একজন কিংবদন্তির ‘অভিনয়জীবন আমার’
বাংলাদেশের মঞ্চ কিংবা টিভিপর্দার কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদারকে কে না চেনেন। তাঁর কর্ম দিয়ে নিজের এক স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছেন বাংলার নাট্যজগতে। ২০১৯-এর বইমেলায় প্রথমা থেকে তাঁর অভিনয়জীবন আমার নামে একটি আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশিত হয়েছে, যা বর্তমানে থিয়েটারে/মঞ্চে, টিভিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের পড়া দরকার। জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, একজন শিল্পীর অনুভবকে বোঝার জন্য, কাজের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, অনুরাগ, আত্মোৎসর্গের মাত্রা, শিল্পীর জীবনের বাস্তবতা বোঝার জন্য। এই বইয়ে তিনি পুরো তাঁর অভিনয়জীবনকে তুলে ধরেছেন টুকরো টুকরো স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে। ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে অভিনয়জীবন শুরু করেছেন, বর্তমান সময় পর্যন্ত কাজ করছেন—তারই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও ঘটনার বর্ণনা। পড়লে মনে হয়, যেন তিনি আমাদেরই সামনে বসে খোলামনে বৈঠকি ঢঙে কথাগুলো বলে যাচ্ছেন। শুধু তার একার কথা নয়, বইটি পড়লে আরও কতজনের মুখ ভেসে উঠবে আপনার। তাঁর পরিবার, জীবনসঙ্গী নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, ত্রপা মজুমদার, আবদুল্লাহ আল মামুন, মমতাজউদ্দিন আহমেদ, আতিকুল হক চৌধুরী, সৈয়দ আহসান আলী সিডনী, হুমায়ুন ফরীদিসহ অনেকেই।
ফেরদৌসী মজুমদারের বইটি পড়ে যা আপনাকে আলোড়িত করবে, তা একজন শিল্পীর বিনয়। এত কাজ করার পরও তিনি তাঁর লেখনীতে সেই অহংবোধ কিছুই প্রকাশ করেননি; বরং প্রতিমুহূর্তেই প্রতিটা ভালো কাজের জন্য নির্দেশক, দর্শক, সহকর্মীদের উচ্চে তুলে মূল্যায়ন করেছেন, ধন্যবাদ দিয়েছেন। আর যে কাজটি তার উল্লেখযোগ্য হয়নি অবলীলায়, তিনি সেখানে নিজের অক্ষমতার কথা বলেছেন অবলীলায়। এটা বলতে পারা তাঁর মতো উচ্চাসনে বসা এমন অভিনেত্রীর নিরহংকারের পরিচয় দেয়, যা আমাদের কাজ করার ক্ষেত্রে শেখার আছে
ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে নিজেকে নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন, বারবার নিজেকে ভেঙে নতুন করে সাজিয়েছেন মঞ্চে, টিভিতে, বেতারে। যেখানেই তিনি কাজ করেছেন, নিজেকে রেখেছেন অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। বইয়ে তাঁর জীবনকে তিনি চারটি ভাগে ভাগ করেছেন—প্রারম্ভিকা, মঞ্চের আমি, টেলিভিশনের আমি, অন্যান্য মাধ্যমের আমি। প্রারম্ভিকায় তাঁর পরিবারের কথা বলা আছে, কীভাবে ভাই মুনীর চৌধুরীর হাত ধরে মঞ্চে প্রথম কাজ শুরু করলেন। বাবার কড়া শাসনের আগল ভেঙে পরম নিষ্ঠায়, আদরে, যত্নে অভিনয়কে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন সেই সময়। তাঁর প্রেম ও পরিণয়-জীবনের কথা বলেছেন, কতটা তিনি একরোখা বোঝা যায় যখন পরিবারের, সমাজের, ধর্মের বাধা উপেক্ষা করে রামেন্দু মজুমদারের সাথে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়েছিলেন। বাবা প্রথম দিকে মেনে নেননি এমন সম্পর্ক। কিন্তু তাঁদের ভালোবাসার শক্তিতে শেষ পর্যন্ত জয় করেছিলেন পিতার অন্তর। সে কথা তুলে আনলেন এভাবে, ‘আমার মৃত্যুপথযাত্রী বাবা বিছানায় বসে অধীর অপেক্ষায়। আব্বা তাঁর দুটো শীর্ণ পায়ের ওপর দুজনকে বসালেন। আমার আর ওর মুখে সমানে হাত বোলাচ্ছেন আর অঝোরে কাঁদছেন। আবার হাসছেনও। পুরো অভিব্যক্তিতে ছিল আমাদের দুজনের জন্য আব্বার প্রাণনিংড়ানো আশীর্বাদ। বিফলে যায়নি এ আশীর্বাদ। জীবনসঙ্গী বাছায় আমি ভুল করিনি।’ [পৃ: ২২] সত্যিই তিনি ভুল করেননি। এখনো পরস্পরের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। লিখেছেন—কীভাবে স্বামী-সংসার-সন্তান সামলিয়ে তিনি কাজ করেছেন। পরিবার কতটা সহায়ক ছিল তাঁর কাজের ক্ষেত্রে।
মঞ্চে অভিনয়ের ইতিহাস তাঁর দীর্ঘ। মঞ্চে চরিত্রের বিচিত্রতা তাঁর অভিনয়জীবনকে করেছে সমৃদ্ধ। শওকত ওসমানের লেখা ‘ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা’ নাটক দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে তাঁর অভিনয়জীবন শুরু। তারপর একে একে অভিনয় করেছেন—যোগাযোগ, সুবচন নির্বাসনে, এখনও দুঃসময়, চারিদিকে যুদ্ধ, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, দুই বোন, ওথেলো, ম্যাকবেথ, এখনও ক্রীতদাস, ঘরে-বাইরে, যুদ্ধ এবং যুদ্ধ, তোমরাই, কুরসী, কোকিলারা, দ্যাশের মানুষ, স্পর্ধা, আন্তিগোনে, কৃষ্ণকান্তের উইল, মেরাজ ফকিরের মা, চিঠি, তাহারা তখন, মেহেরজান আরেকবার, গোলাপবাগান, মাধবী, মুক্তি, বারামখানা, মুক্তধারা, কুহকজাল, একা—এইসকল উল্লেখযোগ্য নাটকে। অনেক নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনাও দিয়েছেন। বইটিতে প্রতিটি নাটককে তিনি আলাদা প্যারা দিয়ে দিয়ে তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। সংসার, পড়াশোনা সামলেও একটা নাটকের ভেতর তিনি নিজেকে কীভাবে প্রবেশ করান, স্ক্রিপ্ট আত্মস্থ করা থেকে শুরু করে অভিনয়ের টেকনিকগুলো, কস্টিউম পরিবর্তনের পদ্ধতি, অভিনয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও চুল ব্যবহার কৌশল, চরিত্রের বিচিত্রতা ফুটিয়ে তুলতে একজন অভিনেত্রীর ভাবনাগুলো কেমন করে ছড়িয়ে দিতে হবে—এ সবকিছুই তিনি কথাচ্ছলে, হাসি-আনন্দ-বেদনার স্মৃতিচারণায় বর্ণনা করেছেন, যা পড়তে যেমন উপভোগ্য তেমনি শিক্ষণীয়।
অভিনয়ের একক ছকে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। মঞ্চের বাইরে তিনি টিভি মাধ্যমে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন বেতারে। সেই তুলনায় চলচ্চিত্রে তাঁর কাজ খুব কম। দমকা, দরিয়া পাড়ের দৌলতী, মায়ের অধিকার, মেঘলা আকাশ ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ফেরদৌসী মজুমদারের বইটি পড়ে যা আপনাকে আলোড়িত করবে, তা একজন শিল্পীর বিনয়। এত কাজ করার পরও তিনি তাঁর লেখনীতে সেই অহংবোধ কিছুই প্রকাশ করেননি; বরং প্রতিমুহূর্তেই প্রতিটা ভালো কাজের জন্য নির্দেশক, দর্শক, সহকর্মীদের উচ্চে তুলে মূল্যায়ন করেছেন, ধন্যবাদ দিয়েছেন। আর যে কাজটি তার উল্লেখযোগ্য হয়নি, তিনি সেখানে নিজের অক্ষমতার কথা বলেছেন অবলীলায়। এটা বলতে পারা তাঁর মতো উচ্চাসনে বসা এমন অভিনেত্রীর নিরহংকারের পরিচয় দেয়, যা আমাদের কাজ করার ক্ষেত্রে শেখার আছে।
