লোকাল বাসের পৃথিবী
১
তুমি একটা পাহাড়, যেনো বা খুব অনড়। অক্ষয়।
অপরিমেয় ভার। তবু এ রাজধানী
তোমাকে তুলোর মতো উড়ায়!
ধরো, আরামবাগ, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও,
যাত্রাবাড়ী, কিংবা ধানমন্ডি,
ধরো, মালিবাগ, শান্তিবাগ, লালবাগ,
মগবাজার অথবা রায়েরবাজার,
ধরো, সদরঘাট, কিংবা কেরানীগঞ্জ
কিংবা টঙ্গী
বলো, তুমি উড়ে গিয়ে কোথায় পড়োনি!
বলো, তুমি সুস্থিরতা পেয়েছো কোথায়!
অথচ তুমি পাহাড়, অনড়
অথচ স্রোত তোমাকে নুড়ি পাথরের মতো
কোথায় যে গড়িয়ে নেয়!
চলতি বাতাসও তোমাকে ক্ষমা করে না!
উড়ায় যখন যেদিকে ইচ্ছা!
অথচ তুমি পাহাড়, অনড়, অথচ
আত্মনিয়ন্ত্রণহীন তুলো, এই নির্মম বাতাসে!
যেনো তুমি এ নগরীর প্রকৃত কাশফুল!
২
দিনের আলোয় চোখ যেনো তোমার পায় না
খুঁজে কিছু। পকেটে তাকিয়ে দেখো প্রিয় মুখ
বলে কিছু নেই। শুধু পিপাসা রোদন। আর রোদ
কোনো আশ্বাস নয় তাকে দেখার। রাতও নেয়
না আর তোমাকে তার কাছে। স্বপ্ন বোনার সুতো
যেনো ফুরিয়ে গেছে কবে। আর ব্যবহার হওয়া
সুতোগুলো কতো এলোমেলো! যেনো বা মরণ
ফাঁদ হয়ে গেছে কবে! তাতে প্রতি রাতে আরাম
খুঁজতে এসে পাটের ফেঁসোয় যেনো আটকে
যাওয়া আইর মাছ তুমি, বারবার, ছটফট করো!
আর জেলের হাত এগিয়ে আসে, যখন ফুরায়
রাত! তবু দিনের আলো মুছে ফেলে দুঃস্বপ্নের
মুখখানি! দাঁত মাজা, মুখ ধোয়ার সাথে সেই
অনুভুতি ধুয়ে ফেলো তুমি! ছুটে যাও ভূমিহীন
কৃষকের মতো পথে! আগের মতোই অন্যের
জমি কর্ষণে নিরুপায় ব্যস্ত হয়ে পড়ো! ফলে
ওঠে ফের পুষ্পিত দিগন্ত! তাদের কারো গায়েই
তোমার ঘামের চিহ্ন নেই! ফের তুমি ফেরো
রাতের স্বপ্নহীন গুহায়। ডানার ক্লান্তি জানে না
ক্ষমা কাকে বলে—যদি বা আকাশ, এমনই তো হয়!
৩
সহজ হলো না সন্ধ্যা। সহজ হলো না সকাল।
পথ ভাঙো প্রতিদিন। লোকাল বাস। জ্যাম।
ঝাঁকি। রড ধরে ঝুলে থাকো। গরমে ঘামো।
এভাবেই আসা যাওয়া। চার ঘণ্টা প্রতিদিন
হারায় জীবন থেকে। জীবনও হারায় তেজ।
মনে হয়, আর কতো! প্রতিদিন। কিন্তু তোমারই
আয়ুর সমান এই পথ। না-হ। বিকল্প জানো না।
গানের সুর কোন সুদূর পাড়ে, কে জানে! শুধু
হর্ন। অ্যাম্বুলেন্সের কাতর চিৎকার। বুকের
বামপাশে চিন চিন ব্যথা। হাসপাতাল ডাকছে
তোমাকেও। না বলে কয়ে তুমিও নেবে লাল
ধ্বনির নদী হয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে!
