শ্বাসে আশে মুক্তি
সাতচল্লিশ হাজার টাকা।
টাকাটার জন্য মেয়েটি মাথা নিচু করে ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বসতে বলার কোনো সৌজন্যবোধ অলক দেখায়নি। তার চেহারায় সে এমন কিছু দেখতে পেল, যা নিজের কাছে অসহনীয়ই লাগল। সে একবারই মেয়েটির চেহারার দিকে তাকিয়েছে। মেয়েটিকে অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। তার দিকে দ্বিতীয়বার সোজাসুজি বা আড়চোখে তাকানোর চেষ্টা না করে অলক ভেতরের ঘরে চলে গেল।
‘যত দ্রুত সম্ভব টাকাটা দিয়ে মেয়েটিকে বিদায় করো।’ অলক ঝিনুকের কানে কানে বলল।
অলকের আচরণটা ঝিনুকের কাছে বেমানান ঠেকল। তবে মেয়েটিকে দ্রুত বিদায় করার কারণটা তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করল না। সে টাকাটা বের করে ড্রয়িংরুমে গিয়ে মেয়েটির হাতে তুলে দিল। মেয়েটি তখন নিজের অস্বস্তিটা সৌজন্যবোধের স্মিত হাসিতে আড়াল করল। অস্বস্তি আর সৌজন্যবোধের হাসির ভারসাম্য রক্ষা করা যে কত কঠিন, তা নিম্ন মধ্যবিত্তরা হরহামেশা টের পায়। মেয়েটি যে হাতে টাকা নিল, সেটি ওড়নায় আড়াল করে আর পেছনপানে না তাকিয়ে আস্তে করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। আর অলক ঝিনুকের মুখের দিকে না তাকিয়ে সোফায় বসে টিভির রিমোট চাপতে লাগল।
‘তুমি সাথীর বোনকে একটু বসে চা-নাশতা খাওয়ার সুযোগ দিলে না কেন?’ ঝিনুক অনুযোগের সুরে জিজ্ঞেস করল।
‘নিচে তোমার বান্ধবীর বোনের রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল।’
‘তুমি দেখেছ রিকশা? আর রিকশা থাকলেই কি! এক কাপ চা খেলে কী এমন দেরি হয়ে যেত!’
অলক ঝিনুকের কথার কোনো জবাব না দিয়ে একটা চ্যানেলে মনোযোগী দর্শক হওয়ার ভান করল। আর ঝিনুক চলে গেল শোবার ঘরে। নিচে সাথীর বোনের রিকশা হয়তো দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো ছিল না। বোনের চিকিৎসার জন্য টাকাটা হাতে নেওয়ার সময় কলেজপড়ুয়া মেয়েটি ভেতরের কষ্ট, সংকোচ ও লজ্জা আড়াল করতে সৌজন্যের যে হাসি হেসেছে, তা বেশিক্ষণ ধরে রাখা কষ্টকর। তাই অলক চায়নি মেয়েটিকে বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখতে। পাছে যদি তার হাসিতে ছেদ পড়ে আর ভেতরের কষ্টটা বেরিয়ে আসে! তাই অলক যতটা দ্রুত সম্ভব মেয়েটির হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে বিদায় করতে ঝিনুককে তাগাদা দিয়েছে।
চাকরির সুবাদে ঝিনুক ময়মনসিংহে মায়ের কাছে থাকে। ছুটি পেলে ঢাকায় গিয়ে থাকে। অলকও চেষ্টা করে তার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে আসতে। সব সময় সম্ভব হয় না বলে ঝিনুকের অনুযোগের শেষ নেই। অলকের ময়মনসিংহ যাওয়ার চেয়ে ঝিনুকেরই বেশি ঢাকায় আসা হয়। জীবিকার তাগিদে এভাবেই চলছে তাদের সংসারজীবন। পৌষের এক সকালে ময়মনসিংহের বাসায় ঝিনুক অলকের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করে।
‘এই, ওঠো না। আর কত ঘুমাবে?’
অলক মুখের কম্বল সরিয়ে শরীর টান করে বোয়াল মাছের মতো মুখ হাঁ করে হাই তোলে।
‘ও...ঠে...কী...ই...ক...র...ব?’
