ক্রিস লাওটারিসের কবিতা
ক্রিস লাওটারিস [Chris Laoutaris]
ক্রিস লাওটারিস গ্রিক-সাইপ্রিয়ট বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ কবি, জীবনীকার, ঐতিহাসিক, গবেষক ও অধ্যাপক। ব্লিড অ্যান্ড সি (রক্তঝরা দেখা) তাঁর প্রথম কবিতার সংকলন। এটি প্রকাশিত হওয়ার আগে ‘এরিক গ্রেগরি পোয়েট্রি’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত তাঁর ইতিহাস ও জীবনী ভিত্তিক বই শেক্সপিয়ার অ্যান্ড দি কাউন্টেস: দি ব্যাটল দ্যাট গেইভ বার্থ টু দি গ্লোভ বইটিও জীবনী শাখায় ‘টনি লোথিয়ান প্রাইজে’র জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠে এসেছিল। ক্রিসের এই বইটি অবজারভার এবং টেলিগ্রাফ পত্রিকার ‘বুক অব দি ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, নিউইয়র্ক পোস্ট এই বইটিকে বছরের অবশ্য-পাঠ্য একটি গ্রন্থ হিসেবেও বাছাই করেছিল। নিউইয়র্কের পেগাসাস বুকস এবং হারপার কলিন্সের সঙ্গে তিনি বর্তমানে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আছেন আরো চারটি বই লিখতে। এই মুহূর্তে যৌথভাবে সম্পাদনা করছেন অ্যান অ্যানে-থোলজি: পোয়েমস কমেমোরেটিং শেক্সপিয়ার’স ওয়াইফ। ইউসিএল [ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন] থেকে ইংরেজি সাহিত্যে কাজের জন্য ‘মোরলি মেডেল’ পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বিবিসি ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস, মেক্সিকো ইত্যাদি দেশের খ্যাতনামা বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাহিত্য নিয়ে আলাপ ও অনুষ্ঠান করেন। ক্রিস লাওটারিস নিজে এক কবিবংশের সন্তান। তাঁর প্রবংশের এক উল্লেখযোগ্য গ্রিক-সাইপ্রিয়ট লোককবির নাম ক্রিস্টোফার পালেশি।
ক্রিস লাওটারিসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর কবিতার মাধ্যমে নয়। একটি একাডেমিক লেখা রিভিউয়ের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটি বন্ধুত্বে বিস্তার লাভ করে। পরে আমি আবিস্কার করি প্রফেসর ক্রিস একজন তুখোড় গবেষকই নন, প্রখর সংবেদনশীল একজন কবিও বটে। আমার আগ্রহ দেখে কবি নিজেই তাঁর বেশকিছু তীক্ষ্ণ মর্মভেদী কবিতা আমাকে পড়তে দেন। এমনকি অনুবাদেরও নিঃশর্ত অনুমতি দিয়ে রাখেন। যে অভিনিবেশ ডক্টরাল গবেষণার জন্য দরকার পড়ে, সেই অনুধ্যানকে ছন্দে রাখবার জন্যই, এই বিলাতে এসে সময়ের রসায়ন থেকে আমি শিখেছি কীভাবে মূল কাজ থেকে হঠাৎ একটুখানি সরে আসতে হয়। নিজেকে নিজের কাজ থেকে অস্থায়ী ভিত্তিতে প্রত্যাহার করতে হয়। এরপর করে ফেলতে হয় কিছু খুচরো কাজ। যেমন খোলা টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়া, নির্জন কোনো স্টেশনে নেমে পড়া আর বিস্তীর্ণ গমক্ষেতের রৌদ্রে অবগাহন করতে করতে ইংলিশ দিগন্ত দেখা। একের পর এক সন্ধ্যা অ্যাভন নদীর তীরে আরএসসিতে নাটক দেখে দেখে অরূপনারাণের কূলে ভিড়ে যাওয়া। তুখোড় কোনো ধুরন্ধরের সাথে নিউস্ট্রিটের ফাইভগাইস পানশালায় আলাপে মজে যাওয়া। সুন্দর সবুজ পরিপাটি কোনো পার্কের ঘাসে উপোড় হয়ে শুয়ে গান লেখা, কবিতা লেখা অথবা অনুবাদ করা। তারপর সব থামিয়ে দিয়ে আবার ডেস্কে বসে পড়ে দিনদুনিয়া ভুলে যাওয়া। এভাবেই মনকে বাঁধবার জন্য মন ছেড়ে দিতে দিতে আমি ক্রিস লাওটারিসের কিছু কবিতা অনুবাদ করে বসি।
আমাদের ভাষার এক শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান একদা অনুবাদের কারবার করতে গিয়ে ইংরেজ কবি রবার্ট ফ্রস্টকে উদ্ধৃত করেছিলেন, ‘পোয়েট্রি ইজ হোয়াট গেটস লস্ট ইন ট্রান্সলেশন’। কবিতার অনুবাদে যা হারিয়ে যায় তা-ই কাব্য। আর যদি তাই হয় তবে বাঙালি বিদূষী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক আউটসাইড ইন দি টিচিং মেশিন বইয়ে তবে কেন বললেন, অনুবাদ হলো পাঠের সবচে ঘনিষ্ঠতম রূপ! তাত্ত্বিক গায়ত্রী স্পিভাকের কথন অনুযায়ী—নিজের মধ্যে থাকা অপরের দাগ খুঁজতে আমাদের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে তার মূকাভিনয় করার কাজ হলো অনুবাদ। ক্রিসের কবিতার শূন্যতা, শল্যচিকিৎসামূলক বাস্তবতা, ফেলে আসা সময়ের নির্জন উপস্থিতি, স্মৃতির চাপ আর মৃত্যুর ভার দিয়ে আমি এই বিদেশ বিভূঁইয়ে ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়েছি। মিতব্যয়ী বাগধারা, ছন্দের চলন, ধ্বনি মাধুর্য, রূপকালঙ্কার ইত্যাদি মিলিয়ে সমকালীন ইংরেজি ভাষার অন্তর্গত কাব্যসুষমায় যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিসর ক্রিস লাওটারিস সৃজন করেন, আমি কবুল করি, আমার অক্ষম অনুবাদে, এর সবই প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তবে গায়ত্রীর দোহাই দিয়ে বলবো, সত্যি কথা বলতে কি, এই দীর্ণ সময়ে, ক্রিসের কবিতার সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠতা অনুভব করেছি। অতএব, আত্ম ও অপরের মধ্যকার সম্পর্ক আস্বাদ করতে চলুন পাঠ করি ক্রিস লাওটারিসের কয়েকটি কবিতা।
—ভূমিকা ও অনুবাদ : শাহমান মৈশান
ক্রিস লাওটারিসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর কবিতার মাধ্যমে নয়। একটি একাডেমিক লেখা রিভিউয়ের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটি বন্ধুত্বে বিস্তার লাভ করে। পরে আমি আবিস্কার করি প্রফেসর ক্রিস একজন তুখোড় গবেষকই নন, প্রখর সংবেদনশীল একজন কবিও বটে। আমার আগ্রহ দেখে কবি নিজেই তাঁর বেশকিছু তীক্ষ্ণ মর্মভেদী কবিতা আমাকে পড়তে দেন। এমনকি অনুবাদেরও নিঃশর্ত অনুমতি দিয়ে রাখেন।
কাজ চলছে
