মায়ের চিঠি


ক্রিসমাসের দীর্ঘ ছুটি শেষে কম্পিউটার খুলে দেখি ইমেইলের স্তূপ জমেছে। আমার ইলেকট্রনিক মাকামে দরকারি-বেদরকারি এসব কোমলপত্রের আগমন ঘটে নিঃশব্দে। অন্তর্জালের সায়রে ভেসে নানান কিসিমের ইমেইল আসে অবিরত। মাঝে মাঝে চিঠিরা আসে বর্ষার ইলিশের ঝাঁকের মতো। সুপারভাইজার বা অধ্যাপকদের ইমেইল ছাড়াও সুপারশপ বা কসাইয়ের প্রমোশনাল লেটারও পাই। স্প্যাম মেইল আসে। মাঝে মাঝে বিরক্ত হই। আমি প্রথমেই অপ্রয়োজনীয় ইমেইল ডিলিট করি। সাথে সাথেই ইলেকট্রনিক মেইলের জবাব দেওয়া একধরনের শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে। জবাব দিই  নির্দিষ্ট কাঠামোয়। কারণে-অকারণে আমাকেও ইমেইল লিখতে হয়। ল্যাপটপের কিবোর্ডে আঙুল চালিয়ে দ্রুতলয়ে মুসাবিদা করি কাঠখোট্টা সব খুদেপত্র। মাউস নাড়িয়ে সেন্ট ক্লিক করি তর্জনীর টোকায়। অনলাইনে সওয়ার হয়ে নিমেষেই এসব চিঠি হাজির হয় কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির ঠিকানা-জিমেইলে, ইয়াহুতে। এখন আর গোটা গোটা হরফে পত্র লেখার খুব একটা বালাই নেই।

আমার বিলেতের ঠিকানায় কিছু ছাপানো চিঠিও আসে। ব্যাংক, ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কাউন্সিল বা লোকাল কাউন্সিল থেকে। ব্রিটিশ রয়াল মেইলের ব্যস্ত পোস্টম্যান এসে দরজায় ঠক ঠক করে রেখে যায় ছাপানো ব্যাংক বিবরণী, পানির বিল, বিদ্যুৎ বিল, সেমিনারের আমন্ত্রণপত্র বা ক্রিসমাস কার্ড। একবার বাড়িওয়ালি বুড়ির আদুরে কুকুরের জন্মদিনের দাওয়াতপত্র পেয়ে গেঁয়ো আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। বুকপোস্টে আসে জার্নাল। সবচেয়ে কষ্ট হয় যখন দেখি ড্রাইভিংয়ের টিকিট সুতানলি সাপের মতো দরজার নিচ দিয়ে নিঃশব্দে এসে হাজির হয়। এই টিকিটের মানে আর্থিক জরিমানা। কিন্তু হাতে লেখা ব্যক্তিগত কোনো চিঠি আর এখন পাই না। আর প্রেমপত্র তো কাঁঠালের আমসত্ত্ব। ডিজিটাল যুগের মানুষের কাগজে-কলমে চিঠি লেখার ফুরসতই-বা কই?

