বরফ আচ্ছাদিত কিংবদন্তি মাহমুদুল হক

 

নক্ষত্রের কিংখাব-পরা অন্ধকারে, একদা আড্ডার অনুরাগরঞ্জিত তাঁর পৃথিবীতে স্তব্ধতা নামে, নীরব সন্ধ্যার মতো। বারবার বলা হয়েছে, কী এক অনির্ণেয় অভিমানে তিনি স্বনির্মিত গদ্যের হীরকখচিত পৃথিবী থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের পরে বনফুল নামে একটি গল্প ব্যতীত উল্লেখযোগ্য কিছুই লেখেননি। অথচ ছিলেন তুমুল আড্ডামুখর, তিনি মাহমুদুল হক [১৯৪০-২০০৮], যখন লিখেছেন, ষাটের দশকে, বাংলা কথাসাহিত্যের পারম্পর্যময় গদ্য বদলে দিয়েছেন। দুর্বিনীত সেই শাসক দিনের পর দিন আড্ডায় ছিলেন ক্লান্তিহীন, অবিশ্রান্ত।

প্রথম উপন্যাস অনুর পাঠশালা গ্রন্থাকারে মুদ্রণের পর দেশ পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সনাতন পাঠক ছদ্মনামে লেখেন, বাংলা গদ্যের ওপর প্রভুত্ব করার ক্ষমতা এঁর আছে। অনুর পাঠশালার মতোই মাহমুদুল হকের প্রতিটি রচনা স্মরণীয় হয়ে আছে কাহিনির আকর্ষিত চমৎকারিত্বে; প্রকরণশৈলীর অভিনব সংগঠন, ভাষার সূক্ষ্ম কারুকাজ এবং সংলাপ ও বাক্যবিন্যাসের অপ্রথাগত রীতির উন্মোচনে। নিরাপদ তন্দ্রা [১৯৬৮], জীবন আমার বোন [১৯৭২], কালো বরফ [১৯৭৭], খেলাঘর [১৯৭৮], মাটির জাহাজ [১৯৭৯], অশরীরী [১৯৭৯], পাতালপুরী [১৯৮১], চিক্কোর কাবুক [১৯৭৯]প্রায় সব রচনাতেই লক্ষণীয় কাহিনিবিন্যাস ও ভাষারীতির নতুন নন্দন নির্মাণের আবেগ ও অশ্রুবিন্দু।

কথায় কথায় মাহমুদুল হক জানিয়েছিলেন, তিনি প্রায় ৮০টি গল্প লিখেছেন, অথচ দুটি বইয়ে [প্রতিদিন একটি রুমাল ও নির্বাচিত গল্প] সংকলিত গল্প ব্যতীত কোনোটিই সংগ্রহে নেই। ফলে সেসব হৃতপ্রায় এবং গভীর নিদ্রার আলস্যে ডুবে যাওয়া লিখনরাশির প্রতি আমার কৌতূহল অদম্য হয়ে উঠেছিল। ছয় বছর প্রায় নিরন্তর অনিদ্র অনুসন্ধানে সংগৃহীত হয় ৪৩টি স্বপ্নবিদ্ধ গল্প। সেগুলো নিয়ে, লেখকের অভিপ্রায়ের প্রতি বিনত শ্রদ্ধায়, তাঁর মৃত্যুর পর ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় অগ্রন্থিত গল্প। তবে, মাহমুদুল হক কৈশোরেই লিখেছিলেন রেড হর্নেট, অরণ্য বাসরআমি সম্রাট শিরোনামে উপন্যাস। সেসব ছিল বাল্যকালে পঠিত ডিটেকটিভ কাহিনির নিঃশব্দ প্রভাব-ঘেরা। অবশ্য, সেই উতরোল তরঙ্গ পার হয়ে প্রথম উপন্যাস রচনার প্রয়াস রূপে দ্রৌপদীর আকাশে পাখি বিশিষ্ট হয়ে রয়েছে। এটির অংশবিশেষ রূপছায়া পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিও এখন অনির্দেশ্য ঘুমের গহনে।

 

