মৃণালের বয়ানে চ্যাপলিন

 

চলচ্চিত্রের দর্শকদের সাধারণ কিংবা বিশেষজ্ঞ দর্শক জাতীয় বর্গে বিভাজিত করা আদৌ ঠিক কি না, কিংবা এ ধরনের বর্গে চলচ্চিত্রের দর্শকদের ভাগ করার ফলে বিতর্ক তৈরির সম্ভাবনাকে আপাতত এক পাশে সরিয়ে রেখে যে প্রশ্ন দিয়ে এই লেখা শুরু হতে পারে তা হলো, বাংলাদেশ কিংবা আমাদের এই অঞ্চলে চলচ্চিত্রের সাধারণ দর্শকদের ভেতর, কিংবা নিদেনপক্ষে গণমানুষের সাধারণ অংশের কাছে চার্লি চ্যাপলিনের পরিচয় কী? অর্থাৎ চ্যাপলিনের সাথে যে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের পরিচয়, সেসব চলচ্চিত্রে চ্যাপলিন আমাদের কাছে কেমনভাবে হাজির হন? এ কথা স্বীকার করে নেওয়া কি খুব বড় ভুল হবে যে, আমাদের কাছে চ্যাপলিন মোটাদাগে একজন কৌতুকাভিনেতা মাত্র? যদিও চলচ্চিত্রের একজন শিল্পীর অভিনয়কে এই তথাকথিত উত্তরাধুনিক সময়ে এসে দর্শকের নিজের মতো ব্যাখ্যা করার বিষয়টি তাত্ত্বিক মহলে স্বীকৃত; এবং একই সাথে চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রের শিল্পরূপ উপলব্ধি করার মতো বাস্তবতা এই অঞ্চলের দর্শক শ্রেণি আদৌ পেয়েছে কি না, তা নিয়েও আলাদা বিতর্ক হতেই পারে। আর সার্বিকভাবে বর্তমান লেখকের এরূপ সাধারণীকৃত মন্তব্যকে খুব বেশি বিরূপ মনে হলে অন্তত এটুকু বলে এই লেখা এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে যে, বর্তমান লেখকও জীবনের একটি বড় সময় চ্যাপলিনকে মূলত একজন চার্লি-ই মনে করে এসেছেন, যার অভিনয় ও চলচ্চিত্রের শিল্পরূপ, চেতনা ও দর্শন একরকম আড়ালেই থেকে গিয়েছিল বর্তমান লেখকের চলচ্চিত্র দর্শকসত্তাটি থেকে।

কিন্তু এ কথাও সত্য যে, মন থেকে চাইলে ঈশ্বরকেও পাওয়া যায়। তাই এটিও নিশ্চয়ই সম্ভব যে চাইলে চার্লি চ্যাপলিনকেও ভিন্নভাবে দেখা ও বোঝা সম্ভব। আর চ্যাপলিনকে ভিন্নভাবে দেখার জন্য আরও অনেকের সাথে মৃণাল সেনের সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে। আজ থেকে প্রায় সাত দশক আগে উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিভাধর চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন মানুষের কাছে চ্যাপলিনকে আরও বেশি সহজবোধ্য করার জন্যই হয়তো রচনা করেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন শীর্ষক বইটি। যদিও ১৯৫৩ সালে বইটি প্রথম প্রকাশের সময় এর লেখক মৃণাল সেন আজকের পরিচিত চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়ে ওঠেননি। আসলে সেই সময়ে তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্রটিও মুক্তি পায়নি। বামপন্থী রাজনীতি ও আন্দোলনের সাথে যুক্ত মৃণাল সেন কর্মজীবনে সাংবাদিকতা ও ঔষধ বিপণনের কাজ করার পর চলচ্চিত্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছিলেন, আর তখনই সম্ভবত খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের মূল সত্তাকে। তবে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে আসার পেছনে তাঁর ওপর চার্লি চ্যাপলিনের দারুণ প্রভাবের কথা মৃণালের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকেই জানা যায়। আর এই প্রভাবের বশেই হয়তো তিনি চলচ্চিত্রজগতে পদার্পণেরও আগে লিখে ফেলেছিলেন এই বই।

মৃণালের চার্লি চ্যাপলিন বইটি প্রকাশের সময় চ্যাপলিন জীবিত ছিলেন এবং তাঁর চলচ্চিত্রে নির্মাণও গতিশীল ছিল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বইটিকে চ্যাপলিনের পূর্ণ কর্মজীবন নির্ভর আলেখ্য বলা যাবে না। ২০০৭ সালে কলকাতায় এই বইটির পরিবর্ধিত একটি সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান আলোচনার জন্য সাহায্য নেওয়া হয়েছে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের কবি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটির সংস্করণ থেকে।

