নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব
নারীবাদী সমালোচনা এককভাবে বিংশ শতাব্দীর কোনো প্রপঞ্চ নয়। এর মূল প্রোথিত রয়েছে সেই প্রাচীন গ্রিসে, স্যাফোর কাজে কিংবা মতভেদে এরিস্টোফেনেসের নাটক লিসিসট্রাটায়, যেখানে নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে এক্রোপলিসের ধনাগার লুণ্ঠনকারী হিসেবে। সেখানে রয়েছে এক নারী কোরাস, যা শারীরিক ও বৌদ্ধিক উভয় জায়গা থেকে পুরুষ কোরাসের চেয়ে শ্রেয়তর। সাথে এক অস্ত্ররূপে যৌনতার ব্যবহার পেলোপলেসিয়ান যুদ্ধের মতো স্পষ্টত পুরুষবাদী অভিক্ষেপের রাশ টানার প্রচেষ্টা হিসেবে। চসারের ওয়াইফ অব বাথেও ফেমিনিজমের উপস্থিতি লক্ষণীয়, যেখানে প্রোটাগনিস্ট কর্তৃত্বের ওপর অভিজ্ঞতাকে চরমভাবে মূল্যায়ন করে এবং যে কিনা তার পাঁচ স্বামীর পক্ষে শুধু জুড়িদারের চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিল। মধ্যযুগে, ক্রিস্টিন দে পিসানের সাহস ছিল সে সময়কার প্রধান পুরুষ সমালোচকদের সাথে তর্কে নামার। রেনেসাঁসের সময়কালে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে বেশ কয়েকজন নারী কবির উত্থান হয়, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য ক্যাথরিন দে রচেস। সতেরো শতকে আফরা বেন এবং অ্যান ব্রাডিস্ট্রিটের মতো অগ্রগামী লেখকেরা লেখালেখি পেশায় আসতে শুরু করলেন।
ফরাসি বিদ্রোহের পর মেরি উলস্টোনক্রাফট তর্ক করলেন যে, বিদ্রোহের আদর্শ ও আলোক নারীদের পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া উচিত, প্রাথমিকভাবে শিক্ষার অধিকারের মাধ্যমে। আর ঊনবিংশ শতাব্দী সাক্ষী হয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকায় অসংখ্য মুখ্য নারী সাহিত্যিকের অঙ্কুরায়ণের। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন মমে দে স্টেল, ব্রন্তে বোনেরা, জেন অস্টিন, জর্জ এলিয়ট থেকে শুরু করে মার্গারেট ফুলার, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, এমিলি ডিকেনসন। এ ছাড়া আধুনিকতাবাদী লেখকদের মধ্যে ছিলেন হিল্ডা ডুলিটল, গারট্রুড স্টেইন, ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড আর ভার্জিনিয়া উলফ।
ইতিহাসের একটা বড় সময়জুড়ে নারী যে কেবল শিক্ষার অধিকার এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল তা-ই নয়, তাদের লড়তে হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক আদর্শের বিরুদ্ধেও, যা তাঁদের ঠেলে রেখেছিল দীর্ঘস্থায়ী শব্দহীনতা এবং আনুগত্যের দিকে। এ ছাড়া ছিল এক পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্য-আবহাওয়া, যা প্রতিনিয়ত তাঁদের সৃষ্টিচেষ্টার প্রতি অবজ্ঞা ছুড়ে দিচ্ছিল। বস্তুত, পুরুষের সাহিত্যে নারীর চিত্রায়ণ—স্বর্গদূত, দেবী, বেশ্যা, অনুগত স্ত্রী কিংবা মাতৃভাবাপন্ন চরিত্রে। মূলত এগুলো ছিল এসব আদর্শগত জায়গাতেই নারীর অনন্ত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার প্রয়াস। