আশাবাদী সরদারের জ্ঞান-সাধনা

 

সরদার ফজলুল করিম বাংলাদেশের বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, আরো অনেক কিছু। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—তিনি জ্ঞান, প্রজ্ঞা বা দর্শনের অনুরাগী। মহামতি সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘The unexamined life is not worth living.’ অর্থাৎ অপরীক্ষিত জীবন যাপন করার কোনো মূল্য নেই। সক্রেটিস ‘জীবন পরীক্ষায়’ বিশ্বাসী ছিলেন। এ জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘অনুসন্ধান’। আর দর্শনের উদ্দেশ্যও হচ্ছে ‘অনুসন্ধান’; জীবন, প্রকৃতি, সমাজ ও পরিবেশ ইত্যাদিকে অনুসন্ধান করা। সরদার ফজলুল করিমও জীবনভর জগৎ, জীবন, মানুষের সমাজ, তার চেতনা ও জ্ঞানের প্রক্রিয়া প্রভৃতি মৌল বিষয়ের অনুসন্ধান করেছেন, উদ্দেশ্য খুঁজেছেন। তিনি উল্লিখিত বিষয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করে গেছেন এবং সেসব প্রশ্নের যুক্তিনির্ভর ও কাঠামোগত সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর সেরা সব দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের চিন্তারাজি নিয়ে কাজ করেছেন। তবে তিনি নিজে সাম্যবাদী রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই রাজনৈতিক দর্শন বৃহত্তর সমাজে ছড়িয়ে দেবার জন্যও তিনি জীবনভর কাজ করেছেন। 

এখানে বলে রাখা ভালো যে, সরদার ফজলুল করিম বেড়ে উঠেছিলেন এক বিশেষ রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে। সেই সময় স্বাদেশিকতাবাদের চেতনায় এক ধরনের জাতীয়তাবাদ১ বিকশিত হচ্ছিল। সাম্যবাদী আদশের্র সঙ্গে জাতীয়তাবাদী বোধ তখনকার অনেককেই আলোড়িত করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নামে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। ১৯৪৭-১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলে ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসনের নামে নিপীড়ন, নির্যাতন। এতে দুই প্রদেশের মধ্যে তৈরি হয় পাহাড়সম বৈষম্য। এর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণ প্রতিবাদ ও আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলে। জাতীয়তাবাদী চেতনায় তা ক্রমেই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। 

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর দেখা গেল, রাষ্ট্রগুলো সকল মানুষের অধিকার ও বৈষম্য নিরসনে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। রাষ্ট্রের কাঠামোতে বসবাসরত সকল জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষদের স্বীকৃতি, বৃহৎ ঐক্য এবং সকলের মুক্তির এজেন্ডা হাজির করা; শ্রেণি ও লিঙ্গীয় বৈষম্য—নিপীড়নবিরোধী অবস্থান নিশ্চিত করার দাবিগুলো অস্বীকৃত হচ্ছে। মানুষ ও পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে, সামাজিক মালিকানা গুরুত্ব দিয়ে, শিক্ষা চিকিৎসায় সর্বজনের অধিকার নিশ্চিত করে উন্নয়নের নতুন পথ নকশা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নের লড়াইটা সামনে চলে আসছে। সেই বাস্তবতায় সরদার ফজলুল করিমও সমাজতন্ত্রকে জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন৷

সরদার ফজলুল করিম আসলে একটা সময়ের সন্তান। যে সময়টাতে দেশপ্রেম, ভাবনার জগৎ, স্বপ্ন, জীবনযাপন, সামাজিক বিকাশ—সবকিছুর বদল হচ্ছিল। একটা ভিন্ন স্তরে প্রবেশ করছিল সময়টা। একটা পরিবর্তনের ঢেউ এসে লেগেছিল সর্বত্র। সবকিছু বদলে দেবার একটা মোহ কাজ করেছিল সে সময়ে। তাই তো তিনি লিখেছেন, ‘দিনগুলো খুব আরামের ছিল না, কিন্তু স্বপ্নের ছিল, রোমান্টিক স্বপ্নের। বলা চলে অবাস্তব স্বপ্নের। কিন্তু এটা তো সত্য যে, অবাস্তব স্বপ্ন বাদে নিরেট বাস্তব পরিবর্তিত হতে পারে না।’ তরুণ, আদর্শবাদী, কমিউনিস্ট, স্বপ্নচারী সরদার ফজলুল করিম সেই মোহে অবগাহন করেছিলেন এবং তা করেছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। 

কিংবদন্তি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি কিশোর সরদার ফজলুল করিমকে বিপ্লবী হতে অনুপ্রাণিত করে। সরদার ফজলুল করিম ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিয়েছিলেন। বিদেশে উচ্চ শিক্ষার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

আত্মগোপন করে বিপ্লবী রাজনীতি চর্চা করার সংকল্প করেন। গোপন সভা থেকে ধরা পড়েন। কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। প্রথম দফায় আট বছর। জ্ঞানচর্চা অব্যাহত থাকে তাঁর কারাগারে গিয়েও। কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হিসেবে। এই পর্যায়ে রাজনীতিতে তিনি যে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়েছিলেন তা নয়। তাঁর নিজের উপলব্ধি, সক্রিয় রাজনীতির জন্য তিনি আসলে তেমন ‘যোগ্য’ নন। শেষ পর্যন্ত তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসেছেন। 

