ভেদ জহুরের ভেদ ও অভেদকথা

 

নাগরী লিপির উৎপত্তি কবে থেকে এবং এর উদ্‌গাতাই-বা কারা, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা তর্ক জারি থাকলেও এ কথায় কারও ভিন্নমত নেই যে, বেপিরা ও বেমুর্শিদার কাছ থেকে তত্ত্বকথা আড়াল করার জন্য একসময় ফকিরেরা এ লিপি গ্রহণ করেছিলেন। এই অঞ্চলের অগ্রজ ফকির সৈয়দ শাহনূর [১৭৩০-১৮৫৬ খ্রি.]-এর সাবধানবাণী ছিল: ‘বেপিরাএ বেমুরশিদাএ জদি নিআ পড়ে/গুপত কথা পাইব শে দুজক গিয়া পড়ে’। কিন্তু কথা হলো, ফকিরি গানগুলো যদি লিখিত হয় তাহলে সেগুলো তো বেপিরা-বেমুর্শিদা পাঠকের পড়ার সুযোগ তৈরি হবেই এবং এর প্রকৃত মরতবা না-বুঝে এর ভিন্ন অর্থ তোলারও সুযোগ তৈরি হবে। এ কারণে তাঁরা ভাবলেন, লিখতে হবে এমন লিপিতে, যা সর্বত্র পঠিত নয়, যা নির্দিষ্ট/উদ্দিষ্ট পাঠকের কাছে অনেকটা সাংকেতিক ভাষার মতোই পৌঁছবে—এমন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে ফকিরেরা তাঁদের তত্ত্বপুথিগুলো লিখে গেছেন। এ যে কোনো আন্দাজি মন্তব্য নয়, তার প্রমাণ এ অঞ্চলের ফকির রিসালায়ে মারিফত গ্রন্থের রচয়িতা শাহ আরমান আলী ওরফে আফজল শাহ [১২১৪-১৩৩৪ ব.]-এর বাণীতে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত রয়েছে:  

ফকিরে কহিলে কতা আলিমে করে হেলা।
কিছু না কহিতে পারি জবান বাংগেলা॥  

এতে স্পষ্ট, ফকিরেরা তাদের তত্ত্ব বয়ানের ক্ষেত্রে বাংলা জবানের/লিপির বদলে নাগরী লিপি গ্রহণ করার পেছনে তাদের সেই আড়ালপ্রয়াসী মনোভাবই কাজ করেছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, এখানে ‘হেলা’ শব্দটি অনেকার্থদ্যোতক: অবজ্ঞা তো বটেই, মুর্শিদ-সহবতের অভাবে যথাঅর্থে পৌঁছতে না পারার সংকটের কথাও এতে ব্যক্ত। ভেদ জহুর পুথি নাগরী থেকে লিপ্যন্তরের পর তার তত্ত্বাধার পয়ারগুলো পড়বার পরপরই আমাদের এই সিদ্ধান্তে আরও পোক্ত হয়েছে। এ ছাড়া এ কথার পক্ষে আরও দৃষ্টান্ত রয়েছে ভেদ জহুর গ্রন্থ এবং উপস্থাপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে। 
ফকির মজিরউদ্দিন আহমদ [১৮৬৩-১৯৩৩ খ্রি.] যে অঞ্চলে বসে বহু আঞ্চলিক শব্দসংবলিত গান ও পয়ারের সমন্বয়ে এই পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন, সেই অঞ্চলেই আমাদের বেড়ে ওঠা; তাঁর গানে যে আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষা থেকে অনেক শব্দ যুক্ত হয়েছে, সেই তিন ভাষার শব্দ সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা সত্ত্বেও লিপ্যন্তরিত ভেদ জহুর-এর পয়ার ও নানা পদের কিছু শব্দের অর্থোদ্ধার করতে আমাদেরকে যারপরনাই নাকাল হতে হয়েছে। আমাদের ধারণা, এর কারণ, ভেদ জহুর-রচয়িতা ফকির মজিরউদ্দিন আহমদ ফকিরি ভেদ জহুর বা প্রকাশ করবার জন্য আমপাঠকের কথা মাথায় না রেখে তাঁর খাস ভক্ত পাঠককুলের কথাই মনে রেখেছেন আর তাদের উপলব্ধির জন্য দরকারমতো স্থানীয় শব্দ ও আরবি-ফারসি শব্দের অপভ্রংশ এবং কখনো পারিভাষিক শব্দের বর্ণান্তরিত প্রচলিত রূপও গ্রহণ করেছেন, আর এতে সময় ও স্থানের ব্যবধানে পাঠকের কাছে কিছু শব্দ অপরিচিত হয়ে উঠেছে। 
ভেদ জহুর পাঠের আগে উপরিউক্ত কথাগুলো মনে রাখা জরুরি। 