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব এক পদ্ধতিগত জায়গায় আসার পেছনে একমাত্র নিমিত্ত হয়ে উঠেছিল বিংশ শতাব্দীতে নারীর রাজনৈতিক অধিকারের জন্য আন্দোলন। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে নারীবাদী সমালোচনা এক বৃহত্তর সংযুক্তির সৃষ্টি করে; সাহিত্য ইতিহাসের পুনর্লিখনের দাবি, যেখানে নারীর অবদানও লিপিবদ্ধ থাকবে; নারী সাহিত্য ঘরানার খসড়া; যৌনতা এবং লিঙ্গীয় প্রভেদের তত্ত্ব, সাইকোএনালাইসিস, মার্ক্সবাদ, সামাজিক বিজ্ঞান; পুরুষের সাহিত্যে নারীর চিত্রায়ণ; উভয় সাহিত্য রচনা এবং সমালোচনায় লিঙ্গের ভূমিকা [যেমনটা পড়ানো হয় গাইনোক্রিটিসিজমে]; জেন্ডারের সাথে অন্যান্য সাহিত্যধারার সম্পর্ক, যেমন জনরা অথবা মিটার [যেমন মহাকাব্যে নায়কোচিত ভাব, ভাবনা, যুদ্ধ কিংবা অভিযান পুরুষোচিত বলে ভাবা হয়, অপরদিকে গীতিকবিতাকে মেয়েলি হিসেবে দেখা হয়]। সর্বোপরি, নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা অভিজ্ঞতা ও ভাষার ব্যাপারে এক সার্বক্ষণিক উদ্বেগ দেখিয়েছেন। কোনো নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা কি রয়েছে, যা কেবল নারী লেখকদের দ্বারাই উন্মোচিত হয়েছে? নারীরা বিষয়টি কীভাবে দেখে যে তাদের ঐতিহাসিকভাবে এমন এক ভাষা নিয়ে এগোতে হচ্ছে, যা পুরোপুরি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিছু নারীবাদী নারীর নিজস্ব ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন, আবার কেউ কেউ মত দিয়েছেন পুরুষ আরোপিত চলিত ভাষাকেই পরিমার্জন করার পক্ষে।
ভাষার এই তাৎপর্য শেষমেশ আশ্রয় নেয় পুরুষের চিন্তাধারার প্রশ্নে, যা চলে এসেছে সেই অ্যারিস্টটলের সময় থেকে: ল অব লজিক, ল অব আইডেন্টিটি থেকে শুরু করে, এমনকি অ্যারিস্টটলিয়ান শ্রেণিবিভাগগুলোও পৃথিবীকে ভাগ করে কঠোর সীমাবদ্ধ অস্তিত্বে। এই বাইনারি বৈপরীত্য ব্যাপারটা দমনমূলক, যেমনটা বলেছেন বিভিন্ন তাত্ত্বিকেরা। উদাহরণস্বরূপ—অ্যারিস্টটলের বিধান অনুযায়ী হয় একজন মানুষ পুরুষ নয় নারী; একজন মানুষ হয় কালো নয় সাদা; হয় মালিক নয় দাস। নারীবাদীরা সর্বদাই পৃথিবীকে দেখার এই বিভাজিত দৃষ্টিভঙ্গিকে নাকচ করে আসছে। তারা দেখাচ্ছে নারী ও পুরুষ, কালো ও সাদা ছাড়াও আরও কত ধরন রয়েছে, আর দাবি করছে বৈপরীত্য নয়, ঐক্যকে বড় করে দেখার।
ইতিহাসের একটা বড় সময়জুড়ে নারী যে কেবল শিক্ষার অধিকার এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল তা-ই নয়, তাদের লড়তে হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক আদর্শের বিরুদ্ধেও, যা তাঁদের ঠেলে রেখেছিল দীর্ঘস্থায়ী শব্দহীনতা এবং আনুগত্যের দিকে।
