ভোর তিনটায় মিসরের মরুভূমিতে
ডু ইউ লাইক দ্য সান!
ডু ইউ লাইক দ্য ফান!
আপনি কি রোদ পছন্দ করেন? আপনি কি মজা পছন্দ করেন? এই লাইনগুলো একটা গানের লিরিক। গানে এমন আরও অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু সব কটি প্রশ্নের উত্তর একটাই। হুরগাদা।
হুরগাদা সমুদ্রতীরবর্তী এক শহর। লোহিত সাগর তীরে সোনালি-শাদা বালু, কাচের মতো স্বচ্ছ সমুদ্রের পানি, পানির নিচে রঙিন ও সতেজ এক জীবন আর উষ্ণ আবহাওয়ায় গড়ে ওঠা হুরগাদা এক ভূ-পাতাল স্বর্গ।
মিসরে সবাই পিরামিড দেখতে যায়। আমিও সবারই মতো। পিরামিড দেখার জন্যই মিসর গিয়েছি। পিরামিড যদি বারমুডায় থাকত, তবে সেখানেই যেতে হতো আমার। ছবি-টবিতে যা-ই দেখি, সত্যিকারভাবে পিরামিড দেখা হয়েছে ২০১০ সালে। সামনাসামনি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে।
পাঁচ দিনের একটা ট্যুর ছিল। পাঁচ দিনে পিরামিড যতটুকুই দেখি, মিসর দেখা হয়েছে কেবল এক বিন্দু। পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো মিসরীয় সভ্যতা। সেই সভ্যতা দেখতে পাঁচ দিনের প্রোগ্রাম করেছি শুনলে মিসরবাসী তো হাসবেই, ফেরাউনদের কেউ জীবিত থাকলে হয়তো গর্দানই নিয়ে নিত।
কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, আল আলামিন আর সুয়েজ ঘুরে সেবারের মিসর সফরে ছেদ টানতে হয়েছে। আমাদের হোস্ট হারুন থাকে কায়রোর একেবারে কেন্দ্রে। তার বাসার জানালা দিয়ে মার্কিন দূতাবাস দেখা যায়। হারুনকে বললাম, ‘শার্ম আল শেখ কদ্দুর?
‘ওহ, সে তো সিনাই উপদ্বীপের একেবারে শেষ মাথায়। বিমানে যেতে হবে। কিন্তু কেন যাবেন? ওই সব পশ্চিমাদের জন্য। রিজোর্ট ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই।‘
‘ঠিক কথা। প্রথমবার মিসর সফরে এসে প্রাচীন অত্যাশ্চর্যগুলো ছেড়ে সেখানে যাওয়ার কোনো মানে নেই। তাহলে ল্যুকজর বা আসওয়ান যাওয়া কি সম্ভব?’
‘ল্যুকজর যাওয়া সম্ভব। তবে এক রাত থাকতে হবে। ল্যুকজর থেকে পরে আসওয়ান যেতে পারেন।’
আমি নিজে খোঁজখবর নিতে থাকলাম। কায়রো থেকে ল্যুকজর ট্রেনে ছয় সাত ঘন্টা। যাওয়া-আসার ভাড়া জনপ্রতি আশি ডলার। কিন্তু ট্রেনের শিডিউল মেলাতে গেলে দু’দিনেও খুব টাইট হয়। বাসভাড়া কম। জনপ্রতি রাউন্ড ট্রিপ পঁচিশ ডলারের মতো। শিডিউলে সমস্যা নেই। কিন্তু প্রায় একনাগাড়ে ছয়-সাত ঘণ্টা বাসের ঝাঁকুনি খেতে কেউ রাজি না। গড়িমসিতে ট্রেনের টিকিটও পেলাম না।
আমাদের কাপড়ের মাপই ছোট। ডান দিকে পকেট লাগাতে গেলে বাঁ দিকের হাতা ছোট করতে হয়। অগত্যা আকাশ সমান পরিকল্পনা কেটে ছেঁটে মাটির কাছাকাছি নিয়ে এলাম। গিজা আর সাকারার পিরামিড, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি আর সুয়েজ ক্যানেল দেখা হলেও বাকি রয়ে গেল মিসরের পঁচানব্বই ভাগ।
শার্ম আল শেখ নামটা জেনেছিলাম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সূত্রে। ল্যুকজর ও আসওয়ান—দুই জায়গার ওপরই ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে। সবই তুলে রাখলাম ভবিষ্যতের কোনো সুযোগের জন্য।
তবে গুরুজনদের কথা অমৃত সমান। নিয়ত একবার করে ফেললে তা পূরণ হয়। ২০১৫-তে পোল্যান্ডে গিয়ে ট্রাভেল বা ট্যুর অপারেটরদের কাছ থেকে নিয়মিত অফার পেতে থাকলাম। তুরস্ক, মিসর, সাইপ্রাস, মরক্কো, তিউনিশিয়া—বিভিন্ন রকম অফার। শপিং মলে গেলে ট্যুর অপারেটরদের জানালায় সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে আস্তে আস্তে কিছু নামও মুখস্থ হয়ে গেল। স্পেনের ক্যানারি আইল্যান্ড, গ্রিসের সান্তোরিনি আইল্যান্ড, তুরস্কের আনতালিয়া, সাইপ্রাসের আইয়া নাপা, মিসরের হুরগাদা।
এর মধ্যে একদিন এইচবিও চ্যানেলে একটা ডকুমেন্টারি দেখলাম, ‘ডার্লিং, আই লাভ ইউ।‘ পোলিশ ডকুমেন্টারি। নামটা যত সহজে লিখেছি তত সহজ না। ‘Darling, I lowe ju’—এ রকম উদ্ভট নাম কেন যেন আমাকে আকর্ষণ করল। আমি পুরো ডকুমেন্টারিটা দেখে ফেললাম।
ডকুমেন্টারি যেহেতু, সেহেতু সেখানে গবেষণার মতো উপাদান আছে। অনেক সাক্ষাৎকার আছে। সবকিছু যে চিত্রনাট্য মেপে মেপে সাজানো বা পাতানো নাটক, সে রকমও না। পোলিশ পরিচালক। আন্না ব্লাশজিগ। কাহিনি তাঁর নিজের। আমি কাহিনিটাই মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করলাম।
পোল্যান্ড বা রাশিয়ার উত্তর দিকে শীতপ্রধান অঞ্চলে বছরের দশ মাস প্রায় ঠান্ডা থাকে। ঠান্ডায় শরীরের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মনও কুঁকড়ে যায়। সে সময় ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এসে তারা যেন প্রাণ ফিরে পায়। পোল্যান্ড থেকে দলে দলে এই জীবনপিপাসুরা ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী সৈকত শহরগুলোতে আসে। সে জন্যই ট্যুর অপারেটরদের জানালায় সান্তোরিনি, আইয়া নাপা আর হুরগাদার হাতছানি দেওয়া ছবি।
ডার্লিং আই লাভ ইউর পটভূমি হুরগাদা। মিসরের অন্যত্র পর্যটকেরা যায় প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত হতে। হুরগাদার কিছুই প্রাচীন না। মরুভূমির বালু আর সমুদ্রের লোনাপানি ছাড়া হুরগাদায় কিছু নেই। কিন্ত ওই লোনাপানি, সোনালি বালু আর কালো মানুষগুলোর মধ্যে পোলিশরা খুঁজে পেয়েছে এমন কিছু, যা হয়তো তাদের মধ্যে নেই।
কী সেই মহার্ঘ্য! সূর্যের আলো? সমুদ্রের গর্জন? আদিগন্ত মরুভূমি! না। আন্না ব্লাশজিগ খুঁজে পেয়েছেন ‘ভালোবাসা’। একেবারে আদি, বন্য, ঘর্মাক্ত দৈহিক ভালোবাসা।
ডকুমেন্টারির বিষয়বস্তু হুরগাদার সেই ভালোবাসা। পোলিশ মেয়েরা বিশেষ করে যাঁরা বৃদ্ধা বা সিঙ্গেল তাঁদের কাছে শহরটি খুব জনপ্রিয়। কারণ, তাঁরা হুরগাদা গিয়ে স্থানীয় প্রেমিক খুঁজে নেয়, এবং সিকিভাগ ইংরেজি এবং আধা সর্বজনস্বীকৃত অঙ্গভঙ্গি দিয়ে প্রেমময় সময় কাটায়। আমার জন্য ব্যাপারটার হয়তো এখানেই ইতি হতো। কিন্তু কাকতালীয় ঘটনা যেকোনো পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে পারে। আর কাকতালীয় ঘটনার বেলায় সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হচ্ছে, কার্যকারণ ছাড়া কিছু ঘটে না। অর্থাৎ যা কাকতালীয়, তা-ই অর্থবহ।
