বিপ্লব চক্রবর্তীর সংগীতযাপন


বাংলার পথে-প্রান্তে লোকসংগীতের রেওয়াজই বেশি। পার্বণিক আচারানুষ্ঠান কিংবা গলি-মহল্লার মচ্ছবেও উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা কম। কর্ম ও কথার সত্য আত্মীয়তার ভেতরে এখানকার গায়েন ও শ্রোতারা সংগীতযাপন করেন। উত্তর-ভারতের প্রায়োগিক কলাচর্চায় এখানকার সুরের কুটুমগণ আত্মমগ্ন হননি খুব। একতারা, দোতারা কিংবা বেহালা কাঁধে রেখে এখানকার গায়েনেরা আসর মাতিয়ে রাখেন; বাংলার মাটির গানের পরম্পরাকে জীবিত রাখেন। বাংলা অঞ্চলের ভাব ও ভাবুকতায় প্রাকৃতজনেরা আত্মঅস্তিত্বের একটা ঘরানা তৈরি করেছেন। আত্মানুভবের এই ঘরানার মূল অবলম্বন সংগীত। অগ্রহায়ণের ধানকাটা মাঠে ধানের গল্লা কিংবা খড় বিছিয়ে মানুষ সারা রাত গান শোনে। গান শোনে আর কাঁদে। সুরস্নাত হয়ে কানতে কানতে মানুষ নিজের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। আবহমান কাল ধরে ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব তীরে মেঘনা-ঘোড়াউতরা-সুরমা-ধনু-কংস-মগরা-সোমেশ্বরীর মানুষেরা এভাবেই সংগীতযাপন করেছেন। শাস্ত্রীয়বিদ্যার চেয়ে মন ও মানবিক বিদ্যায় ধাবিত হয়েছে এই ভূমির ভাব ও ভাবুকতা এবং সুরের জগৎ। জীবনানুভূতির বিভিন্ন মুহূর্ত ও দার্শনিকতাকেই এখানকার গায়েনেরা সুরে সুরে পরিবেশন করেন। কোনো আয়োজন ছাড়াই মাটির উঠানে রাত জেগে চলে গান। হিন্দু-মুসলামনের নিত্যতা কিংবা প্রভু-ভৃত্যের দ্বান্দ্বিকতার ঊর্ধ্বে এই গান।
মাটির এই গান দিয়েই নব্বই এবং নব্বই-পরবর্তী নগরমিশ্রিত একটা বিচিত্র তারুণিক সমাজের মন ও মাধুর্যকে ধাক্কা দিয়েছিল বিপ্লব চক্রবর্তীর গান। তিনি মূলত বাংলার মাটির গানের পরিমার্জিত রূপটাকেই নতুন ফর্ম ও কাব্যিকতায় সুরে সুরে তুলে ধরেছেন। ‘মানুষ আমি আমার কেন পাখির মতো মন’—আবহমান বাংলা ও বাঙালির ভাব ও ভাবুকতার এই গহিনতম রূপটাই তারুণ্যের গায়কিতে টিএসসি, দোয়েল চত্ত্বর, কলাভবন কিংবা বকুলতলায় পরিবেশন করেছেন। নিজের আত্মাকে পাখির আত্মার সাথে প্রতিতুলনা করে দেখানোর এই গায়কি ও রীতিকে বাংলার তরুণসমাজ অন্তরে নিয়েছিল। বলা যায়, এই গানের পঙ্‌ক্তিগুলোতে নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছিল তারা। একটা গানের ভেতরে যখন একটা জেনারেশনের মন ও প্রকৃতিকেই পরিবেশন করা হয়, তখন সেই গানটাকে সেই জেনারেশন নিয়ে নেয়। একটা জেনারেশনের অস্তিত্বের কথা বলতে বলতে গানটাও বেঁচে থাকে বহুকাল। সময়ের ভঙ্গি ও পরিবেশন ভিন্ন হলেও একটা গানের ভেতরে যদি সত্য একটা ম্যাসেজ থাকে, যুগকে ধারণ করার একটা সত্য দার্শনিকতা থাকে, তবে সেই গানটা যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে। সময় ও মানুষের মনোজগতের যে বিচিত্রতা তিনি গানে তুলে ধরেছেন—এ জন্যই তিনি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন। কাব্যিক ছবিতে শব্দসৌর্ন্দযে তার গানে বাংলার সহজতা ছিল; ছিল মনের বহু বিচিত্র মানবিক সত্তাকে সুরে সুরে প্রকাশ করা। আগত-অনাগত সব রকমের প্রজন্ম রেখে (১৬ জানুয়ারি, ২০২২) খুব ভোরে বিপ্লবদা চলে গেছেন। বিপ্লবদার গানের খাতা, সুর ও গায়কিটা এই বাংলার সুরঘরানায় অমৃত পাখি হয়ে উড়তে থাকবে। গায়েন অনন্ত নক্ষত্রে মিশে যাওয়ার পর চলচিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ছোট একটা স্ট্যাটাস লিখেছেন। সেটি বিপ্লব চক্রবর্তীর গানকে বোঝার জন্য খুব দরকার, 

