নগর-পরিকল্পনা

 

যাকে বলে একেবারে ভরদুপুরে ভূত দেখা!

কিন্তু আমি চমকে উঠি নাই। স্বাভাবিক ছিলাম পুরোটা সময়। ঢাকা শহরের ভীষণ ব্যস্ত বাসস্ট্যান্ডটায় সবেমাত্র নেমেছি। মাঝখানে বছরখানেক ঢাকা আসি নাই। সেদিন আমি বাস থেকে নেমে সুনাগরিকের মতোন রাস্তা পার হবো ভেবে ওভারব্রিজের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলাম। চারপাশে ঘন ধুলা উড়ছে, যদিও শুকনা মৌসুম অনেক দেরি। ব্যাগের পকেট হাতড়ে একটা দোমড়ানো-মোচড়ানো টিস্যু বের করে কোনোমতোন নাক-মুখ চেপে ওভারব্রিজের হাতল ধরলাম। গলায় প্যাঁচানো ওড়নাটা খুলে নিয়ে চুল ঢাকলাম। খুব একটা তাড়া নাই, তার ওপর পিঠে বেশ ভারী ব্যাকপ্যাক। ধীরেসুস্থে পা ফেলছি আর এদিক=ওদিক চোখ চলে যাচ্ছে। এই শহর কত দ্রুত চেহারা পাল্টায়! এক বছরেই কেমন অচেনা হয়ে গেছে চারপাশ!

হঠাৎ চোখ পড়ল নিচের দিকে। দেখলাম সে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিএনজিওয়ালার সাথে কথা বলছে। আগের মতোই অস্থির। দাঁড়ানোর ভঙ্গি, হেয়ারকাট, ঘাড়ের গঠনসবকিছুই সেই একই রকম। এত অসংখ্য মানুষ থাকে এই শহরে, এত এত পথ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ঢাকার বুকে পা রাখতে না রাখতেই এমন সময়, এমন জায়গায় এই মানুষটার সাথে দেখা হওয়াটা একটু বেশি নাটকীয় হয়ে গেল! অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বাস্য রকমের বাড়াবাড়ি টাইপের ঘটনা! আমার এত দিন ধারণা ছিল এই রকম কিছু ঘটলে আমি কোনো দিন কোনো ভাবেই সামলে নিতে পারব না, পালিয়ে যাব, এড়িয়ে যাব নয়তো এত বেশি মন খারাপ হবে যে উল্টাপাল্টা কিছু একটা করে বসব। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে এর কোনোটাই হলো না। আমি বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকে ডাক দিলাম, গলা ছেড়ে। একবারের ডাকেই কাজ হলো। সাধারণ ভঙ্গিতে, সুস্থ-সবল মন নিয়ে আবার রাস্তায় নেমে এলাম। কী অবস্থা, কখন আসলা, কোত্থেকে’—ইত্যাদি বলতে বলতে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর, স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় হবে হয়তো, আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিয়ে বরং উল্টা আমাকেই প্রশ্ন করে বসল।

আপনি কই যাবেন? আমি সিএনজি ঠিক করতেছিলাম। চাইলে আমার সাথে যাইতে পারেন।

আমার সাবেক বয়ফ্রেন্ড। আপনি করে বলছে ভাব নেওয়ার জন্য। আমাদের মধ্যে যে এখন কেবল প্রায় পরিচিতের মতোন সম্পর্ক, এইটা বুঝাতে চায় হয়তো। অবশ্য সম্পর্ক শুরুর পরেও কয়েক সপ্তাহ সে আমাকে আপনি ডেকেছে। তার আগে আপু ডেকে তুমি বলত। ভার্সিটিতে আমার চেয়ে দুই ব্যাচ জুনিয়র ছিল এই ছেলে। বয়সে বোধ হয় আরও ছোট হবে, বছর তিনেকের। যাহোক, তার সাথে আরেক সিএনজিতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না! সত্যি কথা বলতেএই ছেলের সাথে হঠাৎ কোথাও দেখা হযে যেতে পারে এই ভয় জমে পাহাড় হয়ে ছিল আমার মাথার ভেতর। এই ভয়ানক ভীতির কারণেই এক বছর যাবৎ আমি একবারও ঢাকায় আসি নাই! পুরো বছর আমি নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করেছি, বলতে গেলে একেবারে একা।

