কবিতার পাঠক ক্রমশ কমছে কেন?
শুরুতে শ্রোতাই ছিল কবিতার। পাঠক এসেছে পরে। যদিও, পৃথিবীর প্রথম কবি [এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ও স্বীকৃত] এনহেদুয়ান্নার কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে লেখা প্রার্থনা-শ্লোকগুলো পাথরে খোদিত হয়। দেবী ইনানার স্তাবকে সমৃদ্ধ এনহেদুয়ান্নার কবিতাগুলোই প্রার্থনা সভা-সঙ্গীতের ভিত্তি নির্মাণ করে ব’লে উল্লেখিত [এনহদেুয়ান্না/পৃথিবীর প্রথম কবি কাজী জহিরুল ইসলাম; অন্য আলো; প্রথম আলো: ১৭ নভেম্বর ২০১৭]। পুরা-প্রস্তর যুগে পৃথিবীব্যাপী মানুষের ইতিহাস শুরু হলেও নব্য-প্রস্তর যুগে কৃষিবিপ্লবের সূচনা ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০-৫০০০ অব্দে। কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শস্য উৎপাদন-ব্যবস্থার বিকাশের ফলে শ্রমবিভাগ ত্বরান্বিত হয়। এবং, এই শ্রমবিভাগের হাত ধরেই ভেঙে দেওয়া হয় আদিম সাম্যবাদী সমাজ। সুবিধাভোগী উচ্চ শ্রেণির উন্মেষের ফলে গড়ে ওঠে শহর। ফলে সামাজিক জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লিখন ও হিসাবপদ্ধতির ব্যবহারও জরুরি হয়ে পড়ে। এর সমান্তরালে হ্রদ ও নদীতীরবর্তী অঞ্চলসমূহে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের মধ্যে গড়ে ওঠে অনেক শহর। তেমনই, দুই নদী, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিসের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা সভ্যতা মেসোপটেমিয়ায় কবিতা লিখতে শুরু করেন এই নারী, এনহেদুয়ান্না। তাঁর কাব্যকলার শ্রোতৃমণ্ডলী সেই রাজসভাষদবৃন্দ। আক্কাদের সম্রাট সারগনের কন্যা প্রাগুক্ত বন্দনাগীতি রচনার সুবাদে পুরোহিতের দায়িত্বই পালন করেন।
ওপরের অনুচ্ছেদে কিংবা বক্ষ্যমাণ গদ্যের শুরুতেই পৃথিবীর প্রথম কবির প্রসঙ্গ কেন? তা এই পর্যবেক্ষণের জন্যই যে, কবিতা শুরুই হয় ধর্মের আধারে এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার দরুন থাকে জনবিচ্ছিন্ন। তাহলে কবিতার পাঠক ক্রমশ কমে যাওয়ায় আমাদের, মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাঠকদের, কিছুটা দুঃখভারাক্রান্ত কৌতূহল কেন? কবিতা কি তাহলে কখনো জনগণসংলগ্ন ছিলো মেসোপটেমিয়া-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা এই বাংলায়? খানিক দৃকপাত করা যায়। বাংলা লোকসাহিত্যের উৎপত্তির ইতিহাস ঠিক জানা না গেলেও এ অনস্বীকার্য যে, আমাদের লোককবিতা মুখে মুখেই উচ্চারিত-পঠিত, বিশ্রুত এবং প্রজন্ম-পরম্পরায় পরিবাহিত হয়। এতেও ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভক্তি পরিদৃষ্ট হলেও এবং প্রত্যক্ষ বিপ্লবের ধারণা প্রায় অনুপস্থিত থাকলেও কর্ম ও পরিশ্রম, নরনারীর প্রেম-কাম-বিরহ এবং ব্যঙ্গ ও কৌতুকসুলভ বিধায় তা জনগণসংলগ্নই। এই লোককবিতায় স্থিতাবস্থা অনূদিত হলেও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ দুর্নিরীক্ষও নয়। এই লোকসাহিত্যের থাকে সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের ক্ষমতাও। সেই ৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পর্যায়ক্রমে মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজবংশ, মুসলিম শাসন এবং এদেরও পরে যথাক্রমে পর্তুগিজ, ফরাসি ও ব্রিটিশদের সংস্কৃতিরও প্রভাবে ভারতবর্ষ তথা এই বাংলারও সংস্কৃতির ভিত রচিত হয়। আর মধ্যপ্রাচ্যে?
