নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়!
১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪। হেমন্তের এক হতচ্ছাড়া বিকেল—কলকাতার বালিগঞ্জ রোডের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন, যার হাঁটার বয়স হাজার বছর। হঠাৎ প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের মতো ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে বালিগঞ্জ ডাউন ট্রাম এলো। একটা ধাক্কা... তারপর...?
তারপর সেই অমোঘ সত্য, ‘নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।’
একজন কমলালেবু বইয়ের ভূমিকা মৃত্যু দিয়েই শুরু। লেখক শাহাদুজ্জামান জীবনানন্দ দাশের জীবনাচরণ, উত্থান-পতন এবং ব্যক্তিজীবনের অনেকখানিই বর্ণনা করেছেন এই বইয়ে।
একজন কমলালেবু বইটি কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং সেসব অধ্যায়ের আছে চমৎকার কিছু নাম। বইয়ের শুরু কবি-মাতা এবং কবি কুসুমকুমারী দাশের পুত্রবাৎসল্য এবং তাঁর লেখা কবিতার কথা নিয়ে। জীবনানন্দ দাশ ওরফে মিলুর জগতে কবিতার আনাগোনা, সাহিত্য জগতে হাতেখড়ি মায়ের নির্দেশনায়। কিন্তু পরবর্তীকালে, মায়ের সাথে পুত্রের বিশ্বাস আর দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে মানসিক দূরত্বের আভাস পাওয়া যায়। তবে জীবনানন্দ দাশ তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে মায়ের কথা মান্য না করার আক্ষেপও প্রকাশ করেছেন একসময়। একজন কমলালেবু বইটি মূলত জীবনানন্দ দাশের দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁর জীবনের চক্রবাক দেখার একটি প্রচেষ্টা—যেখানে উপজীব্য হিসেবে এসেছে জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিগত ডায়েরির লেখা, তাঁর কাছের মানুষদের ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা এবং তাঁর সাহিত্যচর্চা। এতে লেখকের লেখার সৌন্দর্য নষ্ট হয় না একবিন্দুও, তবে ওই সময় আর কবির সমসাময়িক মানুষের প্রতি একতরফা দোষারোপ করার মানসিকতা তৈরি হয় বৈকি! সমসাময়িক সেসব মানুষের মাঝে আছেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাশ, যতীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। জীবনানন্দ দাশের কবিতার কুঁড়িগুলো ফুটে ওঠার সময়টুকু খুব সুন্দরভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন তাঁর বইটিতে। সমসাময়িক প্রায় সব লেখক তুচ্ছতাচ্ছিল্য, কখনোবা তিরস্কার, কখনো সরাসরি আক্রমণ দিয়ে একের পর এক বিদ্ধ করে গেছেন তাঁর লেখাকে। এই চরম বিরাগের প্রধান কারণ হিসেবে ধরা যায়, জীবনানন্দ দাশ ছিলেন তাঁর সময় থেকে অনেকটা এগিয়ে।
তাঁর কবিতার উপমা, শব্দচয়ন, অভিব্যক্তি—পুরোটাই ছিল তাঁদের প্রচলিত জ্ঞানগরিমার বাইরে। ফলে রবীন্দ্রধারার লেখক ও রবীন্দ্রধারার বাইরের লেখক—সবারই রোষানলে পড়েছেন তিনি। জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাব বুঝতে না পারার আক্রোশ তাঁরা মিটিয়েছেন দিনের পর দিন তাঁর কবিতার সমালোচনা আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। জীবনানন্দেরই সমসাময়িক কবি বুদ্ধদেব বসু সে সময় তাঁর পাশে দাঁড়ান বন্ধুর মতো। সেই বন্ধুত্বের সময়কাল দীর্ঘ হলেও তা শেষের দিকে কর্পূরের মতো মিলিয়ে যায়।
কাকাতো বোন শোভনার প্রতি ভালোবাসা, স্ত্রী লাবণ্যের তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর বেকারত্ব—সবই তাঁর জীবনের সাথে সাথে কবিতার জগৎকে চালিত করেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে। জীবনানন্দ দাশের জীবনের সঙ্গে কবিতার যোগাযোগ কতখানি, তা খুব সহজেই মেলানো যায় ব্যক্তিগত ডায়েরির লেখা থেকে।
শুধু বোধ আর বিস্ময়ের বিপন্নতাই নয়, ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন বিপন্ন, অসহায়, কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়া মৃতপ্রায় নক্ষত্র। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকে তাঁর জীবনে যে চরম দুর্দশা শুরু হয়, তার এক এবং একমাত্র প্রতিকার হয় কবির রহস্যজনক মৃত্যুতে। ব্যর্থ প্রেম, দুঃসহ দাম্পত্য অভিজ্ঞতা, আর্থিক সংকট আর সাহিত্য জগতে জায়গা না পাওয়ার যন্ত্রণা কবিকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে সারাটি জীবন। কুঁচো চিংড়ি খেয়ে দিনের পর দিন কাটাতে হলেও কবির কলম কখনো থেমে থাকেনি। লিখে গেছেন কবিতা, উপন্যাস, গল্প। সেসব লেখার বিশাল একটা অংশ তিনি কখনো ছাপাতেই দেননি। রেখে গেছেন কালো ট্রাঙ্কে কোনো এক সময় তাঁকে সত্যিই গ্যেটে, ইয়েটস, তলস্তয়ের মতো স্মরণ করা হবে—এই বিশ্বাস নিয়ে।
তিনি বড় অপছন্দ করতেন অন্নসংস্থানের চিন্তা, কোনোমতে খেয়েপড়ে জীবন চালিয়ে নেবার ভাবনা। অথচ এই ভাবনাতেই পুরোটা জীবন পার করতে হয়েছে তাঁকে। তিনি তাঁর লেখা উপন্যাসে বলেছেন, ‘মাঝে মাঝে মাইনে অর্জন করবার অধিকারটা আজ সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতে ইচ্ছা করে, কিন্তু তবুও এই ঘৃণিত জিনিসটাই প্রেমের চেয়েও আমাকে বেশি দখল করে রেখেছে যেন, আমার মৃত্যুর সময়েও এক হাতে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার—হয়তো একশো টাকার কেরানিগিরির আর এক হাতে সেই মেয়েটির আত্মনিবেদনের চিঠি, এই দুটি জিনিসের মধ্যে কোনটিকে যে ভালোবাসব, বুঝে উঠতে পারছি না।’
জীবনানন্দ দাশ জীবনের সবচেয়ে সংকটপূর্ণ সময়গুলোতে কবিতার চেয়ে গদ্যই লিখেছেন বেশি। সেই গদ্যগুলো ঘাঁটলে দেখা যায়, উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো তাঁর জীবনচিত্রই প্রতিফলন করছে বারবার। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসেও জীবনানন্দ সংশয়ে ভুগেছেন, কবি না গদ্যকার—কী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা উচিত, এই টানাপোড়েনের কথা তাঁর ডায়েরি পড়লে বোঝা যায়।
জীবনানন্দ দাশকে বিষণ্ণতার কবি, নির্জনতম কবি বলা হয়ে থাকে। অথচ নিজেকে একজন লেখক হিসেবে পরিচিত করবার যে প্রাণান্ত চেষ্টা তিনি করেছেন, বারবার সাহিত্য জগৎ থেকে বিতাড়িত হয়েও ঘুরে দাঁড়াবার যে প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ছিল তাঁর—এই প্রাণশক্তি নিভে যাওয়ার বা নিভিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে অনেকে থাকলেও কাউকেই ঠিক দোষারোপ করা যায় না। যদি দুষতেই হয়, তবে সবচেয়ে বড় দোষটা কবির ‘সময়ের’। জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের এক অভাগা কবি, যিনি কিনা ভুল করে ভুল সময়ে জন্ম নিয়েছিলেন এই বঙ্গদেশে।
বিশ্বযুদ্ধের মাতম, দুর্ভিক্ষ, সবশেষে ভারত বিভক্তি—এই সবকিছুরই অসহায় ভুক্তভোগী হতে হয়েছে বাংলার এই প্রবাদপ্রতিম কবিকে।
বাংলা সাহিত্যে টিকে থাকার চেয়েও নিজ জীবনে টিকে থাকাটা তাঁর জন্য বরাবরই কঠিন ছিল, তবে শেষ সময়ে নিজ মাতৃভূমি বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় আবাস স্থাপনের পর সেই টিকে থাকার গ্লানি আরও অসহনীয় হয়ে পড়েছিল তাঁর কাছে। একটা চাকরির খোঁজে পরিচিত সবার কাছে যেতেন, কবিতা পাঠিয়ে টাকা ধার চাইতেন, এমনকি একবার বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতেও গেছেন গদ্য লিখে কেমন আয় হয় তা জানতে। আত্মহত্যার প্রবণতা আগে তাঁর বিভিন্ন কবিতায় দেখা দিলেও এবার তিনি ডায়েরিতে সরাসরি লিখেছেন মৃত্যু নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা। তিনি লিখেছেন, সমুদ্রে ডুবে সপরিবারে আত্মহত্যা করতে চান