সান্তা ফে’র চিত্রকর ও সুন্দরবনের খোঁজখবর
কিছুদিন হলো আমি যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা ফে শহরে বসবাস করছি। এখানে এসে অনেক দিন পর আমার সাথে দেখা হয়েছে রোজেন নিউমি বা রোজের সাথে। তার প্রতিবেশী হিসেবে আমি একসময় সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া নগরীতে বসবাস করেছি। রোজ এর চিত্রকলা নিয়ে লেখালেখির ধাত আছে। সে হালফিল সান্তা ফে’র বাস্তুহারা চিত্রকর ও ছিন্নমূল ভাস্করদের দিনযাপন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে একটি গাইডবুক জাতীয় বই লিখছে। সান্তা ফে-তে এসে আমি প্রথমবার এ শহরের আর্ট ডিসট্রিক্টে যাই তার সঙ্গে।
আজ বেশ উৎসাহের সাথে রোজ আমাকে নিয়ে ফের বেরিয়ে পড়েছে আর্ট ডিসট্রিক্টের দিকে। ওখানে তার বন্ধু চিত্রকর বেন স্টিলের সঙ্গে সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাচ্ছে। বছরখানেক আগে রোজের জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, সে তার স্বামীকে ডিভোর্সের মাধ্যমে পরিত্যাগ করেছে, এবং ক্যানসারের সাথে বছর দুয়েক লড়াই করে সুস্থ হয়ে উঠেছে।
দিনযাপনে নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য সে স্পষ্টত পুরুষ-সঙ্গী খুঁজছে, তার ভাষায়, ...‘শপিং অ্যারাউন্ড আ বিট টু ফাইন্ড রাইট কাইন্ড অব মেইল কমপেনিয়ন।’ যতটা বুঝতে পেরেছি, চিত্রকর বেন স্টিলের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠছে, এবং শপিং অ্যারাউন্ড প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সে বেনের সঙ্গে কখনোসখনো পরীক্ষামূলকভাবে ডেটও করছে। এ রকম একটি সাম্প্রতিক ডেটে সে বেনকে—আমি যে বাংলাদেশ থেকে আগত অভিবাসী লেখক—এ বিষয়টা কথা প্রসঙ্গে বলেছে। বেন স্টিল কী কারণে যেন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী হয়েছেন।
টিলা প্যাঁচিয়ে তৈরি মোরাম বিছানো পথে ড্রাইভ করে রোজ আমাকে নিয়ে আসে, সিটি সেন্টার ছাড়িয়ে ক্যাথেড্রালের পেছন দিককার একটি পার্কিং-লটে। কথা হয় যে, আর্ট ডিসট্রিক্টে চিত্রকর বেন স্টিলের বিচিত্র গ্যালারিটি দেখা হলে পর—আমাদের দেহমনে এক্সট্রা এনার্জি থাকলে ডিনারের জন্য যাওয়া যেতে পারে কোনো রেস্তোরাঁয়।
যে গ্যালারিতে রোজ-এর বন্ধু বেন স্টিল চিত্র আঁকার কাজ করেন, ওখানে আসতে আসতে বেলা পড়ে আসে। গ্যালারির ঘরটির দেয়ালের সাথে লাগানো এক সারি রঙচঙে মেইলবক্স। রোজ ওগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এ ডাকবাক্সের ভাস্কর্য আমাকে আকর্ষণ করে তীব্রভাবে, ঠিক বুঝতে পারি না, শিল্পী এগুলো তৈরি করে ঠিক কী বোঝাতে চাচ্ছেন?’
