মার্কেজের গল্পে পাওয়া আইডিয়া
ইউরোপীয় ভাষ্যে আর আমাদের টাইমে বৃহস্পতিবার অফিস শেষে উইক্যান্ডের যাত্রা, সরকারি হিসাবে দুই দিন—শুক্র ও শনিবার হলেও আমাদের এক দিন, কেবল শুক্রবার অবধি তার পথচলা। সে হিসাবে উইক্যান্ড শুরুর আগ মুহূর্তে মানে বৃহস্পতিবার পাঁচটা বাজার মিনিট বিশেক বাকি থাকতে সাদেকভাইর ডাক—‘আর্জেন্ট মিটিং, তাড়াতাড়ি বোর্ডরুমে আসো।’
অ্যাড ফার্মের মিটিং মানে সাজুগুজু করে স্কুলের সামনে জড়ো হওয়া মায়েদের আড্ডা। সবাই কথা বলে। একজনের পর আরেকজন মুখ খোলে। ফলে তার আর শেষ হবার নাম-গন্ধ থাকে না। তারপর আমাদের ডিপার্টমেন্ট, যারে আমরা বুক ফুলায়ে ক্রিয়েটিভ সেকশন বলি, তার আদি ও অকৃত্রিম বস সাদেকভাইর মিটিং—সে তো পুরা এক বেলা হাতায়ে নিতে ওস্তাদ। এখন পাঁচটায় শুরু হলে আকাশ-পাতাল ঘুরে তার দৌড় কোথায় গিয়ে থামে আল্লাহ মালুম।
তাহলে ইভানার সাথে আমার উইক্যান্ড শুরুর সাক্ষাতের কী হবে? তারে তো সময় দেওয়া, অফিস শেষে তার কাছে ছুটে যাবার কথা। তারপর কোনো আলো-আঁধারিতে বসে আড্ডা দেবার কিংবা সিনেমা-প্রদর্শনীতে যাবার প্ল্যান আঁটা।
ইভানা দেশ ও জাতি উদ্ধারে আমগ্ন এক এনজিওতে। তার অফিস কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় ঝাঁপ বন্ধ করে। ইভানা তারপর আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? ঘড়ির কাঁটা ধরে মিনিট বিশেক। সাততলার মাথায় আমার অফিস থেকে বার হয়ে বড় রাস্তার পাড়ে খাড়া তার অফিসে যাবার সময়টুকু। তারপরেই ফোনে ঝড় তুলবে—‘তুমি কোথায়? আর কতক্ষণ বসে থাকব?...।’ সে আউলা-ঝাউলা ঝড় থেকে বাঁচতে আগাম মেসেজ পাঠাই—‘আমার আসতে দেরি হবে।’ একেবারে সাথে সাথে রিপ্লাই—‘কতক্ষণ?’ আমিও জবাব দেই—‘জানি না।’
ব্যস, গুণে-মানে মাটিতে পা না পড়া ইভানা আর কোনো পথ এতটুকু না হাতড়ে সাথে সাথে আজকের প্ল্যান, যারে আমরা উইক্যান্ড শুরুর সাক্ষাৎ বলে আসছি, তার গলায় আড়াই হাতি ছুরি চালায়। এক পোচে কোরবানি করে ফেলে—‘অতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না। আজ আর দেখা হবে না। অফিস শেষ করে আমি বাসায় চলে যাচ্ছি।’
‘যাহ, শালার অফিস! গোলামির গোয়ালঘর।’ বইলা হাতের কাছে পাওয়া নিজের ডেস্কের উপর রাগ ঝাড়ি, ঘুষিতে আগাগোড়া কাঁপাইয়া দিয়া উঠে দাঁড়াই। তারপর বোর্ডরুম পানে পা বাড়াই।
দুটো রুম পাড়ি দিয়া তাতে গিয়া দ্যাখি খোদ সাদেকভাই-ই অনুপস্থিত। এখনো পদার্পণ করেন নাই। তবে তার করতলের ক্রিয়েটিভ টিমের আগামুড়া, পাঁচজনের সবাই, এমনকি ইভেন্ট সেকশনেরও দু-চারজন হাজির। সবার মধ্যে কানাঘুষা—অফিসের এই অন্তিম মুহূর্তে, উইক্যান্ডের প্রসববেদনাকালে হঠাৎ আর্জেন্ট মিটিং ক্যান?
আমাদের অফিসটা অ্যাড ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কইরা খায়। আর দুনিয়াজোড়া আপনারা-আমরা জানি, বিশ্বসংসারের যত ইভেন্ট তার প্রায় ষোলো আনাই উইক্যান্ডের ঘাড়ে চইড়া আইসা হাজির হয়। শুক্র-শনিবারে সশরীরে তাদের উদয় ঘটে। তা অবশ্য সামলায় আমাদের ইভেন্ট টিমের স্বদল শার্দূলরা। আমরা ক্রিয়েটিভ টিমের লোকজন তখন গায়ে হাওয়া লাগাইয়া ঘুইরা বেড়াই। তবে ঘাড়ে-গর্দানে মোটাতাজা, দেহসৌষ্ঠবে বড়োসড়ো, হাজার লোকজনের সমাগমের কোনো ঘটনা থাকলে আমাদেরও ডাক পড়ে। ডিউটি দিতে বলা হয়। তাহলে কি কাল কিংবা পড়শু সে রকম কোনো ইভেন্ট ওত পাতা? তাতে আমাদের ডিউটি দিতে বলবে? তাই আর্জেন্ট মিটিং?
‘না, সে রকম কোনো ইভেন্টের শিডিউল তো নাই।’ ইভেন্ট সেকশনের লোকজনই জানায়। তাহলে উইক্যান্ডের উষালগ্নে আমাগো সবাইরে ডাকা ক্যান?