মৃণালের বয়ানে চ্যাপলিনের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনাকে এককথায় হয়তো অসাধারণ বলা যাবে না, তবে এখানে মৃণাল যেভাবে চ্যাপলিনের দুঃখভারাক্রান্ত কিন্তু বৈচিত্র্যময় জীবন গতিময়তার সাথে তুলে ধরেছেন, বর্ণনার সেই সুখপাঠ্যতা আজকের দিনের পাঠককেও ধরে রাখার সক্ষমতা রাখে। মূল বিচারে একমুখী বা লিনিয়ার বর্ণনার পরও ক্ষণে ক্ষণে যে নন-লিনিয়ার বর্ণনাভঙ্গিকে মৃণাল এই বইতে আশ্রয় করেছেন, পাঠকেরা সেই বিষয়টিকেও বেশ চমকপ্রদ হিসেবে অনুভব করবেন।

নিদারুণ দরিদ্রতা, দুঃখ-কষ্ট, ক্ষুধা, অপমান ও সংগ্রামকে সাথে নিয়ে বেড়ে ওঠা চ্যাপলিনের শৈশব কীভাবে তাঁর চলচ্চিত্রদর্শন তথা জীবনভাবনাকে তৈরি করে দিয়েছিল, বইটির পাতায় পাতায় খানিক বিরতি দিয়ে মৃণাল পাঠককে মনে করিয়ে দেবেন ঠিক সেই কথাই। অর্থাৎ আমাদের শিশুকালের অভিজ্ঞতা যে সারা জীবনভর আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় এবং আমাদের কর্মকাণ্ডের পেছনে শক্তিশালী প্রভাবকের কাজ করে, চ্যাপলিনের জীবনের দিকে নির্দেশ করে মৃণাল আমাদের তাই দেখিয়ে দিতে চান। তবে নিজের বর্ণনার ক্ষেত্রে মৃণাল সেনকে বেশ সাবধানীই বলতে হয়। বারবার দারিদ্র্যপীড়িত, লাঞ্ছিত চ্যাপলিনের শৈশবের সাথে বর্ণনার যোগসূত্র স্থাপন করলেও, সেই কষ্টময় অভিজ্ঞতা থেকে একেবারে হঠাৎ করেই যে চ্যাপলিন চলচ্চিত্রে তাঁর আদর্শ বা দর্শনের খোঁজ পেয়ে গিয়ছিলেন, এমন কল্পকাহিনিকে বা কিংবদন্তিকে মৃণাল সেন অত্যন্ত সচেতন ও শক্তিশালীভাবে বাতিল করেছেন এই বইতে।

চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রজীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও চলচ্চিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে খুব সাবলীলভাবে মৃণাল পাঠকদের দেখালেন, কীভাবে জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির প্রভাবে বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের ব্যক্তিগত দর্শন তার গঠন লাভ করে। চলচ্চিত্রে চ্যাপলিনের বিশ্বখ্যাত বেশভূষা নিয়ে আলোচনা থেকে পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন, নিতান্ত খেয়ালের বশে করা মানুষের কোন কোন কাজ কীভাবে তাঁর পরিচয়নির্ধারক এবং কখনো কখনো অত্যন্ত শক্তিশালী বার্তা বা যোগাযোগমাধ্যমে পরিণত হয়। চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তার পেছনে ধনিক সমাজের বিপরীতে সিংহভাগ দরিদ্র মানুষের পৃথিবী নিয়ে চ্যাপলিনের সহজ সমীকরণের কথা যেমন মৃণাল জানিয়ে যাবেন এই বইয়ের পাঠককে, তেমনি তিনি এ-ও মনে করিয়ে দেবেন, আধুনিক পুঁজিবাদী পৃথিবীর শক্তিশালী ভিত্তিলাভের সময়টিতে কীভাবে বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে চড়া মূল্যের চুক্তিতে চ্যাপলিনের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে চলেছিল সেই সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যত্র। অর্থাৎ, চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তার পেছনে প্রোলেতারিয়েত আখ্যান ও বুর্জোয়া মনস্তত্ত্বের সম্মিলনের প্রায় বিরল এক বয়ান মৃণাল হাজির করতে সক্ষম হয়েছেন এই বইয়ে। আবার সময়ের প্রয়োজনে মানুষ কেন তাঁর আগের শক্তিশালী বিশ্বাসকে খুব স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন বা পরিমার্জন করে, তার শক্তিশালী এক দৃষ্টান্ত হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মানবসভ্যতার চরম দুর্দশার বিপরীতে বিশ্বজনের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা প্রকাশের তাড়নায় চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রে শব্দযোজনের বিষয়টি মৃণাল পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। উল্লেখ্য, বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকেই চলচ্চিত্রে শব্দযোজনের প্রযুক্তি পশ্চিমে সহজলভ্য হয়ে উঠলেও চ্যাপলিন মনে করতেন, মূকাভিনয়ই চলচ্চিত্রের মূল বিষয়, শব্দযোজনের ফলে চলচ্চিত্রের শিল্পমূল্য কমে যাবে মাত্র। কিন্তু ১৯৪০ সালে দ্য গ্রেট ডিক্টেটর চলচ্চিত্রে শব্দযোজনের পেছনে চ্যাপলিন যে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হওয়ার প্রগতিশীল বার্তা দিয়ে গেলেন, তাই যেন ছাপা অক্ষরে ফুটিয়ে তুললেন মৃণাল সেন।

