কয়েকটি অনুগল্প
মানির অপমান বজ্রপাত
এত বছরের পুরোনো বটগাছটা হঠাৎ করে মারা গেল। কেন মারা গেল কেউ বলতে পারছে না। গাছটার বয়স কত—কেউ বলে একশ বছর, কেউ বলে দেড়শ। বয়স যা-ই হোক, বটগাছটা হঠাৎই মারা গেল। বার্ধক্য কি কারণ? এলাকাবাসী বেশ হতবাক। এখন তো বর্ষার দিন নয় যে বজ্রপাত পড়বে। কেউ এর কারণ উদ্ধার করতে পারল না।
বটগাছকে ঘিরে কয়েকটা ছোটখাটো দোকান গড়ে উঠেছিল। এলাকাবাসী এই জায়গাকে বটতলা বলত। বটতলা একটা স্টপেজের নাম হয়ে উঠেছিল। বিকেলবেলা সবাই বটতলার নিচে গজিয়ে ওঠা চায়ের দোকানে বসে চা খেত আর আড্ডা দিত। সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি—সবই উঠে আসত সেই আড্ডায়।
গাছটা মারা যাওয়ায় সবাই খুব দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। বিভিন্নজন বিভিন্ন রকম গালগপ্প দিল বটগাছের মৃত্যু নিয়ে। কিন্তু কেউই রহস্য উদঘাটন করতে পারল না।
ঘটনা ঘটেছিল মাস ছয়েক আগে। জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে প্রভাবশালী দলের লোকজন বেশ বড় একটা পেরেক মারল বটগাছে। তাতে কি বটগাছ আঘাত পেয়ে মারা গেল? নিশ্চিত না।
পেরেকের ওপর একটা বড় বোর্ড ঝোলানো হয়। বোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা ছিল, ‘আমাদের অঙ্গীকার, দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার’।
নির্বাচনে তারা জয়ী হলো। বছরখানেকের মাথায় দুর্নীতির মহোৎসবে মেতে উঠল সেই প্রভাবশালী দল।
বোকা বটগাছ। বিশ্বাস করেছিল এই প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করবে। যখন মিথ্যা প্রমাণিত হলো, তখন সে কষ্টে, অপমানে নিজেই আত্মহত্যা করল।
গুম দুপুর
: কী অজুহাতে আবার তেলের দাম বাড়ালেন?
: উপায় কী বলো?
: তাই বলে বছর না যেতেই?
: সব কি আমাদের হাতে?
: ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখে নিজেদের ইচ্ছেমতো দেশ চালাচ্ছেন, আর বলছেন এই কথা?
: ওরা টিকিয়ে রাখেনি?
: তাহলে জনগণের স্বার্থ দেখবে কে?
: করোনার পুরো দেড় বছরে ব্যবসায়ীদের কত লস হয়েছে জানো?
: করোনার পুরো দেড় বছরে কত মানুষ পথে বসেছেন জানেন? কত মানুষ না খেয়ে ছিল জানেন?
: কেউ কি মরেছে?
: মরলে বুঝি ঘুম ভাঙবে? সমস্ত ভোগ্যপণ্য, গাড়িভাড়া, বাসাভাড়া আর কিছু বাকি আছে?
: কেন বোঝো না ব্যবসায়ীদের না দেখলে আমাদের ক্ষমতা থাকবে?
: এ কারণেই কি ভোট বন্ধ করে দিয়েছেন?
: উন্নয়ন করতে হলে অনেক কিছু করতে হয়, এইটা জানো না?
: এই উন্নয়ন কেউ চেয়েছে? এই কারণে কি গণতন্ত্র মুছে দিয়েছেন?
: জনগণ আগের চেয়ে ভালো নেই?
: গুম, হত্যা, দখল—সবকিছু পাল্লা দিয়ে বাড়েনি?
: সব কি মন জুগিয়ে চলা যায়?