অথচ আমার মা চিঠিপত্র লিখতে বড্ড ভালোবাসতেন। তবে তা লালিত্যময় সাধু গদ্যে। বেশ আলসেমি লাগলেও খুব ছোট্ট করে মায়ের চিঠির জবাব দিতে আমারও ভুল হতো না। আস্তে আস্তে বড় হয়ে আমি মা থেকে দূরে সরে যাই। বারো বছরের উৎসুক কিশোরের নতুন ঠিকানা হয় স্কুল হোস্টেল। কয়েক দিন মায়ের জন্য মন খারাপ লাগলেও বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা আর বইয়ের রাজ্যে হারিয়ে যেতে আমার খুব একটা বিলম্ব হয় না। যত বড় হই, ততই দূরে ছিটকে পড়ি। ডাকাতিয়ার অবগাহন ছেড়ে বাথরুমের কাকস্নানে অভ্যস্ত হই। বয়ঃসন্ধিকালের উত্তেজনায় স্কুলের কামিনীর ঝাড়ের পাশে কোনো কিশোরীর নিছক ছায়া দেখেই ধন্য হয়ে উঠি। ভুল বানানে একটা দীর্ঘ প্রেমপত্র পর্যন্ত লিখে ফেলি। তাকে আবার ভুলেও যাই। স্কুল পাশ দিয়ে এক সময় কলেজে ভর্তি হই। পুরো ক্লাসে সহপাঠিনীর সংখ্যা হাতে গোনা। তারা অতি ভালো ছাত্রী। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার নেশায় মশগুল তরুণীরা সারাক্ষণ গম্ভীর মুখে পাঠ্যবই ঘেঁটে মলাট পর্যন্ত জীর্ণ করে ফেলে। ভাঙা বেঞ্চিতে বসে ‘আ মাদার ইন ম্যানভিল’-এর গল্প শুনে মিথ্যুক কিশোর অনাথ জেরির জন্য বুকে চিনচিনে কষ্ট হয়। আনমনা হয়ে গ্যালারি থেকে বেরোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ি। দুষ্ট ছেলেরা হইচই করে ওঠে। খঞ্জনা পাখির মতো উচ্ছল সহপাঠিনীরা খিল খিল করে হাসে। লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গিয়ে মাতৃভাণ্ডারের গরম গরম রসমালাই খাই। টমসম ব্রিজে এসে অন্য সহপাঠীদের দেখাদেখি বাসস্ট্যান্ডে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শ্রমিকদের সাথে ঝগড়া করি। একসময় মারামারি পর্যন্ত বেধে যায়। সেদিনই মায়ের চিঠি আসে, ‘আদর্শভাবে চলিও; সিঁদুরে গাছে থোকা থোকা আম ধরিয়াছে’। চিঠি পড়েই আমার জিভে জল এসে যায়। বিকালের দিকে দুই ছাত্র সংগঠন কী একটা ছুতোয় সংঘর্ষে জড়িয়ে গেল। বারুদের গন্ধ আর ককটেলের গগনবিদারী আওয়াজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাম্পাসে। ছাত্রাবাস বন্ধ ঘোষিত হওয়ায় এই প্রথম মারকুটে ক্যাডারদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেল। তাড়াতাড়ি ভাঙামলাটের একটা বই রেক্সিনের ব্যাগে পুরে জীর্ণ টেম্পুতে উঠি। 

অতি রূপবতী বলেই হয়তো সখীবেষ্টিত নির্মম যুবতীটি আমার দিকে ফিরেও চায় না। বরং ভ্রু পল্লবে উপেক্ষার হেয়ালি এঁকে অন্যদিকে তাকায়। তার কী একটা কথায় সখীগণ একজন অন্যজনের গায়ে গড়িয়ে পড়ে। ঝিরঝিরে বাতাসে জারুল ফুলও ঝরে পড়ে। তাদের কোমল চরণে এসব ভূপাতিত ফুলের পাপড়ি থেঁতলে যায়। প্রতিজ্ঞা করি, তরুণীর এই উপেক্ষাকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্যে এমন আবেগী চিঠি লিখব যে তা একসময় নিলামে উঠবে! আবার সেই উপেক্ষা ভুলতেও খুব একটা দেরি হতো না। সাঁঝের মায়ায় শামসুন্নাহার হলের ঝুপড়িতে বসে সুন্দরীদের হাসির বন্যায় ভিজে ছোলা-চা খাই। এই অকিঞ্চিৎকর খাবারও অমৃতের মতন লাগে।

