ছদ্মবেশী

 

ছয়তলা বাড়ি। কালো আর সোনালির মিশেলে লোহার গেট। লোহার গেটের চকচকে রং আর খাঁজকাটা নকশা। গেটের সাথে লাগোয়া সোনালি নামফলকে লেখা আজমীর রহমান।

মানুষজন এজাতীয় নামফলকে তাদের পদ-পদবি লিখতে খুব ভালোবাসে। এই যেমন অবসরপ্রাপ্ত সচিব, অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ইত্যাদি। কিন্তু আজমীর সাহেবের মনে হয় আদিখ্যেতা। তিনি মনে করেন, শুধু সোনার হরফে লেখা নামটাই একদম পারফেক্ট। আর গেটের নকশা দেখেও মানুষ হয়তো বাড়ির মালিক সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারে, বেশ একটা একটা ধাঁধা ব্যাপার।

সবে সকালের হাঁটাহাঁটি সেরে ফিরেছেন তিনি। অভ্যাসটা তার বহু পুরোনো। ডায়াবেটিস নেই তবু ভোরে না হাঁটলে তার দিনটা যেন ঠিকমতো শুরু হয় না। হাঁটাহাঁটি তার কাছে স্বাস্থ্য ঠিক রাখা ছাড়াও কমিউনিটির সাথে যোগাযোগ রাখার একটি উপায়; তাই তিনি এটি সাধারণত মিস করেন না। হাঁটাহাঁটি শেষ করে চিনি লবণ ছাড়া এক গ্লাস এলোভেরা জুস পান করেন; এরপর ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢোকেন।

বিশাল গ্যালারি সাইজ ওয়াশরুম; ইচ্ছে করলে হাত-পা ছাড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা যায়। এক পাশের দেয়ালের পুরোটা জুড়ে চকচকে মসৃণ আয়না। ইমপোর্টেড বেলজিয়াম গ্লাস। এই বেলজিয়াম গ্লাস আয়নায় চোখ রেখে প্রতিদিন প্রয়োজনের চেয়ে বেশ খানিকটা সময় কাটান আজমীর সাহেব। এই আয়নায় নিজের প্রতিকৃতি দেখলে তার দারুণ শান্তি শান্তি অনুভব হয়, মনে ভীষণ আনন্দ হয়। মেয়েদের মতো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। জীবনে একজন সফল মানুষ তিনি।

নিজের মুখখানিতে অপলক চেয়ে থাকেন, তারিয়ে তারিয়ে নিজের সফলতা অনুভব করেন। চেহারায় তার সফলতার ছাপ স্পষ্ট, সম্মান খ্যাতিও, ঠিক তার বাড়ির গেটের মতো। সেই সাথে তিনি ভালোমানুষির ভাবটাও মুখাবয়বে ফুটিয়ে রেখেছেন নিখুঁতভাবে।

নিজেকে দেখতে তার ভালো লাগে, ভীষণ ভালো লাগে। তার গালে ঝোলে স্মিত হাসি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, গাড়ি-বাড়ি, টাকা-কড়ি, মান-মর্যাদাসবকিছু পরম করুণাময় তাকে নিজ হাতে ঢেলে দিয়েছেন। এসবের জন্য তাকে ছাগল-ভেড়ার মতো পরিশ্রম করতে হয়নি, নয়টা-পাঁচটা কাজকর্ম করেই পরম করুণাময়ের কাছ থেকে আদায় করেছেন।

দেড় বছর আগে তিনি চাকরি জীবনের বর্ণিল একত্রিশটি বসন্ত সফলতার সাথে শেষ করেছেন। অবসর না, বেকার হয়েছেন বলা যায়। অবসরের প্রথম দিকে কিছু সময় গিয়েছিল নামে বেনামের টাকাগুলো এক জায়গায় করতে। বাড়ি, ফ্ল্যাটের ঝামেলা চাকরির শেষের দিকে মিটিয়ে নিয়েছিলেন। এখন ঝাড়া হাত পা।

