ইমানুয়েল লেভিনাসের ‘প্রথম দর্শন’
জিউস পিতামাতার সন্তান ইমানুয়েল লেভিনাস [১৯০৬-১৯৯৫]। জন্মেছেন ১৯০৬ সালে, লিথুনিয়ায়। ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়েছেন। দর্শন পড়তে এসেছেন ১৭ বছর বয়সে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যোগ দিয়েছিলেন ফ্রান্স সেনাবাহিনীতে। জার্মান সৈনিকদের কাছে তিনি ধৃত হন। স্ত্রী ও কন্যা ছাড়া পরিবারের সবাইকে যুদ্ধে হারান। পাঁচ বছরের বন্দিজীবনের মধ্য দিয়ে স্ত্রী ও কন্যার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যুদ্ধের অব্যবহিত আগে, ১৯২৯ সালে স্ট্রসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে The Theory of Intuition in Husserl’s Phenomenology প্রতিপাদ্যের ওপর ডক্টরাল ডিগ্রি পান। গ্রন্থাকারে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় Existence and Existents, ১৯৪০ এর শেষের দিকের বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতামালা সিরিজ নিয়ে পরের বছর প্রকাশিত হয়: Time and the Other। পূর্বেকার কিছু প্রকাশিত প্রবন্ধ ও বইপত্রের সারংশ নিয়ে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় Otherwise Than Being। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু ও আলোচনার ধরন পোপ জন পল খুবই পছন্দ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে প্যারিসের বিখ্যাত সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন তিনি। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। মারা যান ১৯৯৫ সালে, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাঁর মনে রেখাপাত করেছিল। সেই রেখাপাতই তাঁর দর্শন নির্মাণে সাহায্য করেছে। এ কাঠামোবদ্ধ চিন্তায় তিনি তিনটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছিলেন: প্রথমত, আমরা কীভাবে শুভ ও মন্দকে প্রত্যক্ষ করি, দ্বিতীয়ত, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভূমিকা কী, আর তৃতীয়ত, যুদ্ধে ঈশ্বর কীভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে বর্তমান নিবন্ধে ইমানুয়েল লেভিনাসের ‘প্রথম দর্শনের’ রূপরেখা উপস্থাপন করার প্রয়াস নেব।
যেভাবে লেভিনাস প্রভাবিত হয়েছেন
তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্প ছিল ‘প্রথম দর্শনের’ [first philosophy] বিকাশ। সাধারণ দর্শনের ইতিহাসে ‘প্রথম দর্শন’ হলো অধিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বের মতো বিষয়াদি। দর্শনের প্রচলিত ধরাবাঁধা বিষয়ের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করতে চাননি। তিনি উপায় খুঁজেছেন মানুষের ভেতরের মননের সঙ্গে বাহিরটাকে একাকার করে শুদ্ধজীবনের পথ নির্মাণ করার। এই লক্ষ্যে তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন: ‘নীতিবিদ্যাই প্রথম দর্শন’। এ ধারণা নির্মাণে তিনি অফুরন্ত রসদ সংগ্রহ করেছেন জিউস তালমুদ হতে। ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গ দর্শন পড়তে গিয়ে তিনি লক্ষ করেছেন, পাশ্চাত্য দর্শনের সঙ্গে তাঁর জিউস বিশ্বাসের ফারাক থেকেই যাচ্ছে। বক্তৃতা ও আলোচনায় জিউস মূল্যবোধকে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। তাঁর জিউস শিক্ষক মরডাচি চৌচানি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সে যেন জিউস তালমুদ ভালোভাবে অনুধাবন করেন। এই অনুধাবনই তাঁর দর্শন নির্মাণের পাথেয় হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
আধুনিকতাবাদী রেনে দেকার্ত, এডমন্ড হুসার্ল ও মার্টিন হাইডেগার ছিলেন তাঁর দর্শন নির্মাণের উৎস। তাঁর ডক্টরাল অভিসন্দর্ভে হুসার্ল ছিল আলোচনার প্রতিপাদ্য। হুসার্লের ভাবনার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে তিনি তিনটি দার্শনিক সিদ্ধান্তে আসেন: এক. প্রতিটি মানবীয় অভিজ্ঞতাই অবভাসিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দাবি রাখে, দুই. প্রতিটি মানবীয় অভিজ্ঞতাই বিশেষ কিছু অর্থকে ধারণ করে, দুই. হুসার্লের মতে, মনোভাবজাত [intentionalit] হলো মানসিক অবস্থা ও অভিজ্ঞতার অবভাসিক সারধর্ম। এ সারধর্ম হচ্ছে ভেতরকার শর্ত যা বাহ্যিকভাবে অতি-মানসিক জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়। মনোভাবজাত শর্তটি আবার বাহ্যিক শর্তের ওপরও নির্ভর করে। সে সময় তিনি হুসার্লের Cartesian Meditations গ্রন্থটি অনুবাদ করেন। এখানে তিনি অতীন্দ্রিয় অবভাসবাদের একটি পদ্ধতিমাফিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। ১৯৩০ এর শেষের দিকে এসে তিনি হুসার্ল ও হাইডেগারের ওপর আলোচনার সূত্রপাত করেন দুটি রচনায়: Martin Heidegger and Ontology ও The Work of Edmund Husserl। লেভিনাসের ১৯৩০ ও ১৯৪০ সালের দিকে উপস্থাপিত দার্শনিক প্রকল্পের গোটাটাই প্রভাবিত হয়েছে হুসার্লের অবভাসিক পদ্ধতির প্রভাবে। বিশেষ করে হুসার্লের অতীন্দ্রিয় সত্তার [transcendental ego] ছিল তাঁর দাশনিক ধারার মূলে। এ পর্যায়ে তাঁর দর্শনের গতিপথ নির্ধারিত হয়েছিল হাইডেগারের Being and Time গ্রন্থের আলোকে। ১৯৩৫ সালের দিকে হাইডেগারের সত্তা ও অতীন্দ্রিয় ধারণা থেকে বের হয়ে তত্ত্ববিদ্যার এক নতুন ধারা আবিষ্কার করেন। এখানে এসে মহাদেশীয় দর্শনের বলয় থেকে লেভিনাস নিজেকে আলাদা করে নেন। এই আলাদা হবার কারণও আমরা লক্ষ করি তাঁর পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতি প্রতিক্রিয়ায়।
লেভিনাস আত্মসত্তা ও পরসত্তার ধারণাকে বুঝতে গিয়ে মার্টিন বুবারের ‘আমি-তুমি’ কিংবা ‘আমি-ইহা’ [I-Thou, I-It] ধারণার শরণাপন্ন হয়েছেন। বুবার তাঁর I-Thou, I-It গ্রন্থে ‘আমি-তুমি’ কিংবা ‘আমি-ইহা’ এর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন। কাকতালীয়ভাবে একই বছর সিগমুন্ড ফ্রয়েডের The Ego and the Id গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ফ্রয়েডের ‘ইড’, আর বুবারের ‘আই’, ফ্রয়েডের সুপার ইগো, আর বুবারের দাউ এর মধ্যে লেভিনাস যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে লেভিনাসের ধারণাটি বোঝা যেতে পারে। ইড [Id] জন্ম হতেই থাকে, আমাদের যাবতীয় চাহিদা এই দলের অন্তর্ভুক্ত, যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, এর পাশাপাশি অন্যান্য প্রয়োজনও রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ‘ইড’ কিন্তু মানুষ ও পশু সবার মাঝেই সমানভাবে রয়েছে। এর কোনো মানবিক দিক বা বিকাশ নেই। ‘ইড’ সম্পূর্ণই লোভ লালসা ও কাম চিন্তায় ভরপুর, তা এমনভাবে মানুষকে প্ররোচিত করে যে, এ প্ররোচনায় মানুষ যেকোনো সামাজিক/অসামাজিক অপরাধ থেকে শুরু করে, খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করে না। এককথায়, ‘ইড’ আপনার ভিতরের সুপ্ত পশু। ইডের পর আসছে ইগোর [Ego] প্রসঙ্গ, যা আমাদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও যুক্তিতর্কের সাথে চিন্তা করতে শেখায়। ন্যায়/অন্যায়, ইচ্ছে/অনিচ্ছা, কিংবা পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। এককথায় দুই বিপরীতের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষাকারী হলো ‘ইগো’। কারও মধ্যে ‘ইগো] না থেকে কেবল যদি ‘ইড’ কাজ করত, তাহলে সে অমানুষ বা উন্মাদ হয়ে যেত। সর্বশেষে, মানুষের বিবেককে বলা যেতে পারে সুপার ইগো [Super Ego]। ‘ইড’ যখন মানুষের কামনা-বাসনাকে উদ্দীপ্ত করে, ‘সুপার ইগো’ তখন তাকে বাধা দেয়। ‘সুপার ইগো’ সব সময় মানুষকে মানবিক চাহিদার ঊর্ধ্বে থেকে ভালো কাজ করতে উদ্দীপিত করে। তবে কারও ভেতর যদি কেবল সুপার ইগো কাজ করে, তাহলে সে সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। ইগো এই দুই অবস্থার মধ্যে [ইড ও সুপার ইগো] ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। মানবীয় চেতনা নির্মাণের ক্ষেত্রে সুপার ইগোর এই কারসাজি রয়েছে প্রথম দর্শন নির্মাণে। মুকুরে নিজের ছবি তা আন্তঃবিষয়ী সম্পর্কের [intersubjective relationship] মধ্য দিয়ে স্থাপিত হলে সবকিছুই অন্যের মত ও পথ ধরা পড়বে, নিজের বলে কিছু থাকে না। আয়নায় নিজেকে দেখতে হয় নিজের মতো করে, এ দেখার উপলব্ধি নিজেকে আপনার হতে বাহির হবার প্রেরণায় উজ্জীবিত করে। এই উজ্জীবনই হলো ‘প্রথম দর্শন’ হিসেবে নীতিবিদ্যার কাজ।