ছোট শহরের একটা ছোট ভার্সিটিতে পড়াই। ক্যাম্পাসের কোনায় একটা বাসা নিয়ে একলা থাকি। এই ছেলের সাথে ব্রেকআপের পর ফেসবুক, ভাইবার বন্ধ করে দিয়ে নিজেকে শহরের বাইরের জগৎ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় ছিলাম। বন্ধুরা ফোন করে পেত না। মোবাইলটা চালু ছিল, তবে কেবল প্রয়োজন পড়লে মা, বাবা, ছোট ভাই আর সহকর্মীদের সাথে কথা হতো। গতকাল সন্ধ্যায় কী জানি কী মনে করে আবার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা অ্যাকটিভেট করলাম। ঢাকা শহরের নানা সুপরিচিত জায়গায় বসে, দাঁড়ানো বন্ধুদের পোস্ট করা ছবি, আর টিএসসির চায়ের দোকানে একগাদা মানুষকে চেক-ইন দিতে দেখতে দেখতে মনে হলো, ধুর, কী হবে এই রকম সন্ন্যাসমার্কা সময় কাটিয়ে?’—এবার আমার ফেরা উচিত। জীবন যেমন জীবন ছিল, আরেকবার তেমন হোক। তাই রাতভর প্রস্তুতি চলল। ব্যাগ গোছালাম, নিজে নিজেই নতুন একটা হেয়ারকাট দেওয়ারও চেষ্টা করলাম। সকালে উঠে বের হবো, বড়সড় ব্যাকপ্যাকটা তুলে কাঁধে নিতে যাব, ঠিক এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই, সেই প্রবল ঢাকাভীতি এসে আমাকে জাপটে ধরে বসিয়ে দিল। আমি আর বের হতে পারছি না। চোখের সামনে আগের সেই ঢাকা শহর। এত দিন এত চেষ্টায় আসলে আমি কিচ্ছু ভুলে যেতে পারি নাই, যেন মাত্র গতকাল আমি ওই শহরে ছিলাম। বয়ফ্রেন্ডের সাথে কাটানো সময়গুলো, জায়গাগুলো, শব্দ, গন্ধ, ছবিসমস্ত কিছু ভীষণ ভারী হয়ে আমার শরীরের ওপর চেপে বসেছে যেন। আমি ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেললাম। কতক্ষণ এমন ঘোরগ্রস্ত হয়ে কাটল জানি না। অবশেষে সাহস করে দৃপ্তপায়ে যখন বের হলাম, ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে।  

বাসে উঠেই শুরু করলাম আমার ডিট্যুর প্ল্যান। যেসব জায়গা, যেসব পথজুড়ে প্রেমের সময়টায় নিত্য যাতায়াত, ওঠাবসা ছিল সেগুলো সাবধানে এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে ওই ছেলে যে বাসায় থাকত, তার আশপাশেও যাওয়া যাবে না। এইবারের ঢাকা-ভ্রমণ অতি সাবধানে সারতে হবে। এই বারোমাস ধরে ধীরে ধীরে যতটুক সাহস আর বিশ্বাস ফিরে এসেছে নিজের ওপর, কোনোমতেই তা হারানো যাবে না। বাসস্ট্যান্ডে নেমে একটা সিএনজি ডেকে নেব। যাব ধানমন্ডি সাতাইশ। একটু ভাড়া বেশি লাগলেও খামারবাড়ি হয়ে কোনোমতেই যাবো না। ওই মোড়ে অনেকবার আমাদের দেখা হয়েছে। পাশেই ইন্দিরা রোডের একটা বাসায় থাকত সে। অবশ্য অনেক সিএনজিওয়ালা রাজি হবে না জানি ঘোরা পথে যেতে। 