‘অনেক বেলা হয়েছে। নাশতা ঠান্ডা হচ্ছে।’
‘হোক। মানুষ বাঁচার জন্য খায়, খাওয়ার জন্য বাঁচে না।’
অলক আবার কম্বলে মুখ ঢেকে ধনুকের মতো পিঠ বাঁকিয়ে শুয়ে পড়ল।
‘কত দিন বলেছি সাথীকে একটু দেখে আসতে। চলো না আজ ওকে দেখে আসি।’
‘তোমার বান্ধবী কি দেখতে সুন্দর?’ অলক কম্বলের ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করল।
‘খুব সুন্দর।’
‘তোমার বান্ধবী কি আনম্যারেড?’
‘আনম্যারেড।’
অলক মুখের কম্বল সরিয়ে এক ঝটকায় বিছানায় উঠে বসল। মাথার আউলা চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দাঁত কেলিয়ে হাসল।
‘তাহলে তো তোমার বান্ধবীকে দেখতে যাওয়াই যায়।’ অলক বলল।
‘তাই চলো। উঠে তাড়াতাড়ি নাশতাটা সেরে নাও।’
ঝিনুক বিছানার কাছ থেকে সরতেই অলক আবার কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়ে। পৌষের এমন সকালে তার কাছে নাশতার চেয়ে কম্বলের আরামই যেন বেশি সুস্বাদু। সেদিনও সাথীকে দেখতে যাওয়া হয়নি। কিন্তু পরের সপ্তাহে অলক আর রেহাই পায়নি। ময়মনসিংহ শহরের মাঝখান দিয়ে রিকশায় করে তারা অনেকটা পথ পেরিয়ে প্রায় শহরতলির কাছে পৌঁছায়। তারপর একটা সরু গলি পেরিয়ে একটা টিনশেড বাসার সামনে রিকশা থামে। সাথীর ছোট বোন দরজা খুলল। চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর একটি পাতলা বালিশে মাথা আর দুহাত সোজা করে রেখে শীর্ণকায় সাথী চোখ বুজে আছে। পেছন থেকে দেখলে মনে হয় অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে। টেবিলের পাশে ঝুলে আছে অবহেলার শিকার এক গোছা নেতানো চুল। তার পৃথিবী সংকুচিত হতে হতে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে তাকে এখন সামান্য পানিও হিসাব করে পান করতে হয়।
‘সাথী, কেমন আছিস?’
ঝিনুকের ডাকে সাথী কায়ক্লেশে মাথা তুলে বিবর্ণ চাহনিতে হাসার চেষ্টা করে।
‘ভালো লাগে না রে। কত দিন স্কুলে যাই না! বাচ্চাদের হাউ-কাউ শুনি না।’
অলক এই প্রথম জানতে পারল, সাথী সরকারি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করে। তার একটি কিডনি পুরোপুরি নষ্ট। আরেকটিও যায় যায়। অনেক ধার-দেনা করে বাবার একটা কিডনি তার দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। সাথী অনেক দিন বেতন ছাড়া ছুটিতে ছিল। চাকরি আর পরিবারের কথা ভেবে সে আবার মাঝে মাঝে স্কুলে যেতে শুরু করে। সেই অপরিণামদর্শী নড়াচড়াই আরও কাল হয়েছে। বাবার দেওয়া কিডনিও এখন কার্যকারিতা হারানোর প্রহর গুনছে। ঝিনুক অলককে তার বান্ধবীর এই অবস্থার কথা আগে বলেনি।
ঝিনুক চিকিৎসার খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করে। সাথীর কথায় হতাশা ছাড়া কিছু নেই। তার কথায় বেতন ছাড়া মাসের পর মাস ছুটিতে থাকায় পরিবারকে সাপোর্ট দিতে না পারার আক্ষেপ ফুটে ওঠে। প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন, পরে নির্দিষ্ট সময় পর পর ডায়ালাইসিস, আনুষঙ্গিক টেস্ট, ঔষধ আর ডাক্তারের ফিসহ আনুষঙ্গিক খরচের দখল সইতে সইতে স্বল্প বেতনের চাকরিতে অবসরে যাওয়া বাবা এখন সর্বস্বান্ত প্রায়। একচিলতে জমি যা-ও ছিল সেটি বিক্রি করার পর এখন বাসার জায়গাটুকু বাকি আছে। ছোট বোনটার পড়াশোনা আর বিয়ে বাকি আছে।