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা স্পষ্ট হয়েছি যে, ফ্রয়েডের ভাবনার সঙ্গে লেভিনাস একটি বোঝাপড়া দাঁড় করিয়েছেন। ব্যক্তি তার নিজেকে ছাড়িয়ে অপরে যাবার ক্ষেত্রে ইড ও সুপার ইগোর দ্বন্দ্ব নিরসন করে নেয় আগে। নিজেকে দ্বন্দ্বে নিয়োজিত করেই মানুষ তা নিরসনে উদ্যোগ নেয়, এই উদ্যোগের জায়গায় সে অপরে উপনীত হয়। আপন হতে বাহির হবার এই মনোবিজ্ঞান তিনি বিপরীত অর্থে ফ্রয়েড থেকে গ্রহণ করেছেন। ‘আপন’ আর ‘পরের’ মধ্যে যে পার্থক্য তা ইগো আর সুপার ইগোর পার্থক্য নয়। তবে দুইয়ের মধ্যে বিপরীত সম্পর্কের টানাপোড়েন মেটানোর জন্য লেভিনাস দায়িত্বশীলতাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। এখানেই ফ্রয়েডের সঙ্গে লেভিনাসের পার্থক্য। আমাদের নৈতিক দায়ের সীমানা কোন পর্যন্ত? লেভিনাস এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, নৈতিক দায়ে দুটি পক্ষ রয়েছে। একপক্ষে রয়েছেন নৈতিক কর্তা [moral agents], অন্যপক্ষে নৈতিক-বিষয়ী [moral patients]। সকল প্রাণবন্ত সত্তা যাদের ব্যথা অনুভবের সক্ষমতা রয়েছে তাদের প্রতি ‘আমি’র নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নৈতিক কর্তা হিসেবে ‘আমি’ সকল সময়ই কোনো অভিজ্ঞতা অর্জনের পূর্বে নৈতিক বিষয়ীর জন্য একগুচ্ছ নৈতিক নীতি বিন্যস্ত করে নেয়। আমরা প্রতিদিন যে নৈতিক বাধ্যবাধকতা পালন করি, তার দুটি প্রান্ত রয়েছে। প্রান্তের একদিকে রয়েছে আত্মসত্তা [Self], আর রয়েছে ‘অপর’ [Other]। আত্মসত্তা সারাক্ষণই নিজেকে ঘিরে আপনাকে নির্মাণ করে। এই আপনার মধ্যে রয়েছে হাসি-কান্না, সুখ ও বিলাস। আর নিজের সুখের মধ্য দিয়ে আপনার বাইরের জনের সঙ্গে অপরত্বের ধারণা সৃষ্টি হয়। এই দুই প্রান্তের মধ্যে যখনই উভমুখী সম্পর্ক নির্মিত হয়, তখনই নৈতিকতার নতুন পরিপ্রেক্ষিত নির্মিত হয়। আত্মসত্তার দিক থেকে অন্যসত্তা অভিমুখীন পারস্পরিক যোগাযোগের সম্মিলনেই সৃষ্টি হয় ‘সকল অন্যসত্তার অন্য’ [all Other Others]। এখানে অন্যসত্তা হলো ‘আপনার আপন যেজন আপনার হয়ে ওঠে’। ‘অপরের’ মধ্যে যে বিপন্নতা ও বিচ্ছিন্নতা রয়েছে, তা কেটে সে পরিপূর্ণতা অর্জন করে।
‘আমি’ আর ‘অন্যসত্তা’ উভয়ের মধ্যে এই যে উভমুখী সম্পর্ক, তার প্রকাশিত হয়েছে লেভিনাসের বিখ্যাত উক্তিতে “দর্শনের আদি হলো নীতিবিদ্যা”। নৈতিকতার সন্ধান করি আমরা প্রথমত ও আদিতে। কিন্তু, প্রথাগত দর্শনে এই প্রচেষ্টার ধরনটি ঠিক উল্টো। এখানে দর্শনের জ্ঞানতত্ত্বকে অতীব গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই গুরুত্বে নৈতিকতার অবস্থিতি হয়ে পড়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের। আবার বাধ্যবাধকতার অনুগামী হিসেবে কোনো না কোনো ঘটনা বিদ্যমান থাকে। কিংবা বাধ্যবাধকতা কতটা সম্মানিত হবে, তা-ও নির্ভর করে সংস্কৃতি ও বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে। নৈতিকতা-সম্পর্কিত এ ধারণা তিনি গ্রহণ করেছেন মার্টিন বুবার এর ‘আমি-তুমি’ কিংবা ‘আমি-ইহা’ [ I-Thou, I-It ] ধারণা থেকে। মার্টিন বুবার এ সম্পর্কিত ভাবনা নিয়ে I-Thou, I-It গ্রন্থটি লিখেছেন ১৯২৩ সালে। তিনি জগতের অভিজ্ঞতার আলোক দিয়ে বুঝিয়েছেন, ‘আমি’র সঙ্গে ‘তুমি’ বা ‘পর’ কিংবা ইহা বা বস্তুর মধ্যকার সম্পর্কে। বস্তুজগৎকে বুঝতে গিয়ে আমরা যেমন বুঝি আমির সঙ্গে ‘ইহা’ বা বস্তুর সম্পর্ক, এ সম্পর্কেরই বর্ধিত পরিসর হিসেবে ‘আমি’কে বুঝতে চেষ্টা করি ‘তুমি’র সঙ্গে সম্পর্কিত করে। তাহলে সম্পর্কের প্রথম ধাপ শুরু হয় ‘আমি-ইহা’ [I-It] দ্বারা। এখানে ‘ইহা’ হলো একান্তই বস্তুগত উপাদান। ‘আমি’র নির্মাণ হয়েছে বস্তুসত্তাকে সাপেক্ষে করে। অথচ সম্পর্কের দ্বিতীয় প্যাটার্নে [I-Tho] আমি [ও] পূর্বোক্ত ধারণা ‘আমি’ থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে। ‘আমি’ বস্তুগত কোনো কিছুকে নির্দেশ না করে নির্দেশ করছে প্রাণবন্ত এক সম্পর্কের স্বরূপকে। তবে সম্পর্কের দুটি ক্ষেত্রেই ‘আমি’ ধারণা দ্বারা কর্তা মানুষকেই ইঙ্গিত করেছ। সম্পর্কের এই স্বরূপ মার্টিন বুবার কীভাবে বুঝিয়েছেন, তা জানা যেতে পারে। একটি গাছ রূপক ব্যবহার করে বুবারের ধারণাকে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন। এখানে অন্তত পাঁচ ধরনের সম্পর্কের স্বরূপ খুঁজে পেয়েছেন।
ওপরের গাছটিকে আমরা অন্তত পাঁচটি পরিপ্রেক্ষিত থেকে ব্যাখ্য করতে পারি। এর সৌন্দর্য আমরা দেখতে পাই, উপলব্ধি করতে পারি। প্রাকৃতিক পরিবেশে এর অস্তিত্ব আমাদেরকে মুগ্ধ করে। আবার গাছটির বৃদ্ধি, তা-ও রয়েছে। শুধু এই গাছ অন্য সব গাছ থেকে যে আলাদা ও স্বতন্ত্রের, তা-ও আমরা দেখতে বা বুঝতে সক্ষম। গাছটি দেখার পরিপ্রেক্ষিত ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, “আমারই চেতনার রঙে পান্না সবুজ”—তেমনি ব্যক্তি তার চেতনা দিয়ে গাছটিকে উপস্থাপন করতে পারেন। এই যে ভিন্নতা, ভিন্নজনের ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ, তা-ই হলো পরিপ্রেক্ষিত। আর গাছটি ব্যাখ্যা দেবার সময় তার ডালপালার বিবরণ, তার অন্য বিষয়াদির জন্য গণিতেরও প্রয়োজন রয়েছে। লেভিনাস এসব দিক বিবেচনা করে বলছেন, গাছের ক্ষেত্রে সম্পর্কের অন্তত পাঁচটি ধারা সামনে আনা যায়: ক. প্রথমে রয়েছে ‘নান্দনিক প্রত্যক্ষণ’ [aesthetic perception], খ. গতিপ্রক্রিয়া সম্পর্কিত প্রত্যক্ষণ [perception movement], গ. আকার বা প্রকরণের দিক থেকে শ্রেণীকরণ [categorising by type], ঘ. পরিপ্রেক্ষিত [perspective] এবং ঙ. গাণিতিক ভাষায় ব্যাখ্যা [interpreting in mathematical terms]।
লেভিনাস স্বীকার করছেন, মানবজগতের দুই পরিপার্শ্ব রয়েছে। এই দুই পরিপার্শ্ব আবার মানুষের দুই মনোভাব কিংবা স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যক্তিসত্তা কিংবা ব্যক্তির জগৎকে মানুষ জানতে ও বর্ণনা করতে পারে দুই উপায়ে। একটি হলো বিষয়গত [objective] দিক, অন্যটি তার বিষয়ী [subjective] দিক। এই যে জগতের দুই প্রভাব তাকেই তিনি দুটি ভিন্ন অথচ ছোট শব্দে প্রকাশ করেছেন। এ দুটি মৌলিক শব্দ আবার দুই ভিন্ন ভিন্ন জোড়ে জোড়ে প্রকাশিত হয়: I-Tho, I-It। I-Tho সাপেক্ষে ‘আই’ হলো ব্যক্তিসত্তা, ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি person। আর I-It সাপেক্ষে ‘আই’ হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিগত, যাকে আমরা বলতে পারি individual। উভয়ের মধ্যে লেভিনাস পার্থক্য করেছেন। person একজন মানুষ যিনি সত্যিকার অর্থে বাস্তবিক অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারে। বুবার যে I-Thou আবিষ্কার করছেন, তার মধ্যেই রয়েছে ও। এর প্রতিপক্ষ হিসেবে রয়েছে অন্যসত্তা বা Thou। অন্য দিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য [individual] হলো তিনি, যিনি অন্যসত্তাকে তার অভিজ্ঞতার আলোকে দেখতে বা বুঝতে পারেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তার যা কিছু রয়েছে, বুবারের ভাষায় It এর আলোকে অপরকে বুঝতে পারা। তাহলে এখানে চারটি বিষয় রয়েছে, ইহা [It] : ব্যক্তি চারপাশ মিলে যা রয়েছে তা, আমি অর্থে ও: ব্যক্তি, অপর অর্থে দাউ [Tho], আমি ও অপর মিলে যে সত্তা তা I-Thou। এখানে রয়েছে দুই মনোভাব, দুই প্রকৃতি।
তাহলে জগৎ নিয়ে মানুষের রয়েছে দুই ভিন্ন মনোভাব: ‘আমি-তুমি’ আর হলো ‘আমি-ইহা’ [I-Thou or I-It]। আই-দাউয়ের সম্পর্ক হলো ‘বিষয়ী-হতে-বিষয়ীর’ [subject-to-object] সম্পর্ক। এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরস্পর সম্পর্কে সচেতন হয়, আর তা হয় মূলত সত্তার ঐক্য হিসেবেই। এ সম্পর্কে মানুষ কখনোই আলাদা করে তার নিজের নির্দিষ্ট ও বিশেষ গুণকে আলাদা করে বোঝে না, বরং পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সমগ্র সত্তার বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন হিসেবে তা ধরা পড়ে। তাহলে আই-দাউয়ের সম্পর্ক হলো আন্তঃসম্পর্ক ও সম্পূরকতার সম্পর্ক, কিন্তু ‘আমি’ [আই] এর সাথে যখন ‘ইহার’ [ইট] এর সম্পর্ক হয় তা হয় বিচ্ছিন্নভাবে, বিক্ষিপ্তভাবে। একজন মানুষ হয়তো তার বিষয়ী-হতে-বিষয়ী’র সম্পর্ককে পরিবর্তন করে বিষয়ী-হতে-বিষয়ীর [subject-to-object] সম্পর্কের দিকে, অথবা বিপরীতক্রমে নিয়ে যেতে পারে। বিষয়ীর যে সত্তা তা হলো ‘ঐক্য’, এই ঐক্যকে বিশ্লিষ্ট করে বিষয়ে পরিণত করা যায় না। কারণ, আমরা যদি বিষয়ীকে বিশ্লিষ্ট করে বিষয়ে পরিণত করি, তখন সেই বিষয়ী আর বিষয়ীই থাকে না। বরং তা বিষয়ে পরিণত হয়, তা আর দাউ [Tho] থাকে না, বরং তা ‘ইহা’ [It] পরিণত হয়। ধরা যাক কোনো সম্পর্কে বিষয়ীকে নির্বাচন করা হলো, অথবা I-Tho সম্পর্কের আলোকে করা হয়, কেবল তখনই তা বিষয়-হতে-বিষয়ী সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। আর এই সম্পর্কে বিষয় ‘আমি’ পূর্ণসত্তার অংশী হয়ে ওঠে।
উপর্যুক্ত ব্যাখ্যার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, মার্টিন বুবারের ধারণার ওপর ভিত্তি করে নীতিবিদ্যার একটি সংজ্ঞা দাঁড় করানোর প্রয়াস নিয়েছেন লেভিনাস। নীতিবিদ্যার ধারণাকে তিনি আবিষ্কার করেছেন দুজন ব্যক্তির ‘মুখোমুখি মোকাবেলা’ [face-to-face encounter] করার ধারণা থেকে। ব্যক্তি হয় তার নিজের খুব কাছাকাছি আসতে চায়, অথবা সে অন্য মানুষদের মোকাবিলা করে। এখান থেকেই লেভিনাস ধারণা করেন যে, আসলে প্রত্যেক মানুষই পরিণতিতে ‘অন্যসত্তায়’ পরিণত হয়। একজন মানুষ অন্য কারও মুখোমুখি হতে পারে ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিসর নিয়ে, যেখানে থাকবে বহুমুখী মনোভাব। এখানে এসেই তিনি অন্যসত্তাগত ধারণাটি ব্যবহার করেন। লেভিনাস গোটা বিষয়ের একটি স্পষ্ট ধারণা দেবার জন্য আরেকটি কৌশলী ধারণা ব্যবহার করেন: পালটে দেওয়া বা পাল্টানো কৌশল।
