ইবলিস

 


কখনো কখনো অদ্ভুত সেই লোকটার কথা আমার মনে পড়ে।
বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার চোখে যখন সন্দেহ আবিষ্কার করি, যখন অকস্মাৎ বুঝতে পারি, এখনই গা ঢাকা দিতে হবে, যখন কিছুতেই আলাদা করা যায় না শত্রু আর বন্ধুর মুখ এবং সত্য আর মিথ্যাকে দেখায় হুবহু এক রকম, কোনো কোনো দিন যখন ভয় এবং ক্লান্তি এসে চেপে বসে আমার বুকের ওপর, যখন গ্রেপ্তার এড়াতে বহুদূরে গভীর কোনো গ্রামে চলে যাই, বন্ধুর বাড়িতে থাকি আর তাদের চোখ আমার মুখে দাগি এক আসামিকে খুঁজতে থাকে, আমি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে বসে অদ্ভুত সেই লোকটা এবং তার সঙ্গে সাক্ষাতের দিনগুলোর কথা ভাবি।


সেই দিনগুলোতে আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতাম শহরের রাস্তায় রাস্তায়। আমার পেছন পেছন অনুসরণ করে আসত আমারই ক্রোধান্ধ আবেগ, যেন আমাকেই হত্যার উদ্দেশ্যে, আর আমি তার হাত থেকে বাঁচতে ছুটতে থাকি নানা জায়গায়। পথ চলতে চলতে রাস্তার ধারে ড্রেনের ময়লা পানিতে পড়ে থাকতে দেখি আমার লুণ্ঠিত স্বপ্নগুলোকে। মনে হতে থাকে উঁচু দালানগুলো হঠাৎ ভেঙে পড়বে আমার মাথায়, নয়তো হাঁটতে শুরু করবে এবং আমাকে পদদলিত করবে পায়ে পিষে ফেলা একটা পোকার মতো। এভারে আমার দুর্ভাগ্য আমাকে ক্রমাগত তাড়া করতে থাকে এবং আমি মিউনিসিপ্যালিটির বন্দুকের তাড়া খাওয়া বেওয়ারিশ কুকুরের মতো পালিয়ে যাই ক্রমশ এক নির্জনপ্রায় এলাকার দিকে।
শহরে ঢোকার রাস্তার ধারে একটা নিরিবিলি কবরস্থান। কোনো কোনো সন্ধ্যায় আমি কবরগুলোর আশপাশে হেঁটে বেড়াই আর মৃত্যুর অনুভব গায়ে মাখি। কোনো কোনো দিন সারা দুপুর বসে থাকি কবরস্থানের ঢালে দাঁড়ানো হিজলগাছটার নিচে। এ সময় আমার আবেগ আমার দেহপাত্র উপচে পড়ে। আমি ভাবি, পিতৃত্ব আসলে কী জিনিস? কোনো পিতা কীভাবে তার সন্তানকে এমন সর্বস্বান্ত করতে পারে?
আমি সেই হিজলগাছের নিচে বসে এক পড়ন্ত বিকেলে অদ্ভুত লোকটাকে আসতে দেখি। আমার মনে নেই, লোকটা কি নৌকা থেকে নেমেছিল, নাকি হেঁটে এসেছিল নদীপাড় ধরে? নাকি তার অদৃশ্য ডানা ঝাপটে উড়ে এসেছিল মেঘ-ঢাকা আকাশ থেকে এবং সোজা এসে দাঁড়িয়েছিল আমার সামনে?
তার মুখে ছিল মৃদু হাসি।
‘হাসতেছেন কেন?’ আমি তাকে জিগ্যেস করি।
‘হাসতেছি, ঈশ্বরের রাজ্যের পতন দেখে। কেউ যখন একটা তুচ্ছ বিপদ  দেখে বিশ্বাস হারায়, তখন আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাজয় ঘটে। এটা দেখেই আমি হাসি।’
আমি কিছুটা বিরক্ত হলেও ভেতরে ভেতরে চমকে উঠি। মনে মনে ভাবি, কে এই লোক? একটা অস্বস্তি আমার মন ও হৃদয়কে ঢেকে ফেলে। আমি ভেবে পাই না, আমি যে বিশ্বাস হারিয়েছি, এটা সে কী করে বুঝল? উপরন্তু, আমার মনে এমন একটা ধারণা উঁকি দিতে থাকে যে, লোকটা আমার সবকিছু জানে—আমার মায়ের অপমৃত্যু, তার কিছুদিনের মধ্যে এক তরুণীকে নিজের সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়ে বাবার বিয়ে করা, বিদেশে থাকা আমার ভাইয়ের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এবং এমনকি আমার মধ্যে যে আত্মহত্যার ইচ্ছা ক্রমশ প্রবল হচ্ছে, এটাও সে জানে। লোকটার চোখের কোনায় থাকা একটা চিকন হাসি দেখে আমার মনে হতে থাকে, বাবার এই বিয়ের পেছনেও লোকটার হাত আছে।