‘এইডা অ্যাড ফার্ম। এহানে কি কামের শ্যাষ আছে? রাইত দুপুরে বিলবোর্ড টাঙানো থাইকা শুরু কইরা ক্লাইন্টগো মেয়েমানুষ সাপ্লাই দেয়া, আর্টিস্টগো মাথায় ছাতা ধরা—দ্যাহো তার কোনটা আইজ আমাগো ঘাড়ে চাপায়। উইক্যান্ডডারে মাটি করে।’
তবে মিনিট দশেক পর সাদেকভাই এসেই সুসংবাদ দেন, সন্দেশের মতো মিঠা খোশ-খবর ছাড়েন—‘এক জাঁদরেল ক্লাইন্ট পাওয়া গ্যাছে। যারে কয় রাঘব-বোয়াল। কোটি টাকার নিচে কোনো চেকে সই করে না।’
হ্যাঁ, কোনো অ্যাড ফার্মের জন্য ক্লাইন্ট পাওয়া আদি ও অকৃত্রিম খোশ-খবরই বটে। তারপর এ রকম দরাজ-দিলের কাউরে পাওয়া গেলে তা তো উদযাপন কইরা লোক জানান্তি দেবার বিষয় হইয়া দাঁড়ায়। তার জন্য পার্টি থ্রো করা জরুরি হইয়া পড়ে। উইক্যান্ডে কি সে রকম কোনো জমকালো উৎসব-পার্টি? তবে তার আগে আমরা সবাই জানতে চাই—ক্লাইন্টটা কে? মস্ত ওলানঅলা দুধেল গাইটা কোন গোয়ালের?
—সরকারি দলের এমপি ক্যান্ডিডেট। দেশ-জোড়া গা-গতর মেলা, বাইরের দুচার দেশে পা ফেলা গ্রুপ অব কোম্পানিজের খোদ মালিক। তবে তার নাম বলা এই মুহূর্তে মানা। জানাজানি না করা ইলেকশন স্ট্যাটেজির অংশভাগ।
ইলেকশনের ক্যান্ডিডেট! তাহলে তো তার দরকার পোস্টার-লিফলেট-ফেস্টুন। আজকাল আবার নতুন ট্রেন্ড—বিলবোর্ড। তার জন্য তো আমাগো নাক-উঁচা, নিজেগো ফার্মের প্রাণভোমরা দাবি করা ডিজাইন টিম আছে। তারাই তার সবকিছু সাপ্লাই দিতে ওস্তাদ।
—না, না। তার পোস্টার-ফোস্টার দরকার নাই। সেসব বানানো তার সারা। তা দিয়া এলাকা ছাইয়া ফালানো শ্যাষ। তার দরকার একটা আইডিয়া। একেবারে আকাশ থাইকা পাইড়া আনা অভিনব নতুন। আগে কখনো কেউ ব্যবহার করে নাই এমন তরতাজা খোলায় তোলা গরম গরম আইডিয়া তার দরকার।
— কীসের আইডিয়া? ইলেকশনে জেতার?
—জেতার জন্য তার চিন্তা নাই। একে তো গভর্নমেন্ট পার্টির ক্যান্ডিডেট, আজকাল তো তার জেতার সব ব্যবস্থা গভর্নমেন্ট আগেভাগে পাকা কইরা রাখে। তারপরও তিনি নিজে লোকাল পার্টি লিডার থেকে উপরতলার সবকিছু ম্যানেজ কইরা ফালাইছেন। পকেটে পুইরা নিছেন। তারাই তার জেতার একেবারে টাটকা গোলাপের মতো পাকাপাকি ব্যবস্থা করবে।
—তাহলে ইলেকশনে আর কী লাগে?
—জনসভায় লোক। এতো বড়লোক। টাকা-পয়সার তার এতো রমরমা। কিন্তু তার জনসভায় লোক হয় না। মঞ্চের সামনের মাঠ ধু ধু কইরা বেড়ায়। এতে তার মান-সম্মান থাহে? এরই মধ্যে তা ধুলায় লুটোপুটি খাওয়া শুরু কইরা দিছে। অপোনেন্টরা হাসাহাসিতে মাইতা উঠছে।
অ্যাঁ! কী যে কন, ভাত ছিটাইলে কাকের অভাব? টাকা ছিটাইলে লোকের? ইলেকশনের টাইমে টাকা দিলেই তো লোকজন সুর সুর কইরা জনসভায় আইসা হাজির হয়। মাঠ ভইরা ফালায়। ভাসমান গুয়ের দলার চারপাশে শিং-মাগুরের মতো মঞ্চের এপাশে ওপাশে ঘুরঘুর করে।
—এইসব আইডিয়া, টাকা দিয়া লোক আনা, ঘরে ঘরে গিয়া থ্রেড দেয়া, এগুলা পইচা গ্যাছে। শুধু তাই না, হেজে গাঙের জলে তাগো ভাইসা যাওয়া সারা। তাই এহন আর এগুলা কাম দেয় না। এতোদিন ধইরা এগুলা করছেন। তাতে দ্যাখা গ্যাছে লোকজন টাকাপয়সা নিছে ঠিকই কিন্তু তা দিয়া ভাত-গোস্ত, ভালো-মন্দ খাইয়া ঢেকুর তুলতে তুলতে অপোনেন্ট ক্যান্ডিডেটের জনসভায় গিয়া হাজির হইছে। আরো দুই-চার টাকা লুঙ্গির খুটে গুঁইজা নিছে।
—বাহ! গেরামের লোকজন দ্যাহি চরম চালাক হইয়া উঠছে।
—হ, তাই তো উনি দুঃখ করলেন। এতোদিন গেরাম-গঞ্জে যান নাই। লোকজনের খোঁজ-খবর নেন নাই। আছিলেন বিজনেস নিয়া দ্যাশ-বিদ্যাশে বিজি। তাই এহন ইলেকশন করতে এলাকায় গিয়া দ্যাখেন লোকজন সব অপোনেন্ট হইয়া উঠছে। তাই তাগো বাগে আনতে, ম্যানেজ করতে যে যা চাইছে তারে তাই দিছেন। বড় বড় অঙ্কের বান্ডিল বান্ডিল নোট মুহূর্তেই শ্যাষ হইয়া গ্যাছে। তাতে অবশ্য উপরমহল—থানা-পুলিশ-র্যাব, এমনকি মাঝারিমহল, লোকাল পার্টি লিডাররা ম্যানেজ হইয়া গ্যাছে। বাট, নিচের মহল, জেনারেল পাবলিকরে আর ম্যানেজ করতে, তাগো জনসভায় আনতে পারেন নাই। তাই তো আমাগো কাছে ছুইটা আইছেন। জনসভায় লোক আনার নতুন একটা আইডিয়া চাইছেন। আরো পাঁচটা অ্যাড এজেন্সির সাথে তার কথা হইছে। যারা ভালো, মানে তার মনে ধরা আইডিয়া দিতে পারবে তাগো লালে লাল কইরা দেবেন। বলছেন, ব্ল্যাঙ্ক চেক লইয়া ঘুরতেছেন। তাগো ব্যাংক আকাউন্ট উপচাইয়া ফেলবেন।
—আইডিয়া জেনারেট করা আমাগো, মানে ক্রিয়েটিভ টিমের কাম। এহানে তা হইলে ইভেন্ট টিম ক্যান? তাগো ডাকছেন কিসের লাইগা?