এ ক্ষেত্রে তাঁর বড় ভাইয়ের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁর হাত ধরেই সরদার ফজলুল করিমের পরিবারে শিক্ষার সূচনা হয়। সরদার ফজলুল করিম ৩০ মার্চ ১৯৫০ সনে ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আমার বড়ভাই এসেছিলেন সেদিন দেখা করতে। আমার মনের উপর অদ্ভুত একটা ছাপ রেখে তিনি চলে গেলেন। সমস্ত সাক্ষাৎটাই একটা রাজনৈতিক তর্কবিতর্কের যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নিয়ে অসমাপ্তভাবে শেষ হলো। বড়ভাই আমাকে রাজনীতির পথ থেকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিলেন। আর পাকিস্তানের আদর্শের ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘স্নেহের ভাইটি আমার, তুই ফিরে আয়।’ বড় অকৃত্রিম আর করুণ লাগলো আমার বড় ভাইয়ের সেই আবেদনকে। আরো করুণ লাগলো তখন যখন জবাবে আমার নিঃশব্দ নীরবতায় রেগে গিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমার নীরব অবজ্ঞাই আমার জীবনের চরম শাস্তি।’

বড়ভাইয়ের এই কথাটি ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ সরদার ফজলুল করিমের মনে গভীর রেখাপাত করে। তারপর থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসেন। দ্বিতীয় জেল জীবনের সময় আন্ডারটেকিং দিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন। এরপর আর কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন না। আন্ডারটেকিং দিয়েছিলেন পারিবারিক চাপে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্যে। কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করতে হয়েছিল বলেই হয়ত তিনি নিজে কমিউনিস্ট হিসেবে বেঁচে থাকার সাধনা করেছেন। কারণ কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী সেই হতে পারে, যে মানুষ হয়ে ওঠে বা মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় থাকে। সরদার ফজলুল করিম আমৃত্যু মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। এই সাধনা তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে, বিশ্লেষণের মাধ্যমে করে গেছেন।

সরদার ফজলুল করিম। ছবি © ঢাকা অপেরা

দুই

সরদার ফজলুল করিমের দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ধারা লক্ষ করা যায়। সক্রেটিস ও রুশো দ্বারা সরদার ফজলুল করিম সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। এছাড়া অগ্রজ শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। ক্ষেত্রবিশেষে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা মতবাদ দ্বারাও তিনি প্রভাবিত। এসকল মনীষীদের মতবাদের মিথস্ক্রিয়ায় সরদার ফজলুল করিমের রাজনৈতিক দর্শনে এক ধরনের ‘সমন্বয়বাদ’ লক্ষ করা যায়। 

আগেই বলেছি, সরদার ফজলুল করিম একক কোনো ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হননি। এটি বোঝা যায় তাঁর কাজের গতিপ্রকৃতি দেখলে। চিরায়ত গ্রিক দর্শনের প্রতি তাঁর ছিল ঐকান্তিক আগ্রহ। সে আগ্রহ থেকেই তিনি একের পর এক অনুবাদ করেছেন– প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স। আবার শুধুই যে গ্রিক দর্শনের চর্চায়ই তিনি মগ্ন থেকেছেন এমনও নয়। সে কারণেই দেখতে পাই, তিনি রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট, আর তাঁর কনফেশান্সের বাংলা অনুবাদ যেমন করেছেন, সেসবের পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন এঙ্গেলসের এন্টি-ডুরিং। রাজনৈতিক-দার্শনিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তিনি মার্কসবাদী, কিন্তু হেগেল-চর্চায়ও সরদার ফজলুল করিম বিমুখ ছিলেন না। এই বহুমাত্রিক চর্চা সম্পর্কেতাঁর ভাষ্যটি এমন, "আমি মনে করি যে প্লেটো এবং মার্কসের মধ্যে কোন কন্ট্রাডিকশান নাই। একটা সাধারণ কন্ট্রাডিকশান আছে। তা হলো প্লেটো হচ্ছেন আইডিয়ালিস্ট আর মার্কস হচ্ছেন রিয়ালিষ্ট। কিন্তু গভীরে ঢুকলে উভয়ের সাদৃশ্যই পরিস্ফুট হয়। মার্কস প্লেটোকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় আইডিয়ালিষ্ট মনে করতেন।" তিনি মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরাকেও এক সারিতে রেখেছেন। এটিকে আমরা বলতে পারি সরদার ফজলুল করিমের দৃষ্টিভঙ্গির অগ্রসরমানতা।

সেইসঙ্গে তিনি এও মনে করেন যে, ‘প্লেটো এবং মার্কসকে সরাসরি বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করানো ঠিক না।’ মার্কস সম্পর্কে তিনি মনে করেন, ‘মার্কসের মহত্ত্ব হচ্ছে এই যে সে এক ঝটকায় কোনো কিছুর অনস্তিত্ব বা অকার্যকারিতা ঘোষণা করে নাই। সে সবকিছুকে দ্বান্দ্বিকভাবে বিশ্লেষণ করেছে।’ এই দর্শন সরদারের কাছে শুধু রাজনৈতিক দর্শন হয়ে ওঠেনি এটি তাঁর জীবন-ভাবনাই হয়ে উঠেছিল। যে-কারণে ফলাকাঙ্ক্ষাহীন জ্ঞানচর্চা কিংবা যাকে বলা যায়, নিছক জ্ঞানের জন্যেই জ্ঞানচর্চা, জ্ঞানের সন্ধান করা–এসব কখনই সরদারের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর চেষ্টা হচ্ছে সব মানুষকে নিয়ে জীবনের সার্থকতার সন্ধান করা। সরদার ফজলুল করিমের রাজনৈতিক দর্শন ছিল—’বিনয়, আত্মানুসন্ধান, আত্মজিজ্ঞাসা, সংকট থেকে ক্রমাগত ব্যক্তির উত্তরণের চেষ্টার মধ্যদিয়ে সামষ্টিক উৎকর্ষ অর্জন।’ 

