মুমতাসিন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারটা এখন এমন ঘিঞ্জি হইছে যে দাঁড়ায়ে রইলে মানুষ মাথার উপর দিয়া যাবেগা। কিছুক্ষণ এর গায়ে, কিছুক্ষণ তার গায়ে ধাক্কা খাইতে খাইতে আটটা দোকান ফেরি কইরা ফালাই—মাগার কামের কাম হইল না! আগেই বলছিলাম মুমতাসিনকে, পাবো না! তবু তার ওই এক গোঁ...আলতা!
আরে, এই সময়ের দুনিয়ায় আলতা আর কেউ মাখে নাকি পায়ে-হাতে। এখন কত কিছু বাইর হইছে না রং-চং!
মুমতাসিন হাসে। হাসলে তাকে যে সুন্দর দেখায় এমনকি এইটাও সে জানে না। তার হাসির দিকে তাকায়ে থাকি। আর সে নিজের মতো কাপড় কাচে পাথরঘাটে। আরও কিছুক্ষণ পর বলে, বুঝছি! তুমার সামনে আসলে হামারে কাজল দেনে পারেগা!
নজর আমার এতই খারাপ?
বহুত খারাব! কই কই যে আঁখোকি তীর মারো বুঝে না হামার শরীর?
মুমতাসিন যে মাঝে মাঝেই হিন্দি মারে কথায় এইটা খুব ভাল্লাগে। দীপিকা পাডুকোনের বিয়া হইয়া গেল, তার হিন্দিও ভাল্লাগতো। এখন শুধু মুমতাসিনই ভরসা!
তবে ভরসার কথাও এত হলফ করে বলা তো যায় না!
পুনর্ভবার যেইদিকটায় একটু কাশফুল হয়, ওই যে সিঁড়িঘাটের ওই পাড়টায়, যেইখানে নদীটা আৎকা একটা বাঁক নিছে, ওইটা ধইরা একটু সামনে গেলেই টমাটোর ভুঁই—ওইখানেই একটা ঝোপতোলা ঘর। মাত্র একটা পাশে মাটির দেওয়াল, অন্যপাশগুলায় খড় আর কঞ্চির এলুনি-বেলুনি। ওইটাই মুমতাসিনের ঘর। তবে ঘরের ভিতর ভাগ আছে। একটা বাঁশকে আড়াআড়ি ঝুলাইয়া তার উপর জাল মেলে দেয়া থাকে দুইটা। ছেঁড়া ছেঁড়া জাল, আলুথালু কাপড় দিয়া এক ঘরের দুই পর্দা। একদিকে মুমতাসিন, অন্যদিকে নেওয়াজুদ্দীন, মুমতাসিনের বাপ।
মুমতাসিনের বাপ বেজায় বজ্জাত লোক। ছয় ফিটের মতন লম্বা ছিল এক সময়। এখন শরীরটা ধনুকের মতন বাঁকাইতে ধরছে। মুখের চামড়া ঝুইলা পড়ছে ঠিকই কিন্তু নাকটা এখনো টিয়া পাখির মতো তড়তড়া! আমাকে দেখলেই খেঁকায়ে উঠে! চোখ আনোয়ার হোসেনের মতো বড় বড় কইরা গালি দেয়—বাহার যা বাইঞ্চোৎ! বাহার যা!
নেওয়াজুদ্দীনের হিন্দি কি উর্দু আমার ভাল্লাগে না একদমই। মাঝে মাঝে মনে হয় শালার টুঁটিটা চাইপা ধরি! একটু ধরলেই মরব বুড়া হাঁপানির টান উইঠা! কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা কি আর করতে পারে…নাইলে কবেই হারামিটাকে পুনর্ভবায় ভাসায়ে দিতাম না!
যা করার তাই রাইতেই করতে হয়!
সিঁড়িঘাটের সামনে দিয়া যে পুনর্ভবা, এইসব সময়ে তাতে পানি হাঁটুর উপর উঠতে পারে না। প্যান্ট ঢলঢলা আমার... হাঁটুর উপর উঠাইতে বেগ তো নাই কোনো। বগলে প্যাকেট ধরে গোল্ডলিপ টানতে টানতেই ওইপাড়! রাইতের জোছনা আছে। টমাটোর ভুঁই বিরান হইয়া পইড়া আছে। তাতে যে জোছনা পড়ছে, মাটি লাক্স সাবানের মতো ফকফকা!
