তেইশ নম্বর
পেশার জায়গায় কী লিখব ম্যাডাম?
একটা জরুরি এসএমএস মন দিয়ে পড়ছিলেন শাহানা হক, আনমনে বললেন—লিখেন বিজনেস।
ঠিকানা?
লোকটার কথায় একটু থমকে চাঁদনীর দিকে তাকালেন শাহানা হক। মেয়েটা বসে আছে নির্বিকার, বিশ-একুশের বেশি বয়স হবার কথা নয়, মন দিয়ে পাসপোর্ট অফিসের কর্মব্যস্ত মানুষগুলোকে দেখছে, দুই চোখে রাজ্যির কৌতূহল। শাহানা হক জিজ্ঞেস করলেন—তোমার ঠিকানা কী, চাঁদনী?
চাঁদনী দাঁত বের করে হাসল—তেইশ নম্বর ঘরের চাঁদনী কইলেই সবতে চিনব।
শাহানা হক খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। পৃথিবীতে সবাই যার যার পেশা আর ঠিকানা ব্যবহার করতে পারলে চাঁদনীরাই-বা পারবে না কেন? আর এই অধিকারটুকুর জন্যই না তাদের লড়াই। তিনি লোকটিকে বললেন, লিখেন, কেয়ার অব শাবানা বেগম, টোয়েন্টি থ্রি, দৌলতদিয়া ব্রোথেল, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী।
পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীটি ঘাবড়ে যায়। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মোছে। তারপর গলা নামিয়ে বলে—অন্য একটা ঠিকানা দেওয়া যায় না ম্যাডাম? মানে, এইটাতে যদি কোনো সমস্যা হয়? মানে পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে তো।
শাহানা হক ভ্রু কুঁচকে তাকান—কেন? সমস্যা হবে কেন? এটাই ওর আসল ঠিকানা। কোনো ভুল তথ্য দেওয়া হয়নি। পুলিশ ভেরিফিকেশন হলে হবে। অসুবিধা কী? পুলিশ বুঝি ওখানে যায় না?
পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী আড়চোখে মেয়েটার দিকে তাকায়। এর আবার পাসপোর্ট করার দরকার পড়ল কেন? পাচার-টাচারের কেস না তো? নাহ্, ও রকম কিছু নিশ্চয় নয়; কারণ, বড় স্যার পাঠিয়েছেন এদেরকে, নিজে ফোন করে আবার জলদি কাজটা করে দিতে বলেছেন। দ্রুত নাকি এদের পাসপোর্ট করতে হবে। সে হলো গিয়ে হুকুমের চাকর, তার কী? ফরমটা ফিলাপ করে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটা অন্যদিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করে—আপনি ছবি তুলতে আসেন।
চাঁদনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে—আমি?
শাহানা হক এবার হাসেন—হ্যাঁ, চাঁদনী, পাসপোর্ট করতে হলে ছবি তুলতে হয়। যাও, ছবি তুলে এসো।
চাঁদনীর তখন মাদারীপুর শহরের সিগন্যাল মোড়ের আয়নাঘর ফটো স্টুডিওর কথা মনে পড়ে যায়। সেই যে কবে স্টুডিওতে ছবি তুলতে গিয়েছিল একবার মামাতো ভাইয়ের সাথে। সবুজ বন আর আর হলদেটে হরিণের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে খুব শখ করে একটা ছবি তুলেছিল তেরো বছরের কিশোরী।
কিন্তু এ রকম ছবি তোলার যন্ত্র সে কখনো দেখে নাই। একটা কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে ক্যামেরা-ট্যামেরা ছাড়াই পট পট করে ছবি তুলে ফেলা হলো তার। একটু সাজগোজ বা চুলে চিরুনি দেবার সুযোগও দেওয়া হলো না। আর ফটোগ্রাফারটাও একটা মেয়েমানুষ। বয়স কম হলেও অকারণ গম্ভীর মেয়েমানুষটা। সালোয়ার-কামিজ পরা, মাথায় হিজাব। চাঁদনী কৌতূহল ভরে জানতে চাইল—দেহি কেমুন হইছে?
