রহস্যময় দেশপ্রেম এবং কাজীদা

 

কাজীদাকাজী আনোয়ার হোসেন আর নেই,এটি কোনো নিরীহ, সরল বাক্য নয়। বিশেষত আমার মতো গন্তব্যহীন মানুষের কাছে, যার প্রায়শই মনে হয়, সত্যিকার অর্থে কারও মৃত্যুই বলে দিতে পারে, সে আসলে কতটুকু প্রিয় ছিল, তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের গাঁটছড়া কতটুকু শক্ত ছিল, দূরত্বে থেকেও সে কত আপনার ছিল। মৃত্যুসংবাদ এসে দরজায় কড়া নাড়লে মানুষ টের পায়, অনুভবের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা শত্রুটিও তাঁকে কতটুকু কাঁপিয়ে তুলতে পারে। মৃত্যু এক দক্ষ মৎস্যশিকারি, অসীম ধৈর্য নিয়ে সে অপেক্ষা করে, ছিপের সুতোয় টান পড়লেও সে উত্তেজিত হয় না, ভালো করে তাকিয়ে দেখে নেয় এই টান মৃত্যুটান হয়ে উঠবে কি না। দক্ষ সেই মৎস্যশিকারি শেষ পর্যন্ত তার ঝুলিতে তুলে নিল কাজীদাকে। যিনি নিজেও শিকারি ছিলেন, মৎস্যশিকারিও ছিলেন বটে এককালে আর দূর কৈশোরে একদিন ট্রেনে চেপে বসে চলে গিয়েছিলেন সেই ভৈরবে, যেখানে এখানে ওখানে ছড়িয়ে পড়েছিল তার জন্য রাজ্যের ভাঙা কাচ। তিনি সেসব টুকরো অসীম মমতায় জড়ো করে থলি অথবা বস্তায় তুলে রওনা হয়েছিলেন বাড়ির দিকে।

শৈশব কী ভীষণ সরল, তার চাহিদা কত সামান্যভাঙা কাচের টুকরোও তখন কী বিশাল প্রাপ্তি হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার বোধ করি, শৈশবে থাকে বিশ্বাস করার অপরিসীম ক্ষমতা। স্কুলের শিক্ষক কাজীদার বাবার নাম জানার পর নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁকে, বাবাকে তোমার কী মনে হয়? সোজাসাপটা বলেছিলেন তিনি, বাবা তো বোকা। বাবাকে বোকা বলছে! অবাক হয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক, তা তাঁর কথায় গোপনও থাকেনি; কিন্তু তাঁর চেয়েও অবাক কণ্ঠে বলেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন, বোকাই তো। মা তো তাই বলে। মা বাবাকে বোকা বলে থাকেন, অতএব তিনি নিশ্চয়ই বোকা, বিশ্বাস করার এমন অপরিসীম ক্ষমতা শৈশবেই থাকে। অবশ্য এ দেশের অসংখ্য শিশুর শৈশব এ রকম হয় না, আমাদের চারপাশ এমন যে, অসংখ্য শিশু শৈশব থেকেই মানুষকে অবিশ্বাস করতে শেখে, এমনকি নিজের মা-বাবাকে, ভাইবোনকেও। কাজী আনোয়ার হোসেনের সৌভাগ্য তাঁর ও তাঁর ভাইবোনদের শৈশব সে রকম হয়নি। সরলতা নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে উপলব্ধি করা সত্যটুকু উচ্চারণ করতে পারতেন তারা। কাজী মোতাহার হোসেন নিজেই লিখেছেন তাঁর এক লেখাতে, কুষ্টিয়া হাইস্কুলে তাঁর গণিতের শিক্ষক ছিলেন হৃশীকেষ মজুমদার। তিনি একবার ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষক হিসেবে ঢাকায় এসে উঠেছিলেন তাঁর বাড়িতে। কাজী মোতাহার হোসেন এই আসার বিষয়টি সম্পর্কে লিখেছেন, স্পষ্ট মনে আছে—‘শুভাগমন; শিক্ষকের ছাত্রের বাড়িতে আসার ঘটনাকে বিশেষ পদবাচ্যে চিহ্নিত করেছেন তিনি। সেই শিক্ষকের কাছে দুই ছেলে কাজী আনোয়ার আর নুরুদ্দীনকে রেখে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। ফিরে এসে দেখেছিলেন, শিক্ষক হৃশীকেষ মজুমদার তাঁদেরও পড়াচ্ছেন। শিক্ষক চলে যাওয়ার পর কাজী মোতাহার হোসেন জানতে চেয়েছিলেন, আমার মাস্টারমশাই কেমন পড়ালেন? আমার মতন? তাঁরা দুজনেই একবাক্যে উত্তর দিয়েছিলেন, না, আপনার চেয়ে অনেক ভালো।

