ঔপনিবেশিক কলকাতায় সুলতানের শিল্পযাত্রা
সুলতানের জন্মবছরে ভারতীয় চিত্রকলার পরিসরে বড় ধরনের একটি ঘটনা ঘটে। তা হলো কলকাতায় জার্মানির বাউহাউস শিল্প ঘরানার চিত্র প্রদর্শনী। ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টের চতুর্দশ বাৎসরিক প্রদর্শনীর সঙ্গে এটি অনুষ্ঠিত হয়। চলেছিল ১৯২২, ২৩ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি, ১৯২৩। পক্ষকালের এই প্রদর্শনী ভারতীয় চিত্রকলার একটি বাঁকফেরানো ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শিল্পী ভাসিলি কান্দিনিস্কি, পল ক্লি, লিয়োনেল ফেনিংগার প্রমুখের ছাপাই ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী নব্যবঙ্গীয় চিত্ররীতি তথা বেঙ্গল আর্টের ছবি। এটা ছিল অভিনব একটি চিত্র প্রদর্শনী, কারণ এর আগে ভারতবর্ষে এ রকম ঘটনা আর ঘটেনি। এই প্রথম ইউরোপীয় একটি ধারার শিল্পীদের মূল ছবি দেখার অভিজ্ঞতা হয় এ দেশের শিল্পী ও রসজ্ঞদের। বাউহাউস বিদ্যালয়ের নব্যধারার শিল্পী এবং বঙ্গীয় শিল্পীদের মধ্যে একটি বিষয়ে সাধারণ মিল ছিল, উভয়ের মধ্যেই মূলধারার শিল্পের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যয় ছিল। বাউহাউস আভা গ্রাদ বিদ্যায়তনিক প্রকৃতিনিষ্ঠ [ন্যাচারালিস্টিক] শিল্পের প্রতিপক্ষ ছিল; নব্যবঙ্গীয় শিল্পীরা ভারতে প্রতিষ্ঠিত ভিক্টোরীয় অ্যাকাডেমিক শিল্প প্রতিরোধের প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এ সময় হ্যাভেল ও অবনীন্দ্রনাথের প্রাচ্যশিল্প আন্দোলন তথা বেঙ্গল আর্টের রমরমা অবস্থা। ঔপনিবেশিক শিল্পশিক্ষা এবং শিল্পচর্চার বিউপনিবেশায়নে শিল্পীরা ব্রতী হন। স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে গতিপ্রাপ্ত প্রাচ্যশিল্প আন্দোলন ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের প্রভূত পৃষ্ঠপোষকতায় অর্জন করে। বেঙ্গল আর্ট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হলেও এটি নিখিল ভারত তো বটে, পশ্চিমা দেশেও নিজেদের জানান দিতে সক্ষম হয়। কলকাতায় বাউহাউসের আগমন এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অতএব বলা যায়, সুলতানের জন্মচিৎকারের সাথে চিত্রকলার, অন্ততপক্ষে বঙ্গীয় চিত্রকলার একটি সূর্যোদয়ের ঘটনা ঘটে। আর প্রখ্যাত শিল্পসমালোচক পার্থ মিত্তির তাঁর গ্রন্থ The triumph of modernism-এ এই ঘটনাকে ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার অভ্যুদয় হিসেবে চিহ্নিত করেন।
কলকাতায় বাউহাউস শিল্প প্রদর্শনী প্রভাব নিয়ে কোনো গবেষণালব্ধ দলিল আমাদের হাতে নেই। তবে এই প্রদর্শনী রবীন্দ্রনাথের শিল্পরচনার প্রেরণার উৎস হয়েছিল। গগেন্দ্রনাথও এর পর থেকে নতুন ধারায় আঁকতে শুরু করেন। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে এই প্রদর্শনী ভাবনাও বিবেচনার নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। আরেকটি বিষয় হলো, বিশের দশকের শুরু থেকেই বাংলার চিত্রকলা নতুন পথ খুঁজছিল, তিরিশের দশকে যেয়ে তা স্পষ্ট হয়েছিল। অশোক ভট্টাচার্যের ভাষায়,
