অনুর পাঠশালা, দেজা ভু ও অন্যান্য
স্তবমুখর একটি মন্তব্য উদীয়মান ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হকের ললাটে উজ্জ্বল তিলক চিহ্নিত করে দিয়েছিল, যদিও তিনি ওই সমালোচনা বা মন্তব্যে চমৎকৃত হননি, বিহ্বল হননি আনন্দ-আবেগে। বরং প্রতিনিয়তই তিনি এড়িয়ে চলতেন ওই সমস্ত অভিমত ও উত্তুঙ্গ আলোচনার মোহন তরঙ্গোচ্ছ্বাস। মন্তব্যটি তাঁর আদি উপন্যাস অনুর পাঠশালা সম্পর্কে, দেশ পত্রিকায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। সনাতন পাঠক ছদ্মনামে তিনি লিখেছিলেন, ‘...বইটি পড়তে শুরু করলেই বোঝা যায়, ইনি একজন সত্যিকারের শক্তিশালী লেখক। বাংলা গদ্যের ওপর প্রভুত্ব করার ক্ষমতা এঁর আছে।’
তত্রাচ, এই উচ্ছ্বাস এড়িয়ে আমাদের আলোড়িত ও উদ্দীপ্ত করে—একদিন ও একরাত্রির নিভৃতি ও অবিরাম শব্দসংক্রামে গ্রন্থিযুক্ত উপন্যাসটি—এই তথ্য। ফিওদর দস্তইয়েভস্কি নিজের দীর্ঘায়ুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় থেকে তাঁর কোনো রচনার জন্য কালক্ষেপণ অথবা পুনর্লিখন করতে চাননি; দ্রুতলিখন এবং ওই রচনাসমূহকে নিতান্তই খসড়া বিবেচনায় তাচ্ছিল্য করাই যেন ছিল তাঁর সৃজনক্ষম প্রজ্ঞার বৈশিষ্ট্য। যদিও ওই খসড়া রচনাসমূহই ব্যক্তিমানুষের দুষ্পাঠ্য, দুর্জ্ঞেয় মনোজগতের বিচিত্র অভিজ্ঞান উন্মোচনের জটিল ও অভিনব শিল্পে দ্যোতিত। মাহমুদুল হকের অনুর পাঠশালা তো বটেই, প্রায় প্রতিটি রচনার ক্ষেত্রে এই দ্রুতলেখ এবং প্রকাশের ব্যাপারে সীমাহীন জাড্যতা ও অনীহা লক্ষণীয়।
দুই
ফিওদর দস্তইয়েভস্কির সঙ্গে মাহমুদুল হকের মনোজগতের এইসব সতীর্থগামিতা সন্ধান উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু রুশ, জার্মান, ইংরেজি এবং অন্যান্য বিদেশি সাহিত্য, বিশেষত ফরাসি সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি আগ্রহ, অন্তত অনুর পাঠশালা রচনার ক্ষেত্রে ওই পাঠ-অভিজ্ঞতা তাঁর শিল্পমনস্তত্ত্ব নির্মাণে যে প্রভাবক রূপে ক্রিয়াশীল ছিল, সেটি বিবেচনায় রাখা জরুরি। এমনকি কৈশোরকালে রহস্য উপন্যাসের গোলকধাঁধা পেরিয়ে তিনি পথের পাঁচালী ও দেবদাস পড়ে ভয়াবহভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন; আমৃত্যু তাঁকে উদ্দীপ্ত করে চলেছিল পথের পাঁচালীর আশ্চর্য অভিজ্ঞান। অন্যদিকে অনুর পাঠশালা উপন্যাসে মাহমুদুল হক চেয়েছিলেন মানবসম্বন্ধসমূহের অন্তর্ভুত রহস্য বিস্তার করতে। যদিও কৈশোরে পড়া রহস্য উপন্যাসের সঙ্গে অনুর পাঠশালায় রূপায়িত রহস্যের কোনোই সম্পর্ক নেই। এই আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায় নিরাকরণের নেপথ্যে ফরাসি নব্য-উপন্যাস রচনারীতি ও তত্ত্ব তাঁর মনস্তাত্ত্বিক আধেয় রূপায়ণে সহায়ক ও স্বপ্নচারী। ফরাসি সাহিত্যে আঁরি বারবুসে ত্রিশের দশকে নব্য উপন্যাসের নন্দনরূপে নতুনতর নিরীক্ষায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি ১৯৩৫ সালে মৃত্যুর পূর্বে মানুষের অন্তর্গত মানবীয় সম্পর্কের অমীমাংসিত পরিপ্রেক্ষিত উন্মোচনে বুনন করেছিলেন দুঃসাহসী ছক। এই বৃত্তপরিসরে আবর্তিত ও সৃষ্টিময় ছিলেন লুই আরাগঁ, র্যালফ্ ফক্স, আঁদ্রে মালরো, জাঁ রিচার্ড ব্লক, এমিল জোলা প্রমুখ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে শিল্পচেতনার নতুন উত্থান সম্ভাবিত হয়েছিল নাতালি সারোৎ, মার্গারিৎ দুরাস—এঁদের রুপালি কলমে।
Contemporary French Literature গ্রন্থে হেনরি পিয়ের নব্য-উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন—সেখানে কাহিনি নয়, প্রধান হয়ে উঠেছে ভাষার সূক্ষ্ম কারুকাজ, বাক্য বিন্যাসের অপ্রথাগত নিরালম্ব রীতি। মাহমুদুল হক অনুর পাঠশালা উপন্যাসটিকে সম্পূর্ণার্থে কাহিনিরিক্ত করেননি বটে, এখানে তা নিতান্তই গৌণ। কাহিনি যা বিদ্যমান, তা-ও ঘনসন্নিবদ্ধ নয়; তিনি গল্পাংশ পূর্ণ করে তুলেছেন ভাষার সূক্ষ্মতায়। তা ছাড়া এই উপন্যাসের আখ্যান পরিকল্পনায় লক্ষণীয় ফরাসি ‘দেজা ভু’ তত্ত্বের চিহ্নে মানবপৃথিবীর বর্ণ, ধ্বনি ও আয়তনিক প্রতীকার্থ।