প্রাক-ইসলামি যুগে লিখনপ্রণালি তেমন উন্নত না থাকায় আরবরা তাদের রচনার বিষয়বস্তু মুখস্থ করে রাখত। তাদের স্মরণশক্তি ছিল খুবই প্রখর। তারা মুখে মুখে কবিতা পাঠ করে শোনাত প্রতিবেশী কিংবা স্বজনদের। কবিতার মাধ্যমেই তাদের সাহিত্য-প্রতিভা প্রকাশিত হতো। ফিলিপ কে হিট্টি তাঁর আরব জাতির ইতিকথা [অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ অনূদিত] বইয়ে জানান, তাদের কাব্যপ্রীতি বিষয়ে ইয়োরোপেও প্রবাদ প্রচলিত ছিল: আরবদের ত্বকের নিচে রক্ত নয়, কবিতাই বহমান। অন্য ইতিহাসবিদদেরও কেউ কেউ স্বীকার করেন যে, ওই যুগে কবিতা কিছুসংখ্যক সংস্কৃতিমান লোকের বিলাসিতার বস্তু ছিল না; বরং এটা ছিল তাদের সাহিত্যানুরাগ প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। এ কারণে লোকগাথা, প্রবাদ, জনশ্রুতি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করেই পরবর্তীকালে আরব জাতির ইতিহাস লিখিত হয়। হিট্টির সুবাদে জানা যায়, কাব্যপ্রেমই ছিল বেদুঈনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ। ওই যুগে আরবদের মধ্যে যে সাহিত্যচর্চা প্রচলিত ছিল উকাজের মেলাই এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। প্রতিবছর ওই মেলায় কবিতা পাঠের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। কথিত আছে, উকাজের মেলায় পুরস্কৃত সাতটি কবিতা সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হতো কাবাগৃহের দেয়ালে। ওই ঝুলন্ত সাতটি গীতিকবিতাকে আরবিতে সাবউ মু’আল্লাকাত বলা হয়। আরবি ভাষাভাষী বিশ্বে কবিতাগ্রন্থ হিসেবে সাবউ মু’আল্লাকাত বিশেষ সম্মানের বস্তু হলেও আব্বাসীয় শাসনামল শেষ হবার পরের ইতিহাস সচেতন পাঠকদের অজানা নেই। অন্ধকার কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে গেল শতকের পঞ্চাশের দশকে তৈলসম্পদ আবিষ্কার এবং গত সাত দশকের উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে, অসচেতন কারোরও আজ অজানা নেই যে, এখন আরবদের ত্বকের নিচে রক্ত নয়, তেলই প্রবহমান।
১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কবিতা পড়তেন ১৭% নাগরিক। ২০ বছর পরে এই হার নেমে আসে ৬.৭%-এ। বলা হয়, কবিতা জাজ সঙ্গীত এবং নৃত্যের চেয়েও কম জনপ্রিয়। ইন্টারনেটে কবিদের আত্মপ্রকাশও পাঠককে কবিতার দিকে ফিরিয়ে আনছে না
ইউরোপে ও যুক্তরাষ্ট্রে কবিতার জনবিচ্ছিন্নতার সাম্প্রতিক চিত্রের সঙ্গে কিছুটা হলেও পরিচিত হবার আগে আমাদের লোককবিতা এবং আধুনিক কবিতার শ্রেণিচারিত্রিক পার্থক্যের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা যায়। লোককবিতার উৎপত্তি গ্রাম-বাংলায় তথা কৃষি-সভ্যতায়। আর, বলা বাহুল্য, আধুনিক কবিতার জন্ম শহরে, মধ্যবিত্তের হাতে। এই দুই কবিতাচর্চার মাঝখানে [লোককবিতার সমান্তরালে], আমাদের ভূখণ্ডে, কবিতা রচিত ও বিশ্রুত হয় রাজদরবারে। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চার প্রসঙ্গটি আমরা ভুলে যাইনি নিশ্চয়। বলতে হয়, এভাবে বাংলা কবিতাও, রচনাস্থলের দিক থেকে, সার্বিকভাবে দেখলে, জনবিচ্ছিন্ন হয় দুইবার। যদিও, দরবারি সাহিত্যও লাভ করে একপ্রকার জনপ্রিয়তা। গ্রাম পর্যায়ে, মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে, অনুলিখিত হয় আলাওল, বদিউজ্জামাল প্রমুখের রচনা তথা পুঁথি। এসব রচনায়, লক্ষণীয়, ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুবর্তনের চেয়ে সামাজিক অনুষঙ্গসহ নরনারীর প্রেম-বিরহ তথা মানুষের ঐহিকতাই একটু বেশি গুরুত্ব লাভ করে। আরেকদিকে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলি, মৈমনসিংহ গীতিকার জনসংযোগের ইতিহাসও স্মরণীয়। তবে এ অনস্বীকার্য, বিষম সমাজে বাংলা কবিতার শ্রেণিচারিত্র্য বা ধরনও ভিন্ন ভিন্ন। এই ধারাগুলোর বহমানতা সমান্তরাল।
দ্য কলেজভিউ [২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮]-তে ইমার হ্যান্ডলি ও শনা বোয়ার্স ‘ইজ পোয়েট্রি আ ডায়িং আর্ট?’ শীর্ষক সমীক্ষায় সাম্প্রতিকতম একাধিক যোগাযোগমাধ্যমে কবিতা প্রকাশের প্রসঙ্গ টেনে কাব্যপ্রেমীদের আশ্বস্ত করতে চান কবিতা মুমূর্ষু শিল্প নয় ব’লে, এভাবে: ‘The emergence of Instagram poets is proof that things are changing, they’re not dying off. Rudy Francisco was originally a spoken word poet who created thought-provoking poems. The American man attracted recognition and praise when he began posting his work on Instagram. The creation of this platform was like a megaphone so that he could amplify his poetry. He reached a wider audience due to this evolution while the integrity of traditional poetry remained intact.’ সিলভিয়া প্লাথের অনেক স্তবকসংবলিত কবিতার প্রসঙ্গ টেনে হ্যান্ডলি ও বোয়ার্স একবিংশ শতাব্দীতে কবিতার আকৃতি হ্রাসের সংবাদ দেন। যুক্তরাষ্ট্রে এখন আট থেকে দশ লাইনের কবিতাই প্রায়ই রচিত হচ্ছে। কিন্তু, তাঁরা জানান, গ্রন্থাগারে এবং ব্যক্তিগত বইয়ের তাকে কবিতার বইয়ের ঠাঁই আর হয় না। তবে তাঁরা দৃঢ় চিত্তে বলেন: ‘As an art form, poetry puts us back in touch with our humanity. It can help you see yourself in someone else’s struggle and thus you begin to understand and appreciate their strength more.’ আর্ট ফরম হিসেবে কবিতা আমাদেরকে মানবতার [হিউম্যানিটি] সংস্পর্শে নিয়ে যায়। ফলে আমরা প্রত্যেকে অন্যের বাঁচার সংগ্রামের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই এবং তাদের শক্তি বুঝতে ও প্রশংসা করতে শুরু করি। সময়ের স্রোতে এই মানবতাও ইতিবাচকভাবে পরিবর্তনশীল।
নিক নুসেন দ্য বুচটেলাইটে [৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩] প্রকাশিত ‘হোয়াই নোবডি লাইকস পোয়েট্রি’ শিরোনামের গদ্যের শুরুতে বলেন, ‘ভাবা হয় কবিতা এখন মৃত এবং কবিরা পৃথিবীতে শীতল।’ কিন্তু পরের বাক্যেই তিনি এই মৃত্যুর ধারণা অস্বীকার করেন এবং জানান, সর্বকালের চেয়ে বর্তমানেই কবির সংখ্যা অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত ৫ মিলিয়ন [৫০ লাখ] নিয়মিত কবিতাপত্রে [পোয়েট্রি ম্যাগাজিন] তাঁরা লিখছেন। কিন্তু সমস্যা এই, প্রত্যেক কবিতাপত্রের পাঠক, বরাবর হিসেবে, মাত্র ১২ জন। নুসেন বলেন, প্রায় কারোরই কবিতা না পড়ার কারণ টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট। এই দুই মাধ্যমকে তিনি ‘কালপ্রিট’ অভিহিত করেন। সেই সঙ্গে অংশত দায়ী করেন মোস্টমডার্ন এবং পোস্টমডার্ন কবিদের। কেননা তাঁদের কবিতায় রাইম ও রিদম না থাকায় পাঠক পড়তে এক বিন্দু আগ্রহও বোধ করেন না। কবিতায় মুক্তছন্দের হুইটম্যানীয় ঐশ্বরিক স্বতঃস্ফূর্ততা আর নেই। ওদিকে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ এবং টেনিসন রক স্টারের সেলিব্রিটিদের টানেন। কিন্তু গড়ে কোনো ব্যক্তিই জীবন-বাঁচানো একটা লাইনের রিদমও [কাব্যচরণের ছন্দ] আর শুনতে পান না। নুসেন ছন্দহীনতার সাথে কবিতার দুর্বোধ্যতার কথাও উল্লেখ করেন।
২০১৬ সালের অক্টোবরে দ্য আটলান্টিক.কম-এ অ্যাডাম কিরশ্ হোয়াই [সাম] পিপল হেইট পোয়েট্রি শীর্ষক এক গদ্যে বেন লের্নারের দ্য হ্যাট্রিড অব পোয়েট্রি [The Hatred of Poetry; BEN LERNER, FSG ORIGINALS; The Hatred of Poetry Paperback – June 7, 2016] বইয়ের আলোচনা করেন। বইটিতে অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে প্রধান ইংরেজ ও মার্কিন কবিদের অনেকেই আলোচিত হন। কিছু কবিতাবিদ্বেষী লোকের মনস্তত্ত্ব পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই গদ্যে কবিতার এই ব্যতিক্রমী সংজ্ঞাও উল্লেখিত হয়: ‘Poetry is the site and source of disappointed hope.’ কবিতাকে ক্ষুণ্ন আশার স্থান ও উৎস বলা হলেও এই আশা শুধু ব্যক্তিক ও আধ্যাত্মিক নয়, তা সামষ্টিক ও রাজনৈতিক। কবিতা তাই, লের্নারের কাছে, মানবসমাজের সার্বিক মুক্তির সম্ভাবনার সাথে সম্পর্কিত, কার্ল মার্কস যাকে বলেন ‘বিপ্লব’। লের্নারের এই ভাবনা ওয়ালটার বেনজামিনের চিন্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিরশ্-এর আলোচ্যমান গদ্যের অংশবিশেষ উদ্ধৃত না করলেই নয়: ‘Poetry’ is a word for a kind of value no particular poem can realiæe: the value of persons, the value of a human activity beyond the labor/leisure divide, a value before or beyond price,Ó he writes. Poetry is a figure for the unalienated labor and uncommodified value that Marx thought would exist after the revolution. This is a 21st-century artist’s Marxism, one that no longer hopes for real revolution, but looks to the imagination for anticipations of what a perfected world would look and feel like. মানুষ ও তাদের কাজের মূল্য, যা শ্রম ও অবসরের ভাগেরও ঊর্ধ্বে, যে-মূল্য বাজারদরের আগে অথবা এরও পরে বা একেও ছাপিয়ে যায় কবিতা তার সঙ্গেই সম্পর্কিত এমন একটি ফিগার [অবয়ব বা অস্তিত্ব] যা মানুষের অ-বিচ্ছিন্ন শ্রম এবং অ-পণ্যায়িত মূল্যের জন্যই অস্তিত্ববান। মার্কস ভাবেন, এ-মূল্য বিরাজ করবে বিপ্লবের পরে। এই চিন্তাকে যে একবিংশ শতাব্দীয় শিল্পীর মার্ক্সিজম বলা হলো, এই অগ্রজ্ঞানের কল্পনা ও যথার্থ পৃথিবীর সৌন্দর্য ও অনুভব কি আমাদের কবিতায় পরিদৃষ্ট? অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান বর্তমান গদ্যের উদ্দেশ্য নয়।