শাহবাগের অস্ত যাওয়া সূর্যের মতোই বিপ্লব দা’র কথাও কি আমরা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। কাল ভোরে মরে গিয়েই কি তবে বিপ্লব দা মনে করিয়ে গেলেন “আমি ছিলাম”? বিপ্লব দা’র ভাগ্নের পাঠানো মেসেজে জানলাম বিপ্লব দা’র এই পৃথিবী ভ্রমণ শেষ হয়েছে। আমাদের সময়টাকে চেনা যাবে না যদি আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের মানুষদের চেনা না যায়। বিপ্লব চক্রবর্তী, আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। “মানুষ আমি আমার কেনো পাখির মতো মন” বা “আমি যারে ভালোবাসি, তারে আবার বাসি না”—এই গানগুলা বিপ্লব দার উজ্জ্বল তারুণ্যে লেখা। “পাখির মতো মন”র কথা ভাবলে মনে হয় কতো আগে বসে বিপ্লব দা উনার পরে যে প্রজন্ম আসবে সে প্রজন্মের ইশারা দিয়ে গেছেন। ব্যাচেলর ছবিতে এই গানটা ব্যবহারের পিছনে আমাদের মূল চিন্তা ছিলো যে এই রকম জেনারেশন ডিফাইনিং গান বিরল। 


দুই
সন-তারিখ আজ আর মনে নেই অত; হয়তো পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে বিপ্লব দা’কে প্রথম দেখেছি দুর্বারের অর্জুনতলায়। নামে-সুনামে বিপ্লব দা তখন কিংবদন্তি। আঞ্জুমান স্কুলের পুকুরঘাটটি শৈশবের রং ও উচ্ছ্বাস নিয়ে জলের নিচে তলিয়ে গেছে আজ। সেই পুকুরঘাটে মুখোমুখি বসে শুনেছি গান ও গায়কি। সুর শোনার অনেক আগেই শুনেছি উঁনার নাম। ঢাকা থেকে প্রত্যাগত কবি মাহবুব কবিরকে ঘিরে দুর্বার, বকুলতলা, অর্জুনতলা কিংবা পুরো শহরেই বিস্তারিত হতো হট্টিটি গুচ্ছের আড্ডা। সেই আড্ডাতেও নামে-উপনামে হাজির হতেন বাংলার এই মহৎ গায়েন। শুনেছি, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সব রকমের কর্মের সহচর ছিলেন তিনি। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জনপদের রাত্রিপল্লিতে, উল্লেখযোগ্য পানশালাতে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সাথে গমনাগমন ছিল তাঁর। সমাজ-সংস্কৃতির ভেতরে না থেকে পরিপূর্ণভাবে জীবনকে উদযাপন করে গেছেন তিনি। আমেরিকান মিউজিশিয়ান Derek sivers তাঁর Anything you want গ্রন্থে বলেছেন, ‘Never do anything just for money... The nead point of doing anything is to be happy, so do only what makes you happy... you can’t please everyone, so proudly exclude people. টাকার জন্য কিংবা লোকরঞ্জনের জন্য বিপ্লব চক্রবর্তী কখনোই কিছু করেননি। সমাজ ও মানুষকে তোয়াক্কা না করে জীবনকে উদযাপন করে গেছেন তিনি।
 