একদিকে যেমন অ্যাকাডেমিক-সিদ্ধ ধারার চিত্রকলা থেকে মুক্ত হচ্ছিলেন কোনো কোনো শিল্পী, অন্যদিকে তেমনই অবনীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত চিত্রকলার পুরাণকথানির্ভর বিষয় আর কুহেলিকাময় পরিবেশে ক্ষীণ আলোকদ্যুতিতে অভিব্যক্ত তার চিত্ররূপের রীতিবদ্ধতা থেকেও বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন কেউ কেউ। বাংলার চিত্রকলা নতুন এক অর্থে, আধুনিক ইউরোপীয় চিত্রকলার নিরিখে, নব্যতন্ত্রী হয়ে উঠেছিল সেই সময়েই।
আর, এ ক্ষেত্রে, বলাই বাহুল্য কলকাতায় বাউহাউস প্রদর্শনীর প্রতিফলন ছিল বলে ভাবা যায়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলা এখানে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং প্রদর্শনীতে বিক্রীত একমাত্র ছবিটিও তিনি কিনেছিলেন। প্রদর্শনী অব্যবহিত পরে কবির তুলি থেকে অজস্র ছবি পয়দা হতে থাকে। অনেকের ধারণা, এই প্রদর্শনী রবীন্দ্রনাথকে ছবি আঁকায় উম্মাদনা জুগিয়েছিল।
নব্যবঙ্গীয় চিত্রকলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের শিল্পরসিক ও চিন্তকদের যে সম্মিলন ঘটেছিল, তা রীতিমতো আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। স্বভাবতই নব্যবঙ্গীয় চিত্রকলা কিংবা ভারতশিল্প আন্দোলন ও সমসাময়িক বিশ্ব শিল্পভাবনা নিয়ে সংক্ষিপ্ত হলেও আলোচনা জরুরি। আমরা যদি ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টের মুখপত্র ‘রূপম’-এর সূচিতে চোখ বোলাই, তাহলে দেখব দুনিয়ার তাবৎ অরিয়েন্টালিস্ট এই পত্রিকায় লিখছেন। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে বিবিধ উচ্ছ্বসিত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এর আলোকে এখানকার চিত্রকলার স্বরূপ নির্মাণের প্রয়াস চলছে একাধিক দশক।
সুলতানের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে নব্যবঙ্গীয় প্রাচ্যকলার প্রতাপ ক্রমেই মলিন হতে থাকে। পাশ্চাত্যপন্থার অনুসরণ কিংবা পাশ্চাত্যপন্থাকে অবলম্বন করে নিজস্ব ধারাকে নবরূপে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস জোরালো হয়। অবনঠাকুরের ছাত্র-শিষ্যরা ভারতবর্ষের কলাকেন্দ্রসমূহের শীর্ষে অবস্থান সত্ত্বেও এই ধারায় ক্ষয় রোধ করা সম্ভব হয়নি। এর একটি কারণ হয়তো নব্যবঙ্গীয় প্রাচ্যশিল্পী ও তাত্ত্বিকেরা এই ঘরানার পক্ষে জোরালো কোনো ধারণা উপস্থাপন করতে পারেননি, অপরদিকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্থায়িত্বশীল কোনো শিক্ষা কার্যক্রমও প্রণয়ন করতে সক্ষম হননি। প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকলার প্রতি সবারই গভীর অনুরাগ ছিল, কিন্তু তার স্বরূপ কী কিংবা বর্তমান সময়ে তা কীভাবে পুনরুদ্ভাবিত হবে, সে নিয়ে পরিষ্কার কোনো পরিকল্পনা উপস্থাপন সম্ভব হয়নি। এটা লক্ষণীয় যে, শত উচ্ছ্বাস সত্ত্বেও প্রাচ্যচিত্রকলার কোনো বাজারও তৈরি হয়নি। মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়ার মনে পশ্চিমের প্রতি লেপ্টে থাকা আকর্ষণ স্বদেশি জোয়ারের মধ্যেও ধুয়ে যায়নি।
সে-সময়ে শিল্পীরা স্বদেশ-চেতনা, দেশপ্রেম আর নিজ পরিচয় নির্মাণে গভীরভাবে মগ্ন ছিলেন। নব্যবঙ্গীয় ধারার শিল্পীদের প্রথম স্তরের কেউ কেউ মগ্নতার মধ্যে শিল্পোত্তীর্ণ চিত্রকলা সৃজন করেছিলেন, কিন্তু ক্রমেই তা দিগভ্রান্ত ও হতশ্রী হয়ে পড়ে। এই ধারার