কলেজের দু’বছর কেটে গেছে চোখের পলকে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হলাম। আইন অনুষদে। পাঠক্রমে দখল-মালিকানা, খুন-জখমের নিত্য কারবার। পাহাড়ি ক্যাম্পাসে হইচই করে দিন কাটে। ‘মউয়ের দোয়ানে’ মরিচ-পেঁয়াজ কামড়ে গরম গরম শিঙাড়া খাই। গগনবিদারী ভেঁপু শুনে দৌড়ে গিয়ে শাটল ট্রেনে উঠি। দল বেঁধে গান গাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনে যত চড়া হয়, তত পড়া হয় না। ক্যাম্পাসে আড্ডা দিই। পাহাড়ি জিরি দেখি। বন্য প্রাণী সুরক্ষার আন্দোলনে নামি। ছবির মতো ক্যাম্পাসে প্রিয়ংবদা মেয়েদের গল্প শুনি। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে গিয়ে গম্ভীরভাবে মোটা মোটা বই নেড়েচেড়ে দেখি। কিন্তু আইনগ্রন্থ বড়ই নিরস। চাকসু ক্যান্টিনে যাবার পথে কোনো এক এলোকেশীকে দেখে থমকে দাঁড়াই। অতি রূপবতী বলেই হয়তো সখীবেষ্টিত নির্মম যুবতীটি আমার দিকে ফিরেও চায় না। বরং ভ্রু পল্লবে উপেক্ষার হেয়ালি এঁকে অন্যদিকে তাকায়। তার কী একটা কথায় সখীগণ একজন অন্যজনের গায়ে গড়িয়ে পড়ে। ঝিরঝিরে বাতাসে জারুল ফুলও ঝরে পড়ে। তাদের কোমল চরণে এসব ভূপাতিত ফুলের পাপড়ি থেঁতলে যায়। প্রতিজ্ঞা করি, তরুণীর এই উপেক্ষাকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্যে এমন আবেগী চিঠি লিখব যে তা একসময় নিলামে উঠবে! আবার সেই উপেক্ষা ভুলতেও খুব একটা দেরি হতো না। সাঁঝের মায়ায় শামসুন্নাহার হলের ঝুপড়িতে বসে সুন্দরীদের হাসির বন্যায় ভিজে ছোলা-চা খাই। এই অকিঞ্চিৎকর খাবারও অমৃতের মতন লাগে। বন্ধুদের অনুরোধে গলা ছেড়ে গান গাই। উৎসুক কেউ কেউ হাসিমুখে ভাঙা-টেবিলে তবলার সঙ্গত দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এত আনন্দযজ্ঞে মন খারাপের ফুরসত কই? সম্ভবত মায়ের কথা মনেও পড়ত না খুব একটা।  

রাতে হলে ফিরে কখনো কখনো দেখতাম, মায়ের চিঠি এসেছে—‘শুদ্ধরূপে ইংরেজি পড়িও। আদর্শভাবে চলিও’। সারাটা রাত সেই লেফাফার অনিঃশেষ সৌরভই আমাকে বিভোর করে রাখত। চিঠি খুলে বারবার পড়ি। পরদিন ভাঙাচুরা পোস্টাপিসে গিয়ে মনিঅর্ডার বুঝে পেয়ে হোটেলে গিয়ে কলিজা-ভুনা মেখে ভাত খাই। হলে এসে অনেক দিন পর দিবানিদ্রা যাই। শিথানে আধখোলা রবি ঠাকুর বা বিভূতিভূষণের বই। সাহিত্যপত্রিকা কিনি। দেশবিদেশের সাহিত্যিকদের হট্টগোলে আমার মা নির্বাসিত হন বিস্মৃতির আড়ালে। দিন কেটে যায় হেলাফেলায়। পরীক্ষা ঘনিয়েছে বলে জিভ কেটে ব্রিটিশ আইনবিদ লর্ড মেকলের পা চেপে ধরি। দেবী সরস্বতীকে পাশ কাটিয়ে দ্বিচারী হয়ে একসময় আইনের দেবী থেমিসের আরাধনা শুরু করলাম। নতুন নিষ্ঠাবান ছাত্র হিসেবে অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে বসি। টেবিলে পড়তে বসলেই কত যে বাহানা আসে। মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটে। মায়ের কাছে আবার খুদেপত্র লিখি, ‘মা, টাকা দরকার’।  

পোস্টবক্স © ছবি: লেখক

একসময় আইনে স্নাতক হয়ে ঢাকায় এসে হাজির হলাম। মেসে বসে মায়ের চিঠিতে জানলাম, গ্রামের বাড়িতে সরকারি চিঠি এসেছে। বিসিএসের নিয়োগপত্র। মুখে কপট কাঠিন্য এঁকে মফস্বলের হাকিম হয়ে ন্যায়বিচার তালাশ করি। মাথায় সারাক্ষণ নথি-বালাম, দলিল-খতিয়ান, রায়-খালাস। বছর-দুয়েক নোয়াখালী-চট্টগ্রামের এজলাস ঘুরে নতুন কর্মস্থল সাগরকন্যা কুতুবদিয়াতে বদলি হলাম। তত দিনে চিঠির রাজত্বে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বগ্রাসী আগ্রাসন জেঁকে বসেছে। এখানেও  সনাতনী মায়ের চিঠি আসে—‘কাহারও সহিত ঝগড়া করিও না’। চামড়ায় বাঁধানো লর্ড মেকলের চুরিচামারি-খুনখারাবির ধারাপাত ‘পিনাল কোড’ এক পাশে রেখে মা’কে ফোনে বলি, আমি এখন ম্যাজিস্ট্রেট। মানুষের ঝগড়াঝাঁটি আর চুরি-চামারির বিচার-আচার তো করিই, চোর-ডাকাত-খুনি-তস্করকে জেলে পাঠাই। আমার ভয়ে হার্মাদের দল মহেশখালীর দ্বীপে পালিয়ে বেড়ায়। মা হাসেন নাকি কাঁদেন ঠিক বুঝতে পারি না। গুড়গুড় শব্দে মোবাইল ফোনের লাইন কেটে যায়। এত দূরে ফোনের নেটওয়ার্ক বেশ দুর্বল।

