মেলামেশা করতে থাকো ও অন্যান্য কবিতা
হূবনাথ পান্ডে [Hubnath Pandey]
প্রতিবাদী কবিতা কিংবা কবিতায় প্রতিবাদ, এ নিয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ বিষয়টিকে বিশুদ্ধবাদীরা দেখেন একরকমভাবে। তাঁদের মত হলো, প্রতিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে লেখাটি বিবৃতিমূলক হওয়ার দিকেই ঝুঁকতে চায়, যা নষ্ট করে কবিতার লাবণ্যকে। আবার, কবিতাও বিভিন্ন সময়ে অনেক আন্দোলনকে প্রেরণা জুগিয়েছে, জোরদার করেছে, আন্দোলনকারীদের উদ্বুদ্ধ করেছে, এমন নজিরও খুব কম নেই।
আধুনিক হিন্দি কবিতার জগতে হূবনাথ পান্ডে চর্চিত একটি নাম। বহুচর্চিত তাঁর কবিতা। এই সময়, এই সময়ের বৈষম্য, কুসংস্কার, জাতপাতের সমস্যায় দীর্ণ ভারতীয় সমাজ, রাজনীতিকদের নীতিহীনতা, রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী মনোভাব...এসবই কবি হূবনাথ পান্ডের কবিতার বিষয়। তাই তাঁর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর শোনা যায় তেলেগু কবি ভারভারা রাওকে সামনে রেখে লেখা কবিতা ‘এক বুড়া’-য়। লেখেন, ‘করোনার ভয়াবহ এই আবহে/ ত্রস্ত রাষ্ট্রের এত ভয়!/ এত ভয় একজন জরাগ্রস্ত বুড়োকে?/ তার কবিতাকে? তার জড়িয়ে-আসা উচ্চারণকে?’ পরেই তিনি লেখেন, ‘এ কথা তো সত্যিই --/ আলোর ক্ষীণ একটি বিন্দুকে আজও/ ভয় পায় জমাট অন্ধকার!’
আমরা জানি, মুক্তির সপক্ষে স্বাধীন কন্ঠ বনাম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চিরকালীন বৈরিতার কথা। আমরা স্বাধীন সেই কন্ঠস্বর শুনি হূবনাথের কবিতায়। হূবনাথ পান্ডের আর একটি দীর্ঘ কবিতার কথা উল্লেখ করব। কবিতার নাম ‘মুসলমান’। কবিতাটি শুরুই হচ্ছে এভাবে– ‘ম্যায় মুসলমান হুঁ/ কিঁউকি মেরে আব্বু মুসলমান হ্যায়/ অগর ও হিন্দু হোতে/ তো ম্যায় ভি হিন্দু হোতা।’ এমনই সহজ সরল ভাষায় লেখা যে, কবিতা তরতর করে শেষ অবধি পড়ে যেতেই হয়। এ কবিতায় তথাকথিত দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিদ্বেষ, তা নিয়ে ইন্ধনকারীদের মদতে ঘটা দাঙ্গার বীভৎসতা উঠে এসেছে কবিতার ছত্রে ছত্রে নিতান্তই আটপৌরে শব্দসংকলনে।
কবি হূবনাথ পান্ডের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘কৌয়ে’। প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে। ওই বছরই প্রকাশিত হয়েছিল ‘লোয়ার পরেল’ কাব্যগ্রন্থও। দুটি বই-ই প্রকাশ করে মুম্বাইয়ের ‘অনিমেষ প্রকাশন’। ‘মিট্টি’ তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল ২০১২। এটিও প্রকাশিত হয়েছে একই প্রকাশনা সংস্থা থেকে। ১, ২, ৩ করে অনেকগুলো ছোট ছোট আকারে কবিতা সংকলিত করা হয়েছে ‘মিট্টি’ কাব্যগ্রন্থটিতে। তার থেকে একটিমাত্র কবিতা উদ্ধৃত করা যাক– ‘মিট্টি কো ছুয়ো/ তো অ্যয়সে/ জ্যায়সা ছুতা হ্যায় ফুল/ খুশবু কো/ জ্যায়সা ছুতী হ্যায় কিরণ/ রৌশনী কো/ জ্যায়সে ছুতি হ্যায় হাওয়া/ শীতলতা কো/ ছুতা হ্যায় জল/ তরলতা কো/ মিট্টি অ্যায়সে হি ছুতি হ্যায় মিট্টি কো’: মাটিকে সেভাবেই ছোঁও/ যেভাবে সৌরভ ছোঁয় ফুল/ যেভাবে আলো-কে ছোঁয় কিরণ/ শীতলতাকে ছোঁয় হাওয়া/ আর তরলতাকে জল।/ মাটি/ এভাবেই ঠিক ছুঁয়ে থাকে মাটিকে।’