সরদার ফজলুল করিমের প্রায় সব কথায়ই একটি গভীর দার্শনিক উপাদান থাকত। তিনি বলতেন, ‘দর্শনের কাজ হলো প্রথমে দেখা। তারপরে প্রশ্ন করা। প্রশ্ন করার মধ্যদিয়ে সেই দেখাকে আরো স্পষ্ট ও গভীর করা।’ তিনি বলতেন, ‘বুঝতে হলে প্রশ্ন করা শিখতে হবে। জিজ্ঞাসা ছাড়া চিন্তার জগতে বদল ঘটানো যায় না। শুধু চিন্তায় বদলই নয়, সমাজ বদলও ঘটানো যায় না। তুমি যদি না জান, না বোঝ, না শোন, না শেখো—তাহলে রাজনীতি করবে কিভাবে? জানতে হলে, শিখতে হলে প্রশ্ন করতে হবে।’ আলাপচারিতার সময় সরদার ফজলুল করিম ক্রমাগত নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতেন। অন্যদেরকে প্রশ্ন করতে প্ররোচিত করতেন। নিজেই আবার সেসব প্রশ্নের জবাব দিতেন। জবাব দিতে দিতে নতুন প্রশ্ন হাজির করতেন। অনেকটা গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের কায়দায়।

চিন্তার ক্ষেত্রে সরদার ফজলুল করিমের অগ্রসরমানতা যেমন আমরা দেখতে পেয়েছি, তেমনি নীতির প্রশ্নেও তিনি ছিলেন নিজের আদর্শের প্রতি সমর্পিত একজন ব্যক্তি। ‘নিজের দেশ ছেড়ে যেতে আগ্রহী নই’– এ কারণ দেখিয়ে সরদার ফজলুল করিম সেই চল্লিশের দশকে স্কলারশিপ পেয়েও বিলেত যাওয়ার কাগজপত্র নিজের হাতে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। আবার ১৯৪৯-৫০ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক রাজবন্দিদের সঙ্গে দাবি আদায়ের জন্যে একটানা প্রায় ৩০ দিন তিনি অনশন করেছিলেন। কীভাবে এটি তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়েছিল? সে ঘটনার কথা জানাতে গিয়ে অসীম বিনয়ের সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘এ কারণে নয় যে, আমি বিপ্লবী বা সাহসী ছিলাম। আমার সামনে ছিল অপর সাথীদের দৃষ্টান্ত।’ বিনয়ী বলেই এমনতর কথা বলতে পারেন, ‘আমি হলাম মোস্ট নন-অ্যামবিশাস পারসন।… ছোটবেলায় বড় ভাই একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, বড় হয়ে তুই কী হবি? আমি কুলি হতে চেয়েছিলাম। আমার স্মৃতিতে ছিল বরিশাল লঞ্চঘাট। সেখানে কুলিরা কী সুন্দর কাজ করছে। অন্যের মাল তুলছে। এসব তখন আমার কাছে সাংঘাতিক ব্যাপার।’

যৌথতার বোধই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, গণ-গবেষণা তত্ত্বে যা আমরা দেখে থাকি। যেখানে মনে করা হয় যারা সমস্যায় আক্রান্ত তারাই পথ খুঁজবে সমস্যার পথ পরিক্রমায়। আর সেই পথ খোঁজা এককভাবে নয় যৌথভাবে। সমস্যা প্রকট হলে তার মানসিক সহায়তায়, উজ্জীবিতকরণে অন্যের এগিয়ে আসা কাম্য, কিন্তু নির্ভরশীলতা তৈরি করা না। এই যৌথতার কথা, সম্মিলিত শক্তির প্রচেষ্টায় সমস্যা দূরীভূত করার কথা তিনি নিজের অভিজ্ঞতায় বর্ণনা করেছেন। ১৯৪৪ সালে রচিত তাঁর ‘১৩৫০’ নামক প্রবন্ধে তরুণ সরদার ফজলুল করিমের মানসিকতা, তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাঁর ব্যাখ্যা আমাদেরকে আকৃষ্ট করে। ‘বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণ বিভিন্ন সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে ভবিষ্যত সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে পারে যদি আমরা বোধোদয়ের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে পারি।’

সরদার ফজলুল করিম একক কোনো ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হননি। এটি বোঝা যায় তাঁর কাজের গতিপ্রকৃতি দেখলে। চিরায়ত গ্রিক দর্শনের প্রতি তাঁর ছিল ঐকান্তিক আগ্রহ। সে আগ্রহ থেকেই তিনি একের পর এক অনুবাদ করেছেন– প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স। আবার শুধুই যে গ্রিক দর্শনের চর্চায়ই তিনি মগ্ন থেকেছেন এমনও নয়...