প্রকৃত গায়েনের কথা ও সুরে স্বপ্ন থাকে; নিবেদন ও সমর্পণ থাকে। বিপ্লব চক্রবর্তী গানকে কোনো ঘরানার সিলমোহরে আবদ্ধ রাখেননি। সুরের সৌন্দর্যকে, বাণীর প্রকাশকে তিনি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। প্রারম্ভিক যৌবনের উজ্জ্বল আলো দিয়ে দেখেছি, এই মানুষটির মধ্যে কোনো ভণিতা ছিল না। একটা স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে কথা বলতেন তিনি। কি উচ্চারণে, কি ব্যক্তিত্বে মানুষটার মধ্যে দরদ ছিল, আত্মস্বার্থের ভণিতা ছিল না

একটা বেপরোয়া, উচ্ছ্বাসী, তাগড়া, বোহেমিয়ান জীবন উদযাপন করতে করতে মানুষ শেষে কি ক্লান্ত হয়ে যায়! বিপ্লবদার ক্ষেত্রে এমনটা মনে হয় না। অন্যদের মতো রেসের লাইনে না থাকলেও তিনি মরে যাননি। বাংলায় ফিরে এসেছিলেন। বাংলায় না ফিরলে তিনি ফিরবেন কোথায়! আর্বানিক আচরণ তিনি কোনো দিন রপ্ত করতে চাননি; বরং এই নাগরিক আয়োজনকে প্রশ্ন করেছেন।

বৃক্ষ কাইটা নগর দিলা
সেই নগরে টব বসাইলা
ডান হাতে কাটো বৃক্ষ
বাম হাতে তা জানে না 

সত্যানুভবের এই সারলিক জিজ্ঞাসা দিয়েই নাগরিক চৈতন্যকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নব্বইয়ের হানিফ সংকেতের ইত্যাদিতে গান গাইবার আহ্বান তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। টিভি বাক্সের ভেতরে গাইতে চাননি তিনি। উন্মুক্ত আসরে হাজার হাজার শ্রোতার সামনে গাইতেন তিনি। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কথা ও সুরে ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’—এই গানের প্রথম গায়কও তিনি। চারুকলার বকুলতলায় এই গান যখন গাইলেন তিনি, সেদিন কোনো শ্রোতাই আর কারও গান শুনতে চাইলেন না। মানুষ তাঁকে চাইলেও তিনি ঠিক ধরা দিতে চাইলেন না। আসক্তির একটা নির্জন উড়ালে বিপ্লবদার মনের পাখিটা উড়ছিল খুব। তাই, হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোথাও শিল্পী খুঁজে দেখছিলেন নিজের জগৎ। শিল্পী পরলোকগমনের পর তাঁর বন্ধু কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ লিখেছেন—

নেশা ছাড়ে না, ছাড়ে নাই আমাদের। কীসের নেশা! অনন্ত সৌন্দর্যের অন্বেষার, অধরাকে ধরার, পেয়ে হারানোর, না হারিয়ে পাওয়ার নেশা! বিপ্লব আমাদের সাথী। আগে বা পরে নেশার ঘোরের জীবন পাড়ি তো দিতেই হবে একদিন। কিন্তু খুব তাড়াহুড়োর কী দরকার! বিপ্লব মানতে ও মানাতে পারেনি অনেক কিছু। কেমন চুপসেও গিয়েছিল কিছুটা। কেমন যেন নীরবতা বিচ্ছিন্নতা ভর করেছিল তার উপর। সেই জম্পেশ আড্ডা, গান, নেশা থেকে যেন খানিক দূরে দূরে চলে গিয়েছিল সে! না, রক্তে নেশার উন্মাদনা কি আদৌ কমে! প্রায় নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আমাদের বন্ধু ছড়াকার গাজী মোবারক হোসেনের সঙ্গে তার।