দুই

নিজের দীর্ঘায়ুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় থেকে ফিওদর দস্তইয়েভস্কি কোনো রচনা শীত নিদ্রায় চালান করতে চাননি; দ্রুতলিখন এবং নিতান্ত খসড়া বিবেচনায় তাচ্ছিল্য করাই যেন ছিল তাঁর সৃজনক্ষমপ্রজ্ঞার বৈশিষ্ট্য; যদিও সেগুলোই ব্যক্তিমানুষের দুষ্পাঠ্য, দুর্জ্ঞেয় মনোজগতের বিচিত্র অভিজ্ঞান উন্মোচনের জটিল ও অভিনব শিল্পে দ্যোতিত। মাহমুদুল হকের রচনার ক্ষেত্রে এই দ্রুতলেখ এবং প্রকাশের ব্যাপারে সীমাহীন জাড্য ও অনীহাই যেন বরফাচ্ছাদিত এক কিংবদন্তি। একদিকে সমাজের জটিল অন্ধকারময়তা, অন্যদিকে ব্যক্তিজীবনের যন্ত্রণা-জর্জরিত তরঙ্গাবেগএই দুই প্রান্ত তাঁর কথাসাহিত্যে ছড়িয়ে দিয়েছে বিষণ্ণ, বিচ্ছিন্ন ও বিষাদিত অনুভব। কিন্তু জীবনের নানা সংকট, দ্বন্দ্ব, দুঃখ, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার করুণ আর্তির মধ্যে মাহমুদুল হকের কথাসাহিত্যে ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে মানবচৈতন্যের অন্তর্লীন মানবিক মুক্তির সুবর্ণ উপচার। অনুর পাঠশালা উপন্যাসের কিশোর অনু মধ্যবিত্তের ঠুনকো আভিজাত্যের সংস্কার ছেড়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়াতে চেয়েছে মুক্তির উদার দিগন্তে। কিন্তু ঊর্ধ্বশ্বাসে ফিরে যাবার পথে বারবার অনুর মনে হলো, জারজ নিনাদে উন্নীত পাখোয়াজের উত্তরোত্তর দ্রুততর উত্তাল ফেনিল তরঙ্গমালা পিছন থেকে পরাক্রান্ত ঘাতকের মতো তেড়ে আসছে তার দিকে। যখন অনুর জাগর আকাঙ্ক্ষা ও উন্মুখ চৈতন্যের সামনে সমস্ত জগৎ বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে, বাবা-মায়ের মনোমালিন্য, পলায়নের উদ্দেশে মায়ের ইংরেজি শেখা বন্ধ, তখন জ্বরতপ্ত শরীরে নিদ্রার ঘোরে অনু পাগলের মতো পৃথিবীময় একজন বুড়ো আইনস্টাইনকে খুঁজে বেড়ায়। পথের পাঁচালীর অপু যেমন সমুদ্রগামী জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে গতির পুলকে শিউরে উঠেছে, মানসভ্রমণে সে যাত্রা করে টাহিটি, এল পাশো, ওয়াকিকি, সুনীল সমুদ্র, বলগা হরিণ, পাহাড়ি ছাগল, গম্ভীর নিনাদি জলপ্রপাত। কাজিনদের সঙ্গে তর্কে অনুর জগৎও উন্মোচিতশ্যাডোজ-এর রেকর্ড, বিটল, প্লাটার্স, হিরোশিমা, অ্যাটম বোমা, আইনস্টাইন, আইজেনস্টাইন, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এবং এসবের বাইরে স্বপ্নাচ্ছন্নতার মধ্যে সে সন্ধান করে পৃথিবীর মাস্তুল।

অনুর অনির্দেশ্য গন্তব্য নিরাপদ তন্দ্রায় অনেকাংশে স্পষ্ট। যন্ত্রণাময়, নিষ্পেষিত অগ্নিদগ্ধ পতিতাপল্লির জীবন থেকে পালিয়ে এসে হিরন আশ্রয় নেয় তার পুরোনো বস্তিজীবনে, যেখানে জীবনের নতুন সম্ভাবনা ও স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষায় এসে উঠেছিল কেরামত আলীর হাত ধরে। অনেক পোড়খাওয়া জীবন অতিক্রমের পর কাহিনির শেষ বৃত্তে ছিল কেরামত আলী নয়, গল্পকথক কামরান রসুল, কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন অবিশ্বাস্য স্বপ্নের ঘোরে তার প্রেমিক কেরামত আলীর নিকটেই সংশ্লেষিত ও রূপান্বিত। প্রকৃতপক্ষে সমস্ত লুণ্ঠন, নিপীড়ন ও অন্ধকার থেকে মানবীয় প্রেমের আলোয় প্রত্যাবর্তনই লেখকের কাছে সত্য। এই শিল্পসত্য রাষ্ট্রীয় সামাজিক পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা ও আধিপত্যবাদী মস্তিষ্কচৈতন্য থেকে মুক্তির দিগন্তে প্রেমের শাশ্বত শক্তিতে উদ্ভাসিত।

