
পূর্ববঙ্গের আলোকচিত্র চর্চার ইতিহাস!
বাঙালির ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্র সেভাবে প্রসারিত নয়। এখানে গবেষক কম। যাঁরা আছেন, তাঁদের জন্য সুযোগও কম। রুটিরুজির জন্য তাঁদের অন্য কিছুতে জড়িয়ে থাকতে হয়। তাই বঙ্গের ইতিহাস নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ কাজ কমই হয়েছে। আর বিভক্ত বাংলার হিসাবে বললে কলকাতায় যেভাবে কাজ হয়েছে, ঢাকায় সেভাবে হয়নি। ওপার বাংলার গবেষকেরা আবার যা করেছেন, সেখানে নামকরণে অবিভক্ত বঙ্গ বলছেন, অথচ অনেকটাই এড়িয়ে গেছেন এপার বাংলাকে। কলকাতার ওপর যেভাবে আলো ফেলেছেন, সেভাবে ফেলেননি ঢাকার ওপর। তাই সেসব কাজও অপূর্ণই রয়ে গেছে। এর বাইরে নয় বাংলার আলোকচিত্রের ইতিহাস গবেষণা। পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি: রাজসাক্ষী গোলাম কাসেম ড্যাডি বইখানি পাঠের শুরুতেই এমন উপলব্ধি হতে পারে পাঠকের। কেননা, এমন আক্ষেপে ভরা ভূমিকা দিয়েই শুরু করেছেন নাসির আলী মামুন।
আলোচ্য বইয়ের বেলায় মামুন একজন লেখক, একজন গবেষক। কিন্তু নেশা বা পেশাজীবনে তাঁর প্রধান পরিচয় আলোকচিত্রী হিসেবে। আদতে তিনি আমাদের ক্যামেরার কবি। বাংলাদেশের গুণীজনদের মুখাবয়ব নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় অন্য মাত্রা পেয়েছে। শুধু মুখচ্ছবি নিয়ে তৃপ্ত নন মামুন; এর পাশাপাশি খ্যাতিমানদের হাত দিয়ে কিছু আঁকিয়ে আনেন। আর কিছু না হলেও কালি-কলমে তাঁদের সই নিয়ে রাখেন সাদা কাগজে। তাঁদের পরশ পাওয়া বা ব্যবহৃত নানা কিছু সংগ্রহ করেন। আমরা দেখি, মামুন নিয়েছেন অনেক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকারও। যেসব বয়ান পরে এসে গবেষণার বড় রসদে রূপ নিয়েছে, বড় রকমের তথ্যসূত্রের ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। তিন দশকের বেশি সময় আগে নেওয়া এমন এক সাক্ষাৎকার থেকে মামুন নিজেই লিখলেন, পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি: রাজসাক্ষী গোলাম কাসেম ড্যাডি।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ছবি তোলা হয় ১৮২৭ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে। ভারতবর্ষে তখন ইংরেজ শাসন প্রায় ভিত্তি পেয়ে গেছে। তাদের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে শহর কলকাতা। সেই শহরে ক্যামেরা চলে আসতে সময় লাগে না। মাত্র এক যুগের ব্যবধানে ১৮৪০ সালে কলকাতার বাবু-সমাজ ক্যামেরার আলোছায়ার খেলায় গড়া মোটা কাগজে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখার সৌভাগ্য অর্জন করে। শহর ঢাকার কেউ কিংবা খোদ ঢাকায় প্রথম আলোকচিত্র তোলা হয় কবে? ঢাকায় কে প্রথম ক্যামেরা হাতে নিয়েছেন? এসব প্রশ্ন সামনে রেখে নাসির আলী মামুন লিখেছেন, ‘জানা যায়, ঢাকার নওয়াব পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা খাজা আলীমুল্লাহ, যাঁর জন্মতারিখ অজ্ঞাত, তিনি পূর্ব বাংলার প্রথম ব্যক্তি, যিনি নিজের ছবি তুলেছিলেন। তবে সে ছবির আলোকচিত্রী বা স্টুডিওর নাম ও অন্যান্য তথ্য এমনকি সেটি ঢাকায় না কলকাতায়, তা-ও অনুমাননির্ভর। ১৮৫৪ সালে ফেজ টুপি মাথায়, সেকালের অভিজাত শ্রেণির শীতের পোশাকে, সম্ভবত শেরওয়ানি পরা অবস্থায়, তাঁর যে একটিমাত্র ফটোগ্রাফের সন্ধান পাওয়া যায়, সেটা তাঁর মৃত্যুর বছরে তোলা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।’