‘দেজা ভু’ [Deja vu] ফরাসি এই শব্দসমষ্টির অর্থ ‘পূর্বেই দেখা’। অর্থাৎ কোনো ঘটনা সংঘটনের পর রহস্যময়ভাবে এই বোধ সঞ্চারিত হয়—ঘটমান পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা যেন পূর্বঘটিত। যেমন, অচেনা কোনো প্রাচীন ভবনে প্রথম প্রবেশের পর অকস্মাৎ মনে হতে পারে ইতঃপূর্বে তিনি এখানে এসেছিলেন। অনেকের অভিমত ‘দেজা ভু’ পূর্বজীবনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতার সমষ্টি।
ফরাসি মনোরোগ গবেষক Emile Boirac [১৮৫১-১৯১৭] Lavenir des sciences psychiques [ইংরেজি ভাষান্তর The Future of Psychic Sciences] গ্রন্থে দেজা ভু তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করেন। যদিও সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং সমকালীন অপরাপর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বিষয়টিকে অপ্রাকৃত, উদ্ভট, রহস্যময়, অনৈসর্গিক, অস্বাভাবিক বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু Emile Boirac— এর অভিমত, স্বপ্নাচ্ছন্নতার মধ্যে বারংবার স্মৃতিতাড়নাই দেজা ভু’র উৎস। এই সময় বিশ শতকের সূচনাকালে Deja vu সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন মনস্তত্ত্ববিদ এবং স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞগণ। তাঁরা মনে করেন, দেজা ভু কোনো পূর্বলব্ধ জ্ঞান বা পূর্ব ধারণা [জন্মপূর্ব-জ্ঞান বিবেচনার্থে] হিসেবে বিজ্ঞান-সমর্থিত নয়, কিন্তু এটি ব্যক্তির অস্বাভাবিক একটি স্মৃতিস্তর, এমন অনুভূতিময় প্রতিক্রিয়া বা অভিজ্ঞান, যা মূলত আকস্মিক এবং পূর্ব-অভিজ্ঞতালব্ধ সময়ের পুনর্নির্মাণ। স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পুনর্নির্মাণও অনেকাংশে অনিশ্চিত, উদ্বেগাকুল; এমনকি সেটি কোনো সুনির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত বা পরিস্থিতিতে ঘটমান নয়, বরং অন্তর্চৈতন্যে স্মৃতিতরঙ্গে ‘দেজা ভু’ অভিজ্ঞতার সঞ্চারণ।
অনুর পাঠশালার কাহিনি সূচনার পূর্বাংশে সন্নিবেশিত বিনয় মজুমদারের কবিতার পাঁচটি পঙ্ক্তি। পঙ্ক্তিগুচ্ছের পুনর্পাঠ নেওয়া যাক:
স্বপ্নের আধার, তুমি ভেবে দ্যাখো, অধিকৃত দুজন যমজ
যদিও হুবহু এক, তবু বহুকাল ধরে সান্নিধ্যে থাকায়
তাদের পৃথকভাবে চেনা যায়, মানুষেরা চেনায় সক্ষম।
এই আবিষ্কারবোধ পৃথিবীতে আছে বলে আজ এ-সময়ে
তোমার নিকটে আসি, সমাদর নেই তবু সবিস্ময়ে আসি।
কবিতাংশটির দু-একটি শব্দ কি দেজা ভু’র চকিত উদ্ভাস? ‘স্বপ্ন’ এবং ‘চেনা’ শব্দ দুটি প্রাথমিকভাবে পরাচৈতন্যের সংগুপ্ত স্মৃতি, কল্পনা ও উপলব্ধির স্রোতে সূচিত করে আকস্মিক তরঙ্গ। ‘দুজন যমজ যদিও হুবহু এক’—এক সেট প্রোটোপ্লাজম এবং ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড [ডিএনএ] সমন্বিত মানুষের যুগল সত্তা প্রকৃতপক্ষে অভিন্ন প্রতিরূপ। এই প্রতিরূপ কি পূর্বলব্ধ দৃশ্য বা জ্ঞানের রূপকার্থ? যুগল সত্তার অস্তিত্ব পেরিয়ে কবি পৌঁছে যান সামষ্টিক সত্তায়—‘মানুষেরা চেনায় সক্ষম’—শব্দগুচ্ছে। নির্বস্তুক, অজ্ঞাত, অনির্ণেয় ‘স্বপ্নের আধার’ তো মস্তিষ্কই, সেখানে সঞ্চিত হয় স্মৃতি-কল্পনা-বিস্ময়-অভিজ্ঞানের সামূহিক ইতিবৃত্ত। কবিতাটির তিন পঙ্ক্তির প্রথম বাক্যের মধ্যবর্তী তিনটি খণ্ড বাক্য বিলুপ্ত করলে কী অভিজ্ঞতা সৃজিত হয়—‘স্বপ্নের আধার, মানুষেরা চেনায় সক্ষম।’ ‘চেনা’ ক্রিয়াপদটি জানিয়ে দেয় ‘পূর্বলব্ধ জ্ঞানে’র ধারণা। তাহলে স্বপ্ন-তরঙ্গের স্মৃতিতাড়নার রহস্য আবিষ্কারই বিস্ময়—এই বিস্ময় ও আকস্মিক উদ্ভাস অনুর পাঠশালার প্রবেশাংশ রূপে গ্রহণ—কাহিনির আন্তর্তরঙ্গে রহস্য সূচনার অভিপ্রায়ে কবিতাটি মাহমুদুল হকের সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার সূত্রমুখ।
হয়তো, আক্ষরিক অর্থে অনুর পাঠশালার গৌণ কাহিনিটিকে দেজা ভু তত্ত্বের ছকবন্দি করে ফেলা যাবে না। কিন্তু উপন্যাস্ত কাহিনির পর্ব ও পর্বান্তরে পুরোনো কালের ভবনে যে নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা উন্মুখ হয়ে রয়েছে; সেখানে একদিকে আখ্যান নির্মাণের প্রেক্ষাপট, অনুর ক্রমরূপান্তরশীল মনস্তত্ত্ব, অন্যদিকে উপন্যাসটির আঙ্গিক-প্রকৌশল উল্লিখিত ফরাসি শব্দযৌগের প্রতি কৌতূহলী করে তোলে।