তিন

স্বার্থত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম। ১১ বছরের জেল জীবন, ৫৮ দিনের অনশন, বিলেতের বৃত্তি প্রত্যাখান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চিত শিক্ষকতা ছেড়ে আত্মগোপনের রাজনীতিতে চলে যাওয়া—সরদার ফজলুল করিমের এসকল আত্মত্যাগের ঘটনা তাঁকে অনন্য ব্যক্তিতে পরিণত করেছিল। 

তিনি আসলে আদর্শ ও জীবনকে এক সুতোয় বেঁধেছিলেন। তিনি পরিবার, সমাজ, যার প্রতি যতটুকু কর্তব্য—তা আজীবন পালন করে গেছেন। তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠার কাহিনি এ যুগে সত্যিই বিরল। স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, পুত্রবধূ—যার জন্য যতটুকু করা প্রয়োজন তিনি হাসিমুখে তার সবটুকুই করেছেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়, জ্ঞানের প্রতি দায়, আদর্শের প্রতি দায়, সর্বোপরি সমাজের প্রতি তাঁর দায়—সব দায় পরিশোধের চেষ্টা তিনি আমৃত্যু করে গেছেন। তিনি সমাজকে দিয়েছেন অনেক, বেঁচেছেন সংগ্রাম করে। তাঁর নাটকীয় রাজনৈতিক জীবন, জেলজীবনের অভিজ্ঞতা বৃথা যায়নি। তিনি শিখিয়ে গেছেন আদর্শ দিয়ে, দৃঢ়তা দিয়ে, সততা ও নিষ্ঠা দিয়ে কাজ দিয়ে জীবনকে কীভাবে জয়ী করতে হয়।

আদর্শকে তিনি আদর্শের জায়গাতেই রেখেছিলেন, জীবনের হিসেবের মধ্যে আনেননি। আদর্শকে ইহজাগতিক জীবনের উন্নতির কাজে ব্যবহার করেননি। তিনি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের কারিগর ছিলেন। দর্শনশাস্ত্রের মতো কাঠখোট্টা বইকে সরদার ফজলুল করিম সাবলীলভাবে অনুবাদ করেছেন পাঠকের জন্য। দর্শনের অনুবাদ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় কিংবা ইতিহাস নিয়েও লেখালেখি করেছেন। লিখে রেখে গিয়েছেন অনন্যসাধারণ স্মৃতিচারণ। 

অনুবাদের জন্য তিনি যথেষ্ট শ্রম দিয়েছেন, যাকে ইংরেজিতে ‘লেবার অব লাভ’ বলা চলে। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি বাংলায় ‘দর্শনকোষ’ তৈরি করেছেন, যেটি দর্শনের যেকোনো ছাত্রের কাছে আকর্ষণীয়। জ্ঞানচর্চায় এমন শৃঙ্খলা আজকের শিক্ষকদের ভেতর অনেকটাই অনুপস্থিত। জ্ঞান আহরণ একটি সাধনার ব্যাপার, কেবল পাঠের নয়। বিষয়টি অন্তরে অনুভব করতে হয়। সরদার ফজলুল করিম তাঁর অনুবাদকর্মে তাঁর অনুভূত ও আহরিত জ্ঞানের সঙ্গে নিজের সৃজনশীল জ্ঞানানুভূতিকে সমন্বিত করতে পেরেছেন। এটাই তাঁর অনুবাদকর্মের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক।

তিনি সবসময় শিকড় খুঁজে বের করার কথা বলতেন। সামনে উপস্থিত করানোর কথা বলতেন। যা কিছু বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে তাকে বিস্মৃত না করা, বিস্মৃত না হতে দেয়ার কথা বলতেন। এর একটা প্রাণান্ত প্রচেষ্টা তিনি করে গেছেন। এই বিষয়টি তাঁর আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকার, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা স্মারকগ্রন্থ, রুমির আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে পাওয়া যায়। আবার দর্শনকোষ, প্লেটোর রিপাবলিক বইগুলোর মাধ্যমে দর্শনের ইতিহাসকে তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেন। এসব কাজের পেছনে তাঁর এই বোধটাও ছিল যে, তিনি ইতিহাসকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাই তো বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের মধ্যে বার বার তিনি ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ঐতিহ্য অনুসন্ধানের কথা বলেছেন। ইতিহাস কেবল ব্যক্তির ইতিহাস নয়, প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি লিখেছেন, ‘একটি জীবন্ত জাতি বা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ এবং গতিময় জীবনে পর্যায় থেকে পর্যায়ন্তর সৃষ্টি হয়। একটি স্তর থেকে উন্নততর স্তরে অগ্রসর হওয়ার জন্যই মানুষের আবশ্যক হয় বিগত পর্যায়ের জীবনকে জ্ঞাত হওয়ার। সেকারণেই জীবন্ত জাতিরও ইতিহাস হয় এবং সে ইতিহাস জানার আমরা প্রয়োজন বোধ করি।’

সরদার ফজলুল করিম। ছবি © ঢাকা অপেরা

চার

রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি বলেছেন, ‘সমাজতন্ত্র একটা আদর্শ। আদর্শ কখনও ব্যর্থ হয় না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাময়িক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এর পেছনে অনেক কারণ আছে, অনেক ভুল আছে। তাই বলে কার্ল মার্কসের সমাজতান্ত্রিক যে আদর্শ তা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না।’ ‘সমাজতন্ত্র আবার কবে প্রতিষ্ঠিত হবে? কার্লমার্কসের আদর্শ কবে বাস্তবায়িত হবে? আমি বলব, এই তো মাত্র দশ হাজার কোটি বছর পর। মনে রেখ, মানুষের সভ্যতা একদিনে গড়ে উঠেনি। শত শত হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতার একেকটা পর্ব রচিত হয়েছে। রাতারাতি কোনো আদর্শিক সমাজ তৈরি হয় না। এর জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হয়। অনেক চড়াই—উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে একটা সমাজ তৈরি হয়, বিবর্তিত হয়। এটা এক বছর, দুই বছর কিংবা একশ দুশ বছরের ব্যাপার না। প্রয়োজনে সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজ নির্মাণের জন্য আমাদের হাজার কোটি বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে’।