মামা, যাবেন ধানমন্ডি সাতাইশ? মীনা বাজারের পিছনে নামব।
যামু, তিনশ ট্যাকা লাগব। 
দুইশ দিব, মামা, কম বলি নাই।
উঠেন, বিশ টাকা ধইরা দিয়েন। বহুত জ্যাম রাস্তায়।
জ্যাম তো, মামা, নতুন না। দুইশই দিব। আপনি পান্থপথ সিগন্যাল দিয়া ঢুইকা বত্রিশ নম্বর দিয়া বের হবেন।
তাইলে দুইশ ট্যাকায় হইব না। ওইডা ঘুরা পথ। ওই রাস্তায় জ্যাম আরও বেশি। 

আগারগাঁও কলোনিতে বড় বোনের বাসা। মাঝখানে কয়েক বছর ঢাকায় এলে ওখানেই উঠতাম। এবার ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাব ওই এলাকা। শেরেবাংলা কৃষি ভার্সিটি, শেওড়াপাড়া, কলোনির মাঠ এই সব এলাকায় ভুলেও যাওয়া যাবে না। এবং আমার গাঢ় ধারণা, আমার এই ডিট্যুর প্ল্যান কোনোমতেই ব্যর্থ হবে না। কারণ, সফলভাবে রাস্তা এড়িয়ে চলার অভিজ্ঞতা আমার ভালো রকমেই আছে। সেই অভিজ্ঞতার বয়স কম করে হলেও সতেরো বছর!

তখন দুই হাজার তিন চলে। আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো বাড়ি থেকে বেশ দূরের একটা স্কুলে। আমাদের বাড়ির ঢাল থেকে সাড়ে আটটায় রওনা দিলে স্কুলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নয়টা বিশ বেজে যায়। যেতে হয় বাঁধের ওপরের নতুন রাস্তা দিয়ে হেঁটে। এই পথে তখনো তেমন কোনো রিকশা-ভ্যান চলে না। আর বাবার আয়-রোজগারের অবস্থা সেই সময় দুর্দান্ত খারাপ যাচ্ছিল। বাড়ি আর স্কুলের মাঝ বরাবর একটা নতুন গড়ে ওঠা বাজার। বয়স মাস দশেকের মতোন কিন্তু এরই মধ্যে অনেকগুলো দোকান বসে গেছে। একটা ওষুধের ফার্মেসি। চা-পুরির দোকান তিন-চারটা। চুল দাড়ি কাটানোর ঘর একটা। শেষ মাথায় মোবাইল ফোনে পাঁচ টাকা/ মিনিট কথা বলার রঙিন দোকানটা। পুব দিকে টানা এক সারিতে কয়েকটা মুদিদোকান। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। সবচেয়ে সুন্দর হয়ে ওই দোকানগুলোতে ঝুলে থাকে বোম্বে সুইটসের পটেটো ক্র্যাকার্স, রিং চিপস আর খান সাহেবের চানাচুর। রসুনের শুকনা ফালি দেওয়া অপূর্ব স্বাদের ওই চানাচুর দেখলেই আমার জিভে জল চলে আসে। বাড়ি থেকে হেঁটে যাই, আর ব্যাগের মধ্যে স্টিলের টিফিন বক্সে থাকে রুটি, আলুভাজি আর আখের গুড়। আম্মা অথবা আব্বা কেউ আমার হাতে নগদ এক টাকাও দেয় না। তাই চিপস বা চানাচুর কেবল দেখে যাই, কোনোটাই কোনো দিন কিনতে পারি না। বয়স তখন দশের বেশি না। ঘুমালে তখনো ফুল, পাখি, দৈত্য আর রসগোল্লা দেখি। একদিন স্বপ্নে দেখলাম আমি মুঠো ভরে খান সাহেবের চানাচুর খাচ্ছি! বাঁধের ওপরের রাস্তাটা কে যেন কখন পাকা করে দিয়ে গেছে। শীতকালের ভোর বলে মনে হলো, কারণ আমার গায়ে গরম জামা, চারপাশে হালকা কুয়াশা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু বাঁধের দুই ধারে বর্ষাকালের মতো উপচে পড়া পানি। পুরো গ্রামের বাড়িঘর সব ডুবে গেছে। টিনের চাল, গাছের মাথা আর এই বাঁধ ছাড়া সব ডুবে গেছে। সেই একলা জেগে থাকা পিচ ঢালা পথে রাজ্য জয় করা সেনাপতির মতো আমি প্রবল প্রতাপে হাঁটছি। আমার গলায় একটার পর একটা চানাচুরের প্যাকেট দিয়ে গাঁথা বরণমালা। সেই মালা থেকে বহু বহুক্ষণ ধরে একটার পর একটা প্যাকেট ছিঁড়ে নিচ্ছি আর খাচ্ছি, নিচ্ছি আর খাচ্ছি কিন্তু অবিনশ্বর, অফুরান চানাচুরের মালা একটুও ফুরায় না।