আমিও ডাকবাক্সগুলোতে আঁকা বর্ণাঢ্য নকশাদি খুঁটিয়ে লক্ষ করে মন্তব্য করি, ‘আজকাল তো ইন্টারনেট, ইমেইল ও ফেসবুক প্রভৃতির কারণে ডাকবাক্সের ব্যবহার কমে যাচ্ছে, তো মনে হয়, এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে শিল্পী সুসংবাদ নিয়ে আসা চিঠিপত্রের প্রাপ্তিতে যে পজিটিভ অনুভূতি হতো, তার স্মৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে চাচ্ছেন।’ শুনে রোজ ‘থ্যাংকস্ ফর ইয়োর ইন্টারপ্রিটেশন,’ বলে কাঠের দুয়ার ঠেলে ঢুকে পড়ে গ্যালারির আঙিনায়।
চোখের সামনে টেরাকোটা ইটে তৈরি মস্ত একটি মানুষের খুলির মূর্তি দেখতে পেয়ে আমি তাজ্জব হয়ে বলি, ‘ওয়াও, হোয়াট ডাজ দিস হেড মিনস্ রোজ? আই অ্যাম টোটালি লস্ট!’ সে ফিক করে হেসে বলে, ‘ডোন্ট ওয়ারি, আই নো দ্য আনসার।’
মাথার খুলি দিয়ে তৈরি মূর্তি © ছবি: লেখক
আমি পেল্লায় খুলিটির ছবি তুলতে একটু দাঁড়াই, সে মৃদুস্বরে বলে, ‘এই খুলি যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন ভাস্করের সাথে আমার কথা হয়। তাঁর নাম এখন মনে আসছে না। ফরেনসিক এনথ্রোপলজিস্টরা ব্যাবিলনের কোথায় যেন খুঁজে পেয়েছিলেন, একটি পাঁচ-ছয় হাজার বছরের ফসিল হয়ে যাওয়া মানুষের খুলির ভাঙাচোরা টুকরা-টাকরা। তারা এগুলো একত্রে জড়ো করে একটি করোটি রিকন্সট্রাক্ট করেন। বিজ্ঞানীদের হাতে পুনরায় নির্মিত মস্তকের আলোকচিত্র ছাপা হয় ফরেনসিক এনথ্রোপলজিস্টদের ম্যাগাজিনে। ওটা দেখে ভাস্কর অনুপ্রাণিত হন এ মূর্তিটি তৈরি করতে।’ রোজের খুলিবিষয়ক দীর্ঘ বর্ণনায় আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বলি, ‘থ্যাংকস্ ফর দি ব্যাকগ্রাউন্ড রোজ, বেলা পড়ে আসছে। চলো, আমরা গ্যালারিতে ঢুকি।’
‘রেট্রো পার্সপেকটিভ’ নামে এ গ্যালারির অ্যাডোবি কেতার দালানখানা বিশাল। ওখানে বেন স্টিল ছাড়াও কাজ করছেন আরও দুজন চিত্রশিল্পী। আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠেই একটি হলরুমের হাটখোলা দরোজার সামনে দাঁড়াই। কামরার বর্ণাঢ্য বাতির তলায়, মেঝেতে ফোমের নরম ইয়োগা ম্যাট পেতে শুয়ে আছে ব্যালেরিনার গোলাপি পোশাক পরা দুটি বালিকা। তারা লিওটার্ডের টাইটসে মোড়া পা দুটি আকাশের দিকে তুলে বেশ জোরেশোরে দোলাচ্ছে। তাতে প্রকাশিত হয়েছে কিশোরীদের অনিম্ন নাভিসহ তাদের মসৃণ মিডরিফ্ট [মিডরিফ]।
টুলে বসে একজন আদুল গায়ে মাসলওয়ালা পুরুষ থুতনিতে মুঠো করা হাত রেখে, বালিকাদের ছলবলে পদযুগলের দিকে তাকিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন গাঢ় চিন্তায়। এ ভদ্রসন্তানের শরীরের পালোয়ানসুলভ আকৃতি ও তার চিন্তা করার ভঙ্গি দর্শককে অবধারিতভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় যশস্বী ভাস্কর রঁদ্যার আঁকা ‘থিংকার ম্যান’ নামক একটি মূর্তির কথা।
আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পালোয়ানের দেহ থেকে চোখ সরিয়ে, মেয়ে দুটির ব্যায়ামের ভঙ্গিতে নাড়ানো দু’জোড়া পা অতিক্রম করে, দৃষ্টিকে নিয়ে যাই হলকামরার অন্যদিকে। ওখানে দাঁড়িয়ে ফিডোরা হ্যাট পরা আরেক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, তার দাড়িগোঁফে ভাবসাব মুখে গোঁজা হাতখানেক লম্বা হোল্ডারে পুড়ছে একটি সিগ্রেট। তিনি তীরন্দাজের মতো নিবিড় দৃষ্টিতে অবলোকন করছেন ব্যালেরিনা দুটির গোলাপি মসলিনে মোড়া ঊরুসন্ধির কারুকাজ।