তিনি বলেছেন, ‘কোনো ব্যবস্থাই চূড়ান্ত নয়। সমাজতন্ত্রও কোনো চূড়ান্ত ব্যবস্থা নয়। হয়তো এর চেয়ে আরও অনেক ভালো ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। তখন আমরা সেই ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করব।’ সরদার ফজলুল করিম আরও বলেছেন, ‘সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এগুলো হয়তো ইউটোপিয়া। তবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা অর্জনের জন্য যে সংগ্রাম এবং আকাঙ্ক্ষা তাই সমাজতন্ত্র। গণতন্ত্রও তাই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বা অর্জনের জন্য যে আকাঙ্ক্ষা বা লড়াই তাই গণতন্ত্র। প্রকৃত গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র হয়তো ডুমুরের ফুল।’ তিনি রাষ্ট্রদর্শনের পর্যালোচনায় সব সময় সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার যৌক্তিকতার পক্ষে কথা বলেছেন এবং লিখেছেন। এর সংকটের কথা বলেছেন। সেই সংকট থেকে বের হওয়ার পথ-পদ্ধতিও বাতলেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তিনি বলেছেন, ‘আর কেউ যদি নাও থাকে, আমি একা হলেও কমিউনিস্টই থাকবো।’ সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছেন, তাদেরকে তিনি বলেছেন, ‘সমাজতন্ত্র একদিন হবেই। লক্ষ বছর লাগতে পারে, কিন্তু সমাজতন্ত্র আসবেই। মানুষ যদি সত্য হয়, তবে সমাজতন্ত্র সে সত্যের অনিবার্য পরিণতি।’

একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘সমাজতন্ত্র নেই কে বললো? সমাজতন্ত্র তো আছেই। প্রতিটি পরিবার চলে সমাজতন্ত্রের নিয়ম অনুসরণ করে। 'ফ্রম ইচ এ্যাকর্ডিং টু হিজ এ্যাবিলিটি—টু ইচ এ্যাকর্ডিং টু হিজ নীডস'—অর্থাৎ 'প্রত্যেকের কাছ থেকে তার সাধ্যানুসারে এবং প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুসারে'। কমিউনিজমের এই বিধানই হলো প্রত্যেক পরিবারের প্রাথমিক সংবিধান।’ সরদার ফজলুল করিমের এই মন্তব্য গভীর বিশ্বাসের ফল। সব পরিবারই হলো এক অর্থে সমাজতন্ত্রের এক-একটি জীবকোষের মতো সংগঠন বা ইউনিট। কার্ল মার্কস যেমন গভীর অন্তর্দৃষ্টি সহযোগে সবচেয়ে আগে 'পণ্যকে' পুঁজিবাদের একক কোষ বা ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করে গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিশ্লেষণ শুরু করেছিলেন, সরদার ফজলুল করিম তেমনই 'পরিবারের' মধ্যে কমিউনিজমের কোষ লুকায়িত রয়েছে বলে বিশ্লেষণ করেছেন। একটু ভাবলেই বোঝা যায়, পরিবারের অভ্যন্তরে তার সদস্যদের 'ব্যক্তিগত মালিকানা' বলে কিছু নেই। একান্ত নিজস্ব ব্যবহারের কিছু জিনিসপত্র বাদ দিলে বাকি সবকিছুই সেখানে পরিবারের সদস্যদের যৌথ সম্পত্তি। কাগজে-কলমে দলিলপত্রে হয়তো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নামেই সম্পত্তির মালিকানা লেখা হয়ে থাকে। কিন্তু সেটি একান্তই সমাজের শোষণমূলক চরিত্র ও বিধি-বিধানের কারণে। কার্যত সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার থাকে যৌথভাবে পরিবারের সব সদস্যের হাতে।

কমিউনিস্ট হিসেবে সরদার ফজলুল করিমের ছিল প্রচণ্ড গর্ববোধ, বিপুল অহংকার। তিনি বলতেন—‘আমি একজন কমিউনিস্ট। এবং আমৃত্যু আমি একজন কমিউনিস্ট থাকবো।’ একজন কমিউনিস্টকে তিনি খুবই উঁচু মর্যাদার চোখে দেখতেন। তিনি বলেছেন, ‘একজন প্রকৃত 'মানুষ' সব সময় কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী। কারণ কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী সেই হতে পারে, যে 'মানুষ' হয়ে ওঠে বা 'মানুষ' হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় থাকে। এরূপ প্রকৃত মানুষ কখনো কোনো অসঙ্গতি, অসাম্য, শোষণ-বৈষম্য মেনে নিতে পারে না। প্রতিনিয়ত লড়াই-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সে 'মানুষের' পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য জীবনপণ সংগ্রাম করে যায়।’