চ্যাপলিন কর্তৃক নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহের প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে মৃণাল সেন তাঁর এই গ্রন্থে খুব স্বাভাবিকভাবেই চ্যাপলিনের অনেকগুলো চলচ্চিত্রের কাহিনি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেসব সুপরিচিত ও বিখ্যাত চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ না করে এই বইয়ের নেতিবাচক সমালোচনা হিসেবে সম্ভাব্য পাঠকদের উদ্দেশে যা বলে রাখা ভালো তা হলো, এই বইতে মৃণাল যেভাবে চ্যাপলিনের বিভিন্ন চলচ্চিত্রের কাহিনির বর্ণনা করেছেন, আজকের দিনে চ্যাপলিনের নতুন দর্শকদের জন্য তা নিঃসন্দেহেই spoiler। মৃণাল অনুরক্ত যে কেউ এ ক্ষেত্রে বলতেই পারেন, ১৯৫৩ সালে ভারতবর্ষে চ্যাপলিনের সহজলভ্যতা না থাকায় মৃণাল হয়তো পাঠকদেরকে চ্যাপলিনের কিছুটা স্বাদ দিতে এরূপ বর্ণনা করেছিলেন। তবে সম্ভাব্য এই যুক্তিখণ্ডনের অস্ত্র মৃণাল তাঁর আলোচ্য বইতেই রেখেছেন, যেখানে তিনি বলছেন, গত শতকের ৪০-এর দশকেই ভারতে চার্লি চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তা ছিল ও বেড়েই চলেছিল।

সে ক্ষেত্রে চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রসমূহের বেশ মনোগ্রাহী ও আগ্রহোদ্দীপক বর্ণনা পাঠক পেতে পারেন ১৯৮৯ সালে শাহাদুজ্জামান রচিত চ্যাপলিন, আজো চমৎকার শীর্ষক লেখায়, যা ২০১৭ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এই যে, শাহাদুজ্জামান তাঁর গ্রন্থের শেষে যেসব তথ্যসূত্র উল্লেখ করেছেন, তাঁর ভেতর এই মুহূর্তে আলোচ্য মৃণাল সেনের চার্লি চ্যাপলিন অন্যতম। অর্থাৎ, বর্ণনাভঙ্গি যেমনই হোক, মৃণাল সেনের এই কাজ নিঃসন্দেহেই পরবর্তীজনদের জন্য পথপ্রদর্শক একটি কাজ। আর এখানেই সম্ভবত চলচ্চিত্রকার হিসেবে পরিচিত মৃণাল সেনের লেখকসত্তার সফলতা।

আর তাই মৃণাল সেনকে লেখক বলি বা চলচ্চিত্রকার, চার্লি চ্যাপলিনকে উপলক্ষ করে ১৯৭২ সালে এই গুণী শিল্পীর লেখা একটি ছত্র হয়তো তাঁর নিজের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে,

Chaplinis undoubtedly one of the greatest wonders of this century and a living inspiration to all who consider all arts as social entities.

শিল্পের একজন প্রকৃত সমঝদারই তো অপর একজন শিল্পীকে চিনতে পারেন, বা চেনার চেষ্টাটুকু করতে পারেন; বুঝতে পারেন শিল্পের সাথে সমাজের সম্পর্ককে। তাই নয় কি?