উপন্যাসের সূচনাতেই দৃশ্যময় হয়ে ওঠে অনু নামের এক কিশোর, যে বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রায়-নির্জন একটি বাড়িতে বাস করে। বাড়িটি নিতান্ত নির্জনই নয়, প্রাচীনও। এমনকি সেখানে অনুর নিজের পায়ের শব্দও তাকে অনেক সময় ভীত করে তোলে। তার মনে হয়—‘মস্ত এক বাড়ির খোলের ভেতর আমি,...অনুর এক একবার খুব আচ্ছন্নভাবে মনে হয়, বেদম জ্বরের ঘোরে গ্লাস উপুড় ক’রে তৃষ্ণা মেটানোর পর যেমন ভেতরটা হাঁসফাঁস করে, এও তেমন। সব মিলিয়ে আঠারো কি উনিশটা ঘর, পুরোনো আমলের দোতলা, খড়খড়ির বড় জানালা, মোটা মোটা কড়ি-বরগা, উঁচু ছাদ। এমন উঁচু ছাদ যে মনে হয় ওর ওপর আর আকাশ নেই।’
বাবার সঙ্গে অনু এবং তার মায়ের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। মা চায় অনুকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যেতে, দূরে কোথাও। এ জন্য তপ্ত হাওয়ায় ছাদে যখন গলানো লোহা কেউ হড়হড় করে ঢেলে রাখে এমন গ্রীষ্মের দুপুরে মা শিক্ষকের কাছে ইংরেজি শেখে, কোনার ঘরে বসে। তখন স্থানটি অনুর জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। এ সময় তার বাইরে ঘোরা বারণ, ছাদে যাওয়া বারণ, ‘তার অনেক কিছুই ইচ্ছাধীন নয়’, রাশি রাশি কমিকের বই ফালতু মনে হয়, ছবি আঁকতে ভালো লাগে না, মাকে তখন কাছে পাবার অদম্য আকাঙ্ক্ষা—ফলে ভয়াবহ একাকিত্ব অনুর অন্তর্সত্তাকে নিদারুণভাবে কাতর করে তোলে। এই রকম নিঃসঙ্গতার মধ্যে অনুর পাঠ্যসূচি এবং আগ্রহের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে—‘আফ্রিকার জঙ্গলে’, ‘অভিশপ্ত মমি’, ‘মিশমীদের কবচ’, ‘ছিন্নমস্তার মন্দির’ খুবই প্রিয় বই ছিল এই কিছুদিন আগেও। এখন ভালো লাগে ‘আম আঁটির ভেঁপু’। বালিশ ভিজে যায়।...রোড্সদ্বীপের পিতলের মূর্তির কথা পড়তে ভালো লাগে, জানতে ইচ্ছে করে আলেকজান্দ্রিয়ার নিঃশব্দ আলোকস্তম্ভের কথা, কুফুর পিরামিড কিংবা স্ফিংস-এর বৃত্তান্ত।’
প্রাচীন একটি বাড়িতে পূর্বপুরুষদের বিবিধ স্মৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে বসবাস এবং এই পাঠ্যসূচি-অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থের জগতে ডুবে থাকা অথবা মায়ের কাছে শোনা পুরোনো আমলের গল্প হয়তো অনুর ক্রমরূপান্তরশীল মনস্তত্ত্ব নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল। একা একা বাগানে ঘোরার সময় অনুর আশ্চর্য অনুভূতি—‘সব বাগানেই মনে হয় কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি গোপন করা আছে। ভরে আছে কমলালেবু, পাকা আলুবোখারা আর স্কোয়াশ ফলের গন্ধে।’ ছায়াচ্ছন্ন বাগানে একাকী অনুর এই উপলব্ধির উৎস কোথায়?
তা ছাড়া উপন্যাসের সাত পরিচ্ছেদ পর্যন্ত নিস্তব্ধতা, নির্জনতাকে করে তোলা হয়েছে ঠাসবুনট। যা দু-একটা কথা স্ফুট হয়ে উঠেছে, তা-ও নিতান্তই নীরবতায় পূর্ণ, যেন শব্দ হলেই কোনো প্রাচীন পুরীর সুপ্তিমগ্ন রাক্ষসরাজ জেগে উঠবে। পাখির ডাকও ‘গনগনে উনুনে পোড়া রুটির মতো চিমসে গন্ধে ভরিয়ে রাখে’; ওলবড়ি গাছ ঝিমিয়ে পড়ে, কাক ঝলসে যায়, নির্জন দুপুরে মালী আর মালীবৌ নিঃসাড় পড়ে থাকে, ছাদের ওপর নিস্তব্ধ গোল আকাশ, ভাঙা মন্দিরের অনুজ্জ্বল চূড়া, কৃষ্ণমূর্তি দানবের মতো পানির ট্যাঙ্ক; মড়ার মাথার মতো নিস্তব্ধ দুপুর; গোলকুণ্ডার হীরা রাখবার চন্দনের পুরোনো কৌটো, ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা শিকারি রৌদ্র—এই স্তূপীকৃত নৈঃশব্দ্যের মধ্যে অনুর স্বপ্ন ও কল্পনার পরাচৈতন্যে উন্মোচিত হতে থাকে এক-একটি স্মৃতিতরঙ্গ:
বাইরে ধু-ধু রৌদ্রের মাঝখানে গোল গোল চারকোণা নরম বাগান।
সেইসব গোল চারকোণা নরম বাগানে ছোটবড় অনেক গাছ। ফিকে সবুজ, ঘন সবুজ, নীলচে সবুজ, ধূসর সবুজ সেইসব গাছ অসংখ্য হাত বাড়িয়ে ধরে রেখেছে আকাশ সমুদ্র আর সুবিস্তীর্ণ স্তেপস কিংবা কিরঘিজ প্রান্তরের ছবি, সে রোমাঞ্চিত হয়। সেইসব গাছের পায়ের কাছে পোষ-মানা আদুরে হাতির মতো কান নাড়ছে অঢেল ছায়া। সবুজ উষ্ণীয় জড়ানো সেইসব সাঙ্কেতিক গাছের অসংখ্য বাহুতে বসে নাম-না-জানা সুনীল পাখিরা দিনরাত আকুল সুরে গেয়ে চলেছে।
এইসব বিস্তীর্ণ দুপুরের মাঝখানে, ধু-ধু রৌদ্রের মাঝখানে, গোল চারকোণা বাগানের চেয়ে, গাছের পাতায় চেয়ে, সমুদ্রের চেয়ে, পাখির গানের চেয়ে, সুন্দর আর ঠাণ্ডা একটি মেঝে পরম নিভৃতে কোথাও আরামে চোখ বুজে অচৈতন্যপ্রায় পড়ে আছে জলেশ্বর মালীর মতো। অনুর মনে হলো, জলেশ্বর মালী কতো সুখী!