‘শ্রমজীবী মানুষের প্রয়াসে সভ্যতা সৃষ্টি ও সৃজিত হয়’—মার্কসীয় দর্শনের এই বিষয়টির প্রতি সরদার ফজলুল করিমের ছিল দৃঢ় প্রত্যয়। তাদের পেশি ও মগজের শ্রম, তাদের সংঘবদ্ধ ও জাগরিত হয়ে ওঠার মাঝেই তিনি অবলোকন করতে সক্ষম হতেন বিপ্লবের হাতছানি ও মুক্তির নিশানা। সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন, ‘এক সময়ের অবরোধবাসিনী, এ সময়ের গার্মেন্ট শ্রমিক। তারা প্রতিদিন ভোরে উঠে রাজপথ ধরে হেঁটে যায়। এরা শ্রমিক। এদের শ্রমে দেশ ও অর্থনীতি চলে। ফলে আমি বলি—রাজপথে গার্মেন্ট শ্রমিক হাঁটে মানে, প্রতিদিন সকালে বিপ্লব হেঁটে যায়।’ ছোট-ছোট গ্রাম্য বালিকা-কিশোরীদের লাখে-লাখে গার্মেন্ট শ্রমিক হয়ে ওঠার মাঝেই ঘটে চলেছে একটি বিপ্লব। তারই প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে বৃহত্তর সামাজিক বিপ্লবের পথে পদযাত্রা। রাজপথে গার্মেন্ট শ্রমিকদের এই দল বেঁধে হেঁটে যাওয়াটাই সরদার ফজলুল করিমের দৃষ্টিতে বিপ্লবের অগ্রযাত্রার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।

জ্ঞানচর্চার দিকে বিপুল আগ্রহটাই সরদার ফজলুল করিমের জীবনকে অন্য একটা পরিমিতির দিকে নিয়ে গেছে সবসময়। তিনি কত বড় নেতা বা কর্মী, কত বড় শিক্ষক—এসব বিষয়কে কোনোদিনই তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। তাঁর কাছে জ্ঞানচর্চার বিষয়টাই সবসময় গুরুত্ব পেয়েছে; যে জ্ঞানের আলো দিয়ে নিজের পথটা নিজের মতো করে তিনি কখনো একা একা, আবার কখনোবা যৌথভাবে পার হতে চেয়েছেন।

পাঁচ

সরদার ফজলুল করিম নিজেই নিজের মতো করে একটি দর্শন তৈরি করেছিলেন। সেটা হচ্ছে জীবন যাপনের দর্শন। শেষ বয়সে এসেও তাঁর প্রিয় উক্তি ছিল, ‘জীবন জয়ী হবে।’ জীবনকেই তিনি মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যুদিন হচ্ছে তাঁর সত্যিকারের জন্মদিন। মৃত্যুর পর যেকোনো ব্যক্তির পুরো পোর্ট্রেটটা আমাদের সামনে আসে। যেভাবেই মারা যান না কেন একজন ব্যক্তি, অসুখে-বিসুখে কিংবা কোনো আন্দোলন বা কোনো যুদ্ধে। মারা যাওয়ার পর জন্ম থেকে শুরু হওয়া সার্কিটটা তখন সম্পন্ন হয়। কাজেই আমরা যে জন্মদিবস পালন করি কেউ পঞ্চাশে, কেউ চল্লিশে বা ষাটে—এটা খুব একটা যথার্থ নয়। তখনো পর্যন্ত পুরো পোর্ট্রেটটা আমাদের সামনে নেই। আমার নিজেরও সার্কিটটা পূর্ণ হয়নি এখনো। এখনো কমপ্লিট হয়নি, তবে এখন এ বয়সে আমি পেছনের দিকে একবার তাকাতে পারি। লুক-ব্যাক। স্মৃতি আমার বেশ ভালোই আছে যদিও ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার মনে নেই। বর্তমান বাংলাদেশের জিজ্ঞাসু যে প্রজন্ম, তাকে আমি কী দিতে পারি? আমি বড় পণ্ডিত নই, বড় প্রফেসরও নই, বড় গবেষক নই। তাঁরা বড় বড় সব প্রবন্ধ লেখেন জীবনের গতি, জীবনের ধারা, পরিবর্তন, পরিবর্তনের ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে। এসব আমি তেমন কিছুই জানি না। এমন আমি, কী দিতে পারি আমার পরবর্তী প্রজন্মকে? আমি দিতে পারি আমার জীবনটাকে।’ 

জ্ঞানচর্চার দিকে বিপুল আগ্রহটাই সরদার ফজলুল করিমের জীবনকে অন্য একটা পরিমিতির দিকে নিয়ে গেছে সবসময়। তিনি কত বড় নেতা বা কর্মী, কত বড় শিক্ষক—এসব বিষয়কে কোনোদিনই তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। তাঁর কাছে জ্ঞানচর্চার বিষয়টাই সবসময় গুরুত্ব পেয়েছে; যে জ্ঞানের আলো দিয়ে নিজের পথটা নিজের মতো করে তিনি কখনো একা একা, আবার কখনোবা যৌথভাবে পার হতে চেয়েছেন। তিনি স্বতন্ত্র হতে চেয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর বেলায় স্বতন্ত্র হয়ে-ওঠা মানে অন্য সকলের সঙ্গে নিজের ‘যোগ’টাকে নষ্ট করে একা একা উপরে উঠে যাওয়া নয়। তিনি সব সময় সব কিছুকে এমনকি নিজেকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। এর মাধ্যমে সরদার ফজলুল করিম জীবনকে অন্বেষণ করেছেন, বেঁচে থাকার জন্য নিজের কাছেই ব্যাখ্যা চেয়েছেন। গড্ডলিকা প্রবাহে, আরাম আয়েশে গা ভাসিয়ে দেননি, অর্থহীন জীবন-যাপন করেননি, জীবনের বাঁকে বাঁকে তাঁকে বাস্তবের বিভিন্ন রকম অবস্থায় অবস্থান করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তিনি তাঁর মৌলিক আদর্শগত অবস্থানটি পরিত্যাগ করেননি। শুধু পারিপার্শ্বিকতার দাবিতে কৌশলী হয়েছেন। কিংবা বলা যায়, হয়ত দাবির কারণে যেভাবে চলতে চেয়েছিলেন সেভাবে চলতে পারেননি। কিছুটা ‘আপস’ [এডজাস্ট] করেছেন। সেটি হয়ত তাঁকে আরও তীক্ষ্ম অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন করে তুলেছে। 