এই পরিববর্তন করার শক্তি যেভাবে আমাদেরকে উপস্থাপন করে তাই হলো স্বগতভাবে অন্যসত্তা, যা ন-আমিত্বকে বোঝায়। এর মধ্যেই আমাদের চিন্তা ও মনোভাব বন্দি হয়ে রয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে ‘আমি’ কে যে কি-না অন্যের প্রতি বিশেষ মনোভাব পোষণ করতে পারে? কিংবা আমি কে যে কি-না সকলের প্রতিই বিশেষ মনোভাব পোষণ করবে। লেভিনাসের মতে, এসব প্রশ্ন সকল সময়ই কোনো-না-কোনোভাবে আমাদের মনোভাব দ্বারা ও কিংবা মনোভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রকাশিত হয়ে থাকে। পরিণতিতে এসব প্রশ্ন অন্য মানুষ বা অন্যসত্তা সম্পর্কে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হই। এই আতঙ্কের একটি দার্শনিক সুরাহা করতে চেয়েছেন লেভিনাস।
পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতিক্রিয়ায় লেভিনাস
দর্শনের পাশ্চাত্য শুরুটা নিয়েই লেভিনাসের আপত্তি ছিল। পাশ্চাত্য philsophy শব্দের মধ্যে তিনি এর মানে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। যেমন, love of wisdom : জ্ঞানের প্রতি প্রেম, কিংবা জ্ঞানের জন্য প্রেম। লেভিনাস মনে করেছেন, wisdom of love বা প্রেমের জন্য জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি। গ্রিক দর্শন থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতিটি শাখা সম্পর্কে দেরিদার মন্তব্য হলো: এ দর্শনে অধিবিদ্যার উপস্থিতি বিরাজমান। সবাই তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন প্রভু-বয়ান নিয়ে। একটু ঘুরিয়ে লেভিনাস বলছেন, পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতিটি দিকই কোনো-না-কোনোভাবে সংকীর্ণতায় সীমায়িত: এখানে সত্য, জ্ঞান ও নিশ্চয়তার বাতাবরণে জ্ঞানের প্রতি প্রেমকে সমুজ্জ্বল করে তোলা হয়েছে। এতে ইচ্ছার ওপরে বুদ্ধিমত্তা ও সত্যের আদিত্ব অপেক্ষা শুভত্বের আদিত্ব গুরুত্ব পেয়েছে। সব মিলিয়ে লেভিনাসের দর্শনে:
—জ্ঞানকে চরিত্রায়ণ করা হয়েছে সক্রিয় থিমাটাইজেশনের মাধ্যমে [active thematisation]
—ধারণাগত সার্বিকীকরণ [generalization] এর লক্ষ্য হলো একত্রীকরণ, সাধারণীকরণ [generalisation], সামগ্রিকীকরণ [totalisation] ও সংমিলন [assimilation]।
এসবের কারণে জ্ঞাতা কিংবা জ্ঞানের বিষয়সমূহ তার অনন্যতা ও অপরত্ব [uniqueness and otherness] যেভাবে থাকে, তা হারায়ে ফেলে। যুক্তির প্রভাব বলয়ে, এবং পাশ্চাত্য চিন্তার সামগ্রিকীকরণের দায়ে “অন্যদের’ [ অপর বা আদারস] একইকরণের মধ্যে নিয়ে আসে। অপরত্ত্ব [আদারনেস] ও অপরের [আদার্স] মধ্যে যে সাংঘষিক সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে, তা নিয়ে কোনো ভাবনা কাজ করে না। এ জন্য পাশ্চাত্য দর্শনকে তিনি বলেছেন, এখানকার দর্শন মানেই হলো আত্মবাদ [every philosophy is an egolog]।
লেভিনাস দর্শনের জন্য নতুন স্বরূপ ও ধারা অনুসন্ধান করেছেন, যা জীবনের সঙ্গে খুব বেশি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক ও যোগাযোগ সৃষ্টিকারী। তিনি যে নৈতিকতার কথা বলেছেন, তা জ্ঞান ও জ্ঞানতত্ত্বের তথাকথিত সীমানা ডিঙিয়ে প্রাক্-প্রতিবর্তী [pre-reflective], প্রাক্-ধারণাগত [pre-conceptual] ও অ-মনোভাবজাত [non-intentional] একটি চরিত্র দেবার চেষ্টা করেছেন। দর্শনের মহা-আখ্যানকে সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। থেলিস আকাশে মেঘাচ্ছন্নতা দেখেছেন। দার্শনিকদের কাছে আকাশ কিংবা মেঘ বা জল গুরুত্বপূর্ণ হলেও আসল স্থান করে নিতে পারেনি। অ্যারিস্টটলের দর্শনেও তিনি এই অপপ্রয়াস লক্ষ করেছেন। অ্যারিস্টটল দাবি করছেন, ‘বিস্ময় থেকে’ জগতের সৃষ্টি। অথচ এই বিস্ময় কীভাবে সৃষ্টি হতে পারে: জগতের বিশাল মায়াজাল দেখে, নাকি মানুষের কিংবা অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে? এভাবেই ইতিহাস, বাস্তবতা, সত্তা ও সত্যকে অনুধাবন করার জন্য পাশ্চাত্য দর্শন নির্ভর করেছে অধিবিদ্যা ও ইগোলজির ওপর। তত্ত্ববিদ্যা বা অধিবিদ্যা আবিষ্কারে দার্শনিকদের হাজারো প্রচেষ্টা লেভিনাসকে বিস্মিত করেছে। এই অচলায়তন থেকে দর্শনকে রক্ষা করার জন্য লেভিনাস ‘অন্যসত্তার জন্য দর্শন’ ধারণা সামনে নিয়ে এসেছেন।
গ্রেকো-রোমান দার্শনিকদের মধ্যেও অফুরন্ত মেধা-শ্রম বিফলে দেবার দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রাচীন পারমানাইডিস থেকে শুরু করে হালের হাইডেগার পর্যন্ত সকল দার্শনিক ঐতিহ্য প্রভাবিত হয়েছে তত্ত্ববিদ্যা ও অধিবিদ্যা দ্বারা। এই আলোচনায় অন্যসত্তাকে পরিণত করা হয়েছে সমভবীকরণে বা একই রূপে। গ্রেকো-রোমান প্রভাব বলয় থেকে লেভিনাস বের হয়ে এসেছেন। তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন জার্মান অবভাসিক দর্শন দ্বারা। বিশেষ করে হুসার্ল ও হাইডেগারের দর্শন লেভিনাসকে পথ দেখাতে সাহায্য করেছে। হুসার্লের দার্শনিক অবভাসের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে তাঁর চিন্তা পাশ্চাত্য অন্যান্য দার্শনিকের থেকে আলাদা হয়েছে। এই পার্থক্য সৃষ্টি হবার পেছনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে তালমুদ। তিনি তালমুদ পাঠ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর। এ সম্পর্কিত পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝেছেন রাব্বি কী? একই সঙ্গে এই আলোচনার সামর্থ্যকে ব্যবহার করে তিনি ধর্মকে দার্শনিক পরিভাষায় বুঝতে চেষ্টা করেছেন। এই বোঝাপড়ার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্ট ও নৃশংসতার অভিজ্ঞতাও প্রভাব ফেলেছে।
পাশ্চাত্য দর্শনে ঈশ্বরের ধারণা ও থিওডেসি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে। প্লেটো ধারণা তত্ত্বের মধ্য দিয়ে বিমূর্ত সত্তাকে সামনে নিয়ে এসেছেন, আর দেকার্ত দার্শনিক পদ্ধতির নামে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। লেভিনাসের দৃষ্টিতে পাশ্চাত্য দর্শন পরিণতিতে থিওডেসিকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এই প্রাধান্যের বিরুদ্ধে লেভিনাসের অবস্থান লক্ষ করা যেতে পারে:
এক. ঈশ্বরের ধারণা প্রসঙ্গে লেভিনাস পাশ্চাত্য দার্শনিক অভিজ্ঞানের সমালোচনা করেছেন। ঈশ্বর ধারণার গতানুগতিক পাঠ পর্যালোচনা তাঁর দর্শনে এসে পাল্টে গেছে। ‘অপরত্ব’ বা ‘অন্যসত্তা’র প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী? অথবা কীভাবে আমরা তাকে পর্যবেক্ষণ করি, তার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ঈশ্বরের ধারণা প্রকাশ করেছেন। লেভিনাস বলছেন, শুভ বা ঈশ্বরের ধারণাকে সামনে রেখে আমরা ‘অন্যসত্তা’র মুখোমুখি হই। মানুষ সাপেক্ষে মানুষই অন্যসত্তায় পরিণত হয়, কিন্তু ঈশ্বর হলো অনন্য, যার কোনো অন্যসত্তা নেই, বিপন্নতা নেই। মানুষের পক্ষে ঐশীসত্তার অনুসন্ধান যেমন সম্ভব নয়, তার সংস্পর্শে যাওয়াও সম্ভব নয়। তবে মানুষ অপেক্ষা ঈশ্বর এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। একবার কেউ তার স্পর্শে এসেছে মানেই হলো সে তার অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ হয়ে গেল। একইভাবে ‘অন্যসত্তা’ আমাদের স্পর্শ করে। আমাদের জ্ঞান ব্যতিরেকেই সে অসীম শুভত্বকে উপলব্ধি করতে পারে। শুভ হলো অসীম। আর এই শুভ সকল সময় আমাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে। ঈশ্বর কখনোই প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সামনে ধরা দেয় না। এভাবে শুভ ও ঈশ্বর একাকার ধারণায় পরিণত হয়েছে।
খ্রিস্ট ধর্মতত্ত্বের ত্রিত্ববাদ লেভিনাসের দর্শনে এসে ভিন্ন দার্শনিকতা অর্জন করেছে। ত্রিত্ত্ববাদে পিতা ঈশ্বর [God the father], পুত্র ঈশ্বর [God the son] ও পবিত্র আত্মা [God the spirit]—এই তিনরূপই স্বরূপে প্রকাশিত হয়। ত্রিত্ববাদ লেভিনাসের কাছে তিন ভিন্ন ধারণায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর দর্শনে পিতা ঈশ্বর প্রকাশিত হয়েছে ‘অন্যসত্তায়’, আর পুত্র যিশু যেন মুখাবয়ব, আর পবিত্র আত্মা হলো আত্মসত্তা। আত্মসত্তা আর মুখাবয়ব হলো—আয়নায় নিজের মুখ দেখার সঙ্গে তুলনীয়। আত্মসত্তা হলো আয়না, সেখানে মুখাবয়ব হলো প্রতিচ্ছায়ার সঙ্গে তুলনীয়। নিজেকে আয়নায় দেখতে পাওয়া যায়, আর নিজের মধ্য দিয়ে অপরকে দেখার সাহস পাওয়া যায়। এ জন্যই তিনি তাঁর দর্শনের নাম দিয়েছেন ‘মুখাবয়ব দর্শন’ [face-to-face philosoph]। মুখাবয়ব দর্শনে সত্তা নিয়ে বলা হচ্ছে: প্রথমত সে হলো নগ্ন। চুলচেরা রূপের বিকার নিয়ে সে ধরা দেয়। আর দ্বিতীয়ত তার রয়েছে বিপন্নতা। যেমন, যখনই কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে, প্রথমেই আমরা তার মুখাবয়বকে দেখে নিই। এই যে দেখছি তা থেকেই মানব সম্পর্কের ভিত্তি নির্মিত হয়। মানবীয় সম্পর্কের ভিত্তি নির্মাণই লেভিনাসের ‘প্রথম দর্শন’ হিসেবে নীতিবিদ্যার কাজ।