ঝিনুক কেন অলককে অনেক দিন ধরে সাথীর কাছে নিয়ে আসতে পীড়াপীড়ি করছিল, এবার সে তা বুঝতে পারল। পেশার সুবাদে অনেক ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের সাথে অলকের জানাশোনা আছে। সে চেষ্টা করলে সাথীর চিকিৎসার্থে নিশ্চয়ই কিছু অর্থের সংস্থান করতে পারবে। অলকের চোখে ভাসে অনেকের চেহারা ও তাদের সাথে হৃদ্যতার বিষয়টি। মনে মনে ভাবে যে সাথীর জন্য মোটামুটি একটা ভালো অঙ্কের টাকা অনায়াসেই জোগাড় করা যাবে। কিছুক্ষণ পর সাথীর মা-বাবা অলককে দেখতে আসেন। অলক তাদের কাছ থেকে সাথীর চিকিৎসার বিভিন্ন কাগজপত্র চেয়ে নেয়। সাথীর বাবা আরেকটা ডকুমেন্ট দেখালেন, যাতে শিক্ষা বোর্ড তার মেয়ের চিকিৎসার্থে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনুরোধ জানিয়েছে। তবে বোর্ডের অনুরোধে স্কুলগুলো ভূমিকা রাখেনি। অথচ জেলা শিক্ষা অফিসের এক বড় কর্তার বাইপাস সার্জারির জন্য স্কুলগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই তহবিলে সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা চাঁদা দিয়েছেন। চিকিৎসা খরচ মেটানোর পরও সেই তহবিলে টাকা রয়ে গেছে। যাহোক, সাথীর বিষয়টি যে শিক্ষা বোর্ডও অবহিত আছে, সেটা যাদের কাছে সাহায্য চাইবে তাদের জানোনোর জন্যই অলক সেই ডকুমেন্টের ফটোকপিটা চেয়ে নিল।
ঢাকায় ফিরে অলক সাথীর কাগজপত্র নিয়ে প্রথমে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইপু ভাইয়ের সাথে দেখা করল। সে সাথীকে সাহায্যের দরখাস্ত এবং সাপোর্টিং ডকুমেন্ট ইপু ভাইয়ের সামনে দিয়ে বিস্তারিত খুলে বলল। তখন তিনি তাকে অবাক করে দিয়ে একটা ঘটনা শোনালেন। ঘটনাটা এমন যে একদিন এক পঙ্গু লোক হুইলচেয়ারে করে সাহায্যের আবেদন নিয়ে এল। লোকটাকে সন্দেহ হওয়ায় পরখ করে দেখা গেল সে আসলে পঙ্গু নয়। তখন মার খাওয়ার ভয়ে লোকটা হুইলচেয়ার রেখে পালিয়েছে। এ গল্প শোনানোর পর অলকের মনে হলো ইপু ভাইয়ের কাছে সে অপরিচিত। মেয়েটির চিকিৎসার্থে কিছু করার সুযোগ ইপু ভাইয়ের না-ই থাকতে পারে। অথবা সেই মুহূর্তে তার প্রতিষ্ঠান কোনো সমস্যার কারণে সহযোগিতা করার অবস্থায় না-ও থাকতে পারে। সেসব না বলে সাহায্য চাওয়ার নামে একজনের প্রতারণার গল্প শোনানোর কী মানে আছে! অলক যারপরনাই মর্মাহত হলেও সাথীর ডকুমেন্ট, ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র এবং সাহায্যের দরখাস্ত ইপু ভাইয়ের টেবিলে রেখে এল।
এরপর সে আরেকটি বেসরকারি অফিসে গেল। এই অফিসের অনেককেই অলকের নিজের অফিসের লোকজনের মতো মনে হয়। এখানকার জনসংযোগপ্রধান দরখাস্ত দেখে বললেন, আপনি যখন এসেছেন, তখন দেখি কী করা যায়। আবার এটাও বললেন যে দুটো কিডনিই যার নষ্ট, তার তো বাঁচার সম্ভাবনা কম। এরপর অলক আরও পাঁচটা অফিসে অনেক দিনের পরিচিত লোকজনের কাছে সাহায্যের আবেদনপত্র দিয়ে আসে। সেসব প্রতিষ্ঠানের বোর্ডের লোকজনের সাথেও সে কথা বলে। প্রায় সব অফিসই আশ্বাস দেয়। কেউ গলা টেনে। কেউ কেউ এটাও বললেন যে মেয়েটির বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। এরপর অলক পাবলিক ফান্ড ম্যানেজ করে এমন একটি বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর কাছে গেল। বিস্তারিত শোনার পর তারও একই কথা, বাঁচার সম্ভাবনা কম। তিনি বললেন যে এই সময়ে মেয়েটির বেশি বেশি কোরআন শরিফ পড়া আর আল্লাহর নাম নেওয়া উচিত। অলক বেশ কিছুক্ষণ হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে ছিল নির্বাহীর দিকে। মানুষ অন্যের বেলায় এত নৈরাশ্যবাদী কী করে হয়!