প্রাক-ইসলামি যুগে লিখনপ্রণালি তেমন উন্নত না থাকায় আরবরা তাদের রচনার বিষয়বস্তু মুখস্থ করে রাখত। তাদের স্মরণশক্তি ছিল খুবই প্রখর। তারা মুখে মুখে কবিতা পাঠ করে শোনাত প্রতিবেশী কিংবা স্বজনদের। কবিতার মাধ্যমেই তাদের সাহিত্য-প্রতিভা প্রকাশিত হতো। ফিলিপ কে হিট্টি তাঁর আরব জাতির ইতিকথা [অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ অনূদিত] বইয়ে জানান, তাদের কাব্যপ্রীতি বিষয়ে ইয়োরোপেও প্রবাদ প্রচলিত ছিল: আরবদের ত্বকের নিচে রক্ত নয়, কবিতাই বহমান
ওয়াশিংটনপোস্ট.কম-এর ২৪ এপ্রিল ২০১৫ সংখ্যায় ক্রিস্টোফার ইনগ্রাহামের লেখার শিরোনাম ‘Poetry is going extinct, government data show’ [কবিতা বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে, সরকারি উপাত্ত অনুসারে] আরও শঙ্কা জাগায়। ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কবিতা পড়তেন ১৭% নাগরিক। ২০ বছর পরে এই হার নেমে আসে ৬.৭%-এ। বলা হয়, কবিতা জাজ সঙ্গীত এবং নৃত্যের চেয়েও কম জনপ্রিয়। ইন্টারনেটে কবিদের আত্মপ্রকাশও পাঠককে কবিতার দিকে ফিরিয়ে আনছে না। তাহলে বাংলাদেশে কবিদের অবস্থা কেমন?
বাংলামাটিতে [তারিখ অনুল্লেখিত] মারুফ রায়হানের কবিতা কি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে! শীর্ষক দীর্ঘ সমীক্ষায় কবি নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, ফরিদ কবির, কয়েকজন তরুণ কবি, আবৃত্তিকার ও পাঠকের অভিমত পাওয়া যায়। গুণ কবিতার জনপ্রিয়তা হারানোর বিষয়টি কিছুতেই মেনে নেন না, তিনি নিজেই পাঠকনন্দিত কবি বলেই হয়ত। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সংসারী, এমন সব পাঠকের, চিত্ত জয়ের এমন একটি সামান্য [ইংরেজি কমন অর্থে] ভাষা তিনি আবিষ্কারে সক্ষম হন যে তাঁর নির্বাচিতার আটটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তিনি আমাদের কবিতার মহিমান্বিত ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। ভাষা আন্দোলন, গণ-আন্দোলন এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কবিতা পুরো জাতিকে কীভাবে উদ্দীপিত করে তা স্মরণ করেন। রফিক কবিতার পাঠক হ্রাসের বিষয়টা সম্পূর্ণ মেনে না নিয়ে পাঠকেরও কাব্যপাঠের যোগ্য না হয়ে ওঠাজনিত সমস্যাগুলো শনাক্ত করেন। ফরিদের অভিমতে প্রতিফলিত হয় সত্যিকার পরিস্থিতি। তিনি বলেন: ‘কবিতার পাঠক অনেক কমেছে। আশির দশকেও একটি কবিতার বই ছাপা হতো ১২৫০ কপি। এখনকার বইগুলো ৩০০ কপি করে! গত চল্লিশ বছরে দেশে লোকসংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু বইয়ের বিক্রি কমে গেছে! আগামীতে কারও কারও বই হয়তো ১০০ কপি ছাপানো হবে। দু-দুজন প্রকাশক আমাকে বলেছেন, কোনো কোনো কবির বই পুরো মেলায় ২০ কপিও চলেনি! আমি নিজে বইমেলায় লক্ষ করে দেখেছি, যাঁরা কবিতা লেখেন, তাঁদের বেশির ভাগই বইমেলায় প্রতিদিন গেছেন কিন্তু ফেরার সময় তাঁদের অনেকের হাতেই আমি