আমরা নেত্রকোনায় সাহিত্য উৎসবে গেলে বিপ্লবের সাথে দেখা হতো। আমরা ওসব রেখে তেরিবাজারের মোড়ে বাংলার টানে চলে যেতাম বন্ধু গাজী মোবারক ভরসায়! আর তার সাথে আড্ডা হবে না। হায়!...একসময় ঢাকায় আড্ডা দিয়েছি আমরা। বিপ্লব অসুস্থ নগর ছেড়ে বাংলার গ্রামে চলে যায়। তারপর তার সাথে নেত্রকোনায় দেখা হতো আড্ডায়, পানে-গানে। কিন্তু সেই জৌলুশ যেন খুইয়ে গেছে। সেই প্রাণচঞ্চল সময় যেন হারিয়ে গেছে! ঢাকায় এলে মাঝেমধ্যে উৎপল, মুন্নাসহ আমরা বসতাম কুড়িলে। কতশত কথা রে! কখনো সখনো ফোন দিত, দেখা হবে আড্ডা হবে এসব কথা। স্বার্থাস্বার্থের একদম বাইরে।

যে জীবন বেয়ে চলছি আমরা এটা কি জীবন! বিপ্লব ধার ধারেনি কিছুর। পাঁড় বোহিমিয়ান। বেঁচে মরে থাকার মানুষ সে নয়! তাই একাকী তাইরে নাইরে কইরে পাড়ি দিয়েছে দূরদেশে বিপ্লব।


তিন

ঝড়ের রাত্রি ছাড়া আমার দেখা পাবি না
পাড় ভাঙা নদীটির পাড়ে আমার ঠিকানা।
... ... ...
যে জলে ভাঙেরে পাড়
সে জলের ঢেউয়ের তালে
আমার খেলাধুলা রে
আমার ধুলার খেলা...
ভেঙে ভেঙে যদি জল হোয়ে যাই
আমায় পাবে খুঁজে জলের সীমানায় রে 
জলের ইশারায়...

অন্ধকার ছাড়া শিখায় আলো জ্বলে না
ঝড়ের রাত্রি ছাড়া আমায় পাবি না।

পাড় ভাঙা নদীটির পাড়ে আমার ঠিকানা’। বিপ্লব চক্রবর্তীর এই গান দিয়ে কি গায়েনকে খুঁজে পাওয়া যাবে। ইহলোক থেকে প্রস্থান করে মানুষ যে তিমিরে বসতি স্থাপন করে, সেই তিমিরের অন্ধ পরলোকে কি মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়! শুধু নাম-সাকিন আর সৃজনকর্মের পরিচযায় ভেতরেই একটা মানুষকে খুঁজে পাই। সৃজনকর্মের দীপ্তিতেই একটা মানুষ দীর্ঘজীবী হতে থাকে। বিপ্লব চক্রবর্তী ছিলেন নেত্রকোনা জেলা সদরের বাংলা ইউনিয়নের সহিলপুরের বাসিন্দা। সকালের শালিক পাখির রোদে, দুপুরের ডুপি পাখির নির্জনতায়, বিকেলে মাছরাঙা পাখির উড়ালের মতো সহিলপুর গ্রামটা খুব সুন্দর। শুধু সৌন্দযের মুগ্ধতায় নয়, এই অঞ্চলের মাটিটাই গানের মাটি। স্বভাব বৈচিত্র্যে এই অঞ্চলের ঘরে ঘরে গান ও গায়েন। জাত কিংবা কুলীনত্বের মর্যাদায় নয়; মানুষই বহন করে সুর ও গানের ধর্ম। এই গ্রামটা মূলত কবিয়াল বিজয় নারায়ণ আচার্য, কবিয়াল মদন সরকার আর রামমঙ্গলের গীতালু বিভা চক্রবর্তীর গ্রাম। সেই গ্রামের উত্তরাধিকারকে ধারণ করে তিনি গায়েন হয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা গুরুদীক্ষা তাঁর ছিল না। নিজের মন ও কণ্ঠকে সুরের পরমে সমর্পিত করেছিলেন তিনি।

সংস্কৃতিস্নাত একটা পরিবারেই জন্মেছিলেন তিনি। পিতা বিমল চক্রবর্তী ছিলেন যাত্রাশিল্পী। খুব সকালেই বাড়ির উঠানে পিতা রামায়ণ-মহাভারত কিংবা বিভিন্ন যাত্রাপালার ডায়ালগ জোরে জোরে আবৃত্তি করতেন। সেই আবৃত্তির সুর ও উচ্চারণ মনকে নিশ্চয়ই স্পর্শ করত। বলা যায়, নিজেকে তৈরি করার একটা গুরুমন্ত্রণা পিতার থেকেই পেয়েছিলেন তিনি। গ্রামে তারা পিতা-পুত্র মিলে নাটকও করতেন। শিক্ষক বিমল চক্রবর্তী স্কুলের শিক্ষার্থীদের দিয়ে নাটকও মঞ্চস্থ করাতেন। সেই অভিনয় এবং আবৃত্তিকলায় পরবর্তীকালে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি।