পোল্যান্ডে আমার এক উদ্ভট বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে রবার্টের সঙ্গে। রবার্ট জুওয়েক। বয়স প্রায় পঞ্চাশ। পোলিশ চলচ্চিত্র প্রযোজক। একই সঙ্গে সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষক। পোলিশ ও ফ্রেঞ্চ ছাড়া তৃতীয় কোনো ভাষায় যদি সে ভাব আদান-প্রদান করতে পারে, তবে তা আকার-ইঙ্গিতের ভাষা। আমি পোলিশ ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় বকলম। আমারও তাই আকার-ইঙ্গিত ছাড়া অন্য কোনোভাবে রবার্টের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয় না। তবে বন্ধুত্বের ভাষা মনে হয় ভিন্ন। সে জন্য ভাষার সীমাবদ্ধতার মধ্যে কেমন করে যেন রবার্টের সঙ্গে আমার গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
মাঝখানে যখন অনেক দিন দেখা হয় না, তখন হঠাৎ করে জানলাম রবার্ট হুরগাদায় থাকা শুরু করেছে। আমি ভাবলাম চলচ্চিত্রের কোনো কাজে। পরে শুনেছি, সে মোটামুটি স্থায়ীভাবে হুরগাদায় থাকতে মনস্থ করেছে। হুরগাদায় সে বিনিয়োগও করেছে।
রবার্টের উদ্যোগে একবার পোল্যান্ডে মিস আর্থ কন্টিনেন্টাল প্রতিযোগিতার বিচারক হয়ে বসলাম। আর সেদিনই পরিচয় মাগেদ হাবীবের সঙ্গে। মাগেদ মিসরীয় নাগরিক। রবার্টের বন্ধু। হুরগাদায় রিজোর্ট রয়েছে তাঁর—রয়েল বিচ রিসোর্ট। আমি বুঝে গেলাম রবার্টের সঙ্গে মাগেদের বন্ধুত্বের সূত্র। আর এই সূত্র ধরে আমি পরিকল্পনা করতে থাকলাম হুরগাদা যাওয়ার। মাগেদকে বললাম, ‘হুরগাদা তো যাব। কিন্তু ল্যুকজর আর আসওয়ান যাওয়া হয়নি আমার। সেগুলোও স্পর্শ করতে চাই।’
মাগেদ করিতকর্মা। কথাও বলে খুব দ্রুত। সে বলল, ‘ল্যুকজর থ্রি আওয়ারস। আসওয়ান সিক্স আওয়ারস। ল্যুকজর গো এন্ড কামব্যাক। সেইম ডে। পসিবল’ এরপর আর একটু দম নিয়ে বলে, ‘আসওয়ান, সেইম ডে, নো পসিবল। ওয়ান নাইট স্টে।’
আমি সব বুঝে গেলাম। সড়কপথে হুরগাদা থেকে ল্যুকজর যেতে তিন-চার ঘন্টা লাগবে। আসওয়ানের দূরত্ব পাঁচশ কিলোমিটারের ওপর। সুতরাং সড়কপথে সাত ঘণ্টা লেগে যাবে। বিমানে খুব সুবিধা নেই; কারণ, সেখানেও তিন ঘণ্টার ওপর লাগবে।
পোল্যান্ডে সবচেয়ে বিরক্তিকর সময় নভেম্বর মাস। এই সময়টায় মেঘ আর কুয়াশার তান্ডবে সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। ঠান্ডা পড়ে। বৃষ্টিও হয়। ফিন ফিন করে দুদিন তিন দিন ধরে বৃষ্টি। গায়ে পড়লে মনে হয় বরফের সুই পড়ছে। মাঝেমধ্যে তুষারপাত হয়। শীত মৌসুমের অগ্রিম তুষারপাত। সেই তুষার রাস্তায় জমে রাস্তাঘাট নোংরা করে ফেলে। আমাদের দেশের বর্ষার কাদা এর চেয়ে ঢের ভালো। আমি ঠিক করলাম হুরগাদা যদি যাই-ই, তবে নভেম্বর মাসে যাব।
রবার্ট জুওয়েক আর মাগেদ হাবীবকে জানালাম। কিন্তু টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি হুরগাদার ফ্লাইট আছে কেবল বৃহস্পতিবারে। ওয়ারশ-হুরগাদা ফ্লাইট বৃহস্পতিবার সকালে, আর হুরগাদা-ওয়ারশ ফ্লাইট বৃহস্পতিবার বিকেলে। তার মানে ফ্লাইটের সময়সহ আট দিনের পরিকল্পনা করা যায়। বৃহস্পতিবার থেকে বৃহস্পতিবার।
মিসরীয় দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করলাম। সপরিবার। বড় ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে। ছুটি পাবে না। মেজ ছেলে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার জন্য সময় বের করতে পারছে না। একদিক হয় তো অন্যদিকে টান পড়ে। ওদিকে রবার্ট আগেভাগে হুরগাদা গিয়ে সব আয়োজন করে রেখেছে। শেষে আমার স্ত্রী এবং চৌদ্দ বছর বয়সী ছোট ছেলেসহ কেবল তিনজনের একটা খণ্ডিত পরিবার নিয়ে উড়ে গেলাম হুরগাদা।
ওয়ারশ থেকে হুরগাদা উড়ে যেতে বিমান খেয়ে নিলো ছয় ঘণ্টার বেশি সময়। এয়ার কায়রোর ফ্লাইট। জনপ্রতি ভাড়া দিতে হয়েছে ১,৩৫০ পোলিশ জুয়োতি। তার মানে বাংলাদেশি টাকায় আনুমানিক তিরিশ হাজার। এয়ার কায়রো ছাড়াও যাওয়া যেত। ভাড়া একটু এদিক-সেদিক হতো। কিন্তু সময় লাগত বেশি; কারণ, অন্য কোনো এয়ারলাইনস সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে না। আমাদেরকে হয় কায়রো না হয় ম্যানচেস্টার-জেনেভা হয়ে যেতে হতো। উদ্ভট সব ফ্লাইট।
এয়ার কায়রোর ফ্লাইট নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। সকাল সাড়ে আটটায় ওয়ারশ ছেড়ে বেলা দুটোয় হুরগাদা পৌঁছে গেছে। আবার বিকেল চারটায় ছেড়ে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় ওয়ারশ ফিরে এসেছে। সময়ের পার্থক্য এক ঘণ্টা। তার মানে সময় লাগছে সাড়ে ছয় ঘণ্টা। এয়ার কায়রোর বিরুদ্ধে অভিযোগ একটা আছে। টিকিট কেনার শর্ত ছিল যে টিকিটের টাকা ফেরত পেতে হলে অন্তত তিন দিন আগে তা বাতিল করতে হবে। আমার বড় ছেলে না যাওয়ার কারণে তার টিকিট বাতিল করেছিলাম দশ দিন আগে। এয়ারলাইনস তা ই-মেইল করে নিশ্চিতও করেছে। কিন্তু শর্ত পূরণ করে রিফান্ডের দাবি জানানো হলেও তা দুই বছরে পাইনি।
ওয়ারশ ছাড়ার সময় বিমানে আমার পাশে যে ভদ্রলোক বসেছেন, তাঁর গায়ের রং লাল। মাথার চুলও লাল। এঁদেরকেই বোধ হয় ‘রেড হেড’ বলে। তাঁর লাল মুখের দিকে যখন তাকিয়ে আছি, তখন তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি হাসলাম। সেও হাসল। আমি আবারও হাসলাম। সে তাঁর ব্যাকপ্যাক থেকে বিয়ারের ক্যান বের করল। ‘প্রশা’ বলে আমার দিকে পোলিশ জুবর বিয়ারের একটা ক্যান এগিয়ে দিল। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁকে নিরস্ত করলাম। আমি বিয়ার পান করি না।
আমরা দুজন নাম বিনিময় করলাম। তাঁর নাম মার্ক। বয়স পঞ্চাশ হবে। মার্ক ইতোমধ্যে ন’বার হুরগাদা সফর করেছে। আমি বললাম, ‘ওয়াও। হুরগাদা নিশ্চয়ই তাহলে অনেক সুন্দর জায়গা!’