দুই. ঈশ্বরের প্রসঙ্গ ধরে লেভিনাস থিওডেসির প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। এ আলোচনায় তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে অমঙ্গলের সম্পর্কের রেশটি নিয়ে প্রশ্ন করেন। এ প্রশ্নের একটি হলো: ঈশ্বর কেন মঙ্গলকে মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন? থিওডেসি শেষতক দাবি করে যে, আমরা ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডকে কার্যকারণিক সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি। কিন্তু, লেভিনাস দাবি করছেন, কোনোভাবেই আমরা থিওডেসিকে গ্রহণযোগ্য ভাবতে পারি না। কারণ, এর সাহায্যে কখনোই মানুষের পরম যে যন্ত্রণা, তাকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারি না। তবু মানুষ তার জীবনে ও যাপনে থিওডেসিকে আঁকড়ে ধরে। এই আঁকড়ে ধরার কারণ হিসেবে মানুষের আত্মতৃপ্তির দিকটিই তিনি লক্ষ করেন। এর মধ্য দিয়ে মানুষ ব্যাখ্যার উৎস খুঁজে পায়, নিশানা পায়। মনে হচ্ছে থিওডেসি মানুষের পথপ্রদর্শক। আস্থা ও বিশ্বাসের অধিস্থান, যা ভেবে ও যাতে অবস্থান করে মানুষ তৃপ্তি পায়। কিন্তু লেভিনাসের পর্যবেক্ষণ ভিন্ন। তিনি লক্ষ করেছেন, থিওডেসি শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরকে আবিষ্কার করা অপেক্ষা নিজের আত্মতৃপ্তির উপায়ে পরিণত হয়। তাঁর থিওডেসি-সম্পর্কিত আলোচনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছে:
ক. ঈশ্বর কেন শুভ ও কল্যাণময়? তাহলে যুদ্ধের মতো বিভীষিকা কেন পৃথিবীজুড়ে অস্তিত্বশীল? কিংবা ঈশ্বর যদি শুভ ও কল্যাণের উদ্যোক্তা হতেন, মঙ্গলের স্রষ্টা হতেন, নিশ্চিত তিনি পৃথিবীজুড়ে এই কল্যাণ ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠার জন্যই ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু, পৃথিবীজুড়ে আছে হিংস্রতা, বৈরী ও বিদ্বেষ। এর মানে কি ঈশ্বর এসবের আদিতে বিদ্যমান, যেখানে ঈশ্বরের একটু একটু ভূমিকা রয়েছে? থিওডেসি-সম্পর্কিত চিরায়ত ভাবনার সামনে লেভিনাস এসব প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
খ. আমরা যদি ধরে নিই, কোনো কিছুই কারণরহিত নয়। একটা কিছু ঘটার সঙ্গে আরেকটি কারণ থাকে, যা ওই ঘটনাটিকে ঘটতে সাহায্য করে। তাহলে নিশ্চয়ই ঈশ্বর সেই কারণ সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবহিত। যদি তাই হয়, তাহলে আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই জানেন। তাহলে সেই অগ্ন্যুৎপাত থেকে মানুষকে তিনি রক্ষা করেন না কেন? যুদ্ধের মতো নির্মমতা থেকে সে তার মানুষকে রক্ষা করেন না কেন?
যন্ত্রণা, দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্য উভয়ের মধ্যে দুঃখ ছাড়া আরও কিছু রয়েছে। অবভাসিক দিক থেকেও যন্ত্রণাকে বোঝা যায়। অনেক সময় যন্ত্রণা একধরনের অভিজ্ঞতা হিসেবেও প্রতিভাত হয়, যা পরখে প্রাপ্ত অর্থহীনতাও। অনেক দার্শনিকই বিশ্বাস করেন যে, দৃঢ় বিশ্বাসের কারণে কেউ হয়তো যন্ত্রণাকে সহ্য করতে পারেন, অথবা অন্ধবিশ্বাসের স্থান থেকে ‘যন্ত্রণার’ একটি সর্বোচ্চ অর্থ দেবার চেষ্টা চালাতে পারেন। অনেক সময় ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে ‘অকার্যকর কষ্টকেও’ [Entre nous] গুরুত্ব দিতে পারেন। বিশেষ করে লিবনিজ তাঁর থিওডেসিতে এই ‘অকার্যকর কষ্টকে’কে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। ইমানুয়েল লেভিনাস যন্ত্রণার এ ধরনের অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
থিওডেসিকে স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ হলো ‘যন্ত্রণার’ জন্য আলাদা করে শিক্ষাতত্ত্বকে স্বীকার করে নেওয়া। একে আরও কিছু বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেমন, আমাদের শরীরের বিশেষ এক অ্যালার্ম সিস্টেম রয়েছে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। আবার শরীরের কিছু সিস্টেম রয়েছে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারে। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া কাজ করে থাকে। কারণ, একজন অপরাধীকে শাস্তি দিলে গোটা সমাজের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। সব মিলিয়ে থিওডেসির দাবি হলো দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা আমাদেরকে জীবনের প্রতি সঠিক মনোভাব শেখাতে সাহায্য করে। লেভিনাস মনে করেন, থিওডেসির ঝুঁকি হলো তা আমাদেরকে দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার অধীনস্থ হতে শেখায়। বিশেষ করে আধ্যাত্মিক, অতীন্দ্রিয়বাদী ও সামষ্টিকতা অর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্ভোগকে জয় করা যায়। দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার অবভাসিক ব্যাখ্যা আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, এটি চেতনযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও, এ হলো অ-অনুমানযোগ্য। লেভিনাসের মতে, আমার প্রতিবেশীর দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার যৌক্তিক বিচারই যেন আমাদের অনৈতিকতার উৎসমূলে।
প্রতিনিয়ত আমরা যে ‘দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার’ অভিজ্ঞতা অর্জন করি তা অকার্যকর। অন্যের দুর্ভোগ-যন্ত্রণা ও বিপন্নতা বোঝার জন্য নিজের দুর্ভোগ ও যন্ত্রণাকে বুঝতে চেষ্টা করি, তখন আমাদের এই দুর্ভোগ একটি অর্থ পায়, ব্যক্তিকে কর্মে উদ্দীপ্ত করে। কার দুর্ভোগ বা বিপন্নতা? লেভিনাস বলছেন, সমাজে যারা যন্ত্রণা ভোগ করছে: জোর-জবর করে যাদেরকে আমরা অভিবাসী বানাচ্ছি তা হলো বিপন্নতার একটি দৃষ্টান্ত। এ দৃষ্টান্ত আমাদেরকে সহানুভূতি প্রদর্শনের দিকে গুরুত্বরোপ করে না, বরং আমাদের অস্তিত্বের উৎসকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে।
থিওডেসির আলোচনায় তিনি বলছেন, এর রয়েছে দ্ব্যর্থকতা ও অস্পষ্টতা। এই অস্পষ্টতাই হলো এর প্যাটার্ন। কিন্তু ‘দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার’ উপকরণকে অন্য কোনো উপকরণের সঙ্গে সংমিশ্রিত করলে তা যু্ক্তিসঙ্গত ও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। ‘দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা’ যখন অর্থহীন মনে হয়, কেবল একে অন্যের সঙ্গে সংমিলিত হয়েই এর অর্থ তৈরি হতে পারে। অন্তত পাঁচটি উপায়ে তা অর্থপূর্ণ, যুক্তিসঙ্গত ও উপকারী মনে করা যেতে পারে:
থিওডেসির প্রথম ও প্রধান উপকার হলো বৈচারিক লাভ। যেমন, কেউ যদি পাপ করে, তাহলে ঈশ্বর তাকে শাস্তি দেবেন, সমাজের কেউ যদি অপরাধ করে তাহলে তার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। এই বিধান হলো ন্যায্যতার প্রতীক। দ্বিতীয়টি হলো শিক্ষাতাত্ত্বিক লাভ [pedagogical benefit]: প্রত্যেক অর্জনেরই পেছনে থাকে শ্রম। এই শ্রমের সঙ্গে থাকে কষ্ট ও দুর্ভোগ। তৃতীয়ত, জৈবিক লাভ [biological benefit] হলো এক সতর্কসংকেত। এই সংকেত এমন যে তা আমাদের স্বাস্থ্যসংকটের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের প্রয়োজন হলো খুবই অল্প, আর যার প্রয়োজন নেই তা অনেক অনেক বেশি। চতুর্থত. সামাজিক লাভ [social benefit] হলো ‘যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ’ যা আমাদের চরিত্র গঠনে সাহায্য করে, বৃহত্তর সুবিধার অর্থে সমাজে বসবাসকারী হিসেবে ব্যক্তির জীবন-যাপনের ব্যয় নির্ভর করার জন্য প্রস্তুত করে থাকে, একই সঙ্গে যারা জটিল ও কঠিন মানুষ, তাদের প্রতি সহনশীল হতে সাহায্য করে, পঞ্চমত, আধ্যাত্মিক লাভ [social benefit] হলো আধ্যাত্মিক পরিপক্বতা ও প্রজ্ঞার জন্য ব্যক্তিকে যে মূল্য দিতে হয় তা। কারণ, একজন ব্যক্তি যিনি জানেন নৈতিক মন্দের কারণ কী, আর যিনি এ সম্পর্কে জানেন না এ দুজনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মন্দের কারণ জানা ব্যক্তি অজ্ঞাত ব্যক্তি অপেক্ষা বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেন। কারণ যন্ত্রণা সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তি জানেন এ পৃথিবীর ঝুঁকিসমূহ কী, এই ঝুঁকির ভয় সে অনুভব করতে পারে। একই সঙ্গে মানুষের হৃদয় বুঝতে সক্ষম ও অনুমান করতে তার সামনে কী বিপদ আসতে পারে। আমাদের কবির ভাষায় ‘... .../অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেয়/ তার বক্ষে বেদনা অপার/ তার নিত্য জাগরণ;/ অগ্নিসম দেবতার দান/ ঊর্ধ্বশিখা জ্বালি চিত্তে অহোরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ।’ সব মিলিয়ে বলা যায়, থিওডেসিতে কোনো আইনীয়, বৈচারিক, শিক্ষাতাত্ত্বিক, জৈবিক, সামাজিক অথবা আধ্যাত্মিক সুবিধা লাভের লক্ষণ লক্ষ করা যায় না। লিবনিজ ও তাঁর অন্যান্য অনুরাগী থিওডেসির আলোচনায় এসবের বাইরের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। যাহোক, থিওডেসিতে এমন সব আলোচনা থাকে যেখানে আমাদের অন্তরাত্মা শুধু দুঃসহ যন্ত্রণাময় জগতের বাইরের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ব্যস্ততা লেভিনাসের কাছে নিরর্থক। ধর্মতত্ত্ব উপর্যুক্ত পাঁচটি লাভের একটিও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে না। অর্থহীনতা ও অযৌক্তিকতা থিওডেসির প্রধানতম কাজ।
দুর্ভোগ থেকে মুক্তির উপায় কী?