গ্রামের মঞ্চে যে অভিনয়ের শুরু, সেই চর্চাতেই জীবনে বহু মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন। অশিষ খন্দকারের পরিবেশ থিয়েটারসহ বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টাল নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয় করেছেন সেন্টু রায়ের প্রামাণ্য চলচিত্রে।


চার

প্রকৃত গায়েনের কথা ও সুরে স্বপ্ন থাকে; নিবেদন ও সমর্পণ থাকে। বিপ্লব চক্রবর্তী গানকে কোনো ঘরানার সিলমোহরে আবদ্ধ রাখেননি। সুরের সৌন্দর্যকে, বাণীর প্রকাশকে তিনি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। প্রারম্ভিক যৌবনের উজ্জ্বল আলো দিয়ে দেখেছি, এই মানুষটির মধ্যে কোনো ভণিতা ছিল না। একটা স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে কথা বলতেন তিনি। কি উচ্চারণে, কি ব্যক্তিত্বে মানুষটার মধ্যে দরদ ছিল, আত্মস্বার্থের ভণিতা ছিল না।

সংগীতকীর্তিতে বিপ্লব চক্রবর্তী কোনো লিভিং লিজেন্ড ছিলেন না। এমনকি লিভিং লিজেন্ড হওয়ার বাসনায় সামান্যতম মগ্নতাও তাঁর ছিল না। আপন কীর্তির ঔজ্জ্বল্যে সংগীতের ভেতর দিয়ে তিনি বর্তমানকেই উদযাপন করে গেছেন। সুরের জগতে তিনি এমন কী মন্তর নিয়ে এসেছেন যে মানুষ যুগ যুগ ধরে তাঁকে মনে রাখবে? সময়ের রুচিবোধ আর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই গানের জগৎ তৈরি হয়। সময় ও জেনারেশনের আগমনের প্রতিধ্বনিটা আভাসিত হয় গানে। একটা জেনারেশনের পর আরেকটা জেনারেশর সুরের সেই অভিজ্ঞতাকে আর নিতে চায় না। কিন্তু কালের অভিজ্ঞান ও আভায় গানগুলো বাজতে থাকে। গানগুলো বাজাতে থাকেন নতুন দিনের নকীব। আসলে উত্তরাধিকার ছাড়া কোনো কিছুতেই নতুনত্ব আসে না। বিপ্লব চক্রবর্তী আধুনিক বাংলা গানে মাটির গানের পরিমার্জিত একটা রূপ রেখে গেছেন। তাঁর এই গায়কিটা না থাকলেও তাঁর পরিবেশিত মাটির গানের সহজাত মরমি রূপটা ধরে নতুন দিনের গায়েনেরা তাদের কল্পনা ও সুরের খাতা উন্মোচন করবেন—এটাই আমার বিশ্বাস।

সংগীতকীর্তিতে বিপ্লব চক্রবর্তী কোনো লিভিং লিজেন্ড ছিলেন না। এমনকি লিভিং লিজেন্ড হওয়ার বাসনায় সামান্যতম মগ্নতাও তাঁর ছিল না। আপন কীর্তির ঔজ্জ্বল্যে সংগীতের ভেতর দিয়ে তিনি বর্তমানকেই উদযাপন করে গেছেন

