দর্শনের বিন্দু বিন্দু আখ্যান
নাম শুনেই মনে হয়, না জানি দর্শনের কী খটমট বই। আসলে এক শব্দের একটা করে নাম দিয়ে মোট আটটা রচনা। খুব কাব্যিকভাবে মজা করে একেকটা বিষয় নিয়ে বলে গেছেন ঝরনার মতো। রেফারেন্স দিয়ে ক্লান্ত প্রবন্ধ নয়, তবে পড়তে পড়তে পাঠকের মাথায় চিন্তার একটা অদলবদল হয়। ভাষা, নৈঃশব্দ্য, স্থান, মানচিত্র, সাবান, আখ্যান, গন্ধ, বিন্দু এই আটটা বিষয়। মনে হয় এই শব্দগুলো নিয়ে কী এমন বলা যায়। কত কিছু যে বলা যায়, পড়তে পড়তে মিলে যায় অনেক উত্তর আবার তৈরি হয় নতুন প্রশ্ন। উপরি হিসেবে পাওয়া যায় লেখকের চমৎকার কৌতুকপ্রিয়তা আর অনুবাদ কবিতা।
প্রথম আখ্যান—ভাষা
কোনো একটা সিনেমায় দেখেছিলাম, এক এলিয়েন এসেছে পৃথিবীতে, ঘুরে-টুরে ফিরে যাওয়ার সময় বলছে, দুনিয়ার সবচেয়ে আজব জিনিস হলো ভাষা। যদি সারা পৃথিবীর মানুষ একটা ভাষায়ই কথা বলত, তাহলে কেমন হতো? ভাবাই যায় না। ভাষার নাকি নিরানব্বইটা নাম দেওয়া সম্ভব। তবে সবচেয়ে যুৎসই হয় মধ্যস্থতাকারী বললে। নিজের সঙ্গে চৈতন্যের, চৈতন্যের সঙ্গে বস্তুজগতের এবং বস্তুজগতের সঙ্গে নিজের মধ্যস্থতা করে ভাষা। পৃথিবীকে আমরা চিনি ভাষার ভেতর দিয়ে। বিশুদ্ধ চিন্তা বলে যেমন কিছু নেই, বিশুদ্ধ ভাষা বলেও কিছু নেই। জ্যামিতির ভাষা অথবা গানের ভাষা, ব্যাকরণের ভাষা অথবা বিজ্ঞানের ভাষা কিছুই স্থির নয়। ভাষা কেবল কথা, লেখা বা ইশারা নয়, ভাষা দেহজ । মার্কস, এঙ্গেলস থেকে লালনকে হাজির করে বলা যায় ভাষার ভূমি দেহ, দেহ নেই তো ভাষাও নেই। দুনিয়ায় যেভাবে ভাষা কাজ করে তা পরখ করে দেখার অজস্র পদ্ধতি আছে। ভাষা উৎপাদিত হয়, হয় বলেই ভাষিক মূল্য তৈরিতে শ্রমের মূল্য আছে। আবার ভাষিক চিহ্ন ছাড়া মতাদর্শের উৎপাদন সম্ভব নয়।
ভাষা নিজেই সংস্কৃতির রূপ নিতে পারে, কেননা ভাষা হতে পারে একটি জনপদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সমষ্টিগত স্মৃতির সঞ্চয়ক্ষেত্র। ভাষা নিজেই নিয়ামক হয়ে ওঠে কখনও কখনও, যেমন কোনো কিছুকে প্রকাশ করতে পারে তেমন প্রচ্ছন্নও করতে পারে। ভাষা হতে পারে শ্রেণি-সংগ্রাম, বর্ণ-সংগ্রাম, লিঙ্গ-সংগ্রাম এবং জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের এলাকা।
এবং কবিতায় ভাষা কী চেহারা নেবে সেটা বলতে গিয়ে ফরাসি কবি স্তেফান মালারমেকে হাজির করেছেন। বলা হয়ে থাকে মালারমেকে অনুবাদ করা যায় না, কারণ তিনি কবিতাকে চুড়ান্ত সাঙ্গীতিকতা দিতে চেয়েছিলেন। ভাষা নিয়ে আখ্যানে যুক্ত হয়েছে লেখকের অনুবাদে মালারমের দুটি দীর্ঘ গদ্য কবিতা এবং হিস্পানিক কবি ভিসেন্ত আলেইহান্দ্রের একটি। তিনটি কবিতা পড়তে পড়তে ভাষা নিয়ে তৈরি হয় নতুন এক নৈঃশব্দের যাত্রা।
