আড়ালে যাওয়া নক্ষত্র সিরাজুল আলম খান!
সিরাজুল আলম খান কখন খান, কখন ঘুমান, তার ঠিকঠিকানা নেই। চালচলন খ্যাপাটে, বোহিমিয়ান, লম্বা চুল-দাড়ি-গোঁফ, অতি সাধারণ বেশভূষা, কম কথা বলা…এর আকর্ষণ-বিকর্ষণ শক্তি দুই-ই ছিল। অনেকেই তাঁকে এড়িয়ে চলতেন, আবার অনেকেই সম্মোহিত হতেন। অনেকেই আড়ালে-আবডালে ‘কাপালিক’ নামে ডাকতেন।
তাঁকে নিয়ে এত আলাপ-আলোচনা, আগ্রহ কেন? কেন তিনি আজও গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্ররাজনীতি বাদ দিলে জাতীয় পর্যায়ে মাঠে বক্তৃতা দিতে দেখা যায়নি। না ছিলেন সংসদ সদস্য, না মন্ত্রী, পদস্থ আমলাও নন। তবে এই কৌতূহলের কী হেতু!
ছয় দফার পর থেকেই মুজিবের ডানে পাকিস্তানি মিলিটারি বামে স্বাধীনতাকামী তরুণ ছাত্রনেতারা। আর এ গ্রুপের মূলভাগে সিরাজুল আলম খান। মুজিবের ওপর স্বাধীনতা প্রশ্নে তাঁরা প্রেশার গ্রুপ। আর তাঁদের অনুপ্রেরণায়ও ছিলেন তিনিই। জানতেন এ উদ্যোগের গোড়া থেকেই। কিন্তু এই তরুণেরা তখনো আওয়ামী লীগের মূলধারায় যুক্ত নন। সাংবিধানিক রাজনীতিক শেখ মুজিবকে তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন লেনিন, মাও সেতুং বা ফিদেল কাস্ট্রো রূপে। সেই বিপ্লবী রাষ্ট্রের ফ্রন্টিয়ারের মূল যোদ্ধা হতে চেয়েছিলেন সিরাজ। মুক্তিযুদ্ধের ভারত-পর্বেও তাঁদের রাজনীতি-প্রশিক্ষণে ছিল ভিন্ন চেহারা। মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকার প্রশ্নে দ্বিমত, মুক্তিযুদ্ধে রিক্রুট বা তাদের মাঠের যুদ্ধ নিয়েও আছে বিতর্ক। শেখ মুজিব ছাড়া অন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কম থাকায় তাঁরা ছিলেন খানিকটা আইসোলেটেড। তবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব প্রশ্নে আপোসহীন, একাত্তরের রণাঙ্গণে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত। পরে তাঁরা তৈরি করেন জাসদ।
বাংলাদেশে ইতিহাসের রাজনীতি আছে—কথাটা যত স্বচ্ছন্দে বলা যায়, রাজনীতির ইতিহাস প্রসঙ্গে ততটা নয়। এর একটি ফল্গুধারা বহমান থাকলেও, মহিউদ্দিন আহমদ তাতে জলের সঞ্চার করেছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাসদের উত্থান-পতনের কাহিনি তিনি লিখেছেন, এরপর দুটি বই লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি এবং প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান। এই আলোচনা পরের বইটি প্রসঙ্গে। এতে সিরাজকে তিন পর্বে খুঁজেছেন তিনি। প্রথমে নিউক্লিয়াস, পরে মুজিব বাহিনী, সবশেষ জাসদ।
২
নিউক্লিয়াসে আছে সিরাজের ছাত্ররাজনীতির শুরু ও নেতা হয়ে ওঠার চড়াই-উতরাইয়ের আখ্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ১৯৫৮ সালে, ম্যাথমেটিকসে। ফজলুল হক হলে রেসিডেন্স। সেটি তখনকার ছাত্রলীগ জেনারেল সেক্রেটারি আজহার আলীর রুম। সেই সূত্রেই ছাত্রলীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। কমিটিতে এলেন ষাটের শুরুতে। পরের বছর শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রেসিডেন্ট, শেখ ফজলুল হক মনি সেক্রেটারি আর তিনি হলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি। এরপর মনি অসুস্থ হয়ে বিশ্রামে গেলে অ্যাক্টিং জেনারেল সেক্রেটারি হন সিরাজ। বাষট্টিতে এসে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে কেন্দ্র করে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সারা দেশে যে আন্দোলন, ওই সময়েই ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁর উত্থান। তেষট্টিতে মনির বিরোধিতার পরও হন জেনারেল সেক্রেটারি।
নিউক্লিয়াস ও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে মহিউদ্দিন আহমদ সামনে এনেছেন বাংলার স্বাধীনতা প্রশ্নে আরও কিছু উদ্যোগের কথা। এর মধ্যে একটি অপূর্ব সংসদ। এর মূলভাগেও ছিলেন এক ছাত্রলীগ নেতা, আবদুল আজিজ বাগমার। ১৯৬৩ থেকে ৬৫ সালের মধ্যে স্বাধীনতার ৩টি ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন, তৈরি করেছিলেন অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার। সংক্ষেপে যা অপূর্ব সংসদ। তবে তা তাত্ত্বিক আলোচনা-প্রকাশনাতেই ছিল সীমিত। এরপর পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট। এর নেতৃত্বে শেখ মুজিব নিজে। আর তার সোলজার শাহ মোয়াজ্জেম ভায়া সিরাজ-মনি। শাহ মোয়াজ্জেমের জবানিতে: মুজিব ভাই একটা লিফলেট ড্রাফট করেছেন পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট নাম দিয়ে। সাইকেল চালিয়ে নিজেই প্রেসে গিয়ে ছেপেছেন।