বঙ্গবন্ধুর সাথে চীন দেশে
তৎকালীন [পূর্ব] পাকিস্তানের জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নয়াচীন ভ্রমণ করেন ১৯৫২ সালে। কেবলই তার কিছুদিন আগে, ১৯৪৯ সালে চীনে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করেছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তথা পৃথিবীর বিপ্লবের ইতিহাসেই এটি একটি বড় ঘটনা। তখনকার চীনকে বলা হতো নয়াচীন। নয়াচীন ১৯৫২ সালে এক শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে। মনে রাখতে হবে, ক্ষমতা দখলের মাত্র তিন বছরের মাথায় এই সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়। পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ডাক পান বঙ্গবন্ধু। তিনি তখনো বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি, কিন্তু হয়ে উঠছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের এক অপরিহার্য নেতা। মাও যখন ক্ষমতা দখল করেন, তার কাছাকাছি সময় থেকে বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন। মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ছাড়া পেয়ে আবার বিপুল বিক্রমে রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। কারাগারকে সম্ভবত তিনি নিয়তি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। জীবনের অনেকটা সময় তিনি কারাগারেই ছিলেন। চীন ভ্রমণের ঘটনাও তিনি লিখেছেন কারাগারে বসে, ১৯৫৪ সালে।
বঙ্গবন্ধু যে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চীনে যান, চীন সম্পর্কে তাঁদের সবার মনোভাব খুব বেশি ইতিবাচক ছিল না। কমিউনিস্ট কথাটা তখন নেতিবাচকভাবেই চর্চিত হতো—ওই প্রতিনিধিদলের বেশির ভাগ সদস্য এমনকি বঙ্গবন্ধুর কাছেও। সম্ভবত এ জন্য প্রপাগান্ডার রাজনীতিই দায়ী ছিল, যা প্রধানত নিয়ন্ত্রণ করত আমেরিকা। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ের প্রথম দিকেই বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ‘অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যোগদান করবেন কেন? আপনারা তো কম্যুনিস্ট না। কথাটা সত্য যে আমরা কম্যুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি।’ অর্থাৎ কমিউনিস্ট দেশে যাওয়াও খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না তখন। কেননা, সেখানে যাওয়ার কারণ এক প্রকার কৈফিয়ত যেন দিচ্ছেন লেখক। বঙ্গবন্ধু নিজের চোখে এই প্রপাগান্ডার সত্যতা বিচার করতে চেয়েছিলেন। পুরো বই পড়ে বোঝা যায়, প্রপাগান্ডাকে তিনি খুব বেশি বিশ্বাস করেননি। যার ফলে তিনি একা একা অনেক জায়গায় ঘুরেছিলেন সরেজমিনে দেখার জন্য। সাধারণ অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন সে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য। প্রপাগান্ডার প্রমাণ পাননি বরং কম্যুনিস্ট সরকারের ভালো কাজের প্রমাণ পেয়েছিলেন বিস্তর। কথা ও কাজের মিল পেয়েছেন। এখানেই বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। চীনা সরকার তাঁদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেটুকু দেখিয়েছেন, সেটুকুতে অন্যরা সন্তুষ্ট থাকতে পারলেও বঙ্গবন্ধু কিন্তু সন্তুষ্ট হননি। তিনি চিরকাল মাঠের রাজনীতি করেছেন, ফলে নয়াচীনে গিয়েও তিনি সাধারণ মানুষের কাছেই গিয়েছেন, সে দেশের আসল অবস্থা জানার জন্য। গিয়ে দেখেছেন মাত্র তিন বছরের মাথায় অত বড় জনসংখ্যার একটি দেশ কীভাবে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শাসকদের আন্তরিকতা থাকলে কীভাবে একটা দেশকে অল্প দিনেই বদলে দেওয়া যায়। কীভাবে জনসাধারণ দেশকে নিজের মনে করে, দেশের জন্য কাজ করাকে নিজের কাজ বলে মনে করে।
বঙ্গবন্ধু যখন নয়াচীনে যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩২, ওই বয়সেই তাঁর যে দেখার চোখ, তা আমাদের বিস্মিত করে। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে থেকেও অন্যদের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এবং অনেক বেশি জানার ইচ্ছা ও পরিশ্রম করার মানসিকতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। তখনই তাঁর মধ্যে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। অন্য প্রতিনিধিরা যখন বিশ্রাম করছেন, তখন তিনি বেরিয়ে পড়ছেন নিজের জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে।