বেড়ার ফাঁক দিয়া আংলি করি হালকাচালে। এই সময়ে নাকি শিশির পড়ারও শব্দ শোনা যায়—আংলিতে হয় খসখস খসখস আওয়াজ। মুমতাসিনের ধড়ফড়ানো গলা—কে?
কিন্তু সে গলাতে চাপও আছে। একটা যেন প্রতীক্ষাও! নাগর গেছিল জেলায়, ফিরতে পারে রাত্রে, এমন ধরন কোনো প্রতীক্ষা নাকি? কিন্তু মুমতাসিন তো আমারে স্বীকারও করে না তেমন। আমিও গলা ঠেলে দিই পুনর্ভবার ওই দিকে—আমি রে... সাদ্দাম!
ওইদিকে এইবার হাসি। চাপা। কিন্তু খিলখিলানি। আবার একটা খসখস আওয়াজ। তারপর আমারে এক টান!
পুনর্ভবার পানি নাই। পানিতে যে ঢেউ থাকে তা-ও নাই। শুধু একটা বেহুদা দুলানি। চাঁদটা তাতে কেঁপে কেঁপে পিছলায়ে যায়। আমার মনের মতো। কিন্তু মন পিছল খায়া যে শরীরে ঠাঁই নিবে সেইখানে তখন অন্য উৎকণ্ঠা—
‘এইটা কী আনছ? আলতা, আলতা কই?’
‘আলতা আর এই দ্যাশে নাই! এইটা কী আনছি বুঝতেছ না? শাড়ি!’
মুমতাসিন আমার দিকে তাকায়ে থাকে অনেকক্ষণ। তার চোখে চাঁদ, তার বুকেও চাঁদ। হঠাৎই এবার ছুড়ে মারে প্যাকেটটা। নদীতে। পুনর্ভবায় ঢেউ নাই। শাড়িটা কোথাও যায় না। না গিয়ে, ধীরে ধীরে, ডুইবা যাইতে থাকে। আমার মনে হয় একটা থাপ্পড় মারি মুমতাসিনকে। এগার শ পাঁচপান্ন টাকা দাম নিছিল শাড়িটার। পুনর্ভবা পরবো এখন এই বারো হাত?
মুমতাসিন ফোঁসায়। অদ্ভুত তার ফোঁসানি। কলিম চাচার মুরগির খোপে যে গহমা সাপ ধরা পড়ছিল, সেই ফোঁসফোঁসানি ছিল এই রকম। কিন্তু আমার মুখেও থুতু...
‘শাড়ি ফেললি ক্যান?’
মুমতাসিন কিছু বলে না।
‘না পরবি, তুই ফেললি ক্যান?’
মুমতাসিন কিছু বলে না।
‘বাইঞ্চোৎ!’
হঠাৎ কী হয় কে জানে, মুমতাসিন ছুটে এসে আমার বুকের উপরে চইড়া বসে। তার সালোয়ার টানটান হয়ে তলোয়ারের মতো আমার গলার আগায়। এক পাশের ফিতাটা দুলতে থাকে ঝাঁকুনিতে।
‘হামাকে বাংগালি লাড়কি করনেমে বহুত মজা তুম লোগোকা, নাহি?’
একটানা এত হিন্দি বা উর্দু বা এই খিচুড়ি ভাষাটা মুমতাসিন কখনো বলে না। আজ বলছে। তার কামিজ ফাইটা চাঁদের আলো বাইর হইয়া পড়ছে আমার চোখে। এ চাঁদ তো এই দেশেরই; বিহারের না!
২
তিন দিন আর মুমতাসিনের সাথে দেখা করি না।
শাড়ির জন্য শোক হয়। আরও ভালো করে বললে টাকার মায়া হয়। আমার ইশকুল মাত্রই এমপিওভুক্ত হইছে। বেতন-টেতন কিছু পাইছিলাম দেখে শাড়িটা নিতে পারছিলাম। এত টাকার জিনিস, ভাবছিলাম মুমতাসিন পরবে। আলতার শোক ভুলে শীত আসি আসি করা রাতগুলোকে শ্রীদেবী মার্কা করে দিবে! কীসের কী!