একমাত্র ছেলে, সে-ও বিদেশে সেটেল্ড। প্রথম থেকেই ছেলের ইচ্ছে ছিল বিদেশে পড়ালেখা করবে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে এখন সেখানে থিতু হয়েছে। ভালো চাকরিও করছে। হয়তো এ দেশে এসে থাকার নামগন্ধটি করবে না। ঘুরেফিরে আজমীর সাহেব আর তার বেগম সেখানে যান। ছেলেকে বাঙালি মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়েছিলেন; কিন্তু ছেলের বউ এখন পুরোদমে বিদেশি। যমজ ছেলে হয়েছে তাদের। কিছুদিন আগে গিয়েছিলেন নাতিদের দেখতে। দুই নাতি অবিকল এক রকম দেখতে। আজমীর সাহেব তাদের আলাদা করে চিনতে পারেন না। বেশ কয়েকবার, নাতিদের চেনানোর পরীক্ষা হয়েছিল, সব কয়বারই আজমীর সাহেব ফেল। বড়ই সুন্দর দেশ, সাজানো গোছানো।

থাকতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু দেশের জন্য আজমীর রহমানের বড় মায়া কিনা, তাই মায়ার টানে চলে এসেছেন। ছেলের সাথে প্রতিদিনই কথা হয়; দেখা হয় ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে। বিদেশ থেকে ফেরার সময় ছেলেকে কিছু পয়সাকড়ি দিয়ে এসেছেন। হাজার হলেও অন্যের দেশ! উন্নত দেশ! উন্নত সব! তাই সেখানকার খরচাপাতিও একটু বেশি। তা ছাড়া সবেধন একটিমাত্র ছেলে, তাকে দেবেন না তো কাকে দেবেন!

অবশ্য এখনাকার বেশির ভাগ ছেলেপেলের স্বপ্নই হলো বিদেশে পড়ালেখা করা। ছেলের এ স্বপ্ন পূরণ করতেও তার বেশ খরচাপাতি হয়েছে। আজমীর সাহেবের জীবনের লক্ষ্য ছিল চাকরি করা, সরকারি চাকরি।

বিশ্ববিদ্যালয় পাস করার পর লক্ষ্যে অটুট, আজমীর সাহেব সময়মতো কাঙ্ক্ষিত চাকরিটি পেয়েও গেলেন। চাকরি না বলে লক্ষ্মীর ভান্ডারের চাবি কিংবা মহামূল্যবান ট্রাম্পকার্ড হয়তো বলা যায়। আত্মপ্রসাদে ভোগা আজমীর সাহেবের ভাষায়, তিনি জীবনে শুধু একের পর এক চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন; আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে একটু মন খুলে কথা বলারও সময় ছিল না। তা ছাড়া জীবনে তাকে চিনতে চেয়েছে অনেকে, কিন্তু তিনি সবাইকে চেনার প্রয়োজন বোধ করেননি।

আজমীর সাহেব আয়নার দিকে চেয়ে আনমনে অস্ফুট স্বরে বলেন, চ্যালেঞ্জিং! তারপর বিড়বিড় করে যা বলেন বোঝা যায় না।

এখন খুব গলা ছেড়ে মানুষের সাথে গল্প করতে ইচ্ছে হয়। নিজের জীবনের সফলতার গল্পগুলো মানুষকে বলতে ইচ্ছে হয়; কিন্তু মানুষ কোথা! সবাই তার মতো ভাগ্যভান্ডারের চাবি হাতড়ে বেড়াচ্ছে।

এবার একটা দীর্ঘ্শ্বাস ফেলেন। নিজের জীবনের সফলতার গল্পগুলো নিজের ভেতরেই রাখেন। মাঝেমধ্যে পল্লবীকে বলেন, কত বড় কর্মকর্তা ছিলেন, সবাই তাকে কত ভালোবাসত! সারা জীবন ডিপার্টমেন্টে সৎ অফিসার বলে পরিচিত ছিলেন। এই সব আরও কত কী! মেয়েটি ভালো শ্রোতা। হাসি হাসি মুখ করে তার কথা শোনে। অন্তত ওর কাছে এলে মনে হয়, পৃথিবীতে সবাই শুধু বলতেই ব্যস্ত এমন নয়, কথা শোনার জন্য এখনো দু-একজন শ্রোতা অবশিষ্ট আছে। ওর কাছে এলে নিজেকে আরও খানিক সুখী মনে হয়।

ফেসওয়াশটা মুখে স্প্রে করেন। কী ব্র্যান্ড কে জানে! ছেলে দিয়েছিল; ভীষণ মিষ্টি ঘ্রাণ। তারপর গালের দুপাশটায় ঘষেন। ফর্সা মুখখানা তার এখনো টান টান। তার বয়সের রেখাহীন মুখ আর সুঠাম শরীর দেখে কেউ বয়স আন্দাজ করতে পারবে বলে মনে হয় না। অবশ্য এখন মানুষের মুখ দেখে বয়স আন্দাজ করা যায় না।