মেয়েটা গম্ভীর মুখে চেয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। অগত্যা নিজের ছবি না দেখেই উঠে আসতে হলো আগের টেবিলে। ওই লোকটা সাবধানে ছোঁয়া বাঁচিয়ে একটা কলম এগিয়ে দিল এবার—এইখানে একটা সই করেন। সই করতে পারেন?
চাঁদনী হাসল লোকটার অবস্থা দেখে—পারুম না ক্যান? আমি প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ছি। মাদারীপুরের হাজী আকবর আলী প্রাইমারি ইস্কুল। কেলাস ফাইভ পাস আমি। বলে খসখস করে সে নিজের নাম লিখল ফরমে—আলেয়া বেগম। তারপর লোকটার সুন্দর নীল কলমটা বুকের কাপড় সরিয়ে ব্লাউজের ভেতর গুঁজে দিতে দিতে আহ্লাদি গলায় বলল—কলমটা আমি নিলাম। নেই?
লোকটার চেহারা হলো দেখার মতো। নিজের কলমের নতুন ঠিকানার ওপর থেকে দৃষ্টি তড়িঘড়ি সরিয়ে দিয়ে আমতা আমতা করতে থাকল—ইয়ে আইচ্ছা, অসুবিধা নাই। নেন।
শাহানা হক উঠে দাঁড়ালেন এবার—চলো চাঁদনী, আমাদের অনেক কাজ বাকি। শোনেন, জাহাঙ্গীর ভাইকে বলা আছে। তিন দিনের মধ্যেই পাসপোর্টটা লাগবে। আর্জেন্ট। ওটা হাতে পেলে তবে ভিসার জন্য দাঁড়াব। সম্মেলনের বেশি বাকি নাই।
শাহানা হক হাই হিলের আওয়াজ তুলে গট গট করে বেরিয়ে যেতে থাকলে চাঁদনী একবার পেছন ফিরে লোকটার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। লোকটি তাড়াতাড়ি ফাইলের আড়ালে মুখ গুঁজে বাঁচার চেষ্টা করল যেন। দেখে একচোট হেসে নিল সে।
আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের নিচে দাঁড়ানো ম্যাডামের ঝাঁ-চকচকে কালো অ্যাভানজা গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। ধোপদুরস্ত ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভার ম্যাডামের দরজা খুলে দিল্। তারা দুজন উঠে বসল গাড়িতে। গাড়ি মিরপুর রোড ধরে এগোতে শুরু করল। এগোয় তো না, যেন গরুর গাড়ির মতো ধুঁকে ধুঁকে চলে। রাস্তায় এত গাড়ি, এত মানুষ, এত রিকশা। সব জট পাকানো। এই শহরে এত মানুষ কোথা থেকে আসে? এই শহরে কেউ কি কাউকে চেনে?
তুই তাগোরে চিনস? ওসি সাহেব ধমকে উঠেছিলেন ওর দিকে তাকিয়ে। তুই দেখছস অন্ধকারে? কে ছিল? কয়জন ছিল?
