‘আমার বাঁচা দৈব ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়’

 

এলি উইজেল এর জন্ম ১৯২৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হাঙ্গেরির এক ইহুদি পরিবারে। বেড়ে উঠেছেন রোমানিয়ার ছোট এক গ্রামে। গল্প-উপন্যাস ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ মিলিয়ে চল্লিশটিরও অধিক বইয়ের লেখক এলি উইজেল। তিনি প্রেসিডেন্টসিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম, ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকা কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’  ‘ফ্রান্স লেজিওন অব অনার লাভ করেছেন এবং ১৯৮৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ছিলেন মানবাধিকার বিষয়ক অ্যান্ড্রু ডব্লিউ. মেলোন প্রফেসর এবং বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি প্রফেসর। ২০১৬ সালের ২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে তিনি মারা যান। তার ‘আমার বাঁচা দৈব ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়: নাৎসি গণহত্যার দলিলের ভূমিকা’ লেখাটির ভাষান্তর করেছেন জিয়া হাশান

যদি আমার জীবনে আমি একটামাত্র বই লিখতাম, তাহলে তা হতো এই বইটা। অতীত ঠিক যেভাবে বর্তমানের ওপর ভর করে, সেভাবেই সেই রাত লেখার পর তালমুদ কিংবা হাসিডিক-এর বিষয়বস্তু নিয়ে বাইবেল-সংক্রান্ত লেখাসহ আমি যা কিছু লিখেছি, তার সব কটিতেই এই বইয়ের গভীর ছাপ রয়েছে এবং একেবারে প্রথম দিকে লেখা এই বই না পড়ে কেউ সেগুলো বুঝতে পারবে না।
কেন আমি এই বই লিখেছি?
আমি যাতে পাগল না হয়ে যাই, সে জন্য কি লিখেছি? অথবা তার বিপরীতে বলা যায় যে, ইতিহাস ও মানবজাতির চেতনাজুড়ে ছড়িয়ে আছে সে বিস্তৃত পাগলামি ও তার ভয়াবহতা, সেসবের গতি-প্রকৃতি বুঝতে গিয়ে কি লিখেছি?
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি রোধে সহায়তা করার জন্য স্মৃতিময় শব্দের উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার জন্য কি লিখেছি?
নাকি যে বয়সে মৃত্যু ও পাপ সম্পর্কে সাহিত্যে যতটুকু পায়, ততটুকুর মধ্যে কারও ধারণা সীমিত থাকে সেই কৈশোরে আমি যে যন্ত্রণা পাড়ি দিয়ে এসেছি তার একটা লিখিত প্রমাণ রাখার জন্য কি লিখেছি? অনেকেই আমাকে বলে যে, এই বই লেখবার জন্য আমি বেঁচে গেছি। আমি তাদের সাথে একমত নই। তবে জানি না আমি কীভাবে বেঁচে গেছি। আমি ছিলাম যেমন দুর্বল, তেমনি লাজুক। তা ছাড়া নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমি কিছুই করিনি। তাহলে কি অলৌকিক উপায়ে বেঁচে গেছি? নিশ্চয়ই তা নয়। কেননা ঈশ্বর যদি আমার জন্য অলৌকিক কিছু করে থাকেন, তাহলে আমার থেকে যাদের বাঁচা বেশি দরকার ছিল, তাদের জন্যও কিছু করল না কেন? সুতরাং আমার বাঁচা দৈব ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। যাহোক, বেঁচে যাওয়ার ফলে সে বাঁচাটাকে আমার অর্থবহ করে তোলা দরকার। তা করতে গিয়ে অভিজ্ঞতাকে কাগজে তুলে ধরেছি, তা কি কিছু হয়েছে?