স্মৃতিতরঙ্গিত এই আকাঙ্ক্ষাই কেবল নয়, দুপুরে ‘ছিন্নমস্তার মন্দির’ পড়তে ভালো না লাগলে বই বন্ধ করে অনু নিদ্রা যায় মেঝের ফরাশে। স্বপ্নে দেখে ‘বাড়ির পেছনে সারগাদায় মার মৃতদেহ...এয়ারগান দিয়ে বহুদিন আগে সে যেসব চড়ুইপাখি মেরেছিল, তার পাশে মৃতদেহটা মুখ থুবড়ে পড়ে, নিঃসাড়।’ পরক্ষণেই স্বপ্নে রূপান্তর ঘটে। সে দেখে:
হঠাৎ ছাদের ওপর থেকে তাতানো লোহার মতো লাল পা নিয়ে নীলচক্ষু আব্বা ক্রূর উল্লাসে লাফিয়ে পড়লেন, হারেরেরেরেরেরেরে—তাঁর হাতে ইয়া এক শাবল!
প্রচণ্ড জোরে অমানুষিক হুঙ্কার ছেড়ে তিনি অনুর মাথায় শাবল বসিয়ে দিলেন। সে চিৎকার করে উঠল—যখন ঘুম ভাঙল, দেখল রক্তাক্ত ফরাশে তার মৃতদেহ পড়ে আছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদেও এই স্বপ্নতাড়না এবং চতুর্থ পরিচ্ছেদে না ঘুমানোর আকাঙ্ক্ষায় অনু জানালায় দাঁড়ালে দেখে বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যাকারী লামার মামার লাশ কবরস্থানে নেওয়ার দৃশ্য। মনে পড়ে কদিন পূর্বে পুকুরে ডুবে লামার মৃত্যুর স্মৃতি। ক্রমাগত স্বপ্নতরঙ্গের মধ্যে স্মৃতিতাড়নাজাত ব্যক্তিমনস্তত্ত্বের এই স্তরকে দেজা ভু-তে বলা হয়েছে The 'previous' experience is most frequently attributed to a dream.
পঞ্চম পরিচ্ছেদে দৃশ্যপট পরিবর্তিত হতে থাকে। অনু দশ মাথাওয়ালা রাবণের মতো বারণ বারণ আর বারণের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে বাইরের পৃথিবীতে। প্রাচীন বাড়ির আঠারো-উনিশটা ঘরের নিস্তব্ধ চৌহদ্দি পেরিয়ে, আইন ব্যবসায় ব্যস্ত ‘অনেক দূরের মানুষ’ জ্বলতে থাকা পুরু কাচের চশমা পরা বাবার কাছ থেকে মাকে নিয়ে অনু পালাতে চেয়েছিল স্বপ্নের জগতে। তার এই পলায়ন অথবা ‘নিজেকে অবাক করে নিরুদ্দেশ’ হওয়া আমাদের ক্ষীণ হলেও স্মরণ করিয়ে দেয় ফরাসি দার্শনিক বের্গসঁ এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাসের অপু চরিত্রটিকে।
বের্গসঁ [Bergson] তাঁর Creative Evolution [ইংরেজি অনুবাদ] গ্রন্থে বলেছেন, মানুষ ক্রমবিকাশের প্রাণাবেগ ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন সৃষ্টির উৎসে পদবিক্ষেপ করে চলেছে। মানুষের এই অবিরাম অগ্রযাত্রার ভাবনা বের্গসঁর চিন্তার অন্যতম প্রতিপাদ্য। তিনি বলেছেন, জীবন প্রকৃতপক্ষে অতীতের বর্তমান অবস্থায় নতুন রূপে অগ্রগমন মাত্র [Persistence of the past into the present]।
বের্গসঁর Bergson ভাবনার সাদৃশ্যে ওই নতুন সৃষ্টির উৎসে পদবিক্ষেপ অনেকটাই যেন ব্রিং খেলায় তুখোড় বস্তিবাসী টোকানি, গেনদু, লাটু, ফালানি, মিয়াচাঁনদের জগতে অনুর অনুপ্রবেশ। এখানেই অনু সন্ধান পায় বাস্তব পৃথিবীর কঠিন রূঢ় নির্মম নিষ্ঠুর জীবনের। খেলার একপর্যায়ে অত্যন্ত আকস্মিকভাবে পরিচয় ঘটে বয়সে তার চেয়ে ছোট সরুদাসীর সঙ্গে। তার স্বপ্ন, কল্পনা ও জ্ঞানের জগতে সূচিত হয় নতুন আলোড়ন ও স্পন্দন।
তিন
আম আঁটির ভেঁপু পড়ে অনু অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। ব্যক্তি মাহমুদুল হকও কৈশোরে স্কুল পালিয়ে কলোনির ফাঁকা ছাদে বসে দেব সাহিত্য কুটিরের বই, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, প্রহেলিকা সিরিজ; কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজ; শশধর দত্তের মোহন সিরিজ—এসব ডিটেকটিভ বই পড়তেন। অষ্টম শ্রেণিতে পথের পাঁচালী কিশোর সংস্করণ পড়বার পর ডিটেকটিভ বই সব পানশে মনে হয়েছিল। পথের পাঁচালীর অপুকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পৃথিবীর শাশ্বত স্বরূপের সঙ্গে, ক্রমবিকাশশীল ইতিহাস চেতনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে তুলেছেন। ক্রমবিকাশশীল এই ইতিহাসের তরঙ্গে সমস্তই ভেসে যায় পরিবর্তমান কালের নিঃশব্দ রথযাত্রায়। বিভূতিভূষণের কাছে চিরপরিবর্তমান এই সময়চেতনার প্রতীক চলিষ্ণু ইছামতী:
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন—মূর্খ বালক, পথ তো তোমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়! তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্য্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডি এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে...