আচমকা আজমীর সাহেবের মনে হয়, ইশ্, মুখ দেখে যদি মানুষের মনের ভেতরের কথাগুলো বোঝা যেত। তাহলে ভীষণ মজার ব্যাপার হতো। পরক্ষণেই আবার মনে হয়, ইশ্, অন্যের মনের ভেতরের কথাগুলো যদি জানা যেত! সব কথা জানার দরকার নেই। শুধু অন্যরা তাকে নিয়ে কী ভাবে, সেটা যদি জানা যেত। যদি একটা মনের ভাব জানার মেশিন থাকত! তাহলে আজমীর সাহেব মেশিনটা দিয়ে অন্যদের মনের গোপন কথাগুলো শুনে ফেলতেন।

তারপর কয়েক দিন ধরে মনের ভাব জানার অদ্ভুত একটা মেশিনের কথা আজমীর সাহেবের মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে। এ বিষয়ে গুগল টুগলে সার্চ করেন। নাহ্, তেমন কোনো মেশিন এখনো আল্লার দুনিয়ায় তৈরি হয়নি। তবে খুব শিগগির হয়ে যাবে মনে হয়। কিন্তু আজমীর সাহেবের তত দিন অপেক্ষা করার ইচ্ছা নেই।

তবু আজমীর সাহেবের খুব ইচ্ছা করে, তিনি কেমন মানুষ তা জানতে, অন্যরা তাকে নিয়ে কী ভাবে, সেটা জানতে। বিশেষ করে মর্নিংওয়াকের পরে আয়না দেখার এই সময়টাতে নিজেকে জানার জন্য তার ভীষণ উদগ্রীব লাগে।

নিজের সম্পর্কে অন্যের অভিব্যক্তি জানার মতো আনন্দদায়ক কোনো ব্যাপার নেই পৃথিবীতে। এই আনন্দদায়ক অনুভূতির জন্য মরিয়া তিনি একটি মিশন নিয়েছেন। আর এ মিশনের নাম দিয়েছে সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত উক্তি অনুযায়ী নিজেকে জানো অর্থাৎ know thyself.

কয়েক দিন ধরে তিনি এ মিশনের একটি পরিকল্পনা ও নকশা তৈরি করে ফেলেছেন। খুব শিগগির নিজের মূল্যায়নের কার্য্ক্রম শুরু করবেন। মানুষের স্বভাব হলো সামনাসামনি ভালো কথা বলা, কিন্তু পেছনের কথাগুলো হলো আসল কথা। তার পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী লোকে আসলে অগোচরে তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে, সেটা জানাই হবে তার মূল লক্ষ্য। পরিকল্পনামাফিক জিনিসপাতিও জোগাড় করেছেন।

ক্লিন শেভ গাল। এত বছরে কখনো দাড়ি রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। সেই ক্লিন শেভ গালকে পুরোপুরি শশ্রুমন্ডিত করার জন্য নকল দাড়ি গোঁফ এবং তার নতুন লুকের জন্য সিল্কের চোস্ত পায়জামা-পাঞ্জাবি কিনে এনেছেন। তার হাফ স্কিন মাথা ঢাকতে একটি পরচুলাও কিনেছেন। সাধারণত কী এক আজব কারণে যেন মানুষ পাঞ্জাবি আর দাড়ি টুপিওয়ালা মানুষদের খুব বিশ্বাস করে। তাই উনি এই বেশটাই বেছে নিয়েছেন।

বাড়িতে ড্রাইভার দারোয়ান যথেষ্টই আছে। তাদের দিয়ে জিনিসগুলো আনানো যেত। কিন্তু এসব খবর আলোর গতিতে তার প্রিয় বেগমের কাছে চলে যেত। বেগমের আবার অলস মস্তিষ্ক। বহুবিধ ভাবনাচিন্তা সেখানে ঘুরপাক খায়। তাই নিজেই বিভিন্ন বিপণিবিতান ঘুরে ঘুরে এসব সংগ্রহ করেছেন।

রিটায়ার্ডের পর থেকে প্রতিদিন দুই বেলা নিয়ম করে স্ত্রীর সাথে ডাইনিংয়ে বসেন। দুপুর আর রাত।