আগের কথার জের ধরে স্বীকার করি যে, আমি জানি না কিংবা জানার চেষ্টাও করি নাএ লেখা থেকে আমি কী অর্জন করতে চাই। তবে কেবল জানি যে, এই জবানবন্দি ছাড়া আমার লেখকজীবন কিংবা জীবনজুড়ে যা হয়ে উঠেছি, তা কখনো হওয়া হতো না। হতো না সাক্ষী হওয়াও। যে সাক্ষী মনে করে যে, মানবসমাজের স্মৃতি থেকে শত্রুদের অপরাধ মুছে যাবার সুযোগ দিয়ে তাদের শেষ বিজয় উদযাপন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা তার স্বাভাবিক দায়দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
সম্প্রতি আবিষ্কৃত তথ্য-প্রমাণাদির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কেননা তাদের মাধ্যমে আজকাল প্রমাণ হয়ে গেছে যে, ক্ষমতা গ্রহণ করার প্রথম দিকে জার্মানির নাৎসিরা এমন এক সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিল, যেখানে ইহুদিদের কোনো জায়গা থাকবে না। কিন্তু তাদের শাসনামলের শেষ দিকে এসে তাদের লক্ষ্য বদলে যায়। তখন তারা পৃথিবীকে এমন একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে ইহুদিদের যে অস্তিত্ব ছিল, তা আর কখনো বোঝা যাবে না। এ কারণে রাশিয়া, ইউক্রেন ও লিথুনিয়ার সর্বত্র ভ্রাম্যমাণ ঘাতক দল দশ লাখের অধিক ইহুদি নারী-পুরুষ ও শিশুদের প্রতি মেশিনগান তাক করে শেষ সমাধান বাস্তবায়ন করে। তাদের মেরে ফেলার একটু আগে তাদেরই দিয়ে খোঁড়ানো গণকবরে ছুড়ে দেয়। শেষে মাটি খুঁড়ে আবার তাদের তুলে এনে আগুনে পোড়ায় সেই বিশেষ বাহিনী। এভাবেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইহুদিদের শুধু দুবারই মারা হয়নি বরং তাদের কবরে সমাহিত করাও প্রতিহত করা হয়।
এটা অনস্বীকার্য যে, হিটলার ও তার সহযোগীরা যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তা কেবল ইহুদি নারী-পুরুষ ও শিশুদের বিরুদ্ধেই ছিল না বরং তা ছিল ইহুদি ধর্ম, ইহুদি সংস্কৃতি, ইহুদি ঐতিহ্য, সর্বোপরি ইহুদি স্মৃতিসমূহের বিরুদ্ধেও।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন ইতিহাসের এই অধ্যায়ের যথার্থ বিচার হবে। আমি জানি তখন আমাকে সাক্ষ্য দিতে হবে। আরও জানি যে, আমার যদিও অনেক কথা বলার আছে কিন্তু তা বলার মতো যথার্থ শব্দরাজি আমার জানা নাই। দুঃখজনকভাবে আমি আমার এ সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে সচেতন। তাই ভাষা যখন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, আমি তখন অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকি। ফলে এটা স্পষ্ট যে, একটা নতুন ভাষা উদ্ভাবন করা জরুরি হয়ে উঠবে। কিন্তু শত্রুদের বিশ্বাসঘাতকতা ও বিকৃতির বিষয়গুলো কীভাবে