পাঁচ

চল্লিশের পর মানুষের জিপসি, তেজি জীবনটা মনে হয় ক্ষয়ে যেতে থাকে। শরীরে-মনে কনসার্টের শক্তি না থাকলে বিপ্লবদার মতো তেজি-জেদি-একরোখা নাগরিক গায়েনও আড়ালে চলে যান। সময়ধর্ম রচনা না করে তাঁরা চুপ করে থাকেন। অভিমান কিংবা আত্মদ্বন্দ্বে সময় ধর্মকে মানতে না পেরে অনেকেই অন্তরালে মরে যেতে থাকেন। প্রকৃতিতে কোনো স্থানই খালি থাকে না। নতুন গায়েনও এসে যায়।
জীবনকে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন বন্ধনহীনতায়। সমাজের প্রশংসাবদ্ধ প্রাত্যহিকতার ভেতরে না থাকতে থাকতে ফিরেছিলেন মাতৃকোড়ে; নেত্রকোনার অদূরে বাংলার সহিলপুরে। প্রতিটা পরিবারের একটা নিজস্ব উঠান থাকে। সেই উঠানটা পরিবারের সবার আশ্রয় ও আশ্রম। সেই মাটির উঠানে বিপ্লবদার ভাই-বোনেরা বিপন্ন ভাইটার জন্য অনেক কিছু করেছেন। ভাইকে তারা তিনবার রিহ্যাবে পাঠিয়েছেন। রিহ্যাব থেকে ফিরে গায়কও সামাজিক হয়েছেন। সঞ্চিতা চক্রবর্তীকে বিয়ে করেছেন। বাংলা বাজারে ফার্মেসির ব্যবসায় অর্থ উপার্জন করে জমিও কিনেছেন। সেই জমি বিক্রি করে আবার হয়েছেন কপর্দকশূন্য। নৌকা-ধানের যুগে ইউনিয়নে স্বতন্ত্র নির্বাচনও করেছেন। হেরেছেন। টাকার ছড়াছড়ি, খাওয়াখাওয়ি কিংবা হোন্ডা মিছিলের আয়োজন না করতে পারলেও মানুষেরা তাঁর বক্তৃতা শুনতে আসত। ঢাকায় তিনি চীনপন্থী মার্ক্সবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। নগরের কপট ও ধূর্ত তাত্ত্বিক রাজনীতিবিদদের তিনি চিনতেন। তিনি যা কিছু করতেন বিশ্বাস থেকে করতেন। সেই বিশ্বস ও স্বপ্নের কথাটাই মানুষকে বলতেন। মানুষ তাঁর সেই সুন্দর কথায় মুগ্ধ হতো। তাঁকে বিশ্বাস করত। তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার ছিল যে লোকটি বাজারের ফার্মেসিতে সবে আকণ্ঠ কেরু পান করে। এসব প্রচার আর ভীতির পরেও নৌকা ও ধানের মার্কা রেখে গ্রামবাসী তাঁকে প্রায় ২০০০ ভোট দেন।

জীবনটাকে কখনোই সিরিয়াসলি নেননি। তাঁর বড় ভাই প্রদীপ চক্রবর্তী আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘সব রেখে সে যদি গ্রামে একটা গানের দল করত, তাহলে তাঁর গানগুলো বেঁচে থাকত’। আসলে তিনি কিছুকেই ধরে রাখতে চাননি। ‘অন্তর বাজাও’ নামের গানের দলটা কী জনপ্রিয় ছিল ঢাকায়! যদিও মোংলাকেন্দ্রিক ‘অন্তর বাজাও’ নামের একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাই শুরু করেছিলেন। কিন্তু ঢাকায় এবং সারা দেশে এটাকে গানের সংগঠনে পরিণত করেন বিপ্লবদা। গানের সেই সংগঠনটাও সময়ের গহ্বরে চলে গেল।

ছয়

১৬ জানুয়ারির মধ্যাহ্নে পৌষের ধানকাটা মাঠে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম চিতার আগুনে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছেন বাংলার মেধাবী গায়েন। পৃথিবীর একেক ঘরানার মানুষ তৈরি করেছেন অন্তিম যাত্রার একেক নিয়ম। কিন্তু মানুষের ছোট্ট কিংবা দীর্ঘ জীবন কি আমকাঠের অগ্নিস্তূপে শেষ হতে পারে! চিতার অদূরে বসে ব্রাত্য ভক্তেরা ঢোল-করতালে গান ঢেলে দিচ্ছিল গায়েনের চিতায়। প্রকৃতি সবাইকে দাহের নিয়মে নিয়ে নেয়। কিন্তু আফসোস, প্রকৃতি খুব দ্রুত জ্বালিয়ে দিয়েছে বাংলার এই গায়েনের চিতা। সেই কখন, বিকেলের রঙে নিভে গেছে চিতার আগুন। কিন্তু গায়েনের ভক্ত, বন্ধু স্বজনদের কান্না থামছে না। পৃথিবীতে একেকজন একেকটা স্মৃতি ধরে রেখে কাঁদে কিংবা একেকজন বন্ধু বন্ধুত্বের একেকটা পরিসর ও উত্তাপ ধারণ করে বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে রাখে। প্রকৃতির সচল বিচরণে অন্তরতম হয়ে গাজী মোবারক, গৌতম বাবুল, হাসান কামরুল, মাহবুব কবির কিংবা চন্দনদারা সেই রাতে কেঁদে গেছেন। আগামীকাল হয়তো উঁনারা আর কাঁদবেন না। সময় কি আশ্চর্য না! সবার কান্নাই থামিয়ে দেয়। সবাইকে সচল রাখে। কান্না ছাড়া যেমন কেউ বাঁচতে পারে না, তেমনি কান্না নিয়েও একটা মানুষ বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। 