দ্বিতীয় আখ্যান—নৈঃশব্দ্য
ভাষা যেমন খুব শক্তিশালী, নৈঃশব্দ্যও। ভাষা যেখানে গিয়ে নীরবতায় শেষ হয়, সেখানে প্রেম। আর নীরবতা যেখানে গিয়ে ভাষায় ফেটে পড়ে সেখানে বিদ্রোহ।
নৈঃশব্দ্য দেখা যায়, শোনা যায়, শোঁকা যায়, চাখা যায়। বিরহব্যথা গভীর হতে হতে ব্যথা রূপান্তরিত হয় নৈঃশব্দ্যে। কথার আদিতে ও অন্তে থাকে নৈঃশব্দ্য। শব্দ থেমে গেলে যা থাকে তাই নিঃশব্দের সুষমা। সুরের ঝংকার থেমে গেলে সুর মুছে যায় না, থাকে নৈঃশব্দ্যের মণিকোঠায়। নৈঃশব্দ্য আর শূন্যতা এক নয়। লালন বলেন—
নয় এ চার শূন্য দিলে
নব্বই হাজার কয় দলিলে
সব শূন্য মুছে ফেলিলে
শুধু যে নয়ের খেলা
নৈঃশব্দ্য অঙ্কের ভেতরে থাকে শূন্য হয়ে থাকা আর না থাকায় শূন্যতা আর নৈঃশব্দ্য একাকার হয়ে যায় কখনও কখনও। মৃত্যু দিয়ে এই অঙ্ক সবচেয়ে ভালো মেলে।
নৈঃশব্দ্যের আছে আলোকবাজি, শব্দের ঊনপঞ্চাশটি গলি ধরে নৈঃশব্দ্য হাউকাউ করে।
অন্তহীন নৈঃশব্দ্য দার্শনিক পাসকালকে তাড়া করে ফিরেছে দিনের পর দিন। বুঝেছিলেন, শব্দকে থামানো যায়, নৈঃশব্দ্যকে নয়। নৈঃশব্দ্য এমন এক তীব্রতা, যা দিয়ে ভালবাসা ও ঘৃণা দুই-ই প্রকাশ করা যায়। নৈঃশব্দ্য দিয়ে সত্য বলা যায়, মিথ্যাও বলা যায়। মারটিন লুথার কিং বলেছেন, শত্রুর সমালোচনার চেয়েও বন্ধুর নীরবতা হৃদয়বিদারক। এই আখ্যানটিও শেষ হয়েছে কালো কবি এলেকসিস নিউন্দাইয়ের কবিতা দিয়ে।
তৃতীয় আখ্যান—স্থান
ইতিহাসের স্থান, পদার্থবিদ্যার স্থান, জ্যামিতির স্থান, মানচিত্রের স্থান, রূপকথার স্থান। এটা এত ব্যাপক এক শব্দ, মনে হয় যেন এর মধ্যে ঝাপ না দিলেই ভালো হতো। কিন্তু লেখক দিয়েছেন যখন, একটা কিনারা তো করেই ছাড়বেন। গিলগামেশ বা রামায়নের মহাকাব্যিক স্থানের নায়কেরা কিছুই নয় স্থান ছাড়া। দান্তের ডিভাইন কমেডি থেকে তার বিচিত্র স্থান যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে মহাকাব্যটি ভেঙে পড়তে বাধ্য। আরব্য রজনীতেও আছে ক্রমাগত স্থান থেকে স্থানান্তরের গল্প। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আছে ঢাকা, জেমস জয়েসের ডাবলিন। কবিতা জুড়েও আছে স্থান, বনলতা সেনের নাটোর।
যুগে যুগে দেশে দেশে স্থানের লড়াই থামেনি কখনও। নেটিভ আমেরিক্যান লেখক লেজলি মারমোন সিল্কো তার মহাকাব্যিক আয়তনের উপন্যাস এলমানাক অব ডেড-এ সেই চিরায়ত চিৎকারে ‘ভূমি আগে প্যাচাল পরে’ আকাশ বাতাস কাঁপিয়েছেন। ইতিহাসের যেমন স্থান আছে, স্থানেরও আছে ইতিহাস। স্থান রাজনৈতিক, বিশ শতকের কালো নারীবাদী কবি-তাত্ত্বিক-এক্টিভিস্ট অড্রে লর্ড তাই জোরালোভাবে বলেছেন, নামহীনকে নাম দাও, যাতে তা নিয়ে চিন্তা করা যায়। দেশ নিয়ে ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত লড়াইয়ের ইতিহাস বা স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সবই স্থানের কবিতার পঙক্তি।