মার্ক হেসে বলল, ‘সোয়াঞ্চসে, মর্সকা প্লাজা, চেগো ভিয়েঞ্চসে চ্চেস—সূর্য, সমুদ্রসৈকত, আর কী চাও।’
‘হু। সত্য। কিন্তু আমি তো এক ডকুমেন্টারিতে দেখেছি হুরগাদায় সব পোলিশ মেয়েরা যায়। মিসরীয় বয়ফ্রেন্ড খোঁজে।’
‘অহ। আন্না ব্লাশজিগ! কুরবা।’
আন্না ব্লাশজিগ সেই ডকুমেন্টারির নির্মাতা। ডার্লিং, আই লাভ ইউ। মার্ক ‘কুরবা’ বলে তাঁকে একটা পোলিশ গালি দিয়েছে যা আমি ছাপার অক্ষরে লিখতে পারব না। বিব্রতভাব এড়াতে আমি হাসলাম।
মার্ক বলল, আন্না মহিলা হওয়ায় সে হুরগাদার একটা খন্ডিত দিক কেবল তুলে ধরেছে। যদিও তা মিথ্যা না। কিন্তু হুরগাদায় এর চেও বেশি কিছু আছে।
মার্ককে নির্বিঘ্নে বিয়ার পান করতে দিলাম। এই ফাঁকে আমি একটু ঘুমের চেষ্টা করলাম। হয়তো ঘুমিয়েছিলাম। পাইলটের ঘোষণায় বুঝলাম, হুরগাদা ল্যান্ড করতে যাচ্ছি। বেল্ট লাগানোই ছিল। কেবল একটু সটান হয়ে বসলাম।
হুরগাদা এয়ারপোর্ট ছোট ও শাদামাটা। এয়ার কায়রো সুন্দর করে ল্যান্ড করেছে। এয়ারবাস এ-৩২০। এয়ারক্রাফট পুরো ভর্তি। দেড়শ জন যাত্রীর প্রায় সবাই পোলিশ। হুরগাদায় ছুটি কাটানোর উত্তেজনা ও আনন্দে তারা বিভোর। ছুটিকে তারা ‘ভাকাচ্চিয়া’ বা ভ্যাকেশন বলে। সুন্দর ল্যান্ডিং হয়তো তাদের সফল ভাকাচ্চিয়ার প্রথম শর্ত। সে জন্য জোরে হাততালি দিয়ে তারা তা উদযাপন করল। আমরাও হাততালিতে শামিল হলাম। পাইলট মহোদয়ের তা প্রাপ্য।
বিমান থেকে নামার পর কিছুটা হেঁটে আমাদেরকে টার্মিনালে ঢুকতে হলো। আলোকিত আকাশ দেখে আমাদের মন ভালো হয়ে গেল। টার্মিনালে ঢুকে আমি ইমিগ্রেশন খুঁজছিলাম। কিন্তু যাত্রীদের অধিকাংশ দেখি হুড়মুড় করে দৌড়াচ্ছে। ভাকাচ্চিয়াতে এসে আমি অন্তত দৌড়াদৌড়ির মধ্যে নাই। হাত-পা নাড়িয়ে প্রথমে সাড়ে ছয় ঘণ্টা বসে থাকার জড়তা কাটালাম। অনেক ট্যুর অপারেটরের বুথ সামনে। টুই, ইথাকা, রেইনবো—হরেক রকম নাম। অপারেটরদেরকে ছেঁকে ধরেছে যাত্রীরা। আমরা সোজা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে গিয়ে আমাদের পাসপোর্ট দিলাম। কিন্তু ইমিগ্রেশন অফিসার জানাল, আমাদেরকে ইমিগ্রেশন ফরম পূরণ করতে হবে। আমার নিজেকে বোকা বোকা লাগল। কয়েক বছর ধরে ইউরোপে থাকার কারণে এবং ইউরোপীয় শহরগুলোর মধ্যে ফ্লাই করার কারণে ইমিগ্রেশন ফরম পূরণ করার কথা ভুলে গেছি।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে ইমিগ্রেশন ফরম পাওয়া যায় এমন কোনো বুথ পেলাম না। ট্যুর অপারেটরদের কাছে আছে কিন্তু সেগুলো তাদের ক্লায়েন্টদের মধ্যে বিলি করতেই তারা ব্যস্ত। একজন দুজনকে ফর্মের জন্য অনুরোধ করলে তারা তা এড়িয়ে গেল। বিনা কারণে কেউ কারও উপকার করে না ওখানে। অগত্যা একজন পুলিশকে সালাম দিয়ে ইমিগ্রেশন ফরমের হদিশ চাইলে, সে একজন ট্যুর অপারেটরের কাছ থেকে তিনটা ফরম এনে দিল। আমি শুকরিয়া উচ্চারণ করতে ভুললাম না।
ইমিগ্রেশন শেষে লাগেজ সংগ্রহ করার জন্য অগ্রসর হলাম কিন্তু ইমিগ্রেশন আর লাগেজ এরিয়ার মাঝামাঝি জায়গায় সিকিউরিটি চেকের জন্য আরেকটি অতিরিক্ত হলঘর পার হতে হলো। সিকিউরিটির লোকজনের ‘পোকার ফেইস’ থাকে। অর্থাৎ পোকার বা জুয়া খেলার সময় কার্ড হাতে নিয়ে যেমন অভিব্যক্তিহীন হতে হয় তেমন। কিন্তু মিসরীয় সিকিউরিটি অফিসারদের তেমন মনে হলো না। কারও ওপর রাগছে, কারও সঙ্গে ইয়ার-দোস্তের মতো আচরণ করছে। আমার পাসপোর্ট হাতে নেওয়ার আগেই আমার পকেটের দিকে আঙুল নাড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘ডলার, ডলার, ইউরো!’
আমি তার কথা না শোনার ভান করে সালাম দিয়ে পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে পাসপোর্ট হাতে নিল। কিন্তু পাসপোর্ট পেয়ে তার চোখমুখ বদলে গেল। তার ডলার-ক্ষুধারও যেন ইতি ঘটল। সে বলল, ‘আ, বাংলাদেশ। মুসলিম ব্রাদার। ইউ কাম হুরগাদা!’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। হুরগাদা। কারণ কায়রো দেখা হয়ে গেছে আগে।’
‘ইউ ফ্যামিলি?’
‘জি। ফ্যামিলি। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?’
‘হ্যাঁ। তুমি কি হুরগাদায় বেড়াতে এসেছ? কদ্দিনের জন্য?’
‘এক সপ্তা।’
‘আর কি কোথাও যাবে?’