আলেয়া, যে তখনো চাঁদনী হয়নি, থানায় নীরব হয়ে ছিল সেদিন। চেহারা গোনা না গেলেও প্রবিষ্ট যৌনাঙ্গের হিসাব রাখা কি কঠিন? চাঁদনী মনে মনে হাসে। এখন দিনে-রাইতে কতবার কত মাইনসের লগে শোওন লাগে, হিসাব নাই। পলিথিনের বেলুন গুনি। কয়টা খরচ হইল সারা দিনে। সেই মতো শাবানা মাসির দেওয়া টাকার হিসাব মেলাতে হয়। তবে তখন সে কুমারীই ছিল। তার চৌদ্দ বছরের কুমারীত্ব যারা হরণ করল, তাদের চেহারা ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ? তবু আলেয়া ওসি সাহেবের সামনে সমস্ত হিসাব ভুলে গিয়েছিল। কারণ, তত দিনে এক লাখ টাকার বিলি বণ্টন হয়ে গেছে। চল্লিশ পাবেন ওসি সাহেব, আর বাকি ষাট হাজার আলেয়ার মামা। যে মামার বাড়িতে আলেয়াকে নিয়ে তার মা আশ্রয় নিয়েছিল স্বামী তাড়িয়ে দেবার পর। তো থানায় বসেই ভাগ-বাঁটোয়ারার আলোচনা শুনেছিল সে, বিনিময়ে মামলা-মোকদ্দমা তুলে নেওয়া হবে। ফলে আলেয়াকে সবই বেমালুম ভুলে যেতে হলো। কিন্তু গাঁয়ের লোক তো আর ভুলবে না কিছু। মামারা তাই তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে চাইলেন। ঢাকা শহরে কাজের অভাব নাই। গার্মেন্টস আছে, বাসাবাড়িতে কাজ আছে। কটা দিন ঢাকায় থেকে এলে ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে সবাই। টাকাপয়সা ভালো রোজগার করতে পারলে ভোলাটা আরও বেশি সহজ আর দ্রুতগতির হবে। তাই সেই প্রথম আলেয়ার ঢাকায় আসা। তারপর কত হাত বদল হয়ে কত ঘাটের পানি খেয়ে আজ সে তেইশ নম্বর ঘরের বাসিন্দা।
তবে পল্লির মেয়েদের মধ্যে তার কপালটাই সবচেয়ে ফরসা। এই জন্য শাবানা মাসির কেনা বাঁদী হয়ে থাকা উচিত তার বাকি জীবনভর। কী মনে করে যে যৌনকর্মীদের বিশ্ব সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য ওকেই বেছে তুলে দিয়েছে মাসি, কে জানে। ছোটবেলায় কপালে জন্মদাগ দেখে দাদি একদিন বলেছিল—রাজকপাল নিয়ে জন্মেছে আলেয়া। কথাটা আজ এত দিন পর বিশ্বাস করতে মন চাইছে তার।
কাজ চালানোর মতো ইংরেজিও ঠিক শিখে নিতে পারবে। হোটেলের লবিতে বসে হাত নেড়ে ভদ্রলোকটিকে বললেন শাহানা হক। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। দেখতে শুনতেও সুন্দর। যাবার আগে একটু গ্রুমিং করে নেওয়া যাবে। তবে স্যার, আমাদের টাকাটা একটু দ্রুত ছাড় করার ব্যবস্থা করেন প্লিজ। আপনাদের সাপোর্ট না পেলে আমার অর্গানাইজেশন দাঁড়াতেই পারবে না। দিনকাল খুবই খারাপ যাচ্ছে স্যার।
চাঁদনী পাঁচতারা হোটেলের লবির বিশাল কারুকার্যময় ছাদ আর ঝাড়বাতি দেখতে দেখতে ম্যাডামের কথা শোনে। ভুঁড়িওলা কালো লোকটা নিশ্চয় অনেক ক্ষমতাবান, নইলে এ রকম কুৎসিত একটা লোককে এত তেল দেওয়া কেন? লোকটা ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসে-আপনাদের সংগঠনটা আমার ভালো লাগে মিস শাহানা। এই মেয়েগুলোর কথা কেউ ভাবে না। আপনি এদের জন্য কাজ করছেন, খুব ভালো কথা। আই রিয়েলি ফিল ফর দেম। দেখি কী করতে পারি। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, এরা যেন বাইরে গিয়ে আমাদের সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট না করে। এ রকম সম্মেলনে অংশগ্রহণের তো অভিজ্ঞতা নেই এদের। ও পারবে তো?