…বললেন, তোর বিশ্বস্ত লোক নিয়া এগুলি ডিস্ট্রিবিউট করবি। সে লিফলেট বিলি হয়েছে রাতের অন্ধকারে। এটা নিউক্লিয়াস গঠনেরও আগে। এ পর্বে মুজিব কমিউনিস্ট মণি সিংহ-খোকা রায়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেন ভারত সরকারের সঙ্গে। এসডিওর ডায়েরির পাতায় আছে সহযোগিতা পেতে তার ত্রিপুরা মিশনের তথ্য। এখানেও সিরাজ মুজিবেরই সৈনিক। স্বতন্ত্র কেউ নন। পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্টই পরে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। এখানে মুজিব কাজে লাগিয়েছেন মূলকেন্দ্র ঢাকা থেকে অনেক দূরের কজন সেনানীকে। তাঁরা হলেন আলী আসাদ [কালা খোকা], আবদুর রহমান সিদ্দিকী, আখতারুজ্জামান [মতি মিয়া] ও নুরউদ্দিন আহমদ [তারা মিয়া]। মুজিবের নির্দেশনা-পরামর্শ-তত্ত্বাবধানেই তাঁরা স্বাধীনতার জন্য ভারতে গেছেন অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহে। সিরাজ এখানে অনুপস্থিত। এ পর্যায়ে মনে হতে পারে স্বাধীনতা পেতে এত এত উদ্যোগের মধ্যে সিরাজের স্বাতন্ত্র্য কী, নিউক্লিয়াস হয়তো বাগাড়ম্বর, বাখওয়াজ। আর তাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছাপানো কোনো লিফলেট বা দালিলিক প্রমাণ না মেলায় সে উদ্যোগ বা ককাসের যে কথা বলা হয়, তাকে চ্যালেঞ্জও করা যায়। তবে কিসে এত বিরাট সিরাজ? সে প্রশ্নের উত্তর পেতে মনোযোগ দিতে হবে পুরো ষাটের দশকের রাজনীতিতে, মূলত ছাত্রলীগ বা বড় পরিসরে সে সময়টার ছাত্র আন্দোলনে। এই সময়টাতেই তিনি ছাত্রনেতা, এই সময়টাতেই তিনি হয়ে উঠছেন জাতীয়। মুজিব হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, স্লোগান হচ্ছে জয় বাংলা। এই সময়টাতেই তাঁর অনাহার-অর্ধাহার, দিনরাত কাজ। এক বসায় ছয় প্লেট চিকেন বিরিয়ানি। বন্ধু মনি, শত্রু মনি। সরকারি এজেন্সির সঙ্গে যোগ থাকার গুঞ্জন, মেলে গড লাইক ইমেজ, সেকেন্ড ম্যানের খেতাবও।
সিরাজুল আলম খান রাজনীতির শুরু থেকেই স্বাধীনতা আর সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছেন। তবে শুরুতে তা চেয়েছেন মূলধারার গণতান্ত্রিক পথ ধরে। মুজিবকে মেনেছেন নিরঙ্কুশ নেতা। মুজিবও দিয়েছেন শিষ্যত্ব। ছাত্রলীগ গড়ার অন্যতম কারিগর শেখ মুজিব। সংগঠনটিকে তিনি ধারণ করতেন। সিরাজ তেষট্টিতে মনির বিরোধিতার পরও জেনারেল সেক্রেটারি হয়ে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত রাজনীতির মাঠে প্রধান যোদ্ধা। বাষট্টির শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর বড় ভূমিকা। এই পুরোটা সময় স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্র প্রশ্নে আওয়ামী লীগসহ বাংলার রাজনীতিকেই আচ্ছন্ন করেছেন। এ প্রশ্নে তৈরি করেছেন নিজস্ব এক বলয়। লক্ষ্য অর্জনে ছিল পরিকল্পনা ও তার সফল প্রয়োগ দুই-ই। ছাত্রলীগে মনি-সিরাজের দুই ধারায় ভেঙে যাওয়ার মূলেও গণতন্ত্র না সমাজতন্ত্র, এই প্রশ্ন। ছাত্রলীগের দুই স্রোতোধারা দুই দিকে বাঁক নিল, সিরাজ একপর্যায়ে নিঃসঙ্গ হলেন। মনি-রাজ্জাক-তোফায়েলদের মতো আওয়ামী লীগার হতে পারলেন না বা হতে চাইলেন না।
সিরাজুল আলম খান রাজনীতির শুরু থেকেই স্বাধীনতা আর সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছেন। তবে শুরুতে তা চেয়েছেন মূলধারার গণতান্ত্রিক পথ ধরে। মুজিবকে মেনেছেন নিরঙ্কুশ নেতা। মুজিবও দিয়েছেন শিষ্যত্ব। ছাত্রলীগ গড়ার অন্যতম কারিগর শেখ মুজিব। সংগঠনটিকে তিনি ধারণ করতেন। সিরাজ তেষট্টিতে মনির বিরোধিতার পরও জেনারেল সেক্রেটারি হয়ে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত রাজনীতির মাঠে প্রধান যোদ্ধা...
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের আলাদা আলাদা গ্রুপ, আলাদা আলাদা কাজ। কেউ কারও কথা জানে না। জানলে তা আর গোপন থাকে না। এই স্ট্র্যাটেজিক কারণেই হয়তো সিরাজ গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে যখন মুজিব-তাজউদ্দীনসহ সব বড় নেতা, মনি-রাজ্জাকরা জেলে, তখন দলটিকে লড়াইয়ে রেখেছেন রাজনীতির মাঠে, হরতালে। আর তার এই নিষ্ঠার কারণ আওয়ামী লীগ নয়, শেখ মুজিব। শেখ মুজিব তাঁকে সংগঠন চালাতে টাকা দিচ্ছেন, যখন জেলে তখন বেগম মুজিবের হাত দিয়ে। সিরাজ হয়ে উঠছেন মুজিব পরিবারের সদস্য। ছয় দফার আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে শ্রমিকদের যুক্ত করার মূল কারিশমা তারই। সেখানে যোগাযোগ তৈরি করেছেন ‘নোয়াখাইলা আর ছাত্রলীগের কানেকশনে’। ছয় দফার আলোকে ১১ দফা তৈরিতেও তিনি। ছেষট্টির ৭ জুনের সেই ঐতিহাসিক হরতাল, ছাত্র আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে পরিণত করার কুশীলবদের একজনও সিরাজ। একের পর এক সেল গঠনে পায়ে হেঁটে ছুটেছেন দিনের পর দিন। তেলের পয়সা থাকলে সঙ্গী হয়েছে লামব্রেটা মোটরবাইক। মহিউদ্দিন আহমদের বর্ণনায়: ১৯৬৬-৬৮ সাল ছিল আওয়ামী লীগের জন্য দুঃসময়। নেতারা বেশির ভাগ জেলে আটক। যুবনেতাদের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি, কে এম ওবায়দুর রহমান ও আবদুর রাজ্জাকও কারাগারে। বলা চলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম রীতিমত হারিকেন জ্বালিয়ে আওয়ামী লীগ অফিস পাহারা দিতেন, আর বাইরে থেকে আন্দোলনের জোয়ার তৈরির চেষ্টায় ছিলেন সিরাজুল আলম খান। মূল ভরসা ছিল ছাত্রলীগ। মূল মন্ত্র ছিল রাস্তা বাঁক না নেওয়া পর্যন্ত একসঙ্গে চলা। একটি ভাষ্যে জানা যায়, সে সূত্রে সিরাজ সিকদারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ-আলোচনা হয়েছিল তাঁর।