জন্মান্তরবাদ ও জীবাত্মা-পরমাত্মার ঔপনিষদীয় চৈতন্যসঞ্চারী দার্শনিক অভিব্যক্তি পথের পাঁচালীতে বিভূতিভূষণের সচেতন ও সজাগ আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ। মাহমুদুল হক উপনিষদের জন্মান্তরবাদের চিন্তাস্রোতে অনুর নির্মাণকে পরিস্রুত করেননি। কিন্তু বন্ধনমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় পথের আনন্দে নতুন জীবনের চাঞ্চল্যে অপু এবং অনুর উদ্দীপ্ত চৈতন্য সমার্থক:
বাড়ি থেকে পালানো কতো আনন্দের, অনু বারবার রোমাঞ্চিত হয়েছে। বনে-পাহাড়ে, পদ্মার নির্জন কোনো কলাগাছ ঘেরা চরে, জেলেদের ছোট্টো কোনো গ্রামে—যার চারপাশে কেবল থৈথৈ পানি—পালালে এইসব জায়গাতেই যাবে। তা না হলে এমন কোথাও যেখানে সকলে চিৎকার করে কথা বলে, ঘাসের বিছানায় ঘুমায়, যেখানে আঠারো কিংবা উনিশটা রাক্ষুসে হাঁ-র মতো ঘর নেই, বিশাল উঁচু ছাদ নেই, যেখানে বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম, হু হু হু হু বাতাস বয়ে যায়। মা যদি চিৎকার করে বলে ‘অ-নু-বে-শি-দূ-র-যে-ও-না-আ-আ-আ’ তাহলে সে চিৎকার শাঁ-শাঁ আকাশের দিকে ছুটে যাবে, ধরবে বিদ্যুৎ, তারপর সেই বিদ্যুৎ চাবুকের মতো হাতে নিয়ে সপাং সপাং মারবে আর পোষ-মানা লোমশ সিংহের মতো বনরাজিঘেরা গ্রাম কেশর নেড়ে নেড়ে খেলা দেখাবে, থেকে থেকে উঠবে গর্জন—
এমনকি যখন অনুর জাগর আকাঙ্ক্ষা ও উন্মুখ চৈতন্যের সামনে সমস্ত জগৎ বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে, বাবা-মায়ের মনোমালিন্য, পলায়নের উদ্দেশে মায়ের ইংরেজি শেখা বন্ধ, তখন জ্বরতপ্ত শরীরে নিদ্রার ঘোরে অনু পাগলের মতো ‘পৃথিবীময় একজন বুড়ো আইনস্টাইনকে খুঁজে’ বেড়ায়। পথের পাঁচালীর অপু যেমন সমুদ্রগামী জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে গতির পুলকে শিউরে উঠেছে, মানসভ্রমণে সে যাত্রা করে টাহিটি, এল পাশো, ওয়াকিকি, সুনীল সমুদ্র, বলগা হরিণ, পাহাড়ি ছাগল, গম্ভীর নিনাদি জলপ্রপাত। কাজিনদের সঙ্গে তর্কে অনুর জগৎও উন্মোচিত— শ্যাডোজ-এর রেকর্ড, বিটল, প্লাটার্স, হিরোশিমা, এ্যাটম বোমা, আইনস্টাইন, আইজেনস্টাইন, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এবং এসবের বাইরে স্বপ্নাচ্ছন্নতার মধ্যে সে সন্ধান করে পৃথিবীর মাস্তুল। তার মনে হয়: ‘তাকে পালাতে হবে একাই, আর সেই জন্যেই কপাল খুঁড়ে, পৃথিবী খুঁড়ে, আলো নিংড়ে নিংড়ে যেমন করেই হোক সরুদাসীকে তার খুঁজে বের করা চাই-ই। সে মনে মনে আওড়াতে থাকে, তোমরা আমাকে আটকে রাখতে পারবে না, ছাদের নিচে আমি হাঁপিয়ে উঠি, এক এক আমি মরে যাই, তোমাদের অনু মরে যায়, এ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতর আমাকে ঠুকরে ঠুকরে খায় জ্যান্ত মাছেরা।’
এতসব সাদৃশ্যের পরেও রফিক কায়সার যথার্থই বলেছেন, পথের পাঁচালীর নিষ্পাপ জগৎ, অপু ও দুর্গার কাশফুল দেখা এবং বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য নিয়ে বাঙালির যে অনুভূতিমালা তারই বিরোধালঙ্কার [Antithesis] মাহমুদুল হকের অনুর পাঠশালা। অপু-দুর্গার বিপরীতে অনু-সরুকে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, বিভূতিভূষণের ধ্রুপদী গ্রন্থটির ভিন্নতর ভাষ্য অনুর পাঠশালা।’
পথের পাঁচালীর নিসর্গের স্নিগ্ধতা, সৌন্দর্য এবং দারিদ্র্যের উপস্থিতি ও ক্রমাগত মৃত্যুর রূঢ়তা অনুর পাঠশালায় অনুপস্থিত। মিয়াচাঁন, গেনদু, ফালানি, টোকানি অথবা সরুদাসীর জীবন ও জগৎ এখানে ক্লেদাক্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, কর্কশ। শৈশবেই এরা জীবনের গভীরতম জৈবিক চেতনার পাঠ নিয়ে নেয়। দারিদ্র্য তীক্ষ্ণ দন্ত-নখর উঁচিয়ে জীবনের পরতে পরতে খামচে উপড়ে ফেলে রক্তমাংস। পথের পাঁচালীর দারিদ্র্যের সঙ্গে এই দারিদ্র্যের দূরত্ব অনেক। এ জগৎ দূরের রেল লাইন চিনিয়ে দেবার রোম্যান্টিকতা থেকে মুক্ত। এখানে রেল লাইন ঘেঁষে আবর্জনার স্তূপে সারি সারি খুপরি ঘরে পুরো পরিবারের বসবাস। অনুর পরিপার্শ্বের নিসর্গও বড়ো রুক্ষ, অনুজ্জ্বল। লামাদের বাগানের বৃক্ষরাজি, প্রজাপতির ঝাঁক আর অকস্মাৎ পাখিদের উল্লাসের বাইরে চতুর্দিকে জরাজীর্ণ চিৎপাত দুপুর; বুড়ো বটগাছের শাখায় আটকে থাকা রঙিন লেজওয়ালা ব্যাঙাচির মতো ঘুড়ি, চিলের চিৎকারে বিদীর্ণ নিস্তব্ধ গোল আকাশ, হঁ-হাঁ নির্জন দুপুর, বরফকলের ঢেউটিনের ছাউনি, রৌদ্রদগ্ধ চিলের পিপাসার্ত চিৎকার, অভিশপ্ত ঘুঘুর ডাক, ঘরের ভেতর শয়তানের ঠাণ্ডা লাল চোখ, ফরাশে চৌচির হয়ে পড়ে থাকা নিজের মৃতদেহ, পাথরের ভাঙা যিশুখৃষ্টের কৃষ্ণমূর্তির গায়ে সাদা টিকটিকি ইত্যাদি। এই নিসর্গ কিছুটা নিতান্তই বাস্তব, অনেকটা ব্যক্তির মনোজগতের জটিল উল্লম্ফন ও পরাচৈতন্যের নির্মাণ।
অনু ব্যতীত সমবয়সী অপরাপর চরিত্রাবলি—গেনদু, ফালানি, টোকানি, মিয়াচাঁন, সর্বোপরি সরুদাসী এই নিসর্গের মতোই রুক্ষ, রূঢ়। সব চাইতে জীবন্ত সরুদাসী। নিজেই সে আশ্চর্য রূপময় এক জগৎ। সে জগৎও পারিপার্শ্বিক উত্তুঙ্গ জৈবিক চেতনার ভেতর পরিস্ফুট হয়ে ওঠা এক সরল শতদল :
‘...আচ্ছা মাগ-ভাতার খেলা জানিস তো?’