শিরোনামের প্রশ্নের সদুত্তর লক্ষ করি লেভিনাসের দর্শনে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে সে দর্শনের নাম দিয়েছেন ‘প্রথম দর্শন’। প্রশ্ন হলো: প্রথম দর্শন [First philosophy] কী? তাঁর ভাষ্য অনুসারে, যৌক্তিকভাবে তত্ত্ববিদ্যা [ontology] থেকে দর্শন আলাদা। জ্ঞানের সর্বজনীন ও যৌক্তিক ভিত্তির পূর্বাকার অর্জন হিসেবে প্রথম দর্শনকে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। প্রথম দর্শনে পদ্ধতিগত কর্মসূচিসমূহ [systematic issues] আলোচনা করা হয়ে থাকে। দর্শনের ইতিহাসে দেকার্তই প্রথম অভিজ্ঞতা ও সচেতনতাকে দর্শনের মৌলিক প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যা সত্তাগত-ধর্মতত্ত্বের [onto-theologica] সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দেকার্তের এ বক্তব্য দর্শন আলোচনায় এক প্যারাডাইমেটিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।
আমরা লক্ষ করে দেখব, ধর্মতাত্ত্বিক অনুধ্যান [theocentric speculation] সকল সময় মানব-জাগতিক সমস্যা অথবা নানন্দিক সমস্যার আগে আলোচনায় নিয়ে আসা হয়। একই সঙ্গে মনে করা হয়, এ ধরনের অনুধ্যান জ্ঞানের সর্বজনীন ভিত্তি দিতে পারে। আমরা যদি দর্শনের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে তত্ত্ববিদ্যক প্যারাডাইম নির্মাণের ধারাটি শুরু হয়েছে থেলিসের আলোচনা দিয়ে। গ্রিক দার্শনিক পারমানাইডিসও মনে করতেন ‘চিন্তা ও সত্তা’ মূলত এক। দার্শনিক হিরাক্লিটাস মনে করতেন, জাগতিক বস্তু যা কিছুকে আমরা স্থির হিসেবে দেখি, তারা আসলে পরিবর্তনশীল, সতত পরিবর্তন তাদের মধ্যে থাকে। এ জগৎ একটা ফ্লাক্সের মতো, এর সুনির্দিষ্ট কোনো গঠন-কাঠামো নেই। বিপরীত দিকে, পারমানাইডিস যুক্তির ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্তে পৌঁছেছেন। হিরাক্লিটাস ও পারমানাইডিসের চিন্তার অপূর্ব সমন্বয় হয়েছে প্লেটোর দর্শনে। হিরাক্লিটাসকে অনুসরণ করে প্লেটো দাবি করেছেন, জগতের সত্যিকার ও বাস্তবভিত্তিক কোনো অস্তিত্ব নেই। আবার পারমানাইডিসকে অনুসরণ করে তিনি বলছেন, এ বস্তুজগৎ হলো অনন্ত সত্তার সতিক্যর অনুলিপি। প্লেটো আকারের কথা বলেছেন। প্লাটোনিক আকারকে আমরা সরাসরি অনুধাবন করতে পারি না। বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে তা বুঝতে পারি। লেভিনাস তাঁর ‘প্রথম দর্শনে’ যুক্তি, পরিবর্তন ও অনুলিপিকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। স্থির ও স্থায়ী এবং আকার ও বিমূর্ত উভয়কে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্লেটোর দর্শনে লেভিনাস যে সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন তা হলো—তিনি অধিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ও নীতিজ্ঞানকে একই সমতলে এনে দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু ইমানুয়েল লেভিনাস এদের পরস্পরের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন পারস্পরিক বিরোধ। তাঁর বক্তব্য হলো দর্শন কখনোই তত্ত্ববিদ্যা অথবা চিন্তার কোনো আকারগত প্রকরণ দিয়ে শুরু হতে পারে না। আর পাশ্চাত্য দর্শনের একটি বড় সংকট হলো স্থায়িত্ব ও প্রপঞ্চকে দার্শনিক উপকরণ হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া। তাঁরা প্রপঞ্চকে মনে করেছেন স্থায়ী ও বাস্তব। লেভিনাস এ মতধারার বিরোধী। দর্শন শুধু সচেতনতা সম্পর্কে প্রশ্ন করে থাকে। স্থায়িত্ব ও চিরন্তনতা নিয়ে কাজ করে থিওডেসি, এ দর্শনের কাজ নয়। হতে পারে যা নিজেদের দিক থেকেই প্রশ্ন করার দাবি রাখে। দর্শনের ভিত্তি হিসেবে তত্ত্ব, অধিবিদ্যা ও থিওডেসি কোনো কিছু থাকতে পারে না। এক বিশেষ চেতনার স্তর থেকে দর্শনের জন্ম। এই চেতনার স্তরটিকে তিনি নাম দিয়েছেন নৈতিকতা: নীতিবিদ্যা। এ কারণে তিনি ‘প্রথম দর্শন’ বলতে নীতিবিদ্যাকে বুঝিয়েছেন। তাহলে চেতনার জন্ম বা উন্মেষ হয় কীভাবে? লেভিনাস বলছেন, কোনো কিছু স্বশাসিত, স্বয়ংম্বর—এ রকম ধারণা থেকে তিনি বের হয়ে এসেছেন। চেতনার জন্ম হয় অন্যব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে। এ জন্য চেতনার [consciousness] সংজ্ঞায় লেভিনাস বলছেন, চেতনার জন্ম হয় তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতিতে। আর এভাবে প্রথম দর্শন হলো: অস্তিত্ব ও চিন্তার সম্ভাবনাকে সংজ্ঞায়ন করার প্রয়াস। তাহলে এটা বলাই সঠিক যে, প্রথম দর্শনের সূত্রপাত অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে। আর প্রথম দর্শন বলতে নীতিবিদ্যা ছাড়া অন্য কিছুকেই বোঝায় না।
নীতিবিদ্যাই ‘প্রথম দর্শন’ এ কথা দ্বারা লেভিনাস বোঝাচ্ছেন যে, ‘নীতিবিদ্যা হলো আয়না’। অনুরাগীর মধ্যে নীতিবিদ্যা লেন্সের মতোই কাজ করে। চোখের লেন্স যেমন প্রতিসারক হিসেবে কাজ করে, কোনো কিছু দেখার ক্ষেত্রে উপযোজনে সহায়তা করে। নৈতিকতা হলো তেমনি এক লেন্স যাতে মানুষের জিজ্ঞাস্য প্রশ্নসমূহ এখানে উপস্থাপিত হয়। তবে যুক্তিবিদ্যা, কিংবা অধিবিদ্যা যেভাবে সত্তা, বাস্তবতা ও সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে ‘প্রথম দর্শন’ হিসেবে, নীতিবিদ্যা তা করে না। এ হলো ফেস-টু-ফেস এনকাউন্টার যেভাবে উন্মেষিত ও পুনর্ব্যক্ত হয় তারই ব্যাখ্যামূলক ও অবভাসিক বর্ণনা। আবার প্রাক্-জ্ঞানিক পর্যায়ে এ হলো আন্তঃবিষয়ী সম্পর্ক। এ পর্যায়ে ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও রপ্ত আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন, যে পরিবারে পিতা-মাতা জিউসদের অপছন্দ করে সেই অপছন্দের ধারা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে প্রশ্নাতীতভাবে। এ হলো আন্তঃবিষয়ী সম্পর্কের একটি দিক। লেভিনাস প্রাক্-জ্ঞানের এই সনাতন ধারাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্রশ্ন হলো, ‘প্রথম দর্শন’ বলতে লেভিনাস কী বুঝিয়েছেন? প্রথম দর্শন বলতে বুঝিয়েছেন ‘আত্মসত্তা’কে যা কিনা তার নিজেকে একজন বিষয়ী হিসেবে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে। এই বিষয়ী আবার অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে। এ যদি হয় দর্শনের কাজ তাহলে এর সঙ্গে যুক্ত পরবর্তী প্রশ্ন হলো—সত্তা কী? এক সত্তার সঙ্গে অন্যসত্তার সম্পর্ক কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে পাশ্চাত্য দার্শনিকেরা ব্যস্ত রয়েছেন। কিন্তু এসব প্রশ্ন কখনোই দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন হতে পারে না। আবার নীতিবিদ্যার কাজও নৈতিক বিচারের মানদণ্ড আবিষ্কার নয়, বরং কীভাবে আমরা নিজেদের মুখোমুখি হতে পারি, কীভাবে আমরা নিজেকে ‘অপরের’ সঙ্গে বুঝতে পারি, তাই হলো নৈতিকতার ভিত্তি। পাশ্চাত্য দর্শন ও নীতিবিদ্যার আলোচনার এই যে গতানুগতিক স্টাইল লেভিনাস সেই স্টাইলটি ভাঙতে পেরেছিলেন। এ ভাঙাগড়ার খেলায় দর্শন ও নীতিবিদ্যার প্রচলিত সব পাশ্চাত্য বয়ানকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন।
লেভিনাসের সমগ্রতা ও অসীমত্বের ধারণা প্রসঙ্গে
১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর Totality and Infinity: An Essay on Exteriorit গ্রন্থটি। তত্ত্ববিদ্যার ওপর লেভিনাসের আস্থা ছিল না। এ ধরনের দার্শনিক চিন্তা প্রক্রিয়া অন্যসত্তার সঙ্গে সম্পর্কের ধরনকে সমভবীকৃত করে। কিন্তু লেভিনাস যে চিন্তা ও দর্শনের কথা বলেছেন, তা অন্যসত্তাকে হ্রাসকরণ করে সমভবীতে নামায় না। আবার, অগভীর ও বাহ্যিকতা [externality] এমন এক সম্পর্কের ধারা যেখানে আত্মসত্তাকে অন্যসত্তা থেকে আলাদা করে রাখে। বাহ্যিকতা সম্পর্কের এমন রূপ এখানে আত্মসত্তা ও অন্যসত্তা গড়পড়তা হিসেবে থাকে, কিন্তু সমন্বিত হয় না, কিংবা অসীমত্বের মধ্যে পতিত হয় না। কারণ, এরা পরস্পর থেকে আলাদা, পৃথক। আবার আন্তরবিষয়ীগত [intersubjectivity] হলো অন্তবর্তিতা [interiority] থেকে উৎপন্ন। অন্তবর্তিতা বিষয়ীগত একই প্রতিবেদনকে ইঙ্গিত করে যেখানে সত্তা নিজেই নিজেকে সামনে তুলে ধরে, উল্লেখ করে। বিষয়ীগততা একই সঙ্গে অন্যসত্তা থেকে নিজেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র করে রাখে। তাহলে আন্তরবিষয়গততার সঙ্গে অন্তবর্তিতার একটি যোগাযোগ রয়েছে। এর প্রতিস্থলে লেভিনাস বলেছেন, সত্তার বাহ্যিকতাকে গুরুত্ব দেবার জন্য এতে করে আত্মসত্তা কখনোই সমগ্রের মধ্যে একাকার হয়ে যায় না।