বাপ-মায়ের ঋণ যেমন তিনি শোধ করতে চেয়েছেন, তেমনি জীবনের ঋণও। সে কারণেই জীবনকে নানাভাবে তিনি বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, জীবনকে বুঝে নিতে পারবার একটা বড় উপায় হচ্ছে, ‘জীবন যাপন করা।’ তাই বলে জীবনের প্রতি তাঁর তেমন কোনো আসক্তি তো নাই-ই বরং জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টি মোহমুক্ত। তিনি যেমন মৃত্যুর জিকির করতে নারাজ, তেমনি অমরত্বের পেছনেও তিনি ছুটতে চান না। বরং চারপাশের জীবন-জগৎকে কেন্দ্র করেই যে একজন সচেতন মানুষের জীবন আবর্তিত হয়, সেটিই তিনি বারবার নানাভাবে বলে চলেছেন। এক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, আজকের পৃথিবী ক্ষুদ্র বটে। আবার বিচিত্ররূপে বৃহৎও বটে। রাশিয়ার ব্যাপার যেমন রাশিয়ার ব্যাপার, তেমনি আমাদেরও ব্যাপার। আমেরিকার ব্যাপার যেমন আমেরিকার ব্যাপার, তেমনি আমাদের ব্যাপার। যেমন বাংলাদেশের, তেমনি পৃথিবীরও। আবার এও সত্য যে, রাশিয়ার ব্যাপার আমাদের ব্যাপার হলেও রাশিয়ার কোন সরকার বা ব্যবস্থা ডুবলে বা আদর্শগতভাবে ব্যর্থ হলে আমাদের ডুবতে হবে কিংবা আদর্শগতভাবে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হতে হবে, তেমন কোন স্বতঃসিদ্ধ কথা নেই।
আর তাই তো দেখি, যে জীবন মানুষ যাপন করে চলে, তার শত প্রতিকূলতা মেনে নিয়ে তিনি সে জীবনেরই জয়গানে মুখর থাকছেন, যার কারণে আমরা তেমনভাবে খুব একটা অবাক হই না, যখন তাঁকে বলতে শুনি—জীবনের অর্থই জীবন। জীবন জীবিত থাকে আর মৃত্যু মারা যায়। বাচ্চা মারা গেলে মা কাঁদে এটা একটা বায়োলজিক্যাল ব্যাপার। তথাপি এ বাচ্চা মারা যাওয়াটা একজন ব্যক্তির extinction, এটা মানুষের extinction নয়। এরকম ভাবনা নিয়েই আমি বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকাটা শুধু শারীরিকভাবে বেঁচে থাকা নয়, বরং এই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা যে, ‘মানুষ’ তথা জনতাই ইতিহাস তৈরি করে।

ছয়

সরদার ফজলুল করিমের সমকালীন চিন্তাভাবনার সবচেয়ে বড় প্রকাশ হচ্ছে তিনি আশাবাদের চাষাবাদ করেছেন। তিনি আমৃত্যু আশাবাদ চাষ অব্যাহত রেখেছেন। সে আশাবাদকে উসকে রেখেছে জ্ঞানচর্চা। জ্ঞানের শক্তিকে উপলব্ধি করেছেন নিজের মধ্যে। অপরের মধ্যে জাগাতে চেয়েছেন সেই শক্তি। সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, আমার চারিদিকে হতাশার সর্বগ্রাসী একটা ব্যাপার দেখি। হতাশা বোধ হচ্ছে এক সংক্রামক ব্যাধি। ব্যক্তির হতাশা থেকে হতাশার মহামারি হয়। জীবনের মধ্যে হতাশাকে অন্বেষণ করতে হয় না। জীবনের মধ্যে আশার বীজ অন্বেষণ করতে হয়।

আশাবাদের কথা বলার সময় মনে হয়, তাঁর কণ্ঠস্বর যেন এক তরুণের কণ্ঠস্বর। তাঁর মন ছিল তারুণ্যের জোয়ারে ভরপুর। যে তরুণ কারও ওপর নির্ভরশীল নয়, যে তরুণ দৃঢ়তার সঙ্গে জরাকে জয় করেছে, যে তরুণ কিছুতেই পিছিয়ে পড়বে না, যে তরুণ আবহমান কাল ধরে পথের কাঁটা দূর করে গেছেন, তিনি যেন ছিলেন সেই তারুণ্যের প্রতিনিধি। তিনি বঞ্চিত নিপীড়িতদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। নিরাশার মধ্যে আশার বাণী শুনিয়েছেন।

সরদার ফজলুল করিমের ‘মানুষ’ আদতে কী? তাঁর কাছে 'মানুষ' হচ্ছে একটি আদর্শিক পাটাতন। সে পাটাতন তৈরি হয়েছে কমিউনিস্ট রাজনীতির দর্শনের প্রতি তাঁর উপলব্ধিগত একাত্মতা থেকে। তিনি ‘মানুষ’কে গণ্য করতেন শ্রেণি সংগ্রামের সামাজিক পাটাতন হিসেবে। সেই সমাজের, যে সমাজে আলাদা-আলাদা প্রতিটি মানুষ ‘সমান-ভাবে’ বাঁচবে। বাঁচার ‘সমান-অধিকার’ নিয়ে থাকবে।