বইয়ের কোনো প্যাকেট দেখিনি! অনেকে ফেসবুকেই কবিতা পড়ে ফেলেন, তাঁদের হয়তো মনে হয়, বই কেনার আর দরকার কী? অনলাইনে কবিতার পাঠক দিয়ে কেউ যদি ভাবে, পাঠক বেড়েছে, তবে সেটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল! নিবিষ্ট মনে একটা আস্ত কবিতার বই পড়া আর, অনলাইনে দুটো-চারটা কবিতা পড়ে একজন কবিকে বুঝতে পারার মধ্যে তফাত আকাশ আর পাতালের। অনলাইনে একজন কবির ৫-২০টা কবিতা পড়েই অনেকে ভাবছেন, তাঁর কবিতা পড়া হয়ে গেছে! আর কিছু পড়ার দরকার নাই! যাঁরা এমন স্বভাবের, তাঁদেরকে তো আমি পাঠক বলতে পারব না।’
বাংলাদেশে আসলে এখন পরিস্থিতি এমন যে ৩৬/৩৭ বছর ধরে লিখছেন এমন কবির কাব্যগ্রন্থও ২৫ কপির বেশি বিক্রি হয় না বইমেলায়। এগুলো তা-ও কেনেন সতীর্থ বা পরিচিত কবি-লেখকগণ। কিছুটা হতাশ কবি খোঁজ নেন না মেলার পরে বছরজুড়ে আর কত কপি বিক্রি হয়। প্রকাশকও চুপ মেরে যান। আরেকটা ঘটনা প্রচলে পরিণত হয়েছে, কবি-লেখকদের টাকায় বই প্রকাশ। এতে একটি রীতিও লক্ষণীয়, গ্রন্থকারকে প্রকাশকের কাছ থেকে নিজের বইয়ের ৫০ থেকে ১৫০ বা ২০০ কপি পর্যন্ত কিনে নিতে হয়। পেশায় পাবলিক ইউনিভার্সিটির সম্মানিত অধ্যাপক এমন সিরিয়াস কবি-লেখককেও, অন্তত কবিতার বইয়ের ক্ষেত্রে, অনেক সময় মানতে হয় এমন প্রচল বা রীতি। ফলে কবিদের কেউ কেউ আগামীতে ১০০ নয়, ৫০ কপি বই ছাপানোর কথাও ভাবছেন। আমাদের সাহিত্যের আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা এখানে উল্লেখ্য, কবিদের মধ্যে যে দু-একজন কবিতা বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধের বই প্রকাশের মাধ্যমে কাব্য-সমালোচক হিসেবে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তাঁদের কবিতা কেন যেন কম মূল্যায়িত হয়। এ ক্ষেত্রে বইমেলা এবং মেলার বাইরের আড্ডায় কবি যশোপ্রার্থীদের কারোর [এবং কোনো কোনো কবিরও] এ-সংক্রান্ত অপপ্রচার নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। খোদ কবিকেই বলা হয়: ‘আপনার কবিতা ভালো, তবে, প্রবন্ধ অসাধারণ!’ প্রসঙ্গত বুদ্ধদেব বসু এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিভাগ্য সামনে চলে আসে। মান্নান সৈয়দের জনবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি উল্লেখিত ধরনের অপপ্রচারও কবি হিসেবে তাঁকে অনেকটা গৌণ করে তোলে। তাঁর জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছর মতো আশ্চর্য সংবেদী কাব্যগ্রন্থকে চাপা দেওয়া হয় তাঁরই তুমুল সাড়া-জাগানো কাব্য-সমালোচনাসাহিত্যের বইগুলোর নিচে।
উপর্যুক্ত এত সব হতাশার আসল হেতু কী? নির্মলেন্দু গুণের আরেকটি বক্তব্য এখানে অবশ্য উল্লেখ্য: ‘যাঁরা বলেন কবিতা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, পাঠক কমে যাচ্ছে, তাঁদের সঙ্গে শুধু ভিন্নমতই পোষণ করি না, আমি এ ধারণার বিরোধিতা করছি। যাঁরা এমন কথা বলেন, তাঁরা কবিতা নিয়ে মিথ্যাচার করছেন। এটা কবিতাবিরোধীদের অপপ্রচার। কবিতার মতো নান্দনিক বিষয় থেকে যদি মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায়, তা হলে অশুভ শক্তির উত্থান ঘটাতে সহজ হয়। কবিতা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে এমন কথা স্বাধীনতাবিরোধীদের চিৎকার।’ [সূত্র: প্রাগুক্ত] কবিতার জনপ্রিয়তা হারানোর করুণ বাস্তবতা তিনি অস্বীকার করলেও এখানে তাঁর শেষ কথাটি প্রণিধানযোগ্য। প্রাগুল্লিখিত রক্তের তেলে পরিবর্তন এবং বিশ্বপুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের তৈলায়নে তৎপর গোষ্ঠীর দুরভিসন্ধি থেকে কবিতাও কীভাবে মুক্ত নয়, তা ভেবে দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
ঐতিহাসিকভাবে কবিতার উৎপত্তিস্থল, প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার দিক থেকেও, জনজীবন থেকে ঢের দূরবর্তী হলেও পৃথিবীর অনেক দেশেরই গ্রামে-গঞ্জে রাইম ও রিদমরূপে, ছড়ায় ও ছন্দে, তরঙ্গিত থেকেছে মূলত কবিতাই। লোককাব্য, লোকগীতির উৎপত্তি কৃষিজীবীদের শ্রম থেকে। আদিম সমাজে চিত্রকলারও উৎপত্তি, আমরা জানি, খাদ্যের প্রয়োজন তথা পরিশ্রম থেকে। ঠিক একইভাবে উদ্ভব ঘটে সঙ্গীতেরও। মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রায় প্রতিটি প্রপঞ্চেরই শ্রেণীকরণ ঘটানো হয় ইতিহাসে। গ্রামের সেই উচ্চ শ্রেণি শহর গড়ে তোলে। আরও পরে ঘটে শিল্পবিপ্লব। শ্রমিক আর শ্রমশোষকের মাঝখানে তৈরি হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শিক্ষিত নাগরিকদের একাংশের হাতে সৃষ্টি হয় আধুনিক কবিতা। আরেক দিকে রোমান্টিসিজম থেকে মিস্টিসিজমে ফেরেন কেউ। এদিকে শার্ল বোদলেয়ারের কবিতায় বাক্সময় হয় পুঁজিবাদের অবক্ষয়। কবিতার বর্তমান দশার তুলনায় এসব ইতিহাস উজ্জ্বলতর বলেই স্মৃতিচারণা। গেল শতাব্দীতে পুঁজিবাদের আওতার ভেতরে গণতন্ত্রের ক্ষেত্র সম্প্রসারণের তত্ত্ব পোস্টমডার্নিজমও আবির্ভূত হয়। পুঁজিবাদী শোষণকে সহনীয় করতে এই তত্ত্ব যতটা না সফল, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করে ধনতন্ত্র নিজেই, অভাবনীয় সব প্রযুক্তিযোগে। রতন খাসনবিশ কথিত মার্কসবাদের কবর রচনাকারী ওই উত্তরাধুনিকতার তত্ত্বসহ, স্থায়িত্বের প্রশ্নে, পাকাপোক্ত হয় পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিও। ফলে বাড়ে মানুষ তো বটেই, মানুষের সৃজনশীল কাজেরও পণ্যায়ন। তাই জয়জয়কার প্রযুক্তির আগ্রাসনে বাতাসেও যেন ভাসে শুধু নানান রঙিন কমোডিটি আর গৌণ হতে হতে ক্রমশ হারায় বুঝি কবিতার মতো ক্রিয়েটিভিটি।
ভিন্নধর্মী লেখা ও বিশ্লেষণ। তথ্যনির্ভরও বটে। আর অনুসিদ্ধান্তে পণ্যায়ন এসে যথার্থ উপসংহার টেনেছে। খুব ভাল লাগলো লেখাটি।
জিললুর রহমান
এপ্রিল ০৩, ২০২২ ০১:৩৩
ভালো লাগলো। তথ্যবহুল ও সুন্দর পর্যবেক্ষণ। ঋদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ কবি।
Shekhar Dev
এপ্রিল ০৩, ২০২২ ০৮:৪৫
Thoughtful and timely!
Zonaid Mohammad
এপ্রিল ০৩, ২০২২ ১০:০৮
খুব ভালো লাগলো। তথ্যবহুল।
রশীদ হারুণ
এপ্রিল ০৩, ২০২২ ১৯:৪৬
খুব ভালো লাগলো। তথ্যবহুল।
রশীদ হারুণ
এপ্রিল ০৩, ২০২২ ১৯:৩২
অনেক তথ্যসমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ লেখা।
মানিক বৈরাগী
এপ্রিল ০২, ২০২২ ১৮:৩০