নুসরাত ফতেহ আলি খানের কণ্ঠ

 

ফরাসি বন্ধু পিয়ের-আলা-বোর সাথে আমার পরিচয় প্রায় দেড় যুগের কম হবে না। তিনি এই উপমহাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান। এই শহরের অনেকেই তাঁকে চেনে, কিন্তু টিনের সিপাই-এর মতো চিকন গড়নের এই লোকটি কেন আসেন, কেন তিনি পাঞ্জাবি-ফতুয়া কিংবা কপাল কাটা চিশতিয়া টুপি পরে ঘুরে বেড়ান, সে কথা খুব কম লোকই জানেন। মূলত তাঁর আগ্রহ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে। একদিকে যেমন বাংলাদেশের বাউল, কীর্তন, মারফতি, মুর্শিদী গানের সন্ধানে উদ্‌গ্রীব, অন্যদিকে পাকিস্তানের কাওয়ালি-মাওলিদ নিয়ে মশগুল। কথা বলার সময় আধা বাংলা, আধা ইংরেজি ব্যবহার করায় যে কেউ বুঝে নিতে পারে তাঁর কথা, সে রিকশাওয়ালা হোক বা হকার। কখনো তাঁরই সাহচর্য পাওয়া বাঙালি বন্ধুদের কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, এ দেশে ওরা কী যে ধান্ধা করতে আসে! আবার অনেকে পিঞ্চ করে বলে, দেশে কাজ নাই, তাই এ দেশে পড়ে আছে! এসব কথা শুনে কখনো কখনো বেকুব হয়ে গিয়েছি। কিন্তু অ্যালেন যে আমাদের সংস্কৃতিকে কতটা ভালবাসেন, তা জেনে আপনারা বিস্মিত হবেন। অ্যালেন ১৯৮৫ সালে প্যারিসের ফন্তভ্রো অ্যাবেতে প্রথম এবং ফ্রান্সে নুসরাত ফতেহ আলী খানের শেষ পরিবেশনা শুনতে যান। তখন শরৎকাল চলছে। সেখানে প্রথম সাক্ষাতের পাশাপাশি সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেন। নুসরাতের বিস্ফারিত চোখ, জাদুকরী ব্যক্তিত্ব আবার শিশুসুলভ সারল্য তাঁকে মোহিত করে। এরপর তিনি সেই ব্যক্তিত্বের প্রেমের ইন্দ্রজালে পড়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো বেছে নেন এই জনপদেই।

তাহলে নুসরাতের কণ্ঠে কী এমন ইন্দ্রজাল রয়েছে, যা শুনে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের মানুষ তাঁকে অসংখ্য উপনামে ডেকেছেন? জাপানে তাঁকে সিঙ্গিং বুদ্ধ বলে ডাকা হয়, তিউনিসিয়ায় কণ্ঠের বিশুদ্ধ প্রতিরূপ কিংবা আমেরিকায় স্বর্গীয় কণ্ঠ, ফ্রান্সে প্রাচ্যের পাভারত্তি, পাকিস্তানে শাহেনশাহ-এ-কাওয়ালি, লন্ডনে ইসলামের প্রতিরূপ ইত্যাদি উপাধিতে অভিষিক্ত করা হয়। উপমহাদেশের সংগীতকারদের মধ্যে নুসরাতের সাথে আর একটি নামও যুক্ত করা সম্ভব হবে না যে কিনা বিশ্ব পরিসরে এমন সুবিদিত। কারণ, তাঁর ওজন যেমন অস্বাভাবিক, স্বরগ্রামও আয়ত্তে ছিল প্রায় ছয় অক্টেভ। অ্যালবাম ছিল গিনেজ রেকর্ড অনুযায়ী নব্বই দশকেই একশো পঁচিশটি। এ ছাড়া ইউটিউব, কনসার্ট, গুগল রেফারেন্স, ক্যাসেট বিক্রি, এগুলো এতটাই ওপরে যে তাঁকে ছুঁতে পারা আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। খ্যাতি ও মর্যাদার এই দিকের কারণ জানাতে হলে এটুকুও জানা থাকা দরকার যে, এই উপমহাদেশের সংগীত শুধু সুরের বহিরাঙ্গিক কাঠামোর বিচিত্রতায় কিংবা নবতরঙ্গের বর্ণিলতায় ডুবে থাকলেই হয় না, তার সাথে কোনো না কোনোভাবে দর্শনগত যোগসূত্র থাকতে হয়। নুসরাতও ঠিক তাই, তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য ও দর্শন সুফি আধ্যাত্মিকতার একটি বলয়। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই সুফিবাদকে আবার তিনি আধুনিক কণ্ঠশীলন ও পরিশীলিত রূপে বেঁধেছেন। সে সম্পর্কে অ্যালেনের ভাষ্য, নুসরাত ফতেহ আলী খান সময়ের থেকে অনেক অগ্রসর ছিলেন। তিনি তাঁর উন্মাদ গায়কির মাধ্যমে অসীম ঈশ্বরের প্রেমে আমাদেরকে আহ্বান জানান। সময়ের সাথে যথোপযুক্ত ভঙ্গিতে ধাবিত হন, নিরীক্ষায়-ফিউশনে উন্মুক্ত নতুন নতুন সুরের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন, তার মধ্যে আঞ্চলিকতা ও বিশ্বজনীনতাকে একাকার করে দেন, শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতাকে একই গৃহে ঠাঁই দেন। (মুক্তাদির ৯)