শোক কিন্তু তিন দিনের বেশি থাকে না। ক্রমে সেইটা প্রতারিত হইছি এমন একটা আভাসের দিকে ছুটতে থাকে। মুমতাসিনের পিছনে কদ্দিন না সময় দিছি, মাঝে মাঝে বাজারও তো করে দিছি... দিই নাই? নদীর এই পাড়ে থাকতে পারে নাই তাদের পরিবার…বাসা বানছিল ওই পাড়ে গিয়া—সবার থেকে আলাদা! আলাদাই তো হারামিগুলা! তার মা যখন মরছিল আমি তো জানাজাতেও গেছিলাম। বাজারের কতজন তা-ও তো যায় নাই! আর একটা শাড়ি দেওয়ায় তার রক্তের ধারা আবার জাইগা উঠল? শালার বাইঞ্চোৎগুলা!
মনা ঠাকুরের লাইসেন্স আছে। দেশি মদের। শিক্ষকদের আগে দাম ছিল। এখন আর সেই দিন নাই। ভিতরে গিয়া বসতে কেউ ছুইটাও আসে না, কেউ উইঠাও দাঁড়ায় না। একটা গ্লাস আসে... ভরা! নাক টিপে খাইতে হয়। পরেরটা খাওয়ার আগেই ঝুপ কইরা সন্ধ্যা নামে। আমারও বমি লাগে। একটা পুরা পুনর্ভবা ভাসায়া দিই বমি কইরা কইরা... কিন্তু তা-ও, বমি শেষ হয় না। মুমতাসিনের মুখের উপর বমি করলে রাগ কিছুটা কমত! চিৎকার কইরা গালি দিতে ইচ্ছা করে—বাইঞ্চোৎ!
কিন্তু ইচ্ছা করলেই কি আর সব করা যায়!
আইজ চাঁদ উঠবে দেরিতে। আমি প্যান্ট গুটাই না। ঢলঢলে প্যান্ট নিয়াই নামি নদীতে। হাত নামায়ে বুক আর মুখ ভিজায়ে খুঁজতে থাকি শাড়িটা। তিন দিন আগের ডুবা শাড়ি। ঢেউ নাই অথচ শাড়িও তো নাই! আমি হাঁচোড়-পাঁচোড় শেষে ওইপাড়ে উঠি… মুমতাসিনের ঘরের সামনে দাঁড়াই। দাঁড়াইতেই দেখি ঘরের ভেতর থেকে মুমতাসিন ছুটতে ছুটতে আগায়ে আসে—আসছো তুমি? আও... আও… জলদি আও...
আমাকে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে যায় মুমতাসিন। হারামিটার গলা চাইপা ধরি নাই, তা-ও শ্বাস উঠতেছে নামতেছে। মুমতাসিন আমার দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বলে, আব্বু নাহি বাঁচেগা! তুমি ছাইড়া যাইও না হামারে!
মুমতাসিন আমার হাত জড়ায়া ধরে। ঘরের চালার ফাঁক দিয়া বাতাস কেমন ভুড়ভুড় কইরা আংলি করতে থাকে, করতেই থাকে! তাতে এক আলগা সুড়সুড়ি লাগে শরীরের এইখানে ওইখানে।
৩
পুনর্ভবার পানি এখন গোড়ালিতে আইসা ঠেকছে। কিন্তু কী জানি হইছে নদীটার। কুলকুল এক ঢেউও আছে তার। আর চাঁদ আছে। মরা। কিন্তু তাতে কী…আলো দিয়া পাড়ের ঘাসগুলাকে হইলদা কইরা রাখছে ঠিকই। মুমতাসিন বলে, এই নদী কই যায় জানতেহো?
‘সাগরে।'
‘কই থেইকা আতাহে?’
‘পাহাড় থেইকা।'
‘এই নদী কাভি আর পাহাড়ে যাইতে নাহি পারেগা…’
আমি তাকিয়ে থাকি মুমতাসিনের দিকে। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলি, আর কুনোদিন সাগরেও মিশতে পারবো না!
মুমতাসিন হাসে। তার চোখে, বুকে, কামিজে, সালোয়ারে বাংলার চাঁদ পিছল খেতে থাকে।