নতুন করে অনুসন্ধানের এই ভাবনা কেন? তাহলে কি যেখানে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবো, সেটাই দেশ’—এই বোধে তাড়িত হয়ে পোকার বাবা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নিষ্ঠুর ও নিদারুণ নিষ্পেষণে আত্মসম্মান আর অস্তিত্বসংকট-মুক্তির সন্ধানে মাতৃভূমি ছেড়ে পরবাসী হয়েছিল। সেই দেশ, সেই নিরুদ্বেগ আশ্রয়, সেই নিঃশঙ্ক নির্ভয় ও মানবিক সারল্যে নিরঞ্জন নীড় কি তারা পেয়েছিলেন?

মাহমুদুল হকের সর্বাধিক আলোচিত উপন্যাস জীবন আমার বোন, এ ছাড়া খেলাঘর উপন্যাসেও, শৈশব আশ্চর্য গোপন দুঃখের মতো অনুকম্পা ও শিহরিত আবেগে অনুরণিত। অঞ্জু ও মঞ্জু, পুকুরের জলে ডুবে দুই সহোদরার মৃত্যু এবং কৈশোরের আবেগ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে সমগ্র কাহিনির কেন্দ্রীয় আলোবিন্দু হয়ে রয়েছে রঞ্জু। দু-বোনের মৃত্যুস্মৃতি কী পরিপ্রেক্ষিত উন্মোচন করে? উপন্যাসের শেষাংশে প্রাণপ্রিয় রঞ্জুর মৃত্যু, যাকে ঔপন্যাসিক রূপান্বিত করেছেন জীবনের প্রতীকে। তাহলে কি মাহমুদুল হক ১৯৭২ সালেই অনুধাবন করেছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পরিণাম? অঞ্জু-মঞ্জু কি অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রতীক? আর নিরঞ্জন রঞ্জু শ্যামল বাংলাদেশ? যে শত্রুর পদলাঞ্ছনায় অপমানিত, বিমর্দিত, বিচূর্ণিত, বিধ্বস্ত ও অস্তিত্বহীন। জীবন আমার বোন উপন্যাসটি সম্পর্কে রোদ্দুরে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমি মুক্তিযুদ্ধের কোনো ইতিহাস রচনা করিনি, কোনোদিন ঠাট্টাচ্ছলেও বলিনি এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। অর্থাৎ এটি ইতিহাস নয়, এটি তাঁর ওই উপন্যাসের পটভূমি-কাল মাত্র, এভাবে জানিয়েছেন উপন্যাসটি রচনার সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞাপ্রসূত তাঁর নির্দ্বান্দ্বিক অভিজ্ঞান। ফলে আমাদের সবচেয়ে আবেগকাতর ও রক্তস্বাক্ষর স্বীকৃত গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধএই সময়-পূর্ব কথামালার পরিপ্রেক্ষিত এ উপন্যাসে অনেকাংশে স্পন্দিত একটি সীমাচিহ্নে। কাহিনিতে অবলম্বিত হয়েছে ওই তরঙ্গসঙ্কুল সময়ের অস্থিতিশীল দ্বন্দ্বদোলাচলতা; সক্রিয় হয়ে উঠতে না পারার ব্যর্থতা; নিঃসঙ্গ, বিক্ষুব্ধ ও আত্মপীড়িত এবং পুঞ্জীভূত যুদ্ধের অগ্নিসংকেতের অনিবার্য অভিঘাতে উৎকেন্দ্রিক ব্যক্তি-মানসের যন্ত্রণা। সকলের মতো বিপ্লবকে তিনকুড়ি বছর বস্তাবন্দী করে গুদামে পুরে রাখা আর ইন্টারকনের লোলুপ নিভৃতে বসে কাটিশার্কব্যালেন্টাইনের মাহাত্ম্যের প্রসঙ্গে দূর থেকে নমস্কার করে স্কটল্যান্ডকে যে আত্মসতর্ক প্রগতিশীল অথবা বামপন্থী রাজনীতিকরা তাদের গড্ডলিকায় খোকা আত্মবিসর্জন দেয়নি। দেশ, দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে মুরাদের ভাবনাকে সে গুরুত্ব দিতে চায়নি, মেনে নেয়নি বিনা তর্কে। সে তার আত্মসচেতন সতর্ক চৈতন্যে ড্রাম ফ্যাক্টরির শ্রমিক, তাদের কাজের মেয়ে ময়নার বাবার চিন্তার সঙ্গে দেশ ও সমাজ রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষায় চঞ্চল মুরাদের ভাবনার সাদৃশ্য দেখতে পায়। ময়নার বাবার যেমন অত্যন্ত সরল প্রত্যাশাজয় বাংলা প্রতিষ্ঠিত হলে তার মেয়েকে আর ঝিয়ের কাজ করতে হবে না। অর্থাৎ দেশের প্রতি দায়িত্ব জ্ঞানহীন, স্বাধীন হওয়ার অর্থই যেন লক্ষ্মীর অফুরন্ত ভাণ্ডার সামনে শর্তহীনভাবে উন্মোচিত হওয়া। দেশকে সকলের শ্রেণি-পেশাগত সাম্যের ভিত্তিতে নির্মাণের প্রয়োজনীয়তাশূন্য এবং ফ্যান্টাসিপূর্ণ। যদিও জীবন-জগৎ সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক সংকট ব্যাখ্যার যে প্রজ্ঞা ব্যক্তিচরিত্রকে দান করতে পারে ইতিবাচক একটি দার্শনিক প্রজ্ঞা ও পরিপ্রেক্ষিত, খোকা চরিত্রে তা সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। ফলে খোকা সব সময় দ্বন্দ্বতাড়িত, জিজ্ঞাসাদীর্ণ ও তর্কপ্রবণ। এই দ্বন্দ্ব তাকে শেষ পর্যন্ত নিক্ষেপ করেছে পলায়নপ্রবৃত্তিভারাক্রান্ত লোলুপতার অন্তর্স্রোতে। কিন্তু রাজীব ভাইয়ের আত্মসমাহিত, স্থিতধী ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে মাহমুদুল হক উন্মোচন করেছেন বাঙালি জাতিসত্তার সচেতন চৈতন্য নির্মাণের সংকট।