তবে খাজা আলীমুল্লাহর আলোকচিত্রই যে প্রথম ছবি, এ বিষয়ে নিশ্চিত নন মামুন। তিনি আরও গবেষণার দাবি রেখে দিয়েছেন বইয়ে। তবু এটা তো চূড়ান্তই যে, বাংলার ক্যামেরা চর্চার শুরুর ইতিহাস মূলত ইংরেজদের কাল। আর ব্রিটিশের ঢাকা শহরে অভিজাত সব কর্মকাণ্ড নবাব পরিবারের হাত ধরেই হয়েছে। কিন্তু খাজারা যে পরিবেশ-প্রকৃতি-রাজনীতি-সমাজ; এ-জাতীয় সবকিছুর বদলে নিজেদের দেখাতেই ক্যামেরার সুবিধা নিয়েছেন, তা অনেকটা সমালোচকের ভঙ্গিতে লিখেছেন নাসির আলী মামুন। এমনকি যাঁকে কেন্দ্র করে কিংবা জনক হিসেবে ধরে তিনি পূর্ববঙ্গের আলোকচিত্র ইতিহাস রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন তিনি, সেই গোলাম কাসেম ড্যাডিকেও এ বিষয়ে এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নন। তাই তো ড্যাডি কেন রাজনীতি বা এ-জাতীয় বড় ঘটনা এড়িয়ে গিয়ে খুব সাধারণ বিষয় ক্যামেরায় ধরেছেন, তা নিয়ে তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জর করেছেন মামুন।
নামকরণে বা ভূমিকায় বিষয়টি স্পষ্ট না হলেও গোলাম কাসেম ড্যাডির সাক্ষাৎকারই বইটির বেশির ভাগ অংশজুড়ে আছে। মামুন তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ এই আলাপচারিতায় ছিলেন ১৯৮৮ সালের ৭ জুলাই। কেন, কীভাবে, কখন, কোথায়—ড্যাডি আলোকচিত্র রচনায় জড়িয়ে পড়েন, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা নিয়েছিলেন মামুন। তাতে আমরা যে তথ্য পাব, সেখানে গোলাম কাসেমকে পূর্ববঙ্গের হিসেবে ধরলে ভুল হবে। তাকে বড়জোর প্রথম বাঙালি মুসলমান আলোকচিত্রী হিসেবে তুলে ধরা যায়। কারণ, তখন তিনি ওপার বাংলার পরম্পরা বহন করে চলেছেন। মামুনের বিবরণ থেকেই তা স্পষ্ট, ‘১৯১২ সালে ইংল্যান্ডের হাটন অ্যান্ড কোম্পানির এনসাইন ক্যামেরা দিয়ে যাঁর যাত্রা হয়েছিল প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে, তিনি হয়ে উঠলেন দক্ষ এক ক্যামেরাশিল্পী। কলকাতার ফটোগ্রাফির দোকান থেকে কিনে আনতেন ফিল্ম, পেপার ও কেমিক্যাল।’
ব্রিটিশ ভারতের দীর্ঘ সময়ের রাজধানী শহর এবং অবশ্যই তখনো বঙ্গের প্রধান শহর হিসেবে কলকাতাই ছিল বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। আলোকচিত্রচর্চাকেও তাই এর বাইরে রাখার উপায় নেই। গোলাম কাসেমও সেই ধারারই একজন। অথচ মামুন লিখেছেন, ‘তাঁর তোলা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অবশিষ্ট প্রায় পাঁচ শ বিভিন্ন ধরনের নেগেটিভ থেকে এমন ধারণা আমার হয়েছিল যে, তিনি আমাদের সৃষ্টিশীল ফটোগ্রাফির জনক এবং পূর্ব বাংলায় প্রথম বাঙালি মুসলমান সার্থক আলোকচিত্রশিল্পী।’ তাই পূর্ব বাংলার হিসেবে আলাদা না করে প্রথম বাঙালি মুসলমান আলোকচিত্রীই তো বলা যায় গোলাম কাসেমকে। তাই নয় কি? পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি: রাজসাক্ষী গোলাম কাসেম ড্যাডি বই থেকেই কিন্তু এর উত্তর মিলে যেতে পারে অনেকখানি।