নিঃসন্দেহে, নারীবাদের অন্যতম মূল্যবান অর্জন হলো বস্তুনিষ্ঠতা এবং সমদর্শনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করা। নারীবাদীরা অগ্রগামী হয়েছে এক নতুন সততার, যা স্বীকার করে যে নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট দ্বারা তাড়িত হয়ে তারা আত্মগত ক্ষেত্র থেকে লেখালেখি করে। এই ক্ষেত্র মূলত নির্ভর করে এই নারীবাদী ধারণার ওপর যে, যেভাবেই হোক চিন্তা কোনো বিচ্ছিন্ন বা বিমূর্ত প্রক্রিয়া নয়, বরং ঘনিষ্ঠভাবে স্থান, কালের বিবেচনায় শরীরের স্থিতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ‘শরীর’ তাই মূর্ততা ও নির্দিষ্টতার এক বিশেষ শক্তিশালী রূপকে পরিণত হয়েছে, যা প্রত্যাখ্যান করে পুরুষের কার্তেসিয়ান ঐতিহ্য, যা বলে চিন্তা আসে বিচ্ছিন্ন বিশ্বজনীনতার বিমানে চড়ে। যে শরীরে আমার বসবাস তা আমার চিন্তাকে আকার দেবে গভীরতম উচ্চতায়। যদি আমার শরীরের জন্ম হয় রাজনৈতিক সম্পর্কযুক্ত ধনী পরিবারে, তাহলে তা নিশ্চয়ই আমার রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক সংযোজনে ফুটে উঠবে। আমার শরীর নারী হোক বা পুরুষ, তা আমার চিন্তা এবং অভিজ্ঞতাকে আরও গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে আমার পড়া যেকোনো বইয়ের তুলনায়। এখন নারীবাদের এসব তত্ত্বের মুখোমুখি হয়ে, সেই দিন এখনো অতীত হয়নি যখন হাইস্কুলের ছেলেমেয়েদের রচনায় ‘আমি’ শব্দটি লিখতে দেওয়া হয় না, যা কিনা বস্তুবাদের ভন্ডামি এবং আত্মবিভ্রমকে স্থায়ীভাবে জিইয়ে রাখে।
এটা পুরোপুরি পরিষ্কার যে নারীবাদের সম্ভাব্য ক্ষেত্র রয়েছে ডিকনস্ট্রাকশন এবং মার্ক্সিজমের মতো তত্ত্বগুলোকে জড়িয়ে, সাথে বিশেষ কিছু দার্শনিকও, যেমন—হেগেল যে কিনা ট্র্যাডিশনাল লজিকের বিরোধিতা করেছিল। এবং শোপেনহাওয়ার ও বার্গসন, যাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন কারণের আজ্ঞানুবর্তিতা থেকে শারীরিক প্রয়োজন, আর সাথে কাব্যিক কল্পনাও যা কিনা ফ্রেঞ্চ প্রতীকবাদ এবং আধুনিকতাবাদে পবিত্রভাবে রক্ষিত। এ সবকিছু বলার পর, মনে রাখতে হবে যেকোনো একটি আন্দোলন বা সংস্কারগুচ্ছ থেকে নারীবাদ উদ্ভূত নয়, এটি এখন নিজস্ব ক্ষেত্রে বিশদভাবে আন্তর্জাতিক, আর এর বিন্যাস এমন যে একে বিভিন্ন স্থানীয় এবং সাধারণ ব্যাপারের সাথে সমন্বয় করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, আরব সংস্কৃতির লেখক, যেমন—ফাতিমা মেরনিসি আর লেয়লা আহমেদ চেষ্টা করেছেন তাঁদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র থেকে এক নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটাতে। একই ব্যাপার আফ্রিকান-আমেরিকান নারীবাদী, যেমন—এলিস ওয়াকার এবং এশিয়ান হেরিটেজের গায়ত্রী স্পিভাকের ক্ষেত্রেও সত্যি। যেটা মূলত অনুসরণ করা হয় তা হলো ফরাসি, আমেরিকান কিংবা ব্রিটিশ নারীবাদের একটা বিস্তারিত মূল্যায়ন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দুটো কাজ নারীবাদকে অনেক দূর টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তা হলো ভার্জিনিয়া উলফের আ রুম অব ওয়ানস ওউন [১৯২৯] এবং সিমোন দ্য বোভেয়ারের দ্য সেকেন্ড সেক্স [১৯৪৯]। এ সম্পর্কে আমরা আলোচনার পরবর্তী পদক্ষেপগুলোতে আরও অনেক কিছু জানতে পারব।