আমি একটু বিরক্তই হলাম। ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম, ‘জানি না কিছু। মুড ভালো থাকলে যেতেও পারি। না হয় মরুভূমিতে হাডুডু খেলবো।’
‘ইউ মুসলিম। আই মুসলিম। ইউ ফ্যামিলি। আই নো হ্যাভ ফ্যামিলি।’
হাসলাম। ইংরেজি এত সহজ হলে স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরোতে আমাকে এত কসরত করতে হতো না। পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে গেলাম। আমার স্ত্রী আর সন্তানের ক্ষেত্রে সময় লাগল না। পরবর্তী হলটা লাগেজ হল। লাগেজগুলো বেল্টে ঘুরছে। টেনে ট্রলিতে উঠাতেই দেখি টার্মিনালের বাইরে রবার্ট এবং অ্যানা দাঁড়িয়ে আছে। কাচের দেয়ালে চোখ লাগিয়ে তারা আমাদেরকে দেখছে। আমি হাত নেড়ে এগজিটের দিকে এগোলাম।
পরে বুঝলাম, এইটি ঠিক এগজিট না। কাস্টমস কন্ট্রোলের লাইন। আমি গ্রিন চ্যানেল খুঁজে সেদিকে এগোলাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। কাস্টমস কর্মকর্তা আমাদেরকে স্যুটকেস খুলতে বললেন। আমি খুব বিরক্ত হলাম। কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে এমন ভাব দেখালাম যেন আমাকে স্যুটকেস খুলতে বলে সে বিরাট ভুল করেছে।
কাস্টমস কর্মকর্তার কোনো ভুল হয়নি। তবে ভাব নেওয়ায় কাজ হলো। কাস্টমস কর্মকর্তা কেন যেন স্যরি বলে আমাদেরকে ছেড়ে দিলেন। স্যুটকেস খুলতে হলো না।
এগজিটের সামনে এসে লম্বা লাইন পেলাম। প্রত্যেকের লাগেজ ট্যাগ ভালো করে পরীক্ষা করে তবে ছাড় পাওয়া যাচ্ছে। কাহাঁতক যে এই সব প্যারা চলবে! কিন্তু এবারে দেখলাম সেই কাস্টমস কর্মকর্তাই আমাদেরকে লাইন ছাড়া পার করে দিলেন। আমি শুকরান বলতে ভুললাম না।
রবার্টের পরনে লাল হাফশার্ট, খয়েরি শর্টস। অ্যানা পরে আছে কালো টি-শার্ট এবং লম্বা স্কার্ট। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আমাদের ক্লান্তি দূর করলাম। রবার্ট এবং অ্যানা দুজনের সঙ্গেই আমার স্ত্রীর প্রথম দেখা। কিছুটা পরিচয় পর্ব চলল। ওয়ারশ এয়ারপোর্ট ডিউটি ফ্রি থেকে রবার্টের জন্য ভদকা কিনেছিলাম। প্রথম সুযোগে তা হস্তান্তর করলাম। রবার্টের মুখ দুদিকে বিস্তৃত হয়ে গেল হাসিতে। ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফ্রেন্ড, ওয়েলকাম টু হুরগাদা’ বলে রবার্ট আবার আমাকে জড়িয়ে ধরল।
অ্যানা রবার্টের নতুন পার্টনার। রবার্টের স্ত্রী মাগদা। রবার্টের ভাষায় ‘মাই লেডি।’ মাস ছয়েক আগে রবার্টকে যখন এক ডিনারে দাওয়াত দেই, তখন সে অ্যানাকে সঙ্গে নিয়ে আসে। আমার মধ্যে কোনো প্রশ্নের উদয় হয়নি; কারণ, ভাষাগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের জন্য রবার্ট সব সময়ই কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসে। কিন্তু ডিনার টেবলের বসার পরই সেবার রবার্ট বলা শুরু করল, ‘মাই লেডি, নো মাই লেডি।’
আমি বললাম, ‘ইউর লেডি, মাগদা!’
‘নো মাগদা। ফিনিশ।’
আমি একটু আতঙ্কিত হলাম। ফিনিশ মানে! মারা গেল নাকি! কিন্তু রবার্টের চোখেমুখে কোনো শোকের চিহ্ন না পেয়ে বুঝলাম এই ফিনিশের অর্থ ভিন্ন। সে বলল, ‘মাগদা। মাই লেডি–নো।’
তখন অ্যানাই যেচে পড়ে আমাকে জানাল যে মাগদা’র সঙ্গে রবার্টের ডিভোর্স হয়ে গেছে। এরপর মাস তিনেক সে অন্য এক নারীর সঙ্গে সময় কাটিয়েছে কিন্তু সেখানে কোনো বোঝাপড়া না হওয়ায় অ্যানার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। অ্যানা পেশায় কসটিউম ডিজাইনার। রবার্টের ফিল্ম প্রোডাকশনে কসটিউম ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে করতে দুজনের নৈকট্য বাড়ে। অ্যানারও একবার বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু সে-ও এখন ডিভোর্সড।
অ্যানা বলো যে সে আমার কথা রবার্টের কাছে অনেক শুনেছে। সে বরং বেশ কৌতূহলী হয়ে আছে কীভাবে আমাদের সম্পর্ক হলো এবং কীভাবেই-বা চলছে তা সামনাসামনি দেখার জন্য। আমি বললাম, ‘রবার্টকে যদি টুকটাক ইংরেজি শেখাতে পারো, তবে আমাদের সম্পর্ক আরও গাঢ় হতে পারে।’
অ্যানা ইংরেজিতে ভালো। তবে আমাকে সব সময় ধীরগতিতে কথা বলতে বলে, যেন সে সব কটি শব্দ পৃথকভাবে ধরতে পারে। অ্যানা জানাল, রবার্ট এক সপ্তা ধরে উত্তেজিত হয়ে আছে আমরা আসব সে জন্য, এবং এর মধ্যে চার-পাঁচবার আমাদের হুরগাদার প্রোগ্রাম বদলিয়েছে। একবার সে ল্যুকজর সফর আগায়, আবার একসময় তা পিছিয়ে স্নোরকেলিং এগিয়ে নিয়ে আসে।
আমি রবার্টকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, ‘এক সপ্তা আমরা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছি তোমাদের ওপর। তোমরা যা পরিকল্পনা করবে, আমরা সে অনুযায়ী চলব।’
একটা মাইক্রোবাসের পেছনে আমরা আমাদের মালামাল তুলে ফেললাম। ড্রাইভার আমাদেরকে সালাম দিল। বলল, মুসলমান যাত্রী পেয়ে সে খুব খুশি। আমি তাকে বললাম যে আমরাও মিসরে আসতে পেরে আনন্দিত। ড্রাইভার আগ বাড়িয়ে যেভাবে সবার লাগেজ গাড়িতে তুলে আমাদেরকে দরোজা খুলে সিট পর্যন্ত সাফসুতরো করে দিচ্ছে, তা দেখে রবার্ট আর অ্যানা আশ্চর্য হয়ে গেল। রবার্ট বলছে, ‘ড্রাইভার হ্যাপি।’
ড্রাইভার মনে হয় সত্যি কিছুটা খুশি হয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে সে হুরগাদার কিছু গল্প বলা শুরু করল আমার সঙ্গে। ভাষাটা রবার্টের ভাষার মতোই। আমার শুনতে ভালো লাগছিল। বলার সময় আমিও সে রকম ভাষায় বলার চেষ্টা করছিলাম। আমার ছেলে দৃঢ় বলল, ‘বাপ, তুমি এইভাবে এক সপ্তা কথা বললে ইংরেজি ভুলে যাবে।’
আমি বললাম, ‘পরোয়া কি! আগে তো হুরগাদা এনজয় করি। কনফুসিয়াস বলেছে যে, হোয়ার এভার ইউ গো, গো উইথ অল ইউর হার্ট।’
দৃঢ় ছাড়ে না আমাকে। বলে, ‘মিসরে এসেও তুমি চীনা দার্শনিককে ভুলতে পারছ না! এখানে মিসরীয় কিছু খোঁজো।’
‘প্রাচীন মিসরীয় প্রবাদ ও দর্শনও আমার খুব প্রিয়। কঠিন সব দর্শন। মুয়াতা আশবি নামে এক মিসরীয় এই সব প্রবাদ সঙ্কলন করেছে। একটা প্রবাদে আছে, সাফারিং ইন সার্চ অব ট্রুথ গিভস ট্রু মিনিং ট্যু দ্য ট্রুথ।’
‘ঠিক বলছ বাপ। প্রাচীন মিসরীয়রা জিনিয়াস ছিল।’
ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আমাদের রিসোর্ট বিশ কিলোমিটার দূরে। হুরগাদা শহরের উত্তরে। আল আহিয়া এলাকায়। আধা ঘণ্টা লাগবে পৌঁছতে। গাড়ির জানালা দিয়ে হুরগাদা শহরটা দেখতে দেখতে যাব ভাবছিলাম। দুপাশে মরুভূমির বাদামি বালু ছাড়া কিছু নেই। মাঝেমধ্যে একটা-দুটো খেজুরগাছ, দু-একটা একতলা বা দোতলা বিল্ডিং। বিল্ডিংগুলো তো এমনিতে হলুদ রঙের, খেজুরগাছের পাতাগুলোকেও ধূসর লাগছে। সবুজের ছায়াও নেই কোথাও। এমন জায়গায় আবার রিসোর্ট হয় কেমনে!