শাহানা হককে আত্মবিশ্বাসী দেখায়—নিশ্চয় পারবে। আর কোনো সমস্যা হলে পিংকি তো আছেই।
নামটা শুনে উৎকর্ণ হয় চাঁদনী। এই নামটা কদিন ধরেই শুনছে সে। পিংকি। সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে চাঁদনীর সাথে এই পিংকিরও যাবার কথা। কিন্তু ও মাগির দেখা এখনো মেলেনি। ম্যাডাম আর ভুঁড়িওলার কথোপকথনের মাঝে সে আচমকা বলে বসল—আমার পেচ্ছাব লাগছে ম্যাডাম।
ম্যাডামের ভ্রু কুঁচকে যায়—চাঁদনী, এখন থেকে বলবে ওয়াশ রুমে যাব। যাও, ওই যে ওদিকে। দেখো, আবার ছেলেদেরটায় ঢুকে পড়ো না।
ওয়াশ রুমে ঢুকে আনন্দে তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। মাগো, বড়লোকদের পায়খানা এত সুন্দর হয়! ওদের নোংরা বদ গন্ধওলা আধ খোলা বে আব্রু পায়খানা নিয়ে রোজ সকালে মেয়েদের সাথে ঝগড়া, মুখ খিস্তি আর গালাগালের মুহূর্তগুলো মনে পড়ে যায় তার। কপাল তাকে কোথা থেকে কোথায় এনে ফেলল। তো কাজ সেরে ফিরে এসে চাঁদনী দেখে, তার বসার চেয়ারটাতে ছোট লাল জামা পরা একটা মেয়ে বসে আছে। তার হাঁটু অব্দি খোলা পা দুটো মসৃণ আর পেলব, ঢেউ খেলানো কোঁকড়া চুলগুলো লালচে রং করা। কড়া লিপস্টিক দেওয়া টুকটুকে লাল ঠোঁটের ফাঁক সিগ্রেট ধরা। শাহানা ম্যাডাম বলে উঠলেন—এই যে পিংকি, এই হলো চাঁদনী। ওর কথাই বলছিলাম। ও তোমার সাথেই থাকবে।
পিংকি ঠোঁট গোল করে সিগ্রেটের ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর একটু হেসে বলে—হাই, আমি পিংকি। বসো।
মেয়েটার মুখের দামি মেকআপ আর শরীরের ভুরভুর করা সুগন্ধির পাশে চাঁদনী কেমন মিইয়ে যায়। এই মেয়েটিও পতিতা? সে না হয় কপালের ফেরে আজ মন্দ পাড়ার বাসিন্দা, কিন্তু এই লেখাপড়া জানা ইংরেজি বলা ভদ্রলোকের মেয়ে এই কাজে কীভাবে এল? কী আশ্চর্য!
সন্ধ্যায় হোটেলের সাত তলায় শীতল কক্ষের ছোট্ট ফ্রিজ খুলে একটা বোতল বের করল পিংকি। দুটো গ্লাস টেবিলে রেখে বলল—চলবে তো? চাঁদনী মাথা নাড়ে। ও অভ্যাস তার আছে। তবে কিনা এত ভালো মাল সে জীবনে কখনো খায়নি। গেলাসে কয়েক চুমুক দিয়ে তার শরীরটা প্রজাপতির মতো হালকা হয়ে গেল। তার মনে হলো, সে মাদারীপুরে তাদের ছোট্ট সবুজ গাঁয়ে হলদে সরষে ক্ষেতে উড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাসে উড়ছে ফুলের রেণু। দূরে গাছের ডালে বসে ডেকে চলেছে বউ কথা কও পাখি। সে প্রাণভরে অনেক দিন পর সেই তাজা সোঁদা গ্রাম্য বাতাসের ঘ্রাণ শোঁকে।
তাকে চমকে দিয়ে ঠক করে গ্লাস রেখে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় পিংকি—তুমি ভাবতেছ, তুমি একাই এখানে একজন দেহপসারিণী? হি হি হি। চাঁদনী বেগম, মাই ডিয়ার, চারপাশে যাদের দেখতে পাচ্ছ, তারা সবাই বলতে গেলে তাই। নিজেকে নানাভাবে বিক্রি করা যায় বুঝছ? আমরা বিক্রি করি এক স্টাইলে, আর ধরো তোমার ওই ম্যাডাম—উনি করেন আরেক স্টাইলে। শেষ পর্যন্ত ঘটনা একই। হা হা হা।