সেই বিয়ের গোড়া থেকে দেখে আসছেন, স্ত্রী সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেন না। সকালের দিকটায় স্ত্রীর ঘুম গাঢ় হয়। স্ত্রী যেহেতু সকালে একটু দেরি করে ওঠেন, তাই সকালটা আজমীর সাহেবের নিজের। তিনি ইচ্ছেমতো এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করেন। কাজের আয়া-বুয়ারা নাশতা পানি গুছিয়ে রাখে। নাশতা সেরে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুঁ মারেন, কখনো-সখনো বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করেন। তার বর্তমান সময়ের বন্ধুবান্ধব কেউ কেউ তার মতো বেকার, কেউ কেউ অসুস্থ, কেউ নতুন চাকরি শুরু করেছেন।

আবার কখনো-কখনো স্পাতে যান। ওখানেই পল্লবীর সাথে পরিচয়। শ্যামবরন। জোড়া ভুরু। খুব ভালো ম্যাসাজ করে। ভীষণ আরামদায়ক। আজমীর সাহেবের মনে হয়, সারা জীবন যদি এমন ম্যাসাজ পাওয়া যেত, তবে এর জন্য বেশ পয়সাও গুনতে হয় তাকে। আবার মাঝে মাঝে মেয়েটার জন্য কিছু গিফটও নিয়ে যান। এই যেমন গত মাসে পল্লবীকে দিয়েছেন একটা দারুণ মোবাইল। পল্লবীর সাহচর্যে তার শরীর-মন দুটোই ফুরফুরে হয়।

ফুরফুরা মনে মধ্যদুপুরের আগেই বাড়ি ফিরে আসেন, এবং বেগমের সাথে লাঞ্চ করেন। দুপুরে খেতে খেতে স্ত্রীর সাথে নানা ধরনের কথাবার্তা হয়। ইদানীং স্ত্রীর একটা স্কুল খোলার ইচ্ছা হয়েছে। ইংলিশ মিডিয়াম। অলস সময়, অলস মস্তিষ্ক, কী আর করবেন! তাই ভালো কাজে সময়টা কাটানোর চিন্তা। স্কুল হলো মানুষ গড়ার কারিগর। একটা স্কুল খুললে অন্তত কিছু মানুষ তৈরি করতে পারতেন। এ ব্যাপারে আজমীর সাহেবেরও কিছুটা সায় আছে।

তা ছাড়া আজমীর সাহেবের বাবা ছিলেন একজন স্কুলমাস্টার। শেষ জীবনে বাবাকে একটু সম্মান দেখানো, এই আরকি! স্ত্রীর বোনের মেয়ে স্কুলের সব কাজ করে দেবেন। আজমীর সাহেবকে শুধু টাকা দিতে হবে। স্কুলের প্রিন্সিপাল হবেন আজমীর সাহেব আর স্ত্রী হবেন ভাইস প্রিন্সিপাল। এটা নিয়েই এখন স্ত্রী মশগুল।

আজ বেলা দশটায় ঘুম থেকে ওঠার পর আজমীর সাহেব স্ত্রীকে দেখলেন বেশ ব্যস্ত। আবার খানিক সাজগোজও করল। দেখে মনে হলো, কোথাও বের হবেন। হয়তো স্কুলসংক্রান্ত কাজে।

আজমীর সাহেব মনে মনে ভীষণ খুশি হলেন। সত্যিই মধ্যদুপুরের আগে তার স্ত্রী বেরিয়ে গেলেন। আর আজমীর সাহেবেরও মওকা মিলে গেল।

একজন পুরুষের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে তার অফিসে! অফিস হয়ে ওঠে একটা প্রিয় জায়গা। এ শহরের মোট তিনটি স্টেশনে উনি কাজ করেছেন। তিনটির সব কটিতে যাবেন ভাবলেন। আজমীর রহমান তার চাকরির অন্যান্য স্টেশনের চেয়ে লাস্ট স্টেশনটায় ছিলেন সবচেয়ে বেশি সময়, প্রায় ষোলো বছর! অনেক সময়! এখান থেকেই তাকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হয়েছিল। তাই মিশন নো দাইসেল্ফ কোথা থেকে শুরু করবেন, সেটা নিয়ে বহু গবেষণা করে, ঠিক করেছিলেন চাকরির লাস্ট স্টেশনে যাবেন। তবে এ অফিসের কর্মকর্তা থেকে কর্মচারীরা সকলে তাকে অনেক ভালোবাসে, সেটা উনি জানেন। তবু নিজের একটা মূল্যায়ন বলে কথা, ভালো থেকেই শুরু হোক। একজন রিটায়ার্ড মানুষের অবদানের প্রতিদান কী রকম, সেটা জানার বড় লোভ তার! আসলে মানুষ হিসেবে নিজের একটা স্কোরিং করা। স্কোরিংয়ে কম পেলে হয়তো নিজেকে শুধরাবেন।

