যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউক্রেনের সাম্প্রতিক কবিতা

 

ইউক্রেনিয়ান সাহিত্যের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য দূর অতীতের এগারো শতক থেকে আজ অব্দি বহমান। সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন উনিশ শতকের কবি তারাস শেভচেঙ্কো, প্রথম জীবনে যিনি রচনা করতেন রোমান্টিক ধারায় পদাবলী, যা বিবর্তিত হয়ে পরবর্তী জীবনে গীতল শৈলীতে প্রকাশ করেছিল ইউক্রেনের ইতিহাস। এই ধারাক্রমে ইউক্রেনের কবিতায় সাম্প্রতিক দিনযাপনের চিত্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মিশ্রিত হচ্ছে ইতিহাসের গতিবিধি। শৈলীর বিচিত্রতা হচ্ছে ইউক্রেনীয় কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ছন্দোবদ্ধ পদাবলীর পাশাপাশি প্রবাহিত হচ্ছে মুক্তক ছন্দের ধারাপ্রবাহ। উচ্চরোলের কবিতায় অহরহ মিশ্রিত হচ্ছে কথ্য বুলি। তবে সাম্প্রতিক কালের রাজনৈতিক আন্দোলন তথা ময়দান বিপ্লব থেকে রাশিয়া কর্তৃক সামরিকভাবে ক্রিমিয়ার সংযুক্তি অথবা দনবাস অঞ্চলের যুদ্ধ প্রভৃতি সমকালীন কাব্যধারার ধমনীতে প্রবাহিত করেছে সাহসী শোণিত, উপস্থাপনের ভঙ্গিও হয়ে উঠেছে প্রত্যক্ষ। কবিতাপাঠের মাইফেলও আজকাল সমকালীন দিনযাপনের নানাবিধ ইস্যুতে সরগরম।

এখানে উপস্থাপিত ছয়টি কবিতায় প্রতিফলিত হচ্ছে সাম্প্রতিক কালের গতিবিধি ও প্রবণতা; যা রাজনৈতিক সচেতনতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ভাবনার স্বাতন্ত্র্যকে উচ্চকিত করে তুলেছে। ইউক্রেনিয়ান ভাষায় রচিত কবিতাগুলো এবং ভূমিকাসংক্রান্ত তথ্য ও ছয়জন কবির নানা তথ্য ও উপাত্ত নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ম্যাগাজিনের সৌজন্যে। কবিতাগুলো নেওয়া হয়েছে The Culvert Journal থেকে। ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত কবিতাগুলোতে ইংরেজি অনুবাদকের নাম মূল রচয়িতার নিচে উল্লেখিত হয়েছে।

ভূমিকা ও ভাষান্তর: মঈনুস সুলতান

 

সুতরাং, এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলবো আমি

শেরহি জাদান

সুতরাং, এ বিষয়টা নিয়ে আমি কথা বলবো:
আলোচনা করবো—বর্ণাঢ্য আকাশে উড়ে বেড়ানো সবুজাভ চোখের রাক্ষস প্রসঙ্গে
সে দৃষ্টিপাত—আড়চোখে তাকায় সে নিদ্রিত শিশুটির দিকে,
সত্যিকারের অনুপযুক্ত একটি চোখ—যাতে উৎসাহের বদলে খেলা করে আতঙ্ক।
সংগীত থেকে সূত্রপাত হয় প্রতিটি জিনিসের,
কিছু গীতালি হৃদয়ে তৈরি করে গাঢ় জখম
এ ধরনের কিছু লিরিক আমি শুনেছি
শরতে অনুষ্ঠিত বিবাহবাসরে—
যেখানে বসেছিলাম আমার বয়সী শিশুদের সঙ্গে মিলেঝুলে।

প্রাপ্তবয়স্ক যেসব নাগরিকজন সৃষ্টি করেন সংগীত,
তাদের গানবাজনার ক্ষমতায় সংজ্ঞায়িত হয়ে ওঠে তাদের তারুণ্য।
অনেকটা যেন গানের তান ও গমকের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে 
সমাজে সুখী হওয়ার বিষয়টি,
মনে হয় কিছু পুরুষের একই সাথে 
শিকারি ও সংগীত কলাকার হওয়ার দক্ষতা সহজাত।
সংগীত হচ্ছে নারীর এলাচ সুরভিত নিঃশ্বাস,
যেসব পুরুষ বিমর্ষভাবে রাক্ষসখোক্কসের সঙ্গে ছুরিকা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়,
তাদের তামাকের গন্ধমাখা কেশ—
যারা এই মাত্র উচ্চরোলের বাদ্যবাজনায় গোরস্থান রীতিমতো গুলজার করে দিয়ে
ভন্ডুল করে দিলো বিবাহবাসর।