তিনি পাশ্চাত্য দর্শনে বিদ্যমান চিন্তার ব্যবচ্ছেদ করেছেন। তাতে তিনি দুটি ধারণা সমগ্র ও অসীমত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। লেভিনাস লক্ষ করেছেন, পশ্চিমা দর্শনের শুরু থেকে এ ধারণা দুটিকে বিশেষ আঙ্গিক থেকে দেখবার প্রয়াস নিয়েছে। গোটা পাশ্চাত্য দর্শনের ধারা হলো tradition of totality। পাশ্চাত্যের এই পরস্পরাগত ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিয়েছেন। একই সঙ্গে অসীমত্ব হলো অতীন্দ্রিয় ধারণারই এক তথাকথিত নির্মাণ। পাশ্চাত্য দর্শনে ‘সামগ্রিকতা’ ও ‘অসীমত্ব’ পরস্পরাগত ঐতিহ্যের ধারা থেকে বের হয়ে দুটি ধারণা নির্মাণ করতে চেয়েছেন। যেমন, সামগ্রিকতা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, the Same [le Meme]: ‘একই’ বা সমভাবাপন্নতাকে। আর অসীমত্ব বলতে বুঝিয়েছেন, Other [l'Autre]: এক ও অভিন্ন [যাকে লেভিনাস বলেছেন, Other [l'Autre] ধারণাটির প্রকাশ হলো একচেটিয়া অহং [monopolistic ego] এর আচরণগত স্বরূপেরই বস্তুনিষ্ঠ প্রকাশ। আর ‘অন্যসত্তা’ হলো Other, যা মানুষের মুখাবয়বের [human face] মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। ‘একই বা এক’ ও ‘অন্যসত্তা’ উভয়ই একই ব্যক্তির দুই প্রকাশ।
সামগ্রিকতার মতো অসীমত্বও আরেকটি সংকট। Other/অন্যসত্তা সাপেক্ষে অসীমের ধারণা হলো অতীন্দ্রিয়তারই এক ধারা।
মুখাবয়ব অন্যসত্তার মুখচ্ছবি/মুখাবয়ব হলো যার ভেতর দিয়ে ‘অন্যসত্তা’ নিজেকে মেলে ধরে। সত্তার বাহ্যিকতাকে এই মুখাবয়ব প্রকাশ করে। এ হলো প্রকাশের সঠিক ও যথারীতি প্রক্রিয়া। লেভিনাস নৈতিকতাকে বোঝাতে গিয়ে ফেস-টু-ফেস সম্পর্কের বিষয়টি এনেছেন। এ জন্য ফেস-টু-ফেস সম্পর্ককে নৈতিক সম্পর্ক হিসেবে উল্লেখ করেন। এটি হলো আত্মদায়িত্বশীল হবার স্বাধীনতা। অন্যসত্তার মুখাবয়ব আমাদের সঙ্গে কথা বলে। ভাষা শুরু হয় মুখাবয়বের উপস্থিতিতে, আমরা নিজেকে যখন অন্যের সামনে মেলে ধরি, তার প্রকাশভঙ্গি হলো অভিব্যক্তি। ভাষা হলো পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া করার এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে অন্যসত্তার মুখাবয়ব দেখে ভাষা তার অর্থ দেয়। এখানে অন্যসত্তা হলো সিগনিফায়ার। সাইন/চিহ্ন উৎপাদনের ভেতর দিয়ে ভাষার মধ্যে অন্যসত্তা প্রস্তুত হয়। কিন্তু, অন্যসত্তা কখনোই থিমাটাইজড করা যায় না। কারণ, কোনো কিছু থিমিং করার অর্থ হলো একে অবজেক্টিফিকেশন করার শামিল।
সমগ্রতা ও অসীমতার আলোচনা নির্মাণের লক্ষ্যে পাশ্চাত্য অধিবিদ্যার ও দেকার্তের সামলোচনার প্রতি লেভিনাস সপ্রশংস প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। এ সমালোচনা দ্বারা তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। হুসার্ল ও সার্তে যে দেকার্তকে আবিষ্কার করেছেন, তা থেকে ভিন্ন পরিসরে তিনি দেকার্ত দেখেছেন। লেভিনাস এ দেখার পেছনে সমগ্রতার ধারণাটি রেখেছেন। যেমন, দেকার্ত দ্রব্যের [substance] কথা বলেছেন। তিনি বলছেন, ‘আমার মধ্যে দ্রব্যের ধারণা রয়েছে। এর কারণ হলো, আমি নিজেই একটি দ্রব্য। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আমার মধ্যে অসীম দ্রব্যের ধারণা রয়েছে, যেখানে আমি নিজে এক সসীম দ্রব্য। অসীমত্বের ধারণার জন্য অবশ্যই সে রকম অসীম কোনো দ্রব্য দিয়ে শুরু করতে হবে।’ ‘আমি চিন্তা করি’ ধারণার মধ্যে দেকার্ত তিনি নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। দেকার্তের এই যুক্তিবাদিতা থেকে হুসার্ল দাবি করছেন, ‘আমি আছি’ তা থেকে তিনি অসীমত্বের ধারণা পেয়েছেন। কিন্তু হাইডেগার তাঁর পরিবেশনার যে সমালোচনা করেছেন, তাতে দের্কাতীয় বুদ্ধিবাদিতার সীমাবদ্ধতা দেখেছেন। অসীমত্বের ধারণা পরিবেশনার সীমাবদ্ধতাকেও অতিক্রম করে যায়। যে দৈহিকতার এর জন্ম তাকেও সে ছাড়িয়ে যায়। মূলত ego cogito যে চিন্তা ও পরিবেশনার উৎস, তা-ও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। লেভিনাস দেকার্তের চিন্তাসূত্রে ব্যবহৃত ‘আমি’ এর আদিত্ব দূর করার জন্য কোথাও হাইডেগারের সাহায্য নিয়েছেন আবার কোথাওবা বিরোধিতা করেছেন।
তাহলে ‘প্রথম দর্শন’ কী?
আলোচনার শুরুতে আমরা উল্লেখ করেছি নীতিবিদ্যা বলতে লেভিনাস কী বুঝিয়েছেন? নীতিবিদ্যা কী? কিংবা কী হওয়া উচিত? গোটা আলোচনায় তিনি এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেননি। নৈতিকতা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি ফেস-টু-ফেস [face-to-face] ধারণা ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে তিনি দেখিয়েছেন, নৈতিক সচেতনতা হলো অন্যসত্তার বিপন্নতাকে বস্তুনিষ্ঠ করা। এই বস্তুনিষ্ঠতাকে তিনি দি ফেস [মুখাবয়ব] হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, মুখাবয়ব ভাষাকে অনুগামী করে। একটি ফেস যখন আরেকটি ফেসের মুখোমুখি হয়, একজন দুঃখী মানুষ যখন অন্য মানুষের দুঃখ বুঝতে পারেন—এই বোঝা-পড়ার মধ্য দিয়ে নৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। তাহলে নৈতিকতা কোনো বিধিবদ্ধ নীতি বা মানদণ্ড নয়। নীতিবিদ্যার এই নতুন ধরন লেভিনাসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে তিনি ‘প্রথম দর্শন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। কয়েকটি দিক থেকে তাঁর অবস্থানটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে:
এক. সমাজ ছাড়া মানুষ বাস করতে পারে না। সমাজের মধ্যেই মানুষের বাস। সমাজে বাস করেই মানুষ পারে একটি অর্থপূর্ণ জীবনের অধিকারী হতে। একই সঙ্গে মানবমূল্যকে মর্যাদাকে দিতে শেখে। এই মর্যাদার ভিত্তিতেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ গড়ে তুলতে তাগিদ বোধ করে। আর সেই আস্থা ও অস্তিত্বশীলতা মানুষের খুঁজে ফেরা উচিত যেখানে কোনো মিথ্যাচার, ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা অথবা শঠতা নেই।
দুই. নৈতিকতায় মুখাবয়বকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন লেভিনাস। এর মধ্যে রয়েছে এক নৈতিক অনুজ্ঞা: যেমন, কারও ক্ষতি করো না, অনেকটা এ রকম স্বরূপে মুখাবয়ব কাজ করে। আমরা সমাজে যে জীবন যাপন করি তা নানা রূপ ও বৈচিত্র্যের মিশেল মাখানো। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ব্যক্তি যখন অন্যদের সঙ্গে সঠিক ও যথাযথ মিথস্ক্রিয়ায় এগিয়ে যেতে পারে, তবেই সে জীবন ‘শুভ জীবন’ বা কল্যাণময় জীবনের অধিকারী হয়। একই সঙ্গে: ১. অন্য মানুষের যে স্বাতন্ত্র্য ও অনন্যতা রয়েছে তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি, ২. এই উপলব্ধির কারণে আমরা অন্য মানুষের ক্ষতি থেকে নিজেকে বিরত থাকতে পারি, ৩. একই সঙ্গে অন্য মানুষের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ববোধ রয়েছে, তা আমরা সঠিকভাবে পালন করতে পারি। সব মিলিয়ে সেই জীবনই ন্যায় ও মঙ্গলময় জীবন হয়ে উঠতে পারে, যেখানে স্বার্থপরতা নেই।
উপর্যুক্ত আলোচনা অনুসারে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, লেভিনাস দুটি অবস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে চেয়েছেন: একটি আত্মসত্তা, অন্যটি পরত্ব। আর ফেস-টু-ফেস ভাবনায় তিনটি ধারণা পাওয়া গেল: এক হলো মুখাবয়ব, দ্বিতীয়ত আত্মসত্তা, আর শেষতক হলো অন্যসত্তা—এই তিন হলো লেভিনাসের দর্শনের মৌলিক চিন্তা। এদের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিটি তিনি অনুসন্ধান করেছেন দায়িত্বশীলতার মধ্যে, কোনো প্রকার সম্পূরকতার মধ্যে নয়। যেমন, আমি অন্য কারো ক্ষতি করব না, তুমিও আমার ক্ষতি করো না। এটার কারণ এই নয় যে, আমিও প্রত্যাশা করি তুমি আমার ক্ষতি করো না। এর বড় কারণ হলো আমি তোমার ক্ষতি করতে চাই না। এ আমার মনোভাব ও দায়িত্বশীলতার বিষয়। এ রকম সম্পূরক সম্পর্ক নৈতিকতার সম্মানজনক ভিত্তি তৈরি করে না।
অধিবিদ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াব কীভাবে?