জাতপাতে দীর্ণ এই সমাজে একজন কবি যখন তাঁর ‘বাল্মীকি’ কবিতায় প্রশ্ন করেন, ‘কী জাত তোমার/ বাল্মীকি?/ জনতা জানতে চায়!’ আমরা চমকে উঠি আমাদের দীনতায়, হীনতায়। এ কবিতাতেই তাঁর উচ্চারণ: ‘তোমার রাম ছিল মানুষ/ একজন মানুষের যেসব দোষত্রুটি থাকে/ সেই সব নিয়ে একজন রক্তমাংসের মানুষ।/ পরবর্তী ভক্ত কবির দল/ রামকে ঈশ্বর বানিয়ে দিয়েছে–/ বেজায় দুর্বল আর অসহায় এক ঈশ্বর।/ এই ঈশ্বর পাপীদের হাতের খেলনা হয়ে উঠেছে/ আর তা নিয়ে খেলা শুরু করেছে ধান্দাবাজ রাজনীতি।’ আবার ‘এক অওর আদিবাসী’ কবিতায় তাঁর স্পর্ধিত উচ্চারণ: ‘তোমাদের সভ্যতার সামনে/ আমরা দাঁড়িয়ে থাকব বুক চিতিয়ে/ আমাদের অসভ্যতাকেই সঙ্গী করে দেখতে চাই/ কত ক্রূর হতে পারে তোমাদের মহান সভ্যতা!/ আর দেখাতে চাই–/ মারখাওয়া মানুষেরাই হারে না প্রতিবার,/ যারা মারে, তারাও জেতে না সব সময়!’ তাঁর কবিতায় যেমন হাইওয়ের ট্রাকের চাকায় পিষ্ট পরিযায়ী যুবক শ্রমিকের প্রসঙ্গ আছে, তেমনই হাথরসে নৃশংস বলাৎকারের ও হত্যার শিকার সেই মেয়েটিও উঠে আসে কবিতার বিষয় হয়ে। এসব থেকেই এই সময়ের সঙ্গে কবি হূবনাথ পান্ডের ভাবনার সম্পৃক্ততা আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি।
২০২০ সালের শুরুতে জয়পুরের ‘বোধি প্রকাশন’ থেকে বেরিয়েছে তাঁর সাম্প্রতিক কবিতার বই– ‘অকাল’। এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতেও ধরা আছে এই সময়। সমাজের অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে যেন তীব্র একটি আলোর অস্থির আনাগোনা এই সব কবিতা। ১৯৬৫ সালের ১৩ এপ্রিল বেনারসে জন্ম কবি হূবনাথ পান্ডের। বর্তমানে তিনি মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। কবিতা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনাও লিখেছেন। এযাবৎ প্রকাশিত কবি হূবনাথ পান্ডের কাব্যগ্রন্থ কৌয়ে, লোয়ার পরেল, মিট্টি ও অকাল। সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনা বাজা ও হমারি বেটি। নিবন্ধগ্রন্থ ললিত নিবন্ধ: বিধা কী বাত, ললিত নিবন্ধকার কুবেরনাথ রায়, সিনেমা সমাজ সাহিত্য ও কথা পটকথা সংবাদ এবং গবেষণাগ্রন্থ সমান্তর সিনেমা মে নারী।
ভূমিকা ও মূল হিন্দি থেকে অনুবাদ স্বপন নাগ
মেলামেশা করতে থাকো
যেদিন আমি থাকব না
তোমার দু’চোখ বেয়ে ঝরে পড়বে অশ্রুধারা
অথচ জানতেও পারব না,
তারচেয়ে বরং ভালো
এসো, আমরা একসাথে কাঁদি।
সেদিন তুমি ফুল পাঠাবে
আমি দেখতেও পাব না,
বরং ভালো, এখনই পাঠিয়ে দাও।
আমার স্তুতি করবে সেদিন
শুনতেও পাব না,
ভালো হয়, এখনই প্রশংসা করো।
মাফ করে দেবে আমার সমস্ত ত্রুটিকে
অথচ জানতেও পারব না;
বরং ভালো, এখনই ক্ষমা করে দাও।
আমি সত্যিই যেদিন চলে যাব
স্মরণ করবে আমায়–
টের পাব না একটুও,
বরং এখনই আমার কথা ভাবো।
আমার সঙ্গে আরো কিছু সময়
কাটানোর ইচ্ছে তো ছিলই তোমার,
ভালো হয় না, এখনই কাটালে!