‘না!’
‘তোকে সব শিখিয়ে দেবো। বাবুদের বাগানে কাঁটামুদি আর ভাঁটঝোপের ভেতর আমার খেলাঘর পাতা আছে, সেখানে তোতে আমাতেমাগ-ভাতার খেলা খেলবো। আমি মিছিমিছি চান সেরে ন্যাংটো হয়ে কাপড় বদলাবো, তুই চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকবি। দেখলে কিন্তু ভালো হবে না বলে রাখলুম। তারপর কাপড় পরে আমি তোকে বুকড়ি চালের মোটাভাত, কাঁকরোল-ভুষো চিংড়ি, মাগুরের ঝোল কিংবা জলপাই কুচিয়ে দেওয়া গাংদাড় মাছের চচ্চড়ি দিয়ে পেটপুরে খেতে সাধবো। তুই মিথ্যে মিথ্যে রাগ করবি। বলবি, মেয়েটা কেঁদে কেঁদে সারা হলো সেদিকে খেয়াল আছে নচ্ছার মাগীর, মাই দিতে পারিস না, এইসব। ... খেয়ে-দেয়ে দুজনে পাশাপাশি শোবো। তুই রাগ করে চলে যাবি। তারপর মিছিমিছি তাড়ি খেয়ে মাতলামি কত্তে কত্তে এসে আমাকে রানডি মাগী ছেনাল মাগী বলে যাচ্ছেতাই গাল পাড়বি। বেশ মজা হবে যাই বল, তাই না রে?’
অনু আমতা আমতা করে বললে, ‘আমি কিন্তু তোমাকে অতোসব বকাবকি করতে পারবো না!’
‘দূর বোকা! খিস্তি-বিখিস্তি না করলে, মেরে গতর চুরিয়ে না দিলে, তোর মাগী কি ঠিক থাকবে নাকি? ভাতারের কিল না খেলে মাগীরা যে নাঙ ধরে তা-ও জানিস না বুঝি?...’
কিন্তু ‘পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণেই উপন্যাসের চরিত্রসমূহ আপাতদৃষ্টে বয়ঃসন্ধিকালের জটিলতায় আক্রান্ত বলে প্রতীয়মান হলেও এদের অন্তর্লোক নির্মল এবং নিষ্পাপ।’ [রফিক কায়সার]। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পথের পাঁচালীতে বন্ধনমুক্ত চিরচঞ্চল ও ক্রমরূপান্তরশীল চলিষ্ণু জীবনার্থের প্রতীক এবং প্রতিবিম্ব রূপে সৃষ্টি করেছেন অপু চরিত্রটি। দুর্গা, সর্বজয়া, অপর্ণা, লীলার মৃত্যু অপুকে করে তোলে বন্ধনবিনাশী। অপরদিকে কিশোর অনু মধ্যবিত্তের ঠুনকো আভিজাত্যের সংস্কার ছেড়ে ব্যক্তিসম্পর্কের অন্তর্জটিলজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এসে উপনীত হতে চেয়েছে মুক্তির উদার দিগন্তে। সরুদাসী সেই দিকচক্রবালহীন দিগন্তের নক্ষত্র। কিন্তু মুক্তি মেলেনি। অনেক বারণ, অনেক ভ্রুকুটি এড়িয়ে অনু ঋষিপাড়ায় আসে। কিন্তু সেখানে সরুদাসী রূপে যাকে আবিষ্কার করে, সে হাড্ডিচর্মসার, শনের নুড়ির মতো রুক্ষ চুল, দন্তহীন এক বৃদ্ধা। মুহূর্তে অনুর চারপাশ হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময়।
সরুদাসীকে হারিয়ে ফেলার ব্যাখ্যা কী? রহস্য কোথায়? তবে কি এই রহস্য উন্মোচনের জন্য প্লেটো বা সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের স্মরণ নিতে হবে? অথবা আর্থরাজনৈতিক উত্তাল তরঙ্গে মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গের এ এক শিল্পিত প্রকাশ? অথবা বিনয় মজুমদারের যে কবিতার চৌকাঠ পেরিয়ে এই কাহিনির অন্দরমহলে প্রবেশ করতে হয়েছে, সরুদাসী কি ওই ‘স্বপ্নের আধার’? যে স্বপ্ন অনুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও পরাচৈতন্যে উন্মোচন করে রহস্যের ইন্দ্রজাল। নিদ্রা স্খলনের পর-পরই ওই অলীক স্বপ্ন ‘জারজ নিনাদে উন্নীত পাখোয়াজের উত্তরোত্তর দ্রুততর উত্তাল ফেনিল তরঙ্গমালা পিছন থেকে পরাক্রান্ত ঘাতকের মতো তেড়ে’ আসে, হারিয়ে যায়; চৈতন্য আলোড়িত করে জেগে থাকে কেবল তার রেশটুকু!