সুলতান প্রভুত সৌভাগ্যবান যে, তিনি আশ্রয়-প্রশ্রয় পেলেন খ্যাতিমান শিল্পসমালোচক শাহেদ সোহওয়ার্দীর। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে এবং তাঁর সুবিস্তৃত লাইব্রেরির আর্টবিষয়ক গ্রন্থাদির বদৌলতে রূপজগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হন। এখানেই তিনি বিশ শতকের খ্যাতিমান শিল্পী ভ্যান গঘ, গগ্যাঁ, পিকাসো প্রমুখ এবং রেনেসাঁস শিল্পীদের বিপুল ছবি দেখা এবং তাঁদের নিয়ে প্রণীত গ্রন্থাদি পাঠের সুযোগ পেলেন। পাশাপাশি তাঁর আত্মকথনে জানা যায়, চিত্রকলার নানা বিষয় নিয়ে সোহওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হতো
শিল্পীরা অতীত ইতিহাস, পুরাণ এবং মহাকাব্যের ভুবন ছবির প্রধান বিষয় করেছিলেন। বর্তমানের কাম্যতা কমই প্রতিফলিত হয়েছিল। আবার অনেকে লোকায়ত চিত্রকলাকে নবরূপে প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। এখানে একটি বিষয় বিবেচ্য, শিল্পকলার ক্ষেত্রে সময় ও যাপনচর্চার পরিবর্তন একটি নিয়ামক। আমাদের গ্রাম দেশে এখনো বিভিন্ন ধরনের পুতুল তৈরি হয়, মাটির হাঁড়িপাতিলে আলপনা আঁকা হয়, নকশিকাঁথা হয়—এগুলোতে অবশ্যই শিল্পসৌন্দর্যের ছোঁয়া রয়েছে, কিন্তু একই কারুকার্যের বছরের পর বছরের পুনরাবৃত্তি এগুলোর শিল্পমান মলিনই করছে। সময়ের সাথে এগুলোর সৃজনমূল্য বাড়ানোর সুযোগ ছিল। অবশ্য লোকশিল্পের থিম নিয়ে কেউ কেউ কাজ করে সফল হয়েছেন। যামিনী রায় প্রকৃষ্ট নজির। কিন্তু সবার পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস ও কাব্যের চরিত্র নিয়ে ছবি এঁকেও আবেগকে সংযত করে শিল্পমানসম্পন্ন ছবি আঁকায় অনেকেই সফল হননি। তাঁরা ভালো ছবি এঁকেছেন, তবে প্রাদেশিকতার গণ্ডি কমই ডিঙাতে পেরেছেন। সে-সময়ের চিত্রকলা নিয়ে শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ:
কিন্তু বাঙালী শিল্পীর নবীন চেষ্টার মধ্যে, সব সময়েই শক্তি বা কৃতকারিতা দেখা যায় না। প্রাচীন শিল্পের প্রতি একটা অন্ধ শ্রদ্ধা আসিয়া পড়ায়, বহুশঃ জীবন্ত অপেক্ষা প্রাণহীন অনুকরণ-চেষ্টাই দেখা যায়। ...দর্শন-শক্তিযুক্ত চক্ষু এবং শিল্পদৃষ্টি-নিয়ন্ত্রিত অকম্পিত হস্ত—এই দুই-ই বিশেষ সাধনার অপেক্ষা রাখে। ...আধুনিক বাঙ্গালী শিল্পীদের অনেকে প্রাচীনের চিন্তা-ধারার সহিত পরিচয় রাখেন না, আধুনিক জীবনেও ভালো করিয়া জানেন না।
এদিকে যান্ত্রিক ও যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতির টানাপড়েনে খোদ ইউরোপেই বিজ্ঞানভিত্তিক চিত্রকলার প্রতি অনীহা জাগে এবং এর প্রতি-শিল্প ভাবনা সংঘটিত হয়। সম্ভবত ই. বি. হাবেলরা এ ধারার লোকই ছিলেন, এঁরা ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার মধ্যে দু-দণ্ড শান্তি খুঁজেছিলেন। অন্যদিকে কুমারস্বামী মধ্যযুগীয় নিখিল বিশ্বের সাধারণ ভাবের সমন্বয় ঘটিয়ে একধরনের নবতর শিল্পধারা রচনায় তাড়িত হন। এ বিষয়ে তিনি প্রেরণা পেয়েছিলেন মরিস ও আর্চারের আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট মুভমেন্ট থেকে। আবার জাপানের ওকাকুরা কুকোজো ‘এশীয় এক’ স্লোগানে এশীয়নিষ্ঠ চিত্রকলা চর্চার প্রচার চালান। আর বিবেকানন্দ-শিষ্যা ভগিনীয় নিবেদিতা ভারতশিল্পের এক আধ্যাত্মিক রূপাদর্শ তুলে ধরেন এবং ভারতশিল্পে তা প্রতিফলনে নিয়োজিত হন। এঁদের সম্মিলিত প্রভাব নব্যবঙ্গীয় শিল্পীদের ওপর বর্তিয়েছিল। এখানে দেখার বিষয়, নব্যবঙ্গীয় জাতীয়তাবাদী শিল্পধারার উদ্যোক্তা ও প্রবক্তারা মূলত ছিলেন অভারতীয়। এটা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা।