কয়েক বছর পর রাজকীয় বৃত্তি নিয়ে বিলেতে এসে হাজির হলাম। ঢেউ খেলানো ব্রিটিশ উচ্চারণ একদম দুর্বোধ্য লাগে। বাতাসের ঝাপটা এসে বুকে লাগে। পড়াশোনার কোনো কূলকিনারা পাই না। সারা দিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। কবর-সাইজের ডর্মে বসে বাহিরের দিকে তাকাই। ছায়াচ্ছন্ন গাছের আগায় ম্যাগপাই ছানারা আনন্দে হুটোপুটি খায়। পৃথুল এসব বিহগের তো অ্যাসাইনমেন্ট লেখার তাড়া নেই। রাঁধতে গিয়ে হিমশিম খাই। ক্যান্টিনের আলুনি খাবার মুখে দিয়ে মন খারাপ হয় খুব। মন চলে যায় কোনো এক লাজুক গাঁয়ে যেখানে উনুনে ইলিশ ভাজা হয়। নিউরনে ছ্যাত-ছ্যাত তরঙ্গ বয়! উজ্জীবিত হতে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলি। আজকাল তার সাথে প্রায় চেঁচিয়েই কথা বলতে হয়। নিঃশব্দ ব্রিটিশ পথচারী ভ্রু কুচকে তাকায়। বাঙালি কেউ মুচকি হাসে। মায়ের কানও কি গেছে? মায়ের হাতে কি সেই পুরোনো নকিয়া সেট? শেষের দিকে মায়ের কথা জড়িয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে জটিল সব গবেষণা নিয়ে অনর্গল কথা বলি। স্নাতক ক্লাসের শিক্ষার্থীদের নিয়ে টিউটরিয়ালে বসি, তাদেরকে অ্যাসাইনমেন্ট রচনার সহি তরিকা শেখাই। কিন্তু এখন ফোন বুকে নিয়ে আমিও মূক হয়ে বসে থাকি। 

বাংলাদেশে দেখেছিলাম, তরুণ-তরুণীদের অনেকে আবার ইংরেজির মিশেলে জগাখিচুড়ির ভাষায় কথা বলত। তারা কি বিশুদ্ধ বাংলায় লিখতে গিয়ে হোঁচট খায় ব্যাকরণের প্রহেলিকায়? শুনেছি, ‘স্মার্ট’ শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলা ভাষার সাহিত্যিকেরা নাকি এখন ব্রাত্যজন। সবাই হুড়মুড় করে ব্যবসায় পড়ে, যন্ত্র পড়ে, তথ্যপ্রযুক্তি পড়ে। কিন্তু মানুষ পড়ে না। জানি না, ইতিহাস-দর্শন-সাহিত্যও কি পাঠ করে ইউটিউব বা উইকি-আসক্ত এই কেতাদুরস্ত প্রজন্ম? বাংলা ভাষার প্রতি করপোরেট বেনিয়ারা বুঝি ‘পার্মানেন্ট ইনজাংশন’ জারি করেছে?  