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব যাতে প্যারোলে মুক্ত হয়ে আলোচনায় না যান, সে জন্য সিরাজের প্রচেষ্টা প্রশ্নে কামরুদ্দীন আহমদ জানান: এ কে ব্রোহি, খাজা সাহাবুদ্দীন ও আইনমন্ত্রী জাফর সাহেব শেখ মুজিবকে জামিনে অথবা প্যারোলে বের হয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের পরামর্শ দেন। স্পষ্টত এটা ছিল ষড়যন্ত্র মামলাকে জিয়ে রাখার আরেক ষড়যন্ত্র। শেখ মুজিব যাতে ওই ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা না দেন, তার জন্য সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক বেগম মুজিবকে সতর্ক করে দেন। বেগম মুজিবকে তাঁরা ক্যান্টনমেন্টে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে অনুরোধ করেন। বেগম মুজিবের মাধ্যমে তারা ব্রোহি ও খাজা সাহাবুদ্দীনের প্রস্তাব অনুযায়ী শেখ মুজিবকে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে নিষেধ করেন।
১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল হয়ে যায়। পরের দিন সব অভিযুক্ত মুক্ত হন। রাও ফরমান আলী নিজে গাড়ি চালিয়ে মুজিবকে পৌঁছে দেন ধানমন্ডির বাসায়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্সে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সংবর্ধনা। সে সভায়ই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন তোফায়েল আহমেদ। এ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদকে সিরাজের বয়ান: এই প্রথম রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব ভাষণ দেবেন। ধানমন্ডির বাসা থেকে আমরা রওনা হলাম। গাড়িতে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে একদিকে আমি, অন্যদিকে তোফায়েল। পেছনের দুটো গাড়িতে খসরু এবং তাঁর টিম। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে লিডার [মুজিব] কানের কাছে মুখ এনে বললেন, কী বলবে-টলবে। আমি বললাম, ছাত্র ইউনিয়ন যা বলবে, ইট ডাজ নট ম্যাটার। আমাদের সব ঠিক আছে। কিন্তু কেউ জানে না এখনো। তোফায়েল বলল, কী বলব? আমি বললাম যে, তুমি একটা টাইটেল দেবা, বঙ্গবন্ধু, আজ থেকে আমরা তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করলাম। তারপর দুবার স্লোগান দেবা। আমি বাঁয়ে ঝুঁকলাম লিডারকে বলার জন্য। তোফায়েল একটা জিনিস দেবে আপনাকে। ওনার ওপর আমার একটা বিরাট কনফিডেন্স ছিল। উনি এটা বুঝলেন। জিজ্ঞেস করলেন না। তোফায়েলকে বললাম, বক্তৃতা শর্ট হবে। এই জায়গায় এটা বলবা, রিসেপশনটা ভালো হবে। মুজিব ভাই অপোজ করলেন না। তার অর্থ হলো উনি এটা অ্যাকসেপ্ট করলেন। এই তো বঙ্গবন্ধু বলার ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শব্দটি কোথা থেকে এলো, তারও একটি বয়ান মিলবে প্রতিনায়ক বইয়ে। একইভাবে আছে জয় বাংলার বাঙালির স্লোগান হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ। এখানেও নিজের পরিকল্পনায় মুজিবের ছাড় পেয়েছিলেন সিরাজ। সত্তরের ১১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের আওয়ামী লীগের সমাবেশে এ শব্দবন্ধটি প্রথম ধ্বনিত হয়। এ প্রসঙ্গে সিরাজ জানান: দুজনের বক্তৃতার পর লিডার বলল, সিরাজ স্লোগান দে।…ইট ওয়াজ জাস্ট লাইক ডেলিভারি পেইন। আমি এক্সাইটেড। দেড়-দুই মিনিট কথা বলেছি। আমার সমস্ত শরীর ঘেমে গেছে। …আমার সঙ্গে আপনারা কণ্ঠ মিলায়া ধরেন—জয় বাংলা। আর কী—বাব্বা! কিসের কামানের গর্জন-টর্জন। স্টাম্বলড হয়ে গেল সব। আমি যখন পেছন ফিরে তাকালাম, শেখ সাহেবকে দেখলাম—হি ওয়াজ হ্যাপি। আমাকে বললেন, পাশে বয়। আমি ওনার পাশে না বসে খন্দকার মোশতাকের পাশে গেলাম। মোশতাক আমার হাত ধরে বলল, ভাইডি, কামডা আজকে সাইরে দিছ, না? এই স্লোগান মুজিব প্রথমবার নিজ কণ্ঠে দিয়েছেন সত্তরের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে। সেদিনই রেসকোর্সকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বলতে বলেন তিনি।
বইটির এ অংশে সেই উত্তাল সময়ের রাজনীতির এক মনোজ্ঞ ভাষ্য তৈরি করেছেন মহিউদ্দিন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে। নিয়েছেন সিরাজের ভাষ্যের বিপরীতের তখনকার অন্য কুশীলবদের বয়ান। নানা প্রশ্নে দ্বিমত থাকলেও সিরাজের তখনকার ভূমিকাকে তারা কেউ-ই অস্বীকার করেননি। আর করবেনই-বা কী করে। এক আলাপচারিতায় শেখ মুজিব নিজে সিরাজ সম্পর্কে বলেছেন: চিনে রাখো। আমার ক্যাস্ট্রো কিন্তু। সিরাজের সঙ্গে তোমরা যোগাযোগ রাখবা। হি ইজ দ্য ম্যান।
বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তরের পর সত্তরের নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করতেও শেখ মুজিব আর কেন্দ্রীয় নেতাদের পর দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতা হিসেবে সিরাজ অনবদ্য, এককথায় ফ্যানটাস্টিক।
৩