‘আমি যে বিশ্বাস হারাইছি, সেটা আপনি কীভাবে জানেন?’ আমি তাকে জিগ্যেস করি।
‘আমি কী জানি, সেটাই বড় কথা, কীভাবে জানি সেটা ব্যাপার না।’
‘আর কী জানেন?’
‘জানি, তুমি আত্মহত্যার কথা ভাবতেছ। আর এটা আমি হতে দিতে চাই না।’
‘কেন?’
লোকটা কবরস্থানের ঢাল বেয়ে উঠে আসে এবং হিজলগাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।
‘চাই না, কারণ মৃতদের নিয়ে আমার কিছুই করার থাকে না। আমি চাই মানুষ বেঁচে থাকুক।’
ঠিক এই সময় আমার মনে আবারও প্রশ্নটা ফিরে আসে, কে এই লোক! জীবিতদের নিয়ে কী কাজ তার?
‘তুমি নিজেকে নিঃস্ব ভাবতেছ। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আসলে তুমি কিছুই হারাও নাই। তুমি চাইলে আমার পুরো রাজ্যটাই এখন তোমার।’
সে আমাকে প্রলুব্ধ করে।
আমার মনের মধ্যে কোথাও পাথর পতনের শব্দ হয়। আমি উৎকর্ণ হয়ে সেই শব্দ শুনি। হয়তো আমার চেহারায় তখন দ্বিধাগ্রস্ততার একটা ছায়া পড়ে।
লোকটা আমার পাশে এসে বসে এবং বলে, ‘যুগ এখন অনেক পাল্টে গেছে। এটা আমারই যুগ। এখানে তুমি সাদা চোখে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা কিংবা বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীর পার্থক্য করতে পারবে না। ভালো লোকদের তুমি আলাদা করতে পারবে না, কোনো রাখাল যেভাবে দল থেকে ভেড়া আর বকরিদের আলাদা করে। আমি তোমাকে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী কোনোটাই হতে বলি না, তোমাকে শুধু সাহায্য করতে চাই।’
আমি বিহ্বল বোধ করি। আমার দ্বিধাগ্রস্ততা তখনো কাটে না।
‘ভেবো না, বিপদ বুঝে তোমাকে লুঠ করতে আসছি, দুর্বল গৃহস্থের ঘর যেভাবে লুঠ করে দুর্ধর্ষ কোনো ডাকাত। আমি যে নিজের রাজ্য তোমাকে দিয়ে দিতেছি, তার জন্য আমি কোনো বিনিময় চাই না। আমি বলতেছি না, এর বিনিময়ে তুমি তোমার আত্মা বন্ধক রাখো আমার কাছে। তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন, আকাশে ওড়া পায়রাগুলো যেমন। এটা ভাবার দরকার নাই যে, আমি একটা ঘোড়া আর তোমাকে আমার পিঠে নিয়ে আমি নিজের মর্জিমতো ছুটতে থাকব।’
‘তাহলে আমাকে সাহায্য করার কী উদ্দেশ্য?’
‘দেখো, এটা আমার যুগ। একটু খেয়াল করলে দেখবে, চারদিকে সবকিছুর মধ্যে বেজে উঠছে আমারই ইচ্ছার ঐকতান। এ এমন এক যুগ, যেখানে যে শস্য তুমি রোপণ করবে, তার সঙ্গে জন্মাবে প্রচুর আগাছা। আর সেই আগাছার শিকড় জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকবে শস্যের শিকড়ের সঙ্গে। যদি তুমি আগাছা ওপড়াতে যাও, তাহলে শস্যটাকেই ধ্বংস করে ফেলবে। কাজেই এখানে আমি ছাড়া আর কে তোমাকে সাহায্য করতে পারে!’
আমি ভাবলাম তর্কের খাতিরে বলি, শস্য আর আগাছাকে আমি একসঙ্গেই বাড়তে দেব। তবে ফসল তোলার পর ঘরে নেব কেবল শস্যটাকেই। কিন্তু সেটা আর বলা হয় না।


তারপর লোকটা আমাকে তার রাজ্য দেখিয়ে দেয়। আমি সেই রাজ্যটাকে আমার বলে চিনতে শুরু করি।