বইটি এত সহজ ভাষায় লেখা যে এটি যেকোনো পাঠককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। এর কারণ হয়তো তিনি একে কোনো সাহিত্যকর্ম হিসেবে গড়ে তুললে চাননি। শুধু নিজের মনের আনন্দে লিখে গেছেন তাঁর পর্যবেক্ষণ, ভালো লাগা, মন্দ লাগা। ১৯৫২ সালের ভ্রমণ বিষয়ে তিনি লিখছেন ১৯৫৪ সালে, জেলখানায় বসে। কিন্তু খুঁটিনাটি বিষয়গুলো যেভাবে সেখানে উল্লেখ করেছেন, তাতে মনে হয় যখনকার ঘটনা তিনি তখনই লিখছেন। বঙ্গবন্ধুর এই অসাধারণ স্মৃতিশক্তির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন অনেকেই, অনেক মানুষই সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর এই গুণটির। বঙ্গবন্ধু একবার কারও সঙ্গে পরিচিত হলে দশ বছর পরও তার নাম এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি মনে রাখতে পারতেন। ফলে আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থটি দুই বছর পর রচিত হলেও মনে হয় যেন তৎক্ষণাৎ লেখা।
এই বইয়ে তিনি যেসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, তা থেকে তাঁর ঔচিত্যবোধের পরিচয় মেলে। যেমন: মিয়ানমারে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্টদূতের বিষয়ে তিনি লিখছেন, ‘রাষ্ট্রদূত অনেক জাঁকজমকের সাথেই থাকেন, বিরাট অফিস ও বহু কর্মচারী তাকে সাহায্য করে। দেখে মনে হলো, যাদের টাকা দিয়া এত জাঁকজমক তাদের অবস্থা চিন্তা করলেই ভালো হতো। তাদের ভাতও নাই, কাপড়ও নাই, থাকবার মতো জায়গাও নাই।’ এ রকম নানা অসামঞ্জস্য লেখকের চোখ এড়ায়নি। মিয়ানমারের বিপ্লব সম্পর্কেও তাঁর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি দেখেছেন সেই দেশে বিপ্লবী বাহিনী আছে, ঘন জঙ্গল থাকায় বিপ্লবী বাহিনী গেরিলা আক্রমণ করে চটজলদি জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারে, সেই সুবিধাও তাদের আছে, তবু তারা সুবিধা করে উঠতে পারছে না। এর কারণ হিসেবে লেখক বলছেন, জনগণের সঙ্গে দূরত্ব। তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখছেন, ‘জনসমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না।’ চীনে যাওয়ার পথে যেসব দেশে থামতে হয়েছে, সেগুলোর বর্ণনাও দারুণ প্রাঞ্জল। অল্প কথায় সেসব দেশের একটা সামগ্রিক ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। তিনি লিখেছেন, ‘যতগুলো শহরে আমি গিয়াছি তার সকল জায়গায় বাজারে ঘুরেছি।’ অর্থাৎ তিনি সেখানকার সামগ্রিক অর্থনীতির একটা চিত্র খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন।
চীন সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় বক্তৃতা করেন। তিনি চীনে গিয়ে দেখেছেন, সেখানকার শিক্ষিতদের অনেকেই ইংরেজি ভাষাটি খুব ভালোভাবে জানলেও বলেন না। তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষায় কথা বলতেই গর্ববোধ করেন। কিন্তু পাকিস্তানের অন্যেরা যেন ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়ে আভিজাত্য প্রকাশ করতে চায়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল লোকেই কিছু কিছু জানে।’ নিজের দেশ ও ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও গর্বের এ এক অনন্য প্রকাশ। পাকিস্তানে তখন বৈষম্য চরমে, লুটপাট, ঘুষ, দুর্নীতিতে ছেয়ে যাচ্ছে নতুন দেশটি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজের বক্তৃতায় দেশের সম্পর্কে কোনো সমালোচনা করেননি, যেখানে অন্যান্য দেশের অতিথিরা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। লেখকের যুক্তি হলো, নিজেদের দুর্নীতির কথা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বলে নিজেদের ছোট করা যাবে না। কেননা, নিজেদের সমস্যা শেষ পর্যন্ত নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। এখানে তাঁর বিচক্ষণতার প্রমাণ মেলে। বঙ্গবন্ধু ‘ঘরোয়া ব্যাপার’ আন্তর্জাতিক বক্তৃতায় আলোচনা করতে চাননি।