তাবৎ দৃশ্যপটটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে ভিন্ন একটি কামরায় অঙ্কনরত এক চিত্রকরের টিভি স্ক্রিনে দেখানোরও বন্দোবস্ত করা হয়েছে। মধুর বয়ামে পড়ে আটকে যাওয়া মক্ষিকার মতো আমার চোখজোড়া সেঁটে যায় এ আচানক দৃশ্যপটে। কিশোরী দুটি জোড়া-পা অতি-ধীরে বাঁকিয়ে এখন তৈরি করছে ত্রিভুজ প্রভৃতি জ্যামিতিক নকশাদি। তাদের হাতে সোনালি রঙের স্মার্টফোন। তার চকচকে স্ক্রিনের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে মেয়ে দুটি ঠোঁটে বুলিয়ে নিচ্ছে হালকা লিপস্টিক।
সম্ভবত আমি হাঁ করে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকাচ্ছিলাম। রোজ কাঁধে চাটি মারতেই হুঁশ ফিরে। সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, ‘দিজ টিনএজার গার্লস্ আর নট ডুয়িং জিওমেট্রিক ডিজাইন ফর ইয়োর প্লেজার। তারা শিল্পীকে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় তাবৎ কিছু অবলোকন করে চিত্র তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করছে। এখানে তোমার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, হাঁ করে তাকিয়ে থাকাটা অশোভন।’
এক সারি রঙচঙে মেইলবক্স © ছবি: লেখক
রোজের বক্তব্যের সাথে আমি একমত হয়ে তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে সামনে এগোতে চাই। রোজ আমাকে থামিয়ে দিয়ে রহস্যজনকভাবে হেসে বলে, ‘যদি বেন স্টিলের সাথে আজ তোমার দেখা হয়, একটা জিনিস খেয়াল করবে, তার স্টুডিওতে আছে সম্পূর্ণ পাথরে তৈরি বিচিত্র একটি চেয়ার। কখনোসখনো এ চেয়ারে বসে থাকে নগ্ন কোনো এক মডেল কন্যা। বি সুপার কেয়ারফুল, ডোন্ট ট্রাই টু টেক হার পিকচার... তুমি ছবি তুলতে গেলে বেন হয়তো জ্যাক ডানিয়েলের খালি শিশি দিয়ে তোমাকে আক্রমণ করতে পারে...।’
প্রতিক্রিয়ায় আমি বলি, ‘অলরাইট, থ্যাংকস্ ফর অ্যালার্টিং মি, এ মডেল-কন্যা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তুমি জানো কি?’ রোজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘নট আ হৌল লট, বাট...’, সে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে কিছু বিচিত্র তথ্য দেয়। শুনে আমার তো আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়!
আঙিনা পাড়ি দিয়ে অতঃপর আমরা ঢুকে পড়ি, ভিন্ন আরেকটি হল কামরায়। এখানকার দেয়ালে ঝুলছে রোজের বন্ধু বেন স্টিলের বিচিত্র কিছু চিত্র। রোজ আমাকে এ কামরায় দেয়ালে ঝুলন্ত চিত্র দেখে সময় কাটানোর পরামর্শ দিয়ে বলে, ‘আমি পেছনের দিকের স্টুডিওতে একটু ঢুঁ মারছি। বেন স্টিল সম্ভবত ওখানে কাজ করছে। তুমি যে এসেছ তাকে এ খবরটা প্রথমে আমি দিতে চাই। তারপর সে আগ্রহী হলে তোমাকে তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেব। বেন তোমার সাথে কী একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চায়।’ আমি ‘ইটস্ অলরাইট রোজ, গো অ্যাহেড,’ বলে তাকে স্টুডিওতে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে ঢুকে পড়ি হলকামরায়।
আমি গ্যালারির দেয়ালে ঝোলানো চিত্রগুলো নজর করে দেখছিলাম। সেলস্-গার্ল ধরনের একটি মেয়ে এসে আমাকে জানায় যে—পেছন দিকের স্টুডিও কামরায় বেন স্টিলের সঙ্গে রোজ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সে আমাকে হাতের ইশারায় ভেতরের কামরায় যাওয়ার পথ বাতলে দিলে আমি ওদিকে অগ্রসর হই।
গ্যালারির পেছন দিকে আছে ভেতরের স্টুডিতে যাওয়ার ছোট্ট করিডর। তা পেরিয়ে যেতেই, দেয়ালে টাঙানো বেন স্টিলের একটি কাজে আমার চোখ আটকে যায়। চিত্রটির শিরোনাম দালি’স ডেইরি। দুধের খামারটির চারপাশে যেন বেজায় দীর্ঘ রনপা পড়ে চলছে কয়েকটি নাদুস-নুদুস গাভি। আমি সচেতন যে, সুরিয়েলিস্ত ঘরানার স্প্যানিশ চিত্রকর সালভাদর দালির [১৯০৪-১৯৮৯] হাতি প্রভৃতি জন্তুর ঠ্যাং বেজায় দীর্ঘ করে আঁকার প্রবণতা ছিল। তো এখানে ঘটনা কী?
