রাষ্ট্রনেতার ছাদবাগান

 

ধরেন, একটা রকেটের কথাই যদি বলি, কীভাবে এমন ঢাউস সাইজের উড়ালপঙ্খিটা পৃথিবীর সমান ওজন নিয়ে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়? কিংবা ধরেন, একটা বিশাল আকৃতির জাহাজের কথা যদি বলি, কীভাবে আমাদের পায়ের নিচে দিনের পর দিন থেঁতলা হয়েও অক্ষত অবস্থায় অতল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে হারিয়ে যায়? কীভাবে পারে? একটা রকেটের ওজন আসলে কত? কিংবা একটা জাহাজের? আমার মাথার ওপর একটা রকেট উড়ছে। আর দৃষ্টিসীমার অনেক দূরে গভীর সমুদ্রে অতিকায় একটা জাহাজ জলরাশি এফোঁড়-ওফোঁড় করে এগোচ্ছে নিজের গন্তব্যে। আমি বসে আছি আধুনিক ছাদবাগানের একটি কোনায়। বাবা একটু আগে লাফ দিয়ে নিচে পড়েছেন। সবাই হইচই করে সেদিকে ছুটে গেছে। আমি বসে আছি। ছাদবাগানে বসে রকেট আর জাহাজের খবর নিচ্ছি। পাশের দালান থেকে একপশলা মিষ্টি বাতাস উড়তে উড়তে বিরিয়ানির গন্ধ টেনে আনছে আমাদের বাসার ছাদে। পেটে মোচড় দেওয়ার মতো কোমল ঘ্রাণ। বাবার একটু আগে রেখে যাওয়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশ এখনো জ্বলছে। আমি হাতে তুলে নিই। ঠোঁটের কোনায় গুঁজে টান মারি। ভাবি সিগারেটটা একটানা এতক্ষণ ধরে জ্বলছে কীভাবে? আমার ধারণা, ওটা নিভে গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। আমার বাসনা বুঝতে পেরে পুনরায় জ্বলে উঠেছে। বিরিয়ানির ঘ্রাণ আর সিগারেটের টান একসাথে আরাম দেয় শরীরে। দুপুরের কড়া রোদ এখন থিতিয়ে পড়েছে। অপরিচিত আর অচেনা প্রতিবেশীদের ভিড় ও জটলা বাসার আশপাশে উৎসবের আমেজ তৈরি করেছে। কেউ একজন জানতে চাইছে, কীভাবে এমনটা হলো? কেউ কি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে? তারপর নিজে-নিজেই আশ্বস্ত হন। কোনো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছান মনে মনে। তিনি আক্ষরিক অর্থেই হয়তো মন খারাপ করে পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছেন। আদতে কী হয়েছে কেউ কি বলতে পারেন? এবার যিনি প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন, তিনি সম্ভবত এলাকার ভোটাভুটিতে নমিনেশন পাওয়ার মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের কমতি নেই। সমস্যার সমাধানে তার দক্ষতা আঁচ করা যায়। ছাদবাগানের বিভিন্ন প্রান্তে ধীরে ধীরে উৎসাহী বিভিন্ন সরকারি মহলের লোকজনের আনাগোনা বাড়বে। বাবার অতি যত্নে বানানো বাগানটি এখনই ভয় কাঁপতে শুরু করেছে। আমার হাতের সিগারেটের আগুনটাও তরতর করে কাঁপছে। আমার হাসি পায়। আগুনেরও এত পোড়ার ভয় কিসের? এত বড় বাগান ঢাকা শহরে কোথাও নেই। বাবা এই শহরের নাম দিতে চেয়েছিলেন বাগানের শহর। বাবার স্বপ্নের কথা শুনেছি। শহরের সব বাড়িকে সবুজ বাগান আর দ্রাক্ষারসে বানানো পানীয় দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তিনি অবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বিশ্বাসীদের মতোই জীবন-যাপন করেছিলেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা জটিল। আধপোড়া সিগারেটটা ঠোঁটের কোণে স্থির হয়ে আছে। খানিকক্ষণ পর পর নিভে যাওয়া আগুনটাকে টান দিয়ে তাতিয়ে দিচ্ছি। মুখে জমা হতে থাকা