খেলাঘর এবং অশরীরী উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিত যুদ্ধাক্রান্ত বাংলাদেশ। মুক্তিসংগ্রামকালীন ব্যক্তিমানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েনের সঙ্গে যুদ্ধের ভয়াবহতা, যুদ্ধ সম্পর্কে ব্যক্তিমনস্তত্ত্ব সমান্তরাল স্রোতে প্রবহমান এবং অনেকাংশে তা পরস্পরের প্রতীকার্থেও উপস্থাপিত। অপরদিকে মাটির জাহাজ এবং পাতালপুরী উপন্যাস দুটিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ অত্যন্ত ক্ষীণ, পরিবর্তে অনুসৃত স্বাধীনতা-পরবর্তী বিপর্যস্ত বাংলাদেশে লুণ্ঠনপ্রবণতা, ধনবাদের বিকাশ, সামরিক শক্তির উত্থান এবং ওই বিপর্যস্ত ও নবোত্থিত ক্ষমতাকাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসবার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় বাস্তবতাস্পর্শী রক্তাক্ত মানবিক বোধ। এ দুটির বিষয়বিন্যাসে ও চরিত্রাবলির পরিণাম ভাবনায় প্রথাগত গাণিতিক মীমাংসা বা নায়কোচিত বীরত্ব প্রদর্শিত মুগ্ধতা নেই। উদ্যমহীন, তর্কপ্রবণ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিক খোকার উদ্দাম তর্কের আশ্রয়ে মাহমুদুল হক এঁকে দিতে পেরেছিলেন তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনের ইতিহাস। তা কেবল ৪৭ থেকে ৭১ নয়, বাঙালি জাতির সুদীর্ঘকালের যাবতীয় ঔপনিবেশিক চিন্তা, শোষণ, নির্যাতন, পুঁজিবাদী আগ্রাসন, সামরিকতন্ত্র ও পেশিশক্তির বিরুদ্ধে তর্জনী উঁচিয়ে ব্যক্তিমানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে যাত্রার পরিক্রমা। মাহমুদুল হকের উপন্যাসের খোকা, মুরাদ, রঞ্জু, নীলাভাবী, রাজীব ভাই, লুলু চৌধুরী, রেহানা, ইয়াকুব, মুকুল চন্দ্র, আম্বিয়া, মন্টু, বিপুল, আঞ্জুম, তাহেরা, মনোহর, জয়নাল, কুসুম, আলমাছিবিবি, অথবা আমিনুল, জামশেদপ্রতিটি চরিত্রই বাঙালির সেই সংকট ও সম্ভাবনাময় সময়ের উজ্জ্বল প্রতিনিধি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও ক্ষয়িষ্ণু পলাতক মূল্যবোধের গড্ডলিকায় আকণ্ঠমগ্ন অধিকাংশ মানুষ। কেউ নারী পাচারকারী, কেউ নারী সরবরাহকারী। অর্থের বিনিময়ে জয়নালের মতো নারী ব্যবসায়ীদের কাছে গ্রামের দরিদ্র, অসহায়, সরল ও সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের বিক্রি করে দেওয়ার মধ্যস্বত্বভোগী মনোহর। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজবিলগ্ন মানবতাবিরোধী কর্মে লিপ্ত এই চরিত্র-দুটির অস্তিত্বসংকট, টিকে থাকার আতীব্র আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নময়তা মাহমুদুল হক গভীর মমতায় লিপিচিহ্নিত করেছেন মাটির জাহাজ উপন্যাসে। এটির শেষাংশে মনোহর যখন অবরুদ্ধ কান্নার আবেগে ভাঙা স্বরে বলে—‘আর একটা কথা, তোমার যদি মায়ের গর্ভে জন্ম হয়ে থাকে, যদি এক বাপের জন্ম হয়, তাহলে একটা কথা তুমি রেখো জয়নাল ভাই, কখনো ভাতের খোঁটা [কুসুমকে] দিতে পারবে না’—তখনই পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূল অন্ধকার অতিক্রম করে জ্বলে ওঠে পিতৃত্বের স্নেহমমতাময় চিরন্তন একটি প্রতিচ্ছবি। জ্বলে ওঠে ক্ষুধা-দারিদ্র্যকে আশ্রয় করে বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থাপনার বিপরীতে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের মানবিক অশ্রু। আকুল করা বোবাকান্নায় জীবনের পাত্র পূর্ণ হয়ে যায় কানায় কানায়। জীবনের জটিল স্বপ্নের ব্যাকরণে দিশেহারা, পরাজিত, ন্যুব্জ মনোহর তবুও দুঃখের ভেতর থেকে উঠে আসে চৈতন্যের মানবিক দিগন্তে। পাতালপুরী উপন্যাসে পরিগৃহীত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্তহীন, পরিণাম ভাবনাশূন্য, বিভ্রান্ত, স্বার্থান্ধ বাঙালি মধ্যবিত্তের সত্যিকার বিড়ম্বনার চিত্রাবলি। সাংবাদিক আমিনুলের ডায়েরির পাতায় চিহ্নিত সেই নির্মম সত্য, অন্যদিকে কালো বরফ উপন্যাসের শেষাংশে আব্দুল খালেক এবং রেখা নৌযাত্রা করে প্রাত্যহিক সমস্ত গ্লানি এবং যাপিত জীবনের যন্ত্রণামুক্তির জন্য। পরস্পরকে কেউ দুঃখ না দেবার অঙ্গীকারে, দৈনন্দিনকে প্রত্যাখ্যান করে ওই নৌযাত্রা তাদের নিয়ে যায় নিসর্গের অন্তর্লীন শুশ্রূষায়। কিন্তু কালো বরফ-এর পাতায় পাতায় আমরা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়তে দেখি জীবনের সমস্ত সারল্য ও শৈশবের অদৃশ্য কীর্তি, এখানে স্মৃতি এক অন্ধ আততায়ীর মতো ধাবমান। বর্তমানের কলুষকালের নির্মম খররৌদ্র, সাম্প্রদায়িক বিরোধ, কালো অর্থের স্ফীতি, চাকরির অনিশ্চয়তা, প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের অসংস্কৃত আচরণ, রাজনৈতিক অসততা এবং এ সমস্ত বাস্তবতার মাঝে নরহরি ডাক্তারের মতো সজ্জন ব্যক্তির যে সমাজ ও রাষ্ট্রে সম্মানজনক ও নিরাপদ আশ্রয় নেই সেখানে আবদুল খালেকও একই অস্তিত্ব সংকটে হয়ে ওঠে নিরাশ্রয়, নিঃসঙ্গ, উন্মূলিত। ছায়াময় সেই অস্তিত্বগ্রাসী অন্ধকারে আবদুল খালেকের অন্তর্চৈতন্যে ধ্বনিত হয়েছে দীর্ঘশ্বাস