পুনরায় তুলে ধরা ও রূপান্তর করা হবে? কেননা ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ভয়-পরিবহন-বাছাই-আগুন-চিমনিএসব শব্দের সব কটিরই স্বকীয় অর্থ আছে কিন্তু সেই সময় এসবের অর্থ ছিল অন্য কিছু। আমার মাতৃভাষা, যা তখন বিলুপ্তির পথে, তাতে লিখতে গিয়ে আমাকে প্রতিটি বাক্যে থামতে হয় এবং নতুন করে শুরু করতে হয় বারবার। আমাকে খুঁজতে হয় অন্য ক্রিয়াপদ, অন্য ভাব ও অন্য বাক্‌ভঙ্গি। তারপরও এখনো মনে হয় তা যথাযথ হয়নি। কিন্তু এই তা আসলে কী? এই তা হচ্ছে কিছু একটা অধরা, অপমানিত অপবিত্র হওয়ার ভয়ে গভীর অন্ধকারে ঢাকা। সব অভিধানকেই এ রকম হীনবল, ফ্যাকাশে ও প্রাণহীন মনে হয়। তাই সিল করা পশুবাহী গাড়িতে শেষ যাত্রা, অজ্ঞাত জায়গার উদ্দেশে শেষ অভিযাত্রা বর্ণনা করার কি কোনো উপায় আছে? আছে কি উন্মুক্ত ও হিমশীতল জগৎ আবিষ্কার করার কোনো উপায়, যেখানে অমানবিকতাই মানবিকতা, কেতাদুরস্ত পোশাক পরা শিক্ষিত, সুশৃঙ্খল লোকজন আসে মেরে ফেলতে আর নিষ্পাপ শিশু ও খুনখুনে বুড়োরা আসে মরতে? কিংবা এক অগ্নিময় রাতেই ঘটে অসংখ্য বিচ্ছেদ, পুরো পরিবার, পুরো কমিউনিটি কান্নায় ভেঙে পড়ে? অথবা সোনালি চুল ও বিষণ্ন হাসির এক ফুটফুটে সুবোধ ছোট ইহুদি মেয়ে অবিশ্বাস্যভাবে হাওয়া হয়ে যাবার, তাদের পৌঁছার রাতেই তার মায়ের সাথে নিহত হবার বিবরণ দেওয়ার কোনো উপায় কি আছে? চিরকালের তরে হৃদয় ভেঙে যাওয়া কেউ শিউরে না উঠে তাদের কথা কীভাবে বলবে?
সাক্ষী মনের গভীরে এখন যেমন জানে আগেও তেমনি জানত যে, তার জবানবন্দি সাদরে গ্রহণ করা হবে না। কেননা তাতে এমন এক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, যা মানবজাতির অন্ধকার অঞ্চল থেকে উঠে এসেছে। যাদের আওশউইট্জ-এর অভিজ্ঞতা আছে কেবল তারাই জানে তা আদতে কী ছিল। অন্যরা কখনোই জানতে পারবে না।
কিন্তু তারা কি অন্তত বুঝতে পারবে না?
যেসব নারী-পুরুষ মনে করে দুর্বলদের সহযোগিতা, অসুস্থকে সেবা, ছোট ছোট শিশুদের রক্ষা, বয়স্কদের শ্রদ্ধা-ভক্তি করা স্বাভাবিক ব্যাপার, তারা কি বুঝতে পারবে সেখানে কী হয়েছিল? তারা কি উপলব্ধি করতে পারবে কীভাবে সেই অভিশপ্ত জগতের ভেতরে সবলরা দুর্বলদের নির্যাতন এবং শিশু, অসুস্থ ও বয়স্কদের গণহারে হত্যা করেছে?
তাই সেসব ঘটনার বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসা কেউ নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারে না। বরং অসম্ভব না হলে যতই মুশকিল হোক না কেন, তা বলা জরুরি।