ক্ষমতার অধিকারী হবার দরুন পুরুষ নানাভাবে নারীকে শৃঙ্খলবদ্ধ করার চেষ্টা করে, সক্ষমও হয়। দীর্ঘকালীন শোষণের ফলাফল হিসেবে তাই নারী মাত্রই নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গীকে অনুসরণ করবেন এমন কোনো কথা নেই আবার নারীর লেখা মাত্রই যে নারীবাদী সাহিত্য হবে তারও কোনো মানে নেই। তাই যদিও নারী ও নারীবাদ এক বিষয় নয়, কিন্তু নারীবাদের মুখ্য বিষয়ই নারী।
ফরাসি নারীবাদ: তুলনামূলক আধুনিক ফরাসি নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা ঘটে ১৯৬৮ সালের মে মাস থেকে, যখন শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবীদের মধ্যে বিদ্রোহী হাওয়া দেখা দেয়। লাকাঁনীয় মনোবিশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়া, রোঁলা বার্ত ঘোষিত টেক্সটকেন্দ্রিকতা, ভাষাতত্ত্ব ও প্রতীকবাদ এই ধারার তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। নারীর যৌন অবদমন এবং যৌন পুলকের স্বীকৃতি লাভ এই ধারার অভীষ্ট লক্ষ্য। এ ছাড়া নারীর নিজস্ব ভাষার নির্মাণ এই ধারার অন্যতম উদ্দেশ্য। জাক লাকাঁ ও জাক দেরিদার চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে এনি লেকলার্ক, মার্গারেট ডুরাস, জুলিয়া ক্রিস্তেভা, লুসি ইরিগোরে, হেলেন সিকসু প্রমুখ নারীবাদী মিলে প্রবর্তন করেছিলেন লেকরিতুর ফেমিনাইন বা নারীবাদী লেখনী। ফরাসি নারীবাদীরা এই ধারার সাহায্যে নারীর অচেতন সত্তাকে সাহসিকতার সাথে আলোয় নিয়ে আসতে চেয়েছেন। এক নারীবাদী লেখনী যা উদ্ধৃত হবে চেতনাহীনতা থেকে, শরীর থেকে, আমূল পুনর্গঠিত বস্তুনিষ্ঠতা, ফেলোসেন্ট্রিক ডিসকোর্সকে পাশ কাটিয়ে যাবার একটি চেষ্টা হিসেবে।
ক্রিস্তেভার মতে, এমন ভাষার জন্ম এক প্রি-অডিওপাল রাজ্যে, সেমিওটিকের রাজত্বে, সাংস্কৃতিক লিঙ্গায়নের ভিত্তি স্থাপনেরও পূর্বে। তাঁর জ্ঞান ছিল, যা-ই হোক, যে এই মাতৃতান্ত্রিক ভাষার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা রাজনৈতিক প্রান্তিকতার ঝুঁকি টেনে আনতে পারে। বস্তুত, লুসি ইরিগোরে ভেতর থেকে পুরুষতান্ত্রিক ডিসকোর্সকে দমিয়ে ফেলার পক্ষপাতী, এক কৌশল যা সে চালিয়ে নেয় তার প্লেটো থেকে ফ্রয়েড এবং মার্ক্স থেকে লাকাঁর একাধিক ডিসকোর্সের পড়াশোনার মাধ্যমে। যা-ই হোক, সে নির্দেশ করে যে নারীর নিজস্ব ভাষা অনেক অধিক বিস্তৃত হবে, তার যৌনতার মতোই, আর কম উৎসাহের সাথে শ্রেণিভুক্ত করা হবে পুরুষ ডিসকোর্সের তুলনায়। হেলেন সিকসুও একটা ঐক্য দেখতে পায় লোগোসেন্ট্রিসম আর ফেলোসেন্ট্রিসমের মধ্যে [যেখানে ফেলাস একটা সিগনিফায়ার, পুরুষ শক্তি এবং প্রভাবের প্রতীক], এমন এক ঐক্য যাকে অবশ্যই প্রশ্নের সম্মুখীন এবং বিনষ্ট করার চেষ্টা করা