বিদ্যালয়ে পড়ুয়া যেসব শিশু উঁকি দিয়ে দেখে নেয় মৃত্যুর হিমশীতল কুঠুরি,
তাদের জননীদের পকেটে বেড়ে ওঠে সপুষ্পক উদ্ভিদ
যেসব পথের দূর্বাতৃণ মানুষের পদভারে হয়েছে পিষ্ট
তা নিয়ে যায়—বুঝলে—শুধু কবরস্থানে এবং জলাভূমিতে।

চাপ চাপ মৃত্তিকার নিচে তুমি গোপন করো শুধু মূল্যবান জিনিসপত্র হে—
তুমুল ক্রোধে পরিপক্ব হয় অস্ত্র,
বিদ্যালয় শিশুদের সমবেত সংগীতের সুরেলা আওয়াজের মতো
মা-বাবার চীনেমাটিতে তৈরি হৃৎপিন্ডগুলো ঝংকারে সরব হয়ে উঠবে।
আমি কথা বলবো
আলোচনা করবো দুশ্চিন্তার সানাই বিষয়ে...
আরেকটি ঘটনা... সেই বিবাহবাসরেরও উল্লেখ করতে চাই
যে অনুষ্ঠানটি ছিলো—যিশুর জেরুজালেমে প্রবেশের চেয়েও গুরুত্ববহ,
তোমার হৃৎপিন্ডের নিচে পবিত্র স্তোস্ত্রের মতো হচ্ছিলো বৃষ্টিপাত।
রাজ্যের সব পুরুষরা নৃত্য করছিলো 
যেভাবে বুটজুতোয় পিষে তারা নেভায় ঝোপঝাড়ের আগুন,
নারীরা যুগলনৃত্যে পুরুষদের এমনভাবে জড়িয়ে ধরছিলো
যেন তারা তাদের মরদদের কিছুতেই যেতে দেবে না যুদ্ধে।
দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে
বিশ্ব কানায় কানায় উপচে পড়ছিলো সংগীত ও অগ্নিতে।

অন্ধকারে উড়ুক্কু মাছ এবং গানবাজনায় পারঙ্গম পশুরা
সরব হয়ে ওঠে,
ইতিমধ্যে—বিবাহিতদের প্রায় সকলেই ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে।
ইতিমধ্যে—আমার বয়সীদের সকলের মা-বাবার মৃত্যু হয়েছে,
পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন আমাদের বীরেন্দ্রকেশরীরাও।
উন্মুক্ত হওয়া আকাশকে দেখায় গোগোলের উপন্যাসিকার আবহের মতো তিক্ত।
প্রতিধ্বনিত হয়—তাদের কন্ঠস্বরের ঝংকার
যারা গাইতে গাইতে তুলে আনে শস্য,
প্রতিধ্বনিত হয়—যারা ঠেলাগড়িতে করে মাঠ থেকে বয়ে আনে পাথর
প্রখর হয়ে ওঠে প্রতিধ্বনি, থামে না তা কখনো।

ইংরেজিতে ভাষান্তর: জন হেনিসি ও ওসতাপ কিন

কবি পরিচিতি

শেরহি জাদান-এর জন্ম ১৯৭৪ সালে। কবিতা ছাড়া তিনি উপন্যাস ও প্রবন্ধাদি রচনা করেছেন। অনুবাদক হিসেবেও তাঁর দক্ষতা প্রশংসিত। পড়াশোনা করেছেন খারকিভ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনাও করেছেন। ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ রেখে কাব্য পরিভাষায় যুগান্তরধর্মী পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা বারো এবং তিনি সাতটি উপন্যাস রচনা করে যশস্বী হয়েছেন।

 

 

শরতের শুরুতে খুব নগণ্য কিছু বিষয়

ইলা ইবতুশেংকো

 