ওহ হো, উনি তো আর চাকরি করতে পারবেন না, তবে কীভাবে শুধরাবেন। যাহোক, অন্তত মরে যাওয়ার আগে অন্যের মুখ থেকে নিজের প্রশংসা অর্থাৎ সত্যিকারের কিছু ভালো কথা শুনবেন বলে মনে হয় তার। আজকে আজমীর সাহেব জানবেন, লোকে তার পেছনে কী বলে, কৌশলে সেটা জেনে নেবেন তিনি।

তিনি নিজেকে সাজিয়ে ফেললেন নো দাই সেল্ফ সাজে। নিজের আলমারিতে থেকে সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখা জিনিসগুলো বের করলেন।

ক্লিন শেভ গালে হাত বোলাতে বোলাতে বেলজিয়াম আয়নায় কৃত্রিম দাড়ি-গোঁফগুলো দেখলেন। তারপর নিজের মুখে জুড়ে দিলেন। পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপালেন। সাথে কালো দামি জুতা। পাঞ্জাবির সাথে জুতা কেমন লাগছে কে জানে! এই বেশ নেওয়ার পর এভারেস্ট শৃঙ্গ আরোহণের মতো আভিযাত্রিক মনে হচ্ছে নিজেকে।

এরপর মনে মনে সাজানো নাটকের স্ক্রিপ্টগুলো রিহার্সাল করলেন। অভিনয়টা তার বেশ হচ্ছে। তার মনে আওড়ানো সংলাপগুলোও বেশ মানানসই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

স্ত্রী ফিরলেন অনেক রাতে। স্ত্রী ফেরার আগেই আজমীর সাহেব নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। রাতে আর খাওয়ার আগ্রহ বোধ করছেন না। এখন তার মাথার ভেতর শুধু সক্রেটিসের নো দাইসেল্ফ।

রাতে স্ত্রী আজমীর সাহেবের রুমে ঢুকে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে নানা ধরনের প্রশ্ন করলেন। এই যেমন শরীর খারাপ নাকি? প্রেশার বেড়েছে নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ইনিয়ে-বিনিয়ে তার স্কুল পরিকল্পনার কথা বলে গেলেন। আজমীর সাহেব কিছু শুনলেন, কিছু শুনলেন না। কোনটায় হুঁ-হ্যাঁ দুটি-একটি জবাব দিলেন। তার মাথায় চলছে অন্য পরিকল্পনা।

তারপর একসময় স্ত্রীও শুতে চলে গেলেন।

রাতে আজমীর সাহেবের ঘুমও হলো না। ডাইনে-বাঁয়ে, কাত-চিত বহুভাবে শুলেন; একদমই ঘুম এলো না। যদিও আজমীর সাহেবের নিয়মিত চেকআপে এযাবৎ ডায়াবেটিস পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার বারবার বাথরুম পেল। শেষ পর্যন্ত রাত শেষ হওয়ার আগেই তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন।

আজানের বেশ আগেই নামাজ কালাম পড়লেন। এরপর নিজেকে সাজিয়ে নিলেন নিখুঁত সাজে। অতঃপর উত্তেজনার আতিশয্যে সুবহে সাদিকের সময় বেরিয়ে পড়লেন।

বাড়ির দারোয়ানটা তখন গভীর ঘুমে। নিজে সন্তর্পণে চাবি দিয়ে গেট খুলে বেরিয়ে এলেন। তা ছাড়া দারোয়ান এই বেশে তাকে দেখতে পেলে বিরাট ঝামেলা হয়ে যেত।

চারদিকে আলো ভালো করে ফোটেনি। দু-একটা কাক এদিক-ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। নিশাচর পাখিরা তখনো উড়ছে। হয়তো একটু পরে নীড়ে ফিরবে। ভিতরে ভিতরে খুবই উত্তেজনা বোধ করছেন। ভীষণ গরম লাগছে তার; শরীর ঘেমে উঠছে। ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেছে কি না কে জানে! ভাবছেন সত্যিই নো দাইসেল্ফ মিশনে বের হবেন, নাকি স্থগিত করে দেবেন?