ফকিরেরা তাদের তত্ত্ব বয়ানের ক্ষেত্রে বাংলা জবানের/লিপির বদলে নাগরী লিপি গ্রহণ করার পেছনে তাদের সেই আড়ালপ্রয়াসী মনোভাবই কাজ করেছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, এখানে ‘হেলা’ শব্দটি অনেকার্থদ্যোতক: অবজ্ঞা তো বটেই, মুর্শিদ-সহবতের অভাবে যথাঅর্থে পৌঁছতে না পারার সংকটের কথাও এতে ব্যক্ত। ভেদ জহুর পুথি নাগরী থেকে লিপ্যন্তরের পর তার তত্ত্বাধার পয়ারগুলো পড়বার পরপরই আমাদের এই সিদ্ধান্তে আরও পোক্ত হয়েছে।

      

নাগরী লিপিতে রচিত ফকির মজিরউদ্দিন আহমদের তত্ত্বগ্রন্থ ভেদ জহুর-এর তেরোটি পয়ারের কোনো কোনোটিতে অন্যত্র-পাওয়া-যায় এমন কিছু সাধারণ তথ্য থাকলেও কিছু পয়ারে রয়েছে এমন ভেদকথা যা সাধারণত মুর্শিদ তার বালক বা শিষ্যকে কানে কানে বলে থাকেন এবং এ কারণে যে কথাগুলো এখনো মুর্শিদ-মুরিদ সিলসিলায় জারি রয়েছে। প্রথম পয়ারে মধ্যে আমরা পাব এমন কিছু বার্তা যা আমাদের চিন্তাকে বহুদিকে বিস্তৃত করে:

জলেতে মিশিয়া জল করিলা মথন
নিজ রূপে মিশাইয়া লইলা পাঞ্জাতন॥
পঞ্চ খান জেওরাত অঙ্গে দেখাইলা তখন।
তন হইলা মোহাম্মদ মন নিরঞ্জন॥
শাহা মরদ বাজুবন্দ হাছলি হইলা নারী।
সংক্ষেপে করিলা লীলা জগৎ অধিকারী॥

পাঞ্জাতন মানে হজরত মোহাম্মদ, হজরত আলি, মা ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন—এই সূত্র মনে রেখে ওপরের পঙ্‌ক্তিগুলোর দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখব কীভাবে নিরঞ্জনের সঙ্গে পাঞ্জাতন এক রূপ পেয়েছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, রয়েছে আল্লাহর নুরে মোহাম্মদ, মোহাম্মদের নুরে জগৎ বা ‘সয়াল সংসার’ অর্থাৎ পাখি জীবজন্তুসহ আঠারো হাজার সৃষ্টির কথা। তারপরে আছে আদমের কাছে স্রষ্টাপ্রদত্ত আমানত প্রদান এবং তার হেফাজত ও দায়িত্ব পালনের কথা। কিন্তু এই সব কথা এবং আমানতটাই-বা কী এবং তা কী উপায়ে জানা যাবে—এর জন্যই মুর্শিদ-সহবত প্রয়োজন: ‘কিবা ধন দিলা কৈলা হেফাজত করিতে।/ মুর্শিদ বিনা এই ভেদ কে পারে বুঝিতে॥’ এসব কথা জানার জন্য একসময় মুরিদকে দিনের পর দিন মুর্শিদ-সহবত করতে হতো। মুর্শিদও সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ করা তো দূরের কথা, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে মুরিদের কাছেও তা প্রকাশ করতেন না। এই মুর্শিদের জরিয়ায়ই জানা যায় আসল ভেদ, আর এই জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যেই তো কণ্ঠে মা সরস্বতীকে ভর করার জন্য এমন আকুলতা:

নাভির মাঝে দমের কুঞ্জি উঠতেছে লহর।
চাকি কুণ্ডলীর মাঝে গহীন সাগর॥ 
এই স্থান হইতে হয় সুষুম্নার উৎপত্তি।
এই নাভি মধ্যে বিরাজিত সরস্বতী॥
উঠ গো সরস্বতী মা, কণ্ঠে কর ভর।
অজ্ঞান বালক আমি ভরসা কেবল তোর॥