একদিন টিউটরিয়াল নেওয়ার সময় শুমারি করে দেখলাম, পুরো ব্যাচের একজন শিক্ষার্থীও কখনো কাগজে-কলমে কোনো পত্র লিখেনি? দু-একজন ছাত্রী শরমিন্দা মুখে জানিয়েছিল, তারা প্রথম-যৌবনে বেশ কিছু চিঠি পেয়েছিল। এর মাঝে অনেকগুলো ছিল বেনামি পত্র। তারা অতি আবেগী সেসব চিঠির জবাব দেওয়ার তাড়া অনুভবই করেনি। উৎসুক শিক্ষার্থীদের আমি শোনালাম মির্জা গালিবের কথা। ব্রিটিশদের উদ্যোগে সুসংহত পোস্টাল সার্ভিস চালু হলে তরুণ মির্জা প্রেমিকাকে প্রায়শই চিঠি লিখতেন। দীর্ঘদিনেও চিঠির জবাব না পেয়ে তিনি প্রেমিকাকে আবার অভিমানে চিঠি লিখলেন, ‘চিঠির উত্তর যদি না-ই দেবে, তবে কেন উত্তর দিচ্ছ না, তা-ই লিখে পাঠাও’। এ যুগে চিঠিও নাই, তাই হয়তো ফিরতি চিঠিও নাই। এত সূক্ষ্ম অভিমানও কি আছে? ঠিক জানি না, এখনকার তরুণ-তরুণীরা কি কাগজে-কলমে কিছু লিখে? নিতান্ত বোকা ছাড়া কেউ কি চিঠির প্যাডে আলপনার প্রহেলিকা আঁকে? নিপুণ আঁচড়ে লেফাফা রচে? থরো থরো অনুভূতির কথাই-বা কীভাবে চয়ন করে প্রেমিকের দল? তরুণীরা কি ইমেইল বা মেসেঞ্জারের বার্তা প্রিন্ট করে বুকে জড়িয়ে ধরে! সুন্দর হস্তলিপিও তো নির্বাসিত। সব অনুভূতিই কি মেসেঞ্জার বার্তা বা ফেসবুকে লিখা হয়। গোপন কথা বলতে গিয়ে কোনো লাজুক মেয়ের পুরন্ত ঠোঁট কি আজ আড়ষ্ট হয় না? চিঠির রাজ্য কি প্রযুক্তির সাঁড়াশি আক্রমণে তছনছ হয়ে গেছে? কাগজে-কলমের পত্র কি নিষিদ্ধ কোনো ইশতেহার? বাংলাদেশে দেখেছিলাম, তরুণ-তরুণীদের অনেকে আবার ইংরেজির মিশেলে জগাখিচুড়ির ভাষায় কথা বলত। তারা কি বিশুদ্ধ বাংলায় লিখতে গিয়ে হোঁচট খায় ব্যাকরণের প্রহেলিকায়? শুনেছি, ‘স্মার্ট’ শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলা ভাষার সাহিত্যিকেরা নাকি এখন ব্রাত্যজন। সবাই হুড়মুড় করে ব্যবসায় পড়ে, যন্ত্র পড়ে, তথ্যপ্রযুক্তি পড়ে। কিন্তু মানুষ পড়ে না। জানি না, ইতিহাস-দর্শন-সাহিত্যও কি পাঠ করে ইউটিউব বা উইকি-আসক্ত এই কেতাদুরস্ত প্রজন্ম? বাংলা ভাষার প্রতি করপোরেট বেনিয়ারা বুঝি ‘পার্মানেন্ট ইনজাংশন’ জারি করেছে?  
সেদিন সুপারভিশন মিটিংয়ে মুখ্য পরিচালকের বকা খেয়ে ফিরে এসে পুরো কক্ষ খানাতল্লাশি করেও মায়ের লিখা কোনো চিঠি খুঁজে পেলাম না। আমার মন খারাপের দাওয়াই যে আমার মায়ের চিঠি। বাসাবদলের কারণে মায়ের অমূল্য সব চিঠি কি হারিয়ে গেছে? এই পাণ্ডববর্জিত শীতল জনপদে আমার সেই সব সঞ্জীবনী পত্র কোথায় পাই? ইশ্‌, কেন যে মায়ের চিঠিগুলো যে স্ক্যান করে রাখিনি। মন খারাপ করে চলে যাই সপ্তাহান্তের পার্টিতে। স্টুডেন্ট ইউনিয়নের আলোর বন্যায় শিক্ষার্থীরা নেচে-গেয়ে ফেটে ফেটে ওঠে। মিউজিক হয় ঊর্ধ্বমুখী। তৃষ্ণার্তরা মদিরায় চুমুক দেয়। আধমাতাল কেউ বাইরের বেঞ্চিতে বসে বিড়বিড় করে ব্যস্ত সুপারভাইজারের মুণ্ডুপাত করে। আমার কেন যেন ইচ্ছে করে মাকে একটা চিঠি লিখতে। মাথা ঝিম ঝিম করে। পার্টি হতে নিঃশব্দ বিদায় হই। ডর্মে ফেরার পথে হিমহিম ঠাণ্ডায় আমার যে মায়ের রান্নাকরা খিচুড়ির স্বাদ পেতে ইচ্ছে করেছিল—তা কী করে বিদেশি বন্ধুকে বলি। বরফরঙা সহপাঠিনীর আদুরে ওষ্ঠের পুঞ্জীবিত বরফকণা যে আমায় অনির্বচনীয় অভিযাত্রায় ডেকেছিল, তা কি কাউকে মুখ ফুটে বলা যায়? 