আপনি বলেছেন, ‘যায় দিন ভালো যায়/ আসে দিন আরো ভালো/ আজকের দিনটা সবচেয়ে বেশি ভালো।...বর্তমানের কোনো তুলনা নাই।’ সেই বর্তমানের হাতে কর্ম তুলে দিয়ে আপনি চলে গেছেন। আপনি বলতেন, ‘জীবনের কোনো অপচয় নেই। জীবনটা আনন্দের; উদযাপনের। সামাজিক হিসাব-নিকাশের আপনি তাই, আনন্দ আর উদযাপনের দিকে হেঁটেছেন। আসে দিন নিশ্চয়ই আরও ভালো হবে। সেই ভালো দিনে আপনার ছোট্ট জীবনটাকে খুঁজতে আসবে আগামীর দুর্দান্ত তরুণ। আপনার গায়কি ও লিরিকে বাংলার মানুষকে বারবার আসতে হবে। এই জনপদের মাটির গানকে আপনি নতুন সৌন্দর্য দিয়েছেন। সেই সৌন্দর্যের আলোয় স্নাত হবে বাংলার সুরের সমাজ।

 

বিপ্লব চক্রবর্তীর কয়েকটি গান


তুমি বাসো কিনা তাও আমি জানি না
ভালোবাসো কিনা তাও আমি জানি না
আমার কাজ আমি বন্ধু করিয়ারে যাব
চিন্তা হতে আমি চিতানলে যাব
বন্ধুরে…
পাহাড়ে পাহাড়ে নগরে বন্দরে
খুঁজিয়া তোমারে ধারা বহাবো
বাউল সাজিয়া একতারা লইয়া
সাঁঝের আঁধারে আমি খুঁজিয়া বেড়াবো
আমি তোমারে বন্ধু ভাল যে বাসিব
বন্ধুরে…
কোন সে ডোরে বান্ধিয়া মোরে
ঘুড্ডি বানাইয়া রাখিলা উরায়ে
শন শন করিয়া যাই গান গাহিয়া
দিও না বন্ধু তুমি লাটাই ছাড়িয়া
পাগল হইয়ে কালা যাব যে মরিয়া
বন্ধুরে…
যদি দাও ছাড়িয়া উড়িয়া উড়িয়া
যাব গো পড়িয়া কোন সে অজানায়
অজানা দেশে অচেনা বেশে
আরেক পিরীতি কুলে লইবো টানিয়া
পাগল হইয়ে কালা যাব যে মরিয়া
বন্ধুরে…


একটি মেয়ের গল্প বলি
মেয়েটি হাসে নারে
কাঁদে নারে
কাউকে কিছু বলে নারে
চুলে তার তেল থাকে না
চুল তার আউলা থাকে রে...
আউলা জাউলা থাকে রে...।

আমার যত দুঃখের কথা
যতন করা কষ্টের কথা,
আমার যত দুঃখের কথা
যতন করা কষ্টের কথা,
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম ভাসাইয়া
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম মিশাইয়া,
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম ভাসাইয়া
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম মিশাইয়া।

