্যুর বয়সে এসে এ রকম ভীমরতি দেখানোর আগে, তোমার এই ফ্ল্যাট, ব্যাংক-ব্যালেন্স, গ্রামের পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ কাকে কীভাবে দিতে চাও, সেটার আগে ফয়সালা হওয়া উচিত।
লোকটার মনে হয়, এমনিতে বাপকে সঙ্গ দেওয়ার দুদণ্ড সময় হয় না কারও। আজ সবাই তাকে ঘিরে একত্র হয়েছে বৃদ্ধ পিতাকে মানবিক ভালোবাসা ও দায় দেখাতে নয়, বরং মরার আগেই মৃত পশুকে খুবলে খাওয়া পশু-শকুনের মতো আচরণ করছে তারা। নাতি রুদ্র শুধু হাসিমুখে বলে, ‘দাদু, তুমি বিয়ে করে নতুন দাদি আনলে আমরা হেভি একটা পার্টি দেব। আমার বন্ধুদেরও ডাকব।’
লোকটি এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘তোমরা যা শুরু করেছ, এরপর তোমাদের সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়। আমি তোমাদের যা দেওয়ার দিয়েছি, আমি মরার পর উত্তরাধিকারী হিসেবে যে যেটুকু পাওয়ার পাবে। যে কয়দিন বেঁচে আছি, আমার ভালোমন্দ নিয়ে তোমাদের আর ভাবতে হবে না।’
আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। জানে, এ বাসায় শান্তিতে তাকে আর একা থাকতেও দেবে না। একটু পরেই হয়তো বদ্ধ দরজায় ঠকঠকানি দিয়ে উদ্বেগ-ভালোবাসা দেখাবে। তার আগেই একটি ব্যাগে সে তার জামাকাপড়, টাকাপয়সা, চেকবুক গুছিয়ে নিয়ে দরজা খোলে। কাউকে কিছু না বলে এবং বলার সুযোগ না দিয়ে ঝটিতি বাসার মেইন দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। লিফটে ওঠার আগে পেছন থেকে নাতি রুদ্রের কণ্ঠ, ‘দাদু, কোথায় যাচ্ছ? যেখানেই যাও, গুগলম্যাপ দিয়ে তোমার লোকেশন জেনে তোমাকে খুঁজে বের করব আমি।’
লিফটের দরজা বন্ধ হতেই স্বজনবিচ্ছিন্ন একা লোকটি অতল অন্ধকারে নামতে শুরু করেছে। অনন্ত অনিশ্চিত অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে তার মনে হয়, প্রথমে কৃষ্ণাকে একটা ফোন করা দরকার।
জীবন থেকে তুলে আনা বাস্তব ছবি। শেষ পর্যন্ত মানুষ বড় অসহায়! প্রিয় লেখককে সমীহ ও ভালোবাসা।
শাহজাহান কাঞ্চন
সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২২ ১৩:২৫
গল্প যেন বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। খুব ভালো লাগলো।
রফিক আহমদ
সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২২ ০৯:২২