নির্বাচন ঘনিয়ে এল। সিরাজপন্থীরা নানা কনস্টিটিউয়েন্সিতে নৌকার জন্য ভোট চাইতে গেলেন। পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি করে কিছু তরুণকে একটা নেটওয়ার্কে যুক্ত করার লক্ষ্য ছিল তাঁদের। ছিল একটি প্রচারপত্রও। নির্বাচনের মাঠে সমান্তরালভাবে স্বাধীনতার বক্তব্য প্রচারের কাজটি হয়ে ছিল গোপনে, সিরাজপন্থী ছাড়া কেউ জানত না। উনসত্তরের পর ছাত্রলীগের তরুণ তুর্কিদের মনে যখন পাকিস্তান শব্দটির আর জায়গা নেই, তখন সামনে আসে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স। তিন সংগঠকের নিউক্লিয়াস থেকে চার সংগঠকের বিএলএফ। কাজী আরেফ আউট, মনি-তোফায়েল ইন। আর তা হয়েছিল শেখ মুজিবেরই ইচ্ছায়। সিরাজের ভাষ্যে: একদিন মুজিব ভাই আমাকে একা ডেকে কাঁধে হাত রেখে অনেক কথার মধ্যে বললেন, তোদের তো কাজ অনেক বেড়ে গেছে দেখছি। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তোদের লোক দরকার।…অবাক বিস্ময়ে শুনতে হলো মনি-তোফায়েলকে নিয়ে কাজ করতে পারবি না? শেখ মুজিব লন্ডন থেকে ফিরলে তাঁরা মাঠে নামেন একসঙ্গে।
একটা কঠিন সময় যে আসছে আওয়ামী লীগ নেতারা তা বুঝতে পেরেছিলেন। সত্তরের ভোটে ল্যান্ডস্লাইড জয়। একে দর-কষাকষির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন মুজিব। একদিকে খোলা রেখেছেন আলোচনার দরজা, অন্যদিকে তারই প্রশ্রয়ে বেড়েছে তারুণ্যের দ্রোহ। তাদের আবার একটি অংশ নিয়মতান্ত্রিক, অন্যটির মুখে: তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থকেরা মনির আর অন্য গ্রুপটি সিরাজুল আলম খানের অনুগত। দুটি ধারাই বড় হয়েছে মুজিবের আশ্রয়ে।
একাত্তরের তেসরা মার্চ শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের পক্ষে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন শাজাহান সিরাজ। এতে শেখ মুজিবকে জাতীয় নেতা, আমার সোনার বাংলাকে জাতীয় সংগীত ঘোষণা দেওয়া হয়। এক প্রস্তাবে মুজিবকে বলা হয় জাতির পিতা। আগের দিন মনি-সিরাজের উপস্থিতিতে এর খসড়া তৈরি হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাপত্রটি আসে বিএলএফের মাধ্যমে। সিরাজ ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা চেয়েছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন: সিরাজ, আই অ্যাম দ্য লিডার অব দ্য পিপল। আই লিড দেম। দে ডোন্ট লিড মি।
সিরাজ ভেবেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ আরও দীর্ঘ হবে। এর মধ্য দিয়েই পরীক্ষিত নেতারা বেরিয়ে আসবেন। তাঁর আক্ষেপটা এ রকম: … কোনো কারণে যুদ্ধ যদি আরও এক বছর চলে, তাহলে ওরা তো বাদ পড়ে যায়। রিয়েল ফাইটিং ফোর্স চলে আসত সামনে। এটা ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টও বুঝত। তারাও চাইত, যে করেই হোক ওই শক্তিটা যেন গ্রো না করে...
একাত্তরের সেই উত্তাল মার্চে বিএলএফের দুই নেতা মনি-সিরাজ ছিলেন এক কাতারে। ক্রাকডাউনের পর মুজিবকে তুলে নিয়ে গেল পাকিস্তানি জান্তা। টিক্কা খান হেলিকপ্টারে ঢাকা আসার পথে ৭ মার্চের রেসকোর্স দেখেছেন। রাও ফরমান আলি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের ধরতে বেপরোয়া। চলছে গণহত্যা, টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। তখন তাঁরা প্রস্তুত হচ্ছেন একটা প্রলংগড ওয়ারের জন্য, তাদের মাথায় ভিয়েতনাম আর সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময়কালের আরবান গেরিলা ওয়ার, প্রট্রেক্টেড ওয়ার।
কয়েক ধাপে নেতারা ভারতে যান কেরানীগঞ্জে সিরাজের বিএলএফের হেডকোয়ার্টার হয়ে। কলকাতায় বিএলএফ নেতারা সবাই মিলিত হলেন ভবানীপুরের সানি ভিলায়। এই ঠিকানা মোশতাক ছাড়া আওয়ামী লীগের সব নেতা ও তাঁদের মুখস্থ করিয়ে ছিলেন শেখ মুজিব। সিরাজের ভাষ্যে: ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানে ঘোরাফেরা করছি। এমন সময় একজনকে দেখলাম, হাতে একটা অ্যাটাচি ব্যাগ। তিনিও যেন কাউকে খুঁজছেন। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হলো। মনে হলো আমরা যাকে খুঁজছি, ইনিই তিনি। তিনি যাদের খুঁজছেন, আমরাই সেই লোক। এভাবেই বিএলএফের সঙ্গে যোগাযোগ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর। সেই লোকটি ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ছিলেন র কর্মকর্তা। এ সংস্থার অধীনে ছিল স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান। বিএলএফের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের দায়িত্বেও ছিলেন তিনিই। তাঁর ভাষ্যে: গোলযোগের অশান্ত দিনগুলোতে আমরা একদল নিবেদিতপ্রাণ যুবনেতার কথা জানতে পারলাম, যাঁরা বাংলাদেশে খুব পরিচিত। তাঁরা হলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। তাঁদের মনে হলো অত্যন্ত অনুপ্রাণিত, করতে অথবা মরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তাদের নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, অস্থায়ী সরকার এদের তেমন মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিল না। তারা চাইছিল, এরা মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে ও যুদ্ধে অংশ নেবে। কিন্তু এই চার নেতার এতে দৃঢ় আপত্তি ছিল। তাঁরা মুজিব বাহিনী নামে অভিহিত হতে পছন্দ করলেন। তাঁরা তাঁদের পুরোনো সহকর্মীদের ক্যাডার হিসেবে বেছে বেছে সত্যায়িত করলেন।
