গ্রামকে হারিয়ে ফেলার মর্মান্তিক যন্ত্রণা
বড় রিক্ততা বড় হারানোর ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না বইটি, বড় বেদনার সিম্ফনি বাজিয়ে। অথচ আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে যখন পড়েছিলাম, মনে আছে, রনবীর সুদৃশ্য ইলাস্ট্রেশন আর হুমায়ুন আজাদের নস্টালজিক বর্ণনার মায়াবিস্তারী হাতছানিতে, বারবারই হারিয়ে গিয়েছি রাংতামোড়ানো রঙিন শৈশবে; কী এক অপার্থিব ভালো-লাগার আনন্দে ভেসে বেড়িয়েছি নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি মন্থন করে, এই বাংলার শ্যামল সবুজ দিগঙ্গনায়।
হ্যাঁ, হুমায়ুন আজাদ আমাকে বড় বেশি শৈশবসাগরে ডুবিয়ে রেখেছিলেন। বাঙালি পাঠকমাত্রই রাখবেন এর পাঠে পাঠে, মন্ত্রমুগ্ধ আবেশে। যারা অন্তত এই বাংলার জলহাওয়ায় মানুষ হয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন, তারা ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না-র পাতায় পাতায় খুঁজে পাবেন নিজের শেকড়সত্তা। আমিও যেমন পেয়েছি, বড় তীব্রভাবেই; তার বোধ হয় অন্তর্নিহিত কারণও রয়েছে। আমি আর হুমায়ুন আজাদ—আমরা ছিলাম একই প্রকৃতিমাখা একই আকাশবাতাস জলকিনারার মানুষ। হ্যাঁ, আমার নানাবাড়িটা ছিল কেরানীগঞ্জের একেবারে শেষ প্রান্তে, যার মাইল দুই পেছনেই বয়ে চলেছে ধলেশ্বরী। আর সেই ধলেশ্বরী ছাপিয়ে আরও তিন-চার মাইল হাঁটলেই হুমায়ুন আজাদের শ্রীনগর, শ্রীনগর পেরিয়ে রাড়িখাল। বর্ষায় যখন পদ্মার পানি উপচিয়ে, দুপারের খালবিল ছাপিয়ে হো হো করে ঢুকে পড়ত বিক্রমপুর-মুন্সিগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ আর মানিকগঞ্জের বাঁকে বাঁকে প্রান্তে প্রান্তে, ডুবিয়ে রাখত এসব এলাকার পুরো নিম্নাঞ্চল, তখন হুমায়ুন আজাদের মতো আমারও দেখার সুযোগ হয়েছে নানাবাড়ির চিনির খালে—‘একটা খাল পুকুর থেকে বের হয়ে পুঁটিমাছের লাফ আর খলশের ঝাঁক নিয়ে চলে গেছে বিলের দিকে। তার ওপর একটা কাঠের সাঁকো—নড়োবড়ো। নিচে সাঁকোর টলোমলো ছায়া!’
হ্যাঁ, এমন ছায়ায় আমিও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে বসে থেকেছি। বসে বসে সাঁকোর নিচে এমন টলোমলো ছায়া দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না, তবে তন্ময় হয়ে থাকতাম লুরানির ভেশালের জালে, কখন পানি থেকে জালটা উঠবে আর কটা মাছ আলো-আকাশের দেখা পেয়ে শুরু করে দেবে লাফালাফি! জলের নিচে কি ওরা আকাশ দেখতে পেত? তখন যে ওদের জন্য এমন দুঃখবোধই আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত—ওরা আকাশ দেখতে পাচ্ছে না! ওরা যে মৃত্যুযন্ত্রণায় তড়পাচ্ছে, এ-কথা কখনো মনে আসেনি।
শুধু কি বর্ষা! যে সময় প্রবাহের প্রস্ফুটনের কথা জানিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ এবং পরিস্ফুটনের—তার ফুলের গন্ধে যে আমিও তেমনই আউলা হয়ে যাই। সারাক্ষণ ঝুমঝুম করে বাজে পানির নূপুর। নানাবাড়ির ঘাটবাঁধানো পুকুর ঘাটের সিঁড়িটা যে কোন্ গভীরে হারিয়েছিল, তা চিরকাল রহস্যই রয়ে গেল; ছোট খালা ভয় দেখিয়ে বলতেন, আর নামিস না! শিকলবুড়ির শিকল পা ধরে টেনে নিয়ে যাবে! সন্ধ্যার নিরিবিলি মাছের ঘাইয়ের কম্পমান ঢেউয়ের দোলা আজো মনের চরাচরকে ধুয়ে দেয়, দুলিয়েও! এখনো কচুরি ফুলের ঝাড়বাতি মনে জ্বালিয়ে চলেছে লাল নীল দীপাবলী! আহা! কী যে কবিত্বের ঝংকার প্রতিটি লাইনে, প্যারায় প্যারায়! ‘আজো লাউডগা তার শেকড় ছাড়িয়ে ভিটে পেরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় দিগন্তের দিকে—ঘাসের ওপর পড়ে থাকে এক দীর্ঘ সবুজ চঞ্চল সুদূরপিয়াসী স্বপ্ন।’
মনা আর বারেকের মতো দু-ভাই আমার নানাবাড়িতেও ক্ষণে-বিক্ষণে হাজির হতো। তাদের নাম ছিল টুয়া আর ভুইট্টা, পুকুরের গভীর তলদেশ থেকে হাতড়ে না হোক, তারাও মাছ ধরত নানাভাবে, কখনো বিলের পানিতে দাউন ফেলে, কখনো পার থেকে ঝাঁকিজালে; সারাক্ষণ প্রকৃতির সঙ্গে কাটাত সময়, এই যদি গরুর জন্য ঘাস কেটে আনছে তো ওই আবার ছুটে যাচ্ছে মুগুর হাতে ক্ষেতের ঢেলা ভাঙতে!
তবে আমার নানাবাড়িতে খেজুরগাছের আধিক্য তেমন ছিল না, আধিক্য কী, ছিলই না বলতে গেলে খেজুরগাছের কোনো অস্তিত্ব, একটা কি দুটা হঠাৎ চোখে পড়ত, তবে খেজুরগাছকে ঘিরে যেসব মনোমুগ্ধকর স্মৃতিগাথা রচনা করেছেন হুমায়ুন আজাদ, তা যেন আমারই মনের স্মৃতি-অ্যালবামের এক একটি স্ক্রিনশট। শীতের দিনে গাজীপুরের দাদাবাড়িতে সেই একই জায়গা ফরিদপুর থেকে ছুটে আসত গাছিরা। কী আশ্চর্য! গাছিদের ঘিরে আমরা কাচ্চাবাচ্চারাও ছড়া কেটে বেড়িয়েছি, যেমনটা হুমায়ুন আজাদরাও করেছেন, তবে আমাদের ছড়াটা অন্য রকম, খানিকটা শ্ল্যাংয়েও ভরপুর, ফরিদপুইরা গাছি ... ... ... নাচি!
আমাদের দাদাবাড়ির পাশের বাড়িতেই ছিল খেজুরবাগান। এক দু-বিঘা জমির ওপর শুধু সারিবাঁধা খেজুরগাছ, সেসব খেজুরগাছের গা ছেটে ছালের মধ্যে ছিদ্র করে পেতে রাখা হতো মাটির হাঁড়ি, সকালবেলা হাঁড়িগুলো সব পেড়ে এনে চৌকোনা স্টিলের বিশাল পাত্রে ঢেলে জ্বাল দিয়ে-দিয়ে তৈরি করা হতো চৌরস, তারপর সে-চৌরস দিয়ে বিশেষ কায়দায় বানানো হতো পাটালি গুড়! আহা! কাঁচা রস থেকে চৌরস হওয়ার মুহূর্তে কী এক সুঘ্রাণে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা হয়ে উঠত!
