বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প কোন পথে?
বাংলাদেশের জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা মূলত ষাটের দশক থেকেই ধীরে ধীরে সাবলীল হয়ে উঠতে শুরু করে এবং নিজস্বতা পেতে থাকে। যদিও ঢাকায় প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহের সময়। এই দীর্ঘ যাত্রায় তৎকালীন পূর্ব বাংলা-পশ্চিম বাংলার মতো সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনায় তেমন কোনো সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। ১৯৫২ তে ভাষা আন্দোলনের মতো একটা গণজাগরণের পরও নয়। সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে আমরা ঢাকার চেয়ে কলকাতাকে এত বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছি যে দেশ স্বাধীন হবার পরও সেই কলোনাইজ মনোগঠন এখনো আমাদের মনকুঠুরি থেকে মুছে যায়নি। ফলে হীনম্মন্যতার দেয়ালের এপারে বসে কলকাতার নাম শুনলেই এখনো আমরা অতিমাত্রায় ভক্তি নিয়ে তাকাই। যদিও বহুদিন থেকেই কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করছে এবং কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি কলকাতায় ‘বাংলাদেশ বইমেলা’র আয়োজন করে যাচ্ছে এবং যথেষ্ট সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এই মেলা আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয়, মণিপুরেও বিস্তৃতি লাভ করবে বলে ধারণা করা যায়। ইতিমধ্যে কলকাতা শহরে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের বইয়ের দোকানও খুলেছে। যদি দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে চলে, তবে বাংলাদেশের প্রকাশনা আন্তর্জাতিক বাজারে ঢোকার প্রথম ধাপ পার হলো, এই কথাটা তখন দৃঢ়ভাবে বলা যাবে।
আমাদের অনুবাদ সাহিত্য খুবই দুর্বল। ভালো মানসম্মত অনুবাদের অভাবে আমাদের শিল্প-সাহিত্য, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আমাদের মননকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরা যাচ্ছে না। আবার অভ্যন্তরীণ বাজারও তেমন বড় হচ্ছে না উপযুক্ত পাঠকশ্রেণির অভাবে। ষোলো কোটি মানুষের দেশে একটি ভালো মানের বইয়ের বিক্রি ষোলো শ কপিও হয় না। সমাজে যদি পাঠকশ্রেণি তৈরি করা না যায়, প্রকাশনার মান কখনোই উন্নত হবে না। বাজারে বইয়ের চাহিদা তৈরি হলে প্রকাশনায়ও বড় আকারের পুঁজি খাটবে। প্রতিযোগিতা বাড়বে, নতুন নতুন লেখক আসবেন তাঁদের মেধা ও শ্রম নিয়ে। কারণ, লেখক তখন তাঁর সময়, শ্রম ও মেধার উপযুক্ত মূল্য পাবেন। বিচিত্র বিষয়ে নানা রকম পাণ্ডুলিপির আয়োজন হবে। একটা আরেকটার পরিপূরক হয়ে উঠবে।
প্রিন্টিং মিডিয়া পুরোপুরি ডিজিটালাইজড হওয়ার সুবাদে প্রকাশনায় অবাধ গতি এসেছে সত্য, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো পরিকল্পনা নেই, বাছবিচার নেই, কাটাছেঁড়া নেই, দেখভাল নেই। টেক্সট যেমনই হোক উন্নত প্রোডাকশনে বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে কত-না লেখকের অসংখ্য ভুলে ভরা অজস্র মানহীন বই। এমন অবস্থার সুবিধা নিয়ে শখের বশে দু’কলম লিখে এখন অনেকেই লেখক, বিভিন্ন লেখা এক জায়গায় করে যে কেউই সম্পাদক এবং যার খুশি বনে যাচ্ছেন প্রকাশক। তা না হলে এক বইমেলাতেই চার থেকে পাঁচ হাজার বই প্রকাশ পাচ্ছে কীভাবে?