‘ভাই, আল্লাহর নাম তো নেবেই। কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যু জানার পরও কি বাবা-মা মেয়েটির চিকিৎসার জন্য চেষ্টা করবে না?’ অলক বলল।
‘আমি হজে যাচ্ছি। আমাকে জাকাত দিতে হবে। আপনি কি জাকাতের টাকা নেবেন?’ নির্বাহী প্রধান অলককে জিজ্ঞেস করলেন।
কারও চিকিৎসার জন্য জাকাতের টাকা নেওয়া যায় কি না, সেটা একটু জেনে নিয়ে নির্বাহী প্রধানকে জানাবে বলে অলক মতিঝিলের রাস্তায় নামে। স্বচ্ছন্দে হাঁটার জায়গা নেই। রাস্তার দুপাশে অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল করে আছে বিভিন্ন মডেলের গাড়ি। সে মনে মনে একটা হিসাব কষে দেখে বিত্তবানের ছেলে-মেয়েদের এক দিনের ফাস্ট ফুড, আইসক্রিম এবং পানীয়র খরচের টাকা দিয়ে অনেক সাথীর জটিল রোগের চিকিৎসা সম্ভব। যে পরিমাণ টাকা প্রতি বছর বিদেশে পাচার হয়, তা দিয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কিনে অনেকগুলো আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের অনেক নামিদামি ডাক্তারদের এনে বিনা মূল্যে সাধারণ মানুষের জটিল রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তবে এসব কেবলই অলকের ক্ষুব্ধ মনের ভাবনা। যাদের সাথে সে দেখা তাদের সাথে তার পরিচিতি অনেক দিনের। এটাও ঠিক যে মানুষকে চেনার তো শেষ নেই। তাই একজন তার প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া না দেওয়ার মানে এই নয় যে তিনি খারাপ। এমন ভাবনাতেই অলকের অভিমান ঘুচে যায়।
অলক সাথীর জন্য সাহায্য চাইতে যেসব প্রতিষ্ঠানে গেছে, তাদের অনেকেই সিএসআর বা করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতে খরচ করে। এই তহবিল দ্বারা নিশ্চয়ই অনেকে উপকৃত হয়। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানই কেমন যেন সম্ভাবনার সাথে থাকতে চায়। বছর শেষে যাতে তারা একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করে লোকজনকে জানাতে পারে যে তাদের সহযোগিতায় কতজন উপকৃত হয়েছে। সে কারণেই কি তারা সম্ভাবনাহীন সাথীর ক্ষেত্রে গলা টেনে ‘কিন্তু’ ‘হয়ত’ কথাগুলো বলেছেন! পরক্ষণেই অলক ভাবে, তার ভাবনা সঠিক না-ও হতে পারে।
অলকের মধ্যে আবার অভিমান হানা দিল। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে আর কারও কাছে সাহায্য চাইতে যাবে না। ঝিনুককে জানিয়ে দেবে যে যাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছিল, তারা এখন একটু সমস্যায় আছেন। কিন্তু পরক্ষণেই অলকের চোখে ভেসে উঠল সাথীর শীর্ণকায় চেহারা আর এক গোছা নেতানো চুল। সাথীর বাবা দুটো পত্রিকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিয়ে সাহায্যের আবেদন করেছেন। প্রায় প্রতিদিনই