উচিত। নারীদের সে অনুরোধ করে, তাদের শরীর সম্বন্ধে লিখতে হবে, অচেতনতার সংস্থান উন্মোচন করতে হবে। এ সমস্ত লেখক পুনর্মূল্যায়ন করে মাতৃকুলের তাৎপর্য, এগুলোকে দেখে শোষণ নয়, ক্ষমতার উৎস হিসেবে। অন্য নারীবাদীরা, যেমন—ক্রিস্টিন ফরে, ক্যাথারিন ক্লিমেন্ট এবং মনিক উইটিগ চ্যালেঞ্জ করে এই শরীরসংক্রান্ত উদ্ব্যক্তিকে এই বলে যে এটি শারীরবৃত্তীয়ভাবে বাতিল, ফেটিশ-ভরা এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তিহীন। মনিক উইটিগ ইচ্ছা রাখে এই সেক্স এবং জেন্ডারের ভাষাগত ব্যাপারগুলোতে চিরদিনের মতো ছেদ টানতে।
আমেরিকান নারীবাদ: ১৯৬০ এর সিভিল রাইট মুভমেন্ট থেকে আমেরিকান নারীবাদ একটি জোরালো অবস্থান তৈরির দিকে আগায়। এই ধারা উদ্দেশ্যের দিক থেকে ফরাসি কিংবা ব্রিটিশ নারীবাদ থেকে বেশ কিছুটা আলাদা ছিল, এমনকি ভার্জিনিয়া উলফ এবং সিমোন দ্য বোভেয়ারের লক্ষণীয় প্রভাব থেকেও কিছুটা দূরে ছিল। বেটি ফ্রিড্যান দ্বারা রচিত হয়েছিল দ্য ফেমিনিন মিস্টিক [১৯৬৩] এর মতো উল্লেখযোগ্য কাজ, যে কিনা পরবর্তীকালে জাতীয় নারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৬৬ সালে। এই বিখ্যাত বই তুলে ধরেছিল আমেরিকার সাধারণ নারীদের বেদনার কথা। একান্ত ঘরোয়া জীবনের মাঝে তাদের আটকে যাওয়া এবং গণজীবনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পেশাজীবন এগিয়ে নিতে না পারার অপারগতার কথা। এই সময়ে আরও কিছু প্রয়োজনীয় নারীবাদী পাঠ্য আলোর মুখ দেখেছিল। তার মধ্যে আছে মেরি এলমানের থিংকিং অ্যাবাউট উইম্যান [১৯৬৮], কেট মিলেটের সেক্সুয়াল পলিটিকস [১৯৬৯], গার্মাইন গ্রিরের দ্য ফিমেল ইউনুচ [১৯৭০] এবং সুলামিথ ফায়ারস্টোনের দ্য ডায়ালেকটিক অব সেক্স [১৯৭০] যে কিনা শ্রেণিবিভেদের বদলে জেন্ডারকে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মুখ্য উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছে। মিলেটের বইয়ে নারীর যৌনতা এবং সাহিত্যে নারীর অবস্থানের বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে। এটি বলে যে পুরুষতান্ত্রিকতা একটি রাজনৈতিক পাঠকেন্দ্র, যা নারীর সাব-অর্ডিনেট ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা আরও বিশদভাবে কথা বলে সেক্স, যার মূল জীববিদ্যায় আর জেন্ডার, যা সাংস্কৃতিকভাবে প্রাপ্ত, এই দুটো বিষয়ের সাযুজ্য নিয়ে। এই ভাবধারার অন্য সমালোচকেরা যাঁরা পুরুষের সাহিত্যে নারীর অবস্থানকে তদন্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ক্যারোলিন হিলব্রান এবং জুডিথ ফেটারলি।