পাশ্চাত্য দর্শনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস লেভিনাস পেয়েছেন মার্টিন হাইডেগারের কাছ থেকে। বিশেষ করে পাশ্চাত্য অধিবিদ্যার বিরুদ্ধে হাইডেগারের অবস্থানটি তিনি লুফে নিয়েছেন। আমি আমার নিজেকে জানি, এ জানার মধ্য দিয়ে আমি আমার নিজের সম্পর্কে সচেতন হই। শুদ্ধভাবে আমি আমার নিজেকে চিনি, সচেতন হই আমার সচেতন জীবন সম্পর্কে। এ হলো বিশুদ্ধ আত্মানুসন্ধান। এই বিশুদ্ধতা দেকার্তীয় পরিভাষা দিয়ে বোঝা যায়। বিশেষ কোনো দৈশিক বাস্তবতায় আমি শুধু আমার দৈহিক অস্তিত্বই খুঁজছি না। এখানে এসে আমি আমার দেহ/ দৈহিক অবস্থাকে এক পাশে রাখছি। আমার আমির পাশাপাশি আরেক আমিকে খুঁজছি তা হলো আমার চেতনার মধ্য দিয়ে অন্যের চেতনা। হুসার্ল খুঁজেছেন বলছেন অতীন্দ্রিয় সত্তা। এর মাঝে বিষয়ী ও অভিজ্ঞতার কর্তা হিসেবে সে প্রকাশিত। আমরা লক্ষ করে দেখব, হুসার্ল তাঁর ১৯২৩ থেকে ১৯২৪ সালের রচনাসমূহে অবভাসবাদী প্রকল্পকে আত্মবাদ হিসেবেই প্রকাশ করেছেন।
এডমুন্ড হুসার্লের জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ Logical Investigation প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। উক্ত গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যে ছিল ‘সমগ্রের’ সঙ্গে ‘অংশের’ সম্পর্ক কী তা দেখানো। আর দর্শনের আলোচনায় মনোবৃত্তি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে। চিন্তারও চিন্তা আছে। আমরা যা নিয়ে চিন্তা করি, তার সঙ্গে সম্পর্কের স্বরূপটি কী, কিংবা আমাদের চিন্তা কীভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করে, তা দেখানোর উপায় হিসেবে হুসার্ল intentionality ধারণাটি ব্যবহার করেছেন। এদিক বিবেচনায় রেখে আমরা এর বাংলা পরিভাষা হিসেবে মনোভাব পোষণ করার উপায়, সংক্ষেপে মনোবৃত্তি ধারণাটি ব্যবহার করছি। হুসার্ল বলছেন, মনোবৃত্তির দুটি দিক রয়েছে, প্রথমত, যে বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তা করি. সেই বিষয়টিকে আমাদের মনের কাছে উপস্থাপিত হয়। দ্বিতীয়ত, উপস্থিত হয় নৈর্ব্যক্তিকভাবে। তাহলে একটি বিষয় স্পষ্ট, এই হাজির হবার ঘটনাটি ‘মনের মাধুরী মিশিয়ে’ নয়, বরং এর বস্তুগত স্বরূপটি যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই আমাদের সামনে উপস্থিত করে। এদিক বিবেচনায় রেখে বস্তুনিষ্ঠতা প্রদানকারী এক ক্রিয়া হিসেবে মনোবৃত্তিকে বুঝেছেন। এই আলোচনার ভেতর দিয়ে হুসার্ল অবভাসবাদ বা প্রবঞ্চবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন।
বস্তুনিষ্ঠতা প্রদান করা মানেই কোনো কিছুকে মূর্তমান করে তোলা। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে বোঝানো যেতে পারে। আমি যখন রাঙ্গামাটির ‘শুভলং’ পাহাড় দেখি তা হলো ওই পাহাড়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান। অফিসে বসে যখন পাহাড়ের কথা চিন্তা করি তখন এ পাহাড় আমার চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়। এর সম্পর্কে নানান ধারণা ও প্রত্যয় গড়ে ওঠে। এই ধারণা থেকে ওই পাহাড় সম্পর্কে তত্ত্ব করি, কিংবা তা তত্ত্বগত রূপ অর্জন করি। ভোলা যাবার পথে যে মেঘনা দেখে এসেছি, আমি তা নিয়ে যখন চিন্তা করি, অবভাসিকভাবে সে আমার সামনে উপস্থিত না-ও থাকতে পারে। কিন্তু সেই নদী, দুপাড়ের দৃশ্য—এসবই পুরোপুরি স্পষ্ট না-ও হতে পারে। আমি যখন মেঘনা নদী নিয়ে ভাবছি, তখন তার পুরোপুরি উপস্থিতি, সামগ্রিক উপস্থিতি না-ও থাকতে পারে। নদীর বাঁক, কোথায় কতটুকু পানি, কোথায় জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য অথবা অন্য কোনো কিছু—সে সবকিছু আমার ভাবনায় না-ও থাকতে পারে। নদী ঘিরে নতুন ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে, ভাবনার সঙ্গে অভিজ্ঞতা যুক্ত হতে পারে। অথচ আমি যখন নদী নিয়ে ভাবছি, তখন শুধুই তাৎক্ষণিক যেসব ভাবনা আছে, সেগুলো আমাদের সামনে হাজির হতে পারে।
হুসার্ল পাশ্চাত্য দর্শনের ভিত্তিতে আঘাত করেছেন। দেকার্তকে তিনি নতুন আঙ্গিকে দিলেন। অনেক ক্ষেত্রে দেকার্তের সঙ্গে পার্থক্যও সৃষ্টি করলেন। ১৯৩১ সালে এ ভাবনার আলোকে লিখলেন: Méditations cartésiennes, হুসার্লের পথ অনুসরণ করেই হাইডেগার ও মার্লো পন্তি পাশ্চাত্য দার্শনিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেছেন। হুসার্ল মানুষের মনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কারণ, মনই পারে বস্তুর দিকে নিবন্ধিত হতে। যেমন, আমি যদি আকাশের চাঁদের দিকে তাকাই, তাহলে আপাতত বোঝা যেতে পারে যে, আমার দৃষ্টি চাঁদের দিকেই নিবন্ধ। কিংবা আমি শুধু চাঁদই দেখছি। অথচ এই চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি আমার প্রিয়তমার কথা ভাবতে পারি: ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’, ‘চাঁদ হেরেছে চাঁদ মুখ তার সরসীর আরশি’তে’ অথবা রবিঠাকুরের ভাষায়: ‘ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে/ ধরা দিয়েছ যে আমার... পাতায় পাতায় ডালে ডালে।’ কিংবা মান্না দের কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গান: ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে/ কারো নজর লাগতে পারে।’ ওই একই চাঁদ কখনো সৌন্দর্য, কখনোবা রূপ, কখনোবা প্রেমিকার মুখাবয়ব, কিংবা অন্য কিছু হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। একই চাঁদ নিয়ে এতভাবে ভাবার শক্তি ও সুযোগ কেবল মনেরই আছে। হুসার্লও বলছেন, কেবল মনেরই রয়েছে টকে অনন্য বৈশিষ্ট্য যে কিনা নানা আঙ্গিকে, রূপে মনের প্রতি নিবন্ধ হতে পারে। মনের এই অনন্য বৈশিষ্ট্যটিকে হুসার্ল মনোবৃত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
মন যে এত রূপে একই সঙ্গে একই বিষয় সম্পর্কে নিবন্ধ হতে পারে, তার অর্থ হলো মনের মধ্যকার অবস্থিত আধার, এটাকে তিনি নাম দিয়েছেন মনোবৃত্তিগত উপাদান। মনোবৃত্তিগত উপাদান হলো আমাদের মনের বিশেষ ক্ষমতা, একে হুসার্ল বলেছেন বর্ণনাক্ষমতা। মানুষের মধ্যে এই বর্ণনাক্ষমতা রয়েছে বিধায়ই কোনো বিশেষ বস্তুকে সে নানা আঙ্গিকে, নানা রূপে ও আকারে স্মরণ করতে পারে, কামনা করতে পারে। মনের এই অসীম গুণকে বোঝানোর জন্য তিনি মনোবৃত্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। দুটি কারণে হুসার্লের কাছে মনোবৃত্তি ও মনোবৃত্তির উপাদান ধারণাসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, ‘টেবিলটি কি আছে, বা নেই?’ এ প্রশ্ন হুসার্লের কাছে জরুরি নয়। টেবিলটিকে তিনি ধরে নিতেন যে ‘আছে’। আছে কিংবা নেই এই তর্কে না গিয়ে ‘আছে হিসেবে ধরে নিয়ে’ কাজ চালাতেন। এই ধরে নিয়ে কাজ চালানোর তার প্রক্রিয়াটিকে তিনি অবভাসিক হ্রাসকরণ [phenomenological reduction] হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ধরে নেবার ফলে যেটা হয়েছে:
[১] এর বস্তুগত অস্তিত্বের জন্য অনুসন্ধানে তৎপর হতে হয় না,
[২] ধরে নিয়েছি বলেই টেবিলটির অস্তিত্ব আমাদের কাছে আছে,
[৩] টেবিলের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা সংশয়াতীত,
[৪] মনোবৃত্তি উপাদান হলো স্বপ্রমাণিত। এর প্রমাণের জন্য অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করতে হয় না, তাই এ ছাড়া কোনো অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব নয়। দেকার্ত অতীন্দ্রিয় যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। হুসার্ল নির্ভর করেছেন ‘মনোবৃত্তি’র ওপর। এ জন্য হুসার্ল দাবি করেছেন যে, যেকোনো বস্তুকে প্রথম তার নিজের মতো করে পরিবেশিত হতে দিতে হবে।
—পূর্বানুমানের প্রয়োজন নেই
—নিজের মতো করে প্রকাশিত হতে দিতে হবে। তারপর ওই প্রকাশিত রূপটাকে বর্ণনা করতে দিতে হবে
—ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন নেই।