স্বপ্নটা দেখলাম, বুধবার রাতে আর শুক্রবার দুপুরে ঘটল সত্যিকারের ঘটনাটা। জুমার নামাজের জন্য প্রায় সব দোকানই বন্ধ তখন, কেবল একটা মুদিদোকান আর ফোনের দোকানটা বাদে। মায়ের কাছ থেকে বলেকয়ে পাঁচ টাকা নিয়ে বের হলাম। গিয়ে দেখি মুদি দোকানদার নাই। মোবাইলের ঘরটা এখান থেকে খানিকটা দূরে, সে ওই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। খালি ফেলে যাওয়া দোকান দেখে হঠাৎ করেই দেড় রাত আগে দেখা স্বপ্ন সত্যি করার পাগলা নেশা চেপে বসল। আমার নিয়ে আসা পাঁচ টাকায় দুইটার বেশি চানাচুরের প্যাকেট পাওয়া যাবে না। দুইটাতে তো আর মালা হয় না। তাইলে বরং চুরি করা যাক, এই সুযোগ! দড়িতে ঝোলানো সবচেয়ে লম্বা চানাচুরের মালাটা এক ঝটকা টানে নিয়ে আমি দিলাম এক দৌড়! বাজার থেকে দূরের এক লিচু গাছে উঠে তবেই থামলাম। দেরি না করে গলার মালা থেকে একটার পর একটা প্যাকেট ছিঁড়ে খেতে লাগলাম। ঠিক ওই সময়টায় মনে হচ্ছিল, জীবন এত সার্থক আগে কখনো হয় নাই!

কিন্তু আসরের পর বাড়ি ফিরেই বুঝলাম কপালে খারাবি আছে। উঠানে বিশ-পঁচিশজন মানুষ। সেই দোকানদার বসে আছে এক কোনায়। এতক্ষণে কয়েক দফা অভিযোগ করা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। আমাকে দেখেই আব্বা ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে এলো। বাম হাতে আমার ডান কান ধরে মারতে মারতে উঠানের পশ্চিম দিকটায় নিয়ে গেল, সোজা ওই দোকানদারের সামনে। দোকানদার অবশ্য আমাকে তেমন কিছু বলল না, তার রাগ ততক্ষণে নাই হয়ে গেছে হয়তো। যা বকার আব্বাই বকতে লাগল। বাকি মানুষগুলোর দিকে চোখ পড়তেই আমি আরও কুঁকড়ে গেলাম লজ্জায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মুখ টিপে টিপে হাসছে। আব্বাকে শান্ত হতে বলছে অনেকেই, লাভ হচ্ছে না। আমি মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছি। আর ওই রাতের স্বপ্নের সুখ-দৃশ্যগুলো চোখের সামনে এসে ঘোলা হয়ে বারবার গলে যাচ্ছে।

সেই দিনের পর থেকে টানা দুই বছর আমি ওই বাজারে যাই নাই। স্কুলে যেতাম ঘোরা পথে। বাঁধে উঠতামই না। দুই-তিনটা গ্রামের মাঠ, পথ পার হয়ে; মানুষের উঠান, বাহির বাড়ি, পুকুরের ধার দিয়ে স্কুলে যেতে আমার অনেক বেশি সময় লাগত। সাড়ে আটটার জায়গায় বের হতাম সাড়ে সাতটায়, তবু ভুলেও বাজারমুখী হই নাই কোনো দিন। কেউ আর জোর করেও নিতে পারে নাই আমাকে। সেই অত ছোট বয়সেই আমি কঠিন ত্যাগ আর জিদের সাথে, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বজায় রেখে ডিট্যুর প্ল্যানে সফল হয়েছি। আর এখন তো আমি পুরোপুরি স্বাধীন মানুষ, দারুণ আত্মপ্রত্যয়ী! এইবার ঢাকায় থাকবও বড়জোর দুই দিন। টানা দুই বছর ঘোরা পথে যেতে পেরেছি, যেই পথে যেতে লজ্জা ভয় নির্দ্বিধায় তা এড়িয়ে চলতে পেরেছি প্রায় সাতশ দিন ধরে, আর এই দুই দিন পারব না, এইটা কোনো কথা? যে যত অনুরোধ, জোর, ঠাট্টা বা অভিযোগ করুক না কেনআমার দৃঢ় সিদ্ধান্ত আমি টিকিয়ে রাখতে পারব, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই।  