যদিও কয়েকটা ধাপ সফলতার সাথে তরী শেষ করেছেন। তীরে এসে ডোবাতে ইচ্ছে হলো না। মূল্যায়নের স্কোরটা জানার জন্য তিনি উদ্‌গ্রীব।

বাড়ি থেকে বের হয়ে পার্কের বেঞ্চের কোনায় বসলেন। তার হাঁটার সঙ্গীরা হেঁটে চলেছে। আজকে তিনি হাঁটবেন না। পার্কে বসে থাকবেন। সকালটা দেখবেন। সূর্যটা ডিমের কুসুমের রাতের কোল থেকে হালকা হলুদ হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে। তারপর একসময় সম্পূর্ণ সূর্যটা দৃশ্যমান হয়। ভোর হয়।

সকালের প্রথম ভাগ। হালকা হলুদ আলো কটকটে হলুদ রং রোদ হয়ে চাগিয়ে উঠল পুরো পৃথিবীটার ওপরে। রোদের তাপে আজমীর সাহেবের মনে হলো, হয়তো বহুদিনের রোদের ভেতরে না থাকার অনভ্যাসে আজমীর সাহেবের খুব গরম লাগছে। এই কাজটিকে এখন খুব ছেলেমানুষি কাজও মনে হচ্ছে। কেমন যেন খেল ব্যাপারটা। কিন্তু এই খেলার নেশাটাই পেয়ে বসেছে আজমীর সাহেবকে।

একটা উবার ডাকলেন। গতকাল রাত থেকে তার ভীষণ গরম বোধ হচ্ছে। জীবনে সময়ে সময়ে এ রকম ভীষণ গরম অনুভূতি হয়। উনি জীবনে বহু চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, জীবনের এই উত্তেজনার সাথে তিনি পরিচিত।

উবার ড্রাইভারকে হাইস্পিড এসি দিতে বললেন। কিন্তু আজকে যেন গরম কোনোভাবেই কমছে না। নিজেকে নিষ্ক্রান্ত করতে তিনি সোশ্যাল সাইটে ঢুঁ মারেন। একটা স্ট্যাটাস দিলে কেমন হতো, মিশন নো দাইসেল্ফ। পল্লবীকে একটা ভিডিও কল দেবেন, এই সাজে তাকে কেমন লাগছে জানতে চাইবেন। নাহ্, ভাবনায় আসা কোনো কিছুই তিনি করলেন না। শুধু মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রল করে গেলেন।

ঘড়িতে আটটা পয়ঁতাল্লিশ। চকচকে রোদ। অফিসে ঢুকতে যাবেন। কিন্তু সুনসান অফিস, এখনো হয়তো কেউ আসেনি। আরও একটু পরে সবাই ঢুকতে শুরু করবে। তাই তিনি উবারের ঠান্ডার ভেতর বসে রইলেন।

ঠিক সাড়ে নয়টায় তিনি অফিসে ঢুকলেন। অফিসে ঢুকে চমকে উঠলেন। আজ কেউ তাকে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করল না। তিনি প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণেই মুখে হাত বোলালেন। কেউ তো তাকে চিনতেই পারেনি, তবে কুর্নিশ কেন করবে?

অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। উনি তো আর এখন অফিসের বস কিংবা রিটায়ার্ড বড় অফিসার নন। উনি একজন সাধারণ মানুষ। নিতান্ত সাধারণ মানুষ। যেমন প্রতিদিন কত মানুষ কত কাজে এসব অফিসে আসে, বসে, গল্প করে, কাজ করে।

উনি বিভিন্ন ফ্লোরে ঘোরাঘুরি করলেন। ছিমছাম সাজানো গোছানো অফিস। কর্মচারীরা এসেছে, কর্মকর্তারাও আসতে শুরু করেছে। রিটায়ার করার অল্প কিছুদিন পূর্বেই তিনি এই অফিসটা রেনোভেশনের প্রজেক্টটা শুরু হয়েছিল। রেনোভেশনের ফার্ম নিয়োগের সম্পূর্ণ কাজ উনিই করেছিলেন; তবে শেষটা দেখে যেতে পারেননি।