—তাগো ডাকছি, তোমরা এমন আইডিয়া বানাবা যা আমাগো ইভেন্ট টিম যেন ইমপ্লিমেন্ট করতে পারে। তাহইলে দুইটা ব্ল্যাঙ্ক চেক মিলবে। একটা আইডিয়ার আরেকটা তা ইমপ্লিমেন্ট করার। ব্যস, যাও এখনই লাইগা পড়ো। হাতে একদম সময় নাই। ইলেকশন ঘনাইয়া আসছে। উইক্যান্ডের মধ্যে আইডিয়া বানাও, যারটা ক্লাইন্টের মনে ধরবে, মনে করবা তার কেল্লা ফতে, পুরা একটা আপাদমস্তক প্রমোশন স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া তার ডেস্কে গিয়া হাজির হইবে।
অফিস থেকে বার হয়ে দেখি সাড়ে ছয়টা বাজে। এখন আর নিশ্চয়ই ইভানাকে পাওয়া যাবে না। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সে বাসায় পৌঁছে গেছে। কেননা যানজটের পাগলামি, এক জায়গায় ল্যাটকা দিয়া বসলে আর চলার, উঠে সামনে দুচার কদম ফেলার নাম করে না, তাই তা থেকে বাঁচতে সে মাস কয়েক আগে অফিসের কাছাকাছি বাসা নিয়া আসছে।
তাহলে অন্য কোথাও কি যাওয়া যায়? আমি গালে হাত রাখি। বন্ধু-বান্ধব কারো কাছে? না, তার দরকার নাই। তার চেয়ে বরং বাসায় যাই, নতুন অভিনব তরতাজা আইডিয়া খুঁজি। পেয়ে গেলে হাতের মুঠোয় প্রমোশন। তখন আর ইভানার সাথে সংসার পাততে কোনো অসুবিধা হবে না। কেননা আমরা দুজন মিলে যা কামাই তার উপর ইভানার ভরসা নাই। দুই পক্ষের মা, ভাইবোন নিয়া আস্তো দুইটা সংসার। তার সাথে আবার আরেকটা লেজুর? ‘না বাবা! এখন না। স্যালারিটা আরেকটু বাড়ুক, দু-একটা প্রমোশন মিলুক, তারপর দেখা যাবে।’
সুতরাং প্রমোশনটা বাগাতে পারলে তখন আর ইভানার নিশ্চয়ই আপত্তি করার কিছু থাকবে না। আমি তাই ডাইনে-বায়ে আর কোনো দিক না তাকায়ে বাসার পথ ধরি।
দুই
আমাদের দেশের ক্রিয়েটিভ কবি-সাহিত্যিকদের দৌড় ইংরেজি পর্যন্ত। তাতে যা লেখা হয় তার ওপর ভর দিয়া তারা আগায়, বাংলায় গল্প-কবিতা কিংবা উপন্যাস ফাঁদে। তাহলে অ্যাড ফার্ম, ক্লাইন্টদের সেবাদাস, তাদের কথায় উঠবস করা সামান্য ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, তার ক্রিয়েটিভ টিমের সদস্য আমাদের দৌড় আর কতদূর হবে? গুগল-ইউটিউব ছাড়া আমরা আর কোথায় যাব?