ক্যামেরার ব্যবহার এবং ছবি ডেভেলপ করার শুরুর দিনগুলোয় জানতে-শিখতে-বুঝতে গোলাম কাসেমকে ছুটে যেতে হয়েছে কলকাতায়। তিনি নাসির আলী মামুনকে সাক্ষাৎকারে সেই সময়ের কথা বলেছেন এভাবে, ‘গেলাম ধর্মতলায়, কলকাতায়। সেখানে ফটো স্টুডিও ছিল। একটা ছিল ডাস কোং, আরেকটা ছিল ক্যামেরা স্টোর, আর ছিল চৌরঙ্গী স্টোর। এ রকম কতকগুলো ফটোর দোকান ছিল। এদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে বলি যে এই রকম ব্যাপার... প্লেট ছিল, ওটা ডেভেলপ করতে গিয়ে ফিক্স করার সময় সব গলে গলে পড়ে যাচ্ছে। তো, যার কাছে গেলাম, সে-ই বলে, দেখুন, এগুলো আপনারা পারবেন না। এগুলো খুব কষ্টের কাজ। যাহোক, এক্সপোজার হয়ে গেলে আমাদের কাছে দেবেন, আমরা যা করার সব করে দেব।’
তবে গোলাম কাসেম ড্যাডিকে পূর্ববঙ্গের আলোকচিত্র চর্চার নেতা হিসেবে মেনে নিতে হবেই। তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন ভারত ভাগের পরের অধ্যায়ে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আসার পর। গড়ে তুললেন সংগঠন। গড়লেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখান থেকেই পাখা মেলতে থাকে পূর্ববঙ্গের আলোকচিত্র চর্চার নানা দিক। আজকের বাংলাদেশে যাঁরা দিকপাল আলোকচিত্রী, তাঁদের সবার কোনো কোনোভাবে ঋণ রয়ে গেছে গোলাম কাসেমের কাছে। ব্যক্তিজীবনে নিঃসন্তান মানুষটি ক্যামেরার মাধ্যমে তৈরি করেছেন শত শত সন্তান। তাই তাঁরা তাঁকে ‘ড্যাডি’ বলে সম্বোধন করে সম্মান জানান। বাংলাদেশের আলোকচিত্র চর্চার জনক হিসেবেও তো একধরনের স্বীকৃতি দেন। আলোচ্য বই তার সাক্ষ্য বহন করে যাবে যুগের পর যুগ ধরে।
নাসির আলী মামুন বইয়ের শুরুতেই এর সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়েছেন। একে পূর্ববঙ্গের আলোকচিত্রের ইতিহাসের একটি আংশিক কাজ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। তাই নওয়াব পরিবারের বাইরে বিশ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম দশকে ঢাকায় ছবি তোলার বিষয়টি কেমন ছিল, তার চিত্র পাওয়া যায় না এখানে। বইয়ের বিন্যাসের একটু অপূর্ণতা তুলে ধরতে চাই এখানে। সেটা হচ্ছে, ভূমিকা, ড্যাডির হস্তলেখা, পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি ও আমাদের ড্যাডি, গোলাম কাসেম ড্যাডির সাক্ষাৎকার, উপসংহার—এভাবে বইটিতে সূচিপত্র থাকলে পাঠকের সুবিধা হতো।
বইখানির বিশেষত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের আলোকচিত্র চর্চার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গবেষণার প্রাথমিক অনেক তথ্য মিলবে এতে। আর লেখকও এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছেন তরুণদের। নতুন প্রজন্মের কোনো না কোনো গবেষক নাসির আলী মামুনের ইচ্ছাপূরণে এগিয়ে আসবেন—এই আশাবাদ সঞ্চারিত হচ্ছে আমাদের মতো পাঠকের মনেও।