শরতের শুরুতে ঘটে যায় খুব ছোটখাটো কিছু বিষয়: ভিন্ন এক শহরে ভুলবশত ফেলে আসি চাবি, গলায় আটকে আছে ভাংতি পয়সার মতো কাশি-কফের টুকরা-টাকরা, এক পেয়ালা তুর্কি ধাঁচের চা পেলে চমৎকার হতো।

তামার খুচরো পয়সা,
ব্যাটারিতে জমে আছে জল
শিলাখণ্ড,
অনুভব করি না কিছুই আর, মনে হয় সে এসেই পড়েছে, আওয়ারা একটি বিড়ালের পা ঘষে ঘষে আদর করছে,
তার ধূসর জিন্সে লেগে আছে বিবর্ণ ঝরাপাতা

কেবলমাত্র এ রকম এক বৃষ্টিমুখর রাতে ব্যালকনি সংলগ্ন দরোজায় শোনা যেতে পারে করাঘাত, শুধু এ রকম জল ঝরঝর নিশীথে খুলে রাখা যায় দরোজা,

কিন্তু দরোজার ওপাশে কে এসে দাঁড়াতে পারে, তা কিন্তু নির্ভর করে—জানালার তলায় পাইনের বাদামগুলো ঝরে পড়লো কি না, আর পাইন বৃক্ষের উঁচু শাখাপ্রশাখা ভাসমান মেঘে বিঁধে ধবল চাদরটি ছিঁড়েফুঁড়ে দিলো কি না। 
আর বিজুলির রেখায় তোমার কপালের দুপাশের শিরার মতো নকশা তৈরি হলো কি না।

শরৎ শুরু হয়েছে রীতিমতো শিশুসুলভ বিষয়-আশয় নিয়ে—দুয়ারে নাড়া দিয়ে এটা দৌড়ে পালিয়ে যায়; সারা দিন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়তে চাই বইপুস্তক; চাদরে জড়িয়ে-মড়িয়ে তোমাকে দেখাচ্ছে মমির মতো, আর্দ্রতার ব্যান্ডেজে জড়ানো—

পুরানো কিছু নিয়ে মেতে থাকতে চাই: না, অ্যালকোহল দিয়েও কিছু হবে না, শীতের বরফকুচিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে জোড়া হাঁটু,

সুতরাং আবার—প্রতিবার—প্রত্যেকটা সময় আমাদের কথাবার্তার প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে হিম কনকনে ঋতু, আর্দ্র স্যাঁতসেঁতে কাদার মতো;

শরৎ যেন দক্ষ তস্করের মতো সিঁদ কেটে লোপাট করে নেয় আমাদের আলোচনার তাবৎ বিষয়বস্তু। পরচর্চার অবসরটুকুও পাওয়া যায় না, আওয়ারা একটি বিড়াল কোলে নিয়ে শুয়ে থাকে সে ব্যালকনিতে, যেখানে আরও অনেক আপাতগোপন জিনিসপত্র জড়ো হওয়ার কথা।

শরৎ আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় রান্নাঘরে, চুলোয় কেতলি বসাতে আমরা বাধ্য হই, শরৎ শুরু হয় অতি নগণ্য কিছু বিষয়-আশয় নিয়ে, কিন্তু বেড়ে ওঠে প্রতিবেশীর শিশুসন্তানদের মতো, হিমজঠর থেকে বেরিয়ে আসে শীতের খুচরো পয়সাপাতি, তুষার আমাদের জমিয়ে মমি করে তুলবে, শীতে আমরা জমে যাবো অর্ধ উচ্চারিত বোলচালের মতো;

তারপর কেউ আর মাঝরাতে ব্যালকনির জানালাটি ধরে নাড়া দেবে না,

কিছুদিনের মতো তারপর অস্তিত্ব হারিয়ে একেবারে বিলীন হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হবে।

ইংরেজিতে ভাষান্তর: ইউরি জাবাদস্কি

কবি পরিচিতি

ইলা ইভতুশেংকোর জন্ম ১৯৯৬ সালে। প্রকাশ করেছেন একটি কাব্যগ্রন্থ, তবে কবিতায় বিবিধ প্রতিযোগিতায় কবি পুরস্কৃত হয়েছেন।

 