তাই আমি এ লেখায় উদ্যোগী হই। শব্দরাজিকে আবৃত ও অধরা রাখা নৈঃশব্দ্যের ওপর আস্থা রাখি। তা ছাড়া জানি যে বিরকেনাউ-এর ব্যাপারে যত জবানবন্দি আছে, তার তুলনায় বিরকেনাউ-এর একমুঠো ছাইয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর বলতে না পারা কথাগুলো ফুটিয়ে তোলার জন্য আমার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে, এখনো তা যথার্থ হয়ে ওঠেনি।
তাই কি ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মহান ফরাসি লেখক ও নোবেল বিজয়ী ফ্রাঙ্কোয়া মরিয়াক-এর অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও ফ্রান্স ও আমেরিকার বড় বড় প্রকাশক আমার পাণ্ডুলিপি প্রত্যাখ্যান করে? তারপর মাসের পর মাস ধরে দেখা-সাক্ষাৎ, চিঠি চালাচালি ও ফোনে কথোপকথনের পর অবশেষে তা ছাপতে সক্ষম হই। এ পাণ্ডুলিপি প্রথমে ইডিশ ভাষায় এবং বিশ্ব নীরব হয়ে আছে নামে লেখার পর তা ফরাসি ও ইংরেজিতে অনূদিত হয়। যদিও আমি নিজেই পাণ্ডুলিপিতে অনেক কাঁটছাট করেছি, তারপরও ইডিশ ভাষার সংস্কার এখনো অনেক বড় রয়ে গেছে। ছোটখাটো কিন্তু মর্যাদাপূর্ণ সংস্থা এডিশন ডি মিথুইউ-এর কিংবদন্তিতুল্য কর্ণধার জারুমি লিনডেন ফরাসি সংস্করণে অনেক সংশোধন ও কাঁটছাট করেছেন। আমি সেগুলো মেনে নিয়েছি। কারণ, কিছু কিছু বিষয়ে অতিরঞ্জন করা হয়েছিল। সারসংক্ষেপ নিজেই অনেক গুরুত্ব বহন করে। তা ছাড়া ছোট ছোট বিষয়ে নিয়ে বড় বড় কথা বলা হয়েছিল বলে শংকিত ছিলাম।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইডিশ সংস্করণে লেখা শুরু হয়েছে এই সব হতাশাজনক বর্ণনা দিয়ে
শুরুর দিকে ছিল বিশ্বাসযা শিশুতোষ, আস্থাযা নিষ্ফল এবং মায়া­যা বিপজ্জনক।
আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম, মানুষের ওপর আস্থা রাখতাম এবং মায়ায় বসবাস করতাম। তাই আমাদের প্রত্যেকেই ঈশ্বরের শিখার থেকে ছুটে আসা ঐশ্বরিক ছটায় বিশ্বাস করতাম। আমাদের প্রত্যেকেই তার চোখে ও তার আত্মায় ঈশ্বরের ভাব বহন করতাম।
এটাই ছিল আমাদের সকল সহিষ্ণুতার কারণ না হলেও উৎস।
মূল ইডিশ লেখা থেকে অন্য যেসব বর্ণনা বাদ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগ বাবার মৃত্যু ও মুক্তি পাওয়াসংক্রান্ত। নতুন অনূদিত সংস্করণে কেন সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলো না? কেননা সেগুলো ছিল বেশি মাত্রায় ব্যক্তিগত, বেশি মাত্রায় আত্মগত। তাই সেগুলো অন্তরেই থাকা দরকার। সেগুলো থেকে একটু নমুনা
মনে পড়ে আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই রাতের কথা
এলাইযার খোকা আমার, কাছে আসো... তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই... কেবল তোমাকে... আসো, আমাকে ছেড়ে যেয়ো না... কেবল তোমাকে... আসো, আমাকে ছেড়ে যেও না... এলাইযার...
আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, তার কথার অর্থ ও সময়ের মর্মান্তিক অবস্থা বুঝতে পারি কিন্তু তারপরও সাড়া দিই না।
তার ক্ষতবিক্ষত দেহ থেকে তার আত্মা যখন ছিঁড়েখুঁড়ে বের হয়ে যাচ্ছে সে মুহূর্তে। তার মরণ যন্ত্রণার সময় তার কাছে আমাকে পাওয়াই ছিল তার শেষ ইচ্ছা। কিন্তু তার সেই শেষ ইচ্ছা আমি পূরণ করিনি।
আমি ভয়ে ছিলাম
আঘাতের ভয়ে
এ কারণেই তার কান্না শুনেও বধির হয়ে থাকি।
আমার দুঃসহ জীবনের তোয়াক্কা না করে তার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে তাকে আশ্বস্ত করার, তাকে দেখানো যে তাকে পরিত্যাগ করা হয়নি, আমি তার কাছে আছি, আমার খুব মনঃকষ্ট হচ্ছেএসব কিছু না করে বরং আমি চিত হয়ে শুয়ে থাকি, ঈশ্বরকে বলিআমার নাম ধরে বাবার ডাকাডাকি থামাও, তার কান্নাকাটি বন্ধ করো।
এসএস সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেসে ভয়ে আমি খুবই শংকিত হয়ে উঠি।
মূলত বাবার তখন আর চেতনা নাই।
তারপরও তার বেদনাকৃষ্ট বিলাপ নীরবতা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে আর কাউকে নয় কেবল আমাকে ডাকে।
তাই এসএস সৈন্য ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বাবার মাথায় বাড়ি চালায়চুপ করো বুড়ো, চুপ করো।
কিন্তু বাবা আর সে আঘাত টের পায় না, তবে আমি পাই। তারপরও সাড়া দিই না। বরং এসএস সৈন্যকে বাবার ওপর চড়াও হতে, তাকে একলা মৃত্যুর হাতের মুঠোয় ছেড়ে দেই। তার চেয়েও খারাপ হচ্ছেগোলযোগ করার, কান্নাকাটি জুড়ে দেবার, এসএস সৈন্যকে ক্ষিপ্ত করে তোলার জন্য বাবার ওপর রাগ করি।
এলাইযার! এলাইযার! কাছে আসো, আমাকে একলা ফেলে রেখো না।
তার কণ্ঠস্বর একেবারে কাছের হলেও মনে হয় বহু দূর থেকে তা আসছে। কিন্তু তারপরও আমি নড়ি না।
এ জন্য আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারব না।
আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য, আমাকে এক অচেনায় রূপান্তর করার জন্য এবং আমার ভেতরে নীচতার সবচেয়ে আদিম প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলার জন্য আমি কখনোই এই জগৎ-সংসারকে ক্ষমা করব না।
তার মুখে শেষ শব্দ ছিল আমার নাম। একটা ডাকনাম। তারপরও আমি তাতে সাড়া দিইনি।
ইডিশ সংস্করণে আয়নায় মুখ দেখার বর্ণনার মাধ্যমে বই শেষ হয়নি বরং বর্তমানের একটা বিষণ্ন ভাবনা তুলে ধরা হয়েছেবুখেনওয়াল্ডের পর সবেমাত্র দশ বছর কেটেছে এখনই বুঝতে পারছি যে, বিশ্ব খুব তাড়াতাড়িই তাকে ভুলে যাবে। আজ জার্মানি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। জার্মান সেনাবাহিনী পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। বুখেনওয়াল্ড-খ্যাত পিচাশ ইলসি কোখকে সন্তান জন্মদানের ও তার পরে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে... যুদ্ধাপরাধীরা হামবার্গ ও মিউনিকে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতীতকে মনে হয় মুছে ফেলা হয়েছে, তা বিস্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।
আজকে জার্মানি, ফ্রান্স এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও সেমিটিক ধর্মবিরোধী লোকজন দেখা যাচ্ছে। তারা বিশ্বকে বলে যে, ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করার কাহিনি ভেলকি ছাড়া আর কিছুই নয়। এবং অনেকেই ভালো করে না জেনে হয়তো তাদের কথা বিশ্বাস করবে, আজ না হলেও কাল কিংবা তার পারের কোনো দিন...।
আমি অতটা সরল নই যে বিশ্বাস করব যে, এসব হালকা ধরনের কথাবার্তায় ইতিহাসের গতিপথ বদলে যাবে কিংবা বিশ্ব-বিবেক নাড়া খাবে।
একসময় বইপত্রের যে শক্তি ছিল, এখন আর তা নাই। অতীতে যারা নীরব ছিল আগামীতেও তারা থাকবে।
পাঠকেরা জিজ্ঞেস করতে পারেনআগের সংস্করণ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে চালু আছে, তাহলে নতুন করে আবার অনুবাদ কেন? আগের সংস্করণ যদি বিশ্বাসযোগ্য কিংবা যথেষ্ট মানসম্পন্ন না হয়, তাহলে তার বদলে আরও ভালো ও মূলের কাছাকাছি এই সংস্করণ প্রকাশ করতে এত দেরি করলাম কেন?