বলতে বলতে আমরা মনে হয় একটা জনপদের মধ্যে এসে পড়লাম। অধিকাংশ বিল্ডিং ধূসর রঙের। বেশ কিছু নির্মীয়মাণ। বোঝা যায় যে এই এলাকা দ্রুত বেড়ে উঠছে। সাইনবোর্ড আর বিল্ডিংয়ের ধরন দেখে বুঝতে পারছি যে এই সবই রিসোর্ট। হাইওয়ে থেকে একটা সার্ভিস রোডে ঢুকে ড্রাইভার বলল, ‘ওয়ান মোর মিনিট।’
রবার্টও বলল, ‘আমরা এসে গেছি।’
আর তখনই ড্রাইভার গাড়ি থামাল একেবারে রয়েল বিচ রিসোর্টের রিসেপশন পোর্চের নিচে। টপাটপ দশ-বারোটা সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে এক পোর্টার চলে এলো গাড়ির দরোজা খুলতে। রবার্ট বলছে, ‘রিসোর্ট এখন প্রায় খালি। নভেম্বর-ডিসেম্বরে এখানে কেউ আসে না বললেই চলে। বন্ধু। আমাদের প্ল্যান করা হয়ে গেছে। লম্বা প্ল্যান। রুমে গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে সি বিচে চলে আসতে পারো। অথবা চাইলে লম্বা রেস্ট নিয়ে একেবারে সন্ধ্যায় নামতে পারো।’
পোর্টার আমাদের লাগেজ নিয়ে নিল। ড্রাইভার বিদায় নিল। আমি বিশ ডলারের একটা নোট বের করেছি দেখে অ্যানা বলল, ‘না, না। আমি দিয়ে দিব। বিশ ডলার অনেক টাকা। তোমাকে ইজিপশিয়ান পাউন্ড করে নিয়ে খরচ করতে হবে।’ হোস্ট যা বলে তাই। অগত্যা হাসি দিয়েই বিদায় দিলাম ড্রাইভারকে।
কিন্তু রুমে এসেও একই সমস্যা। পোর্টারকে কিছু টিপস দিতে হবে। ভাগ্য ভালো, অ্যানা সঙ্গে নেই। ওই বিশ ডলার এবার গিয়ে পড়ল পোর্টারের ভাগ্যে। আমরা স্যুটকেসগুলো এক কোনায় রেখে লিভিং রুমে বসলাম। আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে দুই বেড রুমের অ্যাপার্টমেন্ট। লিভিং রুমটা প্রশস্ত। এক পাশে মিনি প্যান্ট্রি। মাইক্রোওয়েভ ওভেন এবং ফ্রিজ। ধাতস্থ হওয়ার আগে পেলাম দরোজায় নক। রিসেপশন থেকে দুজন পরিচারিকা এসে হাজির। সব ঠিক আছে কি না, অতিরিক্ত বালিশ বা কম্বল লাগবে কি না, টিভির রিমোট কোথায়, কীভাবে কাজ করে—এই সবকিছু নিয়ে ব্রিফিং দিতে দিতে আরও দুজন বয় এসে হাজির। একজনের হাতে সিজনাল ফলের ঝুড়ি, অন্যজনের হাতে ছোট একটা বালতি। ভেতরে বরফ। আর বরফ ঠেলে সে ঢুকিয়ে দিল একটা শ্যাম্পেইনের বোতল।
আমার স্ত্রী বলল, ‘শ্যাম্পেইনের বোতল দিয়ে কী হবে! ওইটা নিয়ে যেতে বলো।’
আমি বললাম, ‘উহু। রবার্ট আর অ্যানা আছে। সদব্যবহার করা যাবে নিশ্চয়ই।’
সুতরাং শ্যাম্পেইনের বোতল থেকে গেল। ভ্যালমন্ট ব্রুট। ইজিপশিয়ান স্পার্কলিং হোয়াইট ওয়াইন। গাঢ় সবুজ রঙের বোতল। সোনালি ফয়েলে মোড়ানো মুখ। তার দিয়ে পেঁচানো বোতলের ছিপি। সমুদ্রসৈকত লাগোয়া রিসোর্টে ছুটি কাটাতে এসে বরফের মধ্যে ঈষৎ কাত করে ঢোকানো এমন একটা বোতল দেখলেও প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
অ্যাপার্টমেন্টে বসে থেকে কী করব! হাতমুখ ধুয়ে, সুবিধাজনক কাপড় পরে নিচে নেমে এলাম। ইউ আকৃতির রিসোর্ট। মাঝখানে এলেবেলে আকৃতির সুইমিংপুল। কয়েক ধাপের। এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে নামার সময় সুইমিংপুলের পানি ঝরনার মতো নিচে পড়তে থাকে। ইউ আকৃতির হওয়ায় সব অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনি থেকে সমুদ্র দেখা যায়। লোহিত সাগর।
সুইমিংপুলের পাশ দিয়ে সৈকতের দিকে হেঁটে গেলাম। অনেকগুলো ছনের ছাতা লাগানো। সুইমিংপুলের শেষে গোলাকার একটা চত্বরে বার ও রেস্টুরেন্ট। মূল রেস্টুরেন্টটি রিসোর্টের ভেতরে। সি বিচে অর্ডার দিলে ওয়েটাররা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনে দেয়। রবার্ট আর অ্যানা বসে আছে বারে। আমাকে দেখেই রবার্ট চেঁচিয়ে বলল, ‘বন্ধু। এখন আমরা হুরগাদায়। কী খাবে বলো।’
আমি মেনু দেখে ডালিমের রস অর্ডার দিলাম। মিসর, তুরস্ক ও সিরিয়ায় এই-ই সবচেয়ে উপাদেয়। রবার্টকে বললাম, ‘অনেক ধন্যবাদ। তোমার পীড়াপীড়ি ছাড়া হুরগাদা আসা হতো না। ওয়ারশ’র প্যাচপ্যাচে ঠাণ্ডা ছেড়ে এখানে এসে মনে হচ্ছে স্বর্গে এসেছি।’
রবার্ট উচ্ছ্বসিত। সে বলল, ‘স্বর্গযাত্রা সবে তো শুরু। পাসিতো পাসিতো। আস্তে আস্তে।’
অ্যানা বলল, ‘বিকেল পাঁচটার দিকে হুরগাদা যাব আমরা। তোমাদের জন্য একটা ফিশ রেস্টুরেন্টে বুকিং দেওয়া হয়েছে। এর আগে কিছু খেতে চাইলে এই বারে অর্ডার করলেই হবে। এখনো ব্রেকফাস্টের সময় আছে। অর্ডার করলে মিনিট বিশেকের মধ্যে এনে দেবে।’
আমি বললাম, ‘কিচ্ছু নিয়ে ভেবো না। এখানে সূর্যের আলো আর বাতাস খেয়েই দিন পার হয়ে যাবে। ছোট ছেলে দৃঢ় নিচে নামুক। সে হয়তো বার্গার, নাগেট বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে চাইবে।’
আমরা ঘণ্টা দুই সমুদ্রসৈকতে হাঁটাহাঁটি, বারে বসে ডালিমের রস আর হমুজ খেয়ে এবং বাকি সময় লাগাতার আড্ডা দিয়ে বিকেল পাঁচটার মধ্যে হুরগাদা শহরে যেতে তৈরি হয়ে গেলাম। রিসোর্ট থেকে বেরোতে দেখি ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ট্যাক্সি দেখে অ্যানার মনঃপূত হলো না। সে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে অন্য ট্যাক্সির জন্য ফোন করল। আমাদেরকে আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। আমি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, আমরা যেহেতু পাঁচজন সেহেতু অ্যানা বড় একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করছিল। তুলনামূলক বিশাল বপুর কারণে রবার্ট সামনের সিট নিল। পেছনের সিটে আমরা চারজন। খুব আরামদায়ক ছিল না। যস্মিন দেশে যদাচার। ড্রাইভার বলল, গাড়ি চলতে থাকলেই নাকি পেছনের সিট আরামদায়ক হয়ে যাবে।
রিসোর্ট থেকে হুরগাদা শহর কেন্দ্র দক্ষিণ দিকে। লোহিত সাগরের সমান্তরাল হাইওয়ে ধরে আমরা এবারে বিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। হুরগাদা শহরটি উত্তর দক্ষিণে লম্বা। লোহিত সাগরের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বেড়ে উঠেছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা শেরাটন রোড বা ওল্ড শেরাটন রোড। এই রোড ধরে আমরা মিনা মসজিদের কাছে নেমে গেলাম। খুব ব্যস্ত এলাকা। রবার্ট সমুদ্রের দিকের একটা কাঁচাবাজার দেখিয়ে বলল, ‘এইটি সবচেয়ে বড় ফিশ মার্কেট। জ্যান্ত মাছই বেশি পাওয়া যায়। জেলেরা সরাসরি বিক্রি করে। অনেকে পাইকারি হারে কিনে নিয়ে অন্যত্র বেশি দামে বেচে।’
আমি দেখলাম মার্কেটের উল্টো দিকে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট। বিশাল বিশাল সাইনবোর্ড। ফ্রেশ ফিশ রেস্টুরেন্ট। বুঝলাম, এই রকম কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাচ্ছে রবার্ট। আমরা হাঁটতে থাকলাম। ছোট ছোট ট্যাক্সি ভর্তি রাস্তায়। কোলাহল অনেক। দু-একটা ঘোড়ার গাড়িও আছে। পরে বুঝেছি ওই সব ঘোড়া না, গাধা। মূলত মালামাল টানাটানিতে ব্যবহৃত হয়। মানুষজনের জন্য এত উপকারী ও সুবোধ প্রাণীকে নিয়ে আমরা কতই না ব্যঙ্গ করি!