আমার দাদাবাড়ির সঙ্গে নানাবাড়ির ভূ-প্রাকৃতিক তেমন মিল ছিল না। নানাবাড়ি যদি ছিল ভৌরা অঞ্চল, দাদাবাড়ি ছিল টেঙ্গুইর। কিন্তু ভৌরা অঞ্চলের হুমায়ুন আজাদের কোনো কোনো বর্ণনা বা ঘটনাক্রমের সঙ্গে দাদাবাড়ির অনেক ব্যাপার-স্যাপারও হুবহু মিলে যেত। এই যেমন দশ বাইশ গ্রামের মানুষ মিলে পুকুর-বিলে নেমে একসঙ্গে মাছ মারা, গ্রাম্য মেলা বাঁশির সুর, বছরে একবার সার্কাস আসা।
হুমায়ুন আজাদ কবি, বড় কবি। কবিরা ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন একদিন গ্রাম মরে যাবে, একদিন বাংলার সব গ্রাম হারিয়ে যাবে। গ্রামের সেই পতনধ্বনি যেন তিনি শুনতে পেয়েছিলেন শৈশব উত্তীর্ণকালেই, রাড়িখালে। সড়ক দিয়ে আর হাঁটা যায় না। খাল গড়িয়ে পদ্মার পানি আসে না। মাছ আসে না। পলি আসে না। পাগলেরা মিলে বেঁধে দিয়েছে সব খালের মুখ
সত্যি, তখন বিল-পুকুর-নদীকে ঘিরে কত রকমের যে মাছ মারার মুহূর্ত কেটেছে। কত মানুষের জীবিকাই তো ছিল মাছ ধরা। আর অনেকের কাছে তা শৌখিনতা। তবে যেমন বাইশ গ্রামের মানুষ বিশাল জাগৈর দিয়ে পলো হাতে নেমে আসত কোপাকান্দির বিলে, তখন যেন কার্তিক শুরুর ক্ষণটা বিপুল উৎসবের বিশাল সমারোহে ভরপুর হয়ে উঠত। আশি বছরের বৃদ্ধ থেকে সাত আট বছরের কিশোর নেমে আসত মাছ মারতে, গায়ে গা ঠেকিয়ে তুরাগ নদী পর্যন্ত মাছ ধরার অভিযানে মাতত দিনমান। কেউ কেউ বিশাল সব আইড়, বোয়াল, চিতল নিয়ে কেউ কেউ বা নলা, গরমা নিয়ে ভরদুপুরবেলা ফিরে যেত বাড়ি।
‘কার্তিক পেরিয়ে অঘ্রান এলেই বাঁশি বেজে উঠতো মেলার। আমাদের গাঁয়ে নয়, উৎসবের গাঁ ভাগ্যকুলে।’ আর আমাদের মেলা হতো কড্ডাবাজার, সিদ্ধেশ্বরী। সে-ও বাড়ি থেকে অনেক দূর। আমার সে-মেলার বর্ণনাই যেন নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন হুমায়ুন আজাদ, সেই বাঁশের বাশি, সেই হাওয়াই মিঠাই, তবে সার্কাসটা কিন্তু এই মেলায় হতো না। সার্কাস হতো কাশিমপুরের মাঠে, বছরে একবার, আলাদা সময়ে। আর অনুমান করি, যে সার্কাস দল ভাগ্যকুলে সার্কাস দেখাতে যেত, তারাই ঘুরেফিরে চলে আসত কাশিমপুর জমিদার বাড়ির মাঠে। কেননা, বাংলাদেশে তো তেমন বেশি সার্কাস দলের অস্তিত্ব ছিল না। তা ছাড়া হুমায়ুন আজাদের বর্ণনার সঙ্গে আমার সার্কাস দেখার অভিজ্ঞতা এত মিলে যাচ্ছে যে, আমি নিঃসন্দেহ আমরা একই দলের সার্কাস দেখেছি, একই দলের জোকারের কর্মকাণ্ডে হেসে গড়িয়ে পড়তাম, প্রফেসরের ত্রিফলা নামের ভয়ানক খেলায় আমাদের উভয়েরই রক্তমাংস হিম হয়ে যেত। হুমায়ুন আজাদের ত্রিফলা খেলা দেখার অভিজ্ঞতা পড়ে সত্যি আশ্চর্যান্বিত হয়ে গিয়েছি যে, আমাদের অনুভূতি এতটা মিলে গেল কী করে!