তুমি

দিমিত্র লাঝুতকিন

ভ্যাংকুভার বে’র সমুদ্রজলে যখন টু-সিটার সিপ্লেনটি নেমে পড়ে
তখন—আকাশ যেন চলে আসে অতি কাছে
মনে হয় ডজন ডজন ধাতব ভোমরা কথা বলছে পরস্পরের সঙ্গে:
চোখে পড়ে—তিমি মাছের পিঠ লাফিয়ে উঠছে সমুদ্রে
গিরিখাতের তুষারে আটকে পড়া স্কি করা মানুষটিকে একদিন টেনে তুলেছিলাম
বুঝলে—পালের সঙ্গেও কথা বলেছি যখন তা গতিপথ বদলে ছিলো

শুধু তুমি আর আমি জানি আসলে কী ঘটেছিল
বিরাট কয়েকটি আলবাট্রস পাখি 
চোরের মতো এসে সাবাড় করে দিয়েছিল আমার প্রাতরাশ
যখন আমরা উপড়ে পড়া পাইন বৃক্ষের ওপর বসে
কুয়াশাচ্ছন্ন উপসাগরের দিকে তাকিয়ে চুমো খেয়েছিলাম
পাখিগুলো ছিঁড়ে তছনছ করে করে দিয়েছিল... শুধু পাউরুটি নয়
ছড়িয়ে দিয়েছিল ফ্রেঞ্চফ্রাইগুলোও

নিঃশ্বাস প্রশ্বাস হয়ে এসেছিল বেজায় মন্থর গতি
তবে নিঃসরণ ছিলো—
মনে হয় ক্রমাগত সংকোচনের ফলশ্রুতি
আর তোমার গ্রীবায় উল্কি করে আঁকা চিত্রটি
আমি জিভ কেটেছিলাম,
তারপর আমরা—এইখানে—খানিক উষ্ণ হয়ে ওঠা শীতে 
পর্যবেক্ষণ করেছিলাম ভলিবল খেলোয়াড়দের
দারুণ রকমের বর্ণাঢ্য সব এথলিট তাদের রঙচঙে জ্যাকেটগুলো 
খুলে ছুড়ে ফেলেছিল সৈকতের বালুকায়
তোমাকে আলিঙ্গনের নিষ্পেষণে পিষ্ঠ করতে করতে
আমি কিন্তু প্রত্যক্ষ করছিলাম নিবিড়ভাবে 
অর্ধবৃত্তাকারে এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে যাওয়া বলগুলো
সুরুজের কিরণে ঝলসে উঠেছিল স্যালেমেনডার নামে একটি গিরগিটির লেজ
জেলেরা নেশাতুর দৃষ্টিতে শুকিয়ে আসা জালের জট ছড়াচ্ছিল
আর ম্যাগনোলিয়ার ঝোপঝাড়ের ওপাশে জড়ো হচ্ছিল 
মারিজুয়ানার ধূম্রপ্রিয় জনা কয়েক নেশাতুর
আজ মনে হয় আর কোনো কাজ নেই
শুধু নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাস
এই হিমশীতল সমুদ্দুর— 
আমাদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর যেন ঝুলে আছে বড়শিতে
শান্ত বাতাস খানিক দূরের দ্বীপগুলোকে ঠেলে নিয়ে আসছে সৈকতের প্রান্তিকে
ভাবগম্ভীর চেহারার একজন চীনা ভদ্রসন্তান জলে যষ্টিটি ডুবিয়ে 
ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়া জলের দিকে তাকিয়ে
যেন মাপজোখ করে নিচ্ছেন বহতা সময়ের
বাদামি আলোয় রেকুন জাতীয় বনবিড়ালগুলো বেরিয়ে এসেছে তাদের বাসা ছেড়ে
আমার স্বদেশের নামটি কীভাবে শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা যায়—তা জানতে চেয়েছো তুমি
তার জবাবে
আমি বলি
ঠিক আছে—
প্রথমে না হয় শেখা যাক কীভাবে বলতে হয়
তুমি
তার পয়লা অক্ষরটি।

ইংরেজিতে ভাষান্তর: ইউরি জাবাদস্কি

কবি পরিচিতি

দিমিত্র লাঝুতকিন-এর একাধিক কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা ছাড়া তিনি সংগীতের লিরিক রচনা করে থাকেন। স্লাম পোয়েট শিরোনামে একটি পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। পেশাগতভাবে কবি এক ক্রীড়াবিষয়ক ভাষ্যকার, টেলিভিশনেও তিনি উপস্থাপক হিসেবে কাজ করে থাকেন।