বিলেত থেকে আমার পত্রবিলাসী মাকে অনেক বছর পর একখানা পত্র লিখি। শাদা কাগজে, বড় বড় অক্ষরে। নইলে বুড়িয়ে-যাওয়া মা পড়বেন কী করে? রোগে-শোকে কাবুও হয়ে গেছেন বেশ। জ্যেষ্ঠ আত্মজের অকালপ্রয়াণে তিনি এখন অনুভূতিহীন। ফোনে শুধু কাতরস্বরে বলেন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। তবে গাফিলতি কোথায় হয়েছে জানি না, বিলেতের রাজকীয় পোস্টাল সার্ভিসের নাকি আমাদের ডাক বিভাগের। আমার সে-চিঠি মায়ের কাছে কখনো পৌঁছায়নি। বিলেতের রয়্যাল মেল বেশ দক্ষ প্রতিষ্ঠান, তার ভুল হবার কথাটা ঠিক ধোপে টেকে না। অবশ্য আমাদের গাঁয়ের বুড়ো ডাকহরকরা বা পোস্টম্যানকে সব সময় আন্তরিকই দেখেছি। ডাক্তার চাচার চিঠি আসত সুদূর আমেরিকা থেকে। আমরা হুমড়ি খেয়ে ডাকটিকিট সংগ্রহ করতাম আর দাদি সেই মহার্ঘ্য চিঠি বুকে জড়িয়ে ধরতেন। কারও মনিঅর্ডার এলে তো পুরো পাড়ায় আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেত। পোস্টম্যান রংজ্বলা-ছাতার শীর্ষ মাটিতে গেঁথে কার্বন কাগজের দোকরে সাবালক কারও স্বাক্ষর নিতেন। সেই নিষ্ঠাবান ডাকপিয়নের কোনো দিন ভুল হয়নি। আর্টিকেল আর ব্লগ লিখতে সিদ্ধহস্ত হলেও আমি কি বেখেয়ালে প্রাপকের ঠিকানা লিখতে ভুল করেছি? না, মায়ের ছেলের কি মায়ের নাম-ধাম লিখতে ভুল হবার কথা? অবশ্য সেদিন ভারতীয় এক সহপাঠিনীর কাছে শুনেছি, আশির দশকে ‘খুশবন্ত সিং, বাস্টার্ড, ইন্ডিয়া’ শুধু এই অসম্পূর্ণ ঠিকানার এক চিঠিও নাকি দিল্লি ডাক বিভাগের অকল্পনীয় দক্ষতায় ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিং-এর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল! আমাদের ডাক বিভাগ হয়তো অতোটা সক্ষম হয়ে ওঠেনি। জানতে পেরেছি, আজকাল আমাদের গাঁয়ের ডাকঘরে বসে নতুন পোস্টম্যান দুয়েকটা সঞ্চয়ী হিসাব লিখে আর সমনের চিঠি বিলি করে আধো-ঘুমে মাছি তাড়ায়। আজ আর সনাতনী চিঠির লেখকও নাই, প্রাপকও নাই। কাগজের চিঠি বুঝি এখন ডুমুরের ফুল!
আমিও এখন আর কাগজে-কলমে পত্র লিখি না। চর্চার অভাবে ণত্ব বিধান–ষত্ব বিধানে ইদানীং ভজকট হয়। হাতে চিঠি লিখার যুগ পার হয়েছে কত আগে। তবু মা কিছুদিন আগেও কিশোরীর উচ্ছ্বাস নিয়ে চিঠি লিখতে বসেন। হাত কাঁপে, তবু চিঠি লেখায় তিনি অক্লান্ত। তার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়েছে বলে লাইন বাঁকা হয়ে যায়, কাটাকুটি হয়। প্রাগৈতিহাসিক মা’কে নিয়ে বাড়ির সবাই হাসে। মা চিঠি লেখা বন্ধ করে সুপারিবনের আলো-ছায়ায় মন্থর পায়ে হেঁটে হেঁটে চিঠির ভাষা আওড়ান, ‘কাহারও সহিত ঝগড়া করিও না। বিলেত শীতল দেশ, বরফে ঠাণ্ডা লাগাইও না।’