তবে একজন মানুষের স্মৃতি-অভিজ্ঞতার সঙ্গে যে আরেকজন মানুষের স্মৃতি-অভিজ্ঞতার হুবহু মিল হবে এমন ভাবার কারণ নেই। প্রকৃতির লীলা যে কী অপরূপ আর বিশাল বৈচিত্র্যে ভরপুর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একই জিনিস বা একই দৃশ্য হয়তো দুজন দর্শকের মনে দু-রকম অভিজ্ঞতার সঞ্চার ঘটাতে পারে। বহুমিশ্র রসের ব্যঞ্জনা ছড়াতে পারে। আবার জন্মসময়-স্থানকালপাত্র ভেদে অভিজ্ঞতা আহরণও হতে পারে ভিন্নতর। যেমন হুমায়ুন আজাদ জন্মেছিলেন পদ্মার অতি নিকটে; পদ্মায় একবার তিনি ইলিশ মাছ ধরাও দেখতে গিয়েছিলেন। এ অভিজ্ঞতা যে শুধু তার স্মৃতির ভাণ্ডারকেই সমৃদ্ধ করেছে তা নয়, তার অধ্যাত্ম-মনন জগৎকেও ঐশ্বর্যময়তা দান করেছে। একজন মানুষ কোথা থেকে যে তার সৃজনীসত্তার পরম্পরা শক্তি খুঁজে পান, তিনি নিজেও তা উপলব্ধি করতে পারেন না!
হুমায়ুন আজাদের সৌভাগ্য, তাঁর গ্রামেই জন্মেছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। একজন শিশু বা একজন বালক যদি শৈশবেই জগদীশচন্দ্র বসুর মতো একজন বিজ্ঞানীর ছায়াসৌন্দর্য স্মৃতিমন্থনা লাভ করেন, তাঁর তো প্রকৃতিপ্রেমিকই হয়ে ওঠার কথা, সেই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী মন। সব ছাপিয়ে হুমায়ুন আজাদ পরবর্তীকালে প্রকৃতিপ্রেমিক কবি হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে—
ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।
ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাঁশি।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়াল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।
শুধু কি প্রকৃতিপ্রেমিক কবি? পরিণত বয়সে তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন বলিষ্ঠ যুক্তিবাদী এবং সাহসী চিন্তক মানুষে। তাঁর এই মহৎ সত্তার ছাপ লুকিয়েছিল শৈশবের ধুলোমলিন দিনেও। প্রকৃতির নিবিড় বর্ণনা, খেলে বেড়ানো বা ঘুরে বেড়ানোর মোহবিষ্টতার ভেতরেও তিনি বলেছেন মানুষের কথা, শুনিয়েছেন দারিদ্র্যের আখ্যান। ‘আমাদের দেশটি চিরগরিব দেশ। চিরকাল এ-দেশের মানুষের অধিকাংশ না-খেয়ে ও প্রায় না-খেয়ে থেকেছে।’ তাই চাকর মতলার কাছে ‘ভাত খাইতে লাগে মধুর মতো।’ এখানেও আশ্চর্যভাবে আমার শৈশবের স্মৃতিসুধা সঞ্চিত হয়ে আছে।
আমাদের বাড়িতে ধান বোনার মৌসুমে যেমন, ধান কাটার মৌসুমেও কামলা রাখার প্রচলন ছিল, সে সময়ে দেখতাম ভিন্ন কোনো জেলা থেকে কামলা আসত রোজ খাটতে। সেসব কামলাকে রাখা হতো স্বল্প টাকা মজুরিতে। বাড়ির বাংলাঘরে কামলাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। তিন বেলা তাদেরকে ভাত খাওয়ানো হতো। সে খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও বাড়িতে পড়ে যেত হুলুস্থুল। আমার দাদিমা যাকে আমরা বলতাম বিবি, তিনি নিজের হাতে দশ-বারোজন কামলার জন্য বড় পাতিলায় রান্না করতেন। ঝাল দিয়ে কোনো ভর্তা বানাতেন ডিশ ভরে, লাউ বা মুলা বা শিমের বিরন করতেন কোনো মাছ দিয়ে। কামলাদের দেখতাম সেসব স্বল্প তরকারি দিয়েই কী গভীর মগ্ন হয়ে ভাত খেতেন। যেন ভাত খাওয়ার জন্যই তারা এ পৃথিবীতে জন্মেছেন, যেন ভাত খাওয়াটা যৌনতার চেয়েও আমোদিত কিছু। গামলার পর গামলা ভরে ভাত দিয়েও কূল পাওয়া যেত না। কখনো কখনো ভাত কমও পড়ত।