আমাদের তাই কোনো নতুন আইডিয়া জেনারেট করতে হলে আমরা তড়িঘড়ি তাদের ঘাড়ে সওয়ার হই। তাদের একোনা সেকোনায় ঢুঁ মেরে তার কোনো একটার ওপর কিছু দেশী আমেজ বসায়ে, কিছু অদল-বদল করে কাজ সারি। চাকরি বাঁচাই।
অফিস থেকে তাই সরাসরি বাসায় ফিরে গুগল-ইউটিউবের আঁতুড়ঘর, কম্পিউটার খুলে বসি। ভার্চুয়াল জগতের রাজা-মহারাজাদের পিছু পিছু ঘণ্টার পর ঘণ্টা দৌড়াই। এ চ্যানেল সে চ্যানেলের দ্বারে দ্বারে ঘুরি। কিন্তু কোনো আইডিয়ারে আর নতুন কিংবা অভিনব মনে হয় না।
আমাদের টিমে আছেন এক আদি ও অকৃত্রিম খায়ের কবির। এই লাইনে, এই টিমে তিনি বহুদিন। তাই তারে সম্বোধনে তার নামের লেজে আমাদের মতো ছোকরাদের ‘ভাই’ সংযুক্ত করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নাই।
তার নতুন আইডিয়া খোঁজার কায়দা অভিনব—কোথাও কিছু খুঁজে না পেলে বাথরুমে গিয়া ঢোকেন। জগতের নির্ভেজাল নির্জনতম সে কুঠুরিতে বসে নিজের মগজ হাতড়ান। আর কী আশ্চর্য! অভিনব না হোক, তরতাজা না হোক কিন্তু দু-একটা নতুন আইডিয়া ঠিকই হাতের মুঠোয় নিয়া বার হন।
আমি তাই জগৎ-সংসার থেকে আলাদা হয়ে একান্তে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সে কক্ষে গিয়া বসি। ঘণ্টাখানেক ধরে মগজে মুগুর চালাই। ছেঁচে ছাতু করে ফেলি। কিন্তু নতুন আইডিয়া বার হওয়া তো দূরের কথা, বরং পুরানাগুলাও যেন কোথায় হাওয়া হয়ে যায়। মনোজগৎ থেকে যেন দূরে দূরে পালায়। মস্তিষ্কটা তখন শূন্যে হা হা করে ওঠে। অস্থির পায়ে আবার নির্জনতম কক্ষ থেকে বার হয়ে আসি।
রাতে খেতে বসলে মার নজরে পড়ে—তোর আইজ কী হইছে অ্যাঁ? বাসায় ফেরার পর থাইকা দ্যাখছি মাথায় বোঝাই বস্তা নিয়া আছিস।
—অফিসের একটা কাজ...।
—বুঝি না, কী চাকরি করিস, তার বোঝা বাসায় আইসাও বইয়া বেড়াইতে হয়।
আপুও খোঁচা দিতে ছাড়ে না—কই, আমরাও তো অফিসে কাজ করি। আমাদের তো কোনো বোঝা বাসায় বইতে হয় না।...এগুলা হইলো হবু বুদ্ধিজীবী হবার ভান।
জানি, এই সব খোঁচা-বিদ্রূপের জবাব একটাই—নতুন ও অভিনব একটা আইডিয়া জেনারেট করে প্রমোশনটা বাগায়ে নিয়া আপুর মুখের উপর ছুড়ে দেয়া—দ্যাখ, সাত বছরে একটাও পাও নাই। আর দুবছরের মাথাতেই আমারটা হাজির। কিন্তু তার জন্য দরকার যে মহার্ঘ আইডিয়া, তা জোগাড় করতে না পেরে নিচু মাথায় চুপচাপের ঘরে বসে খোঁচা-বিদ্রূপ হজম করে নিজের রুমে আবার ফিরে আসি।
আবার কম্পিউটার খুলব? গুগল-ইউটিউবে ঘুরব? কিন্তু যে পাখি সন্ধ্যা থেকে এতটা রাত অবধি ধরা দেয়নি, সে কি আর ধরা দেবে? আমার মনের আকাশে এতটুকু উঁকি মারবে?
মনে হয় না, সে বরং ছয়টা অ্যাড ফার্মের ক্রিয়েটিভ টিমে গড়ে পাঁচজন করে হলে ত্রিশজনের আর কারো খাঁচায় গিয়া ঢুকবে। তার টেবিলে প্রমোশনের চিঠি স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে হাজির হবে। আমি তাই আর কম্পিউটারের কালো মুখে আলো আমদানি করি না।
মার্কেজ, ‘শতবর্ষের নির্জনতা’ লিখে দুনিয়াজুড়ে হইচই ফেলে দেয়া কলাম্বিয়ার কথাকার, তার লেখা আগাগোড়া গল্পে ঠাসা একটা বই মাস দুয়েক আগে কেনার পর থেকেই টেবিলের হাওলায়, তার বুকের উপর পড়ে আছে। এত দিনে তার দুপাতায় দুকদমও ফেলা হয় নাই। কাগজপত্রের সাথে জড়াজড়ি ধরে শুয়ে থাকা বইটা হাতে তুলে নেই। কেননা রাতে ঘুমানোর আগে শুয়ে শুয়ে দুপাতা গল্প-উপন্যাস পড়া, আমাদের বাংলা সিনেমা মতে নাইটগাউন পরা চৌধুরী সাহেবদের কেতা হলেও আমরা সে বংশের না হয়েও তাতে কাবু। তাই বইটা নিয়ে শুয়ে পড়ি।
রাত তখন বারোটার ঘর পাড়ি দেয়া সারা। বাসার সবাই ঘুমোতে যাবার পথে। শুয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ নিজের অজান্তেই যেন চেঁচিয়ে উঠি—‘ইউরেকা! ইউরেকা!! পেয়ে গ্যাছি! পেয়ে গ্যাছি।’ তারপর উৎসাহ উত্তেজনায় একেবারে বিছানায় উঠে বসি।
সাথে সাথে ওঘর থেকে যাদের কেয়ারে-যত্নে এই আমি সে-ই তারা—আম্মু ও আপু ছুটে আসে, ‘কী হইছে? কী পাইছিস?’