তার জবাবে আমি শুধু বলব যে, সেই সময় আমি ছিলাম এক অখ্যাত লেখক। কেবল লেখালেখি শুরু করেছি। ইংরেজিতে আমার দক্ষতাও অত ভালো ছিল না। আমার ব্রিটিশ পাবলিশার যখন বলে যে সে একজন অনুবাদক পেয়েছে, তখনই আমি খুশিমনে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। সে অনুবাদ পড়ে দেখেছি এবং তখন মনে হয়েছে ঠিক আছে। তার পরে পুনরায় আর কখনো তা পড়া হয়নি।
পরে আমার স্ত্রী ম্যারিয়ন আমার অন্য লেখাগুলো অনুবাদ করে। সে আমার কথা বুঝতে পারে এবং তাকে কীভাবে সর্বোত্তম উপায়ে রূপান্তর করা যায়, তা অন্য যে কারও থেকে ভালো জানে। সেদিক দিয়ে আমি সৌভাগ্যবান। তাই ফেরার, স্ট্রাউস ও গিরোয়াক্স যখন একটা নতুন অনুবাদ তৈরি করার জন্য তাকে প্রস্তাব দেয়, তখন সে তাতে রাজি হয়ে যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তার অনুবাদ পাঠকেরা পছন্দ করবে। মূলত তার ব্যাপক সম্পাদনার কারণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংশোধন ও পুনর্লিখন করতে সক্ষম হই।
সুতরাং অনেক আগে লেখা এই বই পুনরায় পড়ে মনে হয় তা প্রকাশে বিলম্ব না করাই ভালো। তবে তারপরও আমার জিজ্ঞাসাআমি কি সঠিক শব্দটা ব্যবহার করতে পেরেছি?
সেখানে আমার প্রথম রাত নিয়ে আমি কথা বলেছি। কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরের বাস্তবতা বুঝেছি। সেখানে একজন পুরানো বন্দী এসে আমাকে ও বাবাকে বয়স সম্পর্কে মিথ্যা বলার পরামর্শ দেয়তাতে বাবা একটু কম বয়সী ও আমি একটু বেশি বয়সী হয়ে উঠি। তারপর বাছাই। নিশ্চল আকাশের নিচে দূরের চুল্লির কাছে আগানো। শিশুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ...। তারা জীবিত ছিল তা আমি বলিনি। তা-ই তখন আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে আমি নিজেকে বুঝ দিই যে, না, তারা মৃত ছিল, তা না হলে সে দৃশ্য দেখে আমি নিশ্চয়ই হুঁশ হারিয়ে ফেলতাম। আমার সাথের বন্দীরাও সে দৃশ্য দেখেছেন। তাদের সাক্ষ্যবাচ্চাদের যখন আগুনে ফেলা হয় তখন তারা জীবিত ছিল। ইতিহাসবিদদের মধ্যে টেলফোর্ড টেইলর তা নিশ্চিত করেছেন। তারপরও কোনো কারণে যেন আমি হুঁশ হারাইনি।
বইয়েরও যে ঠিক মানুষের মতো ভাগ্য আছে, তা আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি। ভূমিকা শেষ করার আগে তাই সে কথা বলে নেওয়া জরুরি বলে মনে হয়।
সাতচল্লিশ বছর আগে ফ্রান্সে সেই রাত প্রকাশ করতে গিয়ে শুরুর দিকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি,লাম তা আগেই বলেছি। শেষে বই প্রকাশের পর প্রচুর প্রশংসিত আলোচনা ছাপা হলেও তেমন বিক্রি হয়নি। কেননা তার বিষয়বস্তুকে মনে করা হয় অসুস্থ, তাই কেউ আর তার প্রতি আগ্রহ বোধ করে না। কোনো রাব্বি যদি কখনো তার বক্তৃতায় বইয়ের কথা বলে, তখন অনেকেই হাজির থাকে একথা বলার জন্য যে, ইহুদিদের অতীতের মর্মান্তিক বিষয়গুলো শিশু-কিশোরদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অর্থহীন।
পরে অবশ্য পরিস্থিতির বদল ঘটে। লোকজন সেই রাত এত সাদরে গ্রহণ করে, যা আমি কখনোই প্রত্যাশা করিনি। আজকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের হাইস্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কারিকুলামের অংশ হিসেবে বইটি পাঠ করে।
পরিস্থিতির এই ব্যাপক পরিবর্তনের ব্যাখ্যা কী করা যায়?