অক্টোবরের বিএলএফের প্রতিনিধি সম্মেলন প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদ জানান: …আশঙ্কা ছিল, শেখ মুজিব জীবিত ফিরে না-ও আসতে পারেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্র থেকে সম্ভাব্য যে বিরোধিতা বা আক্রমণ আসতে পারে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণের গুরুত্ব সম্পর্কে বিএলএফ নেতারা একমত হন। সিদ্ধান্ত হয়, সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আদর্শ—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করে যে দর্শন, তাকে শেখ মুজিবের নামে পরিচিতি দিতে হবে। সিরাজুল আলম খান প্রস্তাব করেন, এই দর্শনের নাম হবে মুজিববাদ। সবাই এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে বিএলএফের নাম হয় মুজিব বাহিনী।
তাদের প্রশিক্ষণ হয়েছিল দেরাদুনের তান্ডুয়া ও আসামের হাফলংয়ে। প্রথমে ৯ দিন, ১১ দিন ও তারপর ২১ দিন দেওয়া হয় ভিআইপি ট্রেনিং। মোট প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলেন ৬ হাজার ৮০০ তরুণ। শেখ মনির তত্ত্বাবধানে ছিল আগরতলা [ত্রিপুরা], রাজ্জাকের তুরা [মেঘালয়], সিরাজের পাংগা [শিলিগুড়ি] এবং ব্যারাকপুরের [কলকাতা] ট্রানজিট ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন তোফায়েল। আর দেশকে চার অঞ্চলে ভাগ করে ঢাকা-চট্টগ্রামের দায়িত্ব নেন মনি। রাজ্জাকের দায়িত্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিরাজ উত্তরবঙ্গের আর তোফায়েলের হাতে ছিল খুলনা বিভাগ। তাদের প্রশিক্ষণ ও সরকারের কমান্ড কাঠামোর বাইরে থাকার কারণে গুঞ্জন ও প্রচার ছিল যে, এই বাহিনী র-য়ের তৈরি, পেছনে সিআইএ আছে। এ সময় সিরাজের সঙ্গে ইসরায়েলি লাইনের যোগাযোগও খুঁজেছেন অনেকে। এই চার নেতা নিজেরদের শেখ মুজিবের মনোনীত প্রতিনিধি মনে করতেন। এ সময়টায় মনি-সিরাজ বিরোধ খানিকটা চাপা পড়ে। তারপরও মনির বিরোধিতায় তাজউদ্দীন পাশে পেয়েছেন সিরাজকে। যুদ্ধের একটা পর্যায়ে বিএলএফ প্রশ্নে আপত্তি আসতে থাকে সেক্টর কমান্ডারদের কাছ থেকেও। ক্ষুব্ধ ছিলেন প্রধান সেনাপতি ওসমানী। তাদের স্বতন্ত্র কর্মকাণ্ড বাতিল করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার চাপও তৈরি করেছিল তাজউদ্দীন সরকার।
বিএলএফের প্রথম সারির নেতারা প্রশিক্ষণ নিলেও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে দেশের ভেতরে যাননি। ব্যতিক্রম শুধু শেখ মনি। নভেম্বরে উবানের নেতৃত্বে অপারেশন ইগল পরিচালনার সময় মিজোরাম হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢোকেন তিনি। অন্য তিন নেতা দেশে ফেরেন স্বাধীনতার পরে। ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, মনিরুল ইসলাম যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন ভারতে। তবে সাধারণ সদস্যরা অস্ত্র হাতে দেশে ঢোকা শুরু করেন জুলাইয়ের শেষ দিকে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে, তারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন—এ চিন্তা থাকলেও তার আগেই যুদ্ধ শেষ করার ভারতীয় পরিকল্পনাটি হয়তো ছিল তাদের জানা ছিল না।
দেশের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রায় কেউ-ই অস্ত্র হাতে লড়াই করেননি। ভারতীয় ভূখণ্ডে বসে, ছিলেন সংগঠকের ভূমিকায়। নেতৃত্বেই ছিল তাঁদের চোখ। অন্যদিকে যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন সেনা সদস্যরা। সে শূন্যতায় রাষ্ট্রক্ষমতা প্রশ্নে তাঁদের মনেও তৈরি হয় আগ্রহ-স্বপ্ন। মুজিব বাহিনী বনাম তাজউদ্দীন সরকারের মতো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় জড়ান সেনা কর্মকর্তারাও। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে গঠন হয় সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স, খালেদ মোশারফের নেতৃত্ব কে ফোর্স, এ নিয়ে জটিলতায় সৈন্যস্বল্পতার পরও জিয়ার নেতৃত্বে গঠন করতে হয়েছিল জেড ফোর্স। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সেই মতভেদ ওঠে তুঙ্গে। এই তিন ব্যক্তির বিরোধের চূড়ান্ত ফল পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের কালপর্ব পর্যন্ত।
১৯৭২-এর ৩১ অক্টোবর জন্ম নেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ। জন্মলগ্নেই সরকার উচ্ছেদের ঘোষণা দেয় তারা। উল্টো দিকে আওয়ামী লীগে প্রভাব বাড়ানো ও জাসদ ঠেকাতে শেখ মনি তৈরি করলেন আওয়ামী যুবলীগ। এতে সিরাজ-মনির দ্বৈরথ জারি থাকল। মনির লক্ষ্য মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা আর সিরাজ এগোলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পথে। জাসদকে সিরাজরা বললেন বিপ্লবের সহায়ক শক্তি, এটি একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন। পাশাপাশি শুরু হয় একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ার কাজও। ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, জাসদ থেকে বাছাই করা লোক নিয়ে হবে সেই বিপ্লবী পার্টি...