করিডরের শেষ মাথায় এসে দেখি, আরেকটি চিত্রে দালি মহোদয় মোমঘষা তাঁর সুচালো গোঁফ পাকিয়ে, ছবি আঁকার গলে যাওয়া কতগুলো ক্রেয়নের দিকে তাকিয়ে আছেন। এ চিত্রটি দালির ‘দ্য পারসিসটেন্ট মেমোরি’ শিরোনামের একটি প্রসিদ্ধ চিত্র—যেখানে একাধিক গোলাকার ঘড়ি অবক্ষয়ে গলে গলে বাঁকাচোরা হচ্ছে, তার কথা মনে করিয়ে দেয়। কাজগুলো দেখে মনে হয়, বেন স্টিল বিখ্যাত সব ওস্তাদ চিত্রকরের কিছু চিত্রকে সৃজনশীলভাবে হিউমার মিশিয়ে প্যারোডির মতো করে আঁকতে পছন্দ করেন।
স্টুডিওতে ঢোকার মুখে চৌকাঠের উল্টা দিকে পেল্লায় একটি আয়না দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। প্রমাণ সাইজের আরশিটির গিল্টি করা স্বর্ণাভ ফ্রেম ছড়াচ্ছে গেল শতকের ধ্রুপদি আসবাবপত্রের আভিজাত্য। আমি আয়নায় রোজ এর প্রতিচ্ছায়া দেখতে পেয়ে খানিক চমকাই!
একটি রংচটা ঝ্যালঝেলে কাউচে বসে চিত্রকর শ্রীমান বেন স্টিল। তাঁর থুতনিতে হিস্পানিক কেতার সংকীর্ণ দাড়ির রেখা। রোজ একটি আইভুরু পেনসিল দিয়ে তার জুলফিতে ধূসর রঙে ঝলসানো চুল কটি ঘষে ঘষে করে দিচ্ছে কালচে-নীলাভ। স্টিল মহোদয় আবেশে চোখ মুদে ডান হাতে প্যাঁচিয়ে ধরেছেন রোজের কোমর। তার অন্য হাতটি টপের ভেতর কিছু একটা খুলিবিলি করতে করতে কাঁচুলির প্রতিবন্ধকের কাছে এসে থামলে, আইভুরু পেনসিল ঘষতে ঘষতে রোজ নীরবে বিষয়টিকে প্রশ্রয় দেয়। তারপর বুক থেকে চিত্রকরের হাত সরিয়ে দিয়ে, তাঁর চুল মুঠো করে কষে ধরে কাছে টেনে এনে কপালে কষে চুমো খায়।
আমি চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করি, এ মুহূর্তে স্টুডিওতে ঢুকে পড়াটা কি সমুচিত হবে? আরশিতে প্রতিফলিত রোজের চোখের সাথে আমার চোখাচোখি হতেই কানের ঝুমকোপাশায় টারকুইজ পাথরের নীলাভ দ্যুতি ছড়িয়ে সে বলে, ‘কাম অন আভার ম্যান, হোয়াট আর ইউ ওয়েটিং ফর?’
স্টুডিওতে ঢুকতেই কাউচ ছেড়ে উঠে দাঁড়ান চিত্রকর বেন স্টিল। টালমাটাল পায়ে আগ বাড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে তিনি চুপচাপ আমাকে নিরিখ করেন। দারুণ অস্বস্তি নিয়ে আমি স্টুডিওর দেয়ালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। দেখি—অনেকগুলো পেইন্টব্রাশ দিয়ে চমৎকার একটি বৃত্ত তৈরি করে দেয়ালে আটকানো হয়েছে। ঠিক বুঝতে পারি না এ মুহূর্তে আমার করণীয় কী।
বেন যেন হঠাৎ করে ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন, এমনি ভঙ্গিতে ধড়মড়িয়ে কাউচে বসতে বসতে জড়ানো কণ্ঠস্বরে বলেন, ‘সরি ফর কিপিং ইউ ওয়েটিং। রোজের কাছে শুনেছি তুমি একটি কন্যাসন্তানের জনক। আই হোপ ইয়োর ডটার ইজ ডুয়িং অলরাইট। আমার যমজ দুটি মেয়ে বড্ড জ্বালাতন করছে। এসব সমস্যা নিয়ে রোজের সাথে পরামর্শ করছিলাম।’
খানিক হতাশার সাথে মাথাটি ডানে-বামে ঝাঁকিয়ে তিনি ফের কথা বলেন, ‘ওয়েল...থ্যাংক ইউ ফর স্টপিং বাই। তোমার সাথে জরুরি আরেকটা বিষয় নিয়েও কথা আছে।’ আমি করমর্দন করতে করতে বলি, ‘আমার মেয়ে কাজরির দিনযাপন খুব ভালোভাবে চলছে, সে শখের ফটোগ্রাফার। তার তোলা ছবি স্থানীয় একটি জার্নালের কাভার হয়েছে। আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি আবাউট দিস।’
বেন স্টিল ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘কংগ্রাচুলেশনস্ ফর ইয়োর ডটারস্ সাকসেস্। আমি অতটা ভালো ভাগ্য নিয়ে জন্মিনি। বুঝলে, আমার মেয়ে দুটি প্রতিদিন তৈরি করছে নতুন নতুন স্ট্রেস।’ আমি তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে জানতে চাই, ‘বেন, আপনি এ ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চান কি।’ তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, ‘ওহ্ ইয়েস। বাট বিফোর দ্যাট হাউ আবাউট আ ড্রিংক?’