সাবানই সভ্যতা, সাবান না মাখতে জানলে সে অসভ্য বর্বর। কে আপনার কানে, কেন এই মন্ত্র দিয়েছে? এটা মামুলি ব্যাপার নয় কিন্তু। সাবানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উপনিবেশবাদ, পুরুষতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদসহ সকল আধিপত্যবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক। সভ্যতা শেখানোর দোহাই দিয়ে নিরন্তর শোষণ চলেছে। এশিয়া ও আফ্রিকাকে ধোঁকা দিয়ে ইউরোপে সম্পদের পাহাড় উঠেছে। দৃশ্যত আর উপনিবেশবাদ না থাকলেও শোষক ও শাসিত দুই তরফের মগজেই রয়ে গেছে প্রভাব। কালোরা এখনও মনে করে সাদাই শ্রেষ্ঠ, সাদারাও মনে করে তারাই যোগ্য দাবিদার। এশিয়া ও আফ্রিকা মনে করে ইউরোপই সকল ভালোর আস্তানা। আবার সাবানই সভ্যতা এই স্লোগান দিয়ে মুনাফার স্বার্থেই বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে সাবানের বাজার। বাজারই মানুষকে আচ্ছন্ন করে, বলে কী তোমার দরকার...
চতুর্থ আখ্যান—মানচিত্র
এইবার পাঠকের পরীক্ষা! স্থানের পরেই এসে গেছে মানচিত্র। স্থানের নানান অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে যখন মনে হবে, স্থান আসলে মানচিত্রই তো। তখনই নতুন আখ্যান নিয়ে যাবে মানচিত্রকলার অর্থনৈতিক আঙিনায়। মিশরেই প্রথম মানচিত্র তৈরি করার কাজটা এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পায়। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থেই মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু হয়। আবার গ্রিক মানচিত্রবিদ্যার ভিত্তিতেই আছে জ্ঞানোৎপাদনের বিষয়টি। ইতিহাসবিদ মারটিন বারনালের সাড়া জাগানো গ্রন্থ ব্ল্যাক এথিনায় বলেছেন, আফ্রো-আরব এবং এশীয় জ্ঞানোৎপাদন ছাড়া গ্রিক ও রোমান সভ্যতা সম্ভব হতো না।
পিথাগোরাসের কল্পনায় পৃথিবীই মহাজগতের কেন্দ্র, হেরেডটাস গ্রিসকে কল্পনা করেছিলেন পৃথিবীর কেন্দ্র। বহুকাল পরে টলেমি পৃথিবীর আট হাজার স্থান শনাক্ত করে দ্রাঘিমাংশ অক্ষাংশ নির্ধারণ করে মানচিত্রের ধারণাই বদলে দিলেন।
এবার হৃদয়ের মানচিত্র। স্থান আর মানচিত্র এখানে একাকার। ঘাসসান কানাফানি জানাচ্ছেন, ১৯৪৮ সালের পরে ফিলিস্থিনি সাহিত্যে অবরুদ্ধ আর নির্বাসিত দুইটি ধারা তৈরি হয়। এই মানচিত্রের বেদনা তারা আজও বয়ে চলেছে, এর যেন সমাধান নেই। মুক্তিকামী মানচিত্রবিদ্যা নিজেই লড়াইয়ের ময়দান। আর মানচিত্রের ফয়সালা হলেও হৃদয়ের মানচিত্র যে পুড়তেই থাকে, ভারতবর্ষের চেয়ে কে আর বেশি জানে তা।