সেসব কত কথা। ইচ্ছে করলেই এখন আর সেসব মনে পড়ে না। কত কথা, কত চার ভাঁজ-করা ছবি, তেশিরা কাচ, লালকুঁচ, কত সকাল-দুপুর-বিকেল বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছে পোকা! কখনো মনে হয়নি, একদিন সবকিছুরই আবার খোঁজ পড়বে নতুন করে।...

যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছুই একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক বাজনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়ে, জিনজার-হিনজার-গিনজার, জিনজার-হিনজার পোকা শোনে, শুনতে পায়। পোকা পোকা হয়ে যায়। [কালো বরফ]

প্রতিটি গল্পের আখ্যান, ঘটনাপরম্পরা এবং চরিত্র পরিচিত জীবন ও সময়-প্রতিবেশকে করে তুলেছে আলোকিততর। পারিবারিক মানুষের শোক-দুঃখ ও বিবমিষার সঙ্গে সমাজের গভীরতম ক্লেদ, অন্ত্যজ ও মধ্যবিত্তের অস্তিত্বসংকট এবং গ্লানি যেমন রয়েছে, গল্পকার একই সঙ্গে জীবনের প্রতি অতলান্তিক মমতা ও মানবিকতার শুভবোধ তুলে এনেছেন।

নতুন করে অনুসন্ধানের এই ভাবনা কেন? তাহলে কি যেখানে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবো, সেটাই দেশ’—এই বোধে তাড়িত হয়ে পোকার বাবা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নিষ্ঠুর ও নিদারুণ নিষ্পেষণে আত্মসম্মান আর অস্তিত্বসংকট-মুক্তির সন্ধানে মাতৃভূমি ছেড়ে পরবাসী হয়েছিল। সেই দেশ, সেই নিরুদ্বেগ আশ্রয়, সেই নিঃশঙ্ক নির্ভয় ও মানবিক সারল্যে নিরঞ্জন নীড় কি তারা পেয়েছিলেন? পায়নি বলেই আবদুল খালেক প্রতিনিয়ত সংসারের মধ্যে থেকেও নিরুদ্দেশ, অনিকেত ও বৈরাগ্যচিহ্নিত। ফলে সীমাহীন নৈরাশ্য, অনিশ্চয়তা ও নিরাশ্রয়বোধ তাকে করে তুলেছে উৎকেন্দ্রিক। এই উন্মূলিত সত্তা ও নিরাশ্রয়তা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় আবদুল খালেক প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছে পোকার অস্তিত্ব ও সময়ের অন্তর্বলয়ে। এই প্রত্যাবর্তন প্রকৃতপক্ষে ৪৭-পরবর্তী নতুন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ আর ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের প্রয়োজনে রাষ্ট্রসংঘকে প্রশ্নবিদ্ধ করেই, জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রসংঘের জটিল মেরূকরণের মধ্য দিয়ে জাগ্রত করে মানবিক সম্পর্কের, নির্দ্বন্দ্ব আশ্রয়ের।