যৌগিক সাহিত্যে ইঙ্গলা, পিঙ্গলা ও সুষুম্নাকে যথাক্রমে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী বলে চিহ্নিত করা হলেও এখানে সে অর্থে সুষুম্নাকে সরস্বতী বলা হয়েছে বলে মনে হয় না, এখানে যেন বিদ্যার দেবীর প্রতি অজ্ঞান বালকের সম্বোধন। কিন্তু শুধু এই তথ্যের জন্য এ পয়ার গুরুত্বপূর্ণ নয়, এখানে রয়েছে দৃষ্টান্তযোগ্য কিছু উদার ও অসাম্প্রদায়িক বার্তাও। 
ফকির মজিরের পয়ারে এইসব বার্তা এভাবে যে হাজির হতে পারে, তার কারণ: ‘হিন্দু আর মোসলমান ভিন্ন ভিন্ন জাত/একই কলমে সৃজন কইলা দীনের নাথ।’ ভেদ জহুর-এর মোট তেরোটি পয়ারের মধ্যে একমাত্র শিরোনামহীন এই পয়ার আগাগোড়া পড়ে নিলে বোঝা যায় এর মূল উদ্দেশ্য দম-সাধনা আর তনের বিচার:

তন রাধা মন কানু ভাবিয়া দেখ মনে।
রাধা কানু বিচারি চাইও আপনার তনে॥
কানুর বাঁশি নাকের স্বর লওরে বুঝিয়া।
তন রাধা সুন্দরী নারী রুহুত কালিয়া ॥

এখানে ফকির, যুগল-ধারণামতে সরূপ চৈতন্য; বল, বীর্য, জ্ঞান হলো রাখাল, ধেনু রাখালি করে রিপু; আর রাধার সখিরা হলো নাক, কান ও চোখ ইত্যাদি।     
 দ্বিতীয় পয়ার ‘পয়ার মণির তেল’কে ‘কামতত্ত্ব’ বলা যায়, সাধারণত এভাবে চিহ্নিত না হলেও ‘নারীতত্ত্ব’ বলেও অভিহিত করা যেতে পারে। ফকিরের কাছে নারী বর্জনীয় নয়, বরং মনে হয় বাস্তবতার কারণেই—গ্রাহ্য: ‘সাধন ভজন সব মাইয়ার চরণ/মাইয়ার চরণে আছে জীবন মরণ।’ সেই নারীর কাছে যেতে গেলে ধন্বন্তরী ওঝা মুর্শিদের মন্ত্র নিতে হবে, না হলে তরী ডুবে যাবে। মজির বলছেন ‘ত্রিপুণী’র অর্থাৎ ত্রিবেণীর তিন নালার ভেদে তিন ধরনের নারী আছে যাদের নিয়ে ফকিরি করা যায়। এ ছাড়া আরও চার প্রকারের নারী আছে, যাদের ওপর খান্নাছের প্রবল আছর থাকায় তাদের কারণে পুরুষকে ধনে-প্রাণে মরতে হয়। তবে সাবধান হতে হয় সকল নারীর ক্ষেত্রেই, গুরুর কাছে জেনে নিতে হয় রাধা-কানু কীভাবে ব্যাপার/লীলা করে, ত্রিপুণীর কোথায় মুখ রেখে কানু দধি পান করে। এই সব জানার জন্য মুর্শিদ-সহবত আবশ্যক বটে, কিন্তু কিছু স্পষ্ট বার্তা আছে এ-পয়ারেও:

গহিন সাগর নদী কুম্ভীর তাতে ভাসে।
কামভাবে নামিলে জলে, তাহারে গরাসে॥
কাম তেজি প্রেমভাব যে করিব সার।
নদীতে পড়িব চর, ভয় নাহি তার॥