এক বুক আশা নিয়ে তিনি ব্যাংকে যান। আর ফিরে আসেন মলিন মুখে। কিন্তু তিনি আশা ছাড়েন না। তিনি ব্যাংকে যাওয়া অব্যাহত রেখেছেন। পারলে শুক্র এবং শনিবারও যেতেন যদি ব্যাংক খোলা থাকত। হয়তো কোনো দিন অসহায় ভাবনার ঘোরে বন্ধের দিন ব্যাংকে গেছেন। অলক অভিমান ভুলে আবার সেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে গিয়ে মানবিক তাগাদা দিতে লাগল। পরিচিতদের মধ্যে দু-একজন যখন সন্দেহের চাহনিতে তাকাল, তখন তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম হলো। যারা গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তির জীবন বাঁচাতে চক্ষুলজ্জা উপেক্ষা করে মানুষের কাছে মানবিক সাহায্য চায়, তাদের প্রতি অলকের শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। সে বুঝতে পারল কাজটা কত কঠিন।
অলক ব্যতিক্রম দুজনকে পেল। যাদের একজন ঘটনা শোনামাত্রই পনেরো হাজার টাকা আর আরেকজন পাঁচ হাজার টাকা বের করে দিলেন। আপাতত দাতার সংখ্যাটা উৎসাহব্যঞ্জক। জনসংযোগ কর্মকর্তা ইপু ভাইয়ের মাধ্যমে কিছু পাওয়া গেল না। আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুটো আবেদন মঞ্জুর করলেন। একটি নাচ-গানের অনুষ্ঠানের জন্য পঞ্চাশ হাজার আর সাথীর চিকিৎসার জন্য পনেরো হাজার। যিনি হজে যাচ্ছেন তিনি জাকাত বাবদ দিলেন সাত হাজার টাকা। এভাবে শেষ পর্যন্ত সাতচল্লিশ হাজার টাকা জোগাড় হলো। সেই টাকাটা নেওয়ার জন্য সাথীর বোনকে আজ ডাকা হয়েছিল। মেয়েটি অস্বস্তি আর সৌজন্যবোধের ভারসাম্য রক্ষা করে বোনের চিকিৎসার জন্য টাকাটা নিতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
কিন্তু এত অল্প টাকা দিয়ে কী হবে? অলক কোনো আশার আলো দেখতে পায় না। আবার এটাও ভাবে যে সৃষ্টিকর্তা চাইলে কারও না কারও মাধ্যমে আরও অর্থের সংস্থান হতেও পারে। কিংবা সাথীর বাবা ব্যাংকে গিয়ে জানতে পারলেন, কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি সাথীর চিকিৎসার্থে প্রয়োজনীয় অঙ্কের টাকাই পাঠিয়েছেন। পরদিন অলক ঢাকায় চলে এল। এক মাস পর ভোরবেলায় একটা মোবাইল কলে অলকের ঘুম ভাঙে। সে বিছানা হাতড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে, ঝিনুক কল দিয়েছে। এত সকালে ঝিনুকের কল দেখে অজানা আশঙ্কায় সে হকচকিয়ে উঠে বসে।
‘সাথী নেই।’ ঝিনুক ধরা গলায় বলল।
অলক চুপ করে রইল। আর ঝিনুক বলেই যাচ্ছে।
‘... ...খুব খারাপ লাগছে। সাথী আশা করেছিল সে সেরে উঠবে। কিন্তু হলো না। আবার এটাও মনে হচ্ছে যে ও মুক্তি পেয়েছে। যেমনটা পেয়েছে ওর মা-বাবা।’
কথাগুলো ঝিনুক একনাগাড়ে বলে গেল। আর অলক চুপ করে শুনল।
‘তুমি আমার কথা শুনছ? হ্যা...লো।’
‘শুনছি।’ অলক নীরবতা ভেঙে বলল।