সরদার ফজলুল করিম ছিলেন জ্ঞানানুরাগী। তিনি জ্ঞানের পুস্তকগুলোকে বাংলায় অনূদিত করেছেন। তিনি ইতিহাসের সব হারিয়ে যাওয়া উপাদান তুলে এনেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। তিনি একইসঙ্গে ছিলেন একজন বাস্তবাদী বা জীবনমুখী লেখক। তাঁর প্রতিটি বই জ্ঞান ও জীবনের গুরুত্বকে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছে। আসলে সরদার ফজলুল করিম হচ্ছেন জীবনের মধ্যে আশার বীজ বপনকারী একজন জ্ঞানসাধক, বিপ্লবী দার্শনিক। 

টীকা

১. স্বদেশের তথা মাতৃভূমির গৌরব ও অগৌরবকে কেন্দ্র করে সেই দেশের মানুষ বা জাতির অন্তরে যে উল্লাস, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, অনুভূতি, জাতীয় চেতনা, আত্মমর্যাদা ও আত্মাভিমান সঞ্চারিত হয় সাধারণত তাকেই জাতীয়তাবাদ বলে। জাতীয়তাবাদ একটি আধুনিক ধারণা। আন্তর্জাতিক খেলাধুলার আসরে বিজয়ী দেশের সমর্থকদের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস যেমন দেখা যায়, তেমনি বিজিত দেশের সমর্থকদের মধ্যে দেখা যায় সীমাহীন বিষাদ ও হতাশা। দেশের প্রতি এই মমত্ববোধ ও একাত্মতাই হল জাতীয়তাবাদ। 
জাতীয়তাবাদ বলতে যে আবেগ বা ধারণা বোঝায় এদেশে ইংরেজদের আগমনের আগে সেই আবেগ বা অনুভূতি তেমন ভাবে প্রকট হয়নি। তখন ভারতবর্ষ কতকগুলি খণ্ড রাজ্যের সমষ্টি ছিল। ইংরেজরা এদেশে এসে সেই খণ্ড খণ্ড রাজ্যকে একই পতাকার তলায় নিয়ে এসে পরোক্ষভাবে এই দেশকে রাজনৈতিক দিক দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ রূপ পরিগ্রহ করেছিল। এছাড়া এর মূলে ছিল ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রেক্ষিত। ইউরোপে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধারণার উন্মেষ ঘটেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলি যথা ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, ইটালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন প্রভৃতির মাধ্যমে এই জাতীয়তাবাদ সুষ্ঠু রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের বাণী—স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি টমাস জেফারসনের মানবাধিকারের ঘোষণা ভারতীয়দের আবেগকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। ঊনিশ শতকে ভারতীয় দেশীয় রাজ্যগুলি একই শাসনাধীনে আসার পর এদেশে ইংরেজ শাসনের বজ্রমুষ্টি যতই দৃঢ় হতে থাকে, ততই তার কুটিল রূপ ভারতীয়দের চোখ খুলে দেয়। ভারতীয়রা ধীরে ধীরে দেশবাসী হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব অনুভব করে। ঊনিশ শতক থেকে ভারতে এই জাতীয়তাবাদী ধারণার উন্মেষ ঘটেছিল। এর সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার একটি বিশেষ যোগ আছে। 

তথ্য সহায়িকা 

১. জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি: ১৯০৫—৪৭, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সংহতি, ঢাকা, ১৪২২।
২. বাংলাদেশের ইতিহাস: ১৭০৪—১৯৭১, সিরাজুল ইসলাম (সম্পাদিত), এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৯৩। 
৩. ‘দ্যা সোশিওলজি অব টলারেন্স অ্যান্ড লাইফ ইন ডেমোক্র্যাসি’, কৌশিক চট্টোপাধ্যায় এবং বিশ্বজিৎ ঘোষ, জার্নাল অব হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস, নম্বর ১৫, সেপ্টেম্বর সংখ্যা, [recearchgate.net], ২০১৮।   
৪. বাঙলির জাতীয়তাবাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দ্যা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০০০।
৫. বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, মহম্মদ আবদুল মান্নান, কথামেলা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১২। 
৬. বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা: একটি প্রচ্ছন্ন জাতির গতি-প্রকৃতির অনুসন্ধান, আকবর আলি খান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫।
৭. ‘দোদুল্যমান জাতীয়তা’, জাতীয়তাবাদ-বিতর্ক: আবদুল হক,[সম্পাদক: মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর], দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৭। 
৮. পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, কামরুদ্দীন আহমদ, স্টুডেন্টস পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ১৩৭৬।
৯. কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস প্রসঙ্গ ও দলিলপত্র, ১ম খণ্ড, নূহ-উল-আলম লেনিন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫।
১০. জাতীয়তাবাদ: উন্মেষ ও বিকাশ, নেহাল করিম, কৃষ্ণচূড়া প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১।
১১. ইতিহাস ঐতিহ্য জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র: নির্বাচিত প্রবন্ধ, সালাহ্উদ্দীন আহমদ, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪।
১২. দিনলিপি, সরদার ফজলুল করিম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৫।
১৩. আমি সরদার বলছি, সরদার ফজলুল করিম, অন্বেষা, ঢাকা, ২০১৩
১৪. জীবন জয়ী হবে: সরদার ফজলুল করিমের সাথে কথোপকথন, শান্তনু মজুমদার, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৪।
১৫. শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, সরদার ফজলুল করিম, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১১।