৪
সিরাজ ভেবেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ আরও দীর্ঘ হবে। এর মধ্য দিয়েই পরীক্ষিত নেতারা বেরিয়ে আসবেন। তাঁর আক্ষেপটা এ রকম: … কোনো কারণে যুদ্ধ যদি আরও এক বছর চলে, তাহলে ওরা তো বাদ পড়ে যায়। রিয়েল ফাইটিং ফোর্স চলে আসত সামনে। এটা ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টও বুঝত। তারাও চাইত, যে করেই হোক ওই শক্তিটা যেন গ্রো না করে। দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেল। এখন তো আর বলা যাবে না স্বাধীন হোয়ো না। সাড়ে আট মাসের বাচ্চা। বলা যাবে না যে এই বাচ্চা চাই না। ইট নিডস নার্সিং।
এর মধ্যে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি হলেন রাষ্ট্রপতি। পরদিনই বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি হলো। এ আদেশে সত্তরের নির্বাচনে ‘জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বিজয়ী এবং আইনের দ্বারা অন্য কোনো দিক দিয়ে অযোগ্য নন’ এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠনের কথা বলা হয়। পাশাপাশি বলা হলো প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থার কথা। ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিলেন শেখ মুজিব। প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী হলেন তাজউদ্দীন। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল আলম খানের মূল্যায়ন: বঙ্গবন্ধুর নামেই যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতা ছিলেন তাজউদ্দীন। তিনিই হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ক্যাজুয়ালিটি। সিরাজ মনে করতেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শুরুটা ভালো হয়নি। যেভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল তা মনোযোগ পায়নি। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এ জন্য তৈরি ছিল না। এ যেন হঠাৎ পাওয়া বিশাল সম্পদ, যার ব্যবহার তারা জানে না। তিনি ভেবেছিলেন, শেখ মুজিব জাতির পিতা। তিনি দল এবং সরকারের প্রধান হবেন না। বাইরে থেকে নির্দেশনা দেবেন, নৈতিক শক্তি জোগাবেন। দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে এ নিয়ে ১৫ দফা সুপারিশও তিনি দিয়েছিলেন। তবে তা গুরুত্ব পায়নি। মুজিবের জনপ্রিয়তা তখন আকাশছোঁয়া, অনেক উঁচুতে। সিরাজকে তিনি তখনো একজন কর্মীই মনে করেন। তাঁর প্রত্যাশিত স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্র—সে ধারায় বঙ্গবন্ধু গেলেন না। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে সিরাজ নন, জায়গা পেলেন শেখ মনি। এর পরপরই একই সঙ্গে ছাত্রলীগের দুই জায়গায় দুই সম্মেলন। বঙ্গবন্ধু গেলেন শেখ মনির সমর্থিত সম্মেলনে। এ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদকে সিরাজ বলেছেন: আগের রাতে একটা-দেড়টা পর্যন্ত আমি মুজিব ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তিনি কোথাও যাবেন না। একপর্যায়ে বললেন, ‘সিরাজ, আমি তো কমিউনিস্ট হতে পারব না?’ তারপর আমি চলে আসি। শুনেছিলাম, মনি এসেছিল রাত দুইটার দিকে। সে মুজিব ভাইকে সরাসরি বলেছিল, ‘আপনি যদি সিরাজের সঙ্গে যান, রাজনীতির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে ঠিক আছে। যদি আমাকে সমর্থন দেন, তাহলে রাজনীতির উত্তরাধিকার তো আছেই, রক্তের উত্তরাধিকারও থাকছে। এখন আপনি ঠিক করেন, আপনি কোন দিকে যাবেন।’
সেই থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে আর সিরাজের মতের আপস-নিষ্পত্তি হয়নি। রাজনীতিতে শেখ মুজিবের কাল্ট তৈরির এই প্রধান কারিগর, মুজিবের নেতৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ করলেন। বলা হলো: এ দেশের কোনো রাজনৈতিক নেতা কোনো আন্দোলনের জন্ম বা নেতৃত্ব দেয়নি; বরং জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই নেতা সৃষ্টি হয়েছে।
ষাটের দশকে সিরাজের তৈরি সেলটি ছিল রাজনৈতিক দলের ভ্রূণ। এবার সেই দল গঠনে মাঠে নামলেন তিনি। মনিরুল হক চৌধুরী জানান, সেই ঘনঘটার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা মন্তব্যের পরও তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন: দেখো, এরা যদি আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে পারে, এর চেয়ে মঙ্গলজনক কিছু হবে না। না হইলে আমাকে স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে হবে।
১৯৭২-এর ৩১ অক্টোবর জন্ম নেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ। জন্মলগ্নেই সরকার উচ্ছেদের ঘোষণা দেয় তারা। উল্টো দিকে আওয়ামী লীগে প্রভাব বাড়ানো ও জাসদ ঠেকাতে শেখ মনি তৈরি করলেন আওয়ামী যুবলীগ। এতে সিরাজ-মনির দ্বৈরথ জারি থাকল। মনির লক্ষ্য মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা আর সিরাজ এগোলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পথে। জাসদকে সিরাজরা বললেন বিপ্লবের সহায়ক শক্তি, এটি একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন। পাশাপাশি শুরু হয় একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ার কাজও। ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, জাসদ থেকে বাছাই করা লোক নিয়ে হবে সেই বিপ্লবী পার্টি। এ জন্যই সিরাজ, কাজী আরেফ, মনিরুলসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা জাসদ বা অন্য কোনো গণসংগঠনে থাকেননি। সিরাজ তখন মাঠে নেই, ডুবে আছেন তত্ত্বতালাশে, নিচ্ছেন সমাজতন্ত্রের ক্লাস। পার্টি থিসিস থেকে শুরু করে পত্রিকা—জাসদের সেই প্রস্তুতিপর্বের অনুপুঙ্খ বর্ণনা তথ্য-উপাত্তসহ মহিউদ্দিন দিয়েছেন তাঁর বইয়ে। এসেছে মেজর জলিল, মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ও আখলাকুর রহমানের এতে যুক্ত হওয়ার প্রসঙ্গ। এসবের মধ্য দিয়েই আসে ১৯৭৪ সাল। ১০ ফেব্রুয়ারি গণকণ্ঠে প্রতিবেদন ‘শাসকগোষ্ঠীর প্রতি জাসদের চরমপত্র: জনতার দাবি মেনে নাও: শেষ সময় ১৫ মার্চ।