রুমের দরজায় তাদের দেখে আমার হুঁশ হয়—বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কেননা বেভুলো বিজ্ঞানী আর্কেমিডিস একটা সূত্র, দুনিয়া কাঁপানো তত্ত্ব পেয়ে এমন চিৎকার করে উঠেছিলেন। নগ্ন দেহে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেছিলেন। আর আমি কিনা সামান্য একটা আইডিয়া, জনসভায় লোক জড়ো করার ফন্দি-ফিকির খুঁজে পেয়ে এমন চিৎকার জুড়ে দিয়েছি। হায় কপাল! নাকি আমার মুখের এতটুকু ধ্বনি, গলা থেকে বার হওয়া স্ফূট স্বররে গভীর রাত তার হাতের মুঠোয় পুরে ইচ্ছামতো ভয়াবহ করে তুলে আম্মু-আপুর কানে পৌঁছে দিছে? তাই তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছুটে আসছে।
সে হিসাব না হয় পরে করা যাবে কিন্তু এখন তাদের কী জবাব দেই? কী কথায় বুঝ দিয়া ফেরত পাঠাই? তাদের কি বলব আসল ঘটনা, মেয়ে মানুষ ব্যবহার করে জনসভায় লোক সমাগম করার আইডিয়া খুঁজে পাওয়ার কাহিনি? না, একজন বিধবা আরেকজন ডিভোর্সিকে সেকথা বলা যায় না। তাই ‘না কিছু না’ বলে চুপচাপের ঘরে বসত নিয়া নিশ্চুপ হয়ে আবার শুয়ে পড়ি। হাতে ধরা বইয়ের প্রতি মনোযোগী হবার ভানে মগ্ন হই।
শেষে তারা ধৈর্যের আর কষ্ট না দিয়া তাদের কাছে আমার আদি ও অকৃত্রিম পরিচয় ‘পাগল ছেলে’ তা আরেকবার আমারে স্মরণ করায়ে দিয়া নিজেরাই চলে যায়। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। বিছানা থেকে নেমে এবার দরজা বন্ধ করে দেই। শুয়ে পড়ে আবার মার্কেজের বইটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরি।
কিন্তু কিশোর যেমন সদ্য গজানো দাড়ি-গোঁফ কৌতূহলে বারবার দেখে, দুপাতার পরই আমিও তেমনি এইমাত্র পাওয়া আইডিয়া পানে ফিরি। তারে নেড়েচেড়ে, উল্টেপাল্টে দেখি। হ্যাঁ, তার চেহারা-সুরত ভালোই মনে হয়। রূপ-যৌবনও যথাযথ আর দেহ-কাঠামো সুবিধামতো মজবুত। মাশাল্লাহ। কিন্তু নারী দেখিয়ে পুরুষদের প্রলুব্ধ করা, তাদের দিয়া কাজ হাসিল করে নেয়া সে তো আদি ও অকৃত্রিম প্রথা। বাংলা-হিন্দি তো বটেই, এমনকি ইংরেজি সিনেমায়ও তার নজির ভূরি ভূরি। তাহলে আইডিয়াটার অভিনবত্ব কোথায়, নতুনত্ব কতখানি? তা দেখা জরুরি। কেননা, তা না হলে তো আমাদের রাঘব-বোয়াল ক্লাইন্ট পছন্দ করবে না। আমাদের বুভুক্ষু ফার্ম ব্লাঙ্ক চেক পাবে না আর অভাগা আমার কপালেও জুটবে না সাধের প্রমোশন। তাহলে অভিনবত্ব কিংবা নতুনত্ব মাপার উপায়? কারও কাছে বললে কি হবে? তার কাছে আগাগোড়া মেলে ধরলে কি বোঝা যাবে নতুনত্ব আছে কি না, অভিনবত্ব কতখানি?
হতে পারে। কিন্তু কাকে বলি, কার কাছে তুলে ধরি? এক আছে সাদেকভাই, আমাদের ইমিডিয়েট বস। তাকে বলা যায়। কেননা সারা দুনিয়ার সব আইডিয়া তার মুখস্থ। আমারটার একটু কোনাকাঞ্চি তার কাছে তুলে ধরলেই তার অন্তর-বাহির সব বুঝে নিতে পারবেন। বলে দিতে পারবেন অভিনবত্বের পরিমাপ, নতুনত্বের পরিমাণ। কিন্তু তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা একটু মুশকিল। কেননা দেখা যাবে পুরো আইডিয়াটাই সে গ্যাপ করে দিছে, দু-একটা ডানা বার করে নিজের বলে চালিয়ে প্রমোশনটা নিজেই বাগায়ে নিছে। বস মানুষ, তখন তারে আমার আর কিছু বলার উপায় থাকবে না।
আর আছে ইভানা, আমার বছর দুয়েকের প্রেম। তাকে বলা যায়। কেননা আগেও বিভিন্ন ক্লাইন্টের অ্যাডের দুএকটা আইডিয়া তার কাছে শেয়ার করছি। তখন তার কোনো ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে ধরিয়ে দিছে। এখানে ওখানে একটু-আধটু সংযোজন-বিয়োজন করতে বলেছে। সুতরাং নতুন আইডিয়া সম্পর্কে তার ধ্যান-ধারণা আছে। তাহলে তাকেই বলি পুরো আইডিয়াটার আগাগোড়া।
এখন রাত ক’টা? দুটোর কাছাকাছি। এখনো কি সে সজাগ আছে? থাকতে পারে। কারণ, উইক্যান্ডের রাত, কাল অফিস ছুটি, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নাই। তাহলে এখনই তারে কাল দেখা করার কথা বলে রাখি। তাই মেসেজ করি—‘কাল বিকালে সংসদ ভবনের সামনে আসো।’
ওমা! সাথে সাথেই দেখি রিপ্লাই—‘ওকে, ঠিক পাঁচটায়।’ জবাবে কেবল গোটা চারেক লাভ ইমো পাঠায়ে খোশ দিলে নিশ্চিন্তে ঘুমের পথ ধরি।
পরদিন যথাসময়ের দু-দশ মিনিট আগেই সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর উত্তর পাড়ে গিয়া দেখি, ছুটির দিন তাই তার এমাথা-ওমাথাজুড়ে লম্বা বিচে বিনোদনপ্রেমী লোকজনে সয়লাব। বেশির ভাগই কপোত-কপোতি, তবে একটা-দুটো বাচ্চাকাচ্চাঅলা সুখী ফ্যামিলির বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠার মতো দম্পতিও আছে অনেক। ইভানা আসে আরও মিনিটি দশেক পর। তারে নিয়া গাছগাছড়ার তলায় কিছুটা নিরিবিলিতে বসতেই সে তার অফিসের গল্প জুড়ে দেয়—‘জানো, কাল কী হইছে? লাবণীর কথা তো তোমারে আগেও বলেছি। দারুণ সুন্দরী, চমৎকার ফিগার। সে কাল বসের কাছে একটা নতুন প্রপোজাল নিয়া যায়। বস তার আগাগোড়া না পড়েই লাবণীর দিকে তাকায়ে তাকায়ে তা অ্যাপ্রুভ করে দেয়। পাতার পর পাতায় সিগনেচার করে। তার ভেতরে একটা পাতায় লাবণীর প্রমোশনের কাগজও ছিল। তাতেও বসের সিগনেচার হয়ে যায়। ব্যস, এখন এক বছরেই লাবণীর দুই দুইটা প্রমোশন আর ঠেকায় কে...।’
ইভানার মুখে তার ভাষায় পুরুষ বসরে নাকানিচুবানি খাওয়াইয়া নারীর প্রমোশন বাগায়ে নেয়ার আগাগোড়া কাহিনি শুনে আমার মনে পড়ে—আরে! ইভানা তো নিজেরে একজন পাক্কা নারীবাদী মনে করে। তার মন্ত্রে দীক্ষিত বইলা তর্জনী তুইলা বক্তৃতা দেয়। তাই সেক্সে নারীদের নিচে থাকার বিষয়টার প্রতি তার বিপুল বিদ্বেষ। ফলে বন্ধুবান্ধবের বাসায় আমাদের যে কয়বার সেক্স হইছে, তার প্রতিবারই সে নিজেরে উপরে তুইলা নিছে। পুরুষরে চিপে-পিষে একাকার কইরা ছাড়ছে।
এখন আমার আইডিয়াটা কি তার মতো পাকাপাকি নারীবাদীর কাছে বলা, নারীর শরীর দেখিয়ে জনসভায় লোকসমাগম করার প্ল্যান তার কাছে খোলাসা করা কি ঠিক হবে? এ নিয়া তাই শঙ্কায় হাবুডুব খাই। কয়েকবার মুখে এনেও তা খুলি না। এ ফাঁকে ইভানা তার অফিসের গল্প চালিয়ে যায়—‘আগামী সেশনে আমারে প্রমোশন না দিলে বসের বিরুদ্ধে যথারীতি হয়রানির অভিযোগ ঠুকে দেব। তখন বুঝবে মজা...।’
কিন্তু আমার আইডিয়াটার একটা যাচাই দরকার। তার অভিনবত্ব ও নতুনত্ব পরখ করা জরুরি। তাই অনেকটা মরিয়া হয়ে মুখ খুলি—‘শোনো, আমারও একটা প্রমোশনের চান্স সামনে। বস বলছে নতুন একটা আইডিয়া, জনসভায় লোক আনার প্ল্যান তৈরি করে দিতে পারলে তা দিয়া দেবে। কাল রাতে সেটা বানাইছি। শোনো, ক্যামন হইছে...।’
আমি মুখ খোলায় ইভানার কথা বন্ধ হয়ে যায়। সে বরং গভীর মনোযোগের সাথে আমার আইডিয়া শোনে। নিজে একটা কথাও বলে না। এমনকি দু-একবার হাঁ হু-এর পথেও নামে না। কেবল আমার দিকে বারকয়েক তাকায়, চেহারার চারদিকে চৌহদ্দি এঁকে তা পাঠ করে। তাতে কী পায় জানি না, তবে আমার আইডিয়ার পুরাটা, এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত বলা শেষ হতেই আগে থেকে বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ এসে পড়া ঘূর্ণিঝড়ের মতো সে আমার ওপর চাড়াও হয়—‘তুমি নারীর শরীর দেখাইয়্যা পুরুষ ধরার আইডিয়া বানাইছো, প্ল্যান ফাঁদছো, তুমি একটা আস্তো পুরুষতন্ত্র, তোমাদের মন এত নীচ, এত হীন। তোমাদের সাথে কথা বলতে ঘৃণা হয়, সম্পর্ক রাখতে লজ্জা লাগে...।’
কথা আধপথে শেষ করে সে আমার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায়, আমারে কিছু বলার, এতটুকু মুখ খোলার সুযোগ না দিয়া পুবমুখে তার বাসার দিকে হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করে।
আমি আমার আম, ইভানার সাথে এত বছরের সম্পর্ক ও ছালা, নতুন বানানো আইডিয়া হারিয়ে হতভম্বের মতো তার চলে যাবার পথপানে তাকায়ে থাকি।
তিন
বাসায় ফিরে পুরাটা রাতই কাটে ইভানার সাথে এত বছরের সম্পর্কের ব্রেকআপ সামাল দিতে। ফলে অন্য আর কিছুর দিকে আর মনোযোগ দেবার সুযোগ হয় না। কিন্তু আমাদের স্বল্পপাল্লার, একদিনের উইক্যান্ড শুক্রবারেই লেজ গুটায়ে নিলে পরদিন শনিবার সকাল সকাল ঠিকঠিকই অফিসে হাজিরা দিতে হয়। নিজের সেকশনে ঢুকে দেখি ক্রিয়েটিভ টিমের সবার হাতে হাতে তরতাজা আইডিয়া। তা নিয়া তাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার জোয়ার। যেন নিজ নিজ আইডিয়াটাই সবার সেরা ও অদ্ভুত অভিনব। ফলে তারটাই ক্লাইন্ট পছন্দ করবে আর তার টেবিলেই ছুটে আসবে পরিপুষ্ট প্রমোশন।