চীন সম্পর্কে পাকিস্তানিদের প্রচলিত ধরণা ছিল যে, চীনের মুসলমানরা খুব নিপীড়িত। কিন্তু লেখক বলছেন, এসব কেবলই প্রচার। পশ্চিমাদের ছড়ানো নিন্দা। বাস্তবে তিনি দেখেছেন, চীনারা সবাই যার যার ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে পালন করে। কেউ কাউকে এসব বিষয়ে বাধা দেয় না বা জোর করে না। লেখক প্রচলিত মতের প্রতি আস্থা না রেখে নিজ বুদ্ধি বিবেচনার প্রয়োগ খাটিয়ে নিজেই যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন।
চীনে ভিক্ষুক এবং যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিল অনেক। কিন্তু মাও সে তুংয়ের আমলে সেটা কমে একদম শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে। লেখক এর কারণ খুঁজেছেন। সত্যিই ভিক্ষুক নেই কি না, এটা দেখার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিস্তর। কিন্তু কোনো ভিক্ষুকের দেখা মেলেনি। কেননা সব ভিক্ষুককে সরকার নির্দিষ্ট হোমে নিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। যারা একদমই অক্ষম, তাদের কোনো কাজ করতে হয় না। সাধারণ মানুষও এই মহৎ উদ্যোগে সমর্থন জানিয়ে ভিক্ষুক দেখতে পেলেই সরকারের কর্মচারীদের মাধ্যমে হোমে পাঠিয়ে দেয়। এই বিরাট সমস্যা মাত্র তিন বছরে চীন সমাধান করে ফেলেছে। আমাদের এখানেও রাস্তাঘাটে অসংখ্য ভিক্ষুক দেখতে পাওয়া যায়। সরকার আন্তরিক হলে অল্পদিনেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। যৌনকর্মীদেরও সরকার কাজ দেওয়ার মাধ্যমে পুনর্বাসিত করেছে। লেখক লিখেছেন, ‘এই বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে নয়াচীন সরকার জেহাদ ঘোষণা করল। আইন করে না, মানবীয় ব্যবহার দ্বারা।’
চীনের আরেকটা সমস্যা ছিল আফিম। কিন্তু সরকার এটাও বন্ধ করতে সমর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রতি পদে পদে দেখেছেন, সরকার ঠিকমতো কাজ করলে একটা দেশ উন্নত হতে সময় লাগে না। কেননা জনগণ যদি বুঝতে পারে, সরকার তাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করছে, তাহলে তারা সরকারকে সব রকমের সহায়তা করে। ফলে, সরকারের কাজও সহজ হয়ে যায়। দেশের আইনে পরিবর্তন এনে আইনকে জনবান্ধব করেছিল চীন সরকার। লেখকের বর্ণনায়, ‘স্বামী জমি যাহা পাবে, স্ত্রীও সমপরিমাণ জমি পাবে এবং দুজনকেই পরিশ্রম করতে হবে। কারণ দুজনই জমির মালিক। স্বামী কাজ করবে আর স্ত্রী বসে খাবে এ প্রথা চীন থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে।’ নতুন একটা দেশ কীভাবে পরিবর্তন করছে নিজেদের, তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন লেখক। কেননা, পাকিস্তানও তখন সদ্য স্বাধীন দেশ। লেখক দুই দেশের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আর গৃহীত পদক্ষেপের পার্থক্য দেখতে পাচ্ছিলেন। চীনে কোথাও না খেতে পেয়ে কেউ মারা গেলে সেই দায় সেখানকার সরকারি কর্মকর্তাদের নিতে হতো, আর পাকিস্তানে এমন হলে এই খবর যে ছাপত সেই পত্রিকার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। অর্থাৎ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও তখন আইন করে খর্ব করা হচ্ছিল।
বঙ্গবন্ধু নয়াচীনে ছিলেন পঁচিশ দিন। কিন্তু এই অল্প সময়েই সেখানকার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো গভীর অভিনিবেশসহকারে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেখানকার মানুষের দেশপ্রেম, তাদের বদলে যাওয়া, সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি ইত্যাদির বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। তার ভেতরের জিজ্ঞাসু মনের জবাব না নিয়ে তিনি ফেরেননি। যার ফলে পাঠক ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ে অসাধারণ এক নেতার সঙ্গে সঙ্গে চীন ভ্রমণ করার আনন্দ পান। আজকের চীন বিশ্বে এক পরাশক্তি। কিন্তু তার আরম্ভটা দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেটা দেখে তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণী তিনি করেছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। নয়াচীনের প্রতি আস্থা ছিল লেখকের। আজকের চীন যেন সেই আস্থারই প্রতিফলন।