ধোঁয়াগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে বিরিয়ানির গন্ধে মিশে যাওয়া দেখতে থাকি। এত উঁচু ভবনের ছাদ থেকেও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি প্রতিবেশীদের অত্যুৎসাহী মন্তব্য ও আবেগমাখা কণ্ঠ। কেউ আগেরজনের কথার সূত্র ধরে বলে উঠল, শেষ দিকে ওনাকে তেমন দেখাই যেত না। মানসিক কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন কি না, তা-ও তো আমরা জানি না। আহা, ডাক্তারের নিয়মমাফিক চেকআপে কোনো গড়বড় হয়েছে কি না কে জানে। ওপরওয়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে এই বিষয়ে তাদের কারও কোনো দ্বিমত পরিলক্ষিত হলো না। আমি ওদিক থেকে কান সরিয়ে নিয়ে বাগানের গাছগুলোর দিকে তাকাই। বাবার শৈশবের সব স্মৃতি আর দস্যিপনা এই ছাদে এসে ভর করেছে। বেগুন, মরিচ, ফুলকপি, কুমড়া, পুদিনাপাতা থেকে শুরু করে ঢেঁড়স, বরবটিসবকিছু জন্মায় এই ছাদে। এমনকি আম, লিচু, শরিফা, পেয়ারাও বাদ যায়নি। ইট-পাথরের শহরের ভেতর বাবা নিজের নিশ্বাসটা সবুজ করার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। দীর্ঘ জীবনপ্রাপ্তির প্রতি ছিল তার দুর্নিবার আকর্ষণ। কে না এমন প্রত্যাশা করে। বিশাল ছাদটি যেন শহরের অর্ধেকটা দখল করে আছে। কোথাও সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে টব। কিছু জায়গাজুড়ে বড় বড় ড্রাম আধাআধি করে কেটে টব বানিয়ে বাইরের অংশে রংতুলির আঁচড়ে বাহারি ডিজাইন করা হয়েছে। তাতে কলমের চারা ব্যবহার করে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন ফুল, ফল ও সবজির চারা। বাবার শৈশবের ফুলের গন্ধ, বুনো লতার স্মৃতি ছাদের বাতাসে ঘুরপাক খেত। ভোরের আলোয় কিংবা রাতের গভীরে বাবাকে ছাদের কোনো এক কোনায় বুনো ফুল আর দ্রাক্ষারসের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে দেখা যেত নিয়মিতই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাকে না দেখে বাবার লাফিয়ে পড়া নিথর দেহটাকে ঘিরে অগুনতি কৌতূহলী প্রতিবেশী কী কী ভাবতে পারে, তা পুনরায় অনুমান করার চেষ্টা করি। মা নিশ্চিতভাবে এতক্ষণে খবরটা পেয়ে গেছে। হয়তো শেষবারের মতো বাবার মুখটা দেখতে তাকে আসতে হবে। বাবার অন্যান্য স্ত্রীকেও এই বিব্রতকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে একটু পর। বাবার ঔরসে আমি ছাড়া আর কোনো সন্তান আসেনি এই ধরণীতে। এই নিয়ে যদিও বাবা কিংবা মা-কে তেমন একটা ভাবিত হতে দেখা যায়নি। ব্যস্ততা ও একটা দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন অনেক কিছু সহজ করে দিয়েছে তাদের জন্য। বাবার সাথে কার কেমন সম্পর্ক ছিল, তার সবিশেষ আমি জানি না। পেশাগত ও বৈষয়িক আড়াল কখনো আমার সামনে প্রকাশ্য হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তাদের দুজনকেই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে ফেলতে দেখতাম। বাবার বাদবাকি সঙ্গিনীদের সম্পর্কেও আমার বিস্তারিত তেমন কিছু জানা নেই। বাবার সাথে আমার বেশির ভাগ কথাই হতো নানাবিধ ফুল, ফল ও কংক্রিটের জীবন থেকে অনেক দূরে ফেলে আসা একটা ছোট্ট গ্রাম নিয়ে। গ্রামের ডাকাত-সর্দার পিতার ঘরে বড় হয়ে কীভাবে একটা দেশের মানুষকে জয় করে নিয়েছেন, তার গল্প বলতে তিনি ভালোবাসতেন।