আমার উত্তরের কোনো প্রত্যাশা না করে বেন সাইড টেবিলে গিয়ে পানপাত্রে ঢালেন জ্যাক ডানিয়েল। আমি স্টুডিওর চারদিকে তাকাই। ইজেল, তুলি ও রঙের টিউব ছাড়া ছড়ানো-ছিটানো আছে বেশ কয়েকটি অর্ধেক কাজ করা চিত্রাদি ও নানা রকমের ফ্রেম। তখনই সুরমা রঙের গ্রানাইট পাথরে তৈরি বিচিত্র চেয়ারটি নজরে পড়ে। রোজের সাবধান বাণী ফিরে আসে মনে। তার ফিসফিসিয়ে বলা তথ্যটি নিয়ে তর্পণ না করে পারি না।
সিঁড়িতে রুমির কবিতার ছত্র © ছবি: লেখক
চিত্রকর বেন এর নাকি প্রেরণার সংকট দেখা দিলে, তিনি তাঁর প্রিয় লাতিন মডেল-কন্যাটিকে লাগোয়া একটি সোওনাতে উষ্ণ বাষ্পে অনেকক্ষণ ভিজতে নির্দেশ দেন। তারপর নগ্নিকাটি সিক্ত শরীরে এসে পাথরের চেয়ারে বসে তার অঙ্গ জুড়ায়। আমার ভাবনা অধিক অগ্রসর হওয়ার কোনো সুযোগ পায় না। বেন আমার দিকে তাকিয়ে গ্লাসে আইস কিউব মিশিয়ে জানতে চান, ‘উড ইউ লাইক সাম জ্যাক ডানিয়েল?’ আমি ও রোজ একসাথে মাথা হেলিয়ে বোঝাতে চাই—উই আর নট ইন্টারেস্টেড। তিনি গ্লাস নাড়িয়ে আইস কিউবের চিং-চাং ধ্বনিতে জানতে চান, ‘হোয়াই নট?’ রোজ জবাব দেয়, ‘উই ডোন্ট ওয়ান্ট টু গেট টিপসি রাইট নাউ, টু আর্লি ফর দ্যাট, বেন।’
প্রতিক্রিয়ায় বেন পাত্র থেকে বেশ খানিকটা হুইস্কি এক ঢোঁকে গিলে নিয়ে বলেন, ‘ও-কে দেন। রেফ্রিজারেটরে ঠাণ্ডা কমবুচা রাখা আছে। আই হোপ ইউ উইল এনজয় দিস নন-অ্যালকোহেলিক ড্রিংকস।’ তিনি ফ্রিজ খুলে জগ থেকে দুটি গ্লাসে ঢেলে কমবুচা আমাদের দিকে বাড়িয়ে দেন। পানীয়টি আমি আগে কখনো পান করিনি, তাই দ্বিধাগ্রস্তভাবে রোজের দিকে তাকাই। সে আমার সংশয় বুঝতে পেরে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘দিস ইজ আ গ্রিন টি বেইসড্ ড্রিংকস। এতে চায়নার মানচুরিয়ান মাশরুম ফারমেন্ট করে মেশানো হয়েছে।’ আমি চুমুক দিই, কমবুচা নামের পানীয়টি স্বাদে কিন্তু খারাপ লাগে না।
বেন একটি টুল টেনে আমাদের পাশে বসে দীর্ঘ চুমুকে হুইস্কির পুরো পাত্র খালি করে, ‘অহ ম্যান, দিস ইজ ট্রুলি ব্যাড’, বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আমাকে কোনো প্রশ্নাদি করতে হয় না। বেন নিজে থেকে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। ২০০৫ সালের দিকে তিনি মাস ছয়েক একটি ব্লন্ড চুলের হিস্পানিক মেয়ের সঙ্গে ডেট করেছিলেন। তাদের বিবাহের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সন্তানের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ না থাকায় তারা প্রটেকশন নিয়ে শরীরী ভালোবাসায় লিপ্ত হতেন, বাট সামথিং ডিডন্ট ওয়ার্ক। তাঁর হিস্পানিক গার্লফ্রেন্ড প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে।
বেন তাঁকে এবরশনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে তাঁর বান্ধবী জানায় যে—শি লাইকড্ টু হ্যাভ দ্য চাইল্ড। পরে—একটি নয় তাদের দুটি যমজ মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। দেখতে একদম আইডেনটিক্যাল টুইন, দুটি আচার-ব্যবহারে একেবারে একই রকমের। এদের একটির নাম ভোরোনিকা ও অন্যটির নাম ফ্রসেনথিয়া। এরা দুজনে একই রঙ ও স্টাইলের পোশাক-আশাক পরে, তাই বাইরের লোকজনের পক্ষে একটি থেকে অন্যটিকে আলাদা করে চেনা মুশকিল।