ক্রমানুসারে বইয়ের তৃতীয় পয়ারেরও শিরোনাম: ‘পয়ার তন বিচার খাকের পুতুলা তন’, যেখানে বলা হয়েছে তনের উপাদান কী কী, সেখানে চার নফস ও চার ফেরেশতা রয়েছে তার কথা, আছে জননী ফাতেমার কথা, আছে হজরত আলি, হাসান ও হোসাইনের কথা, আছে আশিক-মাশুকের রূপে রাধা-কানুর স্থলে লাইলি-মজনুর কথাও। সব তন মিলে যেমন পাঞ্জাতনকেই স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনই মনে করিয়ে দেয় যুগল মতকেও: ‘দুই তনে এক তন ভিন্ন নাহি ছিল।/পিরিতি করিয়া তারা এমতে মিশিল।’  ফকিরের কাছে তনই যে আসল, এ-পয়ারের মূল বক্তব্য শেষ পর্যন্ত তা-ই :

ফাতিমা জননী আছইন হাপ্তম খানা ঘরে। 
তনের মাঝে জায়নামাজ চিনিয়া লইও তারে॥
মলানা মোল্লায় নমাজ পড়ইন তনে কোনখানে।
তনের মাঝে ফুল সজিদা না চিনিলাম কেনে॥

তৃতীয় পয়ারে আমরা পেয়েছি তনের মধ্যে নফসের আর ফেরেশতার অবস্থানের তথ্য, এখন চতুর্থ পয়ারে রয়েছে সেই চার নফস—‘নফসে আম্মারা’, ‘নফসে লুয়াম্মা’, ‘নফসে মুলহিম্মা’ আর ‘নফসে মুতমাইন্না’র নাম। সেই সঙ্গে আছে চার মোকাম—জবরুত, মলকুত, লাহুত আর নাছুতের নামও যাদের সঙ্গে যথাক্রমে হজরত জিবরাইল, হজরত আজরাইল, হজরত ইসরাফিল এবং হজরত মিকাইল জড়িত। উপরিউক্ত কথাগুলো সুফি মতের বইগুলো তালাশ করলে পাওয়া যাবে, কিন্তু নিম্নোক্ত তথ্য সুলভ নয়:            

জবরুতেতে জিবরাইল জবান মাঝার।
চোখে মলকুত মিকাইল দেখে সংসার॥
লাহুতেতে আজরাইল কানে শুনে ধ্বনি।
নাকে নাছুত বাজায় বেনু ইস্রাইলে শুনি॥
এইনা মতে রাখিয়াছেন জগৎ অধিকার।
আল্লার হাট মোহাম্মদের বাজার তনের মাঝার॥

‘পয়ার ছয় লতিফা’, ‘পয়ার চাইর তনের কথা’, ‘পয়ার তনের বিচার’, এবং ‘পয়ার নারীগণের লক্ষণ’-এ আছে প্রধানত ফকিরি তত্ত্ব এবং অংশত সুফি তত্ত্বের নানা প্রসঙ্গ যা পড়লে এ ধারার অনুসারী মুরিদদের পাশাপাশি আম পাঠকেরাও ফকিরি বিষয়ে সাধারণ ধারণা পেয়ে যাবে। কিছু পয়ারে আছে অন্য-পয়ারে-বর্ণিত বিষয়-অনুষঙ্গের পুনরুক্তি, আছে শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারিফতের বর্ণনা আর দুইটি পয়ারে আছে এমন কিছু সাধারণ/সহজলভ্য বর্ণনা, যা অন্য পয়ারের গূঢ়ত্বের কারণে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয়।

ভেদ জহুর-এর পয়ারগুলোকে ‘তত্ত্ব’ হিসেবে ধরে নিলে এর অধিকাংশ গানকে ‘প্রয়োগ’ বলে চিহ্নিত করা যায়। তবে এই সূত্রে এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে, তাহলে পয়ার আর গানের মধ্যে কোনটা আসল, ফকিরদের কাছে কোনটার গুরুত্ব বেশি। এ অঞ্চলের অগ্রজ ফকির সৈয়দ শাহনূরের বাণীতে ‘পয়ার’ রেখে রাগ/গান ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা পড়ে আমরা একসময় বুঝে উঠতে পারিনি এর কারণ কী। তত্ত্ব-পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে চিন্তা করলে আজও মনে হয়, পয়ারে ফকিরি তত্ত্বের যে বিষয়গুলোর উল্লেখ থাকে, গানের রূপক-প্রতীকের মধ্য দিয়ে সেই বিষয়গুলো তো আরও প্রাণবন্ত ও বাস্তব হয়ে উঠতে পারে।