কোনো হাসপাতালই নিঃস্ব মানুষকে চেনে না।
অ্যাম্বুলেন্সও না। লোকাল বাসের ভেতর বসে
এসবই ভাবো। সময় গড়ায় তবু। অল্প বেতনের
অফিস না হয় ভাড়া বাসায় একসময় পৌঁছে
যাও। প্রিয় কোনো পথে প্রিয় কোনো জগতে
কখনও পৌঁছাও না তুমি। এভাবেই যায় দিন।
৪
এই যে লোকাল বাস। ঝুলে আছো রড ধরে।
চাকা ঘুরছে হঠাৎ হঠাৎ। ক্লান্তি বলছে,
একটু যদি বসতে পারতাম। কিন্তু আরও
মানুষ উঠছে। একটু বসার আশা ক্ষীণ
হচ্ছে আরও। একটা শিশু মায়ের কোলে
তার স্বরে কাঁদছে। বাসের ভেঁপু তাকে
তীব্র করছে আরও। ঝুলে আছো, যেমন
ঝুলে আছে মলিন মুখ আরও অনেকে।
গরম, ঘাম, ভিড়, আর ভ্যাপসা গন্ধই সঙ্গী
আমাদের। বাসা থেকে অফিস যেনো
নরক থেকে নরকে ফেরা। দুঃস্বপ্নের
রাজধানী ঘিরে আমাদের এই নিয়তিলিপ্ত
চক্কর! কখনও তা ফুরায় না যেনো। বাবার
হাত থেকে পেয়ে শুধু সন্তানের হাতে দিয়ে
যাওয়া, এই চক্কর, এই জীবন, এই নরক!
বিকল্প জানো না, বিকল্প জানি না আমি!
৫
কে না জানে ঝরে পড়া ফল গাছে ফেরে না!
একজন এ কথা বলে হাহাকার করছে খুব।
মোবাইলে কার সঙ্গে, কেন এ কথা বলে
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে আমি জানি না। লোকাল
বাসে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছি। তার কথা
কানে এলো। বাসায় ফেরা আরও অনেক
সময় লেগে যাবে। ক্লান্তি, গরম, ঘাম পার
হয়ে তারপর বিছানায় এলিয়ে পড়া। তার আগে
কোনোরকম গোসল, একমুঠো কোনোরকম
গলা পার করে পেটে ঠেলে দেওয়া। ভাবি
ভুল স্বপ্ন দেখাই নিয়তি আমাদের! বাস
থেকে নেমে পড়ি, ফের এসে গেছি আমার
ভুল স্টেশনে। নেমে মৃদু হেসে ফেলি। কপাল
থেকে ঘাম মুছি। কারণ, ঝরে পড়া ফলের
বুক থেকে তবু গজিয়ে ওঠে শত গাছ—এমন
দৃশ্য যেনো দেখতে পেলাম ফের কল্পনায়!
কাল আমিও কি ফের ঝাঁপিয়ে পড়ব না পথে!
৬
কেন পরিচিত বলে মনে হয় কিছু মানুষ!
না, ঠিক তা নয়। বরং বলা উচিত, তাদের
বিকেল-সঙ্গ ভালো লাগে। কিন্তু আমার
নিরথর্ক ওই আড্ডা হয় না কতোদিন।
ভেবেছি, আজ হবে। আজ জগতের
ছুটি। কিন্তু আমারই ছুটি নেই। অফিস
ডেকে নিয়েছে আগের মতোই। ভেবেছি,
ফেরার পথে আজ ভিড় হবে না। থাকবে
না জ্যাম। তাড়াতাড়ি ফিরবো আজ। কিন্তু
দিন শেষে বস একটু সঙ্গ চায়। বললো,
চলো চা খাই, গল্প করি মুক্ত আকাশের
নিচে। অগত্যা আমি তার সঙ্গে যাই।
বিলম্ব ঘটে যায় ফেরায়। বাসে চড়েও
দেখি আমার কল্পনার উল্টো পথে ছুটছে
পৃথিবীটা। বাস ফাঁকা একটু। কিন্তু তার
চাকা ঠিক ততটা ঘুরছে না। জ্যাম।
একজন কল দিলো, বললো, কোথায়,
আজও কি হবে না দেখা! বললাম, কী
আর করা, ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে!