মেয়ে দুটির মা-এর সঙ্গে বেন স্টিলের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেক বছর। তাঁর প্রাক্তন বান্ধবী যমজ মেয়ে দুটিকে নিয়ে তাঁর নতুন স্বামীর সঙ্গে ঘর করছে। তবে বেন মেয়ে দুটির রাহা-খরচ সরবরাহ করে থাকেন। টেলিফোনে হামেশা তাদের খোঁজখবর করেন। ক্রিসমাস বা থ্যাংকস্ গিভিংয়ের পরবে তাদের দেখা-সাক্ষাৎও হয়।
দীর্ঘ ব্যাকগ্রাউন্ডের পর বেন সাইড টেবিলে ফিরে গিয়ে ফের পাত্র ভরে জ্যাক ডানিয়েল নেন। আমার অধৈর্য লাগে, তাই চুমুক দিতে দিতে বেন তার টুলে ফিরে আসতেই আমি প্রশ্ন করি, ‘বেন, ভেরোনিকা ও ফ্রসেনথিয়া আদতে কি সমস্যার সৃষ্টি করছে, তা একটু বলবেন কি?’
তিনি পাত্রের তরলে ভাসা আইস কিউব নাড়িয়ে বলেন, ‘ইটস্ টেরিবোল। মেয়ে দুটি তাদের ক্লাসের সবচেয়ে অ্যাথলেটিক গোছের এক ছেলের প্রেমে পড়েছে। ছেলেটি বাস্কেটবল প্লেয়ার। একই ছেলের সাথে একটু আড়াল-আবডাল রেখে মেয়ে দুটি সম্পর্ক বজায় রাখলে আমার আপত্তি কিছু ছিল না। বাট টু গার্লস্ আর হেভিং ত্রিসাম সেক্স উইথ দ্য বয়। আর এসবের কিছু ছবিও তারা সোশ্যাল মিডিয়াতে দিচ্ছে। দিস ফিলস্ ট্রুলি টেরিবোল।’
বিষয়টি ব্যক্তিগত, তাই আমি কোনো মতামত দিতে চাই না। আমার সংশয় আঁচ করতে পেরে রোজ কথা বলে। সে বেনকে উপদেশ দেয়, টিনএজ মেয়েদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে অভিজ্ঞতা আছে এ ধরনের সাইক্রিয়াট্রিস্টের তালাশ করতে।
ডালির থিমের সৃজনশীল ব্যবহার © ছবি: লেখক
বেশ কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে বেন আমার দিকে তাকিয়ে আলটপকা প্রশ্ন করেন, ‘তোমার বাড়ি সুন্দরবনে, অ্যাম আই রাইট?’ জবাবে আমি ‘বাংলাদেশ’ বলে আমার স্বদেশের নাম উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করি, ‘অনেক বছর আগে আমি বার দুয়েক সুন্দরবনে বেড়াতে যাই। আমার বসতবাড়ি সুন্দরবন থেকে তিনশ মাইল দূরে। সুন্দরবন কোনো আবাসিক এলাকা নয়, ওখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রল হরিণের বসবাস, মি. বেন।’ মাথা ঝাঁকিয়ে বেন বলেন, ‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড দিস। বাংলাদেশের কোনো যশস্বী চিত্রকরের সুন্দরবন নিয়ে আঁকা পেইনটিংয়ের অনুলিপি আমি খুঁজছি, ক্যান ইউ হেল্প মি উইথ দিস।’ আমি এবার আতান্তরে পড়ি, সুন্দরবন নিয়ে ফটোগ্রাফস্ আছে বিস্তর, কিন্তু আমাদের বিখ্যাত সব শিল্পী, যেমন—জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান বা কামরুল হাসান সুন্দরবন নিয়ে কোনো ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছেন কি না আমি ঠিক জানি না। কিন্তু বেন সুন্দরবন নিয়ে আঁকা চিত্র খুঁজছেন কেন? বিষয়টা বোঝার জন্য সরাসরি প্রশ্ন করি, ‘হোয়াই আর ইউ ইন্টারেস্টেড, হোয়াট ইজ ইয়োর কানেকশন উইথ সুন্দরবন বেন?’