কাজী আনোয়ার হোসেনের বোন সনজীদা খাতুন, তাঁর স্মৃতিকথায় পাই, উনসত্তর সালে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়াতে গেছেন, সেখানে এক ছাত্র এসেছে তাঁর সঙ্গে ভক্তিভরে পরিচিত হতে। ছাত্র বলছে তাঁকে, আপনি যে মাসুদ রানার বোন, সেটা আমি আগে জানতাম না। ওনাকে আমরা খুব শ্রদ্ধা করি। শুনে তাঁর পিত্তি জ্বলেছে, নবাব মিয়া [কাজী আনোয়ার হোসেনের ডাকনাম] স্বাধীনভাবে লেখালেখি করে মানুষের মনে তাঁর চেয়ে জ্যেষ্ঠতা দখল করে বসে আছে বলে [অতীত দিনের স্মৃতি, প্রজাপতি প্রকাশন]

অনুমান করি, এভাবে শৈশব থেকেই বন্ধনহীনভাবে সত্যকে উপলব্ধি করতে ও বলতে শিখেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তবে এটুকুও বলে নেওয়া ভালো, তাঁকে নিয়ে আমাদের পক্ষে কিছু ভাবতে যাওয়ার প্রথম ঝুঁকিই এই যে, এই ভাবনায় পক্ষপাতদুষ্টতা থাকবেই। এবং দ্বিতীয়ত, এই ভাবনায় অনিবার্যভাবেই চলে আসবে আরও সব প্রজন্মের শৈশব, কৈশোর এবং তা চিন্তাকে নিমজ্জিত করবে বর্তমানেও। আমরা বিভিন্নভাবে নির্মিত হয়েছি, নির্মিত হই। আমাদের নির্মাণ করে আমাদের পরিবার, নির্মাণ করে প্রতিবেশ, নির্মাণ করে সমাজ, নির্মাণ করে চারপাশের নানা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আভাস, পূর্বাভাস, ঘটনা-দুর্ঘটনা; কিন্তু সেই আমাদের অনেকের পক্ষেই অস্বীকার করা অসম্ভব, অস্বীকার করা সত্যের অপলাপ যে, আমাদের খানিকটা হলেও নির্মাণ করেছে মাসুদ রানা, কুয়াশা, সেবা প্রকাশনীএককথায়, কাজী আনোয়ার হোসেন। এই নির্মাণযজ্ঞ তিনি চালিয়েছেন তাঁর নানাবিধ উসকানির মধ্যে দিয়ে, পর্দার নেপথ্যে থেকে যাওয়ার নির্লিপ্ততা দিয়ে, তাঁর সৃষ্টি মাসুদ রানার মধ্যে দিয়ে। মাসুদ রানাবাস্তবে অস্তিত্বহীন তাঁর তৈরি এই দুঃসাহসী স্পাই চরিত্র আমাদের বারবার উদ্বুদ্ধ করেছে নৈতিকতাকে নতুন দৃষ্টিতে ভাবতে, মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করতে, উত্তেজিত করেছে রহস্যময়তার মুখোমুখি হতে এবং সবকিছুকে তুচ্ছ করে দেশপ্রেমের জন্য নিজের জীবনকেও তুচ্ছ করে ফেলতে। আমি যা হতে পারিনি, তাই মাসুদ রানা’—কাজীদার এই কথা নিছক কথার কথা নয়, মাসুদ রানার তলদেশে লুকিয়ে আছে তাঁর সংগুপ্ত সব হাহাকার, নতুন ডাঙার দিকে যাত্রার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা, তাঁর নিজের না পাওয়াগুলোকে তিনি এতে জড়ো করেছেন ভীষণ নিবিড় মমত্ব দিয়ে। যেন তাতে আমরা খুঁজে পাই আবুল হাসানের সেই আহ্বান, আমার না পাওয়াগুলি জোড়া দাও/ আমি তোমাদের ভালো থাকা হব। তাঁর সেই না পাওয়াগুলি জোড়া দিয়ে তৈরি করা চরিত্রটি আমাদের সীমিত জীবনের একঘেয়েমি থেকে একটানে তুলে নিয়ে যায় স্বপ্নের এক আশ্চর্য মায়াবী জগতে। আর সেই চরিত্রের সবকিছুকেই ন্যায্যতা দেয় বোধ করি দেশপ্রেম, অন্যায় অবিচার দেখলে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়।