নুসরাতের মধ্যে এই যে দ্বৈতবাদিতা অর্থাৎ একদিকে মরমি ও সুফিবাদের প্রতি পূর্ণ আস্থা, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিকতার প্রতিমুর্ত রূপ, এই দিকটিই মূলত অ্যালেনকে বিমুগ্ধ করেছিল। ফলে ১৯৮৫ সাল থেকে নুসরাতের অকাল প্রয়াণের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সাথে তিনি বহু স্থানে ভ্রমণ করেছেন, পাকিস্তানে ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কনসার্টের আয়োজন করেছেন। এবং পরিশেষে এদিশন দেমি লুন প্রকাশনা থেকে লে মেসাজার দ্যু কাওয়ালি নামে ফরাসি ভাষায় অসাধারণ একটি বই রচনা করেন, যা ফ্রান্সে বেশ আলোচিত ও পুরস্কৃত হয়। পরে লাহোরের সাং-এ মিল থেকে কাওয়ালি কা পায়াম রাশান নামে উর্দুতে, দিল্লির হারপার কলিন্স থেকে দ্য ভয়েস অফ ফেইথ নামে ইংরেজিতে, এবং ২০২২ সালে ঢাকার পাঠক সমাবেশ থেকে শাহেনশাহ-এ-কাওয়ালি নুসরাত ফতেহ আলী খান নামে বাংলায় প্রকাশিত হয়। বাংলা অনুবাদ করেন কাজী আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির।

তাহলে নুসরাতের কণ্ঠে কী এমন ইন্দ্রজাল রয়েছে, যা শুনে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের মানুষ তাঁকে অসংখ্য উপনামে ডেকেছেন? জাপানে তাঁকে সিঙ্গিং বুদ্ধ বলে ডাকা হয়, তিউনিসিয়ায় কণ্ঠের বিশুদ্ধ প্রতিরূপ কিংবা আমেরিকায় স্বর্গীয় কণ্ঠ, ফ্রান্সে প্রাচ্যের পাভারত্তি, পাকিস্তানে শাহেনশাহ-এ-কাওয়ালি, লন্ডনে ইসলামের প্রতিরূপ ইত্যাদি উপাধিতে অভিষিক্ত করা হয়

বইটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল, একজন প্রেমিক বা ইন্দ্রজালাবিস্ট গবেষকের অনুসন্ধানী চোখ কেমন হওয়া উচিত? কাওয়ালি নিয়ে অ্যালেনের দীর্ঘদিন ধরে অনুধাবনের চেষ্টা একজন মিউজিকোলজিস্টের মতো, যিনি বছরের পর বছর ধরে এথনোগ্রাফির মাধ্যমে অনেক অজানা গল্প ও রহস্য হাজির করেছেন প্রকৃত তাৎপর্য খোঁজার অন্বেষায়। তুরস্কের শামা থেকে কাওয়ালি পর্যন্ত এক গভীর সাধনাময় আধ্যাত্মিক কনসার্ট বা আত্মার উৎসব হয়ে চলেছে, আর তা সুরের বাহনে ভর করে, অথবা যা অসীমের পথে যাত্রার একটি নিবিষ্ট মাধ্যম হিসেবে। গভীর শ্রবণ-সচেতন মনকে পরমাত্মার দিকে ধাবিত করতে এই সুরবাহন প্রক্রিয়া। ইসলামের একদল অনুসারীকে সংগীত হারাম বলতে শুনি, আবার আরেক দলকে হালাল বলতে শুনি বাদ্যরহিত রূপে, কিন্তু এখানে পরমেশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার প্রধান বাহনই হলো সংগীত, তারই পরম প্রকাশ ঘটে কাব্যে, আলাপে, তানে-সারগামে। এসকল দক্ষতার কিংবা কারুকার্য দিয়ে নুসরাতকে বিচার করা কঠিন; কারণ, তাঁর শৈল্পিক উচ্চতা তারও ঊর্ধ্বে। একথা বলছি কারণ নুসরাতের বাবা ফতেহ আলী খান প্রখ্যাত কাওয়াল হয়েও নিজেই ভাবতে পারেননি যে এই মোটাসোটা বোকাসোকা শান্ত ছেলেটা দুর্গম-দুস্তর পথে হাঁটতে পারবে কি না? কিন্তু বাস্তবে নুসরাতের কণ্ঠে পূর্বপুরুষ কাওয়ালদের অষ্টকের সীমানাকে ছাড়িয়ে নতুন ব্যাপ্তি ধরা দিয়েছে। অর্থাৎ নুসরাতের পরিবারের ৯ প্রজন্ম ধরে কাওয়ালি পরিবেশন করে চলেছে। কিন্তু বাবা নাদুসনুদুস ছেলেটাকে চিকিৎসক বানাতে চেয়েছিলেন। এ কারণে সংগীত তালিমের আসরেও তাঁকে ডাকা হতো না। কিন্তু নুসরাত গোপনে অন্যদের বাজনা শুনে নিজে নিজে হারমোনিয়াম বাজাতেন। অ্যালেন বর্ণনা করেন,

একদিন তিনি একান্ত মনে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলেন। তিনি খেয়াল করেননি যে, তাঁর পিতা ঘরে ঢুকে বাজনা শুনছেন। পিতার উপস্থিতি টের পাওয়ামাত্র ত্রস্ত হয়ে বাজনা বন্ধ করলেন। কিন্তু ফতেহ আলী খান হাসিমুখে পুত্রকে কাছে টেনে নিয়ে এই বাদ্যযন্ত্রটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেন। যদিও সতর্ক করে দিলেন চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি প্রথম মনোনিবেশের। (মুক্তাদির ৩৭)

এরপর বড়ে গোলাম আলী খাঁর পুত্র মুনাওয়ার আলী খাঁ বাবা ফতেহ আলী খানকে বলেছিলেন, সে মোটাসোটা হতে পারে, কিন্তু তার মেধা অত্যন্ত প্রখর। এরপর থেকে তিনি শক্ত তালিম গ্রহণের সুযোগ পান। ১৯৬৪ সালে বাবার গলার ক্যানসার ধরা পড়ে এবং ১৯৬৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। ফতেহ আলী খান তাঁর জীবদ্দশায় সর্বভারতীয় সেরা কাওয়ালি গায়ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এখন তাঁর উত্তরসূরি কে হবেন? এরপর পরিবারের লোক ও আজমির শরিফের খাদেম কর্তৃক একই ধরনের স্বপ্নপ্রাপ্ত হন যে নুসরাত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় কাওয়ালি পরিবেশন করছেন। এ কারণেই অনেকে তাঁকে স্বর্গীয় গায়ক বলে থাকেন। শুরুতে অনেক বিচলিত থাকলেও ধীরে ধীরে আঞ্চলিক সংগীতকে আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত করে তোলার জন্য ভারতীয় ধ্রুপদরীতিকে যুক্ত করেন।