আজকে আজমীর সাহেবের পরিচয়, তিনি একটি কোম্পানির মুখপাত্র। গুলশান-বনানী এমনকি দেশের বাইরেও বাড়ি কিনতে চাইলে উনিই ব্যবস্থা করে দেবেন। তা ছাড়া বেশভূষা, পোশাক-পরিচ্ছদসবকিছুই খানিকটা সে রকমই। আজমীর সাহেব নিজেকে সেভাবে সাজিয়েছেন। নিখুঁত বেশবাস।

পদমর্যাদায় উনিই ছিলেন এই অফিসের সেকেন্ড ইন কমান্ড কর্মকর্তা। তার চেয়ারে নতুন একজন উপবিষ্ট। এখান থেকেই অর্থাৎ তার নিজের চেয়ার দিয়েই মিশন স্টার্ট করবেন। একসময় কর্মকর্তাটি তার সহযোগী ও অধস্তন ছিলেন।

আজমীর সাহেব, মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে স্ক্রিপ্টগুলো আওড়ে নেন। আজকে তিনি অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। বহুক্ষণ শেষে লম্বা একটা সালাম দিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। অভিনয়ের শুরুতে তার বেশ হাসি পেল, হো হো করে হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু হাসলে সব পন্ডশ্রম!

বিশাল বড় রুম। সুসজ্জিত। রুমের টেম্পারেচার সম্ভবত উনিশ-বিশের মধ্যে। রুমের ভেতর কয়েকটি অর্নামেন্টাল প্ল্যান্টও রাখা। ঠিক টেবিলের সামনে রাখা কিছু ভিজিটর চেয়ার। তারপর বড় এক সেট বাদামি কালারের সোফা। অফিসারটি মোবাইলে ব্যস্ত। ইঙ্গিতে তাকে বসতে বললেন। তিনি খানিকটা দূরে সোফায় বসলেন।

কর্মকর্তাটি ফোনে কথা শেষ করে আজমীর সাহেবের দিকে তাকালেন। নিজের বানানো পরিচয়টা বললেন। তারপর কথা এগিয়ে নিতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন।

আজমীর সাহেবের আলোচনা জমে গেছে পুরোদস্তুর। বিভিন্ন অফিসের বড় বড় কর্মকর্তার রেফারেন্স টানছেন আজমীর সাহেব। আলোচনা বেশ এগিয়ে চলছে। একপর্যায়ে বললেন, আমার কাছে অনেক ধরনের বিনিয়োগের প্রোপোজাল আছে। আপনি যেকোনো খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন।

তারপর একটা মোক্ষম চাল দিলেন, বললেন আপনার আগের অফিসারের সকল ধরনের কাজ তো আমিই করেছি। অবসরের শেষ দিকে সব ঝামেলা আমাদের কোম্পানির মাধ্যমে মিটিয়েছি। খুব সজ্জন, অত্যন্ত ভদ্র মানুষ ছিলেন।

এবার অফিসারটি যেন চিড়বিড়িয়ে উঠলেন এবং খানিক ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। তারপর খানিক উঁচু গলায় বললেন, আরে ভাই, আপনি তো তাইলে কিচ্ছু জানেন না। বড় বদমাইশ লোক ছিল। ভাই রে, এক্কেবারে দুই নাম্বার। মালকড়ি খাইয়া এখন লেক ভিউ অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। আরে ভাই, যেন রাজার বাড়ির চেয়ে সুন্দর তার বাড়ি। তার তো আপনারে দরকার হবেই। অফিসটায়, সবখানে সে ভাগ বসাত। বড় বজ্জাত লোক ছিল। ফাইল আটকায়া টাকা নিত। কাউরে বিশ্বাস করত না।

আজমীর সাহেব মাথা নিচু করেন। এবং পুরোপুরি বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। হাতে ধরে তৈরি করা অফিসার তার সম্পর্কে এভাবে বলছে; ভাবতেই পারেন না। বিশ্বাস না হইলে কর্মচারীদের ডাকেন, বলে অফিসারটি হা হা করে হাসতে লাগল।

একসময় চা এলো। লোকটি আজমীর সাহেবকে চা নিতে বলল। আজমীর সাহেবের আর প্রবৃত্তি হলো না।

