মৃতের গল্প থাকে না
জীবনানন্দ দাশ ট্রামে চাপা পড়ে কীভাবে মারা গেলেন, তার সঙ্গত কারণ খুঁজতে যাওয়াটা যেমন অবান্তর, জামিলের হাত মেয়েটির পিঠ কীভাবে ছুঁয়ে দিল, সেই রহস্যের কারণ অনুসন্ধান করতে যাওয়াটা হয়তো ততটা অবান্তর নয়!
জামিল এই রহস্য ভেদ করতে পারে না, কেমন করে তার হাত মেয়েটির পিঠ ছুঁয়ে দিল! রীতিমতো হতভম্ব বনে গেছে সে!
মেয়েটি জামিলের সহপাঠী। মালিহা সামথিং সামথিং পুরো নাম। সবাই মালিহা নামেই ডাকে তাকে। জামিল তার নামটা জানে। মেয়েটি তার নাম জানে কি না নিশ্চিত নয়।
জামিলের হাত মালিহা নামের এই মেয়েটিরই পিঠ ছুঁয়ে দিলে জামিল তৎক্ষণাৎ মেয়েটিকে সরি বলে। মেয়েটিও প্রত্যুত্তরে, তার দিকে না তাকিয়েই ‘ইট’স ওকে’ বলে সমান মনোযোগ দিয়ে খাতায় লেকচার তোলে। এমনকি জামিলের হাতটা যখন তার পিঠ স্পর্শ করে, তখনো মেয়েটি একইভাবে লেকচার তুলেছিল বলেই জামিলের ধারণা।
তিন মাস ক্লাস করছে তারা একসাথে। কখনো নিজেদের মধ্যে কথা হয়নি। আজকেই প্রথম তারা একই বেঞ্চে বসেছে, প্রথম সারিতে।
পেছনের সারি থেকে কেউ একজন জামিলের উদ্দেশে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলতে গেলে সেটা শুনতে গিয়ে পেছন ফিরতেই এই রহস্যজনক ঘটনাটা ঘটে। যার ফলে জামিলকে বাকি ক্লাস পুরোটাই হতভম্ব হয়ে থাকতে হয়।
টিচার ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলে জামিল আবারও মেয়েটিকে অনেকটা অনুনয় করে বলে যে, কাজটা সে ইন্টেনশনালি করেনি, কীভাবে কী হয়ে গেল, সে নিজেও বুঝতে পারেনি, সে খুবই লজ্জিত। সে দুঃখ প্রকাশ করে।
মেয়েটি শোনে এবং তার দিকে শুকনো মুখে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে, ‘ইট’স ওকে’।
জামিল আরও কিছু বলতে চায়, তার আগেই সে দেখে মুখ ফিরিয়ে মেয়েটি পাশের সহপাঠীর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। তাদের কথায় সেও মনোযোগী হতে চায়, কিন্তু সে কোনো কথাই শুনতে পায় না।
জামিল বুঝতে পারে না মেয়েটি কেন বিষয়টা শুধু ‘ইট’স ওকে’র মধ্যে সীমিত রাখে। জামিল বিষয়টা ভুলে যেতে চায় কিন্তু পারে না। জামিলের খারাপ লাগা কাজ করে। জামিল অস্বস্তি বোধ করে।
জামিলের ধারণা, মেয়েটি ধরেই নিয়েছে যে সে ইচ্ছাকৃতভাবে কাজটা করেছে। সে একটা বদ ছেলে। তার আরও ধারণা হয় যে, মেয়েটি ছেলেটির সাথে এই প্রসঙ্গেই কথা বলছে। হেসে হেসে বলছে, এটা ভেবে তার খারাপ লাগা আরও বেড়ে যায়।
মেয়েটি আরও কয়েকজন সহপাঠীসহ ক্লাস থেকে বের হতে গেলে তার খারাপ লাগার বোধটা ভয়ে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সে নিশ্চিত যে মেয়েটি চেয়ারম্যান স্যার অথবা স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারের কাছে নালিশ দেবে তার নামে। চোখ ছোট হয়ে আসে তার। মাথায় ঝিম ধরে। সে কিছু ভাবতে পারে না।
দশ মিনিটের মধ্যেই আরেকটি ক্লাস শুরু হবে। এই সময়টা যে যার মতো হুল্লোড় করছে। কেউ কেউ অন্যের খাতা দেখে আগের ক্লাসের লেকচার টুকে নিচ্ছে। জামিল একা অপমানে, লজ্জায়, ভয়ে কাঠ হয়ে কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে।
দরজার সামনেই মেয়েটি আরও কয়েকজন সহপাঠী পরিবৃত হয়ে খিল খিল করে, জামিল দেখে আর তার সন্দেহ তীব্র থেকে গাঢ় হয়। জামিল ভয়ংকর কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় প্রহর গোনে। জামিল নীল হয়ে যায়।