হুমায়ুন আজাদ তাঁর কবিত্ব শক্তির জোরে সেই ভাত খাওয়া সেই দারিদ্র্যের ছবি এঁকেছেন পরম মমতায়, ‘আমাদের গ্রামে জোলাবাড়ি ছিল গ্রামের সবচেয়ে দক্ষিণে, কয়েকটি হাটিতে বা পাড়ায় বাস করতো তারা। কাপড় বুনতো কেউ কেউ। কিন্তু অনেকেই ক্রীতদাসের মতো কাজ করতো, কামলা খাটতো ধনীদের বাড়িতে। দাগা আর ছিটার তাঁত ছিল না। তাই কামলা খাটতো তারা। প্রতিদিন কাজ জুটতো না তাদের; বিশেষ ক’রে বড়োভাই ছিটার কাজ জুটতো না মাঝেমাঝেই। তাদের দুজনেরই সংসার ছিলো খুব বড়ো—আট-ন-জন মানুষ তাদের প্রত্যেকের পরিবারে। ছিটার খুব বদনাম ছিলো যে সে খুব খায়। একবারেই নাকি সে খেয়ে ফেলে দু-সের চালের ভাত। মাছ না থাকলেও কিছু যায় আসে না। পোড়া মরিচ আর লবণ দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে শেষ করে দেয় ভাতের স্তূপ। আমি তার খাওয়া দেখেছি—মনে হয়েছে যেনো ভাত নয়, সে মুঠো ভরে মুখে তুলে দিচ্ছে হীরেপান্নামণিমাণিক্য। তার আলো বেরিয়ে আসছে তার চোখমুখ থেকে।’
এই যে হুমায়ুন আজাদ প্রকৃতি দেখেছেন, প্রকৃতির ভেতর দেখেছেন আবহমান বাঙালির যাপিত জীবনের রূপচ্ছবি, দেখেছেন গরিবদের খাওয়ার মধ্যেও আলোর উদ্ভাসন—এসবই যে পরবর্তীকালে তাঁর কবিসত্তাকে তৈরি করেছে, তাতে সন্দেহ কি! তিনি যখন ছিটার ভাত খাওয়ার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমার মানসপটে শুধু ভেসে উঠছিল তাঁর গরিবদের সৌন্দর্য নামের সেই বিখ্যাত কবিতার চরণগুলো—
গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।
গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।
গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।
গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।
গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।
যখন গরিবেরা মাটি কাটে ইট ভাঙে খড় ঘাঁটে গাড়ি ঠেলে পিচ ঢালে তখন তাদের
সারা দেহে ঘাম জবজব করে, তখন তাদের খুব নোংরা আর কুৎসিত দেখায়।
গরিবদের খাওয়ার ভঙ্গি শিম্পাঞ্জির ভঙ্গির চেয়েও খারাপ।
অশ্লীল হাঁ ক’রে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠো ভ’রে সব কিছু গিলে ফেলে তারা।
থুতু ফেলার সময়ও গরিবেরা এমনভাবে মুখ বিকৃত করে
যেনো মুখে সাতদিন ধ’রে পচছিলো একটা নোংরা ইঁদুর।
গরিবদের ঘুমোনোর ভঙ্গি খুবই বিশ্রী।
গরিবেরা হাসতে গিয়ে হাসিটাকেই মাটি ক’রে ফেলে।
গান গাওয়ার সময়ও গরিবদের একটুও সুন্দর দেখায় না।
গরিবেরা চুমো খেতেই জানে না, এমনকি শিশুদের চুমো খাওয়ার সময়ও
থকথকে থুতুতে তারা নোংরা করে দেয় ঠোঁট নাক গাল।
গরিবদের আলিঙ্গন খুবই বেঢপ।
গরিবদের সঙ্গমও অত্যন্ত নোংরা, মনে হয় নোংরা মেঝের ওপর
সাংঘাতিকভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে দু’টি উলঙ্গ অশ্লীল জন্তু।
গরিবদের চুলে উকুন আর জট ছাড়া কোনো সৌন্দর্য নেই।
গরিবদের বগলের তলে থকথকে ময়লা আর বিচ্ছিরি লোম সব জড়াজড়ি করে।
গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই,
চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়।
মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে
বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়।
অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।
শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়।
