স্মৃতির আলোয় কুড়িটি তারা
মানুষ সম্পর্ক পাতে আরেক মানুষে। এক মানুষ থেকে আরেক মানুষ—এভাবেই সস্পর্কের ডালপালা ছড়িয়ে জড়িয়ে তৈরি হয় মায়া, বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা ছাপিয়ে নাম নেয় নানা মাত্রার সম্পর্ক। আনিসুজ্জামান তাঁর দীর্ঘ পথচলায় নিজ মায়ায়, স্নেহে, ভালোবাসায় বন্ধুত্বে রচনা করেছেন অসংখ্য সম্পর্ক। সেসব সম্পর্ক ডালপালা ছড়িয়ে ফুলে ফুলে ডালি ভরে দিয়েছে স্মৃতির আখর। সময় দৌড়ে পালায় বখতিয়ারের ঘোড়ার মতো। পড়ে থাকে স্মৃতি, তার গায়ে ধুলো জমে না। আনিসুজ্জামানের স্মৃতির মানুষ বইটি নানান সময়ে কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমানো স্মৃতির দলিল। পথ চলতে চলতে অদৃশ্য সুতোর টানে ঝরে পড়া তারাদের কথা। এক লোক থেকে অন্য লোকে পাড়ি দেওয়া স্মৃতির মানুষগুলো তাঁর একান্ত আপন, বন্ধুজন। তাঁদের প্রস্থানে ক্ষরণ হয়েছে হৃদয়ে। সেই ক্ষরণ নিয়েও স্মরণ করেছিলেন স্বল্প কথায় বিভিন্ন সময়ে নানান পত্র-পত্রিকায়। তাঁদেরকে নিয়ে বলার দায়বদ্ধতাও যেন ছিল আনিসুজ্জামানের।
বিপুল কর্মময় জীবন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের। প্রতি মুহূর্তে গেঁথে নিয়েছেন সম্পর্ক। সেসব সম্পর্কের প্রতি তিনি ছিলেন উদার। বৃক্ষের মতো নিজেকে মেলেছেন সম্পূর্ণতায়, মুক্ত মনে। ঔদার্যের ফলেই একই ক্যানভাসে আঁকতে পেরেছেন ভিন্ন ভিন্ন মুখ।
স্মৃতির মানুষ বইটিতে আমরা যাঁদেরকে পাই তাঁরা হলেন: আবু জাফর শামসুদ্দীন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মহিউদ্দিন আহমেদ, মুনীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, আলতাফ মাহমুদ, মণি সিংহ, কামাল হোসেন, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, নিতুন কুন্ডু, হুমায়ূন আহমেদ, নুরুল কাদের খান, খান সারওয়ার মুরশিদ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, সরদার ফজলুল করিম, কাইয়ুম চৌধুরী, তপন রায়চৌধুরী, জাহাঙ্গীর তারেক, কামালুদ্দিন খান প্রমুখ। এই কুড়ি নক্ষত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একেকজন সুপরিচিত মুখ। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন দেশের জন্য তাঁদের কাজে-কর্মে।
তিনি যেন সম্পর্কের, স্মৃতির এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। এক একটি সময়, এক একটি মুখ নিয়ে এবং সম্পর্ককে উদারভাবে বলার, নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার এক অনন্য মানুষ। সহৃদয়তা তাঁর স্বভাবজাত। তিনি নিরপেক্ষ সত্যের উৎস। বাংলাদেশের সাহিত্য-রাজনীতি-সংস্কৃতির ইতিহাস ধারণ করে ছিলেন এই মানুষটি।
বিচিত্র-মত-পথের মানুষ সম্পর্কে লিখতে পেরেছেন উদারমনা বলেই। একই সঙ্গে সময়ের আখ্যানে তাঁদের কর্ম, ব্যক্তিগত ভাব-দর্শন, সামাজিক পটও বুনেছেন। আনিসুজ্জামানের পথচলায় অসংখ্য মানুষ এসেছেন নানান সম্পর্ক নিয়ে। তিনি যেসব সম্পর্কের প্রতি ছিলেন যত্নশীল, সব সম্পর্কেই তিনি ছিলেন খোলা আকাশের মতো। ফলে স্মৃতির মানুষদের সম্পর্কে বয়ানে তিনি ধী-স্থির, নিরপেক্ষ। সম্পর্কের মানুষদের কথা লিখতে গিয়ে নিজের আদর্শ, মূল্যবোধের পারস্পরিক দ্বিমতের কথাও বলেছেন অত্যন্ত বিনয়োচিত শব্দের ব্যবহারে।
যাঁরাই আনিসুজ্জামানের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরাই যেন জিরিয়েছেন তাঁর অন্তরে। চলে গিয়েও কাঁদিয়েছেন স্মৃতির অবকাশে। বন্ধু, ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, আত্মীয়—সবার সঙ্গেই শেষ অবধি একটি সূত্রেই গাঁথা হতো, তা হলো সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম।
বিচিত্র-মত-পথের মানুষ সম্পর্কে লিখতে পেরেছেন উদারমনা বলেই। একই সঙ্গে সময়ের আখ্যানে তাঁদের কর্ম, ব্যক্তিগত ভাব-দর্শন, সামাজিক পটও বুনেছেন। আনিসুজ্জামানের পথচলায় অসংখ্য মানুষ এসেছেন নানান সম্পর্ক নিয়ে। তিনি যেসব সম্পর্কের প্রতি ছিলেন যত্নশীল, সব সম্পর্কেই তিনি ছিলেন খোলা আকাশের মতো। ফলে স্মৃতির মানুষদের সম্পর্কে বয়ানে তিনি ধী-স্থির, নিরপেক্ষ। সম্পর্কের মানুষদের কথা লিখতে গিয়ে নিজের আদর্শ, মূল্যবোধের পারস্পরিক দ্বিমতের কথাও বলেছেন অত্যন্ত বিনয়োচিত শব্দের ব্যবহারে।
সেই কবেকার কথা ১৯৪৫ সালে কিশোর আনিসুজ্জামান কলকাতার বাসায় প্রথম দেখেছিলেন আবু জাফর শামসুদ্দীনকে। ডাকতেন চাচা বলে। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসার পর যখন সাহিত্য আসরে দেখা হতে থাকে, তখন অন্যান্য সবার মতো তিনি তাঁকে ভাই বলে ডাকতে শুরু করেন। আবু জাফর শামসুদ্দীন তখন প্রতিষ্ঠিত লেখক। একটি কিশোরের সঙ্গে গড়ে উঠছে বন্ধুত্ব, তথা ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই সম্পর্কের রসায়নই আমাদের পরিচয় করায় লেখক এবং ব্যক্তি আবু জাফর শামসুদ্দীন সম্পর্কে। আমরা জানতে পারি, লেখকের প্রথম প্রকাশিত লেখা মানব জীবনে রোমান্টিসিজম প্রবন্ধটির নাম। এক এক করে স্বল্প আলাপে জানা হয়ে যায় লেখকের অন্যান্য লেখা এবং লেখার ভাবনা, দর্শন, প্রেক্ষাপট এবং সেসব নিয়ে আনিসুজ্জামানের স্বল্পমাত্রার আলোচনাও।
আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৫৯ সালে। পরের বছর অনার্সের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই হয়ে উঠবেন বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, সেই সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের তথাকথিত সম্পর্কের বেড়াজাল ভেদ করে গড়ে উঠবে অনন্য বিরল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। একদিন পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে অন্যলোকে পাড়ি দেওয়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে লিখবেন, ‘ইলিয়াস সে বাঁধন কেটে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যেতে যে চেয়েছিল তা নয়। তাকে যেতে হলো। সূত্রের অন্য প্রান্ত আমার হাতে। আমি তা হাতে ধরে বসে থাকব। যত দিন না আমাকে চলে যেতে হয়।’
বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ১৯৭১ সালের সালে স্বাধীনতাসংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিচারপতি তিনি। ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনার সময় হাইকোর্টের গঠন সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান জানতে চেয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন দ্রুত সংবিধান রচনা করতে।
পাকিস্তানের অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতনের হাত থেকে বের হতে দীর্ঘ সংগ্রামের পর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলেও অভ্যন্তরীণ নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেতে হয়েছে দেশটিকে। সংঘটিত হয়েছে ক্যু-অভ্যুত্থান। দেশটিকে হারাতে হয়েছে সূর্য-সন্তানদের; রাজনৈতিক পালাবদলে, ক্ষমতা দখল, বিশ্বাসঘাতকতার মতো ঘটনায়। সপরিবারে নিহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতার হত্যা প্রত্যক্ষ করেছেন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রত্যক্ষদর্শী আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।
ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানের শোষণ এবং বাংলাদেশের অরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি চাইতেন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উত্থান, রাজনৈতিক নেতাদের কাজের সুযোগ। বিধি বাম। জিয়াউর রহমানের চাপে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল রাষ্ট্রপতি সায়েমের। জনগণের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দেওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। চোখে পড়ার মতো দেশ ও দশের স্বার্থে কাজের জন্য দক্ষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি আজও। আজও সেনা ছত্রচ্ছায়া থেকে বের হতে পারেনি দেশটির শাসকেরা। ‘অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেজ’ নামে স্মৃতিকথামূলক একটি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর বর্ণময় জীবনের ঘটনাবলি। দীর্ঘ সময়ের আবহাওয়ার গড় যেমন একটি দেশের জলবায়ু নির্ধারণ হওয়ার মতো একটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও এক দিনে গড়ে ওঠে না—এমন আক্ষেপ নিয়েই হয়তো দেশ গড়ার, গড়তে চাওয়ার ফেরিওলারা পাড়ি জমিয়েছেন অন্যলোকে।
আনিসুজ্জামানের এই বইটি যাঁদের নিয়ে লিখিত হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই তাঁর কোনো না কোনোভাবে যোগ ঘটেছিল, কিন্তু আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে নিয়ে লেখাটিতে এই দুই ব্যক্তির কোনো রূপ যোগাযোগ ঘটেছিল কি না জানা যায় না।
১৯৫০ সালে দেখা মুনীর চৌধুরী আনিসুজ্জামানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আরেকটি অনন্য সম্পর্ক। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বলয় ছেড়ে রাজনৈতিক সহকর্মী, নিবিড় বন্ধুত্ব। সেই শিক্ষকই চাকরিসূত্রে সহকর্মী হলে সাইকেলের সামনে বসিয়ে ছাত্রকে নিয়ে পৌঁছে দিতেন জায়গামতো। শুধু কি তাই! সদ্য ঘুম থেকে ওঠা আনিসুজ্জামানকে ভোরবেলায় তাঁর বাড়ি গিয়ে ডেকে তুলে খাবার টেবিলে মুনীর চৌধুরী নিজ হাতে রুটিতে মাখন লাগিয়ে দিতেন, চা ঢেলে দিতেন। জ্ঞান, প্রজ্ঞা সব সময় সুন্দর হয়, বিশাল হয়। তা দূরে না সরিয়ে কাছে টানে সমুদ্রের মতো। দুজন টেনেছিলেন দুজনকে। এসব সম্পর্কের বয়ান আজকের প্রজন্মের জন্য প্রেরণার হয়ে উঠতে পারে।
মুনীর চৌধুরী নামটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রাজনীতি, বাম-রাজনীতি। সেই মুনীর চৌধুরীকেও একসময় ছাড়তে হয়েছিল রাজনীতির উঠোন। সেই রাজনীতি, যার জন্য দফায় দফায় জেল খেটেছেন হাসিমুখে। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অঙ্গন গড়ে উঠল না, আদর্শচ্যুত হলো দলগুলো, তার পরিণতিতেই কি রাজনীতি ছাড়লেন একজন অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষ মুনীর চৌধুরী? রাজনীতি ছাড়লেও দেশপ্রেম তাঁর ছিল অগাধ, জানতেন পাকিস্তানি দোসররা। তাই জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিল হায়েনারা। কমেডি ভালোবাসতেন মুনীর চৌধুরী। বন্ধু, সহকর্মী মুনীর, আনিসুজ্জামানের সঘন স্মৃতি পাঠককে নিয়ে যায় অন্য এক আলোর দেশে, যেখানে জীবন কেবলই কমেডি শেষের স্মিত হাসির।
‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’, ‘যে ভোলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে, আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না’। সেই ছোটবেলায় কোনো এক দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, তিনি কোনো এক প্রশ্নোত্তরে বলেছেন ওপরের লাইন দুটো। ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলাম কোনো এক খেয়ালে। একে একে সকল প্রিয় মানুষের স্মৃতির কথা বলে, এত স্মৃতি ধরেছে যে বুক, সেই বুক খালি করে আলোটুকু ফেলে চলে গেছেন অন্য আলোকে। সততই তিনি ভালোবেসেছিলেন কঠিনেরে। এই দেশ তাঁকে বলতেই পারে, প্রিয় আনিসুজ্জামান, ‘যে ভোলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে, আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না’। ♦