 

কিয়েভ নগরীতে প্রেম

নাতালকা বিলতসারকিভেট্স্

গন্ডোলা ভাসা ভেনিসের তুমুল আকর্ষণের চেয়েও তীব্র
তার চেয়েও অনেক মারাত্মক কিয়েভ নগরীতে প্রেমাচ্ছন্ন হওয়া।
হালকা হাওয়ায় ওড়ে প্রজাপতি— 
তাদের চিত্রিত অবয়ব ক্ষুদ্র হতে হতে বিন্দুতে মিলায়,
প্রজ্বলিত হয় মৃত শুঁয়াপোকার বর্ণাঢ্য ডানা!
আর বসন্ত ঋতুতে পত্রালি শোভিত চেস্টনাট বিরিক্ষে
জ্বলে ওঠে পুষ্পমঞ্জরির মোমবাতি!

জোড়া ওষ্ঠের সস্তা রঞ্জনীও হয়ে ওঠে মুখরোচক,
মিনিস্কার্ট-এর আঁটসাঁট বন্ধনে নিষ্পাপ দেহের দুঃসাহসী দোলন,
আর ওই হেয়ারড্রেসারের কথা বলছি—
কেশবিন্যাসে মনে হয় না পালন করা হয়েছে সঠিক রীতি,
তারপরও দৃশ্যপ্রতিমা, স্মৃতি... কিছু প্রতীক... কিছু ইশারা
আন্দোলিত করে আমাদের…
বিষয়টা দুঃখজনকভাবে সুস্পষ্ট,
অনেকটা মানুষের মুখে মুখে ফেরা—সাম্প্রতিক কোনো লোকপ্রিয় লিরিকের মতো।
বখাটে এক বোম্বাটের ছুরিকাঘাতে নিহত হবে তুমি,
তোমার শরীরের রক্তপাত ছড়িয়ে যাবে
তারতারকার সরণিতে পার্ক করে রাখা 
ঝাঁ-চকচকে মোটরকারের চেসিসে মরচে ধরে যাওয়ার মতো
ঝুলবারান্দা থেকে তুমি মুখ থুবড়ে পড়বে সড়কে... ঠিক এইখানে
নিঃসীম আকাশের তলায়,
যে পরিসরকে কল্পনা করো তুমি ছোট্ট নোংরা প্যারিস
দফতরের কর্মচারীদের মতো নিপাট শুভ্র ব্লাউজ পরা তোমার দেহ
ঠিক ওই জায়গায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
মৃত্যু থেকে বিবাহকে কীভাবে ভিন্ন করা যায়
তা তুমি কখনো উপলব্ধিও করতে পারবে না।

তথাকথিত সাম্যবাদকে নতুন কলেবরে ঢেলে সাজানোর চেয়েও
ঢের মারাত্মক কিয়েভ নগরীতে প্রেমাক্রান্ত হওয়া,
নেশাগ্রস্ত নিশীথে রাজদণ্ড উত্থিত হয় 
চাঁছাছোলা পর্বতটির চাঁদি ফুঁড়ে, 
লাল ঝান্ডা উঁচানো 
তাদের হাতে টবে ভরা সারসের লোহিত চঞ্চুর আকৃতিতে ফুটে ওঠা অঢেল ফুল 

বখাটে এক বোম্বাটের ছুরিকাঘাতে নিহত হবে তুমি,
তোমার শরীরের রক্তপাত ছড়িয়ে যাবে
তারতারকার সরণিতে পার্ক করে রাখা 
ঝাঁ-চকচকে মোটরকারের চেসিসে মরচে ধরে যাওয়ার মতো
ঝুলবারান্দা থেকে তুমি মুখ থুবড়ে পড়বে সড়কে... ঠিক এইখানে
নিঃসীম আকাশের তলায়
যে পরিসরকে কল্পনা করো তুমি ছোট্ট নোংরা প্যারিস
দফতরের কর্মচারীদের মতো নিপাট শুভ্র ব্লাউজ পরা তোমার দেহ
ঠিক ওই জায়গায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