কিছু নারীবাদী অন্যথাও করেছেন এবং নারী লেখনীর চিরাচরিত ধারাকে উপেক্ষা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্যাট্রিসিয়া মেয়ার স্পাকসের দ্য ফিমেল ইমাজিনেশন [১৯৭৫], এলেন মুরের লিটারেরি উইম্যান [১৯৭৬] এবং সান্ড্রা গিলবার্ট এবং সুজান গুবারের দ্য ম্যাডউম্যান ইন দি এটিক [১৯৭৯]। এই ধারার সবচেয়ে জনপ্রিয় বইটি ছিল এলিন শোওয়াল্টারের আ লিটারেচার অব দেয়ার ওউন [১৯৭৭] যেখানে নারীর লেখনীর তিনটি ধাপ দেখানো হয়। একটি ফেমিনিন ধাপ [১৮৪০—১৮৮০] যেখানে নারী লেখকেরা পুরুষের লেখনীর অনুকরণ করতেন এবং পুরুষ রীতির ছাঁচেই চরিত্রগুলো সম্পাদন করতেন। তারপর এলো ফেমিনিস্ট ধাপ [১৮৮০—১৯২০] যেখানে নারীরা পুরুষের সেসব ছাঁচের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। আর সবশেষ একটি ফিমেল ধাপ [১৯২০—এখন অব্দি] যেখানে নারী নিজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকান ফেমিনিজমের সাম্প্রতিক তর্কগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শোওয়াল্টার, লিলিয়ান রবিনসন, এনেট কোলোডনি এবং জেন মার্কাসের মতো ব্যক্তিরা। তাঁরা উদ্বেগ দেখিয়েছেন নারীর সাহিত্যের সাথে পুরুষের তত্ত্বের সম্বন্ধ, নারীবাদী তত্ত্ব এবং নারীর ভাষা, উত্তর কাঠামোবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নারীবাদের সম্পর্ক এবং একই সাথে চলমান রাজনৈতিক ও শিক্ষা আন্দোলনের সমস্যা নিয়ে।
এ ছাড়া মাঠ গরম করা তর্কের শুরু হয়েছে মার্ক্সবাদ এবং নারীবাদের সম্পর্ক নিয়ে। মিশেল ব্যারেটের উইমেন্স অপ্রেশন টুডে: প্রবলেম ইন মার্ক্সিস্ট ফেমিনিস্ট অ্যানালাইসিস [১৯৮০] চেষ্টা করে জেন্ডার আলোচনায় মার্ক্সবাদী এবং নারীবাদী আদর্শের সমন্বয়ে সংগতি আনার। এই ধারার অন্যান্য কাজের মধ্যে উল্লেখ্য জুডিথ নিউটন এবং ডেবোরাহ রোজেনফেল্টের ফেমিনিস্ট ক্রিটিসিজম অ্যান্ড সোশ্যাল চেইঞ্জ [১৯৮৫]। এই পাঠ্যও তর্ক করে নারীবাদী বিশ্লেষণ নিয়ে, যা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে জায়গা করে নেয়। সাম্প্রতিক এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো কালো এবং সংখ্যালঘুদের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীবাদ নিয়ে ভাবা। এ-সংক্রান্ত কিছু পাঠ্য হলো, এলিস ওয়াকারের ইন সার্চ অব আওয়ার মাদার্স গারডেন্স [১৯৮৩] এবং বারবারা স্মিথের টুওয়ার্ড আ ব্ল্যাক ফেমিনিস্ট ক্রিটিসিজম [১৯৭৭]। অতঃপর লেসবিয়ান সমালোচক মেরি ডালির জিন/ইকোলজি [১৯৭৮] এবং আদ্রিয়ান রিচের কম্পালসারি হেটেরোসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড লেসবিয়ান এক্সিসটেন্স [১৯৮০] উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সবকিছুকে ছাড়িয়ে পুরুষত্ব এবং নারীত্বের দোলাচল এবং পশ্চিমা মেটাফিজিক্স, সাইকোঅ্যানালাইসিস এবং ক্ষমতার কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে জুডিথ বাটলারের জেন্ডার ট্রাবল [১৯৯০] ছিল নারীবাদী তত্ত্বে হেটেরোসেক্সুয়ালিটি নিয়ে শক্তিশালী পর্যালোচনা।
