ভূমিজ

 

কনফুসিয়াসের কথপোকথন বইয়ে একটা বিবরণ আছে এরকম: একদিন তিনি চৌ রাজ্যের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ তাঁর গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো একটা লোক। মাথার চুল উস্কোখুস্কো, পরনে ছিন্ন ও মলিন পোশাক। লোকটা উচ্চৈঃস্বরে বলছে:

ফিনিক্স! ফিনিক্স!
আহা! তার সব গর্ব ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। 
এটা বোলো না যে, সে চেষ্টা করেনি,
সে হয়তো জানেই না।
তবে তার উচিত হবে ছেড়ে যাওয়া,
আহা! তার উচিত হবে ছেড়ে যাওয়া। 
এখনকার রাজনীতি বড্ড বেশি 
বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। 

কনফুসিয়াস তাঁর গাড়ি থেকে নামলেন। কিছুটা সামনে এগিয়ে লোকটার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে দৌড়ে পালিয়ে গেল, অদৃশ্য হয়ে গেল উপত্যকার ভেতর। কনফুসিয়াস লোকটার সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগই পেলেন না। 

 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। যুধিষ্ঠির তাঁর ভাই ও মিত্রদের নিয়ে মহাসমারোহে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলেন। রাজভবনে ঢুকে তিনি দেবগণ এবং ব্রাহ্মণদের অর্চনা করছিলেন। এমন সময় এক পরিব্রাজক ভিক্ষু উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকলেন, ‘হে পাণ্ডুপুত্র, আপনি একজন ঘৃণিত রাজা, আত্মীয়-পরিজনদের হত্যা করেছেন। আপনাকে ধিক্কার জানাই। এই রাজ্য দিয়ে আপনি কী করবেন? আপনার জন্য এখন মৃত্যুই ভালো।’

যুধিষ্ঠির লজ্জিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। 
লোকটি ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেল। 

 

রাজা দ্বিতীয় রামপাল আটবিক যাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে একদল অশ্বারোহী। তিনি যাচ্ছেন সামন্তচক্রের প্রধান লক্ষ্মীশূরের সঙ্গে দেখা করতে।  

কৈবর্তরা বিদ্রোহ করে বরেন্দ্রী দখল করে নিয়েছে। রামপাল এই রাজ্য পুনর্দখল করতে চান। তার চাই আরও বেশি সৈন্য এবং যুদ্ধের রসদ। সে কারণে তিনি মিত্ররাজ্য এবং তাঁর সামন্তদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এতে সামন্তদের বিপুল পরিমাণ ভূমিদান করতে হচ্ছে এবং বিস্তর অর্থ ঢালতে হচ্ছে রাজকোষ থেকে। 

পাহাড়ি পথে চলতে চলতে পুরো দলটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এমন সময় রাজা দ্বিতীয় রামপাল খুব কাছ থেকে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন:
কৈবর্ত্যদের শায়স্তা করতে চাও? 
তার আগে ভেবে দেখো, মহীপালকে কেন মরতে হলো 
বল্লমের খোঁচায়? 
ভেবে দেখো,কেন মরতে হলো শূরপালকে? 
কার সোনার কলস উপুর করে দিচ্ছ তুমি? 
মনে রেখ, কৈবর্ত্যরা জলের সন্তান,
নৌচালনায় খুবই দক্ষ। 

রামপালের রক্ষীদল বুঝতেই পারল না লোকটা কোথা থেকে কথা বলছে আর কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। সে যেন পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল এবং ঢুকে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে। 

 

লেফটেন্যান্ট রবার্টসনের নেতৃত্বে সেনাদলটি নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে। বেশ কজন সৈন্য গুরুতরভাবে আহত। সুপারভাইজার গ্লাডউইনের পায়ে গুলি লেগেছে। দলটি ভোররাতে ফকির মজনু শাহের ক্যাম্প আক্রমণ করেছিল। 

ফিরে যেতে যেতে রবার্টসন ভাবছিলেন, এই নগ্ন ফকিরেরা কীভাবে এতো ক্ষীপ্র হতে পারে! মুহূর্তের মধ্যে জঙ্গলে ঢুকে কী তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলল। কী দারুণভাবে রুখে দাঁড়ালো, অথচ প্রথমে তারা জানতোই না যে আমরা তাদের ক্যাম্প এলাকার বিশ গজের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। 

যুদ্ধ বিধ্বস্ত দলটি যখন করতোয়া নদীর পাড় ধরে এগোচ্ছে, একটা লোককে দেখা গেল নদীর ওপারে। সে চিৎকার করে বলছে: 
মজনু শাহ ফকির, ভবানী পাঠক,
চেরাগ আলী—তারা এই মাটির গর্ভে জন্ম নিয়েছে। 
ভূমিপুত্র তারা। 
আর, এখন ভাটির বাতাস বইতে শুরু করেছে,
ভাটির বাতাস বইতে শুরু করেছে এখন। 

লোকটা ‘দম মাদার!’ বলতে বলতে ঢুকে পড়ল পাশের জঙ্গলে। 

 

গভীর রাত। শহরের রাস্তাগুলো প্রায় জনশূন্য। 

টহলপুলিশ এবং গোয়েন্দাদের দৃষ্টি এড়িয়ে একটা লোক জেব্রাক্রসিংয়ের পাশের এক দেয়ালের সামনে দাঁড়ালো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দেয়ালে একটা স্টেনসিলের ছাপ মারল সে। 

জেব্রাক্রসিংয়ের উপর থেকে এক উন্মাদিনী দেখল, দেয়ালের ছবিতে উস্কোখুস্কো চুলের উন্মাদপ্রায় একটা লোক দৌড়াচ্ছে, তার কোলের কাছে খাঁচায় বন্দী লাল সূর্য। 

উন্মাদিনী খেয়াল করল, দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেছে।