গেহরাইয়া সিনেমায় মূল্যবোধের প্রশ্ন
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত একটি মুভি নিয়ে আজ কিছু কথা বলব। এটা মুভি রিভিউ কি না জানি না, তবে মুভিটা দেখে শেষ করার পর মাথায় কিছু এলোমেলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল, যাকে না গোছানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না। মুভিটার নাম ‘গেহরাইয়া’, হিন্দি শব্দ যার অর্থ গভীরতা। এ পর্যন্ত মুভিটি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হয়েছে প্রচুর। তবে আলোচনার চেয়ে সমালোচনার প্রাচুর্যই যে বেশি, তা মুভি রিভিউ গ্রুপগুলোতে ঢুঁ মারলেই দেখা যায়। মুভির রানটাইম ২ ঘন্টা ২৮ মিনিট, সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন শাকুন বাত্রা।
সিনেমাটি দেখে না যত বেশি অবাক হয়েছি, তার চেয়ে বেশি অবাক দর্শকের মূল্যবোধের হঠাৎ জাগরণ দেখে। এখন প্রশ্ন করতে পারেন, কেন দেশি সিনেমা বাদ দিয়ে একটি বিদেশি সিনেমা নিয়ে এত বড় বড় কথা বলছি। উত্তরটা খুবই পরিষ্কার। এ দেশের মানুষ নিজ দেশীয় সিনেমার চেয়ে বলিউডের সিনেমায় মজা পায় বেশি। তা ছাড়া, যেকোনো সিনেমা সাধারণ দর্শকের মাঝে কেমন সাড়া ফেলেছে, তা দিয়ে দেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা অনেকখানিই বোঝা যায়। দেশে ভালো সিনেমা তৈরি হলে প্রশংসা করার লোকের অভাব নেই, কিন্তু কেউ একটু ভিন্নমত পোষণ করলেই একেকজনের সুপ্ত মূল্যবোধ জাগ্রত হয়ে ওঠে। বাঙালির আবেগীয় সুড়সুড়ি প্রচন্ড জানার পরেও বাংলাদেশের যেসব নির্মাতা বর্তমানে ভিন্নমাত্রার সিনেমা বানানোর সাহস করছেন, তাঁদেরকে সাধুবাদ জানাই।
সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগ ছিল ‘এই ছবি নাকি পরকীয়াকে প্রমোট করেছে’! উপমহাদেশীয় জনগণের যদি পরকীয়া নিয়ে এত সমস্যাই থাকত, তাহলে ২০/২৫ বছর আগের ‘কাভি আলভিদা না ক্যাহনা’ সিনেমা প্রাণভরে উপভোগ করল কীভাবে? কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, এই সিনেমা পরকীয়া প্রমোট তো করেইনি, বরং পরকীয়ার ফলাফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে, সেই বার্তাই দিতে চেয়েছে
বাতুলতা বাদ দিয়ে মূল কথায় আসি। সিনেমাটির টিজার মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই সবার মনে চাপা আগ্রহ, একই সাথে ঘৃণার জন্ম দেয় দীপিকা পাড়ুকোনের গেহরাইয়া। সিনেমাটি মূলত দীপিকারই, তবে অধিকাংশ দর্শকের সাথে তাল মিলিয়ে আমি কেন যেন বলতে পারছি না, এখানে নবাগত সিদ্ধান্ত চর্তুবেদীর ভূমিকা নেই। বরং মুভির সেকেন্ড হাফে এই মানুষটির টানাপোড়েনই যেন বেশি চোখে পড়েছে আমার। সিনেমার গল্পে আছে দুই জোড়া তরুণ-তরুণীর গল্প। এক জোড়া সমাজে ভদ্রস্থ হয়ে উচ্চশ্রেণির একজন হয়ে বেঁচে থাকার আশায় ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছে। সেই জোড়ারই একজন দীপিকা পাডুকোন। আরেক জোড়া ইতোমধ্যে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। বেঁচে থাকার সংগ্রাম আর সম্পর্কের জটিলতার মাঝে জোড়া ভেঙে নতুন জোড়া তৈরি হয় গোপনে। পরিচালক যে গোপনীয়তা বজায় রাখতে চেয়েছেন সিনেমার একেবারে শেষ পর্যন্ত। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত আর দীপিকার প্রেম হয়ে যাওয়ায় বুঝে গিয়েছিলাম সিনেমার সামনে আরও চক্র আছে। চক্র-চক্রান্তের লোভে পড়ে প্রচুর এডাল্ট সিন আর ‘এফ’ ওয়ার্ড পার হয়ে পৌঁছে গেলাম মুভির মূল অংশে। যে অংশ দেখে আমার অস্কারপ্রাপ্ত কোরিয়ান মুভি ‘প্যারাসাইট’ এর ওই বিখ্যাত ডায়ালগের কথাই মনে পড়েছে।
You know what kind of plan never fails?
No plan at all.
If you make a plan, life never makes out that way.