হুমায়ুন আজাদ খুব পরিহাসপ্রিয় ছিলেন। কখনো কখনো তা নির্মমতার পর্যায়ে পৌঁছে যেত। আমি নিজেও চাক্ষুষ করেছি, টের পেয়েছি। কীভাবে? আমি ছিলাম হুমায়ুন আজাদের সরাসরি ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পাঠসূত্রে একবার বোধ হয় অনার্স তৃতীয় বর্ষে আরেকবার মাস্টার্স শেষ বর্ষে তাঁকে পেয়েছিলাম শিক্ষক হিসেবে। প্রথম দিনই ক্লাসে এসে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শাশ্বতী কবিতাটি সবাইকে মুখস্থ করার টাস্ক দিয়েছিলেন। সে ভোলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে আমি ভুলিব না, আমি কিছুতেই ভুলিব না। পরের ক্লাসে এসে সবার কাছ থেকে শুনে নিয়েছিলেন। যেদিন কবিতা শুনে নিয়েছেন সেদিন তিনি শুরুটা করেছিলেন ঠিক এভাবে, আমি এখন প্রথমেই শাশ্বতী মুখস্থ শুনতে চাইব ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির কাছ থেকে, এই মেয়ে দাঁড়াও, কী নাম তোমার? স্যার যে মেয়েটিকে দাঁড়াতে বললেন, তার দিকে তাকিয়ে আমরা কেউ কেউ যেমন স্তব্ধ হয়েছিলাম, কেউবা আবার হাসিতে ফেটে পড়েছিল। বলা বাহুল্য, মেয়েটি ছিল স্যারের বিশেষণের সম্পূর্ণ বিপরীত! স্যার যে কেন এতটা নির্মম ঠাট্টা করেছিলেন ওর সঙ্গে, তা আজও বোধগম্য হলো না আমার! তারপরই মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন কবিতাটা নিয়ে। বেশ ভালোই পড়াতেন তিনি, বিষয়ের গভীরে ঢোকার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল।
শুধু যে ক্লাসের পড়া নিয়েই আলাপ-আলোচনা করতেন তা নয়, মাঝেমধ্যেই প্রসঙ্গক্রমে হোক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে, দেশ এবং সমাজ নিয়ে, সাহিত্য এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তার চিন্তাভাবনার প্রতিফলনের প্রকাশও ঘটত নানাভাবে। তবে ছিলেন ভীষণ ঠোঁটকাটা আর নির্মম সত্যভাষী। মনে আছে, তিনি সহকর্মী ভাষাতত্ত্বের শিক্ষকসহ অন্যান্য কিছু শিক্ষক নিয়ে এমন সব রূঢ় মন্তব্য করতেন, যা সহসা মেনে নেওয়া যেত না, কিন্তু যত দিন পার হয়েছে, আমরা অনুধাবন করেছি—কতটুকু যথার্থ বলেছেন এবং তাতে কতটা তাৎপর্যময়তা রয়েছে। সন্দেহ নেই যে, হুমায়ুন আজাদের এই অকপটতা আর স্পষ্টবাদী সত্তাই ধীরে ধীরে তাঁকে মৃত্যুকূপের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। কেননা, তিনি তখন তাঁরই নিজের কবিতার সেই ভবিষ্যৎ বাণীর জগতে পৌঁছে গিয়েছেন, সেধিয়ে গিয়েছেন সেই নষ্ট জগতে!
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয় স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চলে যাবে সেই সব উপকথাঃ সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;
এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বোধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বর
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা—
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে
হ্যাঁ, কবিরা হয় ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা। কবিরা অনেক দূর থেকেই দেখতে পায় সবকিছু, দেখতে পায় দূর ভবিষ্যতে কী ঘটবে, কী ঘটতে পারে! আর সেই ঘাড্ডায় পড়েই কি খানিকটা এলোমেলো, খানিকটা ক্ষ্যাপাটে আর খানিকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ? নইলে তিনি যখন গদ্য লিখতে শুরু করেছিলেন, সাক্ষাৎকার দিতে লাগছিলেন একটির পর একটি কাগজে, সাময়িকীতে—তাঁর মধ্যে কেন এতটা অসহিষ্ণুতা আর অসৌন্দর্যের রাশপ্রিন্ট্রের সারি বুদ্বুদের মতো উগরে পড়ত?