প্রাচীনকাল থেকেই এ উপমহাদেশে সংগীতানুশীলনের দুটি রূপ ছিল। তা হলো একটি পূজা বা উপাসনার নিমিত্তে স্তোত্র পাঠ, অন্যটি সেই পরিবেশনার উদ্দেশ্যে রচিত উপাসনার গান। প্রাচীনকালে বৌদ্ধদের দোহাকোষকে উপাসনার নিমিত্তে আর চর্যাপদকে পরিবেশনার উদ্দেশ্যে গাওয়া হতো, কীর্তনেও এ রকম দুটি দিক আছে। ইসলাম ধর্মেও এর ব্যতিক্রম নেই, যেমন পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত বা আজান এবাদতের উদ্দেশ্যে আবৃত্তি করা হয়, অন্যদিকে হামদ-নাত-মাওলিদ ইত্যাদি পরিবেশনার নিমিত্তেই রচিত। অর্থাৎ প্রথমটির আয়োজন সরল এবং দ্বিতীয়টি বর্ণিল। ভুটানের কালো-মুখোশ নৃত্য, কিংবা জাপানের সৌম্য কিংবা তেন্দাই দেখলেও বোঝা যায় স্তোত্রগুলো উভয় প্রেক্ষাপটে গীত। কাওয়ালিতেও বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই ঘটনা দৃশ্যমান হয়েছে ফিল্মি কাওয়ালির (মুক্তাদির: ২১) মাধ্যমে যা বলিউডের প্রচারের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বকে আন্দোলিত করেছে। পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রকার স্টিফেন ফিয়ারস-এর Sammy and Rosie get laid এবং মারটিন স্টরেস-এর The Last Tamptation of Christ-এ কণ্ঠ দিয়ে উপমহাদেশের বাইরে তাঁর সুনাম ছড়ালেও বলিউডে তাঁর গায়কীর প্রভাব ভারতীয় সিনেমাকেই নতুনভাবে বাণিজ্যিক সাফল্য আনে, চলচ্চিত্রশিল্পের অডিটরি বিভাগে নতুন বিপ্লব আনার ক্ষেত্রেও নুসরাতের গায়কি প্রধান উদ্দীপক। বর্তমানেও আধুনিক সংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলার স্বার্থে ভারত এমনকি বাংলাদেশের গানে যে উচ্চনিনাদি হামিং-এর ব্যবহার করা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও নুসরাত অগ্রপথিক। তিনি আঞ্চলিক ফর্মকে বৈশ্বিক করে তোলার ক্ষেত্রে যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তা হলো সারগামের বৈচিত্র্য, স্কেলের সম্প্রসারণ, ধ্রুপদের পরিবেশনারীতি এবং ফিল্মে কণ্ঠ দান। ইউরোপের শিল্পীদের ভয়েজ রেঞ্জে ছয়টি অকটেভ ব্যবহারের চেষ্টা থাকে, নুসরাত সেই কাজটি করতেন অবলীলায়, যা পূর্বেই বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি ব্যাস থেকে সোপ্রানো লেবেল পর্যন্ত অনায়াসসিদ্ধ করেছেন। এ দেশের বাউল কিংবা কবিগান, জারিগান-বিচারগান, পালা-গীতিনাট্যের সাথে পরিবেশনাগত সাদৃশ্য রয়েছে, কিন্তু এসব লোকধারাকে জাতীয় ধারায় বিকশিত করা সম্ভব হয়নি, কবি ইকবাল যে কাজটি এগিয়ে নিয়েছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই। কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনায়, আব্বাসউদ্দীন কিংবা আবদুল আলীমের শিল্পভাবনায় কিছুটা এ পথে হাঁটার ইশারা পাওয়া যায়। তারা আঞ্চলিক ফর্মকে জাতীয় জীবনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন, কিন্তু বৈশ্বিক পরিসরে তা সম্প্রসারিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে নুসরাত অপ্রতিরোধ্য ও উদাহরণযোগ্য।