আপনি কই যাবেন? আমি সিএনজি ঠিক করতেছিলাম। চাইলে আমার সাথে যাইতে পারেন।

অপ্রত্যাশিত এই বাক্যগুলো এই অতি অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে শোনার পর, বাইরে বাইরে যত স্বাভাবিকই থাকি না কেন, তা হজম করতে আমার খানিকটা সময় লাগল। এত গর্ব, আত্মবিশ্বাস, ক্ষোভ আর ভয় নিয়ে করা আমার ডিট্যুর প্ল্যান তো আমি এত সহজে ভেস্তে দিতে পারি না! বাসের কয়েকটা ঘণ্টা অবিরাম আমি এই প্ল্যান নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। এবং এই ছেলের ওপর আমার রাগের কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। মানুষে মানুষে প্রেমের সম্পর্ক ভাঙতেই পারে, অজস্র সম্পর্ক প্রতিদিন ফুরিয়ে যায়, কিন্তু শেষ করার সময়টায় তার আচরণ ছিল অসম্ভব রকমের বিশ্রী। কোনো ব্যাখ্যা নাই, কারণ দর্শানো নাই, এত হঠাৎ করে, এত বেশি স্বার্থপরের মতোন আমাকে না বলে দিল আমি কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারি নাই, কিছু জিজ্ঞাসা করারও সুযোগ পাই নাই। অপমান-অপমান ক্ষোভগুলো তাই বিশাল বরফশীতল হয়ে জমে আছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শব্দটাকে চিরকাল আমার অপ্রয়োজনীয় আড়ম্বর মনে হতো। এর যে আদৌ কোনো সত্যিকারের প্রয়োজন বা প্রয়োগ আছে, আজকের আগে জানতাম না।

যাকে আর একবারও কোথাও দেখতে চাই নাযার কোনো নাম, ছবি, চিঠি, মেসেজ, উপহারের কোনো চিহ্ন এখন আর কোথাও রাখি নাইযার কথা মনে পড়বে বলে সকল অনুরোধ, বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, মায়া উপেক্ষা করে ঢাকা থেকে শত মাইল দূরে পড়েছিলাম, বলতে গেলে একেবারেই একাতাকে ভূতের মতো আচমকা দেখার পর চোখ-মুখ সহজ, স্বাভাবিক দেখালেও মনের অবস্থা যে অস্থির, ঝড়-গ্রস্ত হবে না এইটা আশা করা একেবারেই যায় না। আবার এই জাতের সাবেক প্রেমিকের কাছে কোনোভাবেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে আমি ছোট হতে চাই না, অন্তত এখন আর না! অতএব দুই কূল রক্ষা করার মতোন কিছু একটা করতে হবে। যেন এই ছেলেকে দেখে আমার ভেতর কোনো রকম ভাবান্তর নাই!

যাওয়া যায়। কিন্তু আমি যেই রাস্তা দিয়া যাব, তোমারও ওই দিক দিয়াই যাইতে হবে। প্রবলেম হইলে একাও যাইতে পারো বা

না, ঠিক আছে, প্রবলেম নাই, চলেন

তুমি দাঁড়াও, বরং আমি কথা বলি সিএনজিওয়ালার সাথে। আমি কোন পথ দিয়া যাইতে চাই, তুমি তো আর জানো নামামা, যাবেন ধানমন্ডি সাতাইশ? মীনা বাজারের পিছনে নামব।