গাধা টানা গাড়ি দেখতে দেখতে আমাদের রেস্টুরেন্টে চলে এলাম। রবার্ট জানাল যে এইটিই সেরা ফিশ রেস্টুরেন্ট—আল হালাকা ফিশ রেস্টুরেন্ট। পাঁচতলা একটি বিল্ডিং। পুরোটাই এই রেস্টুরেন্ট। নিচতলায় ঢুকে দেখলাম একটা একুরিয়ামে তাজা মাছ সাঁতার কাটছে। সেখান থেকে মাছ বেছে নেওয়া যায়। আবার বরফের ভেতর মোটামুটি ছড়িয়ে রাখা মাছের সংখ্যাও কম না। আমি সেখান থেকে অক্টোপাস বেছে নিলাম। নিচতলায় অর্ডার দেওয়ার পর আমাদেরকে তিনতলায় গিয়ে টেবিল বেছে বসতে বলা হলো। আমি জিজ্ঞেস করে জানলাম, পনেরো মিনিটের মধ্যে খাবার সার্ভ করা হবে। তবে সব খাবার পরিবেশন করতে আধা ঘণ্টার ওপর লাগতে পারে।
আল হালাকা ফিশ রেস্টুরেন্টে এসে সারা দিনের সব ধকল উবে গেল। ছোট ছেলে দৃঢ়কে কখনো মাছ খাওয়ানো যায় না। আজ সেও অবলীলায় মাছ খেয়ে নিল। অবশ্য বলতে ভুলল না যে সে কেবল ব্যতিক্রম হিশেবে মাছ খাচ্ছে। এরপর আর কখনো খাবে না। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে রবার্টকে ধন্যবাদ দিলাম। অ্যানাকে তবু হতাশা দেখাল ব্লু ক্র্যাব আর শেলফিশ না পাওয়ার কারণে। দেরিতে আসায় সেই সব শেষ হয়ে গেছে।
রেস্টুরেন্ট থেকে যখন বের হয়েছি তখনো সন্ধ্যা। হুরগাদা যেন নতুন সাজে জেগে উঠছে তখন। রেস্টুরেন্টের কাছেই একটা পুরোনো সামগ্রীর দোকান দেখলাম। কার্পেট, পিতলের পাত্র—
আরও অনেক কিছু আছে। আমি সেখানে ঢুকতে চাইলাম কিন্তু রবার্ট আমাকে নিবৃত্ত করল। বলল, ‘ফ্রেন্ড। আজ না। আজ আমাদের ফিরে যাওয়া ভালো, কারণ আগেভাগে ঘুমাতে হবে। আগামীকাল সকাল সকাল উঠতে হবে।’
আমি বললাম, ‘খাওয়া মাত্র শেষ করলাম। এখনই ফিরতে পারব না। খাওয়া হজম করার জন্য কিছুক্ষণ তো হাঁটতে হবে।’
রবার্ট বলল, ‘নিশ্চয়ই। আমরা কর্নিশে গিয়ে হাঁটব।’
কর্নিশ ইংরেজি শব্দ। ফরাসি ভাষা থেকে এসেছে। রাস্তার এক পাশে যখন খাদ বা জলাশয় থাকে তখন সেই রাস্তাকে কর্নিশ বলে। লোহিত সাগরের পাড় ধরে হুরগাদার কর্নিশ। পাড় বাঁধানো। এখানে লেগুন তৈরি করা হয়েছে জাহাজ, ইয়ট ও স্পিডবোট পার্ক করে রাখার জন্য। একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে অনুচ্চ ভবনে সারি সারি রেস্টুরেন্ট, পাব এবং নাইট ক্লাব। রঙিন আলোর আধিপত্যে এইগুলো পানির ওপর মায়াবি প্রতিফলন তৈরি করেছে। উদ্দেশ্যহীন কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর আমরা ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে ফিরলাম। কোনো এক পাব থেকে তখন ভেসে আসছে জমকালো গানের সুর,
ডু ইউ লাইক দ্য সান!
ইয়েইইইই।
ডু ইউ লাইক দ্য ফান!
ইয়েইইইই।
হুরগাদা।
২
মিসরে লোহিত সাগর তীরে ছোট রিসোর্ট শহর হুরগাদা। হুরগাদায় রয়েল বিচ রিসোর্টে আমাদের হোস্ট পোলিশ দম্পতি রবার্ট ও অ্যানা। সবাই মিলে ডিনারের জন্য এসেছিলাম হুরগাদা শহরে। রিজোর্ট থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। ডিনার সেরে রিসোর্টে ফিরছি। আজ একটু আগেভাগে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আমার স্ত্রী চলে গেছে রুমে। ছোট ছেলে দৃঢ়র সঙ্গে আমি লবি আর তার চারপাশে ঘোরাঘুরি করে সুইমিংপুলের দিকে চলে আসি। সুইমিংপুলের পানি ঠাণ্ডা হয়ে আছে। রাতে একটু কুয়াশাও পড়েছে। কোনো কোনো জায়গায় আলো নেই। অন্ধকারে সুইমিংপুলের সবুজ-নীল পানি মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। একটা ছাউনির নিচে রবার্ট বসেছে শিসা নিয়ে। আমি হ্যালো বলায় সে নড়েচড়ে বসল। ইশারায় হোটেল বয় একটা চেয়ার নিয়ে এলো। প্লাস্টিকের চেয়ার। আমি বসতে যাচ্ছিলাম। হোটেল বয় দৌড়ে একটা টাওয়েল নিয়ে এলো। চেয়ারের ওপর বিছিয়ে দিতে দিতে সে বলল, ‘আফওয়ান। আফওয়ান। ফগ, এভরিথিং ইজ ওয়েট স্যার।’
আমিও দেখলাম। কুয়াশায় চেয়ার ভিজে আছে। রবার্ট শিসার পাইপ এগিয়ে দিলো। সঙ্গে প্লাস্টিকের ক্যাপ। একই শিসা এভাবে অনেকে টানতে পারে। আমি শিসায় অভ্যস্ত নই। বললাম, ‘থ্যাঙ্ক ইউ। নো শিসা।’
রবার্ট বলল, ‘বানডু, ল্যুকজর। মর্নিং। ফাইন?’