ভাবি, হয়তো ততক্ষণে আমার পরিচিত
তারাগুলো ঘুমের দেশে ভেসে বেড়াবে।
আমি তাদের সঙ্গ না পেয়ে ক্লান্তির টানে
এলিয়ে দেবো শরীর। বাসে বসে থাকি,
ভাবি, চাকরি, চক্কর নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো
করে ফেলে আমাদের। ভীড়ের ভেতর
দিনরাত একা যাপন, অনিচ্ছায়। পরাধীন
হতে থাকে স্বাধীন মানুষ—আমাদের
এমন জীবনই উপহার দেয় এই রাজধানী!
৭
লোকাল বাস। এখানেই উদ্ধার। ভ্যাপসা গন্ধ।
কী যে ভীড়। চেয়ারক্লথগুলো তেলচিটচিটে ও
কালো। বাইরেও বাতাস নেই। মাস্ক বাঁধা মুখ।
তিষ্টুতে পারছি না। হাঁসফাঁস। হাঁসফাঁস। কী
করি! একের পর এক বাস আসে। ভেতর
একদম ঠাসা। উঠতে পারি না। মনে হয়
পরেরটা আসুক। আসে। সেই একই দশা।
বাধ্য হয়ে একটায় ঠেলেঠুলে উঠে পড়ি।
এখন ঘামের স্নান। শ্বাস পাওয়া কী কঠিন!
কবিতার কথা ভাবার অবসর নেই এই সন্ধ্যায়।
একটি সিট যদি মেলে। ঘামেতেলে ভেজা
চেয়ারক্লথের কথা পলকে ভুলে যাবো। বাসের
জানালার পাশের সিট শুধু ঈর্ষা ছড়ায়।
পরিচ্ছন্ন জামার লোকজন খুঁজি। তাদের
জিগ্যেস করি, কোথায় নামবেন। সিট খালি
হলে যাতে বসতে পারি। চকচকে মানুষগুলো
জানি আমি, চকচকে রাজধানী ছেড়ে খুব
একটা দূরে যায় না। ছেঁড়া, ময়লা, পুরোনো
জামার মানুষগুলো যায়। বাসে যেনো চকচকে
মানুষই নাই। আমার মতো আরেকজন
মজুরের পাশে দাঁড়াতেই বললো, কোথায়
যাবেন। বললাম, বহুদূর। বলিরেখাময়
মুখের বুড়ো মানুষটা বললো, বসেন। সামনে
নেমে যাবো। আমি বসলাম, কৃতজ্ঞতাসহ।
জানালা দিয়ে উঁকি দিলো পুবের আকাশের
চাঁদ। আমাকে লক্ষ্য করে ফিকফিক হেসে
উঠলো। আমি ভাবলাম, চাঁদের আকাশ,
কী পরিচ্ছন্ন, কোথাও জ্যাম নেই। গরমের
রাতেও মনে হয়, আকাশ কী ঠাণ্ডা আর নীল।
৮
আমার পিপাসার জল যেনো কোথাও নেই।
বহুক্ষণ পর বাসে উঠলো শিশুটি। মাথায়
পানির বোতল। অনেক বেশি চাইলো দাম।
মনে হলো, তৃষ্ণা আজ অপরাধ। বাসের
ভীড়ে, ভারী বোঝা মাথায় শিশুটির দুর্দশার
কথা ভাবি না আর! কী সহজে ক্লান্ত মানুষ
আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে! দুটো টাকা বাঁচানোর
কী তাড়া! আমারও মনে কেবল তাড়া, ভাবি
কখন যে পৌঁছাবো আমার ভুল স্টেশনে!