তিনি জবাব দেন, ‘আমার মেটারনেল গ্র্যান্ডমাদার ভারত বিভক্ত হওয়ার আগে সুন্দরবন থেকে বেশ দূরে, নারায়ণগঞ্জ বলে এক জায়গায় তাঁর মা-বাবার সাথে বাস করতেন। তাঁর বাবা নারায়ণগঞ্জে চাকরি করতেন। তো আমার নানি, তাঁর নাম মিসেস রুমার গাডেন তাঁর পরিবারের সাথে স্টিমারে চড়ে সুন্দরবনে বেড়াতে গিয়েছিলেন।’
আমি এবার জানতে চাই, ‘বেন, আপনি কি আপনার নানির মুখ থেকে সুন্দরবনে বেড়ানোর গল্প শুনেছেন।’ তিনি জবাব দেন, ‘নো, নট রিয়েলি। আমার নানি ও তাঁর পরিবারের সবাই বিলাতের লোক, আমার মা অল্প বয়সে আমার আমেরিকান বাবাকে বিয়ে করে যুক্তরাষ্ট্রে এসে অভিবাসী হন। নানির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে মাত্র দুবার, তখন আমি বয়সে ছিলাম খুব ছোট্ট।’
আমার কৌতূহল মেটে না, তাই ফের জানতে চাই, ‘টেল মি বেন, সুন্দরবন সম্পর্কে আপনি জানলেন কীভাবে?’ বেন জড়ানো স্বরে জানান, ‘আমার নানি মিসেস রুমার গডেন ও তার বোন মিসেস জন গডেন সুন্দরবনে তাদের নৌভ্রমণের ওপর চমৎকার একটি বই লিখে গেছেন। বইটির নাম টু আন্ডার দি ইন্ডিয়ান সান। ওখানে বালুচরে হাঁ করে শুয়ে থাকা বিশ ফুট লম্বা একটি কুমিরের বর্ণনা আছে। কতগুলো সুন্দর সাদা পাখি নাকি তার দাঁত থেকে খুঁটে নিচ্ছিল খাদ্যকণা।’
বেন আবার চোখ মুদে ঝিম ধরেন। মনে হয়, জ্যাক ডানিয়েলের প্রভাবে তিনি টিপসি হয়ে পড়ছেন। আমার বেজায় অধৈর্য লাগে। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। বেন চোখ খুলে দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘বাংলাদেশের নামকরা কোনো শিল্পীর সুন্দরবন নিয়ে আঁকা একটি চিত্রের প্রতিলিপি যদি আপনি জোগাড় করে দিতে পারতেন... অহ্ ডিয়ার... আমার মাথায় এত সব আইডিয়া ঘুরছে, চিত্রটিকে আমি এমনভাবে ব্যবহার করতাম...।’
আমি তাঁকে ভরসা দিয়ে বলি, ‘বাংলাদেশের চিত্রকলা সম্পর্কে আমি তেমন একটা ওয়াকিবহাল না হলেও আমার জানাশোনা বন্ধুবান্ধব আছে, যেমন মঈনুদ্দীন খালেদ বা মোবাশ্বির আলম মজুমদার—এরা চিত্রকলা নিয়ে হামেশা লেখাজোকা করে, এদের কাছে খোঁজখবর নিয়ে দেখব, এরা হয়তো সুন্দরবন নিয়ে আঁকা কোনো ল্যান্ডস্কেপের সন্ধান দিতে পারবে।’
আমার কথা শুনে আগ্রহে যেন বেন আড়মোড়া ভেঙে জাগেন। তিনি জড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘ম্যান, প্লিজ টেল মি মোর।’ আমি একটু ভেবেচিন্তে এবার জবাব দেই, ‘তো বেন, আই হ্যাভ আ ফাইনাল কোয়েশ্চন। যদি আমি একটি চিত্রের অনুলিপি জোগাড় করতে পারি, আপনি তা কীভাবে ব্যবহার করবেন, কুড ইউ এক্সপ্লেইন ইট টু মি প্লিজ?’ এ প্রশ্নে বেনের চোখেমুখে বারুণীর মেলায় বেলুন খরিদ করতে পারা শিশুর মতো ফুটে ওঠে খুশির ছটা, তিনি জবাব দেন, ‘আমার নানির বাবা—যিনি নারায়ণগঞ্জে চাকরি করতেন, তাঁর তোলা ছবির একটি অ্যালবাম আমার হাতে এসেছে। ওতে আমি দোনলা বন্দুক হাতে ইংরেজ সাহেবদের শিকারে যাওয়ার কয়েকটি ছবি পেয়েছি।’
দেয়ালে পেইন্টব্রাশ দিয়ে তৈরি বৃত্ত © ছবি: লেখক