কাওয়ালির সাথে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সভারত্ন তানরস খাঁর সৃজনশীল ও মেধাবী কল্পনা ও রচনার মাধ্যমে খেয়ালের বিকাশ ঘটেছিল, যা উত্তরভারতীয় সংগীতকে প্লাবিত করেছে। কিন্তু নুসরাত পরিবারের শিখনরীতি বৈদিক ধ্রুপদীয় ডাগর ঘরানার সাথে মিলিত হয়েছে, এবং ধ্রপদই কাওয়ালিকে এতটা উন্নত করেছে। সেই তথ্য অ্যালেনের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে।

নুসরাতের কণ্ঠে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক কবিতা ও উচ্চারণের স্পষ্টতা। কারণ, কাওয়ালি সাহিত্যের আভিজাত্যকে অবলম্বন করে চলে। খেয়ালে যেমন শিল্পী সুর বিস্তারের ক্ষেত্রে নিজের মতো করে একটি বলয় সৃষ্টি করে, এবং তা শ্রোতাকে বিমুগ্ধ কিংবা অনুধাবনযোগ্য করে তুললেও মিথস্ক্রিয়ামূলক বা ইন্টারেক্টিভ নয়। সেই বিচারে কাওয়ালি জৌলুশপূর্ণ ও মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টি করে, এবং শ্রোতাকে প্রবল উদ্দীপিত করে, যা মরমিবাদে ফানা বা উন্মাদিত করে তোলার পর্যায়ে নিয়ে যায়। অনেকটা জিকিরের সাথে তুলনীয়। এই মরমিবাদের মাহাত্ম্য সারা বিশ্বের স্কলারদের কাছেই আগ্রহের বিষয়বস্তু। সে কারণে নুসরাত পশ্চিমা বিশ্বে এতটা মর্যাদাসম্পন্ন। সাহিত্যের গভীরতার সাথেও যে কাওয়ালি সংগীতের গভীর সম্পর্ক, সেই দিকটিও গুরুত্ববহ। অ্যালেনও সেকথা বলেছেন এভাবে যে কাওয়ালির মূল ভিত্তি হচ্ছে কবিতার গভীর জ্ঞান আর শব্দের চমৎকার উচ্চারণ।

১৯৯৭ সালে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে নুসরাতের মৃত্যুর হয়। তার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর অবিরত গায়কি লাখ লাখ শ্রোতা তৈরি করেছে। এ দেশের সংস্কৃতিজনের কারও কারও মতে, কাওয়ালি পাকিস্তানি শিল্প বলে অপছন্দনীয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামে তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা ক্ষমাহীন এবং ঘৃণ্য। সেই দাগ এখনো বহন করে চলেছে আমাদের অসমসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কাওয়ালি কনসার্ট নিয়ে যে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার পেছনে সেই দগ্ধ স্মৃতিই হয়তো জেগে উঠেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাসের কারণে সাংস্কৃতিক প্রবহমানতা বাধাগ্রস্ত হোক, এটা প্রত্যাশিত নয়, আর কাওয়ালি পাকিস্তানের নিজ সম্পদও নয়, বরং তা এই উপমহাদেশে মরমিধারার সকলের। যেমন ধরুন, পাকিস্তান আমলে বাংলার শিল্পীরা পাকিস্তানে গিয়ে গান করত, সেসব রেকর্ড সেখানে আজও পড়ে আছে, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। শিল্পী জহির আলীম কয়েক দিন আগে জানালেন, তাঁর বাবা আবদুল আলীমের অনেক গান পাকিস্তান রেডিও আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে, কিন্তু তা তিনি উদ্ধার করতে পারেননি। এ রকম আরও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যা জাতীয় সংস্কৃতির জন্য আত্মহননের শামিল।

তথ্যসূত্র

শাহেনশাহ-এ-কাওয়ালি নুসরাত ফতেহ আলী খান, পিয়ের-আলা-বো, কাজী আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির (অনু.), পাঠক সমাবেশ, ঢাকা ২০২২