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চিত্তরঞ্জন সাহা ভারতে আশ্রয় নেওয়া লেখকদের লেখা নিয়ে ৩২টি বই প্রকাশ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছিলেন ‘মুক্তধারা’। যা ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় কোনো বাংলাদেশি প্রকাশকের প্রথম প্রকাশনা উদ্যোগ। একটা দেশের জন্মলগ্নে প্রকাশনাশিল্পের প্রথম অভিব্যক্তি। বিজয়ের ৫৪ দিন পর বাংলা একাডেমির অনুমতি নিয়ে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে তিনি একাই সেই বইগুলো চটের ওপর বিছিয়ে শুরু করে দেন বইমেলা। কাজটি করে চলেন ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। শুনেছি মেলার প্রাঙ্গণে একটা গরু বেঁধে রাখতেন। সেই গরুর গায়ে লেখা থাকত, আমি গরু, তাই পড়ি না। পাঠক না পাওয়াটা বোঝাবার জন্য এর চেয়ে চরম কথা আর কী হতে পারে?
সেই অন্ধকার সময়টা ক্রমান্বয়ে কেটেছে। প্রকাশকেরা পাঠকের চাহিদা অনুভব করে নতুন নতুন বই ছাপতে শুরু করেছেন। চট বিছানো সেই বইমেলা একসময় স্টলে বিন্যাসিত হয়ে বাংলা একাডেমির চত্বরকে করেছে আলোকিত—পর্যায়ক্রমে দেশের মানুষের পাঠাভ্যাস, মনন ও সৃজনশীলতার প্রতীক রূপে বইমেলা লেখক-পাঠক-প্রকাশকের সর্বজনীন উৎসবের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে; যা এখন বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত।
দেশভাগের অনেক আগে থেকে পূর্ববঙ্গে লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাই মূলত এই প্রকাশনা পেশায় এসেছিলেন সামাজিক দায়বোধে উদ্দীপ্ত হয়ে। ব্যবসায়িক দূরদৃষ্টি তাঁদের তেমন ছিল না। নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে এই শিল্পের মান-মর্যাদা এখনো ধরে রেখেছেন এই শ্রেণির মানুষেরাই। লেখক সৈয়দ শামসুল হক একবার একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমাদের প্রকাশকসমাজের ঋণ লেখকদের পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। এমনও সময় গেছে যখন আমাদের লেখা চলুক কি না চলুক, সেদিকে না তাকিয়ে একধরনের দায়বোধ থেকে তাঁরা আমাদের বই ছাপতেন নিজেদের পুঁজি খাটিয়ে। থরে থরে বই পড়ে আছে গুদামে, পোকায় কাটছে, কোনো পরোয়া নেই। আফসোস নেই। নতুন পাণ্ডুলিপির জন্য তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। সেই মানুষগুলোর অন্তরের জোরটা একবার ভেবে দেখেন।
জাতি গঠনের সেই উত্তাল সময়টা পার হয়ে এসেছি আমরা কিন্তু অনেক প্রকাশকের দায়বোধটা কিন্তু এখনো তেমনই রয়ে গেছে। এখনো আমাদের প্রকাশনাশিল্পে নতুন করে তেমন মনোভাবাপন্ন তরুণেরাই কিন্তু যুক্ত হচ্ছেন, ছোট আকারের অর্থ লগ্নি করছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নারী উদ্যোক্তাকেও দেখা যাচ্ছে। বছর শেষে হিসাব মিলুক কি না-ই মিলুক, কেমন এক স্বপ্নে এই পেশায় লেগে রয়েছেন তাঁরা। এ এক অদ্ভুত দায়বোধ। এ এক আজব আবেগ।
এ রকম মানুষের হাত ধরে আমাদের প্রকাশনাশিল্প আমূল বদলে যেতে শুরু করেছিল মূলত আশির দশক থেকেই—কম্পিউটারে কম্পোজ করে, ডেস্কটপ পাবলিশিংয়ের যাবতীয় সুবিধা নিয়ে অফসেট কাগজে অফসেট প্রেসে ছেপে রং-বেরঙের বাহারি প্রচ্ছদে, বাহারি অঙ্গসজ্জায় প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল অতুলনীয় সব বই। পরিবর্তিত সেই নতুন পরিস্থিতিতে নতুন করে জন্ম নিচ্ছিল কত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের। নবীন ও প্রবীণ উদ্যোক্তারা মিলে নব্য সেই প্রকাশনা জগতে বুঝিবা ঘটিয়ে দিয়েছিল একটা বিপ্লব! তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে কয়েকজন সৃজনশীল প্রকাশক মিলে নিবন্ধিত একটি সমিতি গঠন করেন। নাম দেন ‘বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি’। এই সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল—