চার
অনুর পাঠশালার আঙ্গিক-গঠন অভিনব। এগারোটি পরিচ্ছেদে বিভাজিত ক্ষীণকায় এই আখ্যান। ষাটের দশকে ইংল্যান্ড-আমেরিকার কতিপয় কবি Sound Poetry, Found Poetry । Concrete Poetry শিরোনামের কাব্য-আন্দোলনের সূচনা করেন—বব কবিং; এডুইন মর্গান, পিট ব্রাউন, ক্রিস্টোফার মিডলটন, জর্জ ম্যাকবেথ, ব্রায়ান প্যাটেল প্রমুখ সংগীত এবং কবিতার অন্তর্বর্তী ব্যবধান ভেঙে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কংক্রিট কবিতায় বর্ণিত বস্তুর ইঙ্গিতময় চিত্রটি দৃশ্যময় হয়ে ওঠার কারুকাজ প্রাচীন কবিতা-আঙ্গিকেরই একটি সাম্প্রতিক উদ্ভাস। জর্জ হার্বাট অথবা মালার্মে এবং গিয়ম অ্যাপোলিনেয়রের প্রচুর কবিতায় বস্তুর আকৃতি মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে সৈয়দ শামসুল হকের ‘গেরিলা’ ও ‘বস্তুর আকার’ এবং ষাটের দশকের ‘না’ গোষ্ঠীর ছোট কাগজে প্রকাশিত কোনো কোনো কবিতায় দৃশ্যকে পরিস্ফুট করে তুলবার প্রয়াস লক্ষণীয়।
সম্ভবত আনাতোল ফঁসে [Anatole Frarce] থেইস [Thais] উপন্যাসে বালি ঘড়ি এবং পার্সি ল্যুবক [Percy Lubbock] রোমান পিকচার্স [Roman Pictures] উপন্যাসে অতিকায় শিকলের প্রতিকৃতির গ্রন্থ-রূপ দেন। এগুলো ছিল ঔপন্যাসিকের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে প্যাটার্নের যৌথ রসায়ন।
অনুর পাঠশালা উপন্যাসে অনুরূপ একটি আঙ্গিক পরিকল্পনার আভাস রয়েছে। এই প্রকৌশল বা বিন্যাসরীতি উপন্যাসটির প্রথম সাত পরিচ্ছেদে সীমাবদ্ধ। প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদকে পরস্পর কেন্দ্রবিন্দুতে উল্লম্বভাবে স্থাপন করলে একটি প্রাচীন মন্দিরের চূড়া দৃশ্যমান মনে হতে পারে। প্রথম পরিচ্ছেদটি এগারো পৃষ্ঠা—মন্দিরের মজবুত বেদী; দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ এক পৃষ্ঠার—বেদীর ওপরে স্থাপিত ভবন; এবং পরবর্তী পরিচ্ছেদে বাক্য সংখ্যা স্বল্প ও হ্রস্ব হতে হতে সপ্তম পরিচ্ছেদে ন’টি শব্দের একটি বাক্যের আঁচড় টানা—যেটি এক চূড়া বিশিষ্ট মন্দিরের ঊর্ধ্বাংশ। যেমন ঠাটারীবাজারের জয়কালী মন্দির; প্রাচীন ঢাকেশ্বরী শিবমন্দির, ১৮৯০ [মুনতাসীর মামুন]; অথবা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত অষ্টকোণ শিবমন্দির। [রমেশচন্দ্র মজুমদার]
‘সমীপেষু’ পত্রিকায় এবং যেখানে খঞ্জনা পাখী শিরোনামে গ্রন্থাকারে মুদ্রণের সময় অবশ্য, হয়তো পৃষ্ঠাসংখ্যা সংকুচিত করবার ভাবনা থেকে, পরিচ্ছেদসমূহ ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত। সাহিত্য প্রকাশ কর্তৃক দ্বিতীয় সংস্করণে [ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪] অনুর পাঠশালা শিরোনামে পরিচ্ছেদসমূহ স্বতন্ত্র পৃষ্ঠায় মুদ্রণের ফলে আঙ্গিক নির্মাণের টেকনিকটি স্পষ্ট।
অনুর পাঠশালার আঙ্গিক রূপায়ণের এই জ্যামিতিক অর্থাৎ কিউবিক রীতি, লেখকের অত্যন্ত সচেতন ও প্রজ্ঞাময় নির্মাণ। যে ‘ছিন্নমস্তার মন্দিরের পুরোহিত নীরবে ভ্রুকুটি করে চলেছে’ অনুকে; পরিচ্ছেদ-কল্পনা যেন ওই মন্দিরেরই সমার্থক। পরবর্তী চারটি পরিচ্ছেদ বিস্তীর্ণ আকাশ—কখনো মেঘময়, বজ্রবিদ্যুৎময়; কখনো বর্ষণসিক্ত, কখনো সুনীল দিগন্তের পানে উড়ে চলার আহ্বানসঞ্চারী। ঔপন্যাসিক হয়তো কাহিনির অনিবার্য গতির টানেই এরূপ অঙ্গ-সুষমা নির্মাণপ্রবাহে সৃষ্টিশীল, ব্যাখ্যাটি নিতান্তই আমাদের উচ্ছ্বাস হয়তো, কিন্তু একটি আঙ্গিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পাঠক হিসেবে আমাদের চৈতন্যকে লেখক যেভাবে প্ররোচিত এবং উদ্দীপ্ত করেছেন—এখানেই তাঁর সৃজনক্ষমপ্রজ্ঞার পরিচয়। দেজা ভু তত্ত্ব, এভাবে, অনুর ভাবনা ও আঙ্গিকের ছকে সুসমন্বিত কৃত্য-শিল্পক্রিয়া।
আঙ্গিক নির্মাণের এই অভিনবত্ব আরও রূপময় ও সৌন্দর্যখচিত হয়ে ওঠে এর ভাষা-প্রকৌশলে। প্রতিটি শব্দই এখানে সুপরিকল্পিত মনে হয়; প্রতিটি বাক্যই যেন অনিবার্য। এ সমস্ত বাক্যের অন্তর্বয়নেও ঔপন্যাসিকের আঙ্গিক নির্মাণের কলা-প্রকৌশল-ভাবনার অভীপ্সা মূর্ত ও চিত্ররূপময়। প্রথম সাত পরিচ্ছেদ পর্যন্ত, অত্যন্ত সচেতনভাবেই অনুদের প্রাচীন এবং প্রায় জনহীন বাড়ির নিস্তব্ধতাকে করে দেওয়া হয়েছে বিস্তৃত। শব্দের অনুকার রয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে তা নিস্তব্ধতাকে করে তুলেছে আরও প্রকট ও প্রবল। যেমন:
রঙ-বেরঙের বহু মার্বেল আছে বহুদিন আগেকার; কিন্তু সে ব্রিং খেলা জানে না। নিজের কাছেই সে বয়েস পার হয়ে গিয়েছে। বয়েমে সাজানো আছে মার্বেলগুলো। অদ্ভুতভাবে আলো ঠিকরে পড়ে কখনো কখনো। আর আছে এ্যাকোরিয়ামে আমাজান সোর্ডের চারপাশে ছড়ানো, সিলভার ডলার এ্যানজেল আর লিওপার্ড কোরিডোরাসের খেলার সামগ্রী।...