একটি রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, জাগিয়ে তোলার জন্য যেসব উপাদানের দরকার হয়, তার মধ্যে অন্যতম এই দেশপ্রেমজাতীয়তাবাদও বোধ করি জড়িয়ে থাকে যার সঙ্গে। এই জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত চরিত্র কী দাঁড়ায় সেটি নিয়ে অনেক কথাই রয়েছে, রয়েছে অনেক বিতর্ক; এমনকি তত্ত্ব কিংবা সুলুকসন্ধানের মতো ধূমায়িত চায়ের কাপ ছাড়াই আমরা চারপাশের অনেক উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি, দেশপ্রেম থাকার পরও জাতীয়তাবাদের সাঁড়াশিতে কী করে নির্যাতিত হতে হয় অনেককে। কিন্তু এটাও আবার অস্বীকার করার জো নেই যে, জাতীয়তাবাদের একটি প্রগতিশীল চরিত্রও থাকে এবং বিশেষত একাত্তর অব্দি তার সেই চরিত্র এ দেশের মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছে সামনের দিকে। কাজী আনোয়ার হোসেন যখন তাঁর সৃষ্টিশীলতা নিয়ে মুখরিত হচ্ছেন, তখন এই ভূখণ্ডে দানা বেঁধে উঠছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, জাতীয় মুক্তির আন্দোলনও বটে। তিনি নিজে যে পরিবার থেকে এসেছিলেন, সেই আন্দোলনে এই পরিবারটিরও রয়েছে সৃজনমুখর ভূমিকা। কাজী মোতাহার হোসেন নিজেই তো ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের উচ্চকিত সংগঠক। কাজী আনোয়ার হোসেনের বোন সনজীদা খাতুন, তাঁর স্মৃতিকথায় পাই, উনসত্তর সালে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়াতে গেছেন, সেখানে এক ছাত্র এসেছে তাঁর সঙ্গে ভক্তিভরে পরিচিত হতে। ছাত্র বলছে তাঁকে, আপনি যে মাসুদ রানার বোন, সেটা আমি আগে জানতাম না। ওনাকে আমরা খুব শ্রদ্ধা করি। শুনে তাঁর পিত্তি জ্বলেছে, নবাব মিয়া [কাজী আনোয়ার হোসেনের ডাকনাম] স্বাধীনভাবে লেখালেখি করে মানুষের মনে তাঁর চেয়ে জ্যেষ্ঠতা দখল করে বসে আছে বলে [অতীত দিনের স্মৃতি, প্রজাপতি প্রকাশন]। পিত্তি জ্বলেছেকিন্তু সনজীদা খাতুন স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি, স্বাধীনভাবে লেখালেখি করে জমিয়ে তুলেছেন। জীবনের প্রথম দিকে কাজী আনোয়ার হোসেন লিখেছিলেন, পিস্তল কিনবেন বলে আর প্রকাশনা খুলে বসেছিলেন, জীবনকে বয়ে নিতে চান বলে। থ্রিলার বইয়ের প্রতি প্রায় সব পাঠকেরই বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, প্রীতি রয়েছে; সেই আগ্রহ আর প্রীতির বশীভূত সংখ্যাগরিষ্ঠ উঠতি শিক্ষিত বাঙালি ভাষা ও সাহিত্যচর্চার সঙ্গে নিবিড় বন্ধন তৈরি করেছেন সেবা প্রকাশনীর বইয়ের জগতে এসে। বোনেরা রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীতচর্চা করতেন, তা যেমন এ জনপদের শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তকে একটি শক্ত সাংস্কৃতিক ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তেমনি কাজী আনোয়ার হোসেনের থ্রিলার-ওয়েস্টার্ন চর্চাও এই মানুষগুলোর ভাষাকে বন্ধনহীন করে তুলতে সাহায্য করেছে, মান বাংলার স্বতঃস্ফূর্ত বিস্তারকে সহজ করে তুলেছে। অনেকেই বলে থাকেন এবং তাতে সত্যতাও আছে বটে, সাম্রাজ্য হারানোর পরও নখর-দন্তহীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বৈশ্বিক পরাশক্তির মর্যাদা নিয়ে মাথা তোলার সাংস্কৃতিক শক্তি জুগিয়েছিল জেমস বন্ড