ইউরোপে ভারতবর্ষে একাডেমিক চিত্রধারায় বিপরীতে নানা ভাঙচুর ও আন্দোলনের সূচনার আগেই ইউরোপে তা সংঘটিত হয়। বিশেষ করে চিত্রকলায় সেজানীয় বিপ্লবে পর সাবেকি আদর্শের বিপুল পরিবর্তন ঘটে। এই ধারার শিল্পীরা, যথা সেজান, গগাঁ, গখ, রেনোয়া, মাতিস—এঁরা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লোক হলেও এঁদের প্রতাপ দৃশ্যমান হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। ভারতবর্ষে যখন অ্যাকাডেমিক ধারার শিল্পচর্চা করার জন্য একদল লোক রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তখন পাশ্চাত্যে এই পদ্ধতিকে মুড়িয়ে নতুন রীতির জয়জয়কার। দেহের মাপজোক আর বিধিবদ্ধ নিয়মের মধ্যে তাঁরা আর রইলেন না। কারণ, প্রাচীন ও আদিম শিল্পকলা আর দেশ-বিদেশের লোকশিল্পে অস্থিবিদ্যার মাপজোকের মধ্যে শিল্পকে আটকিয়ে রাখেনি। এভাবে রেনেসাঁর পর থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত অ্যানাটমির যে দিগ্বিজয় চলছিল, তা ভেঙে পড়ে। একের পর এক শিল্পান্দোলনে বৈচিত্র্যময় যত সব পদ্ধতি ও কৌশল উদ্ভাবিত হতে থাকে। একই অবস্থা আমরা দেখি স্বদেশি যুগে অবনপন্থী চিত্রকলায়, তাঁরা মাপজোকের ধার ধারেননি। একদিকে চরমপন্থী পাশ্চাত্য-শিল্পীরা একাডেমিক ধারা থেকে মুক্তি পেতে হাড়-মাংসের মাপজোক ধ্বংস করেন, অন্যদিকে অবনপন্থী শিল্পীরা অ্যাকাডেমিক ধারা থেকে মুক্তি পেতে প্রাচীন শিল্পশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণে আশ্রয় নেন। আরেকটি কাজ তাঁরা করেছিলেন, অ্যানাটমির ভাঙচুরের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন আধ্যাত্মিকতা, স্বাজাত্যবোধ, ন্যূনতমপক্ষে ভাবের খেলা। চিত্রের বিষয়-আশয় মোটামুটি নির্দিষ্ট থাকায়, বৃষ্টির অঝোর ধারার মতো ছবি উৎপাদিত হতে থাকে। অনেক ছবিতেই ভাবাবেগের ঘনঘটার তলায় লুপ্ত হয় শৈল্পিক মানোত্তীর্ণতা। আবার অতি পাশ্চাত্যপন্থার ঝলসানো সব ছবি সৃষ্টি হলেও তার সঙ্গে ভাবের খোঁজ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বিশ শতকের তিরিশের দশকে এসে আবেগ ও কুহেলিকা থেকে বেরিয়ে শিল্পীরা নতুন ধারার ছবি আঁকতে থাকেন। পাশ্চাত্য শিল্পপদ্ধতি নির্দ্বিধায় চর্চায় বিষয় হয়, তবে শিল্পীদের কেউ কেউ অস্তিত্বসংলগ্ন বাস্তবতার সঙ্গে একে জুড়ে দিতে প্রয়াসী হন। এভাবে চিত্রকলার ভিন্ন একটি ধারা তৈরি হয়। কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে উত্তীর্ণ পূর্ববঙ্গীয় শিল্পীরা এই ধারারই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, পরে এঁদের নেতৃত্ব গড়ে ওঠা ঢাকা আর্ট স্কুল তা ধারণ করে।