১৭ মার্চ পল্টন ময়দানে জাসদের জনসভা। সভা শেষে একটি জঙ্গি মিছিল যায় মিন্টো রোডে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসা ঘেরাও করতে। সেখানে গুলি চালায় রক্ষীবাহিনী। সরকারি প্রেসনোটে ৩, ইত্তেফাকে ৬ আর জাসদ দাবি করে তাতে নিহত হয়েছেন ৫০ জন। শুরু হয় ধরপাকড়। গ্রেপ্তার হন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজসহ অনেকে। সে রাতেই নিজ বাসা থেকে আটক করা হয় গণকণ্ঠ সম্পাদক আল মাহমুদকে। তবে সে মিছিল কোথায় যাচ্ছিল মিছিলকারীরা জানতেন না। কাকরাইল মসজিদের কাছে গিয়ে মেলে একটি চিরকুট। তাতেই জানানো হয়েছিল গন্তব্য। সে হাতের লেখা সিরাজের বলে অনেকে দাবি করলেও, সিরাজ জানিয়েছেন, সে সম্পর্কে তিনি কিছু জানতেন না। মহিউদ্দিন আহমদকে তখনকার ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান: …মেজর জলিল যখন বক্তৃতা করেন তখন তিনি এই কর্মসূচিটা ঘোষণা করেছেন। বক্তৃতা করার সময় উনি খুবই উত্তেজিত ছিলেন। প্রায় ১০ ফুট উঁচু মঞ্চ থেকে তিনি লাফ দিয়ে নিচে নামেন। মিছিল তো বেরিয়ে গেছে। মিছিলে কোনো কন্ট্রোল ছিল না। মান্না আরও জানান: ওই দিন রক্ষীবাহিনী গুলি করত না। কারণ, গুলিটা আগেই আমাদের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল। তবে সে গুলি কে ছুড়েছিলেন, সেটি আজও মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। এ প্রশ্নে মহিউদ্দিনের মূল্যায়ন: ১৭ মার্চ তো একটা কাট অফ পয়েন্ট। ১৭ মার্চের আগের ও পরের পার্টি এক না। এ ঘটনাকে শেখ মনি দেখলেন তার বিজয় হিসেবে। তাঁর সম্পাদিত বাংলার বাণীতে আট কলামের হেডলাইন হলো: দুশোর বেশি কর্মী গ্রেপ্তার: হার্ডকোর সদস্যরা ধরা পড়েনি: জাসদ গুপ্ত সংগঠনে পরিণত হতে চলেছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাসদ ট্রেজারার কামরুল ইসলামের বাসায় বসল সিওসির বৈঠক। ছিলেন কর্নেল তাহেরও। সেখানেই সামনে আসে গণ-আন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসঙ্গ। আর সংগঠন মানে সেনাবাহিনী আর সংগ্রাম মানে যুদ্ধ—এ বক্তব্য মার্চের শেষেই এসেছিল। বিপ্লবী গণবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয় চুয়াত্তরে। এখানেই শেষ নয়, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশের মধ্যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। গণবিাহিনীর পলিটিক্যাল কমিশনার মোহাম্মদ শাহজাহান। ফিল্ড কমান্ডার লে. কর্নেল আবু তাহের। হাসানুল হক ইনু সেকেন্ড ইন কমান্ড। তার দাবি: বিপ্লবী গণবাহিনী একটা স্বাধীন সংগঠন, যাকে জাসদ সমর্থন দিয়েছিল। তবে সিরাজ মহিউদ্দিনকে বলেছেন অন্য কথা, তাঁর ভাষ্য: এ নামে বাহিনী তৈরির সিদ্ধান্ত তখনো হয়নি। এটি গড়ে ওঠে তাঁর অজান্তে। সেই সংঘাতময় সময় ২৮ ডিসেম্বর জারি হলো জরুরি অবস্থা। তখনো বঙ্গবন্ধু মনিরুল হক চৌধুরীকে বলছেন: সিরাজ একটাই হয়। এর যত গুণ আছে, তোমাদের সব মিলায়া তার অর্ধেকও নাই। সিরাজ নিজেই অনেককে পালে। এগুলা হইল বাটপার।
এই কালপর্ব প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাহেরের। ৩ নভেম্বর তাদের দেশ ছাড়ার পুরো দিনটিই তিনি ছিলেন বঙ্গভবনে। তাদের সমঝোতা হয়, পটপরিবর্তন হলে জিয়া আবার সেনাপ্রধান, অভ্যুত্থানকারীরা ফিরবেন দেশে। জানান, ৬ নভেম্বর রাতে ১২ দফা দাবিনামার ১০ দফায় স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, যেসব সামরিক অফিসার ও জওয়ানকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এ তথ্য জাসদের হাজার হাজার তরুণের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল...
তখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের একটা সমঝোতার চেষ্টা হয়েছিল। জাসদের অনেক নেতা তখন জেলে। নানা জায়গায় সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়াচ্ছে নেতা-কর্মীরা। মনির অবস্থান তুঙ্গে। এ সময় শেখ মুজিব বাকশাল গঠন প্রসঙ্গে সিরাজকে ডাকলেন। সিরাজের নিজের ভাষ্যে কথোপকথনটা এ রকম: মুজিব ভাই আমাকে ডাকলেন। বললেন, স্বাধীনতার পরপর তোরা একটা জাতীয় সরকারের কথা বলেছিলি। আমি এ রকম একটা করছি। আমি বললাম, এ রকম করলে তো জাতীয় সরকার হয় না। এটা হলো আওয়ামী লীগের সরকার। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ দিয়েছে। তারপরও বঙ্গবন্ধু সিরাজকে বলেছিলেন, তুই জলিল আর রবকে দিয়ে দে। আরেক দিন আয়। এ প্রসঙ্গে সিরাজ আরও জানাচ্ছেন: আরেক দিন। সিরাজ সিকদারকে মেরে ফেলেছে। সাইদ ভাই বলল যে মিটিংটা হবে না। আপনাকেও দেশের বাইরে চলে যেতে বলেছে।…এর আগে উনি পুলিশকে অনেকবার বলেছেন, তোমরা যা-ই করো, শুধু আমার সিরাজের ওপর যেন আঘাত না আসে। লাস্টে তো ‘আমার সিরাজ’ আর নাই। আমাকে বলেছেন, তুমি তোমার পথ দেখো। চুয়াত্তরের ২৮ ডিসেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। সিরাজ চলে গেলেন ভারতে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। সপরিবারে হত্যা করা হলো জাতির পিতাকে। রাষ্ট্রপতি হলেন তাঁর দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী খন্দকার মোশতাক। গণবাহিনীর কমান্ডার তাহের ও ডেপুটি কমান্ডার ইনু ঢাকা বেতারে গিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে দেখা করেন। ১৫ আগস্ট থেকে সামরিক আইন বলবৎ জানিয়ে ২০ আগস্ট জারি হয় প্রজ্ঞাপন। ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনাপ্রধান করা হয় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে উপপ্রধান করা হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। সিরাজ তখন কলকাতায়।