তিনি কখনোই এতটা নির্লজ্জ ছিলেন না। কী শুনছেন এসব! রহমান সাহেবের মাথাটার ভেতর চক্কর মারে। বুকের ভেতর হাতুড়ি বাড়ি মারে। তিনি তার জীবদ্দশায় কোনো মানুষের কাছ থেকে জোর করে পয়সা নেন নাই; বাঁটোয়ারায় যা পেয়েছেন, তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছেন। আর ফাইল তো তার টেবিলে নিয়ে বসে থাকার প্রশ্নই আসে না। জুনিয়র টেবিল পেরিয়ে নথিটি তার কাছে আসত। আজমীর সাহেব আর কিছুই ভাবতে পারেন না। খুব ইচ্ছা করে অফিসারটিকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে; কিন্তু মনে পড়ে যায় তিনি নিজেকে জানার জন্য বের হয়েছেন। আর সেজেছেনও অন্য সাজে।

হঠাৎ কর্মকর্তাটির ডাক পড়ে ঊর্ধ্বতনের। সবশেষে কর্মকর্তাটি বলে, সমস্যা নেই। এ মুহূর্তে ইনভেস্টের কোনো ইচ্ছা নেই, তবে কোনো ট্রান্সফার লাগলে আপনাদের জানাব। এরপর তিনি বেরিয়ে যান।

ভাগ্যিস, লোকটি বেরিয়ে গেল! আর বেশি দূর এগোলে লোকটি সাক্ষী হাজির করে ফেলত।

আজমীর সাহেবও ধীর পায়ে বের হন। চরম অপমানিত, হতভম্ব। সম্ভবত নিজের মূল্যায়ন রিপোর্ট পেয়ে গেছেন। অফিস দূরে থাক পরিচিত কোনো মানুষ তার সম্পর্কে এ রকমভাবে কথা বলতে পারে, সেটা তার ধারণার অতীত ছিল।

শরীরটা খারাপ লাগছে কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। এই অফিসটা থেকে বেশ কাছাকাছি পল্লবীর ডেরা। ওখানে যাবেন। ঠিক করেন পল্লবীর সাথে দেখা করবেন। পল্লবীর সাথে খানিক কথা বললে, কিছু ম্যাসাজ-ট্যাসাজ নিলে হয়তো ভালো লাগবে। তিনি পল্লবীকে ফোন দেন। পল্লবী কেটে দেয়। দুঃখের আতিশয্যে বার কয়েক ফোন দেন। পল্লবী ফোন রিসিভ করে না।

আজমীর রহমান সাহেব পার্লারের কাউন্টারে ফোন দেন, পল্লবীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট চান।

পল্লবী ব্যস্ত আছে। আজকে হবে না। আজকের দিনটা পল্লবীর বরাদ্দ আছে অন্য একজনের জন্য। পল্লবীরা সঙ্গ বেচে খায়। বকুল নামের অন্য একটি মেয়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে চাইল। কিন্তু তার ইচ্ছে হলো না, নিজেকে খুব একা লাগছে।

ঠিক করলেন বাড়ির দিকে যাবেন। রোদে চোখে ঝাপসা দেখছেন, অসহ্য গরম। এত গরম পড়ে এখন!

সাধারণত তিনি নিজের গাড়ি ছাড়া কোথাও বের হন না। আজ বেরিয়েছিলেন। নিজেকে জানার জন্য বেরিয়েছিলেন। নিজেকে জানা হয়ে গেছে। এবার তার ড্রাইভারকে ফোন করতে ফোনটা কানে লাগান। হঠাৎ কানে বেজে ওঠে তার অফিসের সেই কর্মকর্তার কথাগুলো। তার মনে হয় পুরো পৃথিবীর আকাশ-পাতাল সবাই যেন ওই কথাগুলোই বলছে। আকাশে-বাতাসে কর্মকর্তার কথাগুলো যেন মাহফিলের মাইকের মতো প্রথমে আস্তে তারপর উচ্চ শব্দে বেজে ওঠে।

উনি দুহাতে কানে চেপে ধরেন। তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার ধড়ফড় শুরু হয়। পানি পানি বলে বিড়বিড় করতে থাকেন। কিন্তু বোধ হয় কেউ তার কথা শুনতে পায় না। দু পেয়ে ব্যস্তসমস্ত মানুষ তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে।

ছদ্মবেশী আজমীর সাহেবও উদ্‌ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকেন আর বিড়বিড় করেন।