আমি রবার্টের কথা আক্ষরিকভাবে না বুঝলেও তার সারাংশ বুঝি। সে আমাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করে বলছে, আগামীকাল সকালে আমাদের ল্যুকজর যাওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। সকাল মানে বেশ সকাল। রাত তিনটায়। সময়টা ঠিক আছে কি না আমাদের জন্য! আমি স্মিত হেসে বললাম, ‘নো প্রবলেম।’
রবার্ট তবু নিশ্চিত হতে চায়। সে বলে, ‘অ্যানা কাম। উই টক। ‘অর্থাৎ তার গার্লফ্রেন্ড অ্যানা আসছে এবং সে এসে বিস্তারিত আলোচনা করবে।
‘ল্যুকজর। ড্যানডেরা। হিস্ট্রি। ভেরি ফাইন’, রবার্ট বলতে থাকে।
আমাকেও তার মতো করেই উত্তর দিতে হয়। ‘ইউ, অ্যানা, মোর ফাইন।’ অর্থাৎ তুমি আর অ্যানা, তোমরা্ ল্যুকজরের মন্দির থেকে ভালো।
দৃঢ় ইন্টারনেট ব্যবহার করবে। সুইমিংপুল এলাকায় নেটওয়ার্ক অত ভালো না। সেও রুমে চলে গেল। কিন্তু তখনই এলো অ্যানা। কালো শর্ট সাটিন হাফ গাউন পরা। আমি ভাবলাম রবার্ট আর অ্যানার এমন রোমান্টিক পরিবেশে আমি আর কাবাবের হাড্ডি না হই। কিন্তু অ্যানাই আমাকে বসাল। বললো, ‘আমি সরি। অনেক চেষ্টা করেও সুবিধাজনক সময় বের করতে পারিনি। আগামীকাল ভোর তিনটায় শুরু করতে হবে। ড্রাইভার বলছে, যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, তত ভালো। ড্যানডেরা ও কার্নাক মন্দির ছাড়াও তাহলে আরও কিছু দেখা যাবে।’
আমি বললাম, ‘তিনটায় আমাদের কোনো সমস্যা নেই। গাড়িটা জুতসই তো!’
‘আশা করি জুতসই হবে। আমরা আগেও এদের কাছ থেকে গাড়ি নিয়েছি। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এদের ড্রাইভার বেশ ভালো।’
‘ঠিক আছে। তাহলে তোমরা থাকো। আমি একটু ঘুমিয়ে নেই। দৃঢ়কে ঘুমাতে পাঠাই।’
‘শিসা টানতে পারো একটু। অথবা রেড ওয়াইন। কিংবা অন্য কোনো ড্রিঙ্ক।’
‘ধন্যবাদ তোমাকে। আজ রাত এখানেই শেষ হোক।’
‘ওকে। গুড নাইট।’ অ্যানা হাত নাড়াল। কিন্তু রবার্ট আমাকে ছাড়তে চাচ্ছে না। শিসার পাইপ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বানডু। ফ্রেন্ড। মাত্র একটা টান।’
আমি শিসার পাইপ রবার্টের হাত থেকে নিয়ে অ্যানা’র হাতে দিয়ে বললাম, ‘আজ আর না। আজকের রাত এমনিতে ছোট। যেটুকু বাকি আছে তোমাদের জন্য সেটুকু মোহময় হোক।’
রুমে ফিরতে ফিরতে আমি বারবার মনে করতে থাকলাম, ‘আফওয়ান আফওয়ান। ‘রুমে ফিরে জানলাম আফওয়ান মানে ‘এক্সকিউজ মি।’ ভালো হলো। কিছু স্থানীয় শব্দ শেখা থাকলে ঘোরাফেরা সব সময় আমোদের হয়। নতুন একটা ভাষাও শেখা হয়।
রুমে ফিরলেও আমার ঘুম হয়নি। এ রকম কোনো শিডিউল ঠিক করা হলে উত্তেজনায় আমার ঘুম হয় না। লিভিং রুমে এসে সে জন্য আমি ফোন হাতে নিয়ে ব্রাউজ শুরু করলাম। বে-ওয়াচ স্টার পামেলা এন্ডারসন অস্ট্রেলিয়ানদেরকে অনুরোধ করেছে জুলিয়ান আসাঞ্জকে জেল থেকে ছাড়ার পিটিশনে সাইন করতে। ব্রিটিশ ক্লাব আর্সেনাল জার্মান ক্লাব আইনফ্রেখট ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে হেরে গেছে। আমি এইসব ব্রেকিং নিউজ ছেড়ে ইন্টারনেটে ড্যানডেরা লিখে ব্রাউজ করলাম।
দুই এক প্যারা হয়তো পড়েছি, এর মধ্যে ঝিমিয়ে পড়েছি সোফায়। সময়মতো উঠে যেতে অবশ্য সমস্যা হয়নি। ছোট একটা ব্যাগ গোছানোই ছিল। দৃঢ়কে আধা ঘুমের মধ্যে ঠেলেঠুলে রিসোর্টের লবিতে এসে দেখি একটা প্রায় কালো টয়োটা হাই-এস অপেক্ষা করে আছে। গাড়ির কাছে গেলাম। টয়োটা কোয়ান্টাম। হাই-এস এইচ২০০, ফিফথ জেনারেশন টয়োটা।
ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গাড়ি ঠিক আছে তো?’
‘হু। অবশ্যই।’
‘আর তোমার কী অবস্থা? ঘুম ধরবে না তো রাস্তায়।’
‘না। ধরবে না। আর দুই ঘণ্টা পর নতুন ড্রাইভার উঠবে। বাকি পথ সেই নিয়ে যাবে।’
‘গাড়ি কত বছর পুরোনো?’