আমার কাছে আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সেটা তাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। স্বভাবতই মানুষকে জীবনের নানা ধাপ পেরোতে হয়, তরুণ, যৌবন, মধ্য যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য। তাঁর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সময়ের সাথে সাথে তিনি নিজেকে পরিবর্তিত করেছেন, চরিত্র রূপায়নে ভিন্নতা এনেছেন। মনের দ্বান্দ্বিকতা যে আসেনি তা-ও নয়, তবু তাকেও তিনি প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম বলে মেনে নিচ্ছেন অথচ আমরা পাঠকালে অনুভব করতে পারি, আঘাত তাঁর মনেও বেজেছিল গোচরে-অগোচরে। বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘এ অপ্রিয় সত্যটি সবাইকে মানতেই হবে, বয়স নামের শব্দটি আস্তে আস্তে মানুষের জীবনে জাল বিস্তার করতে থাকে। প্রকৃতির নিয়মেই আমরা সেই ২০ বছর আগের রমরমা গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলি’ [পৃ: ৫০]।
তিনি আরও বলছেন, ‘দলীয় নাটকে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত থাকাটাই বড় কথা। ‘এ নাটকে আমি আছি’—এ অনুভূতিটাই মহা স্বস্তির ও শান্তির, তাই যখন মাধবীর মহড়া চলছিল, আমি বাড়িতে বসে অস্থির থাকতাম। ভাবতাম, আমি কিছু করতে পারছি না। আমি সবার সঙ্গে থাকতে পারছি না। তবে কি আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে?’ [পৃ: ৯৯]
ফেরদৌসী মজুমদার © ছবি: ঢাকা অপেরা
কিংবা তিনি অকপটে মনের অনুভূতি ব্যক্ত করছেন, ‘আগে কখনো মনে হয়নি কিন্তু আজকাল মনে হয় জীবনটা বড় ছোট, আহা যৌবন যদি ফিরে আসত! কারণ, যৌবন ছাড়া, চলনশক্তি ছাড়া স্বাভাবিক নিয়মেই আমার সেই শক্তিশালী পুরোনো নাটকগুলো আমি আর করতে পারব না। এটাই চরম ও নির্মম সত্য’ [পৃ: ১১৯]। বড় বুকে বেজেছে আমার এই লাইনগুলো পড়তে গিয়ে। আমাদের জন্য যেন এ নির্মম সত্য!
দীর্ঘ সময় ধরে মঞ্চ ও টেলিভিশনে অগণিত নাটকে তাঁর নানা ধরনের স্মরণীয় চরিত্রচিত্রণ এখনো দর্শকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। মনে পড়ে ‘মুক্তি’ নাটকটি, ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয়ের কথা এখনো আমাদের লোকালয়ে হয়। অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেছেন একুশে পদক, জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা এবং ডেইলি স্টার আজীবন সম্মাননাসহ দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। বাংলা একাডেমি তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক ফেলোশিপ।
কতই না সমৃদ্ধ তাঁর এ জীবন! এই ছোট্ট বইয়ে এ সকল কথা উঠে এসেছে, আশা করি পড়তে খুবই ভালো লাগবে। ভাব প্রকাশের সরলতায় পড়তে কোথাও এতটুকু বাধা পাবেন না। বয়ানে বয়ানে নিজের ইতিহাস দিয়ে যেন আমাদের বলে যাচ্ছেন, শিল্পীজীবনও নিঃশেষ হবে। তিনি বলেন, ‘আস্তে আস্তে এ দেউটিগুলোও নিভে যাবে। তথাকথিত অভিনয় থেমে যাবে। আর কেউই থাকবে না। সেটাই সর্বকালের সবচেয়ে বড় সত্য। কিন্তু থাকল আমার এই বই আর আমার কাজ আর কথা’ [পৃ: ১১৯]।
ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয়জীবন আমার বইটি পাঠকমনে জায়গা করে নেবে তাঁর সাবলীল প্রকাশভঙ্গির কারণে, সরল বয়ানের কারণে। এ ধরনের বই বাংলাদেশে খুব কম লেখা হয়। একজন শিল্পীর ইতিহাস টিকে থাকল এই বইয়ের বদৌলতে। আমরা তরুণ প্রজন্ম চাই এ রকম আরও অনেক শিল্পীর জীবনপাতার গল্পের বই আমাদের হাতে আসুক, আমরা আরও সমৃদ্ধ হই।