সর্বাগ্রে মনে হয়েছে যে, জনগণের মনোভাবের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও যুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া বয়স্করা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তার প্রতি অনাগ্রহ দেখিয়েছে এবং তার প্রতি উদাসীনতাকে উৎসাহ জুগিয়েছে। ফলে তাকে নিস্পৃহভাবে কেবল গণহত্যা বলেছে। যা আসলে সত্য ছিল না। তার পরে কিছু প্রকাশক সাহস করে এ বিষয়ের ওপর বই প্রকাশ করে।
তাই আজ অধিকাংশ বইয়ের তালিকায় এ বিষয়ে বই পাওয়া যায়। শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক তালিকার ক্ষেত্রেও একথা সত্য। তখন এ বিষয়ের ওপর কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কোর্স খোলে। আর আজকে অনেকেই তা করছে। এবং বিস্ময়করভাবে এসব কোর্স এখন খুবই জনপ্রিয়। আওশউইট্জ-সংক্রান্ত বিষয়বস্তু মূল ধারার পাঠসূচির অংশে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া এ নিয়ে সিনেমা, নাটক, নভেল আন্তর্জাতিক সম্মেলন, প্রদর্শনীয় ও বার্ষিক স্মৃতিচারণা হচ্ছে। যাতে বিভিন্ন দেশের লোকজন অংশ নিচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে সাড়াজাগানো প্রতিষ্ঠান যেটা গড়ে উঠেছে সেটা হলোওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্র গণহত্যা স্মৃতি জাদুঘর। ১৯৯৩ সালে তার যাত্রা শুরুর পর বাইশ লক্ষাধিক লোক তা পরিদর্শন করেছে।
তার কারণ হয়তোবাজনগণ জানে যে, দিন দিন গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকের সংখ্যা কমে আসছে। ফলে তার স্মৃতি যেহেতু খুব শিগগির শেষ হয়ে যাবে, তাই তা জানার প্রতি তারা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কেননা শেষে তো স্মৃতিই সবকিছুতার সোর্স, তার প্রসার এবং অবশ্যই তার পরিণতি।
গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে যারা সাক্ষ্য দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে তারা জানে যে, যারা মারা গেছে এবং যারা জীবিত আছে, তাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া তার দায়িত্ব। আমাদের সম্মিলিত স্মৃতিভরা অতীত থেকে আগামী প্রজন্মকে বঞ্চিত করার তার কোনো অধিকার নাই। ভুলে যাওয়া শুধু বিপজ্জনকই নয় বরং অপরাধ। কেননা যারা মারা গেছে, তাদের ভুলে যাওয়া হবে তাদেরকে আবার দ্বিতীয়বার হত্যা করা।
কখনো কখনো আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় আওশউইট্জ-এর প্রতি প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা আমি জানি কি না। জবাব দিই যে, শুধু জানি না তা-ই নয় বরং এই বিশাল মর্মান্তিক ঘটনার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কি না, সেটাই আমার জানা নাই। তবে আমি, জানি যে, প্রতিক্রিয়া করা দায়িত্বশীলতার মধ্যে পড়ে। কেননা খুবই কাছে কিন্তু এখনো অনেক দূরের সেই দানব ও অন্ধকার যুগ নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, তখন দায়-দায়িত্ব শব্দটা হয়ে ওঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের যুবকদের জন্য, আগামীতে যেসব শিশু জন্ম নেবে, তাদের জন্য প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য দিতে বাধ্য। কেননা সে চাইবে না তার অতীতের মতো করে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ হোক।