একটু পজ্ নিয়ে, খানিকক্ষণ একমনে কী যেন ভেবেচিন্তে বেন ফের কথা বলেন, ‘আপনি যদি সুন্দরবন নিয়ে আঁকা একটি চিত্র জোগাড় করে দিতে পারেন, তাহলে আমি তাতে বেঙ্গল টাইগার ও কুমিরের ছবি এঁকে, তাদের মুখে বসিয়ে দেব বন্দুক হাতে শিকার করতে যাওয়া ইংরেজ সাহেবদের মুখের অভিব্যক্তি।’
আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি, ‘বেন, দিস ইজ ইনডিড আ কুল আইডিয়া। আমি চেষ্টা করে দেখব, বাংলাদেশি কোনো শিল্পীর আঁকা সুন্দরবনের চিত্র জোগাড় করতে পারি কি না।’ রোজও উঠে দাঁড়িয়ে বেনকে উষ্ণ হাগে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলে, ‘বেন, ডোন্ট ওয়ারি আবাউট ইয়োর টু গার্লস্, অল উইল ওয়ার্ক আউট ফাইন। এখন তুমি একটু রেস্ট নাও।’
আর্ট ডিসট্রিক্টের সরণিতে নেমে আসতেই দেখি—সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই। আকাশে সূর্যাস্ত লোহিত বর্ণের খানিক ফিকে হয়ে আসা ছটা এমনভাবে ছড়িয়েছে যে—আমরা বারবার ঘাড় ফিরে তাকাই। বিধুর এ দৃশ্য—ফরাসিদেশে ইমপ্রেশনিস্ট ঘরানার নামজাদা চিত্রকর ক্লদ মোনের আঁকা পপি ফুলে ছাওয়া প্রান্তরের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমরা নীরবে হেঁটে কদম কয়েক সামনে বাড়তেই দেখি, সড়কে দাঁড়িয়ে আর্কেডিয়ান বাজাচ্ছেন নিঃসঙ্গ বাদক। তাঁর সুরধ্বনি ভারি চেনা লাগে। আমরা দাঁড়িয়ে পড়ে একটু মনোযোগ দিয়ে শুনি, শুনতে শুনতে লিরিকের কথাগুলো স্মৃতিতে ফিরে আসে। অনেক দিন পর আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি, এক জামানায় পিট সিগারের গাওয়া জনপ্রিয় সংগীত—‘হোয়ার হ্যাজ অল দ্য ফ্লাওয়ারস্ গন...’। বাজানো শেষ হতেই আমরা হাততালি দিই। ছোট্ট একটি মেয়ে এগিয়ে এসে বাদককে অনুরোধ করে, ‘কুড ইউ প্লিজ সিং টুইংকল টুইংকল লিটিল স্টার ফর মি?’
‘অবকোর্স আই ক্যান’ বলে প্রৌঢ় বাদক আর্কেডিয়ানে বাজান শিশুতোষ গানের সুর। বাচ্চা মেয়েটিও তাঁর বাদনে গুনগুনিয়ে গলা মেলায়। আমরা ফের আকাশের দিকে তাকাই। আর সূর্যরঙিন দিনের শেষটুকু আমাদের কাছে সেন্টিমেন্টাল হয়ে ওঠে।
সংগীতের আবহ শেষ হয়, আমরাও ফের পা চালাই। সরণিতে আরও কিছুক্ষণ হাঁটতেই খেয়াল করি যে—রোজ খুব কষ্টেসৃষ্টে আগ বাড়ছে। তাকে বেজায় ক্লান্ত দেখায়। সারা বিকেল ধরে আমরা এলোপাতাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছি, খানিক খিদেও পেয়েছে। তাই জানতে চাই, ‘রোজ, উড লাইক টু টেক আ ব্রেক? কোনো রেস্তোরাঁয় বসে পড়ে কিছু খেয়ে নিলে ভালো হয় না।’
হাঁটতে হাঁটতে সে জবাব দেয়, ‘আরেকটু হাঁটতে হয় যে, আই অ্যাম ইন আ মুড টু ট্রাই পার্সিয়ান রাইস। সামনেই আছে মিলাদ নামে একটি ইরানিয়ান রেস্তোরাঁ। চলো, ওখানে বসে পারস্যের সুরভিত পোলাওয়ের সঙ্গে গোরমা-সবজি খেয়ে নিই।’
আমরা এসে পড়ি, মিলাদ রেস্তোরাঁর কাছাকাছি কাঠে তৈরি দৃষ্টিনন্দন একটি সিঁড়ির কাছে। সিঁড়িতে লোহিত বার্নিশে লেখা সুফিসন্ত হজরত জালাল উদ্দীন রুমির একটি মসনবীর ইংরেজি তর্জমা। রোজ ক্লান্তিতে সিঁড়ির ওপর বসে পড়ে। আমি নোটবুক বের করে রুমির কবিতার ছত্রটি টুকে নিই। তাতে লেখা, ‘লেট দ্য বিউটি অব হোয়াট ইউ লাভ বি হোয়াট ইউ ডু।’