আমার যত দুঃখের কথা
যতন করা কষ্টের কথা।

কবিতায় লিখি নারে
তুমাকে আঁকি নারে,
কবিতায়, কবিতায় লিখি নারে
তুলিতে আঁকি নারে।

কান্দিনারে কান্দাইনারে
শুধু সুরে সুরে আমায় ধরে হাওয়াই উড়াইরে
হাওয়াই হাওয়াই।

আমার যত দুঃখের কথা
যতন করা কষ্টের কথা,
আমার যত দুঃখের কথা
যতন করা কষ্টের কথা,
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম ভাসাইয়া
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম মিশাইয়া,
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম ভাসাইয়া
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম মিশাইয়া।

আমার যত দুঃখের কথা
যতন করা কষ্টের কথা।

আমাকে আমি চিনিছি বহুবার
বুঝতে পারিনি আমি কে,
আমাকে আমি চিনিছি বহুবার
বুঝতে পারিনি আমি কে।

কথা নাই ভাসা নাই
কথা নাই ভাসা নাই,
শুধু সুরে সুরে ভাসাই আমায়
সুরের ভেলায় হাওয়ায় হাওয়ায়।

আমার যত দুঃখের কথা
যতন করা কষ্টের কথা,
আমার যত দুঃখের কথা
যতন করা কষ্টের কথা,
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম ভাসাইয়া
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম মিশাইয়া,
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম ভাসাইয়া
হাওয়ায় হাওয়ায় দিলাম মিশাইয়া।

আমার যত দুঃখের কথা
যতন করা কষ্টের কথা।

মানুষ আমি আমার কেন পাখির মত মন
তাইরে নাইরে নাইরে গেল সারাটা জীবন
তাইরে নাইরে না...
মেঘের বেশে আকাশ দেশে ওড়ে সারাক্ষণ
দুঃখের সুরে বৃষ্টি ঝরে নূপুরের মতন
তাইরে নাইরে নাইরে গেল সারাটা জীবন
তাইরে নাইরে না...
কোন ডালে সেই পাখিটার বসে নাকো মন
কারো প্রেমে ডুব দিল না এমন নিঠুর মন
তাইরে নাইরে নাইরে গেল সারাটা জীবন
তাইরে নাইরে না..
ভবের দেশে নেই এখন আর এমন একটা মন
যে আমারে বাসবে ভাল করিবে আপন
তাইরে নাইরে নাইরে গেল সারাটা জীবন
তাইরে নাইরে না...

আমি যারে ভালোবাসি, তারে আবার বাসি না...
ও কেনো তারে ভালো লাগে না, লাগে না...
আমি যারে ভালোবাসি গো...

ঘরের মায়ায় টানে মোরে
বাহিরেও যে ছাড়ে না রে
রঙ্গিলা দোটানায় পইড়া
সন্ন্যাসীও হইতে পারলাম না...
আমি যারে ভালোবাসি, তারে আবার বাসি না...
ও কেনো তারে ভালো লাগে না, লাগে না...
আমি যারে ভালোবাসি গো...

ঘুরলাম কতো বৈদেশ বন্দর
পাইলাম না তবু একটা অন্তর...
যা দেখি তাই হাওয়াই মিঠাই
আসলের আসল কিছুই নাই...
আমি যারে ভালোবাসি, তারে আবার বাসি না...
ও কেনো তারে ভালো লাগে না, লাগে না...
আমি যারে ভালোবাসি গো...


হাতে চুড়ি গলায় মালা মাথায় লম্বা চুল
আমি আধা নারী আধা পুরুষ বাঙালি বাউল।।

কখনও বা কৃষ্ণ সাজি কখনও বা রাধা
তোমাদের ফুল বাগানে সূর্যমুখী গাঁদা...

পথ আমাকে আপন করে
সংসারে বাতুল
আমি আধা নারী আধা পুরুষ বাঙালি বাউল।।

চেয়েছিলাম—গান গেয়ে দিন কাটাবো
গান বাগানের ফুল
তোমাদের গান শুনাবো, গানেরই বুলবুল—
বাহির আমার প্রেমে পড়ে—
সংসারে পাগল
আমি আধা নারী আধা পুরুষ বাঙালি বাউল।।


কৃতজ্ঞতায়: প্রদীপ চক্রবর্তী, রোদসী চক্রবর্তী, দীপক চক্রবর্তী, গাজী মোবারক হোসেন, গৌতম বাবুল, হাসান কামরুল, মাহবুব কবির।