১. সৃজনশীল প্রকাশনার বিকাশ সাধন এবং সৃজনশীল প্রকাশকদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রসার এবং প্রকাশনার পেশাদারিত্ব জোরদার করা।
২. সৃজনশীল প্রকাশনার অন্তরায়সমূহ চিহ্নিত করে তা অপসারণে সচেষ্ট হওয়া।
৩. দেশে পাঠ প্রবণতা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন এবং ইউনেসকো উল্লিখিত রিডিং সোসাইটি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হওয়া।
৪. কপিরাইট বিধি প্রচলনে সহায়তা করা।
নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ, কিন্তু বাস্তবে তা কতখানি কার্যকর হয়েছে বলা মুশকিল। দেশে ঠিকঠাক রিডিং সোসাইটি গড়ে উঠলে এসব কাজ আপনা-আপনি বাস্তবে রূপ পেত। সকলে নিজ স্বার্থে প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রকাশনায় সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ত। পুঁজি নিয়ে টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টায় খাবি খেতে হতো না।
অন্ধকারে পথ চলতে চলতে সদ্য স্বাধীন একটা দেশে আশির দশকের শুরু থেকে যে স্বপ্ন দেখেছিল প্রকাশকসমাজ, বর্তমানে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। এ আমাদের দুর্ভাগ্য যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য রিডিং সোসাইটি গড়ে তোলা নিয়ে বইয়ের কারিগরদেরই সবচেয়ে বড় ভাবনাটা ভাবতে হচ্ছে এখন। কিন্তু কেন? রিডিং সোসাইটি গড়ে তোলার কাজ কি একমাত্র প্রকাশকসমাজের? আমার তো তা মনে হয় না। বরং রিডিং সোসাইটি গড়ে উঠলে তার চাহিদা পুরণে, তার প্রবল তৃষ্ণা নিবারণে, তার সার্বিক সেবায় যত রকমের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, সেগুলো নেবে প্রকাশকসমাজ। পাঠকের রুচি অনুযায়ী মানসম্মত বিচিত্র রকমের নতুন নতুন বই প্রকাশ করে তাদের সামনে হাজির করবে। একঘেয়ে উপস্থাপনা দেখতে দেখতে বইয়ের প্রতি পাঠক যাতে আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে, তা মাথায় রেখে প্রকাশনাকে ঢেলে সাজাবে। নতুন নতুন লেখক খুঁজে নিয়ে পাণ্ডুলিপি পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও নিপুণ সম্পাদনা-কৌশল প্রয়োগ করে নির্ভুল প্রকাশনায় নিত্যনতুন রুচির জন্ম দেবে।
ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে একই সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে অনুবাদকর্মের কাজও। আরব্য রজনীর গল্প, রুশ দেশের রূপকথাসহ বিশ্বসাহিত্যের সেরা কাজ অনুবাদ হয়ে যেভাবে আসছে আমাদের দেশে, ঠিক সেভাবেই আমাদের ময়মনসিংহ গীতিকার গল্প, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, ঠাকুরমার ঝুলির গল্প, দস্যু কেনারামের কেচ্ছা, আবহমান বাংলার ঘুম পাড়ানির ছড়াসহ বাংলা ভাষার বাছাই করা বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার অনূদিত হয়ে যাবে অন্য দেশে। কারণ, আমাদের সাহিত্যও বিশ্বের যেকোনো ভাষার সাহিত্যের সমমর্যাদায় দাঁড়াতে সক্ষম। এই কাজে সক্ষমতা অর্জিত হলে আমাদের প্রকাশনাশিল্প তখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে আন্তর্জাতিক বাজারে। আর তেমন সেবাই তো দেশ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