চাঁদনীর বিশ্বাস হয় না। এই মেয়ে মাতাল হয়ে গেছে নিশ্চয়। ম্যাডামের মতো মহিলা? ধুর, এ হতেই পারে না। কিন্তু এরপরই পিংকি সিরিয়াস হয়ে ওঠে—তোমাকে এরা মালকড়ি দিছে কিছু? আরে, আমাদের এক রাত বেকার থাকা মানেই লস, তাই না? এদের উচিত ছিল সেইটা পুষিয়ে দেওয়া। কালকে কিছু আদায় করতে হবে, মনে রাইখো। আমাদের দেখায়ে ফান্ডের টাকা পাবে, এদের ছাড়া যাবে না।
বলেই পিংকি তার সেলফোনটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর চাঁদনী শুয়ে পড়ল পাখির পালকের মতো নরম ধবধবে সাদা বিছানায়। তার এই বেশ ভালো লাগছে। নোংরা নর্দমার জীবন নেই এখানে, অচেনা মুশকো ঘামের বিকট গন্ধওলা পুরুষেরা নেই, খিস্তিখেউড় নেই, অশ্রাব্য রসিকতা নেই। বেশ রাজার হালে খাচ্ছে দাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, বেড়াচ্ছে। আহা, যদি এই জীবনটাই চিরকালের জন্য সত্যি হতো।
পরদিন তারা ম্যাডামের সাথে কত জায়গায় গেল। এই অফিস সেই অফিস। ডাক্তারখানায় কী কী সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মার্কেটে কেনাকাটা। পিংকি বেছে বেছে দামি দামি বিদেশি পোশাক আর জুতা কিনল। অন্তর্বাস কিনল। ম্যাচিং করে গয়না আর ব্যাগ। চাঁদনী কিনল কয়েকটা শাড়ি আর সালোয়ার-কামিজ। সে শুনে ভারি অবাক হলো যে পিংকির আগে থেকেই পাসপোর্ট ছিল। কারণ, সে এর আগে বেশ কয়েকবার বিদেশ গেছে। গেছে তার পেশাগত প্রয়োজনেই। হাসতে হাসতে বলল পিংকি—একবার ব্যাংকক গেছি এক বড় নেতার সাথে। নাম শুনলে তুমি টাসকি খাবা। অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র টাইপ নেতা। আর আরেকবার—সেইটা অবশ্য একটা ইনভেস্টমেন্টের মতো, কোনো পারিশ্রমিক নাই। ইন্ডাস্ট্রির একজন বলছিল, ফিল্মে একটা চান্স দিবে, তাই বিনা পয়সায় সার্ভিস দিছি। শালা মাদারচোদ কথা রাখে নাই।
এই সব কথা সে বলে চলে ম্যাডামের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কালো অ্যাভানজা গাড়িতে বসে। ম্যাডাম শুনেও না শোনার ভান করে বিরক্ত মুখে ট্যাব খুলে কাজ করতে থাকেন।
বিকেলে দুজন সাংবাদিক তাদের সাথে কথা বলতে আসে। এই প্রথম আন্তর্জাতিক কোনো সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে দুজন প্রস্টিটিউট অংশ নিচ্ছেন। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। জিনস ফতুয়া পরা মেয়েটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে নানা জটিল প্রশ্ন করে যায়। আপনাদের স্বাস্থ্যসচেতনতা কেমন? নিয়মিত হেলথ চেকআপ করা হয়? পিরিয়ড হলে কী নিয়ম? কোনো ক্লায়েন্ট কনডম ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানালে কী করেন? অ্যাই রবিন, ছবি এমন অ্যাঙ্গেল থেকে তুলবা যেন চেহারা বুঝা না যায়।