: তাই বলে সাম্প্রদায়িকতা? বিভাজন? উগ্রতা? ধর্মের অজুহাতে মানুষ খুন?
: এত প্রশ্ন করো কেন?
: কী করবেন? গুম?
: রাজনীতি কী বলে?
মনন
অনেক দিনই পার করা গেল। আজ আর গেল না। গার্লফ্রেন্ডের জেদ সোহরাওয়ার্দীতে বসবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নোমান গার্লফ্রেন্ড নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর উদ্দেশে রওনা দিল। রিকশা চলছে। নোমানের বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে। গার্লফ্রন্ড অনবরত কথা বলছে। নোমান হাসিমুখে মাথা নাড়ছে। মনে শঙ্কার বীজ গাছপালা গজিয়ে ফল দিচ্ছে।
: তুমি নাকি প্রায় সোহরাওয়ার্দীতে আড্ডা মারো। অথচ আমার সাথে যেতে চাও না, কেন?
: কই, এই যে যাচ্ছি।
: আমি জোর করে নিয়ে যাচ্ছি দেখে যাচ্ছ।
: আরে নাহ্।
রিকশা দোয়েল চত্বর পার করল। তিন নেতার মাজারের সামনে এসেছে। তখনই তিনজন নারী বেশ জোরেই হাঁকডাক দিল।
: এই নোমান, নোমান। কই যাও?
: একটু সামনে যাই।
: চা খাইয়া যাও।
: আজ না। পরে আসবো।
: লগে কে?
: বান্ধবী।
: আইচ্ছা, যাও। পরে আসবা কিন্তু।
রিকশা চলছে। উত্তপ্ত হাওয়া বইছে। গার্লফ্রেন্ডের তলোয়ার সূর্যের আলোয় খচখচ করে উঠল।
: ছি্, এরা তোমার বন্ধু? এই কারণেই তুমি সোহরাওয়ার্দীতে আসতে চাও না?
: আচ্ছা, অসুবিধা কোথায়?
: আবার যুক্তি দিচ্ছ?
: তুমি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে পড়ো? তুমি কেন মানুষকে আলাদা করবা?
: তাই বলে প্রস্টিটিউট?
: ওরা আমার খুব ভালো বন্ধু। ওদের সাথে আমার মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক।
: ছি্।
: সমাজবিজ্ঞানে পড়ে তোমার যদি এই চিন্তা হয়, তাহলে বাকিদের কী হবে?
: শোনো, পড়াশোনা আর ব্যক্তিজীবন—দুটো এক না। পড়াশোনা, পড়াশোনার জায়গায়। ব্যক্তিজীবন, ব্যক্তিজীবনের জায়গায়।
রিকশা স্থির। বোধও কি স্থির?
লাশ পরিহিত মাস্ক!
মাস্ক পরিহিত একটা লাশ মর্গে ঢুকল। ডোম খুব কৌতূহল নিয়ে লাশের দিকে তাকাল। মুখের পান আরও জোরে চাবাতে চাবাতে মাথা দোলাতে লাগল। মাথা দোলানোটা অভ্যাস নয়। বদভ্যাস। দীর্ঘদিনের।
ডোমের সাথে অর্বাচীনও লাশের দিকে তাকাল। কিছু কি বুঝতে পারল?
ডোম পানমুখে আলতো আলতোভাবে বলল, কী? এই অবস্থা ক্যান? কেউ কিছুই বলতে পারল না।
অর্বাচীন ডোমের দিকে তাকাল। কিছু কি বোঝা গেল?