সন্ধ্যাবেলায়। তবে আত্মহত্যার সময় পিছিয়ে দেন কেবল আরও কিছু লিখে যাওয়া বাকি বলে। ১৯৫৩-৫৪ সময়কালে কবির কিছু বান্ধব আর ভক্ত দেখা দিলেও তিনি তখন অস্ত যাওয়ার প্রান্তে। জীবন সম্পর্কে সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ১৯৫৩ সালে তিনি যখন ‘বনলতা সেন’ কবিতার জন্য রবীন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার পান। সেই ক্রেস্ট খাটের তলায় রাখার সময় মেয়ে মঞ্জুশ্রী তাঁকে পুরস্কার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, কবি নিরুত্তাপভাবে উত্তর দেন, ‘ওই আরকি।’
এভাবেই একদিন জীবনযুদ্ধে পরাজিত ক্লান্ত পথিক উটের গ্রীবার মতো লম্বা জীবনকে ছুটি দিয়ে চলে গেলেন আকাশের ওপারে, বাতাসের ওপারে। সেই দুর্ঘটনার পর কবি হাসপাতালে ছিলেন আরও কয়েক দিন। সে সময় কবির একান্ত কাছের বন্ধু সঞ্জয় তাঁকে দেখতে গেলে তিনি কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। ‘কমলালেবু’ নামে একটি কবিতাও আছে তাঁর।
একজন কমলালেবু বইয়ে জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে কবিত্বের নির্মম পরিণতি—সবই বেশ গোছানো ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে একটা জায়গায় আমাকে বেশ হতাশই হতে হয়েছে। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিই জনসাধারণের কাছে জীবনানন্দকে পরিচিত করেছে সবচেয়ে বেশি। লেখক শাহাদুজ্জামান নিজেই বলেছেন, অনেকে জীবনানন্দ দাশের নাম না জানলেও বনলতা সেনের নাম শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। বনলতা সেন যেন বাঙালি নারীর শাশ্বত সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক। কিন্তু বইটিতে বনলতা সেন কবিতার জন্ম বা তার ব্যাখ্যা নিয়ে ভাসা-ভাসা বর্ণনা আমাকে হতাশ করেছে। লেখক শাহাদুজ্জামান জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’, ‘আট বছর আগের একদিন’, ‘ক্যাম্পে’ কবিতাগুলো নিয়ে যতটা ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করেছেন; তার সিকি ভাগও বনলতা সেন নিয়ে করেননি। যেন অনেকটা দায়সারাভাবে বনলতা সেনকে এড়িয়ে গেছেন তিনি। জীবনানন্দ দাশের জীবনের শেষ সময়ে হঠাৎ ‘কিছুটা’ সম্মান, স্বীকৃতি কী করে তাঁর জুটে গেল, এই বিষয়েও যথাযথ কোনো ব্যাখ্যা নেই। বইয়ের শুরুতে কবির বাবা, মা, ভাই সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ থাকলেও বোন সুচরিতা নিয়ে কিছুই ছিল না, কিন্তু জীবনানন্দ দাশের শেষ সময়ে তাঁর ছোট বোন সুচরিতার স্নেহ, ভালোবাসার চিত্র যতটা দেখা যায়, শুরুর সময়ের কোনো বর্ণনায় তাঁর সেই বোনের উপস্থিতি কেন ছিল না, তা সত্যিই ভাবনার উদ্রেক করে।
এই ছোট ছোট খামতি বাদ দিলে একজন কমলালেবু বইটি জীবনানন্দের জীবনকে কিছুটা হলেও বোঝার জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি এমনভাবে কবির জীবনের প্রতিটি বিষয়কে সামনে এনেছেন যেন, লেখক এসব ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী।
কবির নাম ‘জীবনানন্দ’ হলেও তাঁর জীবনে আনন্দের আবহ খুব কমই ছিল। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সময় এবং স্বজনেরা কবিকে করেছেন একঘরে, নির্বাসিত। তবে, ভাবতে দুঃখ হলেও একটি প্রশ্ন বারবারই মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, এই নির্জনতা, বিষণ্নতার ছোঁয়া না পেলে কবির কলম থেকে এত চমৎকার কবিতা বাংলা সাহিত্য পেত কি? কবিতা লেখার ক্ষেত্রে সময় এবং পরিবেশ কত বড় প্রভাবকের কাজ করে, তা তো সবাই জানে। যে দারিদ্র্য, যে বন্ধুহীনতা, যে প্রেমহীনতা কবিকে নিয়ে গেছে ট্রামলাইনের ধারে; আমি বলব সেই হীনতাই কবিকে মহান করেছে, বাংলা কবিতাকে দিয়ে গেছে নক্ষত্রের আলো।