রবিন বলে—সমস্যা নাই, ব্লার করে দেওয়া যাবে।
বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর চাঁদনীকেই দিতে হয়, কেননা পিংকি গোটা সময় গম্ভীর মুখে সেলফোনে ফেসবুকিং করতে থাকে। উপার্জনের সম্ভাবনাহীন যেকোনো কাজে তার চরম অনীহা। সাক্ষাৎকার শেষে সাংবাদিক দুজনের সাথে তারা লিফটে চড়ে নিচের রেস্তোঁরা পর্যন্ত যায়। লিফটে উঠেই ক্যামেরাম্যান ছেলেটা আলতো করে চাঁদনীর নিতম্বে হাত দেয়। সে চমকে উঠে হাত সরিয়ে দিলে ছেলেটা খুক খুক করে হেসে তার পাছায় একটা জোরে চিমটি কেটে দেয়।
রুমে ফিরে পিংকিকে ঘটনাটা বলতে পিংকি হেসে গড়িয়ে পড়ে—ইস, তুমি বলো নাই কেন তখনই? একটা সিনক্রিয়েট করে হারামজাদার কাছ থেকে কমসে কম দুই হাজার টাকা আদায় করে দিতাম। তোমার এই শরীরটার মূল্য অপরিসীম—বুঝলা? কাউকে কখনো বিনা পয়সায় এই শরীরে হাত দিতে দিবা না। এইটা হলো আমাদের প্রফেশনের এথিকস।
চাঁদনী অপমান ভুলে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে—যাহ, পাছায় হাত দিলে দুই হাজার টেকা? কী কও? আইচ্ছা—লজ্জায় মুখ নিচু করে জিজ্ঞেস করে সে—তুমি সাধারণত কত টেকা নেও?
পিংকির মুখে তার পারিশ্রমিকের অঙ্ক শুনে চোখ কপালে উঠে যায় তার। এই মেয়ে বলে কী? তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ভাবে—পিংকির সাথে কি তার তুলনা হয়? বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পর্যন্ত পড়েছে মেয়েটা। টক টক ইংরেজি বলতে পারে। দেখতেও দারুণ সুন্দর। ছোট স্কার্টের সাথে আঁটোসাঁটো গেঞ্জি পরলে মনে হয় বোম্বের নায়িকা। অবশ্য, পিংকির নাকি খরচও অনেক। জামাকাপড় তো আছেই, বুঝলা, পার্লারের পেছনে আমার মাসে মাসে অন্তত দশ হাজার টাকা খরচ। সেই খরচ উঠাতে হবে না? আচ্ছা, ভালো কথা। আজকে সন্ধ্যায় তোমাকে ঘন্টাখানেক একটু লবিতে গিয়ে বসতে হবে। রুমে আমার একজন ক্লায়েন্ট আসবে। এইভাবে বেকার বসে থাকা আমার আর পোষাচ্ছে না।
গুণী মেয়ে রে বাবা! মনে মনে ভাবে চাঁদনী। এইখানেও ক্লায়েন্ট জুগিয়ে ফেলেছে। কী আর করা। যথাসময়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে পিংকির ক্লায়েন্টের সাথে প্রায় ধাক্কা খাবার উপক্রম হয় তার। লোকটাকে হঠাৎ কেমন যেন চেনা চেনা লাগে। লোকটা মুখ নিচু করে দ্রুত চাঁদনীদের রুমে ঢুকে পড়লে বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে যায় ওর। এ তো সকালবেলার সেই বড় অফিসার—ম্যাডাম যার সঙ্গে টাকা ছাড়ের জন্য দেনদরবার করছিলেন। ওদের মতো মেয়েদের দুঃখে যার নাকি প্রাণ কাঁদে!