কাজী আনোয়ার হোসেন © সুদীপ্ত সালাম/ঢাকা অপেরা

বাংলাদেশের রাষ্ট্র-চেতনা গঠনে, জাতীয়তাবাদী জাগরণে এবং বাঙালি মধ্যবিত্তের আদল তৈরিতে আপাতদৃষ্টে এবং গবেষকদের গবেষণাপত্র অনুযায়ী মাসুদ রানার কোনো ভূমিকা অবশ্য নেই; কিন্তু এর অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তাই বলে দেয়, কোনো না কোনোভাবে তা প্রভাব ফেলেছে; আর বোধ করি এই চরিত্রের মূল ভূমিকা ছিল বাঙালি মধ্যবিত্তের তরুণ প্রজন্মকে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক করে তোলা। মাসুদ রানার কাহিনিতে যত থ্রিলই থাকুক না কেন, লেখককে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হয়েছে স্পর্শকাতর সব পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের দিকে, আন্তঃইস্যুগুলোর দিকে, বইয়ে রাখতে হয়েছে মনোমুগ্ধকর অথচ বিপজ্জনক প্রাকৃতিক ভৌগোলিক বর্ণনা, প্রতিকূল পরিবেশে দিনযাপনের রোমাঞ্চ। এসবের পাঠ যে অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলী পাঠের মতোই ঘোর লাগানো আবেশের ও রোমাঞ্চকর, অনেককে অবশ্য তা বোঝানো যাবে না। মাসুদ রানার পাঠকেরা জানেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে কূটনৈতিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ববিরোধ ছিল, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ফলে যা তীব্রভাবে প্রকাশ্যে চলে আসে, অনিবার্য কারণেই ১৯৬৬ সাল থেকে প্রকাশিত প্রথম দিকের মাসুদ রানাগুলোতে তা ভীষণ রকম প্রকাশ্য। তার মানে এই না, মাসুদ রানার মিশন ছিল পাঠককে ভারতবিদ্বেষী করে তোলা। কোনো না কোনো প্রতিপক্ষ না থাকলে জাতীয়তাবাদ কিংবা দেশপ্রেম ঠিক জমে ওঠে না, মাসুদ রানায় ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ঠিক সেই কাজটিই করেছে। আবার এটাও কি ঠিক নয়, সুলতা রায় কিংবা মিত্রা সেনদের মতো নারীরা যেন মাসুদ রানার প্রতি তাদের দুর্বলতার মধ্য দিয়ে, রানার চারপাশে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরির মধ্য দিয়ে ভারতকেই বাঁচিয়ে তুলেছে খানিকটা; পাঠক উপলব্ধি করেছে, এখনো ভারতের মানুষের কাছে প্রাণের মূল্য আছে, যৌক্তিকতার মূল্য আছে। রাজনীতির ভিড়ে কিংবা কূটিল মঞ্চে দাঁড়িয়ে নয়, ভীরু বাঙালির জাতীয়তাবাদের অন্বেষণকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছে মাসুদ রানা ব্যক্তির তীব্র কল্পনাচারিতার মধ্য দিয়ে, আবার সেই জাতীয়তাবাদকে খর্ব করতেও শিখিয়েছে পাঠককে আন্তর্জাতিকতাবাদের সংস্পর্শে নিয়ে গিয়ে।