পঞ্চম আখ্যান—সাবান
হ্যাঁ গোসেলের সাবান, সুগন্ধি সাবান। স্থান এবং মানচিত্র নিয়ে নানান জটিল কথা শুনে এসে ধুম করে সাবান, ঠোঁটে হাসির রেখাই ফুটে উঠবে পাঠকের। কিন্তু নিদারুণ এক সাবান অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে আপনার। সাবানই সভ্যতা, সাবান না মাখতে জানলে সে অসভ্য বর্বর। কে আপনার কানে, কেন এই মন্ত্র দিয়েছে? এটা মামুলি ব্যাপার নয় কিন্তু। সাবানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উপনিবেশবাদ, পুরুষতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদসহ সকল আধিপত্যবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক। সভ্যতা শেখানোর দোহাই দিয়ে নিরন্তর শোষণ চলেছে। এশিয়া ও আফ্রিকাকে ধোঁকা দিয়ে ইউরোপে সম্পদের পাহাড় উঠেছে। দৃশ্যত আর উপনিবেশবাদ না থাকলেও শোষক ও শাসিত দুই তরফের মগজেই রয়ে গেছে প্রভাব। কালোরা এখনও মনে করে সাদাই শ্রেষ্ঠ, সাদারাও মনে করে তারাই যোগ্য দাবিদার। এশিয়া ও আফ্রিকা মনে করে ইউরোপই সকল ভালোর আস্তানা। আবার সাবানই সভ্যতা এই স্লোগান দিয়ে মুনাফার স্বার্থেই বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে সাবানের বাজার। বাজারই মানুষকে আচ্ছন্ন করে, বলে কী তোমার দরকার। নারীবাদী সংস্কৃতিতাত্ত্বিক আন ম্যাকক্লিনটন বলেছেন, সাবানকে সভ্যতার নামে চালাতে গিয়ে আসলে বলা হচ্ছে সাদাই সৌন্দর্য। সাদাই সুন্দর, সাদাই সভ্যতা, সাদাই পবিত্র, সাদাই পরিস্কার—তাই সাবান চাই। নানামাত্রিক ধোকার আয়োজন চলে সভ্যতার নামে। সাবান এখানে তাই ধোঁকার উপকরণ মাত্র নয়। সৌন্দর্যের ধারণা মোটেই নিরীহ ও নিরপেক্ষ নয়। কখনও কখনও সৌন্দর্য দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের মুক্তির বিপক্ষে।
ষষ্ঠ আখ্যান—আখ্যান
এই অধ্যায় নিয়ে বলবার নেই তেমন কিছু। এটা মামুলি এক আখ্যানই। জ্যাক দেরিদার লাইভ বক্তৃতা শোনার একটা মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন লেখক। ‘টাইপরাইটার রিবন: লিমিটেড ইংক’ নিয়ে টানা চারঘণ্টা কথা বলেছেন দেরিদা। ক্লান্তিহীন খইয়ের মতো ফুটেছে কথা, কথা শুধু কণ্ঠ দিয়ে বলছেন না, বলছেন পুরো শরীর দিয়ে। মজার অভিজ্ঞতাই বটে। লিমিটেড কালির বদলে আনলিমিটেড কথা। সব শেষে লেখকের উপসংহার: দেরিদা আসলে বুঝিয়েছেন, চিহ্ন মোছারও চিহ্ন থাকে।
সপ্তম আখ্যান—গন্ধ