মর্গ থেকে ডোম বের হলো। কয়েক কদম এগিয়ে চায়ের দোকানে বসল। অর্বাচীনও ডোমের সাথে চায়ের দোকানে বসল। গরম ধোঁয়া ওঠা চা আর সিগারেট ফুঁকতে লাগল।
চায়ের দোকানে টেলিভিশন চলছে। খবর হচ্ছে। কেউ শুনছে, কেউ দেখছে, কেউ গিলছে। সুন্দরী উপস্থাপিকা খবর পড়ছে। রাজধানীতে মাস্ক পরানোর অভিযান চলছে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
পরের খবর, রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় একজন মারা গেছে। মৃত মানুষের চেহারা অবিকল মর্গে পড়ে থাকা লোকটির মতো।
অর্বাচীন বুঝতে পারছে, এই সেই লোক। এখন মর্গে পড়ে আছে। মুখে মাস্ক।
মাস্ক না পরে পুরো করোনা পার করে দিল লোকটি। অভিযান চলছে দেখে দোকান থেকে দ্রুত মাস্ক কিনে গাড়িতে উঠবে। এমন সময় বাম দিক থেকে দ্রুতগামী একটা বাস ছুটে এলো। বাসটা ধাক্কা দিয়ে চলে গেল।
অর্বাচীন ভাবছে, কিছু কি বোঝা গেল?
ইচ্ছাপূরণ
নেশায় বুঁদ। ড্যান্ডি খেয়ে রাস্তার আইল্যান্ডের ওপর ঝিমাচ্ছে দুটি শিশু। বয়স অল্প। নেশা ভেঙে গেলে তারা গুলি করছে। গুলি কখনো মানুষের গায়ে লাগছে। কখনো গাড়িতে। কখনো আবার গাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে। সবই হচ্ছে খেলার ছলে।
সেই সময় আইল্যান্ডের পাশে দিয়ে যাচ্ছিলেন সংস্কার মন্ত্রী। সংস্কার মন্ত্রী দেশের অনেক কিছু সংস্কার করেছেন। এর জন্য তিনি বেশ বিতর্কিত।
সাইরেন বাজিয়ে যাওয়ার সময় ড্যান্ডি খাওয়া শিশু দুটি খেলার ছলে তার গাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। গাড়ি উড়িয়ে দিয়ে তারা খুব মজা পায়। নিজেরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
সংস্কার মন্ত্রী তার গাড়ি নিয়ে কিছুদূর গেল। এমন সময় তার গাড়িতে বোমা পড়ল। বিকট শব্দ হলো।
মন্ত্রী সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন শিশুদের পাঠ্যবই সংস্কার করে।
জন্মদিন
রেস্টুরেন্ট পাহারা দেওয়ার গুরুদায়িত্ব মতিনের ওপর। কিন্তু তার মাথায় এখন অন্য কিছু ঘুরছে। গেটে দাঁড়ালেও তার মন এখন অন্যখানে।
আজ জন্মদিনের বিশাল পার্টি। মতিন আজকে বারবার ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাইছে। কারণটা অজানা। ম্যানেজার এত ব্যস্ত যে মতিনের কথা শোনার মতো সময় পাচ্ছে না। মতিন যতবারই আসছে, ম্যানেজার হাতের ইশারায় পরে আসার কথা জানিয়ে দেয়।
অবশেষে সে সুযোগ পেল। মতিন বেশ ইনিয়ে-বিনিয়ে যা বলল, তা হলো আজ তার ছেলের জন্মদিন। ছেলে তার বাবাকে বলেছিল, আসার সময় যেন ভালো কিছু নিয়ে আসে। তাই মতিন ভাবছিল ম্যানেজার স্যারকে বলে যদি কিছু পাওয়া যায়।
ম্যানেজার ভ্রু কুঁচকাল। বিরক্তি নিয়ে বলল, তুমি মিয়া আগে বলবা না। এখন তো কিচেনে কিছুই নাই। আজ দেখলা না কেমন ভিড়। কী আর করা, অন্য একদিন তোমার ছেলের জন্য ভালো কিছু দিয়া দিব। এখন যাও।
মতিনের মন ভরে নাই। মুখে না বললেও মনে মনে বলল, পোলার জন্মদিন তো আরেক দিন আইবো না।