ভেদ জহুর-এর পয়ারগুলোকে ‘তত্ত্ব’ হিসেবে ধরে নিলে এর অধিকাংশ গানকে ‘প্রয়োগ’ বলে চিহ্নিত করা যায়। তবে এই সূত্রে এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে, তাহলে পয়ার আর গানের মধ্যে কোনটা আসল, ফকিরদের কাছে কোনটার গুরুত্ব বেশি। এ অঞ্চলের অগ্রজ ফকির সৈয়দ শাহনূরের বাণীতে ‘পয়ার’ রেখে রাগ/গান ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা পড়ে আমরা একসময় বুঝে উঠতে পারিনি এর কারণ কী। তত্ত্ব-পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে চিন্তা করলে আজও মনে হয়, পয়ারে ফকিরি তত্ত্বের যে বিষয়গুলোর উল্লেখ থাকে, গানের রূপক-প্রতীকের মধ্য দিয়ে সেই বিষয়গুলো তো আরও প্রাণবন্ত ও বাস্তব হয়ে উঠতে পারে। বিষয়টি কি ফকিরেরা বুঝতেন না? এ প্রসঙ্গে সৈয়দ শাহনূরের সাবধানবাণী ছিল এই: 

পয়ার তইয়া যেই জনে রাগ নিত চাইব  
নিশ্চয় জানিও তার রুহু ছিয়া অইব।
তবে যদি চায় কেউ ভাংগি লেখিবার
আউয়ালে আখেরে সে হইব গোনাগার॥

স্পষ্ট বোঝা যায়, পয়ার এখানে রাগের/গানের প্রবেশকমাত্র, তা আত্মস্থ না করে কেউ গানের প্রতীক-রূপকায়ত লীলাময় বাস্তবতা আস্বাদন করতে চাইলে তা যথার্থ/যথাযথ উপলব্ধিতে পৌঁছতে সমস্যা হবে ভেবেই এই সাবধানতা। পরবর্তীকালের এবং একালের কিছু বাউল/ফকির-ভাবের গানগুলোর বিষয় বিবেচনায় আনলে ওই সাবধানবাণীর যাথার্থ্য ভালোভাবে বোঝা যাবে। বেপিরা-বেমুর্শিদা গীতিকারদের বিষয়ে ফকির সমছুল [১৯৪১-২০১৮ খ্রি.] ও বাউল মকদ্দস আলম উদাসী [১৯৪৭ খ্রি.]-কে [মৎগৃহীত এবং এখনো অপ্রকাশিত একটি কথোপকথনে] সওয়াল করেছিলাম: ‘এ-যুগে যারা ভালোভাবে তত্ত্ব না বুঝে গান লিখছেন তাদের সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কী? এর জবাবে ফকির সমছুল বলেছিলেন: ‘গান লেখউকা, লেখতে লেখতে নিজর ভুল বুইঝ্যা একদিন এরা পথঅ আইবানে; আর মকদ্দস আলম উদাসী বলেছিলেন: ‘মালদই আম গাছঅ পাকলে কোনো কোনো সময় কাউয়ায় ঠুকরাইয়া নষ্ট করিলায়, আর খাইত পারে না।’ ফকির সমছুলের সরলোক্তি মতে পথে-ফিরে-আসার আশা বাস্তবায়ন হলে তো ভালোই, কিন্তু নষ্ট না করে আম খেতে গেলে আগে নিজেকে খাওয়ার যোগ্য করে তুলতে হয়। অর্থাৎ পয়ারোক্ত তত্ত্ব যথাঅর্থে উপলব্ধি করতে না পারলে গানের মর্মে প্রবেশ করা যায় না। সে কারণেই গ্রন্থের প্রথম পয়ারেই মজির বলেছিলেন:  

রাধা কানু মুখে বলে মনে অন্য আশা।
মুর্শিদের পদের তলে মজিরের বাসা॥

আর এ জন্যই ভেদ জহুর-এর পয়ার আর গানের মধ্যে এতটা পরস্পরসম্বন্ধ। ‘পয়ার মণির তেল’-এ মজির উল্লেখ করেছিলেন, কলমে ছিয়াই বা কালি তুলে যে লিখতে পারে, তার ঘরে দিনরাত চেরাগ জ্বলবে, আর এখানে ‘কোন কলে তালা লাগে’ গানটিতেও রয়েছে সেই কথা: 

নিজ কলম নিজ হস্তে সাবধানে রাখিতে হয়।
দোয়াতের ছিয়াই কলমে তুইলে লওহে মাহফুজে লেখতে হয়॥