তার গ্রামের পুকুরটাকে ছাদে তুলে আনার কথা বলতেন। একদিন এমনই একটা কাজ সত্যিই সফলভাবে সম্পন্ন করে আমাকে তাক লাগিয়ে দেন। ছাদের বড় একটা অংশে উঁচু পিলার, ইট এবং সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে বড় চৌবাচ্চার আকার দিয়ে গ্রামের আস্ত পুকুরটা বাড়ির ছাদে এনে বসানো হয়। মাছ আর জলজ উদ্ভিদগুলো পুকুর থেকে ছাদে উঠে এসে বাবার ছাদবাগানটাতে বসন্তের বাতাস বয়ে আনতে শুরু করে।

বাবার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনটা আমার কাছে কৌতূহল আর আতঙ্কের যুগল উত্তেজনায় ধরা দিয়েছে সব সময়। প্রতিপক্ষের লাশ পড়লে বাবাকে মুষড়ে পড়তে দেখা যেত। তখন দ্রাক্ষারসের অফুরান উৎসের খোঁজে তিনি সারা রাত ছাদের এক কোনায় কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু ক্ষমতাকে কীভাবে পরম যত্নে টিকিয়ে রাখা যায়, তার জন্য বিকল্প পন্থাগুলো তিনি সুকৌশলে ব্যবহার করতে জানতেন। সন্তান হিসেবে আমার উপভোগের দিনগুলো ধরা দিতে না দিতেই তিনি সবকিছু হারিয়ে ফেলেন পরবর্তী সময়ে। আমার ভেতর ক্ষোভ, হতাশা ও লালসার ফোঁটাগুলো জমা হওয়ার আগেই এসব বিষয় থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। মানুষের শাসন ও শোষণের নির্দিষ্ট মুহূর্তগুলো যখন নিমেষেই শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হতে থাকে, তখন একজন পরাজিত ও নিঃস্ব মানুষের মতোই হয়তো তাকে সবকিছু মেনে নিতে হয়। দীর্ঘ কারাবাস আর রাজনৈতিক পরাজয়ের শেষ দিনগুলো তাকে সহায়-সম্বলহীল মানুষের মতো শোকাতুর করে তোলে। উজ্জ্বল দিনগুলোর স্মৃতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতেই তিনি ছাদের জীবনটাতে গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। কখনো বুনো টগরের সাথে কথা বলতে বলতে কিংবা জুঁই-জবা-হাস্নাহেনার সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে রাতটা পার করে দিতেন। সেই সব রাতের কোনো কোনো মুহূর্তে হয়তো সিগারেটের উজ্জ্বল আলো থেকে ধোঁয়া বের হয়ে হাতের দুই আঙুলের গোড়ায় খানিকটা আগুনের আঁচ লাগিয়ে যেত।

সিগারেটের সেই আগুনের আঁচ কখন যে অজান্তেই আমার আঙুলে উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে, সেটা খেয়াল করতেই মনে হলো অ্যাম্বুলেন্সের করুণ সুর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

পুলিশি হইচই আর তদন্তের ষোলোকলা পূরণের গল্পগুলো কেমন হতে পারে তা অনুমান করি। রাষ্ট্রের বিবিধ সংকটের দিনগুলোতে আচমকা একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এমন অপ্রত্যাশিত ও করুণ প্রস্থানের খবর দেশের সকল মিডিয়ায় এখনই হয়তো ভেসে বেড়াতে শুরু করবে।

বাবা যখন ছাদ থেকে লাফ দিল, তার ওজন তখন কত ছিল আসলে? আকাশ বিদীর্ণ করে ছুটে যাওয়া একটি রকেটের সমান? নাকি গভীর সমুদ্রে ভেসে থাকা বিশালাকৃতির জাহাজের সমান?

ছাদের বাতাস থেকে বিরিয়ানির গন্ধ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে।

তারপর চোখ ফিরিয়ে দেখি পুলিশের ইউনিফর্ম পরা কয়েকটি উৎসাহী প্রতিবেশী আমার নাম ধরে ডাকছে। চোখের সামনে ভাসতে থাকে একটা দৃশ্য, বাবার পতনের শব্দে ছুটে আসছে একদল অচেনা প্রতিবেশী, রাষ্ট্রীয় পাইক-বরকন্দাজ, মিডিয়ার লোকজন আর শত শত কৌতূহলী পিঁপড়া।

কিন্তু সেসব কোনো কিছুই পুলিশের পোশাক পরা লোকগুলোকে বিচলিত করতে পারে না। খানিকটা নিরাসত্ত ভঙ্গিতেই আমাকে নিচে নামার নির্দেশ দেয়। ইঙ্গিতে বোঝা গেল থানা-পুলিশের নজরদারি থেকে আমি আপাতত মুক্ত নয়। তাদের মধ্য থেকে একজন আমার শরীর ঘেঁষে এমনভাবে দাঁড়াল যে, বিরক্তিতে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হলো। আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি?

এই মুহূর্তে বাবার সঙ্গটা খুব বেশি মিস করতে লাগলাম। বাবাও কি আমাকে ঠিক একই রকমভাবে মিস করছে? জুঁই-টগর-চামেলি কিংবা বুনো টগরের গল্প বলতে মুখিয়ে আছে? আসলেই কি বাবার শৈশবে এসবের অস্তিত্ব ছিল? বাবার ডাকাত-সর্দার পিতার রক্তমাখা হাতে কি কখনো খেলা করত ফুলের ঘ্রাণ?

পুলিশের নজরদারি আর জেরার কথা কল্পনা করতেই দেখি বাবার রেখে যাওয়া আধপোড়া সিগারেটটা আঙুলের ফাঁকে নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। তীব্র কৌতূহল আর উত্তেজনা নিয়ে সিগারেটটাতে আরেকবার দীর্ঘ চুমুক বসালাম।

সিগারেটটা লাই পেয়ে পুনরায় জ্বলে উঠল। সেই আগুনের মধ্যে বাবার লাফিয়ে পড়ার দৃশ্যটা ভেসে ওঠে, যেন মাথার ওপর দিয়ে একটা রকেট পৃথিবীর সমান ওজন নিয়ে তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে দূরের আসমানে।

পুলিশের হ্যান্ডকাফ থেকে খানিকটা দূরে বাবার লাশের দিকে একবার তাকানোর ইচ্ছাটা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে।