আহ! আহ্লাপাহ্

 

এক অদ্ভুত কিসিমের মানুষ। হাঁটা খুব পছন্দ। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতে পারে বহুদূর পথ। প্রায়শই পথ হারিয়ে হাঁটে। পথ হারিয়ে হাঁটাতেই নাকি আনন্দ। চেনা পথে বেশি কিছু পাওয়া যায় না। কিছু পেতে হলে যেতে হয় অচিন পথে। কিছুটা ঘুর পথে। এ হচ্ছে তার জীবনের দর্শন।    
অধিক অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই বয়েসেই তার পায়ের হিলে স্পার দেখা দিছে! বউ বলে, তার হবে না তো কার হবে! বউটা তার মাঝে মধ্যে দার্শনিকের মত কথা বলে। মানুষের নাকি সব কিছুর কোটা আছে। নির্দিষ্ট বরাদ্দ আছে। তারও যতখানি হাটনের কথা ছিল তার থেইকা বেশি হাইটা ফালাইছে বইলা পায়ে স্পার গজাইছে। এর অর্থ হইল এইবার খেমা দেও। স্থির হইয়া ঘরে বস। 
আর এইসব প্রসঙ্গ এলেই ছোটবেলায় দেখা এক ভিক্ষুকের মুখচ্ছবি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। 
লাঠিতে ভর করে ঠুকঠুক শব্দে হেঁটে চলছে ভিক্ষুক লোকটা। মুখে সফেদ শাদা চাপ দাড়ি। চোখ দু’টা গর্তে ঢোকানো। শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডলের দৃশ্যমান অংশটুকুতে বলিরেখা স্পষ্ট। খ্যাংরাকাঠি চেহারা।  
প্রতিদিন গড়ে দশ-বার কিলোমিটার পথ হাঁটত লোকটা। হাঁটা অর্থ বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করা। বয়স যখন আশি ছুঁই ছুঁই তখনও তার শিরদাঁড়া অতটা বাঁকা হয়ে যায়নি। সামান্য যতটুকু ঝুঁকেছে হাতে ধরা লাঠিটা দিয়ে অনায়াসে সে তা ঠেকা দিয়ে দিত। ঠিকমত খাবার-দাবার জুটত না—অথচ শরীর তার স্থানীয় লোকজনের ভাষায়, ‘লাগে য্যান হুক্কারকাডা’। ঠিকঠাক আমিষ-শর্করার যোগান থাকলে একশ বছর বয়সেও সে এমন হাঁটতে পারত বলে সবার ধারণা। লোকটা প্রায় নব্বুই বছর ধরে বেঁচে ছিল। 
এই ভিক্ষুক লোকটাই নাকি তার হাঁটার অনুপ্রেরণা।   
হাঁটার জন্য তার প্রথম পছন্দ পাহাড়। আর পাহাড়ের দিকে গেলেই অনিবার্যভাবে সঙ্গী হয় মংখ্যে মার্মা। মংখ্যে তার মনের ভাষা বোঝে, আর সে বোঝে তাকে। একটা পাখি উড়ে গেল তো মংখ্যে চিল্লান দিয়া উঠবে, দ্যকদ্যাক-গেলগা তো! আবার তার চোখে একটা বেজি বা গুইসাপের নড়াচড়া ধরা পড়ল তো-মংখ্যেরে ডাক দিয়ে দেখাবে সে, উরিসসালা সেই রকম জিনিস! এভাবে ধীরলয়ের এক যৌথ-পর্যটন চলে পাহাড়ে খাঁজে খাঁজে।    
হাঁটার জন্য সবসময় তার পছন্দ হচ্ছে-ঘুরপথ। ঘুরপথে যেতেই আনন্দ। দীর্ঘকালের হাঁটার অভিজ্ঞতা থেকে সে এটুকু বুঝেছে—পথ যত দীর্ঘ হবে দেখাও হবে তত গভীর!  

অন্যরকম পথ

এবারের পথটা একটু অন্যরকম। সঙ্গী যথারীতি মংখ্যে। গভীর-নির্জন। সুনসান। পথের খাঁজ এবং বাঁকও অনেক বেশি। পথের ধারে গভীর খাদ। পায়ে লেগে দু’একটা পাথর ছুটে গিয়ে নিচে পড়লে দীর্ঘ সময় পরে গভীর তলদেশ থেকে ভোঁতা শব্দ ভেসে আসে। আর এই শব্দ দিয়ে মংখ্যে পরিমাপ করে নেয় খাদের গভীরতা।
—বউদ্দুর! লাশ তোয়াইত হেলিকপ্টার লায়িবু। 
এইটা আসলে একটা কথার কথা। সেও বোঝে মংখ্যেও জানে হেলিকপ্টার দুই পাহাড়ের অপরিসর খাদের ভিত্রে নামার প্রশ্নই ওঠে না। একটা হইতে পারে, হেলিকপ্টারের রোটর কটরখটরমটরমট করে ঘুরতে থাকবে। ঘুরতেই থাকবে। কেউ একজন দড়ি বেয়ে নিচে নেমে রেস্কিউ করবে। একতাল মাংসপিণ্ড-দলাপাকানো হাড়গোড় সমেত শবদেহ প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে তুলে আনবে!      
—আরে ডর দেখাস ক্যান? নিজের চিন্তা নিজে কর।
তারা নরমালি তুমি বা আপনি সম্বোধন করে পরস্পরকে। তবে আবেগঘন মুহূর্তে তুই-তোকারি শুরু হয়ে যায়। মংখ্যে যখন বলবে, 
—চুদিরপুত সাবধানে হাট। পইরা গেলে চইইয়ার মাথায় হ্যাজাক বাইন্ধা খোঁজা লাগব। তাও তোয়াই পাওন যাইত না। 
তখন বুঝতে হবে প্রেম তার উথলে উঠেছে। 
পাহাড়ের একটা বৈশিষ্ট হল, যত দুঃখ তত সুখ। এটা যেন একেবারে বাটখারায় মাপা! একটা জায়গা পার হতে জান বেরিয়ে যায় যায় অবস্থা তো সেটা পার হয়েই পাওয়া যাবে মধুর এক প্রশান্তি। হিম শীতল বাতাস কিংবা চোখ জুড়ানো এক উপত্যকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘাস ফুল!  
এ যাত্রায়ও পথের চড়াই-উতরাইয়ের সাথে তাল রেখে এসবের দেখা পেয়ে আসছিল নিয়ম করে। ক্লান্তিতে শরীর যখন ধরে আসছিল, শরীরের ভার যেন বহন করতে পারছে না আর দু’পা; এই বুঝি দেহখানা ব্যাগবোচকা নিয়ে উড়াল দেবে গভীর খাদের তলার দিকে! 
ঠিক তখনই মেয়েটাকে দেখতে পেল তারা।  
মংখ্যে যেন একটু চমকাল। সে এখানে এ ধরনের কারো উপস্থিতি আশা করে নাই। একে তো এই পথটা সে অর্থে প্রচলিত ট্রেইল না। অস্পষ্ট পথরেখা। গতবারের জুমে যাওয়ার পথ হতে পারে। এ বছর আশেপাশে তেমন কোন জুম নেই বলেই মংখ্যের ধারণা।   
এমন নির্জনে-যেখানে জনমুনিষের দেখা পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নাই, ঠিক সেখানে এই নারী মূর্তি তাদের ধন্দে ফেলে দিল। কিছুটা ভয়, কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা অবিশ্বাস—সব মিলিয়ে ভজঘট অবস্থা। আরো খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর তাদের মনে হচ্ছিল আর দু’চার কদম গেলেই মেয়েটিকে পরিষ্কার দেখতে পাবে। কিন্তু কি আশ্চর্য! চোখের পলক পড়ে কি পড়ে নাই—মনুষ্যমূর্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! এ নিশ্চয়ই চোখের ভুল, মনের ভ্রম!   
—যাউজ্ঞা। মংখ্যে আগাইয়া যা।  
নিজেরে নিজে সাহস যোগানোর ভাষা এটা। তারা আগাতে থাকে। এবার আরেকটু ধীর গতি। আরেকটু সতর্ক। নৈঃশব্দ্য ঘিরে ধরে। হার্টবিট শোনা যাওয়ার মত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এতক্ষণ যে সকল ঝিঁঝি পোকারা তারস্বরে চিৎকার করছিল কোরাসে তারাও কার যেন ইঙ্গিতে থেমে গেল হঠাৎ। পাখিদের কলকাকলি, বাতাসের শব্দ সবকিছু একযোগে থেমে যাওয়ায় একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি হল। মংখ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল ভয় কিছুটা সত্যি সত্যি পেয়েছে। ভয় এবার তার ভিতরেও সঞ্চারিত হওয়া শুরু হল। সমুদ্রে যাত্রায় যেমন মাঝির মুখের দিকে তাকিয়ে বিপদের মাত্রা মাপে লোকজন কিংবা পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভারের মুখের কুঞ্চনরেখা দেখে নির্ভার হওয়ার চেষ্টা করে যাত্রীরা তেমনি মংখ্যের সাথে পাহাড় ডিংগানোর কালে তার চান মুখের মধুর হাসিই সঙ্গীদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। সেই মংখ্যের মুখের হাসি যখন উধাও, চোখে মুখে চিন্তার ছাপ তখন আর নিঃশঙ্ক থাকা যায় না। দু’জনারই চোখ আটকে আছে সামনের বাঁকটাতে। সামনের বাঁকটা খুব বেশি দূরে না। তবে পথটুকু বেশ দুর্গম। কিছু জায়গা বেশ খাড়া বেয়ে নামতে হল। ঘোড়ার ক্ষুর আকৃতির খাঁজ বেয়ে পঞ্চাশ গজের মত নামতে শিরদাঁড়া বেয়ে কুলকুল শব্দে ঘাম নামছে। ষাঁড়ের পিঠের মত একটা দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া গেল নিচে নেমে। আদতেই ষাঁড়ের পিঠ। দুপাশ দিয়ে পেলব ভঙ্গিতে খাড়া নেমে গেছে। এই যায়গাটুকু ভারী ভাল লেগে গেল দু’জনার। খুব বেশি দীর্ঘ নয়। সাকুল্লে একশ মিটার হবে কিনা সন্দেহ আছে। এই জায়গাটুকুতে কোন গাছ বা ঝোপঝাড় নেই। মসৃণ সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো। একটা তাগড়া ষাঁড় যেন ঘাড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পশ্চিম দিকে সুউচ্চ পাহাড়ের ছায়া এসে ষাঁড়ের পিঠে পড়েছে। কী এক অদ্ভুত মায়া চারপাশে! এই সুন্দর আর নৈঃশব্দ্য তাদের টেনে ধরে, তারা দু’জনেই হাঁটু মুড়ে বসে যায়। মংখ্যে চোখ কুতকুত করে তাকায়। ভাবখানা এমন—হে হে কোথায় নিয়া আসলাম,দ্যাক ব্যাটা!  

রহস্যময় বাঁক   

বাঁকের ওপাশটা কি এক দুর্মর আকর্ষণে টানছে। মংখ্যে ইশারায় বোঝাতে চাইল, বাঁকটা ঘুরলেই এক বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। তার মনও বলছে বাঁক পার হলেই রহস্যের জট খুলে যাবে। আর এ ভাবনা থেকেই এই সুন্দরের মাঝে যতখানি সময় ডুব দিয়ে থাকার কথা ছিল, তারচে অনেক অনেক কম সময় নিল তারা। আবার কিছুটা পথ খাড়া বেয়ে উঠতে হল। সেই একই হাল-অশ্ব ক্ষুরাকৃতি খাঁজ বেয়ে ওঠা। সহসা তার কানের পাশ দিয়ে বুলেটের মত কি একটা যেন ছুটে গেল। কেউ কি গুলি করল? নাকি কোন তীরন্দাজের ছোড়া তীর অথবা গুলতি? মংখ্যে জানাল, একটা বাদুড় উড়ে গেছে। সঙ্গী যাতে ভয় না পায় সে উদ্দেশ্যে কথা বলতে শুরু করেছে মংখ্যে। আর ঘণ্টাখানেক নিচের দিকে নামলে একটা ঝিরির দেখা পাওয়া যাবে বলে সে জানাল। পাহাড় ট্রেকিঙে এই এক মজার বিষয়—ঝিরি। পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই ভেঙে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ মন নিমিষেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে ঝিরির শব্দে! মংখ্যে ঝিরির প্রসঙ্গ তুলতেই ভিতরে অনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল, যেন সেতারের ঝালার শব্দতরঙ্গ ছুঁয়ে গেল অন্তর-মন।  
অবশেষে বাঁকটা পার হল তারা। প্রথমে মংখ্যে পরে সে।   
কই, কিছুই তো নেই এখানে! সুনসান নীরবতা। অথচ তাদের মনে হচ্ছে এই একটু আগেই কেউ ছিল এখানে। বুনোফুলের ঘ্রাণের সাথে যেন মিশে আছে কারো শরীরের গন্ধ! এক জায়গায় দুমড়ানোমুচড়ানো ঘাস-লতাপাতা দেখে তাদের মনে হল—একটু আগেই কেউ একজন বসেছিল এখানে। কারো উপস্থিতির উষ্ণতা মাখামাখি হয়ে আছে জায়গাটিতে।   

কোথাও কেউ নেই। যতদূর চোখ যায়—খা খা শূন্যতা। ঘোরের মধ্যে যেন এক অলীক স্বপ্ন অথবা কোন এক মায়া হরিণ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। একটা অদ্ভুত সুন্দর নাম না জানা পাখি ডানা ঝাপ্টে উড়ে গেল।  

এবার মংখের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মৃদু হাসির রেখা। হাসিতে অদ্ভুত এক রঙ ছড়াতে দেখা গেল। গোধূলির রঙ যেন ছড়িয়ে পড়ছে সবুজ পাতাদের উপর। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পাখিটা তার চেনা। এটাও বোঝা গেল এখনই এ পাখি বিষয়ক গল্পের কিনারা হবে না। আগে যেতে হবে ঝিরি পর্যন্ত। ঝিরিতে গা-মাথা ধুয়ে শরীর জুড়িয়ে নিয়ে দু’ঢোক দোচয়ানি পেটে চালান করে দিয়ে সে আয়েশ করে বসবে একটা পাথরের উপর। একটা ডার্বি ধরিয়ে দুটো সুখটান দিয়ে সে খুলে বসবে তার গল্পের ঝাঁপি।    

ক্রমশ ঝিরির শব্দ নিকটবর্তী হচ্ছে। 

এমন দৃশ্য দেখার জন্য কোনভাবেই তারা প্রস্তুত ছিল না। ঝিরি-ঝর্না তো জীবনে কম দেখা হয় নাই—ক্যামলং, চ্যামা, পদ্ম, আন্ধারমানিক, হরিণকাটা, গাছকাটা, গবাছড়ি, বগামুখ, নাফাকুম, দেবতাকুম, রাইক্ষ্যং…আহা!    
এমন সুন্দর এর আগে কখনই তাদের চোখে পড়ে নাই। তারা আরো অবাক হল এ দৃশ্যের ভেতর একটু আগের দেখা অপূর্ব সুন্দর পাখিটিকে দেখে। চুপচাপ বসে আছে যেন তাদেরই অপেক্ষায়।
তার বসার ভঙ্গিটাও অপূর্ব ঠেকছে তাদের চোখে।
 
মংখ্যের চোখ মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। সে বিড়বিড় করছে—আহ! আহ্লাপাহ্! আহ্লাপাহ্!  

নোট: আহ্লাপাহ্ মার্মা শব্দ। যার অর্থ সুন্দর।