আমার চলে যাবার খবর পেয়েই
তুমি ছুটে আসবে আমার ঘরে,
সমবেদনা জানাবে;
অথচ কেটে গেছে বছরের পর বছর
আমরা একটি কথাও বলিনি পরস্পরে
এখন, এখনই ফিরে তাকাও আমার দিকে।
একা একা তো বলতেই পারি
কিন্তু তুমি সঙ্গে থাকলে কত কথা বলা যায়,
এমনকি একাকী খুশি, তাও থাকতে পারি
তুমি থাকলে উৎসবে মেতে ওঠা যায়;
স্মিতহাসি হাসতেই পারি, যদি একা থাকি
তুমি থাকলে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠা যায়।
মানবসম্পর্কের এ এক আশ্চর্য মজা–
একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজন কিছুই নয়!
মেশো, মেলামেশা করতে থাকো।
লাফটার চ্যানেল
‘তাড়াতাড়ি এসো মাম্মি
দেখো, আরও দুটো স্কাল পেয়েছে খুঁড়ে’
ডাইনিং টেবিলে বসে
টিভি দেখতে দেখতে
মাকে ডাকে সাত বছরের চিকু।
মেটের টুকরো মুখে তুলে পাপা বলল,
‘একটু হাড়সুদ্ধু মাংস দাও তো!’
মাংসের প্লেট হাতে
কিচেন থেকে মায়ের আসার আগেই
নিউজ চ্যানেলে
কিছু গাঁয়ের মেয়েমানুষদের দেখাচ্ছিল।
নকশাল ভেবে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে
তার মরদ আর ছেলেদের,
তাই নিয়ে অসভ্যের মত চিৎকার করছে।
‘চ্যানেল পাল্টাও তো
কী বিচ্ছিরি চেঁচামেচি করছে দেখো,
গাঁইয়া মেয়েছেলে’
কাবাব পরিবেশন করতে করতে
মায়ের বিরক্তি।
এবার এক অভিনেতা
তার হবু বৌকে নিয়ে চলেছে হাসপাতালে:
দিদার আশীর্বাদ নেবে!
আর তাদের দেখতে হামলে পড়ছে জনতা–
‘হাউ নাইস, না ডার্লিং!’
এর মধ্যেই
ছোটা সা কমার্শিয়াল ব্রেক।
আর তারপরই
টিভির পর্দা থেকে ঝরে পড়তে থাকল
চোলি সাবান হিরো জাঙ্গিয়া বাইক
বিস্কুট চকলেট
এক রঙিন দুনিয়া জুড়ে
ঝলমলে যুবক আর যুবতীরা
ভরিয়ে দিল পুরো ডাইনিং হল।
‘মাম্মি, তুমি ওই স্কালের সিন-টা
খুব মিস্ করলে,
ও বাংলো থেকে এখনো অব্দি
থার্টি ফোর স্কাল বেরিয়েছে।’
‘আর একটু চাটনি দাও তো ডার্লিং
আজকের মাটনটা কিন্তু ডেলিসিয়াস হয়েছে।’
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে
বিদর্ভে চাষির আত্মহত্যায়
তার বিধবা বৌয়ের বিলাপ, কান্না
সরকারও বসিয়েছে তদন্ত কমিশন।
‘এই ফার্মাররা সুইসাইড কেন করছে?
কী সব ফালতু নিউজ দেখছো পাপা,
বদলাও না চ্যানেল!’
আর, এবার শুরু হল লাফটার চ্যানেল-টু
অর্ধনগ্ন একটা মেয়ে
নেচেকুঁদে শুরু করল ইতরামি...
পুরো ঘর ভরে উঠল অট্টহাসিতে।
মহাদেব
সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে
আর কত ঘুরে বেড়াবে মহাদেব?
অকথ্য ভিড় দেখো মণিকর্ণিকায়।
দূষণজর্জরিত জাহ্নবীর কিনারে কিনারে
মরা মাছের মত ভেসে যাচ্ছে
অগুনতি মানুষের লাশ,
ওখানেই ভাসিয়ে দাও সতীর মৃতদেহ।
প্রাণে বেঁচে ফেরো ধূর্জটি!
যাও, দেখো বিসর্জনের জন্যে
আত্মীয়েরা আর কারা বাকি রইল!
তোমার সাধ্যাতীত এই তান্ডব
হে মহাকালেশ্বর! হে মহাদেব!
অসহায় নতজানু প্রজাদের দেবতা
অমর হয় না কখনও।