আইডিয়াগুলো আবার কাগজে অবয়ব দেয়া। কম্পিউটারে সুন্দর করে কম্পোজ করা। তার সাথে ছকে এঁকে, গ্রাফিক ডিজাইন করে তার রূপযৌবন ফুটিয়ে তোলা। একেবারে সাজানো কনের মতো একেকটার চেহারা দেয়া।
আমার আইডিয়ার কী হবে? সে তো ইভানার লাথি-গুঁতা খাওয়া, তার কাছে প্রত্যাখ্যানের শিকার হওয়া। সুতরাং তারে কি এখন আর কারও পাতে তোলা, কারও কাছে পেশ করা ঠিক হবে? তা না হলে তো নতুন একটা খুঁজতে হয়।
কে না জানে, আইডিয়া এক অচিন পাখি। সে কখনো দুচার ঘণ্টায়ও ধরা দেয় না, দু-চারদিন লাগায়। আবার কখনো মুহূর্তেই হাতের মুঠোয় এসে হাজির হয়। মস্তিষ্কে বাসা বাঁধে। সুতরাং সেদিন রাতে হাজারো ক্লিকে যা পাইনি এখন তা দুচার ক্লিকেই মিলে যেতে পারে।
আমি তাই তড়িঘড়ি কম্পিউটার খুলি, তার কালো মুখে আলোর আমদানি করি। গুগল-ইউটিউবে ঢুঁ মারার উদ্যোগ নেই। কিন্তু তাতে বরফ গলা ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেন খোদ সাদেকভাই। কেননা ইউটিউব-গুগলের দরজায় পা দেবার, তাদের মুখের ওপর কাটশার্টটা নেবার আগেই তিনি সমন পাঠান—সবাই আমার রুমে আসো।
ব্যস, সবকিছু ফেলে রেখে ক্রিয়েটিভ টিমের পাঁচ আসামিকে সাথে সাথে তার টেবিলের সামনে হাজির হতে হয়। তিনিও যেন ওত পেতে ছিলেন। আমরা বসতেই তিনি হাত বাড়ায়ে দেন—‘একদম সময় নাই। ক্লাইন্ট সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছেন। বার তিনেক ফোন দেয়া হয়ে গেছে। দাও, কে কী আইডিয়া বানাইছ।’
পরীক্ষা শেষে খাতা জমা দেবার মতো করে সবাই নিজ নিজ আইডিয়ার ফাইল জমা দেয়। সাদেকভাই একটার পর একটায় চোখ বোলান। সাবইরে পড়ে শোনান। তাতে দেখি কোনোটায় নাচ-গানের আসর বসিয়ে, কোনোটায় খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে, আবার কোনোটায় মেলা-প্রদশর্নীর উদ্যোগ নিয়া জনসভায় লোকসমাগমের কাহিনি বয়ান করা।
শেষে সাদেকভাই আমার দিকে ফেরেন—তুমি লিখে আনো নাই? তাহলে এখন আর লেখালেখির সময় নাই। মুখে মুখে বল আমি পয়েন্টগুলো টুকে নিচ্ছি। তাতেই এখন চলবে...।
জানি, এটা বেসরকারি চাকরি, বসের কথায় উঠবস করা কেরানিগিরি। সুতরাং এখন তার কথায় কিছু ভালো হোক কিংবা মন্দ, নতুন কিংবা বস্তাপচা, এমনকি প্রত্যাখ্যান হওয়া কোনো আইডিয়া না বললে চাকরির দেহকাঠামো একেবারে হালকা-পাতলা হয়ে যাবে। দুদিন পর হাওয়ায় ভাসায়ে দেবে, পত্রপাঠ বিদায় বলবে। তাই ইভানার কাছে লাথি-গুঁতা খাওয়া আইডিয়াটার কয়েকটা বেসিক পয়েন্ট বলে বসের রুম থেকে বার হয়ে আসি।
দুপুরে আমাদের লাঞ্চ আওয়ারের আগে আগে অফিসে প্রথমে গুঞ্জন মাথা তোলে। এ সেকশন সে সেকশনে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর বিজয়োল্লাস—পাঁচটা অ্যাড ফার্মরে হারাইয়া দিয়া আমরা জিতে গেছি। রাঘব-বোয়াল ক্লাইন্ট আমাদের আইডিয়া গ্রহণ করেছে।
কারটা নিল? কার ভাগ্যে প্রমোশনের সিকা ছিঁড়বে? তা নিয়া অফিসের সবচেয়ে অভাগা ডিপার্টমেন্ট—আমাদের সেকশন কৌতূহলে নড়েচড়ে ওঠে। কেননা পাঁচজনের পাঁচটা আইডিয়া পাঠানো হইছে। তার মধ্যে কারটার গলায় জুটেছে জয়ের মালা, তা জানতে সবাই সাদেকভাইর রুমের পানে ছোটে। তাকে গিয়া পাকড়ায়। কিন্তু আমার পা চলে না। কারণ, যে লাখি-গুঁতা খাওয়া, কোমরভাঙা আইডিয়া জমা দিছি, তার আর জয়ের সম্ভাবনা কোথায়? তাই আর নড়ি না। নিজের ডেস্কে গ্যাঁট হইয়া বইসা থাকি।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর খোদ সাদেকভাই-ই ছুটে আসেন। আমার পিঠ চাপড়ে দেন—ব্রাভো হে! তুমি তো কামাল করে দিছ। তোমার আইডিয়া ক্লাইন্টের মনে ধরছে। বলছে, সিম্পলের মধ্যে সেরা, একেবারে পারফেক্ট। তাই ইমপ্লিমেন্টের কাজটাও আমাদের দিছেন।
কিন্তু আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলে। এখনো সেখানে আমার শিকড় গাড়া, দাদাজানের ঘর-বসতি মজুত। ফলে তার সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা আমার জানা। তা সামাল দেবে কীভাবে? তারপর ইলেকশনের হাজারো বিধিবিধান? তারা কি জলজ্যান্ত নারী দেহের টোপ ফেলে লোকজন জড়ো করার আয়োজন মেনে নেবে?