আপনি জীবনে যত পরিকল্পনাই করুন না কেন, চারপাশের মানুষকে যতই ফাঁকি দিতে চান না কেন, দিনশেষে তা-ই হবে, যা হওয়ার ছিল। সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী আর দীপিকার পরিণতিও ছিল ঠিক সে রকম। মুভির শেষে একটা টুইস্ট পাওয়া যায়, যা অনাকাঙ্ক্ষিত তবে আশ্চর্যজনক নয়। সেই টুইস্টই মুভিকে এগিয়ে দিয়েছে অনেকখানি।
সিনেমাটি দেখতে বসেছিলাম সময় নষ্ট করার প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে। কারণ, এই মুভি নিয়ে ভালো রিভিউ কদাচিৎ চোখে পড়ে। প্রচুর ১৮+ দিন, এফ ওয়ার্ডস এবং সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগ ছিল ‘এই ছবি নাকি পরকীয়াকে প্রমোট করেছে’! উপমহাদেশীয় জনগণের যদি পরকীয়া নিয়ে এত সমস্যাই থাকত, তাহলে ২০/২৫ বছর আগের ‘কাভি আলভিদা না ক্যাহনা’ সিনেমা প্রাণভরে উপভোগ করল কীভাবে? কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, এই সিনেমা পরকীয়া প্রমোট তো করেইনি, বরং পরকীয়ার ফলাফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে, সেই বার্তাই দিতে চেয়েছে। সিনেমার একেবারে শেষে নাসিরুদ্দিন শাহের কয়েকটি ডায়ালগ সে কথাই প্রমাণ করে। তিনি বলেছিলেন, ‘Her life was bigger than that one ‘mistake’.’ পরকীয়াকে সরাসরি ভুল বলার পরেও আবেগপ্রিয় দর্শকশ্রোতা সেই বার্তা ধরতে পারেননি। কেননা তাদেরকে সবকিছু গুলিয়ে গিলিয়ে খাওয়াতে হয়। ভাসা ভাসা কোনো কিছুই তারা বুঝতে পারে না। যদি কোনো ফিল্ম আর্টফিল্ম হয়, তবে তারা ভেবে নেয়—এই জিনিস তাদের জন্য নয়। আর যদি বাণিজ্যিক ছবির আদলে গড়া কোনো সিনেমা তাদের ছকের বাইরে চলে যায়, তখনই শুরু হয় যত সব নাক ছিটকানো। শুধু বাংলাদেশি না, উপমহাদেশের দর্শকশ্রেণির মাঝেও এই প্রবণতা আছে। ‘গেহরাইয়া’ সিনেমাটি দেখে আমার মনে হয়েছে, এই ছবি সময়ের চেয়ে এগিয়ে আছে বলেই দর্শক ঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। এখানে বলিউডের অকারণ মেলোড্রামা নেই, আইটেম সং নেই কিন্তু নায়ক-নায়িকা সমানে প্রেম (?) করে যাচ্ছে, এ যেন দর্শকের ঠিক ধাতে পোষাচ্ছে না। এখানে নায়িকা মহৎ না, নায়ক শক্তিমান সুপারম্যান না—চাইলেও তারা কোনো কিছুকে বদলাতে পারছে না। এই অক্ষমতাই যেন দর্শককে বিদ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশি। বাঙালি মহৎ করে দেখালে বারবনিতার চরিত্রকেও ভালোবাসতে পারে, আকণ্ঠ মদে ডুবে থাকা দেবদাসকেও করে নিতে পারে সবচেয়ে আপনজন, মানুষখেকো যুগলবন্দীও তাদের প্রিয় হতে পারে। কিন্তু যেসব চরিত্র সাধারণ মানুষের মতো, সব সময় জ্বলজ্বল করে না, জীবনের জটিলতায় দুমড়েমুচড়ে যায়—তাদের দুর্বলতা গ্রহণ করার মানসিকতা এখনো সাধারণ দর্শকশ্রেণির হয়ে ওঠেনি।
সিনেমার অসংখ্য রিভিউর মাঝে এই রিভিউর কিছু কথা আমার বেশ মনে ধরেছে-‘okay i get it, it’s not for everyone, it doesn’t have that cheery feel to it doesn’t make you laugh at some stupid joke…it’s deeper than that. This movie made tears glide down my cheeks, heart pound in nostalgia and hit way too close to home.’
পার্শ্ববর্তী দেশের একটি বিতর্কিত চলচ্চিত্র নিয়ে এত কথা অনেকেরই পছন্দ হবে না জানি। কিন্তু একটি চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকের ভাবাবেগ আর মূল্যবোধের হঠাৎ জাগরণ মাঝে মাঝে ভাবনার জন্ম দেয়, তাদের মানসিকতা নিয়েও অনেক বাস্তব ধারণা দেয়, যা অন্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া যায় না। তবে সবকিছু মিলিয়ে গেহরাইয়া ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা বলিউডের চিরাচরিত প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখানো সাহসী চলচ্চিত্র, যা কোনো নায়ক-নায়িকার জন্ম না দিলেও জীবনের প্রচন্ড বিচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরে নিষ্ঠুরতার সাথে।
লেখা পড়লাম। এখন চলচ্চিত্রটি দেখার ইচ্ছে জাগছেঅ
মামুন মাহবুব
এপ্রিল ০৬, ২০২২ ১০:৫৯