এটা আমরা যেন ভুলে না যাই যে, পাঠকসমাজ গড়ে তোলার প্রধান কারিগর প্রকাশক নন, পরিবার। এর পরই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে পাঠের সংস্কৃতি তো উবে গেছে সেই কবে! পাঠের সংস্কৃতি জাগ্রত না হলে দেশে সুনাগরিক যেমন তৈরি হয় না, তেমনি প্রকাশনাও সেই মানে পৌঁছায় না। একটি দেশের প্রকাশনা দেখলেই সেই দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির চেহারা অনুমিত হয় তখনই, যখন সমাজে প্রকৃত পাঠকশ্রেণি বিকশিত হয়। সেই দায় কিন্তু আমাদের সবার।
সারা বিশ্বে বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে প্রায় ৩০ কোটি। এর মধ্যে বাংলাদেশেই রয়েছে ১৬ কোটির মতো মানুষ, যার মধ্যে পাঁচ কোটির বেশি শিক্ষার্থী। এই বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় বর্তমান প্রকাশনাশিল্পের আয়তন খুবই ছোট। বাংলাভাষীদের এই বিরাট বাজারে নিষ্ঠা-প্রজ্ঞা-পুঁজির সংস্থান নিয়ে সুশিক্ষিত, সৎ, সাহসী, দায়িত্ববান, প্রতিযোগী মানসিকতাসম্পন্ন সংস্কৃতিমান উদ্যোক্তারা যদি সৃজনশীল বই, অনুবাদ, মননশীল বই, গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশনায় এগিয়ে আসেন এবং রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে যদি যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, লেখক-সাহিত্যিক ও সর্বস্তরের পাঠকদের সার্বিক সহযোগিতায় নতুনভাবে এই প্রকাশনাশিল্পকে গড়ে তোলা সম্ভব
সে যা-ই হোক, এরই মধ্যে আমরা একটা নতুন শতাব্দীতে ঢুকে পড়েছি—যোগাযোগ প্রযুক্তির চোখধাঁধানো বিস্ময়কর এক নয়া জমানায়। ডিভাইসের শাসনে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে আমূল বদলে যেতে শুরু করেছে সব। আমাদের আবেগ-অনুভূতিতে, আমাদের চিন্তা-চেতনায়, রুচিতে, সময় কাটানোয়, পাঠাভ্যাসে, আমাদের জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, কিসে যে নয়—একটা তুলকালাম ঘটনা ঘটে চলেছে নিয়ত। অসম্ভব অস্থির হয়ে উঠেছে প্রতিটি জীবন। একটা আস্ত বই পড়ার জন্য যেটুকু নিবিড়তা, মনের যেটুকু সুস্থিরতা লাগে, তা কেড়ে নিচ্ছে অবোধ চাঞ্চল্য। পৃথিবীজুড়েই কি পাঠের অভ্যাস ক্ষয়ে যাচ্ছে মানুষের? বইয়ের দোকান কমে যাচ্ছে। সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়, কাগজের বই আর ওলটাবে না মানুষ—এমন একটা ধারণার কথাও উঠছে। জীবনের এই অনিবার্য দ্রুত ধাবমানতার মধ্যে পড়ে প্রকাশনাশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে খাবি খাচ্ছে এই মাধ্যমের মানুষ। যতই দিন যাচ্ছে, সময়ের এই চেহারাটা বুঝি আর পড়ে উঠতে পারছে না কেউ। নাকি এ-ও এক বিভ্রম! এখনো সময় হয়নি সময়টাকে চিনবার।
প্রিন্টিং মিডিয়া পুরোপুরি ডিজিটালাইজড হওয়ার সুবাদে প্রকাশনায় অবাধ গতি এসেছে সত্য, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো পরিকল্পনা নেই, বাছবিচার নেই, কাটাছেঁড়া নেই, দেখভাল নেই। টেক্সট যেমনই হোক উন্নত প্রোডাকশনে বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে কত-না লেখকের অসংখ্য ভুলে ভরা অজস্র মানহীন বই। এমন অবস্থার সুবিধা নিয়ে শখের বশে দু’কলম লিখে এখন অনেকেই লেখক, বিভিন্ন লেখা এক জায়গায় করে যে কেউই সম্পাদক এবং যার খুশি বনে যাচ্ছেন প্রকাশক। তা না হলে এক বইমেলাতেই চার থেকে পাঁচ হাজার বই প্রকাশ পাচ্ছে কীভাবে? পাঠকের হিসাব আমার জানা নেই, কিন্তু ক্রেতা নিশ্চয়ই আছে, না হলে এই বইগুলো যাচ্ছেই-বা কোথায়?