হিসেবনিকেশ করে যে কাজী আনোয়ার হোসেন এসব শুরু করেছেন কিংবা চালিয়ে গেছেন, সে রকম নয়; সে রকম হওয়ার সুযোগও ছিল না। তিনি যা লিখতেন, তাতে কোনো মৌলিকত্বের দাবিও করেননি তিনি। যদিও কাহিনিতে না হোক, ভাষার জন্য, পাঠকের সঙ্গে সংযোগ তৈরির ধরনের জন্য মৌলিকত্বের দাবি তিনি করতেই পারতেন। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য যখন কেবল ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের কিছু ডাকসাইটে ইংরেজি জানা বাঙালি অধ্যাপকের দখলে ছিল, তখন তাঁরা তাঁদের অনেক গল্প-কবিতায় বিদেশি সাহিত্যের যা কিছুর ছায়া ফেলেছেন, কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁর প্রকাশনীর থ্রিলার ও রোমাঞ্চকর লেখাগুলোয় পড়া ছায়া নিশ্চয়ই সেসবের চেয়ে অনেক বেশিই হবে। কিন্তু এটা তো ঠিক, ভাষাটাকে তাকে বাংলাই করে তুলতে হয়েছে, এমন এক বাংলাযা ওই স্কুলে পড়া বালকটিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েটিকেও আকৃষ্ট করবে; আর চরিত্রগুলোকেও করে তুলতে হয়েছে বাঙালির বোধগম্যতার জগতের। তাঁর ছায়া-লেখকের দাবিদার অনেকেই আমাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করছেন, কিন্তু এসব ছায়া-লেখকের লিখনরীতিকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচের মধ্যে নিয়ে এসে একজন সুনির্দিষ্ট লেখকের নামে চালিয়ে দেওয়ার সম্পাদকসুলভ কাজটিও যে কষ্টকর ও কঠিন, তা লেখাই বাহুল্য। তা যা হোক, তাঁর লেখায় কোনো মৌলিকত্ব থাকুক বা না থাকুন, তিনি যে কয়েকটি প্রজন্মকে নতুন এক নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংস্পর্শে সম্পৃক্ত করে গেছেন, সেটিকে তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এটি কেবল বই পড়ার বা পড়ানোর মতো ব্যাপার নয়, এটি তারও চেয়ে বড় ঘটনাপাঠকের মনোজগতে তিনি তার চরিত্রগুলোকে চিরস্থায়ী করে রেখে গেছেন।

গায়ক কাজী আনোয়ার হোসেনও কম-বেশি চেনা অনেকের। অনেক কথাও হয় তাঁর গান ও লেখা নিয়ে; কিন্তু তাঁর লেখালেখির একটি দিকে কেউই তেমন দৃষ্টি ফেলেননি, যদিও রাজনীতির ও সাহিত্যের ইতিহাসের স্বার্থেই সেদিকটিতে তাকানো উচিততিনিই বোধ করি প্রথম লেখক, যিনি স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের সংঘবদ্ধ অপতৎপরতার বিষয়টিকে সাহিত্যে নিয়ে আসেন। ছোটবেলায় একটি বই পড়েছিলাম দেব সাহিত্য কুটিরের, লেখকের নাম মনে নেই, তবে বইটির নাম মনে আছে ওয়ার ক্রিমিনাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সময়ের পটভূমিতে লেখা রহস্য উপন্যাস, সেটিই বোধ করি বাংলা ভাষায় যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে লেখা প্রথম বই। এর দীর্ঘদিন পরে ১৯৭২ সালের এপ্রিলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ পায় মাসুদ রানা সিরিজের এখনো ষড়যন্ত্র। অংশত মৌলিক এই থ্রিলারের বিষয়বস্তু থেকেই বোঝা যায়, কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লেখক ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হলেও এই যুদ্ধাপরাধীরা যে দ্রুতই রাজনৈতিকভাবে শক্তিমান হয়ে উঠবে, তিনি এই সত্য দেখতে পেয়েছিলেন ১৯৭২-এই। দীর্ঘ বিরতির পর মাসুদ রানায় যুদ্ধাপরাধী ইস্যু আবারও ফিরে আসে যত দূর মনে পড়ছে নব্বইয়ের দশকেআবার ষড়যন্ত্র নামের মাসুদ রানার আরেক পর্বে আবারও তিনি পাঠকদের কাছে নিয়ে আসেন যুদ্ধাপরাধীদের অপতৎপরতার বিষয়টি। হয়তো রহস্য উপন্যাস বলেই, এসব বই বিদগ্ধ পাঠক সমালোচকদের চোখে পড়েনি। তা না পড়ুক, মাসুদ রানায় এই ইস্যুর উপস্থিতিই বলে দেয়, কাজী আনোয়ার হোসেন রাজনৈতিকভাবে কত সচেতন ছিলেন এবং মাসুদ রানার মধ্য দিয়ে এ বিষয়টি কত সাধারণ পাঠকের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। যত দূর মনে পড়ে, বছর পঁচিশেক আগে আবার ষড়যন্ত্র প্রকাশের পর এটি আর এখনো ষড়যন্ত্র মিলিয়ে একটি লেখা দাঁড় করেছিলাম আমাদের আস্তানা ৩৬৮-তে। ছাপার জন্য নয়, লেখার জন্য লেখা। এখন পাওয়া গেলে ভালো হতোএইখানে জুড়ে দেওয়া যেত আর আরেকবার উপলব্ধি করতে পারতাম, মানুষের রাজনৈতিক দৃষ্টিকে স্বচ্ছ করে তুলতেও তিনি কত দক্ষ ছিলেন।

হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে, কাজী আনোয়ার হোসেনের সেগুনবাগিচা ছাপাখানা থেকেই ছাপা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের বিখ্যাত ছয় দফা পুস্তিকা। ছাপানোর জন্য কোনো প্রেস মিলছিল না। কাজী আনোয়ার হোসেন গোপনে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন এই পুস্তিকা। অন্য কেউ হলে এই বিষয়টি পুঁজি করে অনেক কিছুই করে ফেলতেন। কিন্তু কাজীদা লিখিতভাবে এর স্মৃতিচারণাও করেননি কোনোখানে। টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না’—মাসুদ রানার অন্তত এইটুকু হতে পেরেছিলেন কাজীদা। নিজে বাঁধনে জড়াননি, জড়ানওনি কাউকে। বোধ হয় সে কারণেই শোনার পরেই একদমই ভুলে গিয়েছিলাম, ভীষণ অসুস্থ তিনি। ২০২১ সালের প্রায় শেষ দিক তখন। বারান্দায় দুপুরের রোদেও তেজ নেই একদম, রাজধানীর পৌষ মাস এমনই বিপদগ্রস্ত তখন। গলাটা একটু নামিয়ে ধ্রুব এষ জানিয়েছিল আমাকে, কাজীদা আর বেশি দিন বাঁচবেন না। বড়জোর সপ্তাহখানেক...

একদমই ভুলে গিয়েছিলাম এই কথা। অবশ্য সাত দিন নয়, তার পরও প্রচণ্ড প্রাণশক্তির জোরে আরও কয়েক সপ্তাহ ছিলেন তিনি আমাদের মধ্যে। বাঁচবেন না জেনেছিলাম, তবু তাঁর মৃত্যুসংবাদ জেনে চমকে উঠেছিলাম। চকিতে মনে পড়েছিল রোমাঞ্চকর সেই দিনটির কথা১৯৯২ সাল, ধ্রুব এষ ভীষণ অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছে শঙ্করের এক ক্লিনিকে; আমি আর আশরাফ কায়সার বসে আছি ক্লিনিকে ধ্রুবর কেবিনে, হাফহাতা শার্ট আর গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরা কাজীদা এলেন ধ্রুবকে দেখতে আর আমরা দেখা পেলাম এক রহস্যমানবের...কিন্তু এসব কথা নিজেদেরই থাক।

যোগাযোগ ছিল না তেমন, সেবার বইও তো তেমন পড়া হতো না পরে... মৃত্যু এসে পরিপূর্ণভাবে জানিয়ে দিয়ে গেল, হৃদয়ের কতটুকু পড়শি ছিলেন কাজীদা... মৃত্যুই একদিন এ পাওয়াটুকুও নিয়ে যাবে নিশ্চয়...