ব্যক্তিমানুষের এই আশ্রয়-সন্ধানের ইতিবৃত্ত মাহমুদুল হকের গল্পসমূহে হয়ে আছে অন্তর্লীন। তাদের যন্ত্রণা, শোক-তাপ, জরা-মৃত্যু-সংশ্লিষ্ট জীবনের কথামালার অন্তস্রোতে তিনি সংরাগময় করে তুলেছেন সমাজ-রাষ্ট্র, সময়-সমকাল ও ইতিহাসের অন্তর্বেদ। সমাজ ও সমকালের সংকট তাঁর কথাসাহিত্যের চরিত্রসমূহকে এতই নিঃসঙ্গ, তাপিত, আলোড়িত ও সংক্ষুব্ধ করে যে, ব্যক্তিমানুষের অন্তর্চৈতন্যে সংগুপ্ত মানবিক আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত স্ফুরণ ঘটে। ফলে দু-একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত তাঁর গল্পগুলো সমকালের তথ্য ও টীকাভাষ্য নয়। সমকালের বহির্চিত্রকে তিনি ছুড়ে ফেলেছেন, তুলে এনেছেন আন্তর্তরঙ্গে প্রবহমান জীবনের জটিল ইতিহাস ও যন্ত্রণাবিধুর কালো আত্মা। কালের তরঙ্গ ও সমাজ-রাষ্ট্রের সংকটকে উপস্থাপনের জন্যে লেখককে অনেক সময় আশ্রয় নিতে হয়েছে রূপকের, প্রতীকের। আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি মাহমুদুল হক কিশোর বয়সেই, যখন স্বভাবতই একজন কথাশিল্পীর হয়ে ওঠার অন্তর্লীন অভিজ্ঞতা পুঞ্জীভূত নয়, তখনই তাঁর জীবনদৃষ্টির রূপকী বিন্যাস। যেমনি আর তেমনি, মাকাল ফলের কথা, কোকিলের কান্না ইত্যাদি গল্পে ওই রূপকের আশ্রয়ে তৎকালীন সমাজ-রাষ্ট্র-সময়ের প্রতিচ্ছবি নির্মাণ করেছেন।

প্রতিটি গল্পের আখ্যান, ঘটনাপরম্পরা এবং চরিত্র পরিচিত জীবন ও সময়-প্রতিবেশকে করে তুলেছে আলোকিততর। পারিবারিক মানুষের শোক-দুঃখ ও বিবমিষার সঙ্গে সমাজের গভীরতম ক্লেদ, অন্ত্যজ ও মধ্যবিত্তের অস্তিত্বসংকট এবং গ্লানি যেমন রয়েছে, গল্পকার একই সঙ্গে জীবনের প্রতি অতলান্তিক মমতা ও মানবিকতার শুভবোধ তুলে এনেছেন। ব্যক্তিমানুষের অন্তর্চৈতন্যে সংগুপ্ত এই বোধ, কল্যাণময়তা দুঃখী সর্বংসহা অন্তর্লীন এক স্রোতোস্বিনীর মতো এসব গল্পের শরীরে প্রবাহিত। জীবনের সব ক্লান্তি, ক্ষোভ, বিপদ, বিরহ, বিষণ্ণতা, নৈরাশ্য, শূন্যতার বিপরীতে মানুষের অপরাজেয় মানবিক চৈতন্যের জাগরণ মাহমুদুল হকের শিল্পভাবনার আলোকিত প্রান্ত, কিন্তু তা বিপ্লবী উচ্চকণ্ঠ-ঘোষণার মন্দ্রিত স্বরগ্রাম নয়; জীবনের মতো করুণ, নিসর্গের সবুজ আলো-অন্ধকারের মতো নিবিড়, স্বাভাবিক ও স্বপ্নসঞ্চারী।