দাঁতে ঠোঁট চেপে নিচে নেমে আসে চাঁদনী। লবিতে বসে অকারণেই দুটো ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়। তার কেন যেন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। ওদের তেইশ নম্বর ঘরের খদ্দেররা এর চেয়ে অনেক ভালো। রাতভর ট্রাক চালিয়ে বা দোকানের ঝাঁপি ফেলে মদ খেয়ে তারা ফুর্তি করতে তাদের ঘরে আসে, মাল খেয়ে দুইটা দুঃখের কথা আওড়ায়, তারপর বাড়ি ফিরে অকারণে বউকে পেটায়। ভদ্রসমাজের পুতুপুতু লেবাসটা অন্তত গায়ে দিয়ে বসে থাকে না। আই ফিল ফর দেম! বাঞ্চোত কোথাকার! চাঁদনী ম্যাগাজিনের পাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে গাল দেয়। হোটেলের বেয়ারা আর রিসেপশনের লোকগুলো, এমনকি গেটের কাছে সিকিউরিটিগুলো পর্যন্ত সবাই কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে বলে মনে হয় তার। সে উসখুস করতে থাকে। উফ, পিংকি কখন ফোন করবে?
আপনাকে একজন ডাকছে। কথাটা শুনে চমকে ওঠে চাঁদনী। হোটেলের বেয়ারাটা ওর দিকে তাকিয়ে ফাজিলের মতো হাসছে। ওই যে, ওইখানে। গেটের বাইরে। আঙুল তুলে দেখায় বেয়ারাটা। চাঁদনী আশ্চর্য হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এখানে, এই শহরের পাঁচতারা হোটেলে, তাকে কেই-বা চেনে? কে ডাকবে ওকে এখন? কৌতূহলী হয়ে কাচের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলে কে একজন তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে পাশে অন্ধকারে টেনে নেয়।
চল—ফ্যাস ফ্যাস করে বলে ম্যাডামের অ্যাভানজা গাড়ির ড্রাইভার—ওই পরীবাগের দিকে একটা সস্তা ভাড়া ঘর আছে। বেশি সময় লাগব না। ম্যাডাম বিদেশিদের সাথে ডিনার করতেছে। ডিনার শেষ হওয়ার আগেই এইখানে দিয়া যামু আবার। পয়সা দিমু, ভাবিস না।
চাঁদনী তড়িতাহতের মতো খানিকক্ষণ নিশ্চল হয়ে থাকে। তারপরই ম্যাডামের ড্রাইভারের শক্ত সাঁড়াশির মতো হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। অন্ধকারে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে সে। একদিন জ্ঞান ফিরে আসার পর মাদারীপুরের সাইফুল মেম্বারের বাড়ির বিচালির ঘর থেকে বেরিয়ে সরষে ক্ষেত পেরিয়ে বাঁশ বন পেছনে ফেলে পাটক্ষেত মাড়িয়ে যেভাবে প্রাণপণে ছুটেছিল সে, ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে একসময় হারিয়ে গিয়েছিল ঘন কালো নিকষ অন্ধকারের ভেতর, যে অন্ধকার থেকে কোনো দিন আর নিস্তার পাবে না জেনেই; সেই অন্ধকারের দিকেই আবার ছুটতে শুরু করে দেয় তেইশ নম্বর ঘরের চাঁদনী ওরফে আলেয়া বেগম। তার পেছনে পড়ে থাকে আলোয় আলোয় ভরা এক ঝলমলে শহর!
খুব মন দিয়ে পড়লাম। ওদের জন্য দীর্ঘশ্বাস। লেখিকার উপস্থাপন চমৎকার। এ আরেক জগতের গল্প। বিদেশ সম্মেলন হয়ত কিছুটা কাল্পনিক বাকী সব জ্বলজ্বলে সত্য।
মোঃ এনামুল কবীর
সেপ্টেম্বর ০১, ২০২১ ২১:২২
দারুণ গল্প! বিশেষভাবে সবার বিক্রি হওয়ার বিষয়টা।
গাজী তানজিয়া
সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২১ ২০:৪৮
ভাল লাগল।
অমিতরূপ চক্রবর্তী
ডিসেম্বর ০১, ২০২১ ২২:২১