কবিতার কথা ভুলে যেতে হয়। যেতেই তো হবে।
এ জীবন অসহনীয় হলেও, তবু তা কবিতার
মতোই হয়ে উঠবে একদিন। কার কথা
মনে নেই। যে নরকেই পা রাখি, কেন মনে
হয়, আগের নরকটি একটু শীতল ছিলো
হয়তো। শুধু আমি বাধ্য হয়েছি পালাতে।
পালাতে ভালো লাগে না আর। আশাহীন
হয়ে পড়া মানুষ কখনও কি পালাতে পারে!
বাসের চাকাগুলো যতোই ঘুরুক, একই পথে
দিনরাত পাক খায়। যেমন আমিও, এ পথেই!
৯
মাঝরাত। রাস্তা ফাঁকা। জ্যাম নেই। আনন্দ
হচ্ছে। কিন্তু আয়ু তার মুহূর্তমাত্র!
কেননা এই তো আরেকটি লোকাল বাস
তার সামনে এসে বাদ সাধলো। কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে
উঠলো। যাত্রী নিয়ে পালালো। যাত্রীশূন্য
স্টেশনে পড়ে রইলো আমাদের বাস। বাসের
কয়েকটা সিট খালি। স্টেশন এলেই থেমে
থাকে বাস। এগোতে চায় না। যাত্রীরাও
চেঁচিয়ে ওঠে এবার।
একজন পাশে বসে অবিরাম চেঁচিয়ে কথা
বলছে, থামছে না। পারিবারিক কলহ।
এ সংসার অবিশ্বস্ততার নরক, বলছে সে।
আমি যখন ভাবছি, জ্যাম থাকা, না থাকা
দুটোই সমান। তখনই একজন পাশে এসে
ঘাড়ের ওপর দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখি তাকে।
দুটি স্ট্যান্ড পার হতেই বাসের ভেতর আর
একটুও ফাঁকা নেই। একের কাঁধের ওপর
আরেকজন সেঁটে আছে।
মাঝরাতে ফাঁকা বাস আর ফাঁকা রাস্তার দৃশ্য যে
ফুরফুরে মেজাজ উপহার দিতে চেয়েছিলো,
মুহূর্তে উধাও। আমি ঘামতে লাগলাম।
চেচাঁমেচি। বেশি ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের ঝগড়ার
সঙ্গে ফিরে এলো সারাদিনের শ্রমে ক্লান্ত
মানুষের ঘামের গন্ধের তীব্র ঝাঁঝ। শ্বাস ফেলতে
পারছি না। বসন্তের বাতাসে মাঝরাতে একেই
বলে শ্রমিকের ঘরহীন ঘরে ফেরা।
১০
গরমের দিন আসি আসি করছে। তখন কী হবে,
আমি কি জানি না! লোকাল বাসে পৃথিবীতে বসে
গরমের সেসব দিনের কথা ভাবি। মলিন মুখ
যাত্রীদের দিকে তাকাই। চাপা ভাঙা, রঙজ্বলা
শার্ট, ধুলো মাখা চুল, বিধ্বস্ত চাহনি। গরম এলে
তার সঙ্গে যুক্ত হবে চামড়া-জ্বলা আর ঘামের ফোয়ারা।
বসন্ত বাতাস, দেখলাম, বাসের ভেতরে থাকা
এসব মানুষের গায়ে স্বস্তির কোনো চিহ্ন
আঁকতে পারছে না। একজন এই ভীড় আর
চিৎকারের মাঝেও ঘুমিয়ে পড়েছে।
তার স্টেশন কখন পার হয়ে গেছে বাস। জেগে
কেমন অবাক হয়ে আছে, এ কোথায় চলে
এসেছে সে! বসন্ত বাতাসে মাঝরাতে এমনই তো
আমাদের প্রতিদিন এই নির্মম বাড়ি ফেরা!
ফিরতে ফিরতে রাত যেনো ফুরায়, আর ভোরে
আবার ঝাঁপিয়ে পড়া পথে! পথ বৃত্তাকার হলে,
ভাগ্যবন্দি হয়ে যায় পথচারী, যদি সে স্বল্প
আয় আঁকড়ে বেঁচে থাকে নিরুপায় এ দুনিয়ায়!