প্রতিদিন একটি রুমাল গ্রন্থের হৈরব ও ভৈরব থেকে শুরু করে প্রতিটি গল্পে দুঃখ ও অশ্রুজলের মধ্যে দিয়ে, বঞ্চনার কঠিন নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে জীবনের অপার সম্ভাবনা সুচিহ্নিত। সাহিত্যচর্চা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবার প্রায় পনেরো বছর পর তিনি লেখেন বনফুল গল্পটি। কিন্তু দীর্ঘ বিরতির কোনো প্রভাব, ভাষাগত শৈথিল্য অথবা দৃষ্টিভঙ্গিগত মৌলিক রূপান্তর গল্পটিতে লক্ষণীয় নয়। তুমুল সৃষ্টিমুখর মাহমুদুল হকের তীব্র উপস্থিতি গল্পটির কণায় কণায় বিকীর্ণ করে হীরক-দ্যুতি। সমাজের রক্তচক্ষু, ক্ষুধার্ত সন্তানদের আহাজারি, পথে পথে কুটিল ভয়ের দন্ত বিকশিত অট্টহাসি স্বামী পরিত্যাগী এক নারী জীবনের সীমাহীন লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে এসে উপনীত হয় ক্ষুধিতের প্রতি, মানুষের প্রতি মানবিকতা বোধের নিষ্কলুষ আলোর ভুবনে। ড্রেনের পচা পঙ্কিলতার পাশে অচেনা দুঃখী এক বৃদ্ধের হাসিভরা মুখে মা ডাক শুনে যে নারীর সমগ্র চৈতন্যে উদ্ভাসিত হয় মাতৃত্বের কোমল আর্তি, তার অন্তর্সত্তা আলোকিত হয় স্বপ্নময় অলৌকিক জ্যোৎস্নায়। যেখানে গোলাপের নির্যাসে ধুয়ে দিচ্ছে তার কুসুম কোমল পায়ের পাতা একরাশ পরিচারিকা। আইভরি চিরুনির কোমল স্পর্শে তার কেশদাম উৎফুল্ল। কিন্তু এই সব অচেনা জগৎ, যেখানে তার সন্তানরাই নেই, সেই রঙিন ভুবনে সে যেতে চায় না—‘না, সেখানে লেদু নেই, লালমিয়া নেই, ময়না নেই, নেই তার প্রাণের প্রাণ হাড্ডিসার এই একফোঁটা দুব্লা পাতলা কালাচান্দ। ওরে আমার ময়না, আমার কালাচান্দরে, কেবলই ডুকরে ওঠে তার মন। অশ্রুসিক্ত এই রোদন মাহমুদুল হকের গল্পের অন্তর্স্রোতে ঘটায় অদৃশ্য রক্তপাত। উপরিস্তরের আনন্দ এবং উচ্ছ্বাসের আন্তর্তরঙ্গে সর্বংসহা জীবনের দুঃখ, মানবিক হৃদয়লোকের উন্মোচন তাঁর গল্পে সৃষ্টি করে এক আশ্চর্য উন্মুখতা। অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্ববোধের উদ্বোধন এবং একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য উচ্চতায় ব্যক্তিমানুষের চৈতন্যকে উন্নীত করা তাঁর গল্পের অন্তর্নিহিত শক্তি।

 

তিন

বিষয়-নির্বাচন, কাহিনিসংগ্রন্থনা, ভাষাবিন্যাসপ্রতিটি পর্ব ও পর্বান্তরে সমাজ, পরিপার্শ্ব ও সময়সংলগ্ন হয়েও মাহমুদুল হক কথাসাহিত্যে তুলে এনেছেন কাহিনি-অন্তরালে সংগুপ্ত মানবিক নির্বেদ, উন্মূলিত ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্বসংকট ও জীবনের প্রতি অন্তর্লীন প্রেমানুভব। ব্যক্তিমানুষের প্রতি এই দায়বোধ ও মানবিক আশ্রয় সন্ধানের শিল্পকৃতির জন্যেই তাঁর রচনা শিল্পের সত্যে জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রসংঘের জটিল মেরূকরণের মধ্য দিয়ে জাগ্রত করেন নতুন মানবিক সম্পর্কের প্রদেশ।

এই জীবনানুসন্ধান ও জীবনদৃষ্টির সঙ্গে কথাসাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণ মাহমুদুল হকের অন্বিষ্ট ছিলযে ভাষা একটি জাতিসত্তার সামূহিক সংগ্রাম, উত্থান-পতন, ক্ষয়, সম্ভাবনা ও বিনির্মাণে প্রাণসঞ্চারী এবং স্পন্দমান। মাহমুদুল হক অত্যন্ত সচেতন অভিনিবেশে একটি রুচিশীল সাহিত্যিক গদ্য নির্মাণে অন্বেষী হয়েছিলেন, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে গদ্যের এই নতুন অন্বেষণ সূচিত হয়েছিল চল্লিশের দশকের শেষ প্রান্তে। মাহমুদুল হক বাংলা গদ্যভাষার সেই অন্বেষাতে সংযোজন করেন নতুন সৃজনশীলতা। যে গদ্য নিছক কলাকৈবল্যবাদের বিচ্ছিন্নতাসন্ধানী চোরাবালিতে পথভ্রান্ত নয়, বরং শিল্পের ভেতর দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের নতুন সৃষ্টিক্ষম চিত্রকল্পময় সাহিত্যভাষা নির্মাণে বৈপ্লবিক। বাংলা কথাসাহিত্যের গদ্যভাষা সৃষ্টির সেই অন্বেষাতে মাহমুদুল হক হয়ে ওঠেন আমাদের কালের সিসিফাস।