ব্যক্তিগত দক্ষতা ও যোগ্যতার গুণে কিছুটা পরিস্থিতির সুযোগে এই পেশায় এখন আর্থিক সাফল্যের মুখ দেখছেন অনেকেই। তাঁদের অধিকাংশের দৃষ্টি শিক্ষা ভবন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণগ্রন্থাগার, এনজিও ও অন্যান্য সরকারি, বেসরকারি, সামরিক প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় ও প্রকল্পে। এসব জায়গায় বই নয়, বই নামের গাদা গাদা প্রডাক্ট সাপ্লাই চলছে নিয়মিত। অরাজকতার ফাঁক গলে লাভবান হচ্ছেন বিশেষ শ্রেণির গুটিকয় লেখক ও প্রকাশক।
বাংলাদেশের প্রকাশনা খাতকে শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করার দাবি নিয়ে প্রকাশকদের পক্ষ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণয়নের প্রস্তাব নব্বই দশকের শুরুতেই সরকারের কাছে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। রাষ্ট্র কর্তৃক এই খাতকে পূর্ণাঙ্গ শিল্পের মর্যাদা না দেওয়ায় এই খাতে বড় পুঁজি বিনিয়োগের কোনো সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি। জাতীয় গণগ্রন্থাগার, গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলা একাডেমি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দায়সারা গোছের কিছু ক্রিয়াকর্মের মধ্যে তাদের বার্ষিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে কেবল। ফলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠানের যে ভূমিকা থাকা দরকার, তা প্রায় হাস্যকর পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
সারা বিশ্বে বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে প্রায় ৩০ কোটি। এর মধ্যে বাংলাদেশেই রয়েছে ১৬ কোটির মতো মানুষ, যার মধ্যে পাঁচ কোটির বেশি শিক্ষার্থী। এই বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় বর্তমান প্রকাশনাশিল্পের আয়তন খুবই ছোট। বাংলাভাষীদের এই বিরাট বাজারে নিষ্ঠা-প্রজ্ঞা-পুঁজির সংস্থান নিয়ে সুশিক্ষিত, সৎ, সাহসী, দায়িত্ববান, প্রতিযোগী মানসিকতাসম্পন্ন সংস্কৃতিমান উদ্যোক্তারা যদি সৃজনশীল বই, অনুবাদ, মননশীল বই, গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশনায় এগিয়ে আসেন এবং রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে যদি যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, লেখক-সাহিত্যিক ও সর্বস্তরের পাঠকদের সার্বিক সহযোগিতায় নতুনভাবে এই প্রকাশনাশিল্পকে গড়ে তোলা সম্ভব। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ খোলা হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী দিনে ওই বিভাগ থেকেও কিছু সুযোগ্য পেশাজীবী এই পেশায় যুক্ত হবেন। বাংলাদেশের প্রকাশনা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ববাজারে প্রবেশের একটা বড় সম্ভাবনার দ্বার খুঁজে পাবে তখন।
বিদ্যালয়ে পর্যায়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, বই পড়া ,লাইব্রেরি আন্দোলন ইত্যাদি দিয়ে শুরু করতে হবে। দেওয়াল পত্রিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বিভিন্ন স্থানে বই বিনিময় প্রচলন পাঠকদের ভালো অবদান রাখবে।
হুজ্জাতুল ইসলাম
জুলাই ২৬, ২০২২ ১৯:২০