গ্রামের ছেলে সে। মাত্র কয়েক মাস হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে মহানগরে এসেছে। হলে থাকে।
বড় ভাইয়ের কথা মনে পড়ে জামিলের। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলে বাড়ি থেকে ঢাকা আসার পথে—রাজনীতি থেকে একশো হাত দূরে থাকা, ক্লাসের আড্ডাবাজ, ওভার স্মার্ট ছেলেদের সাথে মেলামেশা না করা, মেয়েরা নোট চাইলে তা না দিয়ে তাদেরকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা, ক্যাম্পাসে আমলকী ফল পাওয়া যায়, অন্য কিছু হাবিজাবি খাওয়ার অভ্যাস না করে প্রতিদিন কিনে কিনে আমলকী খাওয়ার উপকারিতার কথা বলেছিল বড় ভাই, জামিলের মনে পড়ে।
বড় ভাইয়ের কোনো কথাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয় না জামিলের। কোনোটা ইচ্ছাকৃতভাবে, কোনোটা চাপে পড়ে। হলে উঠতে গেলে সে বুঝতে পারে মিছিল-মিটিং না করলে হলে ওঠা যায় না। আড্ডাবাজ সে এখনো হয়ে উঠতে পারেনি, ওভার স্মার্ট ছেলেরা তাকে পাত্তাই দেয় না। মেয়েদের সাথে সে নিজ থেকেই চায় বন্ধুত্ব করতে কিন্তু পারে না। আর আমলকী ফল যতই পুষ্টিকর হোক, কিছুদিন পর ভালো লাগে না।
জামিল সামনের হোয়াইট বোর্ডের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এসব ভাবতে থাকলে, তার চোখ ঘোলা হয়ে আসে। ঘোলা চোখে সে পাশ ফিরে তাকালে মেয়েটা আবার তার পাশে ঘন হয়ে বসে। পরের ক্লাস শুরু হয়। আবার পরের পিরিয়ড। জামিল স্থির হতে পারে না। জামিল হাঁসফাঁস করে।
সব ক্লাস শেষ হয়ে গেলে জামিল ওঠে না বেঞ্চ থেকে, মেয়েটি ব্যাগ গোছায়। জামিলের দৃঢ় বিশ্বাস, মেয়েটি এই শেষ বেলায় নিশ্চয়ই তাকে কড়া কিছু অপ্রীতিকর কথা বলে হন হন করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যাবে। মেয়েটি কোনো কথা না বলে চলে যায়।
মেয়েটির পিছু পিছু সেও বের হয় না। আজকে কিছু ঘটেনি, তবে আগামীতে মেয়েটি যে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটাবে না, এটার নিশ্চয়তা কী, ভাবে সে।
ক্লাসের সবাই বের হয়ে গেলে সে বের হয়। এবং সিঁড়িতেই আবার মেয়েটিকে অপর আরেক সহপাঠীর সাথে কথা বলতে দেখলে সে আবারও মেয়েটিকে সেই সময়ের অবস্থাটা বুঝিয়ে বলতে চায়। মেয়েটি এবার বিরক্ত হয়। তার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ভ্রু-কিঞ্চিৎ করে ‘যত্তসব’ বলে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে চলে যায়। পাশের ছেলে সহপাঠীটি জামিলের দিকে কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থাকে এবং তার কোনো ভাবান্তর না দেখে ‘হোয়াট দ্য ফাক, ম্যান’ বলে মেয়েটির পেছনে ছুটতে থাকে।
সে বুঝতে পারে না সমস্যাটা কোথায়। সে হলে ফিরে আসে। গণরুমে ফিরে আসে। বিধ্বস্ত জামিল গণরুমের উদ্বাস্তু শিবিরে কোনোরকমে গা এলিয়ে দিয়ে সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা শুয়ে থাকে। বের হয় না। গণরুমের গণবন্ধুরা আসে যায়, কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করে না।
ক্লাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা জামিল শেয়ার করতে চায়। জামিল বের হয়। গণরুমের এক বন্ধুকে নিয়ে শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড়ে চা খেতে খেতে সে সবকিছু শেয়ার করলে বন্ধুটি অদ্ভুত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই হলের ব্যাচমেটদের মধ্যে কথাটা রাষ্ট্র হয়ে গেলে সে আরও বিধ্বস্ত হয়ে তার রুমে ফিরে আসে।