৩ নভেম্বর ভোরে সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আরেকটি অভ্যুত্থান। সেনাপ্রধান জিয়া গৃহবন্দি, খন্দকার মোশতাক হন ক্ষমতাচ্যুত। খালেদ নিজেকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান হন। বঙ্গভবনে এই পটপরিবর্তনের মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। সেদিনই সন্ধ্যায় ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা ব্যাংকক চলে যান। এটা ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে সমঝোতার অংশ। ওই সময় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা খালেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাকে সেনানিবাসে লিফলেট বিতরণ করে। সেই টালমাটাল সময়ে জাসদ খাপ খোলা তলোয়ার। খাপ সিরাজের হাতে, তলোয়ার তাহেরের। জিয়াকে তাহের ধারণা দিয়েছিলেন, তাঁর পেছনে বিশাল দল আছে। আর জাসদকে ধারণা দিয়েছিলেন, আমার পেছনে আছে জিয়া আর তাঁর সেনাবাহিনী। এই ইকুয়েশনেই ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ঘটে সিপাহি অভ্যুত্থান। তবে ৭ নভেম্বর ভোরেই পরিস্থিতি বিপরীত। জিয়া মুক্ত হয়েই তাঁর ক্ষমতা সংহত করেন। দাবার কোট থেকে ছিটকে পড়ে তাহের বুঝতে পারেন ‘টুনাইট অর নেভার’ কথাটির মর্মার্থ। ১৫ আগস্ট হয়েছিল বলেই ৩ নভেম্বর আর ৩ নভেম্বরের প্রতিক্রিয়ায় ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান। সেটি ব্যর্থ হওয়ার পর জাসদ এবং তাহেরের কফিনে শেষ পেরেকটি পড়ে। ১৭ জুলাই তাহেরের ফাঁসির আদেশ হয়, তা কার্যকর হয় ২১ জুলাই। অক্টোবরে সিওসির সভায় বিপ্লবী পার্টি গড়ার প্রক্রিয়া থামিয়ে দেওয়া হয়। সব দায়িত্ব ‘এক ব্যক্তি’র হাতে ন্যস্ত করে পার্টি বিলোপ। ওই ব্যক্তি সিরাজুল আলম খান। তিনি গ্রেপ্তার হন ২৬ নভেম্বর, ঘটে জাসদের একটি পর্বের সমাপ্তি।
এই কালপর্ব প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাহেরের। ৩ নভেম্বর তাদের দেশ ছাড়ার পুরো দিনটিই তিনি ছিলেন বঙ্গভবনে। তাদের সমঝোতা হয়, পটপরিবর্তন হলে জিয়া আবার সেনাপ্রধান, অভ্যুত্থানকারীরা ফিরবেন দেশে। জানান, ৬ নভেম্বর রাতে ১২ দফা দাবিনামার ১০ দফায় স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, যেসব সামরিক অফিসার ও জওয়ানকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এ তথ্য জাসদের হাজার হাজার তরুণের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। পরে ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা জিয়ার আমলে ফিরেও ছিল। গঠন করেছিল ফ্রিডম পার্টি। তাহেরের ফাঁসি হলেও জাসদের অনেক নেতার সঙ্গে ছিল তাদের যোগাযোগ, লিবিয়া গেছেন ট্রেনিং নিতে।
ফারুক-রশীদ গ্যাঙের সঙ্গে তাহেরের যোগসাজশ ও তাঁর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা প্রশ্নে সিরাজের সঙ্গে মহিউদ্দিনের কথোপকথনও চমকপ্রদ। সেই সূত্রে দায় জাসদের ওপরও বর্তায় কি না এ প্রশ্নে সিরাজ সাফ জানান, সেটি তাহেরের ইনডিভিজুয়াল রোল। এর সঙ্গে জাসদের কোনো কানেকশন নেই। জাসদ শেখ মুজিবের পতন চেয়েছে রাজনৈতিকভাবে। নট ইন দিস ওয়ে। তাহের সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি করত বলেও জানান মহিউদ্দিন। এ কথা সত্য হলে জাসদে তো তিনি অনুপ্রবেশকারী। হয়তো এসেছিলেন নেতা হত্যার বদলা নিতে। আর তার মাসুল গুনতে হয়েছে সিরাজকে।
গুলি আর রক্তের সেই টালমাটাল জোয়ারে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতা হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকে খুন করা হলো। খালেদ-হায়দার-তাহেরের পর হত্যা করা হয়েছে জিয়াকে। খুন হয়েছেন মঞ্জুরও। সেনানিবাস হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার শূন্য। নিজেদের অজান্তেই হয়তো তাঁরা কোনো অদৃশ্য নীলনকশার বাস্তবায়ন করেছেন নিজেদেরই প্রাণ দিয়ে, প্রাণ নিয়ে। তবে মঞ্জুর হত্যার বিচার শেষের আগেই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে আরেক সামরিক শাসক এরশাদের।
জাসদ নেতারা রাজনীতির মাঠে থাকলেও ক্ষমতার রসায়নটা বুঝতে সময় নিয়ে ফেলেন। নতুন শক্তি হয়ে মাঠ দখল করে সেনাবাহিনী। পরে তাদের সঙ্গে সমঝোতা আর দর-কষাকষির মধ্য দিয়ে এগোতে চেয়েছে জাসদ। প্রমত্তা পদ্মার মতো উত্তাল দলটি শিরা-উপশিরার মতো বিভক্ত হয়ে চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে।
৫
মুজিব হত্যার পর অভিভাবক হারান সিরাজ। হারান বেড়ে ওঠার দিনগুলোর রাজনৈতিক সহকর্মীদের। তাঁকে ঘিরে থাকা তারুণ্যের যে দ্রোহ, যে উন্মাদনা তার রাশ তিনি টেনে ধরতে পারেননি। জিয়া ক্ষমতায় এলে উত্থান হয় পাকিস্তানের পক্ষে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোর। সক্রিয় হয়ে ওঠে একাত্তরে পরাজিত বিদেশি শক্তি। সবারই টার্গেট জাসদ। ৭ নভেম্বরের পর থেকেই তাই, সেই সিরাজের মতো এই সিরাজও নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে পলাশীর প্রান্তরে। দল নেই, অফিস নেই। আগে বিকেলে যেতেন শেরাটনের লবিতে। খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন সন্ধ্যার পর বসেন ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের অক্সফোর্ড স্কুলে। বছরে কয়েক মাসের জন্য বিদেশে যান। ফেরেন শীত পড়লে। মহিউদ্দিন ও সুমন মাহমুদকে তিনি জানিয়েছেন তাঁর শেষ ইচ্ছের কথা: আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।