সুলতানের জন্মভূমি নড়াইল জমিদারবাড়ির একজন ছিলেন অরুণ রায়। তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন, বছর তিনেক পর স্কুল ছেড়ে স্বাধীনভাবে ছবি আঁকেন। আর তাঁর মাধ্যমেই সুলতান ইউরোপীয় ওল্ড মাস্টারদের বিশ্ববিখ্যাত কাজগুলোর প্রতিচিত্র প্রথম দেখার সুযোগ পান। ছোটবেলায় পটুয়া নাচগানের সঙ্গে দেখা তাঁদের আঁকা পটচিত্র থেকে সেগুলো ছিল আলাদা। এগুলো আঁকা হতো আলতা, হলুদ, কালিচুন, পুঁই-তেতুল-বড়ুইয়ের বীজ উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। সুলতান নিজেও স্কুলশিক্ষক কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্যের আগ্রহে এভাবে আঁকতে শিখেছিলেন। অরুণ রায়ের কাছেও শেখা শুরু করেন। স্থানীয় জমিদার ডি.এন রায় যখনই কলকাতা যেতেন, সঙ্গে করে কালার বক্স, ব্রাশ, আর্ট পেন্সিল নিয়ে আসতেন। এভাবে বিশাল ব্রিটিশ-ভারতের পূর্ব বাংলার এক প্রান্তে সুলতান শিল্পী হওয়ার সাধনা চালিয়ে যেতে থাকলেন। এখানেই পটশিল্পের পাশাপাশি কলকাতায় চর্চিত শিল্পপদ্ধতির সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচয় ঘটে। বড় শিল্পী হওয়ার বাসনাও জেঁকে বসে। অরুণ রায় কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির উৎসাহ জুগিয়ে চলেন।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান কলকাতায় গেলেন। কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার বাসনা ও তাড়না প্রখর হয়েছিল। গিয়ে উঠলেন ভবানীপুর রুবি স্টুডিওতে। স্টুডিও স্বত্বাধিকারী নড়াইল জিটি স্কুলের আর্ট শিক্ষক কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্য। তিনি ইতিমধ্যে শিক্ষকতা ছেড়ে এখানে সাইনবোর্ড লেখার দোকান খুলেছেন। সুলতান সাইনবোর্ড লেখার কাজ করেন আর অবসরে প্রিয় শিক্ষকের কাছে আঁকার তালিম নেন। একদিন মাস্টারবাবুকে নিয়ে দেখে এলেন কলকাতা আর্ট স্কুল, বাইরে থেকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন। দেখতে দেখতে রুবি স্টুডিও তে কেটে গেল এক বছর। রুবি স্টুডিও থেকে গিয়ে উঠলেন কাশিপুর, নড়াইল জমিদারদের কলকাতাস্থ বাড়ি। সেখানে ফের পেলেন চিত্রশিল্পী অরুণ রায়কে। আঁকার পাশাপাশি বিদেশি ওল্ড মাস্টারদের ছবি বুঝে চলছেন। চষে বেড়াতে লাগলেন কলকাতার গলি-ঘুপচি। যান থিয়েটারে, সংগীত ও নৃত্যের আসরে। এ সময় ডিএন রায়ের বন্ধু ওসি গাঙ্গুলির কাছেও তিনি আঁকা শেখেন। ওসি গাঙ্গুলি ছিলেন ল্যান্ডস্কেপ শিল্পী। তিনি ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট থেকে প্রকাশিত জার্নাল রূপম-এর সম্পাদক ছিলেন। অনেক পথঘাট পেরিয়ে অবশেষে সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন।
সুলতান যখন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, তখন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ছিলেন মুকুল দে। তিনি নব্যবঙ্গীয় ধারার তৃতীয় প্রজন্মের শিল্পী। অজন্তা শিল্পরাজি নিয়ে তিনি মুগ্ধ ছিলেন, এই নিয়ে তাঁর একটি ঋদ্ধ গ্রন্থও আছে। তিনি অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ উভয়ের স্নেহধন্য ছিলেন। তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই আর্ট স্কুলের শিক্ষা কারিকুলাম অনেক বদলে গেছে। হ্যাভেল-অবনীন্দ্র ভারতপন্থী কারিকুলাম বদলে ফের পাশ্চাত্যপন্থা প্রবল হয়ে ওঠে। সুলতান এই শিল্পী-অধ্যক্ষের দারুণ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। সুলতানের কথামালা থেকে আমরা জানতে পারি, আর্ট স্কুলে পড়ুয়া মুকুল দের স্ত্রী বীনাপানির সঙ্গে তিনি আউটডোরে অনুশীলনে যেতেন। সুলতান প্রভুত সৌভাগ্যবান যে, তিনি আশ্রয়-প্রশ্রয় পেলেন খ্যাতিমান শিল্পসমালোচক শাহেদ সোহওয়ার্দীর। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে এবং তাঁর সুবিস্তৃত লাইব্রেরির আর্টবিষয়ক গ্রন্থাদির বদৌলতে রূপজগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হন। এখানেই তিনি বিশ শতকের খ্যাতিমান শিল্পী ভ্যান গঘ, গগ্যাঁ, পিকাসো প্রমুখ এবং রেনেসাঁস শিল্পীদের বিপুল ছবি দেখা এবং তাঁদের নিয়ে প্রণীত গ্রন্থাদি পাঠের সুযোগ পেলেন। পাশাপাশি তাঁর আত্মকথনে জানা যায়, চিত্রকলার নানা বিষয় নিয়ে সোহওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হতো। আর্ট স্কুলে প্রিয় শিক্ষক হিসেবে পেলেন রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সতীশ সিনহা, রমেন চ্যাটার্জি, বলাই কর্মকারকে। আরেকজন পূর্ববঙ্গীয়, যদিও তাঁর হাতে হাতেখড়ি নেওয়া হয়নি—শিল্পী জয়নুল আবেদিন। সহপাঠী হিসেবে পেলেন শিল্পী কামরুল হাসানকে। আর্ট স্কুলে তিনি ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক পাঠক্রমে শিক্ষা নিয়েছিলেন।
সুলতান যখন কলকাতায় চিত্রশিক্ষা নিচ্ছেন, তখন ভারত তো বটে, বিশ্বব্যাপী নতুনপন্থা অনুসন্ধানে ব্যাপৃত। ভারতে নব্যবঙ্গীয় চিত্র সর্বভারতীয় হয়ে উঠতে পারেনি, বরং ক্রমেই মলিন হয়ে ওঠে। ইউরোপে প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রের বিপরীতে একগুচ্ছ শিল্পান্দোলন শিল্পের চরিত্রকেই আমূল রূপান্তর ঘটিয়ে দেয়। আকাশের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতো চিত্রপদ্ধতি নানা বাঁক এবং স্থিতি ও অস্থিতির ঘূর্ণাবর্তে অবিরত সৃষ্টিমুখর ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষায় সুলতান রইলেন না, পৃথিবীর রূপ-রস-রঙের নেশায় ঘর ছাড়লেন।
সুলতান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী। কলকাতা আর্ট স্কুলের সেরা ছাত্র। ছিলেন শিক্ষকদের স্নেহধন্য। পেয়েছিলেন শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর মতো খ্যাতিমানের পৃষ্ঠপোষকতা। নড়াইল জমিদারবাড়ির সদস্যরাও ছিল তাঁর আপন। কোনো ধরনের সংকটই তাঁর ছিল না। তবে কোন যুক্তিতে তিনি শিল্পশিক্ষা অসমাপ্ত রেখে শহর কলকাতা ছাড়লেন? সুলতানের কেন মনে হলো এখানে শেখার আর কিছু নেই? আমরা কি এটা ধরে নিতে পারি, তৎকালে চর্চিত প্রাচ্যপন্থা কিংবা প্রতীচ্যপন্থায় তিনি নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি? নতুন পথ খুঁজছিলেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবল সময়ে দুস্তর পথ পাড়ি দিলেন, পথচলার মধ্যেই বদলে গেল নিজের দেশ, নিজের পরিচয়—দেশভাগ সবকিছু উলটপালট করে দিল। তবে তিনি উন্মূল কখনোই ছিলেন না। সুলতান বলেন, ‘আমার বেড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে লোকাল আইডেনটিটির খুব গোপন ও সূক্ষ্ম রেশ।’ তাঁর এই পরিচয়, তাঁর জীবন সত্য প্রকাশে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল নতুন চিত্রভাষা, নয়া প্রকাশভঙ্গি। এ জন্য কেবল নিরীক্ষাই যথেষ্ট ছিল না, দরকার ছিল ঔপনিবেশিক মনের বদল। ছবি আঁকাটা ছিল তাঁর সাধনা, সিদ্ধি লাভে তাই তাঁকে দেশান্তরি হতে হয়েছে, নিরুদ্দেশ হতে হয়েছে।