হাইডেগার তাঁর বিভিন্ন লেখায় একটি উদাহরণ প্রায়ই ব্যবহার করতেন: ‘হাতুড়ি পেটানো’। একজন সুতোর হাতুড়ি দিয়ে কাঠে পেরেক ঠুকছেন। সব ঠিকঠাক থাকলে বোঝা যাবে: তিনি হাতুড়ি পেটাচ্ছেন কিন্তু তিনি হাতুড়ির উপস্থিতি আর টের পাচ্ছেন না। কারণ, হাতুড়ি কীভাবে কাজ করছে তা নিয়ে মোটেই তিনি ভাবছেন না। তিনি ভাবছেন কীভাবে পেরেকটি কাঠে ঢোকানো যায়। কারণ, তাঁর দৃষ্টি হাতুড়ির প্রতিবির্নিষ্ট নয়। তিনি এ কাজের বৈশিষ্ট্যের কারণে হাতুড়ির কথা না ভেবে ভাবছেন পেরেকটি কীভাবে ঠোকানো যায় সে বিষয়ে। আবার তিনি যদি খুব ভালো মানের একজন সুতার হোন, তাহলে তিনি হাতুড়ি কিংবা পেরেক—কোনোটি নিয়েই ভাববেন না। তিনি কাজ করবেন আর অনায়াসে তাঁর বন্ধুর সাথে কথা বলবেন। মনে হবে যেন হাতুড়ি কিংবা পেরেক ঠোকানো তাঁর কাজ নয়। এ হলো খুব সঙ্গতভাবে, পরিচ্ছন্নভাবে কোনো বিশেষ পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। গোটা পরিস্থিতির সঙ্গে এই মানিয়ে চলাকে হাইডেগার বলছেন ‘স্বচ্ছতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া’। তিনি স্বচ্ছতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ধারণাটি কেন ব্যবহার করেছেন? একটি কাচ যদি স্বচ্ছ হয়, তাহলে ব্যক্তি তাঁর মুখচ্ছবি থেকে শুরু করে সবই দেখতে পাবেন। এই দেখতে দেখতে তিনি আর কাচের কথা ভাববেন না। কাচটি স্বচ্ছ কি না, তা-ও ভাববেন। অনেকটা তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে ভাঙল কাচের আয়না। এখানে আয়না ভাঙা নয়, চুল বাঁধাই মুখ্য। কাচ স্বচ্ছ না থাকলে কতভাবে নিজেকে আয়নায় দেখার চেষ্টা করতে হয়। তখন আয়না বা কাচই মুখ্য হয়ে পড়বে। সুতরাং স্বচ্ছতা এখানে যে অর্থ পেয়েছে, তা হলো এর দক্ষতা ও নিপুণতা। যেমন সুতার যখন হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকছেন প্রথম হাতুড়ি, তারপর পেরেক, এরপর হলো পেরেক ঠোকার কাজ। পেরেক ঠোকার কাজ হলো সদা প্রস্তুত থাকা।
আমরা যখনই মুখাবয়ব দিয়ে মানুষকে বুঝি, কার্যত তা দিয়ে আমরা মানুষের নীতি নৈতিকতাকেই বুঝি। এই মুখাবয়বের ধারণা থেকেই তিনি প্রতিবর্তী নীতিবিদ্যার [reflective ethic] বিকাশ ঘটান। মুখাবয়ব হলো চেহারারই পূর্ণ প্রকাশ, অনেকটা যিশুর আত্মপ্রকাশের মতো। এর মধ্যে মানবতাকেও শনাক্ত করা যায়। তবে অন্যসত্তার মুখাবয়বকে লেভিনাস অধিবিদ্যক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ একদিকে যেমন উপলব্ধির বাইরে, একই সঙ্গে সামগ্রিকতারও মধ্যেও তা ধরা পড়ে না। লেভিনাসের মতে, আমরা যখনই ‘অন্যসত্তার মুখাবয়ব’ দেখতে শুরু করি, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আত্মা আত্ম-সংরক্ষণের জন্য আর কোনো চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে না। ‘অন্যসত্তা’ অপেক্ষা দেহ ও ইগো সমন্বিত আত্মপ্রতিকৃতি নিয়েই ব্যস্ত থাকি। এ ধারণার আলোকেই লেভিনাস ‘ন-তত্ত্ববিদ্যক নৈতিক দায়িত্বশীলতা’ [non-ontological ethical responsibility] হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যসত্তা সাপেক্ষে আমার আমিকে চিনি ‘আত্মা’ হিসেবে।
পরিশেষ মন্তব্য
লেভিনাসের মতে, সামগ্রিকতা হলো পাশ্চাত্য দর্শনের এক সারধর্ম। রাজনীতি, যুদ্ধ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান—এসব ক্ষেত্রে ‘সামগ্রিকতা’ হলো সর্বজনীন যুক্তির এক প্রক্রিয়া, যা সকল কিছুকে একত্রীকরণ মতবাদ বা অনুশীলনের মাধ্যমে সকল কিছুকে একই মাত্রায় কোডিফাইং করতে পারে। এই কোডিফাইং করার নামই হলো টোটালিটি বা সামগ্রিকতা। লেভিনাস টোটালিটিকে বলছেন, ঐকীকরণের বা একেরই এক স্বেচ্ছাচারিতাকে। আর অসীমত্ব হলো ‘opening to alterit’। দুটিই মূলত সর্বজনীন সমন্বয়। আমাদের সকল অভিজ্ঞতাকে যেমন এ হ্রাসকরণ রীতির মধ্যে সকল অভিজ্ঞতা ও জগতের সকল কিছুকে একসঙ্গে করার চেষ্টা চালায়। এই প্রক্রিয়ায় কোনো কিছুই বাদ যায় না। আর এভাবে আমাদের চেতনাও হয়ে পড়ে ‘পরম চিন্তা’। তাহলে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কীভাবে সর্বজনীন সমন্বয় করে? সাধারণত ব্যক্তিক বিষয়ী যা কিনা প্রস্তুত করা হয় আমাদের দেহে, সেখান থেকেই এ ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ।
আবারও আমরা দেকার্তের সেই আলোচনায় ফিরে আসি: ‘আমি চিন্তা করি, আমি অস্তিত্বশীল’। আমি ব্যক্তি, আর ব্যক্তির চিন্তাক্রিয়া তার সচেতনতাকে নির্মাণ করে। এভাবে আত্মসত্তার সচেতনতা থেকে সকল কিছু চেতনার অনুমান করা হয়। দর্শনের ইতিহাসে এই যে সামগ্রিকতাবাদ ও অসীমত্বের প্রয়াস, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই তেমন একটা। বিশেষ করে দর্শনের ইতিহাসে চিন্তার সকল প্রক্রিয়া, বিশুদ্ধ চিন্তা অর্জনের প্রয়াস এমনকি পরম জ্ঞান এসবই হলো সামগ্রিকতা প্রবণতার ফসল। ‘আমি’ যেন সকল কিছুর সঙ্গে একই, অভিন্ন। সকল কিছুর সঙ্গেই যেন এই ‘আমি’র সমগোত্রীয় বা অভিন্ন হবার প্রয়াসে লিপ্ত। সর্বজনীন চিন্তার উপাদেয় হলো ‘আমি চিন্তা করি’। সর্বজনীন চিন্তার বড় সমস্যা হলো: তা কখনোই ‘অন্যসত্তা’কে উন্মুক্ত করতে পারে না। কিন্তু অন্যরা কীভাবে একই হয়, নিজের সঙ্গে নিজেরা অভিন্ন হয় সে নির্মাণ করাই এর কাজ।
আমরা লক্ষ করে দেখব, হেগেলীয় দার্শনিক আলোচনায় ‘আমি’ আর ‘অন্যসত্তার’ মধ্যে এক বিরোধ সক্রিয়। পার্থক্য ও ভিন্নতাকে বোঝার কামনার ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং ‘আমি’র সঙ্গে অন্যসত্তার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে একে সংজ্ঞায়ন ও সৃজন করার কামনার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এ বিরোধ। সামাজিক জীবনে আমরা প্রায়শই ‘সর্বজনীন মানবাধিকারের’ এর কথা বলি। এর ওপর ভিত্তি করে আমরা নৈতিকতার সর্বজনীন আইনও তৈরি করি। লেভিনাস বলছেন: পরম যে জ্ঞানের কথা আমরা বলি, তা মূলত সমতা সম্পর্কিত চিন্তা। এ চিন্তা মূলত গবেষণা, প্রতিজ্ঞা ও দর্শনের দ্বারা উপস্থাপিত হয়ে থাকে। যেমন, যে সত্যের মধ্যে ‘সত্তা’ মিশেল বন্ধনের মতোই থাকে। কা,রণ ‘সত্য’ এখনো সুনির্দিষ্ট নয়। কারণ, সত্য হলো চূড়ান্ত ও পরম। হয়তো এমন হতে পারে আমাদের সসীম ও সীমাবদ্ধ জীবনের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করতে পারি না। বরং আমরা অন্যসত্তা নির্মাণ করি এক ও অভিন্ন হবার মাধ্যমে।
সামগ্রিকতার মতো অসীমতার জন্মও একই থিমাটাজেশন ও পরিবেশীকরণ [thematization and representation] মাধ্যমে। লেভিনাস বিষয়টি বোঝানোর জন্য ‘ইল-ওয়াই এ’ ধারণাটি ব্যবহার করেছেন। অসীমত্বের বহুমুখী প্রকাশ রয়েছে আমাদের জীবনে যাপনে ও প্রাত্যহিকতায় উদ্বিগ্নতা, অস্বভাবিতা, অস্বাভাবিকতা—এসবই হলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের স্বল্পতা। আমরা এসব উদ্বিগ্নতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাই, যা উৎপন্ন হয় ‘ইল, ওয়াই এ’ এর মাধ্যমে। আসলে অসীমত্বেও বিকাশ দ্ব্যর্থকতা, বিমূর্তকরণ ও পরিবেশনার বাইরে থেকে। তাহলে আমরা যে নৈতিক চেতনা হলো ‘অন্যসত্তা’র রূপায়ণেরই বিপন্নতা, যা আমরা মুখাবয়ব দ্বারা বুঝে থাকি। ভাষার অনুগামী হিসেবে এই মুখাবয়ব ক্রিয়াশীল। আমরা ‘অন্যসত্তার’ প্রতি যে প্রতিক্রিয়া জানাই, তা ভাষারই এক রূপ, কার্যত তাই ডিসকোর্সে পরিণত হয়। এ জন্য লেভিনাস মনে করেন, দর্শনে সামগ্রিকতার কর্মসূচি হলো ‘বাগচাতুরী ও দ্ব্যর্থকতার কর্মসূচি’। বিশেষ দৃষ্টি ও প্রত্যক্ষণের ওপর ভিত্তি করে আমরা ‘সামগ্রিকতা’র সংজ্ঞায়ন ও শ্রেণীকরণ করি। সামগ্রিকতার প্রতি আমাদের যে প্রবণতা, তা মূলত ভুল পাঠ ও চিন্তা থেকে উদ্ভূত। যেমন আমরা ‘বস্তুনিষ্ঠ সমাজ’ এর কথা বলি, তা-ও ওই একই সামগ্রিকতাবাদী ধারণা থেকে উদ্ভূত। সামগ্রিকতাবাদ ‘প্রথম দর্শন’ নির্মাণের পথে অন্তরায়। ব্যক্তি ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে’ পারলেই সম্ভব স্ব ও অপরের বিপন্নতা কাটিয়ে ওঠা।