পাখির শিস ভালো লাগে—নিস্তব্ধ দুপুরে।
রৌদ্রের ঝনঝনে থালা ছুঁড়ে ফেলে নির্মল ছায়া বিধৌত পাখির রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে, মড়ার মাথার মতো নিস্তব্ধ দুপুরে।
ভাষা-প্রকৌশলের অপরাপর প্রসঙ্গ অন্যত্র বিস্তৃত করা যেতে পারে। এখানে কেবল এ তথ্যটুকুই, বিন্যাসিত অনুকার শব্দও অনেকাংশে চৈতন্যসৃজিত। চরিত্রের মনোজগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াময় অন্তর্লীন অনুভবে সংবেদী। ফলে নির্জন মস্ত বাড়িটার বুকের মধ্যে আটকে পড়ার নির্বাক নিস্তব্ধ বস্তুবিদ্ধ অনুভূতিই প্রধান হয়ে উঠেছে এইসব শব্দমালায়।
নোট
মাহমুদুল হকের সঙ্গে দীর্ঘদিনের আড্ডার এক পর্যায়ে, তিনি তখন বাস করতেন জিগাতলার নতুন বাজার সংলগ্ন একটি ভাড়া বাড়িতে, বলেছিলেন, অনুর পাঠশালা রচনার পরিপ্রেক্ষিত। ১৯৬৭ সালে, ২ এপ্রিল গোপনে বিয়ের কারণে বাড়ি ছেড়ে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন সস্ত্রীক, স্বামীবাগে। জুলাইয়ের অগ্নিহাওয়ার দিনে গভীর আচ্ছন্নতা ও সংবেদনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত মাহমুদুল হক স্ত্রী কাজলকে বলেছিলেন বাবার বাড়ি যেতে, বাড়িটার মধ্যে সারাদিন এক একা থাকতে চেয়েছিলেন—‘তার আগে তো একা থাকিইনি। ও আলুভাজি, ডিম ভাজি আর পরোটা তৈরি করে দিয়ে গেল। আমি বন্ধ জানলার পাশে বসে সারাদিন ধরে বইটা লিখলাম। সন্ধ্যায় ও ফিরে এল। তখনও লেখা চলছে, শেষ হয়নি তো। শেষ হল ভোর বেলা।’
অনুর পাঠশালা রচনার প্রায় তিন বছর পর শেখ আবদুর রহমানের সাহিত্যরুচির কথা ভেবে মাহমুদুল হক একদিন তাঁকে পাণ্ডুলিপিটি পড়তে দেন। শেখ আবদুর রহমান ছিলেন নিমগ্ন পাঠক, তাঁর সাহিত্যরুচিও ছিল উন্নত ও বিচিত্রগামী। ফলে আত্মীয়তার সম্পর্কের [বড়ো ভাইয়ের শ্যালক] বাইরে তাঁর সঙ্গে মাহমুদুল হকের গড়ে উঠেছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। এ রচনার ভাষা, কাহিনির বিন্যাস শেখ আবদুর রহমানকে এতটাই বিমুগ্ধ ও আচ্ছন্ন করে তোলে যে, তিনি বসে থাকেন দীর্ঘক্ষণ, হতবিহ্বল এবং অনাস্বাদিত রহস্যময় পুলকে। তিনি উপন্যাসটির প্রসঙ্গে আলাপ করেন শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে। অতঃপর দুজনে একদিন হানা দেন মাহমুদুল হকের মগবাজারের বাড়ি। তিনি তখন বাড়ি ছিলেন না। অতিথি দুজন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে অবশেষে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর সেটি ‘সমীপেষু’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, এপ্রিল, ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আলোড়িত হয়েছিলেন বিদগ্ধ পাঠকবৃন্দ।
অনুর পাঠশালা রচনার পর পাণ্ডুলিপিটি তিনি দীর্ঘদিন তুলে রেখেছিলেন অন্ধকার তোরঙ্গে। এ সম্পর্কে ছিলেন নীরব, ইচ্ছে ছিল কোনো এক অবকাশে উপন্যাসটির কাহিনি সংগঠন ও কলাপ্রকৌশল সম্পর্কে ভাববেন, প্রয়োজনে পরিবর্তনও করবেন। কিন্তু সীমাহীন জাড্য ও নিরাসক্তি পেয়ে বসে তাঁকে। অবশ্য ‘সমীপেষু’তে প্রকাশের পর বর্ণবীথি প্রকাশন থেকে গ্রন্থাকারে মুদ্রণের পূর্বে তিনি উপন্যাসটির কিঞ্চিৎ ভাষাগত পরিবর্তন করেন। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৩ সালে, বর্ণবীথি প্রকাশন, ঢাকা থেকে গ্রন্থাকারে মুদ্রণের সময় এটির নামকরণ হয় যেখানে খঞ্জনা পাখী। বর্ণবীথি প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী কাজী ফারুক ছিলেন পুরোনো বইয়ের ব্যবসায়ী, পুরানা পল্টনে তার বইয়ের দোকান ছিল। তিনি মাহমুদুল হককে বইটি প্রকাশের আগ্রহ ব্যক্ত করেন, অনিচ্ছা থাকলেও মাহমুদুল হক তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। অনুর পাঠশালার নতুন নামকরণটি কাজী ফারুকের, তার যুক্তি ছিল—পত্রিকায় প্রকাশের ফলে সকলে উপন্যাসটি সম্পর্কে জ্ঞাত, নতুন নামকরণ হলে ব্যবসায়িক সুবিধাপ্রাপ্তি সম্ভব। যেখানে খঞ্জনা পাখী শিরোনামটি পছন্দ না হলেও মাহমুদুল হক দ্বিমত করেননি। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় মুদ্রণে অনুর পাঠশালা নামেই প্রকাশ হয়।
সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যপঞ্জি
— অরুণ মিত্র, ফরাসী সাহিত্য প্রসঙ্গে, প্রমা প্রকাশনী, কলকাতা, জুলাই ২০০৯
— বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, অবসর, ঢাকা
— রফিক কায়সার: আলোছায়ার যুগলবন্দি, মাহমুদুল হক স্মরণে, মফিদুল হক, আবুল হাসনাত, আবু হেনা মোস্তফা এনাম [সম্পাদিত], সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ২০১০
— মুনতাসীর মামুন, ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, ঢাকা ২০০৪
— রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস [আধুনিক যুগ], তৃতীয় খণ্ড, কলকাতা, মাঘ ১৩৮১
—Emile Boirac, The Future of Psychic Sciences, https://elricholderfield.wordpress.com/2010/09/26/100th-post-deja-vu/
— Henri Bergson, Creative Evolution, http://www.goodreads.com/book/show/379659.Creative_Evolution
—Henry Pier, Contemporary French Literature, https://en.wikipedia.org/wiki/20th-century_French_literature
— https://en.wikipedia.org/wiki/D%C3%A9j%C3%A0_vu