নানা জাতির সাহিত্যের দিগবলয়
বাংলাদেশের নানা জাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-রাজনীতি বিষয়ে লেখাজোকার পরিমাণ হাতে গোনা। অথচ আমাদের তিন পার্বত্য জেলা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জাতিসমূহের আছে নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-মিথ ও লোকাচার। এসব সাহিত্য প্রান্তিকতার দায় নিয়ে এখনো অনেকাংশে অবহেলিত। যদিওবা এ কারণে তাদের সাহিত্যচর্চা থেমে নেই। নিজ ভাষা, উপভাষা ও মান ভাষাকে মাধ্যম করে প্রতিনিয়ত সক্রিয় রেখেছেন তাদের মনোজগৎ ও বহির্জগতের ভাব ও চেতনাকে ফুটিয়ে তোলার কাজ। তাদের সাহিত্যে উঠে এসেছে পাহাড়ি জনপদের প্রকৃতি-পরিবেশ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উল্লাস, রাজনীতি ও লোকজ বিষয়-আশয়।
বাঙালির জাতীয় বলয়ের ভেতর অবস্থানকারী এসব জাতিসত্তার মাঝে বাঙালিয়ানার ছাপ পড়েছে নিঃসন্দেহে। তাই তাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাঝে বাঙালি ঘরানার বিষয়-আশয় ঢুকে পড়েছে অনায়াসে। চাকমা, মারমা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, খুমি, পাংখো, বোম ইত্যাদি জাতিসত্তার রয়েছে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্য। যদিও তাদের বেশির ভাগই সাহিত্য রচনা করে নিজ নিজ ভাষার বাংলা উচ্চারণে ও বাংলা বর্ণমালায়। অনেকে তাদের নিজস্ব বর্ণমালার পাশাপাশি বাংলা ভাষায়ও সাহিত্য রচনা করে চলেছে।
কবি হাফিজ রশিদ খান দীর্ঘদিন ধরে এসব জাতিদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন। দীর্ঘদিনের এই চর্চার ফসল ‘আদিবাসী সাহিত্যের দিগবলয়’। প্রবন্ধগ্রন্থটি সাজানো হয়েছে ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও ১টি সাক্ষাৎকার দিয়ে। প্রবন্ধসমূহে আদিবাসী সাহিত্য-সংস্কৃতির নানান দিক উঠে এসেছে।
‘আদিবাসী সাহিত্যের দিগবলয়’ প্রবন্ধে নৃগোষ্ঠীদের সাহিত্যের আদলটিকে চিহ্নিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। দেশের প্রায় ৪৫টি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। তবু নিজেদের প্রকাশ করার জন্য ভাষিক বাধা পেরিয়ে মান ভাষায় নির্ভরশীল হয়ে চর্চা করছেন সাহিত্য। সাহিত্যচর্চার এসব নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্যপত্র, সাময়িকী প্রকাশনার তালিকা দিয়েছেন ওই প্রবন্ধে।
‘জুমিয়া ভাষা-পরিবার ও আদিবাসী সাহিত্যের হালচাল’ প্রবন্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১১টি জাতিসত্তার সমবায়ী কৃষি ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে একটা ভাষা-পরিবারের কথা প্রচলিত আছে এই অঞ্চলে। সে ভাষাটি মূলত জুমিয়া ভাষা। সে ভাষার কথা বলতে গিয়ে ওই ১১ জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষাগুলো উদঘাটনে প্রয়াসী হয়েছেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ ভাষা হিসেবে জুমিয়া, চট্টগ্রামী (নাকি চাটগাঁইয়া ভাষা হবে?), চাকমা, ইংরেজি ও বাংলা ভাষার কথা আলোকপাত করেন।
‘জুমিয়া জাতিসত্তার কবিতায় প্রতিফলিত জীবনধারা’ প্রবন্ধে জুমিয়া ভাষাভাষীর কবিতা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। মূলত জুমিয়া গোষ্ঠীর বাংলা ভাষায় রচিত কবিতাগুলোতে প্রতিফলিত জীবনধারা ফুটিয়ে তুলেছেন এই প্রবন্ধে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীদের সাধারণ ভাষা নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে লিংগুয়া ফ্রাংকার খোঁজে’।
নৃগোষ্ঠীদের রচিত সাহিত্যে কবিতাচর্চাকারীদের কাব্যবোধ ও কাব্য চেতনা নিয়ে লিখেছেন ‘বাংলা ভাষায় আদিবাসীদের কবিতাচর্চা’, ‘পাহাড়ি জনপদ : কবি ও কবিতার পরম্পরা’, ‘আদিবাসী ভাষায় সাহিত্যচর্চা একটি পার্শ্ব অনুভূতি’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম কবিতার তারুণ্যের কণ্ঠস্বর’, ‘আমার কবিতার আদিবাসীপর্ব’ ও ‘হৃদয়-শেকলে বাঁধা কবিতা ও ৮ মারমা কবি’ ইত্যাদি প্রবন্ধে। প্রবন্ধগুলোতে উঠে এসেছে এতদঞ্চলে কবিতাচর্চাকারীদের নাম, কবিতা ও তাদের প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ের বিষয়-আশয়।