জামিলের গ্রামের কথা মনে পড়ে। জামিলের মায়ের কথা মনে পড়ে।
২
জামিল যে বোকার মতো উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মেয়েটির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা যে খুবই এক্সিডেন্টাল এবং সেটিকে পাত্তা না দিয়ে মেয়েটির মতো সেও ক্যাজুয়ালি বিষয়টা ডিল করতে পারে, এ ছাড়া মেয়েটির কাছে বারবার একই বিষয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে উলটো বরং সেই যে মেয়েটির বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে, অতঃপর হলের বন্ধুদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে হাস্যরসের বিষয়টাও যে জামিলেরই বোকামির ফল, সেই উপলব্ধি যখন জামিলের হয় তখন প্রায় মধ্যরাত। মধ্যরাতে জামিল বুঝতে পারে অহেতুক বিষয়টি সে জটিল করে ফেলেছে।
জামিলের এখন ভালো লাগা কাজ করে, সে রুমে ফিরে আসে। রুমমেটরা তার আগমন উপলক্ষে আরেকবার ঠাট্টা করলে সহজেই সকলের সাথে সেও ঠাট্টায় যোগ দেয় এবং একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন সকাল ৮টার ক্লাসে সবার আগে গিয়ে সে আবারও প্রথম সারিতে জায়গা নিলে মেয়েটিও তার পাশেই বসে। একসাথে বসে কেউ কারও সাথে কোনো কথা না বলেই সব ক্লাস শেষ করে। ছুটি হয়ে গেলে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে জামিল মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই হেসে হেসে গত দিনে তার বোকামির কথা অকপটে স্বীকার করলে মেয়েটিও হাসে।
‘আমি মালিহা’ বলে মেয়েটি জামিলের দিকে তাকালে জামিলও নিজের নাম তাকে জানায় এবং অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে বলতে তারা দুজনে কাজী মোতাহার হোসেন ভবনের চারতলা থেকে একসাথে নেমে শহীদ মিনারের পেছনে দুধ-চা খায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি লাল বাস এসে দাঁড়ালে মেয়েটি বাসে ওঠে, জামিল হাত নেড়ে মেয়েটিকে বিদায় জানায়।
এই প্রথম কোনো মেয়ের সাথে জামিলের বন্ধুত্ব হলো। জামিল আজ দারুণ খুশি। নিজেকে তার সুখী মনে হয়। সে হলে ফিরে আসে না, ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়ায় আর মেয়েটির সাথে তার অনাগত সম্পর্কের ব্যাপারে সে কল্পনা করতে থাকে। তার ভালো লাগে। নিজেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয় তার।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলে মধুর ক্লান্তি নিয়ে সে হলে ফেরে। হলের বন্ধুদের সাথে সারা সন্ধ্যা চুটিয়ে আড্ডা দেয়, ক্যারম খেলে, রাত জেগে টিভিতে খেলা দেখে, মধ্যরাতে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের গেটের সামনে ডিম-পরোটা খেয়ে হানিফ ভাইয়ের দোকানে চা খায়। ভোর হলে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ে।
৩
পরদিন মালিহাসহ জামিলের পরিচিত কেউই জামিলের মৃত্যুর সঙ্গত কারণ খুঁজে না পেয়ে ‘বেঁচে থাকা’ জামিলের গল্প রোমন্থন করে আর নিজেদের ‘বেঁচে থাকা’র অন্তত একটা যথার্থ কারণ খুঁজে পায়।
[দ্রষ্টব্য: এই গল্প লেখার ক্ষেত্রে আন্তন চেখভের ‘কেরানির গল্প’ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তবে পাঠকমাত্র দুই গল্পের মৌলিক পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবেন।]