হ্যাঁ, এই হুমায়ুন আজাদকে গ্রহণ করতে আমিও যে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, তা কী করে অস্বীকার করি। আমার কাছে মনে হয়েছিল, কমিউনিজমের পতনের ফলে, বাংলাদেশে একের পর এক সামরিক শাসনের ধাক্কার কারণে, পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী শক্তির উত্থানের বিপর্যস্ততায়, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বেপরোয়া অগ্রগতির জন্য আমাদের যে চারপাশের জগৎটা ক্রমে ক্রমে নষ্টদের অধিকারে চলে যাচ্ছে, বা চলে গেছেও বুঝিবা পুরোপুরি, তিনিও যেন খানিকটা নিজের অজান্তেই সে-জগতেরই মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন, হয়তো নিজের অজান্তেই ষোলো আনা না হোক আংশিক—যা থেকে হয়তো তিনি যেমন নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি, পারেননি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সঙ্গে জড়িত বাঘা বাঘা আরও অনেক মানুষ! যদি তারা নষ্ট এ জগৎ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারতেন, বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যের জগতের চিত্রটাই হয়তো আজকের মতো এত নীতিবহির্ভূত হতো না! এতটা গোষ্ঠীবদ্ধ, এতটা সংকীর্ণতাবেষ্টিত হতো না কোনোক্রমেই! পুরস্কার নিয়ে হতো না লজ্জাহীন একেকটি বিমূঢ়-করা কাণ্ডকীর্তি অথবা সাহিত্য নিয়ে হতো না এত বেশি তামাশা। হুমায়ুন আজাদ স্পষ্টতই নৈরাজ্যবাদিতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, বোদলেয়ারও দিয়েছিলেন নৈরাজ্যকে প্রশ্রয়, তা ছিল ক্লেদজ কুসুম আর হুমায়ুন আজাদেরটা ক্লেদজ কাটা।
যাহোক, আমি ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না পাঠের কথা বলছিলাম। সেখানেই ফিরে যাওয়া ভালো। বড় রিক্ততা বড় হারানোর ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না বইটি, বড় বেদনার সিম্ফনি বাজিয়ে। যখন বইটি ক্রমে ক্রমে শেষের দিকে চলে আসে, আমরা লেখকের ছোট ভাই আবুল কালাম আজাদের মৃত্যুর বিষাদে পুড়তে থাকি। আজ যেমন করোনার আক্রমণে দিকে দিকে মৃত্যুর মিছিল, একদা তেমনি কলেরার ঘায়ে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। আজকের মতোই তেমনি এক ঘোর মহামারিকালে ছোট্ট আবুল কালাম আজাদ মায়ের কোল খালি করে, কিশোর হুমায়ুন আজাদের রঙিন দিনকে চুরি করে, বাবার অসহায়ত্বকে বীভৎসভাবে উন্মোচন করে দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল অজানা লোকের ঠিকানায়। তারপর থেকেই শুধু হারানোর সুর, বেহালার ছড়। হুমায়ুন আজাদ কবি, বড় কবি। কবিরা ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন একদিন গ্রাম মরে যাবে, একদিন বাংলার সব গ্রাম হারিয়ে যাবে। গ্রামের সেই পতনধ্বনি যেন তিনি শুনতে পেয়েছিলেন শৈশব উত্তীর্ণকালেই, রাড়িখালে। সড়ক দিয়ে আর হাঁটা যায় না। খাল গড়িয়ে পদ্মার পানি আসে না। মাছ আসে না। পলি আসে না। পাগলেরা মিলে বেঁধে দিয়েছে সব খালের মুখ।
হাজার ডাক পাড়লেও আর হুমুইর দেয় না রাড়িখাল, হুমুইর দেয় না আমার গ্রাম জরুনও! গ্রামকে হারিয়ে ফেলার এক মর্মান্তিক যন্ত্রণা ফুলের গন্ধ ঘুম আসে না, যখন একদিন আমাদের সব গ্রাম শহর হয়ে যাবে, তখনো আমাদের মনে করিয়ে দেবে, আমরা একদা গ্রামে ছিলাম, ফুলের গন্ধে আমাদের ঘুম আসত না, জোনাকির আলোয় আমরা কবিতায় থাকতাম বুঁদ হয়ে!
খুব ভালো আলোচনা।
আবু আফজাল সালেহ
ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২ ১৬:০৭
এক কথায় অসাধারন অভিব্যক্তি। আমি মুগ্ধ!
ভুবন কুমার দে
জানুয়ারি ০৬, ২০২২ ২১:৫৪