‘নতুন গাড়ি। ২০১৫ হবে। এখানে টয়োটা এসেম্বল হয় সাউথ আফ্রিকায়।’
আমি সন্তুষ্ট হয়ে গাড়ির ভেতরটা দেখলাম। চালক ছাড়াও সামনে আরও একজন বসছে। সেই আসলে দুই ঘণ্টা পর স্টিয়ারিং ধরবে। পেছনে তিন সারিতে দশ সিট। রবার্ট এবং অ্যানা সামনে, আমরা দ্বিতীয় সারিতে। রিসোর্ট ছাড়তে ছাড়তে আমাদের প্রায় সাড়ে তিনটা বেজে গেল। আমার সিটটায় পা রাখার জায়গাটা বেশি। সিটটা এলিয়ে পা লম্বা করে ঘুমানোর চেষ্টা করে গেলাম।
হুরগাদা থেকে দক্ষিণে রওনা হলো আমাদের গাড়ি। প্রায় সমুদ্রসৈকতের সমান্তরাল। এইটি হাইওয়ে ৬৫। লোহিত সাগরের বরাবর একেবারে সুদান সীমান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। আমাদের গাড়ি সুদান সীমান্তে যাবে না। সাফাগা শহর পর্যন্ত গিয়ে ডানে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে হাইওয়ে ৬০ ধরবে। আধা ঘণ্টার মতো ড্রাইভের পর বুঝতে পারলাম, গাড়ি পশ্চিমে মরুভূমির ভেতরে ঢুকে গেছে। একবার দুবার গাড়ির ঝাঁকুনিতে চোখ যখন খুলে ফেলেছি তখন চারপাশে বালু ছাড়া আর কিছু দেখিনি। কোন স্ট্রিট ল্যাম্প নেই। কিন্তু চাঁদের আলো বা বালুর প্রতিফলনে মরুভূমি মোটামুটি আলোকিত। ড্রাইভার এক ছন্দে চালিয়ে যাচ্ছে। তার পাশের লোকটা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। রবার্ট নাক ডাকছে। দৃঢ় হেলান দিয়ে আছে তার মায়ের গায়ে। আমি একবার ফোন খুলে গুগল ম্যাপ পরীক্ষা করলাম। মরুভূমির ভেতর রাস্তা ছাড়া আর কোনো চিহ্ন নেই।
কোনো এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম যখন ভেঙেছে তখন দেখি গাড়ি এসে থেমেছে একটা সরাইখানার সামনে। হাইওয়ে রেস্টুরেন্টও বলা যায়। একতলা। সামনে দশ-বারোটা গাড়ি পার্ক করে রাখা। বাস, মাইক্রোবাস, সেডান কার, এসইউভি।
বাইরে মোটামুটি ঠাণ্ডা। আমার গায়ে জ্যাকেট। চেইন আরেকটু উপরে টেনে দিয়ে আমি দুহাত ছড়িয়ে নিঃশ্বাস নিলাম। শরীর একটু স্ট্রেচ করা দরকার। গাড়ি থেকে কেউ নামতে চাচ্ছে না। সবারই চোখেমুখে ঘুম। আমি আশপাশে হেঁটে দেখলাম। রেস্টুরেন্টটা খুব শাদামাটা। প্লাস্টিকের কিছু চেয়ার টেবিল। কাউন্টারে বিস্কিট, চিপস, চুইংগাম। ডিসপেন্সারে কোল্ড ড্রিঙ্কস, লাবান, জুস, পানি।
গাড়ির কাছে ফিরে গিয়ে দেখি অ্যানা জিজ্ঞেস করছে কেউ টয়লেটে যাবে কি না! এখান থেকে এক ঘণ্টা ড্রাইভে আর কোথাও দাঁড়াবে না। রবার্ট জিজ্ঞেস করছে, আমরা কেউ কিছু খাব কি না! ভেতরে তখনো দ্বিতীয় ড্রাইভার কম্বলের নিচে ঘুমুচ্ছে। প্রথম ড্রাইভার আমাকে মিসরীয় কফি এনে দিল। সে জানাল, সে এই সরাইখানাতে থেকে যাবে। ফেরার পথে এইখান থেকেই সে আবার আমাদের গাড়ির হাল ধরবে।
সূর্য উঠে গেছে। আমার ছায়া চল্লিশ হাত লম্বা। মরুভূমির বালুতে সেই ছায়া পরাবাস্তব চিত্র তৈরি করেছে। আদি ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে আমরা কেনার পথে ড্রাইভ শুরু করলাম। দ্বিতীয় ড্রাইভারের ভালো ঘুম হয়েছে। সে কম্বল ভাঁজ করে রেখে ড্রাইভিং সিটে বসে গেছে। জানলাম যে তার নাম আলি।
আলিকে বললাম, ‘ঘুম ভালো হয়েছে তো?’
‘ইয়েস স্যার। আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। ঘুমে অসুবিধা হয় না।’
‘আমরা আর কতটুকু দূরে আছি?’
‘এক ঘণ্টা লাগবে না স্যার। কেনা থেকে আমাদের গাইড উঠবে। সে যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে তবে আমরা সময়ের আগে ড্যানডেরা পোঁছে যাব।’
চল্লিশ মিনিটের মাথায় কেনা শহরের কোনো এক মোড় থেকে একজন গাইড উঠল আমাদের গাড়িতে। শহরের ভেতর যখন ঢুকেছি তখন সূর্যের আলোও কিছুটা উঁকি দিচ্ছে। এত সকালে রাস্তাঘাটে লোকজন নেই। কিন্তু প্রচুর পুলিশ চেকপোস্ট আছে। মরুভূমির ভেতর চেকপোস্ট চোখে পড়েনি। আলী জানাল, মরুভূমির ভেতরেও দুটো চেকপোস্ট ছিল।
এই ধরনের চেকপোস্ট আমার চেনা। ২০১০ সাল থেকে দুই বছর ইসলামাবাদ ছিলাম। দুই মিনিট পরপর রাস্তায় গতি কমাতে হতো। জিগজ্যাগ করে ব্যারিকেড দিয়ে মিলিটারি চেকপোস্ট বসানো ছিল। ইসলামাবাদের কথা না হয় আলাদা, মিসরে এসেও এ রকম চেকপোস্ট পাব, ভাবিনি।
এই ফাঁকে হ্যালো বলে গাইড তাঁর পরিচয় দিলো। তাঁকে মোস্তফা বলে ডাকতে পারি। মোস্তফা আমার প্রশ্নের উত্তরে বলল, হুরগাদায় ২০১৬ ও ২০১৭ সালে পরপর দুটো সন্ত্রাসী ঘটনায় কিছু ইউরোপীয় পর্যটকের প্রাণহানি হয়েছে।
আমি বললাম, ‘বলো কী! পর্যটকেরা টার্গেট! এমন দেশে কিনা ঘুরতে আসলাম!’
‘স্যার, এই সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। জানোই তো, মধ্যপ্রাচ্যে সর্বত্র এইসব সন্ত্রাসীদের তান্ডব চলছে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া। দুঃখজনক। এই সব মানুষের কাজ না।’
‘তুমি কিছু লুকিয়ো না। আমি মুসলমান। বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমি জানি ধর্মীয় কট্টর ও সহিংস গোষ্ঠী এই অঞ্চলে সক্রিয়। তাই বলে পর্যটকদের টার্গেট করলে তোমাদের অর্থনীতি চলবে কেমনে!’
‘সেই তো স্যার। কে বুঝাবে তাদের এই সব কথা। পর্যটকেরা আসে। আমরা গর্বের সঙ্গে তাদেরকে আমাদের দেশের সম্পদ দেখাই। লাখ লাখ লোকের জীবিকা পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখন তবু অবস্থা ভালো। আগে একেবার মন্দিরের ভেতর পর্যন্ত আর্মড পুলিশ থাকত। তবে আচ্ছালামু আলাইকুম স্যার, আপনি প্রথম বাংলাদেশি, যাঁর সঙ্গে এই ভ্রমণে যাচ্ছি। খুব খুশি হলাম আপনাকে পেয়ে।‘
‘মোস্তফা, আমিও খুশি মিসরে এসে। আর তোমার মতো গাইড পেয়ে।’
‘আমি শুনেছিলাম, স্যার আপনারা পোল্যান্ড থেকে এসেছেন। এজন্য কোম্পানি আমাকে দিয়েছে।’
‘পোল্যান্ড থেকে এসেছি, সত্য। কিন্তু আমরা বাংলাদেশি। তবে আমাদের দুই বন্ধু, রবার্ট আর অ্যানা পোলিশ।’
‘ওহ। জিন্দো ব্রে রবার্ট। জিন্দো ব্রে ম্যাডাম। ইয়েস্তেম মোস্তফা। দো উসউগ।’ অর্থাৎ শুভ সকাল রবার্ট। আমার নাম মোস্তফা। তোমাদের সেবায় আছি।
রবার্ট উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘জিংকুইয়ে। জ্রুপ উবাগেনাপ সিয়াচুজ বাংলাদেশো। গ্রেট ফ্রেন্ড।’—বাংলাদেশি বন্ধুদের খেয়াল রেখো। নিকট বন্ধু তাঁরা।
‘ইয়াসনে—নিশ্চয়ই। আস সাদাকাত তুদায় ফুলফারাহা ওয়াতুদায় ফুলহাজনা।’
মোস্তফা কি দোয়াদরুদ পড়া শুরু করল নাকি! জার্নি শুরু করার কোনো দোয়া! তাকে জিজ্ঞেস করায় বলল, ‘সরি স্যার। আমাদের একটা প্রবাদ আছে। তুমি কি আরবি জানো? বন্ধুত্ব আনন্দ বাড়ায়, দুঃখ কমায়।’
অন্ধকার সরে গিয়ে বাইরে তখন সূর্যের আলো। মোস্তফা যখন মাথা ঘুরিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে থাকে, তখন সেই আলো মোস্তফার ঠিক মুখে এসে পড়ছে। এমন সুন্দর কথা এমন আলোকিত মুখে মানায়। আমি বললাম, ‘মোস্তফা, খুব সত্য কথা। বন্ধুত্ব আনন্দ বাড়ায়, দুঃখ কমায়।’
পুরো ভ্রমন কাহিনিটি পড়ে মিশরের পিরামিড ছাড়াও অন্য জায়গার সাথে পরিচিত হতে পারলাম।
মোঃনাসিম আহামেদ
অক্টোবর ২৯, ২০২২ ১৪:৫৮