— নেবে, নেবে। ক্লাইন্টের সাথে এসব নিয়া ডিটেইলস আলাপ হইছে। সেসবের দায়-দায়িত্ব তার। তারপর সে গভর্নমেন্ট পার্টির ক্যান্ডিডেট। যারা দিনের ভোট আগের রাতেই সাইরা ফালাইতে পারঙ্গম, তাদের পক্ষে কোনো কিছুই আর অসম্ভব নয়। তাই তো আমাদের ইভেন্ট টিম কাজ শুরু করে দিছে। সাজ-সরঞ্জাম জোগাড়, লোকজন ভাড়া করার কাজে নেমে গ্যাছে। সব নিয়া আজকেই ওরা রওনা দেবে। ক্লাইন্টের এলাকায় গিয়া কালকের জনসভা ধরবে।
—তাহলে বস! আমি গিয়া আইডিয়াটা কেমন কাজ করছে, তার ইফেক্টটা দেখতে চাই।
—ওকে, নো প্রবলেম। তুমি এখন আমাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁস। যা চাইবে তা-ই পাবে...। তাহলে কাল সকালেই চলে যাও। তোমার জন্য প্লেনের টিকিট কাটতে বলে দেই।
অফিস শেষ হবার আগেই তাই টিকিট চলে আসে। কিন্তু তা নিয়া বাসায় ফিরে রাতে আর ঘুমাতে পারি না। ভয় দানা বেঁধে ওঠে—আইডিয়া যদি ফেল মারে? জনসভায় লোক না হয়? তাহলে তো খোদ চাকরিটাই লুট হয়ে যাবে। হাতের মুঠোয় আর থাকবে না। তাই রাতভর বিছানায় এপাশ-ওপাশ চলে। শেষে ভোরের দেখা পেলে এয়ারপোর্টে ছুটতে হয়। প্রথম ফ্লাইট ধরে জেলা সদরে গিয়া হাজির হই। সতিনের সন্তানের মতো অযত্ন-অবহেলায় লালিত-পালিত খাঁটি ও নির্ভেজাল মফস্বল শহর। তাতে আমার জন্য বুকড করা হোটেলে কিছু সময় রেস্ট নিয়া ভাড়া করা গাড়িতে ক্লাইন্টের নির্বাচনী এলাকা পানে যাত্রা করি। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল। রাস্তায় গাড়ি ধুঁকে ধুঁকে আগায়।
দেশের এই এলাকায় আগে কখনো আসা হয়নি। এখানকার ভাষাবৈচিত্র্য কিংবা ভূপ্রকৃতি আমার একেবারেই অজানা। তাই গাড়ির জানালা গলে কৌতূহলে দুপাশে তাকাই। দেখি রাস্তার দুধারে প্রচুর গাছপালা। তার স্নেহ-ছায়ায় ঘর-দুয়ার। তাই তা দেয়া মুরগির তলা দিয়া যেমন দু-একটা ডিমের কোনাকাঞ্চি দেখা যায় তেমনি হাজারো গাছগাছড়ার ফাঁকফোকর গলে এখানে সেখানে বাড়িঘরের উঁকি দেয়া টিনের চাল চোখে পড়ে।
আকাঁবাঁকা কোমর দোলানো রাস্তা পাড়ি দিয়া ক্লাইন্টের নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছে তাই দেখি বিকেলের জনসভা শুরু হয়ে গেছে। মঞ্চে দাঁড়ায়ে কেউ একজন জোর গলায় বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে।
আমাকে দেখে আমাদের ইভেন্ট-ইন-চার্জ জামান আগায়ে আসে। তাকে জিজ্ঞেস করি—ওই যে বক্তৃতা দিচ্ছে, এলাকারে একেবারে সোনায় বাঁধাইয়া দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়া যাচ্ছে, উনি কে?
—উনিই তো এ এলাকার গভর্নমেন্ট পার্টির ক্যান্ডিডেট। আমাগো ক্লাইন্ট সিরাজুল আসলাম সাহেব। একটু আগে ডেকে নিয়া বাহবা দিছেন। বলছেন, দারুণ অ্যারেঞ্জমেন্ট হইছে। জনসভা জইমা গ্যাছে। দ্যাখেন তা কী বিশালে রূপ নিছে।
দেখি, নাম না জানা স্রোতোবতী এক নদীর নজর দূরত্বে খোলা জায়গায় জনসভার মাঠ। তার উত্তর দিকে প্রশস্ত মঞ্চের দুই পাশে দুটো অস্থায়ী খুপরি ঘর। দেখলেই বোঝা যায়, অস্থায়ীভাবে আমাদের ইভেন্ট টিমের বানানো। তার সামনে দিয়া শুরু হওয়া দুটো লাইন এঁকেবেঁকে মঞ্চের সামনে দিয়া চলে গিয়া পুরো মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে মঞ্চে দাঁড়ায়ে কিংবা দূর থেকে তাকায়ে দেখলে মনে হয় পুরো মাঠ জনতায় ভরা। লোকে লোকারণ্য হওয়া।
—বাহ! তোমরা তো দারুণভাবে আইডিয়াটা ইমপ্লিমেন্ট করছ।
— হ্যাঁ, ওই খুপরি ঘর দুটোর মধ্যে রেখেছি ঢাকা থেকে নিয়া আসা মেয়ে দুটোকে। তারা দারুণ সুন্দরী। অনেক টাকা দিয়া তাগো ভাড়া করা। তারপর এখানে এসেই চাউর করে দিছি যে, আমাদের সাথে ডানাকাটা পরী আছে। দেখতে হলে, তাদের রূপ-যৌবন চাখতে হলে এই মাঠে আসুন। ব্যস, তাই আজ বিকেল শুরু হতে না হতেই ছেলেবুড়ো সবার লাইন শুরু হয়ে যায়। মাঠ ভইরা ওঠে। বাট, ভাই! এ রকম অ্যাফেকটিভ একেবারে খাপে খাপে কার্যকর আইডিয়া কই পাইলেন?
—কই আর! মার্কেজের গল্পে। সেখানে সরলা এরেন্দিরা নামের এক মেয়েকে মরুভূমির মধ্যে খুপরি ঘর তুলে তাতে বসে দেহবিত্রিু করতে হয়। তখন সে খুপরি ঘরের সামনে তার দেহ ভোগ করতে আসা লোকজনের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। সে গল্প পড়তে পড়তে আইডিয়াটা আসে। মনে হয় সেই জনমানবহীন মরুভূমিতে যদি এত বড় লাইন হতে পারে, তাহলে আমাদের জনাকীর্ণ গ্রাম, জনবসতিতে বিশ্ব রেকর্ড করা গাঁওগুলোতে লাইন নিশ্চয়ই আরও দীর্ঘ হবে, মাঠঘাট ছাড়িয়ে যাবে।
—হ, ভাই একেবারে তাই হইছে। ওই দ্যাখেন, মাঠঘাট ছাড়াইয়্যা আশপাশেও লাইন পাও বাড়াইছে। পুরা এলাকা লোকে লোকারণ্য হইয়া উঠছে।