আমি তোমাকে রাখতে চাই
ধরে মাঝখানে
ওই বালকটির
যে এঁকেছিল ভয় তাদের নরম অস্তিত্ত্ব জুড়ে
যে পর্যন্ত তারা আরাম পাচ্ছিল,
আর ওই যুবকটির
যার কাঁপুনি পৌঁছেছিল
ওই কক্ষটির ভিতরে,
ওই কক্ষে থাকা জীবনগুলোর ভিতরে,
ওই জীবনগুলোর চারপাশে থাকা দুনিয়ার ভিতরে,
তার কাঁপুনি থামবার আগপর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল।
এখন আমি জানি এর সারমর্ম কী
এই কক্ষে, ওই বিছানায়
যেখানে তুমি শুয়েছিলে
ভাঁজ হয়ে যাবার হাত থেকে আমাদের জীবন বাঁচিয়ে দেওয়া।
যদিও তুমি এক মৃত ভালোবাসা
যার কাজ এখনো চলছে, এখনো যা তৈরি হয়ে চলছে।
শীতযাপন
আমরা কেটেকুটে কোনোরকম একটা পথ করেছি
বনের নীরব ঢালুতে,
প্রত্যেকটি ছিলে তুমি যে যে গাছ আমি দেখেছি,
এদের বসন্তগুটিঅলা বাদামী হাড় তোমার শরীর ছিল কাদামাটিতে,
তা আমরা যেখানে ফেলে এসেছি আর নেই
গাছেদেরও জিভ আছে, তারা বলে আমাদের হাসি আর ভুলগুলোর কথা।
আমি খেয়াল করেছি একটি ডুবন্ত ধনুক ভেঙে টুকরো দুই;
এর ভাঙার শব্দ যেন ছিল তোমার নাম, এর বেঁকে যাওয়া ছিল একটি চিত্রলেখা
ভালোবাসার। আমি হারিয়ে ফেলেছি গন্তব্য
এই সম্পর্কের, ওই প্রেরণা মিলবার
তুলে নিয়েছি প্রতিটি নিন্দা যেন ঘায়ের পুঁজদ্রব্য
এই যাপিত শীতের মধ্যে কালসিটে থিকথিকে চামড়ার।
আমি কিভাবে বলতে পারি
তুমি মরে গেছ
যখন সহজেই এটা বলা হয়
তখনো তোমার
পালস পর্দায় দেখা যায়,
একটি জৈব-আলোককীট
ধরা পড়েছে
ডুবো কেন্দ্র্র্রের
আলোকরশ্মিতে,
এক্সরে-তে
তোমার হাড়গুলো সেভাবে উচ্চারিত
যেভাবে আমার
আঙুলগুলো তোমাকে
পাঠ করে, জীবন্ত,
যখন দাঁতগুলো আর
শুঁড়গুলো তোমার
চামড়ার নিচে
যেমন আমি তোমাকে
ধুইয়ে দিয়েছি
আর পোশাক পড়িয়েছি
তেমনি আমাকে খাইয়েছ
বিষ
আমি অনুভব করেছি
ভালোবাসা?
কৃতজ্ঞতা
তুমি কি রেগে আছ? তোমার বার্ষিকীতে আমাকে তোমার এ কেমন প্রশ্ন।
সত্যি করে বলো তো আজকের এই হিংস্র অনুভূতিগুলো আগে কোথায় ছিল?
তোমার ক্ষতের গভীরে এই হাত সেঁদিয়ে দিয়ে তুলে এনেছি ভিনদেহের শিকড়।
আমি একে আবার রোপন করেছি, ভালোবেসেছি, দেখেছি এর রক্তফুলের বাহার,
এর নাম দিয়েছি কৃতজ্ঞতা; তোমার কষ্টের জন্য না, তোমার অকাল মৃত্যুর জন্যও না
[আমি চাই তুমি আজো বেঁচে আছ, এজন্য তোমাকে কতটা কষ্ট সইতে হতো, তাতে আমার কি আর এটা খুব স্বাার্থপর একটা চাওয়া তাও আমি জানি],
কিন্তু এইতো আমার উপলব্ধি
তোমার সম্মানে। এটা এক প্রকার রণকৌশল, যোদ্ধার সংকেত,
যে সাফল্য দিয়ে তুমি তোমার জীবন গড়েছিলে তা তুমি করেছিলে
একান্তই তোমার নিজের মতন, এমনকি তোমার শরীর যখন তোমাকে বারবার বঞ্চনা করেছে তখনো।
আমি জানতাম এটাই তুমি বলতে, তোমার প্রত্যুত্তরে, হাসিমাখা মুখে। এতে কিছু আসে যায় না
জীবন কতটা সংক্ষিপ্ত, ভালোবাসায় আসে না জয়, পুনরুদ্ধার।