ব্রিটিশ নারীবাদ: বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ নারীবাদী সমালোচনায় প্রথম নাম ভার্জিনিয়া উলফ। বেশির ভাগ ব্রিটিশ নারীবাদী সমালোচনাই এক রাজনৈতিক স্নানের মধ্য থেকে উদ্ভূত, যা ক্রমাগত বাধ্যতার জায়গায় নিয়ে আসে এক বস্তুগত এবং আদর্শিক প্রেক্ষিত থেকে নারীবাদী চিন্তন এবং সাহিত্য পাঠ্যকে স্থাপন করাকে। জুলিয়া মিশেল, তাঁর প্রধান গ্রন্থে [উম্যান: দ্য লংগেস্ট রেভ্যুলেশন যা কিনা পরে বর্ধিত হয়ে বের হয় উমেন্স এস্টেট নামে ১৯৭১ সালে] পুরুষতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করে মার্ক্সিস্ট ধারণার উৎপাদন ও ব্যক্তিগত সম্পদ এবং একই সাথে জেন্ডারের সাইকোঅ্যানালিটিক বিশ্লেষণের আলোকে। তাঁর পরবর্তী কাজ যেমন—সাইকো অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ফেমিনিজম [১৯৭৪] এই ব্যাপারে আরও আলোকপাত করে। আরেকটি সমপর্যায়ের পাঠ্য ছিল মিশেল ব্যারেটের উইমেন্স অপ্রেশন টুডে [১৯৮০]। যেটি চেষ্টা করেছে এক বস্তুবাদী নন্দনতত্ত্বের প্রচলন করতে এবং বারবার চেয়েছে মার্ক্সিস্ট শ্রেণি-ধারণার সাথে নারীবাদ বিশ্লেষণ করে জেন্ডার রিপ্রেজেন্টেশন ব্যাখ্যা করতে। অন্য বিশেষ সমালোচকদের মধ্যে রয়েছেন জ্যাকলিন রোজ এবং রোজালিন্ড কাওয়ার্ড, যাঁরা জাক লাকাঁর কিছু ধারণার প্রবেশ ঘটিয়েছেন বস্তুবাদী নারীবাদের উদ্দেশে, ক্যাথারিন বেলসেও লাকাঁর ওপর নির্ভর করেছে রেনেসাঁসের নাটককে বস্তুবাদী ফেমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে, আর নরওয়েতে জন্ম নেওয়া টরি মই, যে কিনা উলফের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হিউমেনিজম এবং কিছু আমেরিকান নারীবাদীর অন্তর্নিহিত অপরিহার্যতার সমালোচনায় নিয়োজিত হন। একই সাথে পুরুষ স্টেরিওটাইপ বিরোধী এবং নারীর নিজস্ব সংস্কৃতি উদ্ধারের আমেরিকান নারীবাদী প্রবণতা সমালোচক জুডিথ নিউটন এবং ডেবোরাহ রোজেনফিল্ড। শেষমেশ, বেশ কিছু সমালোচক যেমন, কোরা কাপলান, মেরি জেকবাস এবং পেনি বোউমেলহা গঠন করেন ব্রিটিশ মার্ক্সিস্ট-ফেমিনিস্ট সংঘ, ১৯৭৬ সালে।
নারীবাদ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে উত্তর আধুনিক তত্ত্ববিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এই তত্ত্বের আলোচনা কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। একদিকে যেমন তা মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার প্রাচীন ঐতিহ্যের খোঁজ করে, তেমনই তা আধুনিক নারীকে ছুঁয়ে থাকা সমস্ত বিষয়ের প্রেক্ষিতে তার অবস্থানকেও তুলে ধরার চেষ্টা করে। সামন্ততান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে নারী হয়ে পড়ে পুরবাসিনী। ক্ষমতার অধিকারী হবার দরুন পুরুষ নানাভাবে নারীকে শৃঙ্খলবদ্ধ করার চেষ্টা করে, সক্ষমও হয়। দীর্ঘকালীন শোষণের ফলাফল হিসেবে তাই নারী মাত্রই নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গীকে অনুসরণ করবেন এমন কোনো কথা নেই আবার নারীর লেখা মাত্রই যে নারীবাদী সাহিত্য হবে তারও কোনো মানে নেই। তাই যদিও নারী ও নারীবাদ এক বিষয় নয়, কিন্তু নারীবাদের মুখ্য বিষয়ই নারী।