আবুল হাসানের জার্মান কবিতার কাহিনি

 

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ও পূর্ব জার্মানির মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক চুক্তি অনুযায়ী হৃৎপিণ্ডের সম্প্রসারণজনিত অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য কবি আবুল হাসান সরকারিভাবে পূর্ব জার্মানি যাওয়ার সুযোগ পান। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ব বার্লিনের চ্যারিটি হাসপাতালে অসুস্থ আবুল হাসানের হৃদরোগের চিকিৎসা শুরু হয়। হাসপাতালে আবুল হাসানের সাথে রাইনহার্ট হেভিকে (হুবনার) নামের এক জার্মান তরুণ চিত্রশিল্পীর পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়; বয়সে হাসানের দুই বছরের ছোট রাইনহার্টও ছিলেন একজন হৃদরোগী। রাইনহার্ট সে সময়ে বার্লিন-ওয়েইসেনসির একাডেমি অব ফাইন আর্টসে অধ্যয়নরত। একপর্যায়ে বড়দিনের সময় হাসান হুবনার পরিবারের আতিথ্য গ্রহণ করেন। রাইনহার্টের বাবা আছিম হুবনার ছিলেন একজন চিত্র পরিচালক, অভিনেতা ও কাব্যামোদী। রাইনহার্ট হাসানের বেশ কিছু প্রতিকৃতি আঁকেন; তিনি জীবনভর হাসানের কবিতার অলংকরণ করে গেছেন এবং ২০১৬ সালে বার্লিন থেকে রাইনহার্টের অলংকরণে আছিম হুবনারের অনুবাদে হাসানের ৪৪টি কবিতার জার্মান অনুবাদ Das Kleine Abul Hasan Brevier প্রকাশিত হয়। এই অনুবাদকর্মের জন্য রাইনহার্ট হাসানের কাছ থেকে লিখিত অনুমতিও নিয়ে রেখেছিলেন। ২০২১ সালে রাইনহার্ট মারা যান।   
১৯৭৫ সালের নববর্ষের প্রাক্কালে তাঁরা যখন একে অপরের শান্তি, স্বাস্থ্য এবং সুখ কামনা করছিলেন, আবুল হাসানের পায়ে বেশ ব্যথা হচ্ছিল, আর তিনি নতুন বছরের আতশবাজির শব্দে
অনভ্যস্ততাহেতু, খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন। রাইনহার্টও সচরাচর রাত জাগতে পছন্দ করতেন না। কিন্তু আবুল হাসান কয়েকটা ছোট বালিশের ওপর নিজের পা রেখে নিজের হাতেই পায়ের মাংসপেশি মালিশ করতে করতে রাইনহার্টকে বললেন,
আজ, এই নববর্ষের রাতে, এসো আমরা একসাথে মিলে একটি কবিতা লিখে ফেলি; তারপর এই পৃথিবীতে আমাদের যন্ত্রণাদায়ক দেহ থেকে একটি আনন্দময় উত্তরণের জন্য আমরা সেই কবিতাটি সুর করে গাইব। রাইনহার্ট কাগজ-কলম নিয়ে হাসানের হাতে দিলেন।
 হাসান মৃদু হেসে বাংলায় কিছু একটা গুনগুন করলেন; তারপর লিখলেন,
আমাদের নশ্বর দেহের খোলসগুলি গাছ, পাতা, ফুল, পাখি, ফল এবং হ্রদে রূপান্তরিত হয়যেখানে নগ্ন মেয়েরা লাফ দেয়। রাইনহার্ট যোগ করলেন, লম্বা, আলগা চুলের সাথে।  

রাইনহার্ট, আবুল হাসানের ইচ্ছাতেই প্লাস্টার অব প্যারিসে তাঁর মুখের ছাপ নিয়ে একটি মুখোশ [Life-mask] তৈরি করেন। মুখোশের ফ্রেম আর পেছনের দিকটা তামার তৈরি। হাসানের মৃত্যুর পর রাইনহার্ট সেই মুখোশ ব্যবহার করে হাসানের একটি সমাধি তৈরি করে নিজের ঘরেই রাখেন। মুখোশের পেছন দিকে ধাতুর ওপর এই যৌথ কবিতা জার্মান ভাষায় উৎকীর্ণ করা আছে।  