এই একটা শব্দের সামনে দাঁড়িয়ে পড়া শুরু করার আগে কত কী খেলে যায় মাথায়। পড়া শুরু করে শেষ করতে করতে কত শত স্মৃতি জাগানিয়া, ঘুম ভাঙ্গানিয়া সুবাসে মন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। গন্ধ থাকে মায়ের আঁচলে, বাবার জুম্মাবারের পাঞ্জাবিতে আতরের গন্ধ, বোনের মেহেদীর গন্ধ, ভাইয়ের ফুল বাগানের গন্ধ। এক জীবনে এসব সঙ্গে সঙ্গে থাকে। গন্ধ থাকে কবি হাফিজের গজলে গজলে জায়নামাজে শরাবে। জীবনানন্দের চিলের ডানায় লেগে থাকা রোদেলা গন্ধ, দুপুরের স্তব্ধ জলের ক্লান্ত গন্ধ, ঘুঙুরের মতো বেজে চলা নদী-মাঠ- ভাঁট ফুলের গন্ধ। গন্ধ আছে সুকান্তের রুটিতে ও চাঁদের আলোতে। গন্ধ থাকে বারুদের, বিপ্লবের। গন্ধ থাকে একলা কফিতে, আড্ডার চা’য়ে। শিশুর চুলে গন্ধ, প্রেমিকার স্পর্শের গন্ধ, গরম ভাতের গন্ধ। এইসব পাগলামি পরাবাস্তব হয়ে ওঠে যেন হলুদের গন্ধের মতো। বেলি, বকুল, শিউলি আলাদা হয়ে ধরা দেয় যেন অচেতন মরমিয়া সুর হয়ে।
শেষ আখ্যান—বিন্দু
এক বিন্দু শিশিরের কাছে যেতে হয় চোখে আলো নিয়ে।
ধবধবে সাদা কাগজের মাঝখানে কলমের নিবের এক ছোট্ট বিন্দু বদলে দেয় গোটা পাতা। কে তাকে প্রথমে বিন্দু বলে ডেকে উঠল। জ্যামিতিই তাকে প্রথমে বশ করতে চেয়েছে। কবিতাও জানে বিন্দুর মাহাত্ম। আর জানে তৃষ্ণার্ত, এক ফোটা জলের মর্ম। গালিব জানেন একবিন্দু মদের তৃষ্ণা। সাধক কবীরের গানে পাওয়া যায় বিন্দুতে সিন্ধু—
সিন্ধুর ভেতরে বিন্দু গলে
দেখে তা সবাই
বিন্দুর ভেতরে সিন্ধু থাকে
দেখে না তা কেউ।
সনাতন জ্যামিতির বয়ানে বিন্দুর আকার আছে কিন্তু আয়তন নেই। কিন্তু কবিতায় আহে মায়াবী বিন্দু ছায়াসহ। দুর্দান্ত গণিত-জানা ফরাসি কবি পল ভ্যালরি কবিতা লিখবেন বলে দীর্ঘকাল নৈঃশব্দের সাধনা করে গেছেন, কবিতা লিখবেন বলেই গণিত চর্চা করে গেছেন। বলেছেন, কবিতা কখনও সমাপ্ত হয় না, কেবল তার লেখন বন্ধ হয়।
জীবনানন্দে পাওয়া যায় কয়েকদণ্ড অনন্তের খোঁজ। যেন বিন্ধুতেই থেমে থাকে সব।
বিন্দুতেই থেকে যায় বাক্য, আবার বিন্দুর পরেই শুরু হয় কথা। অশ্রুবিন্দু এক মুহূর্তে বলে যায় হাজার অভিমান। হিস্পানিক কবি ফেদেরিক লোরকার কবিতার অনুবাদ দিয়ে শেষ হয়েছে বিন্দুআখ্যান।
সবুজ শাখা
ছন্দ আর পাখি ছাড়া
ফুঁপিয়ে কাঁদার একটি প্রতিধ্বনি
যন্ত্রণা বা ওষ্ঠ ছাড়া
চোখের পানি ফেলে যাই
নুন সমুদ্রের কিনারায়।
আমার চোখের তারায়
দুটি সাগর গান গেয়ে যায়।
বইটির একমাত্র অসুবিধা হলো, একেকটি আখ্যান অনুচ্ছেদ আকারে না লিখে নম্বর দিয়ে দিয়ে ভাগ করা। সাধারণত একেকটা অধ্যায়ের এরকম নম্বরিকরণে অভ্যস্ত আমরা। আখ্যানগুলোর কোনো কোনোটিতে ত্রিশ চল্লিশটা পর্যন্ত নম্বর দিয়ে এমন অনুচ্ছেদ আছে। কোনো অনুচ্ছেদ এক লাইনের, কোনোটা আধাপৃষ্ঠা, কোনোটা দুই পৃষ্ঠা। কোনো কোনো বিষয়ের বয়ান আরো বিস্তৃত হলে পাঠের শূন্যতা সৃষ্টি হতো না। আবার কারো কাছে এটা আরামদায়কও লাগতে পারে। কিন্তু মাত্র দেড়শ পৃষ্ঠার একটা বইয়ে এত এত কথা ধরে, যেন বিন্দু বিন্দু শিশিরের ঝর্ণাধারা।