মতিন চলে যাচ্ছিল। এমন সময় ক্লিনিংয়ের কলিম মিয়া এগিয়ে আসে। একটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দেয়। বেশ আবেগ নিয়ে বলে, ভাই, এইডা খাবার খারাপ না। স্যাররা তো মেলা খাবার লই, খাই কিন্তু একডু। যেডা ফালাইয়া দেয় হেইডা আমি আলাদা কইরা পরতেক দিন বাড়িত লইয়া যাই। আইজক্যা আপনের পোলার জন্মদিন। আপনে এইডা লইয়া যান। এত রাইতে কই খাবার পাইবেন? পোলায় মন ভইরা খাইতে পারব। আপনি আর আমি জানলাম, পোলায় তো আর জানব না, এইডা ফেলান দেয়া খাবার।
বিচার কাঁদে সরবে
রিকশাওয়ালা বারবার চিৎকার করছে। বড়ই তির্যক। কানে লাগে। ‘আল্লাহ আপনের বিচার করবো...’। ব্যাঘ্র, তবে কাটছে না। ফুঁসছে।
রিকশাওয়ালার মুখের ওপর একের পর এক চপেটাঘাত পড়ছে। কয়েকজন এগিয়ে এসেছে। কারও মনে উৎসুক দৃষ্টি। উঁকি দিচ্ছে। কেউ এগিয়ে থামিয়েছে। কেউ দূরে দাঁড়িয়ে আহা, উহু করছে। কেউ ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে,
কেউ ঘটনার রায় দিয়ে ফেলেছে। কে অপরাধী, কে নিরপরাধ। তাদের রায়ে সব নিশ্চিত।
ছাদে দাঁড়িয়ে অর্বাচীনও দেখছে। শাসক আর শোষিতের চিরচেনা দৃশ্যপট। ব্যতিক্রম কি কিছু আছে?
এই যে রিকশাওয়ালা চিৎকার করে বিচার চাইছে। সে নিজেও কি বিচার আশা করে? বিচার কি আছে?
উপেক্ষিত বিচার। বিচারিক প্রক্রিয়া। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিচার বসল দরবারে। সত্যি সত্যিই বিচার বসল। বিস্মিত সবাই। অর্বাচীনও। দুনিয়ার বিচারক স্বয়ং।
বিচারক সব শুনলেন। বুঝলেন। রায় দেওয়ার আগে নিজেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লেন। বিরতি নিলেন।
রিকশাওয়ালা শোষিত। নিঃগৃহীত। সন্দেহ নেই। কিন্তু যার বিচার হবে সে তো ক্ষমতাবান। কিছুদিন আগেই মসজিদ বানিয়ে দিয়েছে করতলে। আলিশান মসজিদ। বিলাসবহুল মসজিদে টাকা আর বিলাসিতা পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে। তার অর্থের উৎস কী? জমি এলো কোথা থেকে?
এই জমি দখল করা। জমির মালিককে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে। জমির মালিক কি বিচার চেয়েছিল? শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।
আর অর্থের উৎস? মানব পাচার।
ওই মসজিদেই দিন দশেক আগে সেই রিকশাওয়ালা নামাজ পড়েছে। খাস দিলে দোয়া করেছে মসজিদ নির্মাণকারীর জন্য। এখন আবার রিকশাওয়ালা তার বিরুদ্ধে বিচার চাইছে। এই জটিল সমস্যার সমাধান মিলবে কীভাবে? অর্বাচীন নিজেও ভাবছে।
বিরতি শেষ। বিচারক আসনে। সবার আগ্রহ রায়ের দিকে। বিচারক ঘামছেন।
অর্বাচীন পরিস্থিতি বুঝে বেরিয়ে এলো। এই রায় অর্বাচীনের জানা। তাই সে বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া উড়ছে।
চমৎকার কিছু কথা, সমাজের বোধ জাগ্রত হওয়ার জন্য ছোট প্রচেষ্টা, তারপরও যদি বোধ জাগ্রত হয়
দেবাশীষ দত্ত
মে ০১, ২০২২ ১৫:৩০