দুজনেই কিছুক্ষণ ভাবলেন এবং তারপর ইংরেজিতে এই সব কথা আলাদা আলাদা কাগজে  লিখলেন। তারপরে তাঁরা কবিতাটি সম্পাদনা করলেন। হাসান চেয়েছিলেন সেই গীতিকবিতাটি জার্মান ভাষায় বিশেষভাবে উদ্দাম এবং সুরেলা শোনাবে। রাইনহার্টের কিছুটা সাংগীতিক প্রতিভাও ছিল; তিনি সদ্য জন্ম নেওয়া কবিতাটি জার্মান ভাষায় যতটা সম্ভব সুরেলাভাবে আবৃত্তি করেছিলেন। এইভাবে সে রাতে একটি সত্যিকারের আন্তভাষিক কবিতা তৈরি হয়েছিলবাংলা, ইংরেজি আর জার্মান। সকালে উঠে রাইনহার্ট দেখলেন, হাসানের নিদ্রিত চেহারায় বেদনার কোনো ছাপ নেই।
রাইনহার্ট, আবুল হাসানের ইচ্ছাতেই প্লাস্টার অব প্যারিসে তাঁর মুখের ছাপ নিয়ে একটি মুখোশ [
Life-mask] তৈরি করেন। মুখোশের ফ্রেম আর পেছনের দিকটা তামার তৈরি। হাসানের মৃত্যুর পর রাইনহার্ট সেই মুখোশ ব্যবহার করে হাসানের একটি সমাধি তৈরি করে নিজের ঘরেই রাখেন। মুখোশের পেছন দিকে ধাতুর ওপর এই যৌথ কবিতা জার্মান ভাষায় উৎকীর্ণ করা আছে।    
এসকল তথ্য এবং ছবি, শিল্পী রাইনহার্ট হেভিকের একজন ভক্ত জার্মান কবি, লেখক ও সম্পাদক স্টিফেন মার্সিনিয়াকের সূত্রে পেয়েছি। রাইনহার্ট, স্টিফেনের বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণও করেছেন। এই যৌথ কবিতা রচনার ইতিহাস পেয়েছি রাইনহার্টের পাণ্ডুলিপি অবলম্বনে স্টিফেন মার্সিনিয়াকের অপ্রকাশিত আখ্যান
পদ্মাসনে, দূর দেশে: কবি আবুল হাসান ও চিত্রশিল্পী রাইনহার্টের বন্ধুত্ব থেকে।

কবিতাটি এই

 

আমরা এখান থেকে চলে যাই চলো

আমরা এখান থেকে চলে যাই চলো  
বেদনামুক্ত মানুষ যেভাবে সহজেই
নিজ থেকে চলে যায়
উন্মুক্ত নিসর্গে।

যেমন জল বয়ে যায়
যেমন পাখি উড়ে যায়
সহজভাবে,
তেমন করেই চলে এলাম।  

আমাদের বাহুগুলো আজ গাছের সবুজ শাখা
যারা পাখির পালকের মত আঙ্গুল বিছিয়ে দেয়
গাছের পাতায়

বেদনাহীন, কেননা  

আমাদের চোখ জোড়া বদলে যায়
আকাশের নীল রঙে ডোবা জলাধারে,  
আমরা গ্রিক বনদেবতার হাতে শোভিত
রক্তিম ফল
   
এইমাত্র।

নিরন্তর তরঙ্গায়িত বাতাসে দোলে
পরম সুস্বাদু
লাল লাল ফল

নগ্ন বালিকারা এবারে ঝাঁপ দিবে
পরম আস্বাদে,  
আমাদের কামনা
শুধু এইমাত্র!
[আবুল হাসান ও রাইনহার্ট হেভিকে, ৩১/১২/১৯৭৪]

 

মূল জার্মান কবিতাটি এই
Wir sind von dannen gegangen

Wir sind von dannen gegangen
Von den Menschen wie Menschen
Ohne Schmerz
Einfach so

Wie das Wasser davon fließt
Wie der Vogel davon fliegt
Einfach so

Unsere Arme zu begrünten Ästen werden
Die ihre Finger wie Federn lassen
Schmerzlos
Einfach soo

Unsere Augenpaare wandeln sich
Zu himmelblauen Seen
Und unsere griechischen Satyrschwänze
Zu roten Früchten sich wandeln
Einfach sooo

Um von den wild unendlich lang gelockten
Nackten Mädchen lustvoll verspeist zu werden
Das wünschen wir uns sehr
Einfach soooo

Abul Hasan & Reinhart Hevicke (Hübner), 31.12.1974

 

বাংলা অনুবাদ ও ভূমিকা : মোশতাক আহমদ