ইংরেজিতে ভাষান্তর: এন্ড্রু সরোকোস্কি

কবি পরিচিতি

কবিতা রচনা করে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন কবি নাতালকা বিলতসারকিভেট্স। সৃজনশীল শৈলীতে তাঁর দখল সর্বজনবিদিত। এ ছাড়া সম্পাদনা ও অনুবাদের কাজেও কবি প্রচুর দক্ষতার পরিচেয় দিয়েছেন। তাঁর কবিতা ইউরোপের বিবিধ ভাষায় অনূদিত হয়ে একাধিক মর্যাদাবান সাহিত্য সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

 

আমাকে লাশ ভেবে আমার কপালে চুমো খাবে না

ইউলিয়া মোসাকভস্কা

ধরা যাক, প্রায় দুই বারের মতো শুধু চোখ দুটোর দৃষ্টিক্ষমতাই কমেনি, 
বরং বেড়েছেও চশমার কাচের ঘনত্ব।
ওষুধের সঙ্গে সে মেশায় ফলের সুমিষ্ঠ নির্যাস,
বই-এর পৃষ্ঠাগুলো তার শরীরের ত্বকের মতোই হলুদাভ।
যেন শূন্যতাকে শ্রোতা ভেবে সে বলে যায়
তার চমৎকার গল্পগুলোর বেশ কয়েকটি।

আমার দৃষ্টিতে—প্রধান চরিত্রগুলো আদতে পুরানো দিনের চেনাজানা বন্ধুবান্ধব।
গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা গুটিসুটি মেরে বসে একদম আগের মতো
হাসপাতালের বিছানায়, 
তাদের পায়ে হাঙ্গেরি থেকে আমদানি করা চকচকে জুতা,
এ ফ্যাশনেবল পাদুকা দুটির জন্য সে—এমনকি খুনখারাপিতেও পিছপা হবে না।
ভাবভঙ্গিতে মনে হয় সবকিছুকে সে বিদ্রূপ করছে।
সে বলেই বসে—বুঝলে... রক ব্যান্ড বিটেলস্ কিংবা বিদেশি ভাষা বিভাগ
এসব কিছু থেকে উপকার কিছু পাওয়ার ভরসা নেই হে,
যা দেখছো—সত্যি কথা বলি, 
তাবৎ কিছুই হরেদরে সুনির্বাচিত জনা কয়েকের জন্য
এ থেকে—যারা পিতৃমাতৃহীন অনাথ কিংবা দিনদরিদ্র আত্মীয়স্বজন
কারোরই উপকৃত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

আর আরেকটা ব্যাপার—সে নীরবে ন্যাংটি ইঁদুরের মতো
মাখনের ভেতরে প্রচ্ছন্ন পনির হয়ে লুকাতে পছন্দ করে।
তোমার মতো মানুষজন গলিঘুঁজিতে আমাদের হাতেই ধরা পড়ে
কাটা পড়ে এদের শিকড়,
আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষজন এটা পছন্দ করে।
পুরো বিষয়টি হয়তো তার ছেলেটির জন্য
লড়াইটি তাজা একখণ্ড মাংস অথবা একটি নাশপাতির জন্য।

আমার চোখে পড়ে—বুদ্ধিদীপ্ত তবে কুঁচকানো মুখশ্রীঅলা নারীটির দিকে
মাকড়সার সরু পায়ের মতো লিকলিকে খ্যাংরাকাঠি তার পদযুগল
পাশে পড়ে আছে পোর্সেলিনের চিত্রত তৈজস, ইস্পাতের যন্ত্রপাতি।

উঁচু ছাদের স্যাঁতস্যাঁতে একটি ফ্ল্যাটে বাস করছে সে
কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাই সুস্পষ্ট—গিটার হাতে সুঠাম,
জিনসের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তাকিয়ে আছে বড় বড় বিস্ফোরিত চোখে
দেখে মনে হয়—তার স্মৃতিতে সঞ্চিত হয়ে আছে অজস্র বইপত্রের সহস্র পৃষ্ঠা।
তার মুখটি খোলা—তাকিয়ে আছে তাবৎ পৃথিবীর দিকে— 
চোখ জোড়া কৃষ্ণাভ জলের সমুদ্র-গভীর
কোনো নারীর জন্য নয়—কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়াতেও উৎসাহী ছিলো না কখনো
বাহুযুগল ছড়ানো—কাঁধে ওপর নয় যেন তরঙ্গবিভঙ্গে ভেসে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে

ইংরেজিতে ভাষান্তর: ইউরি জাভাদস্কি

কবি পরিচিতি

ইউক্রেনের লাবিব নগরীর বাসিন্দা কবি ইউলিয়া মোসাকভস্কা-এর গ্রন্থসংখ্যা চার। কাব্যকলার জন্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন একাধিকবার। কখনোসখনো মাতৃভাষা থেকে ইংরেজিতে সাহিত্য অনুবাদও করে থাকেন। পেশাগতভাবে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কাজে যুক্ত আছেন।

 

যোগাযোগ

ইউরি জাভাদস্কি

অনুভূতির সঙ্গে রক্তচাপ ওঠানামার সম্পর্ক— 
ব্যাপারটা সত্যিই আশ্চর্যজনক!
শরীরের অন্তর্গত বিদ্যুৎ স্থবির হয়ে পড়ার পথে সৃষ্টি করে প্রতিবন্ধক, 
কিন্তু, তারপরও আমি সচেতনভাবে চেষ্টা করি সক্রিয় না হতে—
আঙুলগুলো স্নায়বিক চাপে ঘাবড়ে গিয়ে কিবোর্ড নিয়ে খুটখাট করছে,
অসম মাত্রায় অতঃপর পদাবলী পরিবর্তিত হয় দিবাস্বপ্নে।

তোমার টেক্সট্ ম্যাসেজগুলো অনুসরণ করতে শুরু করে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ,
না, একেবারে নীরব থাকার কোনো বাসনা আমার নেই
কিন্তু তোমাকে বলার মতো আমার অবশিষ্টও কিছু নেই।
চলে গেছে যে দিন— 
নেই এমন কোনো ওষধি গুলি কিংবা বটিকা—যা আনতে পারে 
তাকে ফিরিয়ে,
বিশেষ দিনটি বিগত হওয়ার পর
অপ্রীতিকর এক ক্লান্তিতে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল আমার দেহমন,
তারপর—সে রাতের বিরক্তিকর ধকলজাগানিয়া স্বপ্ন
চাইলেও তা আজ আর স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।
তুমি এ সময়ে আমার খুব কাছেই আছো—ভেবে আমার অবশ্য ভালো লাগছে, 
তোমার আঙুলের উষ্ণতা আমি যেন অনুভব করতে পারছি।
আহ্, সেই শিকড় উপড়ানো দিনগুলো যেন আমারই কবিতার পঙ্‌ক্তি
আমাকে অ্যালকোহলের তুমুল মাদকতায় আচ্ছন্ন করে আছে।
আজকের পুরো দিনটিকে মনে হচ্ছে অনিকেত এক ভোরের মতো
ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে হিমেল কুয়াশা
শিশিরের বর্ণাঢ্য সব অণু পরমাণু ভেসে আছে হাওয়ায়,
শরতের এ শূন্য প্রহর।

এই যে তোমার পাশে আছি— 
এ অনুভূতি আমাকে তুমুলভাবে খুশি করে তুলেছে,
আগে কখনো নিজেকে এ রকম শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী মনে হয়নি।
যদি প্রতিটি প্রহর এ রকম শরতের শিশিরে স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে
বড়ো দ্বিধা হয় আমার—
আমি সচেতন যে—এমন সুরভিত সময়ও অতিক্রান্ত হবে
তারপর মাঝেমধ্যে আমি স্মৃতিকাতর হবো 
ভাববো—সত্যিই তো পার হয়ে এসেছি সুন্দর সময়।
চোখ দুটি মুদে নিজেকে একটু এলিয়ে দাও তো— 
অনুভব করতে পারছো কি?
এসেছে শরৎ ঋতু— 
আর আমাদের আচ্ছন্ন করে ঝরে পড়ছে বিষাদ,
এই তো আমি, অনুভব করো আমাকে
যে আমি নিমজ্জিত হয়ে আছি সাময়িক এক সংকটে।

কবি পরিচিতি

জন্ম ১৯৮১ সালে টারনোপিল শহরে। টারনোপিল-এর পেডাগোজিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। কিরক নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তরুণ লেখকদের জন্য তৈরি একটি মাস্টার্ লেভেল একাডেমিক প্রোগ্রামে অধ্যাপনা করেন। সংগীত কলাকার হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। তিনি সাউন্ড পোয়েট্রি নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। অনুবাদক হিসেবেও কবি ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।