কইন মজিরে একনামে মুর্শিদের পদে মজতে হয়।
দুই অঙ্গে এক অঙ্গ হইলে আরেক অঙ্গ উদয় হয়॥

কোথায় লিখতে হবে পয়ারে তার উল্লেখ ছিল না, কিন্তু এখানে পাচ্ছি ‘লওহে মাহফুজ’ অর্থাৎ যে-ফলকে লিখলে লেখা/বাণী হেফাজতে থাকবে তার কথা। লওহে মাহফুজের কথা সাধারণত কোরানের আয়াতের প্রসঙ্গে এভাবেই উল্লিখিত হয় যে, তা পরে অবতীর্ণ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আগে থেকে লওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ ছিল বা আছে। এমন জায়গায় লেখা তো সহজ কথা না, এর জন্য মুর্শিদ-পদে মজে একাঙ্গ হতে হয়, তা নাহলে ফল ফলবে না এবং লেখাও সম্ভব হবে না।
একই পয়ারে আছে ত্রিপুণীতে মুখ রেখে কানাইয়ের দই খাওয়ার প্রসঙ্গ, যা ‘গান পুতের বধূ’তেও পাচ্ছি। শ্বশুর সেজে পুত্রবধূকে লক্ষ্য করে লেখা এই গানটির কথা ও সুর বড়ই মর্মভেদী:     

সিনান করিয়া বুলে 
তোমার বসন পিন্দে গো বধূ তোমার বসন পিন্দে।
তোমার বসন পিন্দিয়া বধূ গো ও বধূ নাচে শ্যামচান্দে গো॥

দেখছনি গো দধি খাইতে 
মুখ রাখে কই গো বধূ মুখ রাখে কই।
কিবা সুখে উল্টা মুখে গো বধূ খায় ভাণ্ডের দই গো॥

পয়ারে বর্ণিত প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গের বাইরে অন্যান্য রূপক-প্রতীকে এমন কিছু গান রয়েছে ভেদ জহুর-এ, যা ফকিরি তত্ত্বের মূল বক্তব্যকে নিখুঁতভাবে প্রকাশ করেছে। আগের গানে ছিল পুত্রবধূর উদ্দেশে শ্বশুরের ভাষ্য, এখন অন্য একটি গানে গাইলে-ছিয়ায় ধান-বারার প্রতীকে লিখিত শাশুড়ির ভাষ্যটিও পড়ে দেখতে পারি:    

কেউ ঝারে কেউ পুছে কেউ করে জুলারে ভাই কেও করে জুলা। 
ঘরের মাঝে গণ্ডগোলরে ও ভাই উন্দুরায় কাটে ঝুলা রে॥

শাশুড়িয়ে বলে বধূ, চাউল থইছ কই গো বধূ চাউল থইছ কই। 
আন চাউল কিনিয়া রাখি গোয়ালে আনছে দই রে॥

কৈন মজিরে মণিপুরে চাউলের আছে গোলারে ভাই চাউলের আছে গোলা। 
গোলার চাউল উন্দুরায় খাইল রে ও ভাই লাভে মূলে গেলা রে॥

এই গোলার চাল যাতে ইঁদুরে না খেতে পারে এবং মূল/পুঁজি অক্ষুণ্ন রেখে কীভাবে এবং কী উপায়ে ফল লাভ করা যায়, সেই জন্যই লিখিত হয়েছে এই গান। এই বারা ভানার বিষয়টি ব্যবহার করে ফকির ইয়াছিন শাহও একটি দেহতত্ত্বের গান লিখেছিলেন, যেখানে ছিল বারা ভানার সঙ্গে তনের জিকির আর আন্দোলনের প্রসঙ্গ, কিন্তু এখানে রয়েছে সাধন-দৈন্যের এমনই এক বার্তা, যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই মূলত লিখিত হয়েছে ভেদ জহুর। 
এই তত্ত্বগ্রন্থ পড়ে সংশ্লিষ্ট ভক্তজন যে ফায়দা পাবেন তা তো জানা কথা, তত্ত্ব-অনাগ্রহী পাঠকেরও এখান থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করবার আছে। বিশেষত ভেদ জহুর-এর শব্দভাণ্ডার, রচয়িতার অন্তরঙ্গ রচনাভঙ্গি এবং স্থানিক প্রতীক-রূপকের যে সার্থক ব্যবহার, তা একালের কবি-কুশলীদেরও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হতে পারে।