নানা জাতির ব্যক্তিত্ব ও তাদের উত্তরাধিকার নিয়ে লিখেছেন ‘অং শৈ প্রু চৌধুরী ও বোমাংপ্রধান বা উত্তরাধিকারী প্রসঙ্গ’, ‘বোমাং প্রধানগণের কুরসিনামা ও রাজত্বকাল’, মেনলে ম্রো: পৌরাণিক চরিত্রের স্বপ্নবীজ’, ‘পাহাড়ি গায়ক অরুণ সারকী’, ‘মনে পড়ে পাহাড়ের প্রিয়মুখগুলো’, ‘এম এন লারমা: অবিস্মরণীয় মানবাত্মা’, ও ‘মুক্তিযোদ্ধা মং ঞো হ্লা অং ও তাঁর আদিবাসীভুবন’ প্রবন্ধসমূহ।
আলোচিত গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহের মধ্যে যে প্রবন্ধগুলো একটু ভিন্ন স্বাদ ও ব্যঞ্জনা আছে সেগুলো হলো, ‘আদিবাসী ও কর্মবাদ: অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ’, ‘জুম্ম ও বিহু কীভাবে দূরে সরে গেল’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: কথা না-রাখার জনপদ’ ও ‘পাহাড়ি জনপদ: চারটি জলরঙ স্কেচে’ উল্লেখযোগ্য।
‘আদিবাসী পিতৃভূমি-চেতনা ও বর্তমান অবস্থান’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সংখ্যা এবং তাদের বাংলাদেশি পরিচয়ের পাশাপাশি সম্পত্তির মালিকানা, উৎপাদন ও সম্পদের বিতরণে বাঙালিদের সাথে সাযুজ্যের দিকটা তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া বর্তমান সময়ে তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আঞ্চলিক নির্মোক পরিত্যাগ করে নগরমনস্ক হয়ে ওঠার বিষয়টিও উল্লেখ করেন। প্রবন্ধটি সম্পর্কে লেখক বলেন, ‘এ দেশে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসরত আদিবাসী জাতিসত্তাগুলোর প্রতি এক শ্রেণির সংবেদন ও ইতিহাসবোধহীন মানুষের আলগা আচরণ ও সূক্ষ্ম তাচ্ছিল্যভাব পোষণের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে ব্যক্তিগত অভিমত’ উপস্থাপন করেছেন।
‘ক্ষুদ্রজাতি ও তাদের সংস্কৃতির আদিবিন্যাস অবহেলিত হচ্ছে’ শিরোনামে লেখকের নিজের একটি সাক্ষাৎকার এখানে সংকলিত হয়েছে। এখানে উঠে এসেছে কবির রচিত আদিবাসী কবিতা, আদিবাসীদের সাথে কাটানো সময়ের যাপিত অভিজ্ঞতা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা, আচরণ ও জীবনের নানা চেতনাবোধ এবং আদিবাসী শব্দ নিয়ে লেখকের পক্ষপাতের বিষয়টাও।
আমরা জানি, বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ নামে। যদিওবা ‘আদিবাসী’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। বিষয়গুলো নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে অসন্তোষ রয়েছে বটে। লেখক ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আদিবাসী বলতে বোঝাতে চেয়েছি, কোনো দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নানাবিধ প্রভাবশালী বেষ্টনীর ভেতর দীর্ঘকালব্যাপী বসবাস করা সত্ত্বেও যে-সকল জাতিগোষ্ঠী তাদের পুরাকালীন ধর্মীয় রীতিনীতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও প্রাত্যহিক কৃত্যগুলো অবিকৃত রেখে বেঁচে থাকার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের।
কবি হাফিজ রশিদ খানের ‘আদিবাসী সাহিত্যের দিগবলয়’ শিরোনামের প্রবন্ধগ্রন্থটি বাংলাদেশ তথা তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সাহিত্যের পাশাপাশি আঞ্চলিক বিবিধ বিষয় ও রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনার আভাস পাওয়া যাবে। বইটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সাহিত্য নিয়ে যেকোনো অভিসন্দর্ভের জন্য সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে।
বইটির ব্যাক কাভারের লেখাটি এমন, ‘বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা ও কিছু সমতলভূমিতে বসবাস করেন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারণ প্রক্রিয়া বাঙালি জীবনধারা থেকে ভিন্ন। গ্রন্থকার এ সময়ের একজন প্রাতিস্বিক কবি এবং তাঁর এ গদ্যগুলো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকেন্দ্রিক, তাদের মনন ও সাংস্কৃতিক বোধ নিয়ে। এমন প্রত্যাশা তাই অমূলক নয়, উভয় জীবনধারার মানুষের কাছে বইটি সমান প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিয়ে পঠিত হবে।’
লেখাটা ভালোলেগেছে। শেখর দেব ও তর্কবাংলাকে অনেক ধন্যবাদ।
হাফিজ রশিদ খান
ডিসেম্বর ০২, ২০২১ ১৩:৫১
দারুণ। ধন্যবাদ, শেখর দেব দাদা।
মঈন ফারুক
ডিসেম্বর ০১, ২০২১ ১৮:৪৫